পৌলোমী সেনগুপ্ত
দুপুরবেলা রনিদার অফিস আওয়ারের সময় চুপিচুপি তার সাইকেলখানা না বলে চেয়ে নিয়ে মেলার মাঠের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল দু’জনে। ভুচুং আর টনি।
সাইকেল হাতানো ছাড়াও চুপিচুপির আরও একটা কারণ, প্রবল বাধার মুখে পড়ে যাওয়ার ভয়। এই ভরদুপুরে শেষ চৈত্রের চড়া রোদে মাইল চার-পাঁচ রাস্তা ভেঙে মেলার মাঠে যাওয়ার ফন্দি করছে ওরা, সেটি জানতে পারলে রক্ষে রাখবেন মেজোপিসিমা? …অর্থাৎ কিনা ভুচুংয়ের পিসিমা এবং রনি-টুনির মা সুধাময়ী!
হইহই করে ওঠবার সময় তিনি তাঁর নামের মহিমার ধার ধারেন না। রোদে বেরোলেই যেন ওরা মোমের পুতুল হয়ে গিয়ে গলে যাবে! আশ্চর্য।
অথচ ভদ্রেশ্বরের এই জমজমাটি চড়কের মেলাটি ঠিক শেষ চৈত্রের চড়া রোদের সময়ই হবে। তাই হয়ে আসছে বরাবর! আহা। মেলা বসাবার সময় নির্বাচনের ব্যাপারে মেলা কর্তৃপক্ষ যদি একবার সুধাময়ীর সঙ্গে বৈঠকে বসত!
তা হলে আর এমনটি হত না।
তা সে যা হওয়ার, যখন হয়েই আছে। এইসব চুপিচুপি লুকোচুরি ছাড়া গতি কী?
ওঃ, নিজস্ব একটা সাইকেল থাকলে, ওরা রোদ পড়লে বিকেলেও বেরোতে পারত। মেলা তো রাত বারোটা পর্যন্ত চলে। বেশি রাতে আরও রমরমা।
কিন্তু বিকেলটি হলেই সাইকেলের মালিক এসে হাজির হবে না?
হেনস্থার কিছু বাকি থাকবে তখন?
এমনিতেই ওই সাইকেল চড়াটি শিখতেই যা একটু-আধটু চোরাই কারবার করতে হয়েছে, তাতেই কম হেনস্থা হয়নি।
কী করে যে টের পেয়ে যেত রনিদা! প্রমাণ লোপ করবার সবরকম ব্যবস্থা করেও ধরা পড়ে গেছে। তবু শেখাটা হয়ে গেছে।
তবে টনি যতটা চৌখস, ভুচুং ততটা নয়!
তাই সাবধানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সাইকেলকে হাঁটিয়ে-হাঁটিয়ে আমতলা পর্যন্ত এনে, টনি বলল, “এখন আমি চালাই, বুঝলি! ফেরার সময় তোর টার্ন!”
বলেই লাফিয়ে চড়ে বসে বলল, “তুই আমার পেছনে আচ্ছা করে সেঁটে বোস। দেখবি যা একখানা দৌড় মারব! দশ মিনিটে মেলার মাঠে!”
সত্যিই এই রোদের হলকা-লাগা গরম হাওয়ার দাপট ভেদ করে যা সাঁই-সাঁই করে কেটে বেরিয়ে যেতে লাগল টনি, দেখলে তাজ্জব! আহা, ভুচুং কবে এমনটা পারবে?
তবে হ্যাঁ, যদি নিজের এক্তিয়ারে একখানা সাইকেল পাওয়া যায়, তা হলে প্রাণভরে প্র্যাকটিস করতে হবেই নিশ্চয়!
তো সে সুদিন কি আসবে কখনও? এলে কবে? সে আর হয়েছে! ভুচুংয়ের যা ভাগ্য।
ওমা! ভাবতে-ভাবতে দেখে, এসে পড়েছে মেলার মাঠে। এতক্ষণ যে কানে মেলার সেই বিখ্যাত ডুডুং ডুডুং গিজাং গিজাং বাদ্যিটি কানে আসছিল, তা খেয়ালেই আসেনি। সত্যিই টনি একেবারে সাইকেলখানাকে উড়িয়েই নিয়ে এসেছে।
এ বারের মেলার প্রধান তাজ্জব হচ্ছে রোবট মানুষ।
তাঁবুর মধ্যে ঢোকানো আছে। টিকিট কেটে দেখতে হবে। লাইন পড়েছে লম্বা। দু’ টাকা করে টিকিট!
টনি বলে উঠল, “টু মাচ! তাই না ভুচুং? কী সাপ-ব্যাঙ দেখাবে, কে জানে। প্রতিবারই তো দেখা যায় ওই তাঁবুর আড়ালেই যত ফাঁকির কারবার। পাঁচপেয়ে গোরু, তিনঠেঙো মানুষ, ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া কাকাতুয়া, জীবনে শুকোবে না এমন স্বর্গীয় পারিজাত ফুল। আরও কত কী সব। বেশির ভাগই শেষপর্যন্ত ধরা পড়ে, স্রেফ ভাঁওতা ফক্কিকারি। হ্যাঁ, এই খোলা মাঠে যদি কিছু…”
কথা বলতে-বলতে ভিড়ের ঠেলায় বিশাল মাঠটার একেবারে অন্য প্রান্তে এসে পড়ে ওরা। আর সেখানেই দেখে খোলা মাঠেই একটা কিছু হচ্ছে।
একটা লোক ড্রাম পিটিয়ে-পিটিয়ে কী যেন বলে চলেছে, তাকে ঘিরে লোকারণ্য। ভিড়ের পেছন থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবে কান পেতে মন দিয়ে শুনে ঘোষণাটা বোঝা গেল।
গলা ফাটিয়ে হেঁড়ে গলা চিরে যা বলে চলেছে লোকটা, তা হচ্ছে “পঞ্চাশ পয়সা। পঞ্চাশ পয়সা! মাত্র পঞ্চাশটি পয়সার বদলে একটি—দু’ চাকা পক্ষিরাজ ঘরে নিয়ে যান দাদা! মাত্র পঞ্চাশ পয়সা! এই পঞ্চাশ পয়সাতেই আপনার ভাগ্যটিও জেনে ফেলবেন। আসুন… এই যে এখানে!”
“কী ব্যাপার রে টনি? জ্যোতিষী-ট্যোতিষি না কি?” বলল ভুচুং।
টনি বলল, “তাই কি? দেখি তো সামনের লোকদের জিজ্ঞেস করে।”
তা জানা গেল। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে।
মজা দেখে দাঁত বের করে ফিরে আসছেও অনেকে। তাদের কাছ থেকেই ব্যাপার উদ্ধার।
জ্যোতিষী নয়, লটারি।
একখানা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল বেচতে নামিয়েছে লটারি করে। পঞ্চাশ পয়সায় কুপন।
এরাও হিহি করে হেসে বলে, “পঞ্চাশ পয়সায় একখানা সাইকেল! ‘ভাঙা লোহা বিককিরি-ই’ বলে চেঁচালেই হত!”
খেয়াল করল না, তাতে আর ক’ পয়সা হত?
ক্রমেই যেন ওই ড্যালাপাকানো ভিড়ের সঙ্গে ভিড় জমছে! অনেকেই যেন একটা কিছু করছে!
হঠাৎ ড্রাম বাজিয়ে লোকটা ভিড় ঠেলে মাঠের এদিকে এসে চেঁচিয়ে ওঠে, “সেকেন্ড হ্যান্ড বলে— হেলা করবেন না স্যার। আমাদের পক্ষিরাজের এখনও যা কন্ডিশন দেখবেন ফার্স্ট হ্যান্ডের ঠাকুরদা! রংটাই যা একটু চটে গেছে, মেজাজটি চটেনি। ঠিক আছে!”
অনেক লোক অনেক কথা বলছে। তার মাঝখান দিয়ে ওই লটারি কোম্পানির একটা লোক দু’ হাতে দুটো বেশ বড়সড় টিনের কৌটো নাচাতে-নাচাতে লোকের সামনে ধরছে। তাদের ঢাকনির খানিকটা কাটা।
“এই যে দাদু, এই কৌটোয় পঞ্চাশটি পয়সা ফেলুন, আর এইটা থেকে দু’ আঙুলে টিপে ধরে কুপনটি তুলে নিন! … দেখুন! ভাগ্য আপনাকে কী দেয়—জিরো, না স্টার!”
টনি একটু উত্তেজিত হয়ে বলে, “আয় ভুচুং, কিনেই নেওয়া যাক দু’জনে দুটো কুপন। পঞ্চাশটা পয়সা বই তো নয়!”
আসলে ওইটাই ওই লটারি কোম্পানির চৌকস বুদ্ধির কৌশল!
ভাঙা পুরনো জিনিস! তার জন্য নগদ একটা টাকা? লোকে চট করে পকেট থেকে বের করবে না। কিন্তু মাত্র পঞ্চাশটা পয়সা? মজা দেখতেও ভাববে, দেখা যাক!
কিন্তু ওদের তো—তিল কুড়িয়ে তাল।
এই মেলার মাঠে হাজার-দু’ হাজার খানেক লোক হয়েছে। দূর-দূর পাড়া থেকে। অন্য-অন্য গ্রাম থেকেও তো সবাই ভদ্রকালীর চড়কের মেলা দেখতে আসে।
এত ড্রাম পেটা, এত গলাফাটানো, এত বাকচাতুরি কি বিফলে যাবে?
সিকির সিকি লোকও যদি মজা দেখতে এগিয়ে আসে, তাও তো অনেক!
লোকটা কাছাকাছি আসতেই কে একজন হেসে-হেসে বলে উঠল, “ও দাদা, যদি পক্ষিরাজই হয়, আর একদম নতুনের ঠাকুরদা, তা হলে পঞ্চাশ পয়সায় বিকোতে বসা হয়েছে কেন?”
সঙ্গে-সঙ্গে চটপট জবাব, “আর কেন। মালিকের খেয়াল। সাইকেল বাতিল করে হোন্ডা কিনবেন। তাই লটারিতে চড়ানো। যথা লাভ!”
“ভুচুং! আয় কিনেই ফেলি দু’জনে দুটো কুপন।”
“কিন্তু জিনিসটা পাওয়া হবে কখন?”
“তাই তো? পাওয়া যাবে কখন? কী ভাবে?”
তো সেটাও জানা গেল। বিকেল পাঁচটা বাজলেই খেলা শেষ। সঙ্গে-সঙ্গে প্রাপ্তি!
“এই এত-এত কুপনের নম্বর গোনাটা হবে কখন?”।
“আরে, নম্বর গোনাগুনি আবার কী? নম্বর-ফম্বর বলে কিছু নেই। মেলার মাঠে কি রাজ্য লটারি-র নিয়মকানুন? সব কুপনই স্রেফ ফাঁকা সাদা এক টুকরো কাগজমাত্র।…তো সেরকম হাজার-দু’হাজার টুকরোর মধ্যে নাকি একটি টুকরোর ওপর লাল রঙে একটি স্টার আঁকা। সেইটিই যার ভাগ্যে উঠবে, তার লাক খুলে যাবে।”
গ্রাম অঞ্চলের লোকজন সাইকেল খুব ভজে। ছেলের বিয়ে দিতে কনের বাবার কাছ থেকে একখানা সাইকেল চায়! তাই উৎসুক হচ্ছে অনেকেই। তা ছাড়া ওই লোকটার বাক্যবিন্যাস।
“বুঝলেন সার, তারকা চিহ্ন। ওইটিই আপনাকে এনে দেবে পথ চলার একটি পরম সঙ্গী! সাইকেলই হচ্ছে গেরস্ত লোকের মারুতি, অ্যাম্বাসাডর, কনটেসা।”
একটি লোক খ্যা-খ্যা করে হেসে বলে উঠল, “মন বুঝছে কোনও টুকরোর মধ্যেই ওই স্টার-চিহ্ন নাই হে। সবই শূন্য, সাদা!”
কৌটো-নাচানো লোকটা হঠাৎ ভারী গম্ভীর হয়ে বলে ওঠে, “সে সন্দ হয় তো আপনার পয়সা ফেরত নে যান। পঞ্চাশ পয়সা ঠকিয়ে কেউ বড়লোক হবে না !”
হঠাৎ জায়গাটা একটু থমথমে হয়ে গেল। একজনের কথায় অনেকজন লজ্জিত হল। তবে খেয়াল করল না ওর কৌটোয় মাত্র ওই পঞ্চাশটা পয়সাই পড়েছে কি না!
টনি বলল, “ভুচুং, অনেস্ট বলেই মনে হচ্ছে! ওই একগাদার মধ্যে আছেই নিশ্চয় একখানা লালরঙা স্টার মার্কা। কেউ-না-কেউ পেয়েই যাবে। হয়তো তুই-ই পেয়ে যেতে পারিস। যা সাইকেল-সাইকেল করিস!”
টনির মধ্যে বেশ বিশ্বাস-বিশ্বাস ভাব!
যদিও ইতিমধ্যে মাঠ ভরে গেছে ছেঁড়া সাদা কাগজের কুচিতে। এক-একটা জোর হাওয়ায় সেগুলো এককোণে এসে জড়ো হচ্ছে, আবার আর-একটু ঝাপট এসে সেগুলো ওড়াউড়ি করে বেরিয়ে মাঠ ঢেকে ফেলছে।
কারণ সব্বাই ওই ‘কুপন’ নামক ভাঁজ করা একটু সাদা কাগজের টুকরো তুলছে, দেখছে, ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছে। … কেউ-কেউ বলে যাচ্ছে, “আক্কেল সেলামি, পঞ্চাশটা পয়সা দিয়েই গেল!”
ভুচুং সেই দৃশ্যটা তাকিয়ে দেখছিল, এখন টনির কথায় হেসে উঠে বলে, “আমি? তা আর নয়! আমি না হলে আর কে পাবে? যা না একখানি ভাগ্য আমার! আমার জন্ম-তারিখটা ভুলে যাচ্ছিস? মার্চের তেরো তারিখ না! অর্থাৎ আনলাকি থার্টিন!…দেখিস না, আমার ব্যাপারে যা কিছু হতে যায়, সবই গুবলেট-মার্কা হয়ে যায়! জুতো, জামা, ঘড়ি, পেন, কোনটায় নয়? এমনকী, পড়ার জন্য একটা টেবিল-ল্যাম্প-এর আবদার করে ফেলে কী কাণ্ডই হল সেবার, ভাব? অথচ তোর? কোনও ব্যাপারে কিছু গোলমাল হয় না। সব-কিছু এককথায় একদম ঠিকঠাক! যার জন্য তোকে আমি এত হিংসে করি!”
“তুই আমায় হিংসে করিস? হা হা হা।”
“হাসছিস কী? করিই তো! আমার বেলায় সব ‘হত গজ’, আর তোর বেলায়? সব যেন পিচ-ঢালা রাস্তায় রবারের চাকা গড়িয়ে যাওয়া! মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয় কপালটা তোর সঙ্গে বদলে নিই।”
কথাটা ভুচুং একটু কায়দা করে বললেও, ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই ‘সত্যি’। ভুচুংয়ের ভাগ্যটা ওইরকমই গোলমেলে। সারাজীবন (মানে তার এই সাড়ে চোদ্দো বছরের জীবনে) দেখে আসছে, তার জন্য যা কিছু জিনিস কেনা হবে, একবারে হবে না। ‘ঘোরা ফেরা বদল করা’-র ধাক্কায় পড়তেই হবে। জুতো কিনতে যাও? তা যে এবাড়ি থেকে বাবা, মেজকা বা রনিদা, কি ও-বাড়ি থেকে বড়মামা, ছোটমামা, পুঁচকে দাদু, যার সঙ্গেই হোক, আর যে পাড়া থেকে যে দোকান আর যত-যত দোকান ঘুরেই হোক, ঠিক মনের মতনটি জুটবে না। কিছুতেই না!
রঙে পছন্দ তো ফ্যাশনের স্টাইলে নয়। রঙে, গড়নে, ফ্যাশনে সব পছন্দ হল তো—পায়ের মাপে খাপ খেল না। ধস্তাধস্তি করেও না।
শেষপর্যন্ত যেটা নিয়ে যাওয়া হল, সেটা হয়তো শুধু মাপেই মিলল, আর কিছুতে নয়।
শুধু কি জুতোই?
শার্ট, প্যান্ট, পায়জামা, পাঞ্জাবি ইত্যাদি কীসে নয়?
সেটাই দারুণ। পছন্দ হয়ে গেল, মাপে ঠিকও, সেটায় হয়তো পাট খুলতেই কোথাও কিছু-না-কিছু খুঁত বেরোতে দেখা গেল। হয় দাগি, নয় ফুটোফাটা, নয় পোকা-লাগা!
পিস কিনে দর্জি দিয়ে বানাতে গেলেও, নির্ঘাত দর্জির ভুলে জামা স্রেফ অচল। হয়ই এরকম।
এ ছাড়াও সবচেয়ে প্রিয় পোশাকটিই হয়তো কাচতে দিয়ে হারিয়ে গেল লন্ড্রিতে, বেশি গরম ইস্ত্রির চাপের ভাপের দাগ ধরিয়ে দিল।
নতুন গেঞ্জি-পায়জামাদের কাপড়কাচুনি কাজের মেয়েটি সাবানে ভিজিয়ে তার সঙ্গে হয়তো এমন একখানি ছোট্ট খুদে শিশুর কাঁচা রঙের রঙিন জামাটি ঢুকিয়ে দিল যে, সাদা জিনিসটি লাল, কালো, নীল, হলুদ রঙের ছাপে বহুরূপী!
সেই কাঁচা রঙের ছাপটি কিন্তু পাকাপোক্ত হয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রয়ে গেল।
সব বলতে গেলে ফুরোবে না।
আরও আছে।
ভুচুংয়ের পকেট থেকেই পেন, রুমাল, মানিব্যাগ পড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। ভুচুংয়ের বিছানাতেই কালি পড়ে যায়। মানে যত কিছু অঘটন ভুচুংয়ের ব্যাপারেই। …ওই যে টেবিল ল্যাম্প-এর ব্যাপারে? তার একটা সুইচ করাতে গিয়ে বাড়িসুদ্ধু ইলেকট্রিক লাইন জ্বলে গেল। প্রায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাওয়ার অবস্থা!
অথচ বাড়িতে এত লোক, আর কারও ব্যাপারেই এত সব ঘটে না। ঘটলে তো দেখাই যেত!
এই তো হাতের কাছেই টনি! যে নাকি ভুচুংয়ের সঙ্গে কাঁটায়-কাঁটায় এক-বয়সি। একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে আসছে চিরকাল। একই বাড়িতে থাকে। একই হাঁড়ির ভাত খায়, একই ঘরে শোয়, একই চিরুনিতে চুল আঁচড়ায়। একই শিশি থেকে তেল মাখে। একই লন্ড্রিতে দু’জনেরই জামাকাপড় যায়। এবং অসুখটসুখ হলে দু’জনে একই ডাক্তারবাবুর ওষুধ খায়।
অথচ?
ওই তো আগেই বলে ফেলেছে ভুচুং, যার জন্য সে টনিকে হিংসে করে। “তুই বাবা দারুণ লাকি” বলে। ওর কল্পনা হচ্ছে যদি তেমন একখানা জোরালো সাধুসন্ত পেয়ে যাওয়া যেত, যিনি কোনও এক ফু-মন্তরে দু’জনের ভাগ্যটা বদলাবদলি করে দিতে পারবেন। হুঁ ! সে আশা বৃথা।
তার প্রমাণ দ্যাখো ওই একই সাইকেলটি চুরি করে দু’জনে চালাতে শিখল। টনি সাইকেলকে ওড়ায়, আর ভুচুং সাইকেল নিয়ে খোঁড়ায়! তাই না তার এত সাইকেল-সাইকেল বাসনা! যাতে প্রাণভরে প্র্যাকটিস করতে পায়।
কিন্তু বাসনা থাকলেই কি পূর্ণ হয়?
ভুচুংয়ের বিশ্বাস নেই। তাই বলে, “আমি আর পেয়েছি! …ওই আনন্দে থাক। পেলে তুই-ই পাবি।”
“কেউই পাব না রে ভুচুং! এখন ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরতে পারলে হয়! কী যে ঘটছে সেখানে! মা কি আর এতক্ষণে টের না পেয়েছেন?”
“যা বলেছিস! হয়তো দুর্ভাগ্যক্রমে আজই রনিদা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে।”
এই কথাবার্তার সময় ওদিকে ঘণ্টাধ্বনি। …পাঁচটা বাজল। “এবার আমাদের খেলা শেষ। যদি কারও কুপন নেওয়া বাকি থাকে, এক্ষুনি নিয়ে নিন। এই শেষ চান্স।”
কৌটো-নাচানো লোকটা সামনে এসে দাঁড়াল। বলে উঠল, “ঝটপট। ঝটপট। খেলা গুটিয়ে এল।”
তা ওরা খুবই ঝড়ের বেগে পয়সার কৌটোয় পয়সা ফেলে। কুপনের কৌটো থেকে কুপন তুলেই দৌড় দেয় সেই খেলোয়াড়ের দিকে।
ব্যস্তবাগীশ টনি দৌড় মারতেই হাত থেকে ফস করে পড়ে গেল কুপনটা।
ভুচুং পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “এই, তোর টিকিট পড়ে গেল।”
চেঁচিয়েই অবশ্য সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটল ওর পিছু-পিছু।
আর ঠিক সেই মুহুর্তে!
হ্যাঁ, ঠিক সেই মুহূর্তে ভুচুংয়ের চেতনা-চৈতন্য সব কিছুর মধ্যে দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল।
এই তো! এই থেকেই তো ভাগ্য বদলের পরীক্ষা হয়ে যেতে পারে। মানে, ‘ইন কেস’ সত্যিই এই লাস্ট চান্সে সেই ‘লালরঙা স্টার মার্কা’টা কারও হাতে ওঠে? উঠে থাকে তো, সেই ওই লাকি ম্যান টনির হাতেই উঠেছে। শেষ তলানিতেই হয়তো টিনের তলায় পড়ে ছিল সেটা।
তো—এই তো মহা মুহূর্ত!
পরম সুযোগ!
কুড়নো কুপনখানার সঙ্গে নিজের হাতেরটার একটু বদলাবদলি।
তারপর?
তারপর, গল্প হলেও সত্যি!
টনি নিজের হাতের কুপনখানার ভাঁজ খুলেই চোখ ড্যাবা করে চেঁচিয়ে উঠল, “ও মশাই, দেখুন তো, এই আপনাদের সেই স্টার মার্কা কি না?”
তারপর?
হ্যা-হ্যা করে হেসে-হেসে বলল, “তো আপনাদের দু’ পেয়ে পক্ষিরাজের পা দু’খানা নড়ে তো? না স্ট্রেচারে চাপিয়ে নিয়ে যেতে হবে? পরীক্ষা করে দেখতে বলছেন? আচ্ছা।”
আর বলতে-না-বলতেই লাফিয়ে চড়ে বসে আচ্ছা একখানা ছুট। অনেকটা ফাঁকা হয়ে আসা মাঠটায় চক্করের পর চক্কর।
রনির সাইকেলখানা একটা চেনা চায়ের দোকানে জমা রাখা ছিল। সেটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে টনি বলে, “ফেরার সময় তোরই তো দান ছিল। তাই না ভুচুং। তুই-ই ওটায় চেপে বোস। আমি না-হয় তোর সঙ্গে একটু আস্তে-আস্তেই চলি! এখন গিয়ে দেখা যাক বাড়িতে কী মার মার রব উঠছে।”
তা সত্যি উঠেছিল।
রনি এসে সাইকেল হাপিস দেখে আর ওই মানিকজোড়কে কখন থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না জেনে থাপ্পড় বাগিয়েই বসে ছিল।
কিন্তু তারপর?
তারপর দু’খানা সাইকেল আরোহীকে বাড়ি ঢুকতে দেখেই উঁচোনো থাপ্পড় নেমে এল। …আর তারপর? টনির ‘লাক’ নিয়ে পাড়া তোলপাড়। ধন্যি, ধন্যি!
আর তারপর?
তারপর আবার কী?
টনি সেই পঞ্চাশ পয়সার সাইকেলেই পাড়া টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। নির্ভয়ে দাদার নাকের সামনে দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে।
তো ভুচুংকে কি মাঝে-মাঝে অফার করছে না? করছে বইকী! খুবই করছে। কিন্তু ভুচুং সে অফার না নিলে?
তা নেবে কোন মুখে?
বুদ্ধুর মতো, আসল জায়গা থেকে আসা অফারই না বুঝেসুঝে হেলায় ঠেলে ফেলে, সব গুবলেট করে বসল!
৯ জুন ১৯৯৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন