পৌলোমী সেনগুপ্ত
এখন আমি একটা সাধারণ খবরের কাগজের আপিসে কাজ করলেও, এক বছর আগেও একটা সাংঘাতিক গোপনীয় কাজ করতাম। সে কাউকে বলা বারণ। বললে আর দেখতে হত না, প্রাণটা তো বাঁচতই না, তার ওপর সব চাইতে খারাপ কথা হল যে, চাকরিটাও চলে যেত। তবে এটুকু বলতে দোষ নেই যে, কাজটা ছিল খবর সংগ্রহ করা। কোথায়, কেন, কার জন্য সে-সব তোমরাই ভেবে নিয়ো।
আমার বয়স তখন ২২; নামটা আর বললাম না। আমাদের পাড়ার হরিশ খুড়ো চাকরিটা করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম দিনেই আমার বড়-সায়েব— সায়েব হলেও তিনি কুচকুচে কালো—আমাকে বলেছিলেন, “দেখো, সর্বদা ‘নেই’ হয়ে থাকবে। তুমি আদৌ আছ সে-কথা টের পাওয়া গেলে চলবে না। তোমার আলাদা একটা চেহারা, কিংবা চলাফেরা, কিংবা কথা বলার ধরন গজালেই চাকরিটে যাবে। পানাপুকুরে এক ফোঁটা ময়লা জল হয়ে থাকবে; সমুদ্রের ধারে এক কণা বালি হবে; এক কথায় স্রেফ অশরীরী হয়ে যাবে। কথা বললে কী বলছ বোঝা যাবে, কিন্তু আলাদা করে গলার আওয়াজ মালুম দেবে না। আর সব চাইতে বড় কথা হল যে, নিজের চেহারা বলে কিছু রাখতে পাবে না, যাতে তুমি মরে গেলেও তোমাকে শনাক্ত করা না যায়। ও-রকম করে তাকাচ্ছ কেন, এ কিছু শক্ত কাজ নয়, কিছু করতে হবে না, স্রেফ নেই হয়ে থাকতে হবে। বেশি লেখাপড়া জানারও দরকার নেই। বলো, পারবে তো?”
আমি বললাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার।’
বড় সায়েব বেজায় রেগে গেলেন, ‘ফের কথার ওপর কথা! চুপ করে থাকতেও কি শেখাতে হবে নাকি? কী নাম তোমার?’
আমি কোনও উত্তর দিলাম না।
বড় সায়েব খুব খুশি হয়ে বললেন, “খুব ভাল। মাইনে নেবার সময় নাম লিখবে না, টিপ সই দেবে না। নাম ভাঁড়ানো যায়, কিন্তু টিপসই দিয়ে সবাইকে চেনা যায়। দুনিয়ার কোনও দু’জন লোকের এক রকম আঙুলের ছাপ হয় না। ১ তারিখে আমার কাছ থেকে মাইনে নিয়ে যাবে, খাতায় লেখা হবে ‘নষ্টামি বাবদ দুইশো টাকা’। আচ্ছা, যেতে পারো।”
আমি হাতে রুমাল জড়িয়ে তিনটে আঙুল দেখালাম। বড় সায়েব হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, তিনশো টাকাই। কিন্তু মনে থাকে যেন, বিপদে পড়লে আমরা বলব তোমাকে চিনি না।’
ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। শুনলাম আমার নতুন নাম ইংরিজি হরপের ‘কিউ’। যেখানে যত সন্দেহজনক খবর শোনা যেত, নিজে দেখে এসে আপিসে পাশের গলিতে ভাঙা টাইপরাইটার ভাড়া খাটত, তাতে টাইপ করে জমা দিতে হত। তার পরের ছয় মাসে কোথায় যে না গেলাম, কী যে না দেখলাম, তার ঠিক নেই। অথচ আমাকে কেউ দেখতে পেত না। রাস্তার ভিড়ের মধ্যে এক্কেবারে মিলিয়ে যেতাম। যেখানে ভিড় নেই, শুধু ভাঙা দেয়াল, সেই দেয়ালে একটা দাগ হয়ে মিশে থাকতাম। একবার একটা চোরাই গুদোমে সারা দিন শ্রমিকদের একজন হয়ে গিয়ে রাশি রাশি গোপন খবর এনে দিয়েছিলাম। বড় সায়েব খুশি হওয়ায় মাইনে বেড়ে গেছিল। আরেকবার একটা বিদেশি মালজাহাজে সারা দিন একটা পিপে হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার সোনা খুঁজিয়ে পাইয়ে দিলাম। সেই জন্য খবরের কাগজে বড় সায়েবের সে কী প্রশংসা!
সে যাই হোক, শেষবারের কাজটার কাছে ও সব কিছু না। নাকি গড়িয়ার দিকে এতকাল কোনও বে-আইনি কাজ হয়নি, তাইতে সকলের সন্দেহ হল, নিশ্চয় কোনও গোপন ষড়যন্ত্র চলছে। তার ওপর সব বাংলা কাগজে যখন ছোট্ট একটা নোটিস বেরুল—টিপ বোতাম পরিষদের প্রথম সভা গ-শু ৭, তখন আমার বুঝতে বাকি রইল না যে গড়িয়াতে, শুক্রবার, সাতটায় গোপন সভা বসবে।
বড় সায়েবের ঘর থেকে প্রায় অদৃশ্য ভাবে বেরিয়ে যাচ্ছি, তাঁর পেয়ারের বেয়ারা বলল, ‘টিকিট ছাড়া ঢুকতে দেবে না।’
রুমাল জড়িয়ে হাত পাতলাম। সে এক কুচি লাল কাগজ বের করে বলল, ‘দু টাকা।’ একটা আঙুল দেখালাম। তাকে টাকা দিয়ে টিকিট পকেটে ফেলে চলে এলাম।
শুক্রবার পাঁচটায় যখন বাসে সব চাইতে ভিড় হয়, তখন, বেছে বেছে সব চাইতে ভিড়ের বাসে উঠলামা উঠে চারটে লোকের মধ্যিখানে এমন ‘নেই’ হয়ে রইলাম যে, কন্ডাক্টর টিকিট চাইল না। চাইবে কেন, আমার তো আর শরীর-টরীর নেই যে বাসের জায়গা জুড়ে থাকব।
গড়িয়াতে নেমেই একটা চায়ের দোকানে ভিড় দেখে, সটান সেখানে গেলাম। এক ভাঁড় বেজায় হালকা, বেজায় গুড়ের চা নিয়ে, তার ওপর দশ পয়সা ফেলে দিলাম। সস্তা তো হবেই, শুকনো শালপাতা দিয়ে এ সব চা বানাতে হয়, চা পাতা দিলে আর ওই দামে দিতে হত না।
ভাঁড় নিয়ে একটা বাঁশের খুঁটির পিছনে গুম হয়ে গেলাম। ভিড়ের মধ্যে হাসাহাসি হচ্ছিল, ওই শুক্রবার নিয়ে নাকি চারদিন পকেটমার হয়নি। চট করে বুঝে নিলাম সভা তা হলে পকেটমারদের। একটা চিমড়ে লোক চায়ের ভাঁড় শেষ করে, সামনের বাঁশবাগানের দিকে পা বাড়াতেই, বাকি সব হাঁ-হাঁ করে ছুটে এল—‘ও মশাই অমন কাজও করবেন না। ওই বাঁশবাগানের পথ দিয়ে একটি মাত্র জায়গায় যাওয়া যায়, সেটি হল গোরে-বাড়ির ভাঙা কেল্লা, ভূতদের থান! দিনের বেলাতেও ও পথে কেউ যায় না। কাগ-চিল, কুকুর বেড়ালও না।’
লোকটা ভয়ে ভয়ে ইদিক উদিক তাকিয়ে উল্টো দিকে মাঠের পথ ধরল। সকলে হাঁফ ছেড়ে যে যার জায়গায় ফিরে গেল। আমিও সেই সুযোগে ওই লোকটির পিছন পিছন চললাম যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। মাঠ ভেঙে ঘুরে সে আবার বাঁশবাগানের ওপারে, সেই রাস্তাটাই ধরল। আমি তার পিছনে ‘নেই’ হয়ে চললাম। শুকনো পাতার ওপর এতটুকু পায়ের শব্দ হল না, নইলে এত দিন কী শিখলাম!
তার পরেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। সামনেই একটা প্রকাণ্ড ভাঙা কেল্লা। সেখানে পৌঁছে পথটাও শেষ হয়ে গেছে। কেল্লার চুড়োটা শুধু দেখা যাচ্ছে, চারদিকে এমনি ঘন বন হয়ে গেছে যে তার বেশি কিছু ঠাওর হল না। লোকটা একটুও দাঁড়াল না, সটান বনের মধ্যে দিয়ে সেঁধিয়ে গিয়ে, কেল্লার লোহা-বাঁধানো প্রকাণ্ড সদর-দরজায় দাঁড়িয়ে, পাশে ঝোলানো একটা দড়ি ধরে টানতেই দরজা খুলে গেল। আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে সেঁধিয়ে গেলাম, সে কিছু টেরই পেল না।
ঢুকেই একটা প্যাসেজ, তার ও ধারেই মস্ত ঘরে সভা বসেছে, সে কী ভিড় আর কী ভয়ংকর তর্কাতর্কি! ঘরে একটা জানলা নেই, উঁচু ছাদে কয়েকটা ঘুলঘুলি দিয়ে বাতাস আসে, তাও এমন আড়াল করা যে, বাইরে এক বিন্দু আলো যাচ্ছে না। যদিও ঘরে কয়েকটা ডে-লাইট বাতি জ্বলছে, তাতে ঘরের অন্ধকার কাটছে না, ঘুপচি ঘুপচি ভাব, একটা সোঁদা গন্ধ, পায়রার নাকি বাদুড়ের বা অন্য বিকট কিছুর, কে বলতে পারে।
সেই অন্ধকারের সঙ্গে আমি মিশে যেতে যেতে বুঝলাম যে, কেউই আলো চায় না, কারও মুখ চেনা যাচ্ছে না; সকলের একরকম কাপড়চোপড়, চেহারা, ঘাড় গুঁজে বসার আর আড়চোখে চাওয়ার অভ্যাস। এদের সঙ্গে আমার এতটুকু তফাত নেই দেখে, নিশ্চিন্তে অদৃশ্য ভাবে একটা থামে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। দরজার কাছে। বেরুবার পথ ওই একটি, আর সব বন্ধ, হয়তো একশো বছর খোলা হয়নি, খোলা যায় না।
ফ্যাঁশফেঁশে বেড়ালে গলায় যা বলা হচ্ছিল তার কতক কতক বুঝতে পারলাম। এরা ইউনিয়ন করতে চায়, কিন্তু শরদের জ্বালায় কিছু হয়ে উঠছে না। আজকের ওই কুখ্যাত নির্জন জায়গায় কারও অনধিকার প্রবেশের কোনও সম্ভাবনাই নেই—হঠাৎ চমকে উঠলাম। একটা থামের পাশের সব চাইতে অন্ধকার কোণ দিয়ে সর সর করে কেউ ছাদের অস্পষ্টতা থেকে নেমে এসে, আমার থামের ও-পাশে দাড়াল। আমার গা শিউরে উঠল।
বক্তা তাঁর সরু সরু হাত-পা নেড়ে বলে চললেন, ‘সাধারণ নাগরিকদের অধিকার থেকে কেন আমাদের বঞ্চিত করা হবে? জনতা থেকে আমরা অভিন্ন। আলাদা করে চিনুক তো কেউ! বলুক দেখি আমরা কেমন দেখতে, কেমন গলার আওয়াজ! আমাদের—’
আমার গা শিউরে উঠল! আরও গোটা দশেক ছায়া ছায়া মতো এ-কোণ থেকে ও-কোণ থেকে বেরিয়ে এসে, আবছায়াতে মিশে রইল।
বক্তা একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আমাদের একটা আস্তানার দরকার ছিল, এর চাইতে ভাল আস্তানা কোথায় পাওয়া যাবে? আমরাই তো আসল অশরীরী, সকলের চোখের সামনে কাজ করি, কেউ আমাদের দেখতে পায় না। এই ছোট ইটের টুকরো ফেলে আজ এখানে আমাদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা—’
এই অবধি বলে ইটটা হাতে করে তুলেছে, অমনি ঘরে একটা শোরগোল উঠল, ‘না, না, না, না—’, তার পরেই মনে হল ঘরের আনাচ-কানাচ থেকে পঁচিশ-ত্রিশটা ছায়ামূর্তি বক্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি অদৃশ্য ভাবে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বক্তা একটা কোঁক শব্দ করে বসে পড়ল।
হঠাৎ বক্তার পাশে বসা ছুঁচোমুখো একটা লোক গর্জন করে উঠল, ‘নটে! ভজা! কার্তিক! কী, কচ্ছিসটা কী? কই সমঝা!’
সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য ভাব ছেড়ে দিয়ে গোটা পঞ্চাশেক ছোকরা খালি হাতেই মঞ্চের ওপর উঠে পড়ে, ওরে বাবারে, সেই ছায়ামূর্তিগুলোকে পেল্লায় পেটাতে লাগল! সেই ফাঁকে বক্তা উঠে পড়ে দে দৌড়।
আমি এমন পেটনাই জন্মে দেখিনি। আগন্তুকদের আগাপাশতলা ধাঁই-ধড়াক্কা মার! তার মধ্যে কে রব তুলল, ‘ব্যাটারা সব পুলিশের চর, অশরীরী সেজে এয়েচেন! লাগা! লাগা! ভজা দেখছিস কী?’
ভজা বলল, ‘পেছলে যাচ্ছেন যে!’
শেষটা তাদের পৃষ্ঠভঙ্গ দিতেই হল। সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে মঞ্চ থেকে নেমে, স্রেফ জলের স্রোতের মতো ভিড়ের মধ্যে দিয়ে গলে, ঘরের একটি মাত্র দরজা দিয়ে, সব নিমেষের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল। ধন্যি পুলিশের ট্রেনিং!
হয়তো একটু অসাবধান হয়ে পড়েছিলাম। ওই অদ্ভুত ব্যাপার দেখবার জন্য বোধহয় ভিড় থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা হয়ে পড়েছিলাম। কারণ পালাতে পালাতে শেষের লোকটা আমাকে দেখতে পেয়ে একরকম কোল-পাঁজা করে তুলে ধরে বাইরের জঙ্গলের মধ্যে এনে ফেলে বলল, ‘চঁলে চঁল! চঁলে চঁল। দেঁখছিস কী!’
বলে একটা শ্যাওড়া গাছের ডাল বেয়ে উঠে পড়ল। ততক্ষণে ডে-লাইট হাতে নিয়ে নটে ভজারাও দোরগোড়ায় দেখা দিয়েছে। সেই আলোতে দেখলাম, যে লোকটা গাছে চড়ছে, তার গোড়ালি দুটো সামনের দিকে! তক্ষুনি গাছ-গাছড়ার সঙ্গে মিশে গিয়ে মুচ্ছো গেলাম। ওরা বোধহয় আমাকে খুঁজে পায়নি। অবিশ্যি আমি যে আছি, তাও ওরা জানত না। খুঁজবে কাকে?
বড় সায়েবের কাছে আর যাইনি। আজকাল খবরের কাগজের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করি। অবিশ্যি একেবারে ‘নেই’ হয়ে।
মে ১৯৭৭
অলংকরণ: অলক ধর
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন