পৌলোমী সেনগুপ্ত
সকালে উঠেই আজ আবার আরশিটার খোঁজে চৌকির তলায় ঢুকে গেল টুনি। ভাঙা আরশিটা যে তার বড় দরকার। ন’দিদার ভাঙা স্টিলের ট্রাঙ্কে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। আরশিটা তো তার রোজ দরকার হয় না। মাঝে মাঝে সে এই আরশিতে তার মুখ দ্যাখে। তারপর যত্ন করে রেখে দেয়। রেখে দেয় না, লুকিয়ে রাখে বলাই ভাল।
এত বড় সুন্দর বাড়িতে ভাঙা আরশি বেমানান। মামা-মামি পছন্দ করেন না তাকে। দূরছাই করেন। ন’দাদু জোরজার করে তাকে রেখে দিয়েছেন। সে ন’দাদুর চিঠি না পেলে পালিয়ে আসতে সাহস পেত না। সে তো পোড়াকপালি। বাবা উড়নচণ্ডী না খ্যাপা মানুষ, তাও সে আজকাল আর মনে করতে পারে না।
অভাবে-অনটনে বাবার মাথা খারাপও হয়ে যেতে পারে। তবে তার হাত-বদলের জন্য সে আর কাউকে দোষ দেয় না।
কপাল।
অভাবের তাড়নায় বাবা গেলেন, মাও গেলেন। একজন আগুনে, একজন রেলের তলায়। রেলগাড়ি আর আগুন দুটোকেই টুনি বড় ভয় পায়। সে যেখানে যায়, সেখানেই আগুন লাগে।
কোথায় যে রাখল!
এই ঘরটা প্রায় তার নিজের। ন’দাদু আর সে থাকে। পালিয়ে আসার সময় পুঁটলিতে আরশিটা ছিল। ন’দাদুকে রাস্তায় সব খুলে দেখিয়েছে। ভাঙা আরশিটাও। ন’দাদুর এক কথা, “ভাঙা আরশিতে মুখ দেখতে নেই টুনি। অমঙ্গল হয়।”
ন’দাদু জানবেন কী করে আরশিতে সে মাঝে মাঝে তার প্রিয়জনকে দেখতে পায়। কোথা থেকে তারা হাজির হয়, তাও সে জানে না। কখনও উটকো একটা লোককেও দেখতে পায়। আবার কখনও মনে হয় একটি বড় জলাশয়, শানবাঁধানো ঘাটলায় সে বসে আছে। মাঝে মাঝে একটা লোক ঝোপ থেকে উঠে দাঁড়ায়। তাকে দেখেই আবার ঝোপের মধ্যে ডুবে যায়।
প্রিয়জন দেখলে দিনটা ভাল যাবে, সে ভাবে।
পিসির মুখও সে দেখতে পায়। দেখলেই ভাবে দিন ভাল যাবে না। কখন না পিসি-পিসে এসে হাজির হন। কখন না তাঁরা এসে বলেন, “টুনি তো পোড়াকপালি, যেখানে যায় আগুন লাগে। না বলে না কয়ে তুই ফেরার হলি, এত আস্পর্ধা তোর! চল সঙ্গে।”
পিসির সম্পর্কের জোর বেশি। ন’দাদু এখানটাতেই কাহিল। নিজের পিসি পর হয় কী করে! তার ন’দাদু, সম্পর্কে মা’র খুড়োমশাই। জোর কার বেশি! পিসি বলতেই পারেন, “মেয়েটা একটা বানর। তাকে আর আশকারা দেবেন না। সে এল আর রেখে দিলেন, কোনও খবরাখবর নেই! ভাগ্যিস থানা-পুলিশ করিনি!”
এই আতঙ্কে রাতে একটাই প্রশ্ন তার, “ও ন’দাদু, পিসি যদি আসে?”
ন’দাদুর সঙ্গে এক চৌকিতে ঘুমোয়। সে ন’দাদুর পিঠে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে।
“এই টুনি, সরে শো-না।”
“দাদু, পিসি যদি জোর করে নিয়ে যায়!”
“সোজা! আসুক-না। পুলিশের হাতে তুলে দেব।”
“বা রে, পিসির কী দোষ!”
“তোকে বেচে দিতে চায়, দোষ না!”
তা ঠিক। তার সুন্দর মিষ্টি মুখের কদর আছে। সে তো এখনও ভাল করে বড় হয়নি। অখিলের সঙ্গে তাকে নাকি খুব মানাবে। হোক-না দোজবর। শ্যালো চালায় লোকটা। ঘরবাড়ি আছে, গাছপালা আছে, হাঁস-কবুতরও কম না। তা ছাড়া গণ্ডাখানেক আণ্ডাবাচ্চা। গাছের মতো বাড়ছে। সেও না-হয় আর-একটা গাছ হয়ে যেত।
তার পরই তার কেমন ভয় ধরে যায়। গাছ যদি চালান হয়ে যায়, পিসি-পিসের স্বভাব ভাল না। বর্ডার এলাকার মানুষ। বড় হওয়ার আগেই তাকে ঘরছাড়া করতে চান, স্কুলে যেতে দেন না। ভাল জামা-প্যান্টও দেন না, দাসী-বাঁদির মতো খেটে খেতে হয়। পিসের মুদির দোকান সামলাতে হয়। একদিন সে তার আরশি বের করে দেখতেই বুঝল, ঘোর অমঙ্গল। মাসির মুখ আরশিতে। কেবল বলছে, “পালা, পালা।”
সেদিনই সকালে নিমাইমামা হাজির। ছানার কারবারি। বর্ডার এলাকায় এলে চাঁপার মেয়েকে দেখে যান। মা-বাবাকে খেয়েছে, ছিল বড়মাসির কাছে, তাঁকেও রেহাই দেয়নি। বড়মাসি তাকে বুকে করে মানুষ করেছিলেন, সেই বড়মাসিও গেলেন। নিমাইমামা এসে আড়ালে তার হাতে ন’দাদুর চিঠি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “পালা, পালা।”
“ও দাদু?”
“কী!”
“বলো-না, বড়মাসি কেন মরে গেল!”
“বড় হ’। নিজেই বুঝতে পারবি।”
“তুমি মরে যাবে না তো!”
“আমি মরে যাব কেন?”
“না, আমার ভয় করে। কাশিটা তোমার ছাড়ছে না। সকালবেলায় এত কাশলে শরীর দুর্বল হয়ে যায় না! বাসকপাতার রসে কাজ দিচ্ছে না। ফের জলে ভিজলে।”
“শোন দিদি, আমার জন্য ভাবিস না। চাঁপা বেঁচে নেই, নীপাও গেল। ওদের দু’বোনকে কোলেপিঠে মানুষ করেছি। তোর মতো সারাদিন আমার সঙ্গে চোপা করত। জ্বরজ্বালা হলে আমার, তোর মায়ের মাথা গরম। ন’কাকা বিছানা থেকে উঠেছে তো, তোমার একদিন কি আমার একদিন। আসতে- না-আসতেই আমার ওপর তোর মা’র মতো খবরদারি শুরু করলি!”
“মা বুঝি খুব বকত তোমাকে!”
“বকবে না? কাজকাম করি না, বড়দার সংসারে পড়ে থাকি, তোর ন’দিদা, হারু, নাড়ু একপাল আমরা। তোর মা তাড়া না দিলে স্নানে যেতাম না, খেতে বসতাম না। মানুষের তো দিন সমান যায় না দিদি। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। বড়দা না থাকলে আমাদের যে কী হত! সেই বড়দার নাতনির কপালে এই ছিল!”
দিন সমান যায় না, কথাটা সে বোঝে। ন’দাদুর ছেলেরা লায়েক হয়ে কত বড় বাড়ি তৈরি করেছে। তার নিজের মামার এখন সংসার অচল। তার খোঁজও নেয় না। ন’দাদু না থাকলে কী যে হত!
কিন্তু ভাঙা আরশিটা গেল কোথায়! তক্তপোশের নীচ থেকে মাদুর-বালিশ টেনে বের করল। ভাঙা স্টিলের ট্রাঙ্ক টেনে বের করল, সারা ঘর খুঁজেও ভাঙা আরশিটা খুঁজে পেল না। লিপের ধুম জ্বর। রোজ ডাক্তারবাবু দেখে যান। মামির মেজাজ অপ্রসন্ন। তাকে দোতলায় উঠতেই দিচ্ছেন না। গেলেই তাড়া খাচ্ছে।
“এখানে কী! যাও। নীচে যাও। যত সব অলক্ষ্মী এসে বাড়িতে হাজির হয়!”
অলক্ষ্মী বলায় মনটা তার খুব দমে গিয়েছিল। সে ভয়ে আর সিঁড়ি ভাঙেনি। লিপের সঙ্গে কথা না বলতে পারলে, তাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে না পারলে তার যে বড় কষ্ট। সারা সন্ধ্যা মনমরা হয়ে ঘুরেছে। রাতে ভাল করে খেতে পারেনি। মনোর মা তার আর ন’দাদুর ভাত বেড়ে দিয়ে চলে গেছে। সে আর ন’দাদু খেয়েছে। নয়নমামার খেতে বেশ রাত হয়। রাত জেগে পড়াশোনা করলে কে তার জন্য জেগে বসে থাকবে! মামা-মামি দোতলা থেকে নামছেনই না। একতলার ঘরগুলি কেমন খালি খালি লাগছিল। লিপ কী সুন্দর কথা বলে। সে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। তার বই-খাতা ব্যাগ থেকে বের করে দেখিয়েছে। ছবি এঁকে বলেছে, “এই দ্যাখ, আমাদের বাড়ি।”
সারারাত সে ঘুমোতে পারেনি।
ন’দাদু কেবল বলেছেন, “কী রে, তোর কী হয়েছে? কথা বলছিস না। বই খুলে চুপচাপ জানলা দেখছিস। কেউ তোকে কিছু বলেছে? বলতেই পারে। আমার বউমাটি এম এ পাস বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। ওর কথায় কান দিবি না।”
সে কী বলে! সে তো বলতে পারে মামি তাকে অলক্ষ্মী বলেছে। মামি তো মিছে কথা বলেননি। সে তার বাবাকে খেয়েছে, মাকে খেয়েছে, বড়মাসিকে খেয়েছে। পিসিও হয়তো যেত, তার আগেই দোজবরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে রক্ষা পেতে চেয়েছে। লিপের কিছু আবার না হয়। একবার উঁকি দিতেই, “ও টুনিদি ঘরে এসো-না। আমার শিয়রে বোসো-না। জানো আমার খুব জ্বর হয়েছে। জ্বরটা নাকি ভাল না।”
মামি তখন কাছে ছিলেন না। নীচে থাকতে পারেন, কিংবা মামার ঘরে। মামা কলেজে যাননি। মামারও মন খারাপ। একটা তো মেয়ে। সারা বাড়ি দাপাদাপি করে বেড়াত। সে শুয়ে আছে ছোট্ট খাটে। সাদা চাদরে শরীর ঢাকা। জ্বরটা আবার খুব বেড়েছে। ওষুধে ধরছে না।
কী যে হবে!
যদি কিছু হয়ে যায়।
ভাঙা আরশিটা তার দরকার।
যদি কেউ কিছু বলে আরশিতে তাকে সতর্ক করে দেয়।
সে খুব সকালে উঠে ফুল তুলেছে, দূর্বা তুলেছে। পুজোর ঘরের বাসন মেজে রেখেছে। ন’দাদু ঠাকুর-দেবতা নিয়ে আছেন। সিংহাসনে শালগ্রাম শিলা, রাধাগোবিন্দ। পুজোর বাসনকোসন মেলা। তামার টাট, কোষাকুষি, নৈবেদ্যর থালা। আমের পল্লব সে তুলে এনে দেয় মেজোদিদার গাছ থেকে। সে তো সব কাজ পারে। ঠাকুর-দেবতার বাসন আর ক’টা! ন’দাদুর এই একটু কাজ সে করে দেয়। মামির পছন্দ না। কিন্তু ন’দাদু বলে দিয়েছেন, “ঠাকুরঘরের কাজ টুনিই করবে।”
সে ঠাকুর-প্রণাম করার সময় বলেছে, “লিপকে ভাল করে দাও ঠাকুর। আমি আসায় লিপের যদি কিছু হয়ে যায়। লিপকে ঠাকুর কষ্ট দাও কেন। জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। ওর তো কোনও পাপ নেই।”
“ন’দাদু, লিপের জ্বর। আমার কিছু ভাল লাগছে না ন’দাদু। একবার তুমি ওপরে যাও-না। দেখে এসো-না লিপ কী করছে।”
“দেখেছি। জ্বর সেরে যাবে। তোর এত মনখারাপের কী হল। জ্বর হবে না! রোগবালাই মানুষেরই থাকে। ডাক্তার দেখছে। ঠিক ভাল হয়ে যাবে।”
নয়নমামা দাঁত মাজতে মাজতে তার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। সে দরজার আড়ালে সরে বসল। কিন্তু ঠিক দেখে ফেলেছে, নয়নমামা তার ভালমন্দর খোঁজখবর নেয়। মামির ছোটভাই এখানে থেকে কলেজে পড়েন। বাড়িটায় পড়ার খুব চল। ন’দাদুর অনেক পুণ্য।”
পুণ্য না থাকলে, নাড়ুমামা এত বড় কাজ করতে পারেন! ন’দাদুর বড় ছেলে এম এ পাস। ছোট ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, মামিও এম এ পাস। নয়নমামা এখানে আছেন, এম আই টিতে পড়েন। লেখাপড়া ছাড়া বাড়িটার কথা নেই।
“এই টুনি, পড়তে বসলি না! ঘরটা জঙ্গল বানিয়ে বসে আছিস! কত বেলা হল।”
“নয়নমামা, তুমি আমাকে ফের টুনি ডাকছ! বলেছি না আমার নাম শর্বরী। শর্বরী বলে ডাকবে।”
টুনি নামটা তার ঘোর অপছন্দ। তার নাম তো শর্বরী। স্কুলের খাতায় ও তো শর্বরী রায় লেখে। টুনি নামটা কে যে রাখল! মাঝে মাঝে মনে হয়, এই টুনি নামটাই যত পোড়াকপালের হেতু। টুনি বললে সে আজকাল খেপেও যায়। ন’দাদু আর তাকে এখন টুনি বলে ডাকেন না। শর্বরী বলে ডাকেন। শর্বরী ডাকলে তার মনে হয় নামে আর পাপ নেই।
নয়নমামা ফের বললেন, “সকালবেলাতেই টুনি দেখছি খেপে আছে, কী ব্যাপার!”
“তুমি আবার টুনি বলছ। জানো, টুনি নামটা ভাল না।”
“শর্বরী নামটা খুব ভাল বুঝি। শর্বরী মানে কী জানিস?”
“শর্বরী মানে তো রাত্রি।”
“রাত্রি মানে অন্ধকার। ভূত-প্রেত, হায়েনা ঘুরে বেড়ায়। বাদুড় ওড়ে। চোর-ডাকাতের উপদ্রব। নিশাচরদের সাম্রাজ্য।”
এতটা সে ভেবে দেখেনি। রাত্রি যে অন্ধকার, তাও তার মনে হয়নি। ভূত-প্রেত অন্ধকারেরই বাসিন্দা। ইস, সে যে কী করে!
“ঘরের কী ছিরি করে রেখেছিস! সারা ঘরে পা ফেলার জায়গাই রাখিসনি!”
নয়নমামা তো জানেন না, ভাঙা আরশিটা সে খুঁজে পাচ্ছে না। লিপের ধুম জ্বর। আরশিটার কথা ন’দাদু ছাড়া বাড়ির আর কেউ জানে না। নয়নমামাকে বলতেও পারছে না, জানো আমার আরশিটা খুঁজে পাচ্ছি না। বললেই সাতকাহন হয়ে যাবে, কার আরশি, কোথায় পেলি! ভাঙা আয়না দিয়ে কী হয়! বাড়িতে কি আয়নার অভাব আছে!
তা নেই সত্যি। কিন্তু ওটা তো তাকে সব আগাম খবর দেয়। সে পোড়াকপালি বলেই ওটা এত যত্ন করে রেখেছে। পিসি যে তাকে অখিলের কাছে বেচে দেওয়ার মতলবে ছিল, ভাঙা আরশিটা বের করে না দেখলে টেরই পেত না। এখানটায় এলে তাকে বেচে দেওয়ার মতলবে ছিল পিসি, তাও সে বুঝতে পারত না।
সেই আরশিটাই খুঁজে পাচ্ছে না।
তার আরও মনখারাপ হয়ে গেল।
“নয়নমামা, তুমি একবার ওপরে যাবে?”
“কেন রে?”
“লিপ কী করছে দেখে আসবে।”
“তুই দেখে আয়-না।”
“মামিমা রাগ করেন। ওপরে উঠতে বারণ করে দিয়েছেন। লিপকে ছুঁতে বারণ করে দিয়েছেন।”
দিদিটা হিংসুটে, স্বার্থপর, নয়ন ভালই জানে। নিজের আত্মীয়স্বজন ছাড়া দিদি কাউকে পছন্দও করে না। টুনিকে নিয়ে আসায় নানা অশান্তি। চোখের ওপর সহ্যও হয় না। টুনি পড়তে বসলেই দিদির অশান্তি আরও বাড়ে। তার ভগ্নিপতিটি দিদির বোঝা ছাড়া সংসারে কিছু না। দিদি নড়লে তিনি নড়ে ওঠেন।
বাড়ির মেসোমশাই নিরীহ ভাল মানুষ। কিন্তু টুনিকে নিয়ে আসার পর সে বুঝেছে, মানুষটি খুবই দৃঢ়চেতা। অজুহাতেরও অন্ত ছিল না। “টুনি পালিয়ে এসেছে, ওকে রাখা ঠিক হবে না। পিসি অপহরণের মামলা করতে পারে।”
বলেছেন, “মেয়ে তো নয়। বিচ্ছু! এ কী রে বাবা, কোথা থেকে কোথা! এতটা পথ চিনে এল কী করে। বাসে ট্রেনে পায়ে-হাঁটা পথে এতটা রাস্তা কেউ চিনে চলে আসতে পারে! সম্ভব! দুষ্ট আত্মা ভর না করলে পারে!”
তারপর বলেছেন, “বাড়িটা কি অনাথ আশ্রম! এসে উঠলেই হল! খাওয়ায় কে! তিনি কি ভেবেছেন আমাদের রাজার ভাণ্ড আছে!” ভগ্নিপতিটিও কম ঝামেলা করেনি। “থাকবে কোথায়? খাওয়াবে কে?”
মেসোমশাইয়ের সোজা জবাব, “আমার ঘরে থাকবে। আমার সঙ্গে শোবে। রাসু আমার নামে টাকা পাঠায়। দরকার হয় মাটির ঘরটায় গিয়ে থাকব। জমিজমা বেচে দেব। আমাদের দুটো পেট চলে যাবে। ভাগ্যিস, তোমার মা বেঁচে নেই। থাকলে যে তাঁর কত দুর্গতি হত!”
তার পরই বলেছেন, “এই মাটির ঘরটাতেই তোমরা জন্মেছ। বড় হয়েছ। বড়দা না থাকলে, এত যে জমিজমা দেখছ তার কিছুই থাকত না। এত সুন্দর বাড়ি, উঠোনে সাজিরঘরটা বেমানান। দাও ভেঙে। ভাগ্যিস, মাথা পাতিনি। তোমার মা’র স্টিলের ট্রাঙ্কটাও শেষে আমাকে আঁস্তাকুড় থেকে তুলে আনতে হয়েছে। কে করে সব বোঝো না!”
ভগ্নিপতিটি আর উচ্চবাচ্য করেননি। জমির দাম বাড়ছে। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে কেনা জমি সব এখন প্লট করে বিক্রি হচ্ছে। মেসোমশাইয়ের এ সব জমি একশো টাকা বিঘেয় কেনা। এখন জায়গাটা আধা শহর। জমি বেচে দিলে মাথায় হাত। বুঝেছিল টুনিকে হজম করা ছাড়া উপায় নেই। যতটা তড়পে সিঁড়ি ধরে নেমেছিল, ততটাই ম্রিয়মাণ হয়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেছে।
লিপ তো বোঝে না কিছু। দিদি দিদি করে টুনির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। লিপকে টুনি আঁকড়ে ধরেছিল, শেষ অবলম্বনের মতো। তার মামির সহ্য হয়নি। এক হ্যাঁচকায় মেয়েটাকে টানতে টানতে সিঁড়ি ধরে ওপরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে গেছেন। নিজের দিদির এই ব্যবহারে নয়নের কেমন মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল।
দিদি পারে না হেন কাজ আছে! টুনির সুন্দর ফ্রকটা কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলল। টুনি স্কুলে গেলেই তার বই হাঁটকানো, ট্রাঙ্ক হাঁটকানোর স্বভাব। স্কুল থেকে ফিরে শুকনো মুড়ি চিবিয়ে খায়। খেতে খেতে দেখল, তার সুন্দর ফ্রকটা ফালা ফালা করে কাটা। ফুঁপিয়ে কান্না, “ন’দাদু, আমার ফ্রকটার দ্যাখো কী অবস্থা!”
ন’দাদু কী আর করেন! কান্না থামানোর জন্য বলল, “কী আছে, আর একটা কিনে দেব।”
পরদিন সবাই অবাক, পার্সেলে এক ডজন প্যান্ট-জামা হাজির। “শর্বরীর জন্য পাঠালাম।” প্রেরকের নাম নেই। আশ্চর্য সুন্দর ফ্রকগুলো টুনি পেয়ে কী খুশি!
ন’দাদু ফ্রকগুলো ট্রাঙ্কে তুলে রেখে তালা দিয়ে দিলেন।
নীল রঙের টাসেল টুনির খুব পছন্দ। মেলা থেকে টাসেল কিনে আনল তার ন’দাদু। টুনি টাসেলে চুল বাঁধল। দেওয়াল-আয়নায় মুখ দেখল। তার খুশির শেষ নেই। সাইকেল চালিয়ে দাদুর তালমিছরি কিনতে বের হয়ে গেল।
“আরে টুনিদি, কোথায় যাচ্ছিস?”
টুনির মাথায় নীল রঙের টাসেল। চুল কী ঘন আর মিহি! বাতাসে তার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে যত দূর যায়, ছোট ছোট ছেলেরা তার পেছন নেয়। টুনির সামান্য সুন্দর টাসেলও দিদি সহ্য করতে পারল না। কেটে তিন-চার টুকরো করে রাখল। আর কী হয়, সকালে আসে ফেরিওয়ালা, রকমারি তার টাসেলের রং। টুনিকে যত দেয় তত সে বলে, “না, না, আমার পয়সা নেই।”
“পয়সা লাগবে না দিদি। পয়সা দিয়ে কি সব হয়! তোমার চুলে আমার টাসেল খুব মানাবে। তুমি পরো-না, দেখি।”
নয়ন তার ঘরে বসেই সব শুনতে পায়। কে টুনির সঙ্গে সাতসকালে কথা বলছে! বের হয়ে দেখল, উঠোনে কেউ নেই। টুনি একা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লাল, নীল, হলুদ রঙের রকমারি টাসেল।
“কে দিল!”
“একটা লোক।”
“কোথায়?”
“দেখছি না। এই তো ছিল।”
টুনির মামি বললেন, “কে দেয় বোঝো না! আমার বাড়িতে এ সব চলবে না।”
ন’দাদুই বলেছিলেন, “যে দেওয়ার সেই ঠিক দেয়।”
কিন্তু মামি মানবেন কেন! “দেয় তো খাওয়ায় না কেন! নিয়ে গেলেই পারে। আমার এখানে মরতে আসা কেন?”
ন’দাদু ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন।
“যার কেউ নেই, তার ভগবান আছেন। কে দেবে আবার! তিনিই পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
মামির চোপা শুরু হয়ে যায়।
“যার এত ভগবান আছে তার এত পরের অন্ন ধ্বংস করা কেন! ভগমানের কাছে চলে গেলেই পারে। এ তো মানুষ না! কোন অপদেবতা ভর করে বাড়ি এসে উঠল, কে জানে!”
মামি সারাদিন চোপা করে বেহদ্দ। কিছুতেই টুনি জব্দ না। একটা ফেলে দিলে দশটা এসে হাজির হয়।
বইয়ের সব পাতা কুচিকুচি করে কাটল। তারপর ঘর থেকে চুপিচুপি সে বের হয়ে গেল।
কিন্তু টুনির সাড়া নেই। বই না থাকলে পড়বে কী করে! ও মা, সকালে টুনি বারান্দায় নতুন বইখাতা নিয়ে পড়তে বসে গেছে।
মামি মহাখাপ্পা। মেয়েটার পোষা ভূত আছে। দাও ওটাকে গুঁড়িয়ে। ভাঙা আরশিটা আড়ালে আছাড় মেরে গুঁড়ো করে ফেলল। তারপর কাগজে তুলে, ফেলে দিয়ে এল জঙ্গলে।
সুতরাং আরশিটা পাবে কোথায় টুনি!
দিন যায়। আর টুনি বাড়ি ফিরেই এ-ঘর সে-ঘর রান্নাঘরের দিকটায়, এবং নয়নমামাকে ডেকে বলল, “ওপরে খুঁজে দেখবে!”
নয়নমামা সিঁড়ি ধরে নেমে আশা করেছিল, টুনি তার আরশিটার কথা বলবে। কিন্তু আশ্চর্য, সে দেখল, টুনি তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“কিছু বলবি?”
“লিপ আমাকে ডাকছে। ওর কাছে আমাকে যেতে দাও-না একবার। আমি লিপকে কোলে নেব না। শুধু দেখে আসব।”
“ভাঙা আরশি দরকার নেই তোর?”
“লিপের জ্বর ছাড়ছে না কেন? আরশি দিয়ে আমি কী করব! লিপের জ্বর কবে ছাড়বে!”
“আর ছাড়ছে! ডাইনি মেয়ে তুই। তুই লিপকে খাবি। সিঁড়ি ধরে উঠলে, তোর ঠ্যাং ভেঙে দেব!” মামি দোতলার রেলিংয়ে চোপা করছে।
সত্যি, লিপের জ্বরটা ছাড়ল না। সুন্দর বাড়িতে লিপ তার দোতলার জানলায় চুপচাপ বসে থাকে। আর হঠাৎ-হঠাৎ ডাকে, “দিদি আমার কাছে এসো। আমার পাশে বোসো।”
ন’দাদু চোখের জল ফেলেন, শেষে সত্যি মেয়েটার কিছু না হয়ে যায়! ডাক্তার-বদ্যি সব শেষ। কত রকমের রক্ত পরীক্ষা, শহরের সদর হাসপাতালে ভর্তি—কিছুই ধরা পড়ে না। লিপ দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ হঠাৎ চিল-চিৎকার দোতলার রেলিংয়ে। মামি চিল্লাচ্ছে, “বাড়ি থেকে বের করে দাও। ওটা একটা অশুভ আত্মা। বিদেয় না হলে লিপের রক্ত শুষে খাবে। আমার কচি বাচ্চাটাকে শেষ করে দেবে।”
বাড়িতে মামা একদিন ওঝা নিয়ে হাজির। টুনি আসায় বাড়িটা যদি দোষ পায়। ন’দাদু কোনও কথা বলেন না। নয়ন খেপে থাকে ভেতরে। আর টুনি বাড়িতে চোরের মতো ঘরের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকে। বসে থাকে আর ভাবে, সে যদি সত্যি মানুষখেকো হয়! মিছে কথাও নয়। বাড়ি থেকে পালাবে। কিন্তু কার কাছে পালাবে! লিপকে ছেড়ে কোথাও যাবে ভাবতেই পারে না। সে এখানে খেতে পায় পরতে পায়, তার আশা লিপ ভাল হয়ে গেলে সিঁড়ি ধরে দিদি দিদি ডাকতে ডাকতে তার কাছে ছুটে আসবে। অবোধ শিশু তো বোঝে না, মামি তাকে অপছন্দ করে।
সকাল থেকেই বাড়িটায় সাফসোফের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মনোর মাকে দিয়ে বালতি বালতি জল ঢালা হচ্ছে। ধূপ-ধুনোর গন্ধ। ধোঁয়ায় ঘরগুলো ভরে গেছে। কুলোয় দশটা প্রদীপ সাজিয়ে মামি বাড়িটা প্রদক্ষিণ করছে। মামার ছোটাছুটির শেষ নেই। ওঝা মানুষটি রুদ্রাক্ষ গলায় কাঁঠালগাছের নীচে একটা ফুলতোলা আসনে বসে আছে। তারই কথামতো কাজ হচ্ছে বাড়িতে। অশুভ আত্মা থেকে বাড়িটাকে রক্ষা করার জন্য সে আদাজল খেয়ে লেগেছে।
“এই আমার পঞ্চমুণ্ডি আসনের মাটি।”
সে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাতের ধুলোতে ফুঁ দিল। সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লেই অপদেবতার রুষ্ট রোষ নষ্ট হয়ে যাবে।
টুনি কিছুই দেখছে না। সে ভাগবে আবার।
তার হাতবদলের কপাল। সে ঘরের ভেতর থেকে বেরই হচ্ছে না।
ন’দাদু গজগজ করছেন, “যত্ত সব বুজরুকি!”
ওঝা মানুষটির তখন হুমকি, “তুমি দেবতা হও, ‘পিচাশ’ হও, যক্ষ-রক্ষ যেই হও, নিস্তার নেই। পালাতে হবেই। পালাবে না, যাবে কোথায়! ফাঁদের নাম গুরুকপালি।”
গুরুকপালির বাঁধন, অষ্ট বন্ধন। ওঝা আগুনে শালবন্দি পাখির পালক ছেড়ে দিল। কালো গোরুর লেজ পোড়াল—লোকজনের ভিড় বাড়ির বাইরে। তারপর সারাদিন মন্ত্রপাঠ চলল ওঝার। সাঁজবেলায় বাড়ির চার কোনায় বেতপাতা, মটকিলার ডাল পুঁতে দিয়ে অন্ধকারে কাঁঠালগাছের নীচে একটা মশাল জ্বালিয়ে বসে রইল। মামি তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বারান্দায় কাঠাখানেক চাল, আনাজপাতি, একশো টাকার একটা নোট রেখে দিল। লিপকে পঞ্চমুণ্ডি আসনের ধুলো মাখানো হল।
অন্ধকার রাত। অমাবস্যা। টুনি জড়সড় হয়ে বসে আছে ঘরের অন্ধকারে। ন’দাদু তার পাশ থেকে নড়ছেন না। বাড়িটাকে অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। কোথায় যে ওঝা লোকটি, বোঝাই যাচ্ছে না! ভুতুড়ে বাড়িতে টুনির কেমন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
আর তখনই ওঝা মানুষটির হাঁক।
“পড়ে গেছে।”
“ঝুলে পড়েছে।”
“যার যার ক্ষেমতা আছে বের হয়ে এসে দেখে যান।”
এই সব চিৎকারে নয়নই প্রথমে ছুটে গেল উঠোনে। মাটির ঘরটার পেছনে দাঁড়িয়ে ওঝা মানুষটি মশাল তুলে নাচছে।
“কে ঝুলছে?”
“এই দেখুন! হারুকর্তারে ডাকেন। মাঠানরে ডাকেন।”
“কোথায়! কী ঝুলছে। কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।”
“ঝুলছে। ডালে ঝুলছে। অন্ধকারে দেখতে পাবেন কী করে?”
ওর বুকটা কেঁপে উঠল। টুনির ওপর যা নির্যাতন চলছে…
সে চিৎকার করে বলল, “আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”
“তা দেখবেন কী করে? অমাবস্যার অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। যার ঝোলার, সে ঠিক ঝুলে পড়ে।”
ন’দাদু দেখছেন, হাতড়াচ্ছেন। ওঝার এক কথা, বাড়িটায় রাতে আলো জ্বলবে না। তিনি অন্ধকারে ডাকছেন, “টুনি, অ টুনি, ভয় পাস না। আমি তো আছি! তুই কোথায়!” হাত বাড়িয়ে টের পেলেন, টুনি নেই।
কে কোথায়, এখন ঠিক করাই মুশকিল। পাড়া-প্রতিবেশীরা বাড়ির ভেতরে ঢুকতে সাহস পায়নি। টুনির মামাকে আগেই ওঝা বলে রেখেছে, “কেউ যেন অঙ্গনে না ঢোকে। ঢুকলে মন্ত্রগুণ থাকবে না। গুরুকপালি বন্ধন টসকে যাবে। অপদেবতার রোষ তখন আরও বেড়ে যাবে। তাকে থামানো কোনও কাপালিকেরও কম্ম নয়।”
নয়ন পড়িমরি করে ছুটে গেল বাড়ির ভেতর। ডাকল, “টুনি, টুনি!” কিন্তু টুনির সাড়া-শব্দ নেই।
গেল বুঝি মেয়েটা!
সে তার ঘরে ঢুকে টর্চ বের করে নিল। তার ভগ্নিপতিটি বারান্দার রেলিং ধরে থরথর করে কাঁপছে। লিপ অন্ধকারে চিৎকার করছে, “দিদি, দিদি, তুমি এসো। আমার পাশে বসবে। আমার ভয় করছে।”
ওঝা মানুষটি গলদঘর্ম হয়ে ছুটে এল উঠোনে। তারপর আছাড় খেয়ে পড়ল। চিৎকার করে বলতে লাগল, “দেবতা, অপদেবতা শেষ। অশুভ আত্মার আর রক্ষা নেই। যাওয়ার সময় কাঁঠালগাছে ঝড় তুলে যাবে। ডাল ভেঙে পড়বে।”
সারা বাড়ি জুড়ে ত্রাস। ন’দাদু অন্ধকারে ডাকছেন, “টুনি টুনি। কোথায় গেলি!”
ন’দাদু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
টুনি ঘরে নেই। টুনি সাড়া দিচ্ছে না। কোথায় গেল! “ও নয়ন, শিগগির এসো।” ঘরে আলো জ্বেলে দেখলেন, নেই। বারান্দার আলো জ্বালতে গেলে কে বাধা দিল। হাত সরিয়ে দিল। তাঁর ঘরের আলোও নিভিয়ে দিল কেউ।
কার কাজ! এ তো সত্যি অশুভ আত্মা! অন্ধকারে ছুটে বেড়াচ্ছে।
‘নয়ন, তুমি কোথায়! আমাকে আলো জ্বালতে দিচ্ছে না।”
নয়ন কাঁঠালগাছের নীচ থেকে সাড়া দিল, “যাই।”
সে কাঁঠালগাছের ডালে খুঁজল কিছু। টর্চ মেরে দেখল শুধু গাছের ডালপাতা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। আর একটা দড়ি ঝুলছে ডালে। মাথায় তার ফসকা গেরো। যাক, টুনির কিছু হয়নি। নয়নের বুকে বল এল। দিদি এত হিংসুটে, টুনিকে শেষ করে দেওয়ার মতলবে আছে! হিংসায় দিদির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। না হলে থানা-পুলিশের কথা ভাববে না!
অবশ্য এতটা ভাবার তার সময়ও ছিল না। বাড়ির ভেতরে বুড়ো মানুষটা তার খোঁজাখুঁজি করছে। উঠোনে ওঝা বসে আছে, বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠ করছে। সে বারান্দায় উঠেই আলো জ্বালতে গেল। দিদির হিসহিস গলা, “নয়ন, আলো জ্বালিস না। আমার লিপ তবে মরে যাবে। ওঝা খেপে যাবে। মন্ত্রগুণ নষ্ট হয়ে যাবে।”
“দিদি তুমি পাগল হয়ে গেছ! লিপের কথাও তোমার মনে নেই। সে কোথায়?”
“নয়ন, আলো জ্বালিস না ভাই। আমার সব যাবে।”
নয়নের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। হিংসা মানুষকে পাগল করে দেয়, তার দিদিকে না দেখলে টের পেত না। সে বারান্দার আলো জ্বেলে দিতেই দেখল ওঝা মানুষটি মাথা দোলাচ্ছে উঠোনে।
“বের করছি মাথা দোলানো!”
সে চিৎকার করে বলল, “এ সব কী হচ্ছে! ডালে দড়ির ফাঁস ঝুলছে কেন? বের হও! ভড়কিবাজি বের করছি।”
নয়নের রুদ্রমূর্তিতে কেমন ভয় পেয়ে গিয়ে ওঝা বলল, “কর্তা আমারে মারবেন না। কাঠার চাল, আনাজপাতি নিতে দিন। টাকাটা নিতে দিন। পায়ে পড়ি। আমি চলে যাচ্ছি।”
আর নয়ন তখন হতভম্ব! কেমন এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে দিদি। তার স্বামী, সন্তান কিছুই মাথায় নেই। সে ওঝার পিছু পিছু ছুটছে।
নয়ন দিদির হাত ধরে টানতে টানতে বারান্দায় এনে তুলল। কোলাপসিবল গেট টেনে তালা লাগিয়ে দিল। দিদি মাথা ঠুকছে। ভগ্নিপতিটি বোকার মতো তাকিয়ে আছে।
টুনি গেল কোথায়? লিপ কোথায়? নয়ন সিঁড়ি ধরে ছুটে দোতলায় উঠে গেল। আর দেখল দেওয়ালের অন্ধকারে কে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“কে? কে?”
“আমি টুনি, নয়নমামা।”
“লিপ কোথায়?”
টুনি কিছু বলছে না।
আলো জ্বালতেই দেখল লিপ টুনির কোলে। টুনি দু’হাতে লিপকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে।
টুনি বলল, “সবাই তো নীচে। অন্ধকারে লিপ ভয় পাবে না! কী করব, ওপরে উঠে লিপকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ডাকলেই সাড়া দিই কী করে। মামি যদি রাগ করে?”
নয়নের চোখ জলে ভরে গেল। লিপ টুনিকে কাছে পেয়ে কী খুশি! আগের মতো ফের চঞ্চল হয়ে পড়েছে। দিদি দিদি করছে। হাত ধরে দিদিকে নিয়ে যাচ্ছে ঘরে। বলছে, “বোসো, বোসো। আমার পাশে বোসো।”
দু’-তিন দিনের মাথায় লিপের জ্বরও ছেড়ে গেল। শুধু তার হিংসুটে মামি এটা ভাল চোখে দেখছে না।
টুনির মধ্যে কিছু একটা আছে। না হলে টুনির জন্য লিপ এত আকর্ষণ বোধ করবে কেন? জ্বরটাই বা দু’দিনের মাথায় ছেড়ে যাবে কেন? কিছু না থাকলে কেউ এত তাড়াতাড়ি লিপকে বশ করতে পারে! বাড়িতে টুনি ছাড়া আর কারও কথা লিপ শোনে না। টুনির সঙ্গে দৌড়-ঝাঁপ না করলে তার ভাত হজম হয় না। টুনিই সব। বাড়িতে আর সবাই যেন ভেসে এসেছে!
শুধু লিপ কেন! নয়নও কম যায় না। সবাইকে বশ করে ফেলেছে পোড়াকপালি মেয়েটা। এই হিংসায় মামির কিছু দিন পরেই ফিটের ব্যামো দেখা দিল। হিংসেয় জ্বলে গেলেই যত্রতত্র ফিট হয়ে পড়ে থাকে মামি। শয়তান মেয়েটাকে কিছুতেই জব্দ করা গেল না!
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন