কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ

পৌলোমী সেনগুপ্ত

কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ

বাঘকে যেমন বাঘের মতো দেখতে হয়, এ-বাঘটা একদম তেমন নয়। মুণ্ডুখানা যেমন তোবড়ানো, তেমনই ঠ্যাং চারটে তেড়াবেঁকা। একটা চোখ এইটুকুনি, আর-একটা এত্তবড়। দুটো কানের একটি গেছে, একটি আছে। মানে, কানকাটা বাঘ। ছি ছি, পাঁচজনের সামনে এ-মুখ বাঘ দেখায় কেমন করে! কেউ দেখলে নিশ্চয়ই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাঘকে রাগাবে:

কান কাটা বেঁটে মোটা তেড়াবেঁকা ঠ্যাং,

বাঘ না, শেয়াল এ যে ঘুমোয় সটান!

যেই রাগাক তাকে তুমি দোষ দিতে পারো না। অবশ্য বাঘ যদি রাগের কথা শুনে সত্যি-সত্যি রেগে যায়, রেগে গাঁক করে কামড়ে তার টুঁটি ধরে লটকে দেয়, তবে অন্য কথা। আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো, এ-বাঘটা রাগতেই জানে না। তুমি যতই হেঁকে হেঁকে বাঘকে হেনস্থা করো, বাঘ রাগবেও না, ডাকবেও না। চাই কী, মুখ খিঁচিয়ে গাঁক করে হাঁকবেও না। যেমন সটান শুয়ে আছে তেমনই শুয়ে থাকবে। আর মাঝে মাঝে একটু জোরে বাতাস বইলে বাঘ গা ঝাড়া দিয়ে ঘুরে ফিরে এ-দিক ও-দিক করবে। বাঘটার বাতাস ছাড়া আর বন্ধুই নেই। সত্যি বলতে কী, বাতাসের দৌলতেই বাঘটা এমন একটা মনের মতো বনের ভেতর নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারছে। আসলে, বাঘটা ঘুম ছাড়া আর কিছু জানে না। তাও কী, চোখ দুটো ড্যাবড্যাব করে চেয়েই ঘুমোবে। বাঘটার খিদেও নেই, তেষ্টাও নেই। কী বাঘ রে বাবা! এমনকী, হাঁটতে হাঁটতে আচমকা তোমার পা-ও যদি তার গায়ে ক্যাঁত করে একটি শট মেরে দেয়, তাতেও বাঘের গ্রাহ্যি নেই। দিব্যি আরামসে নাক ডাকাবে। ভুল হয়ে গেল! এ বাঘের ফুটো ফুটো দুটি নাক আছে ঠিকই, কিন্তু সে-নাক ডাকতে জানে না। এমন হেঁয়ালি-হেঁয়ালি কথা শুনে অবাক হচ্ছ, না? ভাবছ হয়তো, নাক থাকলে তো ডাকতেই পারে! হ্যাঁ, এ-কথাটা একশো বার সত্যি। তবে কী জানো, আসলে এ-বাঘ কাগজে আঁকা একটি ছবি।

অবশ্য এ ছবি যে কে এঁকেছে, কেউ জানে না। তবে যেই এঁকে থাকুক, মন্দ আঁকেনি। তার মানে এই নয়, সে একজন ওস্তাদ ছবি আঁকিয়ে। ছবিটা দেখলে তুমি ঠিক বুঝতে পারবে, বয়েসটা তার কচি কচি। সাতও হতে পারে, আটও হতে পারে। কিংবা তার কমও হতে পারে। তবে তাকে যখন আমরা কেউ দেখিনি, তখন আড়ালে তাকে নিয়ে কোনও কথা না বলাই ভাল। তার চেয়ে বরং যাকে দেখছি, সেই বাঘের কথাই শুনি।

খুব সম্ভব কাগজে আঁকা বাঘটা কোথাও বন্দি ছিল। ওই যে শুনলে-না বাঘের বন্ধু বাতাস! বলতে পারি ওই বাতাসটাই বোধহয় বাঘটাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এনেছে এই বনে। এ-কাজটা করতে বাতাসকে তো আর কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। বাতাস ইচ্ছে করলে গায়ে যেমন সুড়সুড়ি দিয়ে ফুরফুর করে বইতে পারে, তেমনই আবার দমকা ঝাপটা মেরে সব ওলটপালটও করে দিতে পারে। হবে হয়তো এমনই এক ঝাপটা মেরে বাঘকে বনে এনে ফেলেছে বাতাস। তারপর ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ঘুমোচ্ছে বাঘ। কে জানে কবে ঘুম ভাঙবে!

বলতে বলতেই একঝাঁক টিয়া উড়ে এল গাছের আড়াল ভেঙে বনের ভেতর। বুঝতেই পারছ একঝাঁক টিয়া মানে একঝুড়ি গল্প। সে কী ট্যাঁ ট্যাঁ সুরের টকটকানি! কেউ বলছে মটরশুঁটির গল্প, কেউ বলে ধানিলঙ্কার কথা, কারও মুখে কাশীর পেয়ারার রাশি রাশি সুখ্যাতি। সবচে পুঁচকে যে টিয়াটা, তার ও সবে কান নেই। মনও নেই। কেমন করে যেন তার চোখ পড়ে গেছে ওই বাঘটার দিকে। অনেকক্ষণ ধরে অবাক হয়ে সে বাঘের দিকেই চেয়ে ছিল। আর মনে মনে ভাবছিল, ওটা কী রে বাবা! এইটুকুনি একটা বাঘের মতো দেখতে! যখন দেখল, বাঘের মতো দেখতে বাঘটা নড়েও না, চড়েও না, তখন সে গাছের ডাল থেকে নেমে এল বনের মাটিতে। ঝরাপাতার ওপর ডিঙি মেরে সে বাঘটাকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখতে লাগল। তার চার পাশে ঘুরতে লাগল। কই, কোনও সানও নেই, প্রাণও নেই। সে বাঘটার আরও একটু কাছে এগিয়ে গেল। এবার ডানা ছড়িয়ে বাঘের ঘাড়ের ওপর দিয়ে এ-পাশ ও-পাশ করতে লাগল। ডানার হাওয়ায় বাঘটা নড়ল বটে, কিন্তু উঠে দাঁড়াল না। তখন পুঁচকে টিয়াটার বেড়ে গেল আরও সাহস। সে একেবারে ঝপ করে বাঘের গায়ের ওপর দিল লাফ! যেই না লাফ দেওয়া, টিয়ার ডানার ঝাপটায় বাঘের কাজ সারা। ছিল সোজা, গেল উলটে। মাটির দিকে বাঘের ছবি, চোখের ওপর সাদা কাগজ। ব্যস, শুরু হয়ে গেল তুলকালাম কাণ্ড। কোথাও কিছু নেই, বাঘটা চিৎকার করে উঠল, “দম আটকে আসছে, দম আটকে আসছে, আমাকে সিধে করে দাও! আমি মরে গেলুম!”

বলব কী, চিৎকার শুনে ওই একঝাঁক টিয়া চোখের পলকে ফুড়ুত। পুঁচকে টিয়াও দে হাওয়া! কিন্তু পুঁচকেটা হাওয়া দিলেও রহস্যটা তো আর তার মাথা থেকে হাওয়া হচ্ছে না! তাই উড়ে গিয়েও চোখের পলকে আবার ফিরে এল। কাছ-বরাবর একটা গাছের ডালে বসে উলটে-পড়া বাঘের হাঁসফাঁসানি শুনতে লাগল। এ কী কাণ্ড রে বাবা!

পুঁচকে টিয়া আর কতক্ষণ বসে থাকবে এই কাণ্ড দেখে! অত ধৈর্য কি আর পুঁচকেদের থাকে। ওই পুঁচকে টিয়ার মাথার ভেতর ‘কী হয়’ দেখার তাগিদটা এমন কিলবিল করে উঠল যে, সে আর থাকতে পারল না। ঝপ করে গাছ থেকে নেমে, একটু ইদিক-উদিক দেখে, ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরল বাঘ-আঁকা কাগজটা। তারপর দিল উলটে। বলব কী, সঙ্গে সঙ্গে এক আজব কাণ্ড! কাগজে আঁকা বাঘটা একটা সত্যি সত্যি বাঘের মতো জ্যান্ত হয়ে ‘হালুম’ বলে একটা লম্বাই লাফ মারল। মেরেই খাড়া দাঁড়িয়ে পড়ল। পুঁচকে টিয়াটার তো চক্ষু চড়কগাছ! সে পড়িমরি দিল লম্বা। ধড়ফড় করে উঠে পড়ল সামনের গাছটার একেবারে মগডালে। বাঘ হও আর যেই হও, আর তাকে ধরতে হচ্ছে না। উফ, খুব বেঁচে গেছে পুঁচকেটা। ওইটুকু বুকের ভেতর পুঁচকেটার যতটুকু প্রাণ আছে এই এক ধাক্কায় সেটুকুও যায় বুঝি! যাই হোক, এ যাত্রায় বেঁচে গেল। বেশ ক’টা ফিনফিনে হাঁফ ছেড়ে পুঁচকেটার যখন ঘোর কাটল তখন সে দেখল, বাঘটা থাপুস মেরে বসে নিজের গা চাটছে আর হাই তুলছে। কী রে বাবা, বাঘটা আবার ঘুমোবে নাকি! বাঘটাকে আরও একটু স্পষ্ট চোখে দেখার জন্য পুঁচকেটা নিঃসাড়ে মগডাল থেকে একটা নিচু ডালে নেমে এল। পাতার আড়াল থেকে উঁকি মেরে এই আজব বাঘের ছিরিটা সে লক্ষ করার চেষ্টা করল। অবশ্য এখান থেকে চোখ নামিয়ে দেখতে তার কষ্ট হল না বলেই সে ফস করে নিজের মনে হেসে উঠল। এ কী বাঘ রে! দেখতে কেমন গেঁড়া গেঁড়া, মাথাটা কেমন বেঁকাতেড়া, ঠ্যাং চারটে খাড়া খাড়া, একটা চোখ টেরা টেরা, গায়ের রং ছেঁড়া ছেঁড়া! দেখেশুনে তার হাসিটা যখন মুখ দিয়ে ফসকে বেরোবে বেরোবে করছে, আর হাসিটাকে যখন সে মুখের ভেতর চেপে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তখন তার নজর পড়ে গেল বাঘের কানের দিকে। একটি কান আছে, আর একটি গেছে! সে আর থাকতে পারল না। ট্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ করে হেসে ফেলল। আর ঠিক তখনই একটা কাঠবিড়াল গাছের এ-ডাল ও-ডাল থেকে তিড়িংবিড়িং দিল ছুট। ছুটতে ছুটতে সিধে লাফিয়ে পড়ল মাটিতে। শুধু লাফিয়ে পড়ল না, বাঘটাকে সে বাঘ বলে ঠাওর করতে পারল না বলে সটান বাঘের পিঠের ওপর উঠে পড়ল। বাঘটা তো হকচকিয়ে গেছে। পিঠে চড়ে কে রে বাবা! বাঘ খুব জোরে একটা গা ঝাড়া দিল। কিন্তু কাঠবিড়ালের নড়তে বয়ে গেছে। ও মা, কাঠবিড়ালটা বাঘের পিঠ চাটতে শুরু করে দিলে। এঃ বাবা কী ঘেন্না! যে জানে সে জানে বাঘের গায়ের গন্ধ কেমন। কেমন বিচ্ছিরি বোঁটকা। কাঠবিড়ালটার কি ঘেন্না নেই? কেমন চাটছে দ্যাখো! চাটবেই তো! এ-বাঘ তো আর সে-বাঘ নয়। এ তো আঁকা ছবির বাঘ। এ-বাঘের গায়ে মিষ্টি মিষ্টি রং। মিষ্টি মিষ্টি রঙের মিষ্টি মিষ্টি গন্ধটা যাবে কোথায়!

সে যাই হোক, এ দিকে কাঠবিড়ালের চাটাচাটিতে বাঘটা এমন ভয় পেয়ে গেল যে, সে মারল এক লাফ! লাফ মেরেই কাঠবিড়ালকে পিঠে নিয়ে দিল ছুট! আর তাই না দেখে পুঁচকে টিয়ার হাসতে হাসতে পেট ফাটার জোগাড়! হাসতে হাসতে সে উড়তে শুরু করে দিলে। বাঘ যে দিকে যায়, পুঁচকে টিয়াও সে দিকে ওড়ে। উড়তে উড়তে চেঁচায়, “ছুটো না বাঘ, ছুটো না, তোমার পিঠে কাঠবিড়াল।”

হতভম্ব কাঠবিড়ালটা কী করবে, কী করবে’ ভাবতে ভাবতে বাঘের পিঠ থেকে দিল লাফ— তিড়িং! লাফ দিয়েই সটান সামনের গাছটায় উঠে, পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।

তবুও বাঘটা ছুটছিল। তবুও পুঁচকে টিয়া উড়ছিল আর হাসছিল। তারপর বাঘটা যখন বুঝল তার পিঠে আর চাটাচাটির শব্দ নেই, তখন সে থামল। যে গাছটার নীচে থামল, সেই গাছটার ওপরে ঝুপ করে বসে পড়ল পুঁচকে টিয়া। বাঘটা তখনও হাঁফাচ্ছিল। আর পুঁচকে টিয়াটা তখনও হাসছিল। হাঁফাতে হাঁফাতে বাঘটা ওপরবাগে চাইছিল। পুঁচকে টিয়াটা হাসতে হাসতে এ-ডাল ও-ডাল নাচছিল। হঠাৎ বাঘের চোখে চোখ পড়তেই পুঁচকেটা বাঘকে কী জিজ্ঞেস করবে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে সে ফট করে বাঘকে বলে বসল, “তুমি কেমন বাঘ? একটা কাঠবিড়ালির ভয়ে লেজ তুলে পালাও?”

বাঘ প্রথমটা কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। উত্তর দেওয়া ঠিক কি না সেইটা ঠিক করতেই তাকে বারকতক দম ফেলতে হল। তারপর চট করে বলে বসল, “ওটার নাম কাঠবিড়ালি?”

পুঁচকে বললে, “হায় কপাল, কাঠবিড়াল চেনো না?”

বাঘটা প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেলেও পরক্ষণেই বুকটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলল, “ওটার নাম যদি কাঠবিড়ালি হয়, তোমার নামটা কী?”

“আমার নাম পুঁচকে।” বলে পুঁচকে টিয়া ডানাটা একটু নেড়ে দিল।

পুঁচকে নামটা শুনে বাঘের ভীষণ মজা লেগে গেল।

বাঘ বলল, “পুঁচকে আবার কী ধরনের নাম! পুঁচ-কে। নামটা তোমার কাতুকুতু মেশানো। আমার হাসি পাচ্ছে।”

পুঁচকে বলল, “তোমাকে দেখেও আমার খুব হাসি পাচ্ছে।”

“কেন?” বাঘ যেন একটু চমকে গেল।

“তোমার একটা কান নেই। তুমি কানকাটা।” বলে পুঁচকেটা খুব জোরে হেসে উঠল। আর ঠিক তখনই বনের ভেতর একটা শেয়ালও ডেকে উঠল। শেয়ালের ডাক শুনে বাঘটা এমন ঘাবড়ে গেল যে, সে একেবারে চোখ-কান বুজে দিল ছুট!

পুঁচকেটা বাঘের হঠাৎ এমন ছুট দেখে নিজেই কেমন থতমত খেয়ে গেল। কী রে বাবা! শেয়ালের ডাক শুনে বাঘ ছুটে পালায় কেন! ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে পুঁচকে বাঘের পিছু পিছু উড়ে চেঁচাতে লাগল, “কোথায় যাচ্ছ তুমি? দাঁড়াও, দাঁড়াও!”

বাঘ বেশ খানিকটা ছুটে থামল। বেশ খানিকটা হাঁফাল। তার পরে কান পেতে শুনল। না, আর শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে না।

পুঁচকে টিয়া গাছের ডালে বসে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ছুটলে কেন?”

বাঘ ফ্যালফ্যাল করে এ-দিক ও-দিক চেয়ে পুঁচকে টিয়াকে জিজ্ঞেস করল, “বিচ্ছিরি গলায় হুক্কা হুয়া বলে কে হেঁকে উঠল বলো তো?”

পুঁচকে টিয়া আরও জোরে হেসে উঠে উত্তর দিল, “আরে ছ্যা ছ্যা, শেয়ালের ডাক শুনে তুমি পালিয়ে এলে! কোথায় শেয়াল তোমাকে দেখে ভয়ে পালাবে, না, উলটে তুমিই ভড়কে গেলে!”

বাঘ কেমন যেন বোকা বোকা গলায় জিজ্ঞেস করল, “শেয়ালের চেয়ে আমি বুঝি বড়?”

“হায় রে, তাও জানো না?” হাসতে হাসতে থেমে উত্তর দিল পুঁচকে।

বাঘ একটা লম্বা স্বস্তির নিশ্বেস ফেলে বলল, “যাক, খুব রক্ষে কেউ দেখতে পায়নি।”

পুঁচকে টিয়া এবার বাঘকে একটু খোঁচা দিয়েই বলল, “সত্যি বলতে কী, তুমি বাঘের নামে কলঙ্ক। তোমার যেমন একটা কান নেই, তেমনই তোমার সাহসও নেই। এই বনের অন্য বাঘ তোমাকে দেখতে পেলে তোমাকে বন থেকে তাড়িয়ে ছাড়বে। লজ্জা, লজ্জা! তুমি শেয়ালের ভয়ে পালাও!”

বাঘ যেন এবার একটু ভাবনায় পড়ল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল, “কী করা যায় বলো দিকিনি? আমার কী করা উচিত?”

পুঁচকে বলল, “শেয়াল যখন চেঁচাল, তখন তো তোমার উচিত ছিল রুখে দাঁড়ানো।”

বাঘ উত্তর দিল, “তারপর দেখে ফেললে!”

পুঁচকে দু’বার চোখের পাতা ফেলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “দেখে ফেললে মানে?”

বাঘ উত্তর দিল, “দেখে ফেললে মানে আমার কাটা কানটা!”

পুঁচকে বলল, “সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছ। একটা কান না থাকা বাঘের পক্ষে খুবই লজ্জার!”

বাঘ খুবই অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করল, “তুমি এর একটা বিহিত করতে পারো না?”

“কীসের বিহিত?” পুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

“আমার কানের যদি একটা বিহিত করে দিতে পারো।”

পুঁচকে হেসে উঠল। বলল, “তুমি তো বেশ কথা বলছ! কান নেই তোমার, আর আমায় বলছ বিহিত করে দিতে! আমি যদি তোমার মতো বাঘ হতুম, আর যদি আমার একটা কান কাটা থাকত, তবে দেখতে কবেই আমি নিজের কানের নিজেই বিহিত করে নিয়েছি। হাতির গায়ে যে অত জোর, সেই হাতিকেই ঘায়েল করে, হাতির কান ছিঁড়ে এনে নিজের কানে বসিয়ে নিতুম। আরে বাবা, বাঘ বলে কথা! গায়ে ক্ষেমতা কত!”

বাঘটা কেমন বোকার মতো জিজ্ঞেস করল, “হাতিকে বুঝি বাঘ ছাড়া সবাই ভয় পায়?”

পুঁচকে জবাব দিল, “পাবে না! হাতির তাকত কত। শুঁড় দিয়ে ধরবে আর পা দিয়ে চেপটে চ্যাটাং করে দেবে। বাঘ ছাড়া কার অত সাধ্যি হাতির সঙ্গে লড়ে!”

বাঘটা গা-ঝাড়া দিল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “আমাকে তুমি বলছ হাতির সঙ্গে লড়াই করতে?”

“নিশ্চয়ই।” পুঁচকে জবাব দিল, “মান-ইজ্জত যদি বাঁচাতে চাও তবে এখনই একটা হাতির কান ছিঁড়ে এনে নিজের কানে বসিয়ে নাও! কান তো কান হাতির কান! যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া। তোমার কাটা কানে বসিয়ে নিলে তোমাকে যা দেখতে হবে না, দারুণ!”

বাঘের লেজটা যেন উত্তেজনায় ছটফটিয়ে দুলতে লাগল। তারপর বলল, “আমার মনে হচ্ছে, তোমার কথা শুনে আমার বুকের ভেতরে সাহসটা খামচাখামচি শুরু করে দিয়েছে। ঠিক আছে, তোমার কথাই সই। আমি হাতির সঙ্গে লড়াই করে তার কান ছিঁড়ব। কিন্তু হাতির দেখা কোথায় পাব, তা তো জানি না!”

পুঁচকে বলল, “এসো আমার সঙ্গে। আমি আকাশে উড়ে যে দিকে যাই, আমাকে দেখে দেখে সেই দিকে তুমি মাটিতে হাঁটো। বনের একটু ভেতরে না গেলে হাতির দেখা পাওয়া যাবে না।”

বাঘ জিজ্ঞেস করল, “হাতি বুঝি বনের ভেতরে থাকে?”

পুঁচকে মুচকি হাসল। বলল, “কেন, বনের ভেতরে যেতে তোমার ভয় করছে নাকি?”

বাঘ বলল, “না, না, আর আমার ভয় করছে না। যতই হোক আমি তো বাঘ। তোমার কথা শুনে ইস্তক আমার বুকের ভেতরটা ‘হাতি হাতি’ করে হাঁফাচ্ছে। এখন আমার মনে হচ্ছে এখনই একটা হাতি দেখি, এখনই তার কান কাটি।”

ব্যস, বলতে-না-বলতেই সামনে একটা হাতি! পুঁচকে টিয়া দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠল, “বাঘ তুমি সাবধান হও! ওই তোমার সামনেই হাতি!”

কানকাটা বাঘের তো হাতি দেখেই ভয়ে পা ঠকঠক। তাই তো, এমন একটা ধুমসোর সঙ্গে লড়াই করা কি চাট্টিখানি কথা! তাই বাঘটা মনে মনে ভাবল, ঝুটঝামেলায় না গিয়ে হাতির কাছে ভাল মুখে একটা কান চাইলে কেমন হয়? সেইটাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ। তাই কানকাটা বাঘটা হাতির মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে কিছু বলার আগেই, হাতিটা এমন হাতির মতো হেসে উঠল যে, তাই শুনে বাঘের গা-পিত্তি জ্বলে গেল। কোথায় ভাল মুখে কথা বলে হাতির সঙ্গে একটা রফা করবে, তা নয়, হাতি বাঘকে দেখে হেসে দিল। কী বিচ্ছু হাতি রে বাবা! মেজাজটা একেবারে বিগড়ে গেল বাঘের। খুব কড়া গলায় কানকাটা বাঘ গর্জে উঠল, “তুই হাসছিস কেন রে হাতি?”

হাতি হাসতে হাসতেই উত্তর দিল, “হাসি পেলে না-হেসে থাকি ক্যামনে?”

বাঘ আরও রেগে গেল। বলল, “হাসি পেলে মানে? অত বড় একটা ধুমসো হাতি, তার যখন-তখন হাসি পেলেই হল! কীসের জন্য হাসি পাবে?”

হাতি হাসতে হাসতেই বলল, “তোকে যে দেখবে সে-ই হাসবে।”

“জানিস, আমি বাঘ!” দম্ভে ফেটে পড়ল বাঘ।

হাতি বলল, “সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে কানকাটা বাঘ।”

ব্যস! ভস্মে যেন ঘি পড়ল। বাঘ গর্জে উঠে ধমক মারল, “তোর সাহস তো কম নয়! আমায় তুই কানকাটা বলিস! তবে তোরই কান কাটি আমি!” বলে বাঘ হাতির ঘাড়ে পড়ার জন্য গাঁক করে লাফিয়ে উঠল। যেই না বাঘ লাফিয়েছে অমনই হাতি শুঁড় দিয়ে বাঘকে লুফে নিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। তার পরেই লেগে গেল ঝটাপট। বাঘ চার পা ছুড়ে যতই গাঁক-গাঁক করে লাফায়, হাতি ততই শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে বাঘের দফারফা করে দেয়। শুঁড় দিয়ে হাতি বাঘকে একবার শূন্যে তোলে, একবার নীচে নামায়। আবার তোলে, আবার নামায়। তারপর আচমকা বাঘকে এমনই তোল্লাই দিয়ে ছেড়ে দিল যে, বাঘ মাটির ওপর ঘাড় গুঁজে ধপাস! যেই মাটিতে পড়া, অমনি হাতি বাঘের পেটটা চেপে ধরল পা দিয়ে। যেই-না চেপটে ধরা সঙ্গে সঙ্গে ফুস-স-স! অত বড় বাঘটা চোখের পলকে কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল, বোঝাই গেল না! দেখা গেল, জ্যান্ত বাঘের বদলে হাতির পায়ের তলায় একটা কাগজ। আর সেই কাগজে আঁকা ছবি-ছবি বাঘটা। হাতি তো দেখেশুনে তাজ্জব! ভাবল, যাঃ বাব্বা! এ কী বাঘ!

আর গাছের ডালে বসে বসে সেই পুঁচকে টিয়াটা ভাবল, একেই কি বলে ম্যাম্যাজিক! হবে হয়তো!

২১ ডিসেম্বর ১৯৯৪

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন