পৌলোমী সেনগুপ্ত
চারু মহাজন বেশ কিছুদিন বেপাত্তা । নানা জনে নানা কথা বলল। মহাজনের ধারবাকি মেলা। তাগাদার চোটে দেশান্তরী।কেউ নাকি দেখেছে রাতে শ্মশানের দিকটায় যেত। শ্মশান থাকলে মন্দির থাকে, মন্দির থাকলে সাধু থাকে, এমনই জানতাম। আমাদের গাঁয়ে নদী আছে, শ্মশান আছে, মন্দিরও আছে।তবে মন্দিরে কোনও সাধু থাকতেন না।কবে সাধু হাজির, কবে মহাজন সাধুর দর্শন পেল, আর বিবাগি হওয়ার বাসনা জাগল, বুঝতে পারলাম না। চারু মহাজন আর ফিরে এল না।চর আসমানদিপুরে কপালির মামার বাড়ি।কপালির মামার বাড়ির দেশ থেকেও মামারা এসে গেল।না, কোনও খবর নেই! কপালির বাবা চারু মহাজন শেষে চারু ফটাস হয়ে গেল।
কপালি কান্নাকাটি করে।তা ছোট্ট মেয়ে কপালি, বাপের জন্য তো কষ্ট হবেই।ওর কাকারা প্রবোধ দেয়। প্রতিবেশীরাও। আমরাও দিই।দিতেই হয়। এমন জলজ্যান্ত একটা মানুষ দেশ ছাড়া, বাড়িছাড়া, খায় কী, থাকে কোথায়—ভাবনা তো হবেই! কপালির মা অন্নজল ত্যাগ করেছিল।পরে সবার সুবিবেচনায় খেতে-পরতে রাজি হয়েছে। কপালির মাকে আমরা ‘বিধুখুড়ি’ ডাকি। বিধুখুড়ি নদীর ঘাটে স্নান করতে এলেই আমাদের দেখতে পায়। কপালিকে পাঠিয়ে দেয়।কপালি দৌড়ে আসে।ওর দু’বিনুনি ঝোলে।বড় বড় চোখে তাকায়, আর হাঁপায়।বলে, ‘মা ডাকছে।’
আমাদেরও কর্তব্য আছে।গাঁয়ের ছেলে, পূজাপার্বণে চারু মহাজন রাবণ বধের পালা আনত গাঁয়ে।টাকা-পয়সা দু’হাতে খরচ করতে পারত। বাজারের দিকটায়, মতিহারি তামাকের দোকান, পাটের আড়ত, মশলাপাতির দোকান, হাঁড়িপাতিলের দোকান—সব চারু মহাজন করেছে। ভাইদের দোকানে-দোকানে বসিয়ে দিয়েছে।সেই মানুষ বিবাগি হয়ে গেলে কার না খারাপ লাগে! সবচেয়ে খারাপ লাগে, কেউ চারু মহাজনের বাড়ি কোন দিকে বললে, এক কথা, ‘চারু ফটাসের বাড়ি! ওই ওদিকটায়।বাঁশতলা পার হয়ে দিঘির পাড় ধরে হেঁটে চলে যান, চৌখুপি জানলার টিনকাঠের ঘর দেখলেই বোঝবেন, চারু ফটাসের বাড়ি।’
এমনকী ‘এ-কার মেয়ে রে বাবা! গাছতলায় বসে কাঁদছে !’যেই থাকুক, আমরা থাকলেও বলি, ‘ও, চেনেন না, চারু ফটাসের মেয়ে কপালি।বাপের কথা মনে হলেই গাছতলায় বসে কাঁদে।’
আসলে ‘ফটাস’ কথাটা আমাদের তিনুকাকাই চালু করেছেন।তিনিই ছোটকাকাকে খবর দিয়েছিলেন, ‘শুনছ ছোড়দা, চারু মহাজন ফটাস!’
ছোটকাকা জমিজমা দেখতে বের হচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনুর কথায় তিনি কিছুটা বিভ্রমে পড়ে গিয়ে বিচলিত বোধ করলেন, ‘ফটাস কী রে!’
‘ফটাস বোঝো না।নিখোঁজ।’
‘কবে থেকে?’
‘পরশু থেকে।’
‘কে বলল?’
‘বেচু সাহা বলল।’
অবশ্য চারু মহাজনের বাড়ি আমাদের গাঁয়ে— তবে লম্বা গাঁ, প্রায় পরগনার মতো। দু’ক্রোশ লম্বায়। নদীর বাঁক আছে বলে, চরটা খুব কাছে হয়। নদীর চর ধরে উঠে গেলে বেশি দূর না। তিনুকাকা চরের দিকটায় মাছের খোঁজে গিয়েছিলেন। মাছের নেশা প্রবল। চরেই নাকি বেচু সাহা বলেছে, ‘তিনুকর্তা নাকি, শুনছেন খবর, চারু মহাজনের দু’দিন হল খোঁজ নাই। গদিতে নাই, শহরেও যায়নি, বাড়িতে শোক…একবার ছোটকর্তারে খবর দেবেন।’
দু’দিন বোধ হয় চেপেচুপে ছিল, যদি ফিরে আসে—কিন্তু না আসায় বাড়ির মানুষদের ধৈর্য শেষ। ফেটে বের হয়ে গেছে খবরটা। কোথাও যাবে বলেও বের হয়নি। গদি থেকে ফিরে রোজ যেমন, নদীর ঘাট থেকে হাত-মুখ ধুয়ে মালা জপ করতে বসে, তাই বসেছিল। রাতে বিধুখুড়ি খেতে দিয়েছে। কপালি বাপের পাতে বসে খেয়েছে। বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। সকালে খোঁজখবর করারও কারণ হয়নি। সকালে সে নিজের ধান্দায় ঘোরে, গদিতে গিয়ে বসে থাকে। ফড়েরা আসে। কথাবার্তা হয়। পাটের গুদামে পাট ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ থাকে বলে, সর্বক্ষণ কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না। সেই লোক, নিখোঁজ হলে ফটাস হয় টের পেলাম তিনুকাকার কথায়। কপালিকে তিনুকাকাও স্নেহ করেন। মেলায় বান্নিতে গেলে কপালি লগ ধরবেই। কাকা নিজেই গিয়েছিলেন—আমরাও। কাকার এক কথা—‘চারু, ফটাস! গেল কোথায়!’
তা সেই ফটাস চারুকে নিয়ে মাসখানেক আমাদেরও আহার-নিদ্রার কথা মনে ছিল না। তিনুকাকা আচমকা কোনও বিদঘুটে খবর-টবর পেলেই বের হয়ে পড়তেন। তা দামোদরদির বাজারে একজন কবিরাজ এসেছেন। শেকড়বাকড় দিচ্ছেন। মাথায় ফেজটুপি, গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি। দেখতে চারু মহাজনের মতো। আর যায় কোথায়! খবরের আগে আগে আমরা দামোদরদির বাজারে গিয়ে শুনি লোকটা হাওয়া। নদীর পাড় ধরে কোথায় হেঁটে চলে গেছে!
দেশটা নদীনালার বলে, দুর্গম রাস্তাঘাট। আর গভীর বনজঙ্গলেরও প্রাচুর্য আছে। জঙ্গলের ভেতর যদি কুটির নির্মাণ করে সাধুসন্নেসি হয়ে যায়! আমাদের মহাজনকাকা যদি মনে করে তার ইহকাল পাটের লাছি গুনে গেল, পরকালের জন্য থাকল কী— ভেবে যে-কোনও তীর্থে চলে যায়নি কে বলবে!
নানা জনে নানা কথা বলতে থাকল।
কিছু কু-কথাও চাউর হতে থাকল।
নদীর পাড়ে লাশ। কার লাশ খোঁজো। মহাজনকাকার লাশ হয়ে থাকার প্রবৃত্তিই হবে না। তেমন মানুষই তো নয়। ধর্ম আর দুর্মতি দুইই তার সম্বল। কপালি সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। সেই জানে তার বাবার মতিভ্রম যতই হোক, তাকে দেখলে স্থির থাকতে পারবে না।
আমরা নদীর পাড় ধরে হাঁটি। কপালি দৌড়য়। বিধুখুড়ি একদিন ডেকে খবর দিল, চরে কে নাকি রাতে ঘোরাঘুরি করে। ঠিক মহাজনের মতো! জ্যোৎস্না রাতে লোকজন পাঠিয়ে খুঁজেছে। কিন্তু না, কেউ না। বিধুখুড়ি সর্বক্ষণ যদি কাকার কথা ভাবে, জ্যোৎস্না রাতে চরের মধ্যে ফটাসকাকাকে দেখতেই পারে। তা কালো, নধর চেহারার ফটাসকাকা, বেটেখাটো। গলায় তুলসীর মালা। গালে চাপদাড়ি। গায়ে ফতুয়া, মাথায় লম্বা টিকি। টিকিতে হলুদ করবী ফুল বাঁধা থাকত। সকালে কপালির কাজই ছিল শুদ্ধবস্ত্রে করবী ফুল তুলে আনা। তামার পাত্রে ফুলটি। নদীর ঘাট থেকে উঠেই সূর্যপ্রণাম। তারপর চোখ খুললে, সামনে মা মহামায়া। তামার পাত্রে করবী ফুল। সেই মা মহামায়াকে ফেলে দেশান্তরী হয়ে থাকা যে খুব বেশি দিন সম্ভব না, আমরা বুঝি।
এই এক আশা ছিল। কিন্তু আশা কুহকিনী। তবে তিনুকাকা ছাড়ার পাত্র নয়। রানির বাবা হারান পাল আর বশিরকে দিয়ে বোঝা গেছে। শেষ পর্যন্ত গুপ্ত খবরটি ফাঁস করা তিনুকাকার পক্ষেই সম্ভব।
খবর রটে গেল। ঢোল পিটিয়ে দেওয়া হল হাটে। উদ্ধবগঞ্জ থেকে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে আনা হল। কপালির কাকারা হাটে-বাজারে হ্যান্ডবিল বিলি করতে বের হয়ে গেল। বগলে ছাতা, কেউ যায় উত্তরে, কেউ যায় দক্ষিণে। নদী বলতে মেঘনা। আর ওদিকে বিশ-ত্রিশ ক্রোশ দূরে শীতলক্ষ্যা। তার ভেতর যত গ্রামগঞ্জ সব জায়গায় হ্যান্ডবিল বিলি করেও যখন পাত্তা পাওয়া গেল না, তখন কপালির মা কাঁদতে বসল।
নদীর ঘাটলায় বসে শোকার্ত কান্না। শুনতে কাঁহাতক ভাল লাগে! কপালিও বিধুখুড়ির গলা জড়িয়ে দোহারে লেগে যায়। আর কান্না তো সংক্রামক ব্যাধি! আমাদেরও কাঁদতে ইচ্ছে করে। কপালিকে ডাকি, ‘এই, তুই কীরে। কাকা ঠিক ফিরে আসবে। মরাকান্না জুড়ে দিলি!’
তিনুকাকাও ধমক দিলেন ঘাটে গিয়ে, ‘তা বউঠান, আপনি যেমন! মানুষটা সাধুসন্ত যদি হয়ে যায়, তবে তা আর কতক্ষণ! পাটের দর উঠছে, বিষয়ী মানুষ খবর পেলে লোটা-চিমটে ফেলে দেখবেন চলে আসবে। মরাকান্না শোভা পায়!’
বিধুখুড়ির হঠাৎ কী মনে হল, কান্না থামিয়ে বলল, ‘আমি যে তিনু তোমার দাদাকে অকম্মার ঢেঁকি বলেছি! সেই রাগে ঘর ছেড়ে চলে গেল।’
‘অকম্মার ঢেঁকি কেন!’
‘কাজকাম ছাড়া লোকটার মাথায় কিছু নাই। মামলা-মোকদ্দমা ছাড়া মাথায় কিছু নাই। আমার একজোড়া দুল করার কথা, তার নাকি মনেই থাকে না। তা রাগ হয় না! আমি কেন যে মুখ ফসকে বলে ফেললাম, অকম্মার ঢেঁকি। মনে তো খটকা লাগবেই।’
তার পরই ফের কান্না জুড়ে দিল বিধুখুড়ি। বলতে থাকল, ‘যে করে পারো তারে ধরে আনো। যে খবর দিতে পারবে, তার বখশিশ মিলবে।’
তিনুকাকা বলল, ‘কত টাকা উল্লেখ করব?’
‘কত টাকা বখশিশ দিলে তোমার দাদার খোঁজ পাওয়া যাবে মনে হয়।’
‘তা হাজার। হাজার হলে, অনেক টাকা। এক হাজার।’
এক হাজার টাকা সোজা কথা না! এক হাজার টাকায় কত কিছু কেনা যায়। আবার হ্যান্ডবিল, আবার বিলি। কপালির কাকারা দাদার জন্য সর্বস্ব পণ করতে রাজি। বুদ্ধি, পরামর্শ, জমিজিরাতের বন্দোবস্তি কারবার সহ, পাটের গুদাম, আখের খেত সব দাদার মাথা থেকে উৎপত্তি। দাদা না থাকলে সে বিদ্যেও নেই বিষয়আশয় ধরে রাখে। হাজার টাকা যায় যাক। দরকারে সব বাজি রাখতে রাজি, দাদা ফিরে এলে আবার সব ঠিকঠাক। পুষিয়ে যাবে সব।
তিনুকাকার কিছুটা হাতটানের স্বভাব আছে। ঠাকুমার ভাণ্ডার থেকে এটা ওটা সরান। তাঁর মুখে কত দিগ্বিজয়ের কাহিনি—বাড়ি এসে উদয় হলেই আমাদের অনেক মজা। কাকার মুখের ওপর কথা বলারও কেউ নেই। ঠাকুমার একটামাত্র ভাই, তাঁর একটামাত্র ছেলে, পিসির বাড়ি আদর খেতেই আসেন। এসে যদি দেখেন আমাদের ব্যাজার মুখ, তবে ঠাকুমার মাথায় যেন কাগেবগে নোংরা ফেলে। ঠাকুমা আমাদের খুশি রাখার সব রকমের বন্দোবস্ত করেন। ভাইপোটা না আবার আমাদের ব্যাজার মুখ দেখে পালায়। দুধের সর, মিষ্টি আম, কনক ধানের চাল দিয়ে পাটিসাপটা, চিতই পিঠে, জমির আখি গুড়, তারপর শীতের দিন হলে তো কথাই নেই— মোচার ঘন্ট, বড় পাবদা মাছের ঝোল, মাষকলাইয়ের বড়ি আর ধনেপাতা সহ ঝোল, নানা কিসিমের রান্না। বউরা তখন চোপা পর্যন্ত করতে সাহস পায় না। তিনুঠাকুর বাড়িতে প্রায় গুরুঠাকুরের শামিল। ছোটকাকা পর্যন্ত কাকাকে সমীহ করে চলে। বললেই হল, ‘ধুস, থাকে! থেকে কচু হবে। যেমন আমার পিসি তার তেমনই বউরা। ছেলে ক’টাকে চোরের মতো গৃহবন্দি করে রাখা—সহ্য হয়! কেবল পড়া, স্কুল, পড়া, শিক্ষকের বেত্রাঘাতে জর্জর—সহ্য হয় চোখে। চললাম।’
সবাই পড়ে যায় মহাফাঁপরে। ঠাকুমার চোপার কাছে, সবাই জব্দ। সেই আতঙ্কে, তিনুকাকার সাতখুন মাপ।
তিনুকাকা বলেন, ‘পারবি?’
আমরা বললাম, ‘কী পারব।’
‘পারবি দনদির বাজারে যেতে!’
‘কী হবে গিয়ে!’
‘লোক ধরে আনবি। ছদ্মবেশী মনে হলেই খবর দিবি।’
‘দিলে কী হবে?’
‘হবে কচু। বুঝিস না, হাজার টাকা। খবর দিতে পারলে, হাজার টাকা। খোঁজাখুঁজির টাকাও দেবে। খরচের বহর কী কী আছে দ্যাখ। রাস্তাঘাটের খরচ, থাকার খরচ, খাওয়ার খরচ, কত পয়সা বোঝ।’ ইতিমধ্যে খবর এসে গেল—দেখা গেছে, উদ্ধবগঞ্জের হাটে একটা লোক সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। কথা বলে না। দেখতে চারুকাকার মতো।
বিধুখুড়ি বাড়ি এসেই বলল, ‘শিগগির চলে যান তিনুঠাকুর। সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁশের সাঁকো। ভেঙে পড়লে সব যাবে।’
ছুটলাম। তা একদিনের পথ নৌকায়। গিয়ে আর তার খোঁজ পাওয়া গেল না। খরচপত্রের হিসাব দিলেন—তা পঁয়তাল্লিশ টাকা দশ আনা। মোট খরচ। মাঝিমাল্লার খরচ আলাদা। আমরা দু’-তিনদিন নৌকায় থাকলাম। নদীর জলে সাঁতার কাটলাম। নৌকার পাটাতনে রান্না। ইলিশ মাছের ঝোল আর ডিম ভাজা। গরম ভাত, পদ্মপাতায়। খোলা আকাশ মাথার ওপর নদীর জলে নৌকা, আনারস কাঁঠালের নৌকা থেকে কাঁঠাল আনারস। জলে জলে নৌকা যায়। গজারির বনের ভেতর নৌকা ঢুকে যায়। মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো। আমরা সাঁকোর খোঁজে গিয়ে খবর পেলাম, লোকটা গোলাম মিঞার মসজিদে উঠে গেছে। কেউ বলল, সে থাকে মাঝের চরের বিলে। তা বিলে নেমে শুনি, একটা লোক দুটো কুকুর সঙ্গে নিয়ে নৌকায় উঠে গেছে। লোকটা নাকি চারুকাকার মতো। তা কুকুর কেন? ধর্মরাজ তো একজন, দুটো কুকুরের মর্মার্থ উদ্ধার করা গেল না। একভাবে আট-দশ দিন ফের ঘুরে আসা গেল। চারু ফটাসের খবর পাওয়া গেল না।
কাকা ফিরে এসে প্রমাদ গুনলেন। কপালি ছুটে এসেছে—কাকাকে বলেছে, এক গণ্ডা চারু ফটাস বাড়িতে হাজির। নানা জায়গা থেকে লোকজন চলে আসছে চারু ফটাসের নামে। সঙ্গে সবার একজন চারু ফটাস। কপালির কাকারা গলদঘর্ম। বেছে চারজনকে রেখে দিয়েছে। যদি তারা চারু ফটাস হয়! তা কাকার যদি গালে দাড়ি থাকে, আর দাড়ি যদি কামিয়ে দেশে ফেরে—তবে চিনতে তো অসুবিধা হবেই। বিধুখুড়ি বিয়ের পিঁড়িতে গাল সাফ দেখেছিল, তারপর যে কী হল, ধর্ম এবং দুর্মতি দুই চারু মহাজনকে কাবু করে ফেলল। দু’নম্বরি কাজকারবার করতে গেলে গলায় তুলসীর মালাটি চাই। সাধু-সন্নেসি চেহারা চাই। মুখে, ‘হরি বল, জয় হরি’ ছাড়া কথা বলে না। কাকার এই ছদ্মবেশ খুলতে বিধুখুড়ি হিমশিম খেয়েছে। এখন এক গণ্ডা ছদ্মবেশীকে বৈঠকখানায় বেছে রেখে দেওয়া হয়েছে। কারও গায়ে গিরিমাটি রঙের আলখাল্লা, কেউ জটাজুটধারী। তা মচ্ছব চলছে। সকালে সবরি কলা, দুধ, মুড়ি। দুপুরে খিচুড়ি, পায়েস, বেগুনভাজা। রাতে মুগের ডাল, পটলভাজা, ছানার কালিয়া। বিধুখুড়ি ভাণ্ডার খুলে দিয়েছে। কপালি ঘরে ঢুকছে, বের হচ্ছে। কাকারা সতর্ক প্রহরায় আছে। তিনুকাকা না ফিরলে কাউকে ছাড়া হবে না।
কাকা আমাদের ডেকে বললেন, ‘ধন্দে পড়া গেল।’
‘কী ধন্দ কাকা!’
‘তোদের মাথায় সত্যি গোবর পোরা। বুঝিস না তোর তিনুকাকার সমূহ বিপদ! হাজার টাকা বেহাত!’
তারপর প্রশ্ন, ‘তুলসীর মালা আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে।’
‘বেঁটে গাট্টাগোট্টা দেখতে?
‘হ্যাঁ, তাই।
‘কেন যে চারু ফটাস ধর্ম এবং দুর্মতি বজায় রাখতে গিয়ে দাড়ি রাখল, টিকি রাখল, করবী ফুল শিখাগ্রে ঝোলাল! এতে কি বেশি সুবিধা!’ প্রশ্ন করলাম।
‘টিকি আছে কি না বল?’
‘তিনজনের আছে। একজনের নেই।’
‘নেই কেন!’
‘তা কী করে বলব!’
‘চল তো! চোরের ওপর বাটপাড়ি। দলে দলে চারু ফটাস সেজে চলে আসছে। দাড়ি গালে থাকলে বোঝাও দায়! আঁব আছে কপালে?’
‘একজনের আছে। তিনজনের নেই। আরও দু’জন আসছে। চারু ফটাস মোট ছ’জন। বাছাবাছির ঝামেলা।’
তিনুকাকা কপালিদের বাড়ি ঢুকলেন। গাঁয়ের আরও মানুষজন সঙ্গে। কেউ এসে উদয় হলেই লোক ভেঙে পড়ে মজা দেখার জন্য। সবাই মৌনীবাবা। শুধু জপ-তপ। চিমটা বাজানো। কেউ কথা বলে না। মহা দায়। বিধুখুড়ি বৈঠকখানায় চুপি দিয়ে একবার দেখে যায়। তার এক কথা, ‘মনে তো লয়।’
মনে লয় মানে, হতে পারে।
তিনুকাকা খেপে গেলেন। ‘মনে তো লয় মানে! চিনতে পারছেন না। মচ্ছব লাগিয়ে দিয়েছেন। সব ক’টাকে মেরে না তাড়াচ্ছি তো!’
বিধুখুড়ি তিনুকাকার প্রায় পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল, ‘না না, তিনুঠাকুর, দোহাই, সাধুসন্ত মানুষ, বিভূতির অন্ত নাই। তিনি যে নানা বেশে হাজির হননি কে বলবে! আছে যখন থাক। মেজাজ প্রসন্ন হলে স্বরূপে দেখা দেবেন। রোজ ঠাকুরকে ডাকছি, আমার বেয়াদপির অন্ত নাই ঠাকুর। স্বামী হল গে সতীর পরমায়ু—কেন বুঝছেন না। প্রসন্ন হলে স্বরূপে প্রকাশ পাবেন।’
তিনুকাকা বললেন, ‘হয়ে গেল!’
‘কী হয়ে গেল কাকা!’
আমাদের বাইরে টেনে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘চার চার হাজার টাকা গচ্চা! বউঠানকে ঠকিয়ে চার চার হাজার টাকা গায়েব। বোঝো এবার!’
বড়দা বলল, ‘আমরা তবে চারু ফটাস সেজে চলে আসি। আমরা চার ভাই—হবে না! চার চার হাজার টাকা, সোজা কথা!’
কাকা থম মেরে থাকলেন! কী ভাবলেন! নিজের ট্যাঁক থেকে পয়সা খরচ করে হ্যান্ডবিল ছাপালেন। বাজার-হাটে বিলি করতে থাকলেন—তাতে একটাই খবর। ‘চারুদা ফিরে এসো। তুমি ফটাস হয়ে গিয়ে ভাল কাজ করোনি! চারু মহাজন সেজে সবাই চলে আসছে। তোমার সব গায়েব।’
মাসাধিক কাল এই চলল। তারপর এক রাতে আমাদের বৈঠকখানায় কে কড়া নাড়ে! কাকা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। আমাদের ডেকে তুললেন। দরজা খুলে হ্যারিকেনের আলোতে দেখি, মাথা ন্যাড়া, গাল সাফ, বেঁটেখাটো মানুষ, তুলসীর মালা গলায় দাঁড়িয়ে কে এক মহান্ত। বগলে পুঁটলি। বলল, ‘চিনতে পারছ ঠাকুর?’
কাকার এক কথা, ‘না।’
‘আমি চারু। চারু মহাজন। দেশে ফিরে হাটেবাজারে কী সব খবর পেলাম। বাড়িতে চারজন চারু নাকি হাজির! আরও দু’জন আসছে!’
‘মেলা বকবে না। যাও। তুমিও দেখছি চারু সেজে চলে এসেছ?’
‘দোহাই তিনুকর্তা, আমি সত্যি চারু মহাজন। চারু ফটাস না। পরিবারের গঞ্জনায় মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। কামাখ্যায় গেলাম, শান্তি পেলাম না। হরিদ্বারে গেলাম, শান্তি নেই। সব দেখে চলে এলাম। কপালির কথা মনে হলেই পাগল পাগল লাগে। বৃন্দাবনে গেলাম। সব ধান্দা তিনুঠাকুর! যে যার মতো ধান্দায় ঘুরছে। গেলাম গয়ায়। মাথা মুণ্ডন করে ফেরার পথে হাটেবাজারে শুনি মেলা চারু। কেলেঙ্কারির এক শেষ! কী করি! বাড়ি গেলে আর-একজন চারু ফটাস হয়ে যাব। তুমি রক্ষা করো তিনুঠাকুর।’
‘হাজার টাকা চাই।’
‘দেব।’
‘হাজার টাকা, তোমার ভিটা-জমিতে ক্লাবঘর চাই। ফুটবলের মাঠ চাই। ইস্কুলের বাড়ি তুলতে হবে। টাকা চাই।’
‘সব দেব।’
আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোদের কিছু চাই?’
দাদা বলল, ‘একটা চামড়ার ফুটবল।’
‘আর কিছু না?’
‘না। আর কিছু না।’
তারপর সে অনেক পর্ব। সব ঝেঁটিয়ে বিদায়। চারু মহাজন অবশ্য কথা রেখেছে। ধর্ম এবং দুর্মতি একসঙ্গে সয় না ভেবে চারু শিখাটি ছেঁটে দিল। তুলসীর মালা নদীর জলে ফেলে দিয়ে সোজা একজন সাধারণ গেরস্ত হয়ে গেল।
১ মে ১৯১১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন