পৌলোমী সেনগুপ্ত
“ফ্যাঁ…শ।”
না, আওয়াজটা ঠিক বোঝানো গেল না। শুধু লেখা অক্ষরের মারফত বোঝানো যায়ও না বোধহয়। ও আওয়াজ ধরবার মতো বর্ণ-পরিচয় কোনও ভাষাতেই তৈরি হয়নি। শুধু উদাহরণ দিয়ে একটু বোঝাবার চেষ্টা করা যেতে পারে।
কী উদাহরণ দেব? এই যেমন একজোড়া কোরা কাপড় মাঝখান থেকে ধরে দু’হাতে ছিঁড়ে দু’ফাঁক করা।
না, শুধু তাই নয়, সে-কাপড় ছিঁড়ে দু’ফাঁক করার শব্দের সঙ্গে একটা ডুকরে উঠতে চাওয়া কান্নাকে যেন প্যাঁচানো ছিপি ঘুরিয়ে চেপে দেওয়া।
আওয়াজ যেমনই হোক, ভড়কালাম না। ভড়কাব কেন? খুঁজে-পেতে সাধ করে এমন একটা ডাকসাইটে কম-সে-কম দুশো বছরের পোড়ো বাড়িতে রাত কাটাতে এসেছি, এমন দু’-চারটে বুকের-রক্ত-জল-করা আওয়াজ শুনতে হবে না! এ আওয়াজ তো শুধু উপক্রমণিকা মাত্র। তার পর যা হতে পারে, তার জন্যেই তৈরি থাকা দরকার।
টর্চটা তাই একবার জ্বেলে পরীক্ষা করে নিলাম। হ্যাঁ, ব্যাটারি একেবারে নতুন। কালিমাড়া অন্ধকারে যেন সার্চ লাইটের মতো জোরালো রোশনাইয়ের তেজ নিয়ে ভাঙা দালানের উত্তরের হাঁ-করা জানলাটা বুনো লতা-পাতার ফাঁসে জড়ানো সবেধন নীলমণি দোমড়ানো শিকটা সমেত স্পষ্ট করে তুলল।
টর্চটা নেভাবার আগে কাছের বাতিদানে মোমবাতিটা জ্বেলে নিলাম। ধূপও জ্বালিয়ে দিলাম ক’টা। বহু কাল ইঁদুর-চামচিকের বাসা-হওয়া দালানের এঁদো ভ্যাপসা গন্ধটা একটু হাল্কা করবার জন্যে। তার পর গুপ্তি লাঠিটারও ওপরের খাপ খুলে, ভেতরের সড়কিটা ভাল করে দেখে নিয়ে খোলা অবস্থাতেই পাশে নিয়ে এই পাতাটা লিখতে বসলাম।
হাতঘড়িটায় দেখে নিলাম, রাত একটা বাজতে তিন মিনিট।
তিন মিনিটে না থোক, আর তিন ঘণ্টার মধ্যে যা হবার হবেই। আওয়াজের যে নমুনা দিয়ে পালাটা শুরু হয়েছে, তাতে রাত জাগার মজুরি ভাল করেই পোষাবে বলে মনে হয়।
এ পর্যন্ত লিখে কলমটা থামিয়ে চারিদিকে একবার তাকালাম। আবহাওয়াটা অনুকূল বলেই মনে হচ্ছে। বাইরে হাওয়া-টাওয়া নেই। মোমবাতির সলতেটা প্রায় নিষ্কম্প হয়ে জ্বলছে। নেহাত শীর্ণ একটা বাতি, তার আলো আমার বসবার জায়গা আর খাতাটা ছাড়িয়ে অতি ভয়ে ভয়েই যেন আবছা অন্ধকার দেয়াল আর ছাদের দিকে এগোতে গিয়ে থেমে আছে।
ঝিঁঝি-টিঝি নয়, কী একটা অজানা পোকা অন্ধকার নিস্তব্ধটাই যেন থেকে থেকে আচমকা কুরে কুরে ফুটো করবার চেষ্টা করছে।
কোরা কাপড় ছিঁড়ে দু’ভাগ করার সঙ্গে প্যাঁচানো ছিপিতে চেপে দেওয়া কান্না মেশানো যে আওয়াজটা খানিক আগে শুনেছিলাম, সেটা একেবারে থেমে গেলেও কিছু-একটা হবার সময় ঘনিয়ে আসছে বলেই মনে হয়।
লেখবার খাতাটা সরিয়ে রেখে তৈরি হয়ে বসলাম।
কোন দিক থেকে কী ধরনের চমকটা আসবে,তা ভাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। তবে এই ভাঙা দালানের মধ্যেই কিছু একটা হওয়ার কথা। আমার পেছনে নয়, সামনে।
পেছনে কিছু হওয়ার সম্ভাবনাটা একেবারে দেয়ালেই পিঠ দিয়ে বসে একরকম কাটিয়ে রেখেছি বলা যায়। ঝুল ধুলো সব সাফ করে তার জন্যে একটু খাটতেও হয়েছে। আগেকার দিনের তৈরি দেয়ালটা বেশ মজবুতই আছে এখনও। পুরনো পঙ্কের কাজ বেরঙা হয়ে উঠে গেলেও কোথাও ফাটল-টাটল ধরেনি।
তাই পেছনে কিছু হতে গেলে দেয়ালটা ভেঙে বা উড়িয়ে দিয়েই হবে। সে সুদূর সম্ভাবনাটা আপাতত বাতিল করে সামনের দিক সম্বন্ধেই সজাগ হলাম।
হয়তো দু’ পাশের পলস্তারা খসে হাড়পাজরা বেরোনো দেয়ালের ধারে জমে-থাকা ভাঙা ঘুণধরা সব আসবাবপত্রের স্তূপ, কিংবা সামনের ওই হাঁ-করা বিভীষিকার মতো জানলাটাতেই তাঁদের কারুর আবির্ভাব দেখব। মাথার ওপরকার প্রায় অন্ধকার ছাদটা থেকেও কিছু হতে পারে।
কিন্তু কই?
হাত-ঘড়িটায় মাঝে মাঝে আপনা থেকেই চোখ না দিয়ে পারছি না। পাঁচ দশ মিনিট করতে করতে বড় কাঁটাটা যে নীচের ছয়ের দাগ ছুঁই-ছুঁই করছে! অথচ সেই গায়ে-কাঁটা-দেওয়া প্রথম আওয়াজের পর আর কোনও সাড়াশব্দই নেই। অজ ধাপধাড়া এক আধা-জংলি মুল্লুকের অন্তত দশ-কুড়ি বছর পার-করা এক পোড়া ভিটের ভাঙা দালানের বদলে চৌরঙ্গির কোনও দোকানের দোতলায় বসে আছি ভাবলেও চলে।
দেড়টার দাগ পার হয়ে ঘড়ির বড় ছোট কাঁটা ক্রুমশ দুটোর কাছে পৌঁছে গেল। নিশুতি রাত ভেতরে-বাইরে ঝিমঝিম করছে।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার বেশি আর কোনও অভাবিত কিছুর একটু উঁকি পর্যন্ত নেই।
শেষকালে এত তোড়জোড় করে আসার হয়রানি, রাত জাগার এই ধকল সব মিথ্যে হবে নাকি?
এইটুকু লিখে বেশ একটু হতাশা নিয়েই খাতাটা আবার বন্ধ করলাম।”
***
খাতাটা বন্ধ করলাম আমিও এবং একটু নয়, রীতিমতো হতাশ হয়ে।
এত আশা এত আগ্রহ নিয়ে শুরু করার পর শেষ অবধি এমনি করে আহাম্মকের মার খাওয়া?
সমস্ত ব্যাপারটা এখন গোড়া থেকে একটু খুলে বলতে হয়। এতক্ষণ ধরে অধীর কৌতূহলে যা পড়ছিলাম তা একটি পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া অনেক-ঘাঁটাঘাঁটিতে ময়লা বেরঙা মোটা খেরো খাতা মাত্র। খাতার বদলে কাগজের বান্ডিল বললেও হয়। আলগা পাতাটাতা খসে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে একটা লাল শালুর পুঁটলির মধ্যে বাঁধা।
সেই অবস্থাতেই আমি পেয়েছিলাম শহরের বোধহয় সবচেয়ে লম্বা দৌড়ের পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাসে।
যাচ্ছিলাম বালিগঞ্জ হয়ে এয়ারপোর্টে। ভি আই পি রোড ধরে বাঙ্গুর কলোনি টলোনি ছাড়াবার পর আমার দিকের সিটগুলো কিছুটা খালি হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়েই বান্ডিলটা ঠিক আমার পাশেই দেখলাম। এ বান্ডিল যে কার, তার কোনও হদিশ মেলেনি। স্পষ্টই কাগজ ভরা আলগা বান্ডিল দেখে উপস্থিত সকলের সামনে খোলার পরও মালিকানাটা অজানাই থেকে গেছে।
দলিলপত্র বা দামি কাগজ-টাগজ নয়, নেহাত জড়ানো সেকেলে হাতের লেখায় ভরা একটা হাতে সেলাই সস্তা কাগজের খেরো খাতা দেখে সেটা আমার হাতে দিতে কারুর আপত্তি হয়নি। খাতাটা আগাগোড়া হাতড়ে নাম-ঠিকানা কিছু পেলে আমিই মালিককে পাঠিয়ে দেব বলে কথা দিয়েছি।
খাতাটা মালিকের কাছে পৌঁছে দেবার এই বেফায়দা ঝামেলা সাধ করে ঘাড়ে নেওয়াটা নেহাত পরোপকারের মহত্ত্ব নয়। বাসে সকলের সামনে বান্ডিল খুলে খাতাটা উল্টোবার সময় একটা এমন কথা চোখে পড়েছিল, যাতে সেটা একটু নেড়ে-চেড়ে দেখবার লোভ সামলাতে পারিনি।
বাড়িতে এনে আগাগোড়া নেড়ে-চেড়ে দেখেও সেই কথাটুকুর বেশি লেখক বা মালিকের নাম ঠিকানা কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। খাতার মধ্যে ছোট চিরকুট গোছের একটা চিঠির খসড়া পেয়ে তা থেকে কিছু হদিশ পাবার যে আশাটুকু হয়েছিল, চিঠি পড়বার পর তাও বরবাদ হয়ে গিয়েছে। চিঠির চিরকুটটি খাতার লেখক ও মালিকেরই যে লেখা, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু কাকে লেখা হচ্ছে বা কে লিখছে, তার কোনও পরিচয় সেখানে মেলেনি। চিঠিটি এইরকম—কল্যাণবরেষু, সরকার ভায়া, তুমি যে আস্তানার খবর দিয়েছ সেটা লোভনীয় বলেই মনে হচ্ছে। জোগাড়-যন্তর সব করে রাখো। আসছে অমাবস্যার দিনই গিয়ে পৌঁছোচ্ছি। আপাতত আগের বৃত্তান্তগুলো লিখে ফেলতে ব্যস্ত। ওসব জমিজমার হিসেবপত্র বড়কর্তাকে বুঝিয়ো। অমাবস্যার জন্যে তৈরি থেকো। আশীর্বাদ নিয়ো। ইতি মেজকর্তা।
চিঠিটা কোনও কারণে ফেলা হয়নি বলে এই মেজকর্তা নামটুকুই শুধু পেয়েছি! এই মেজকর্তা নামটুকু বাদে আর যে কথাটি প্রথমেই পেয়েছিলাম সেইটেই হল মোক্ষম।
কথাটা হল ভূত-শিকার! হ্যাঁ, মেজকর্তা যেই হন, তিনি এক সৃষ্টিছাড়া মানুষ। ভূত-শিকারই তাঁর নেশা। আঁদাড় পাঁদাড় বন-বাদাড় যত বেয়াড়া বিদঘুটে জায়গাই হোক, হদিশ কিছু পেলেই তিনি ভূত শিকার করে বেড়ান। এই খাতা তাঁর সেই সব শিকারের বৃত্তান্ত।
খাতার গোড়ার পাতার ভূমিকায় এই পরিচয়টুকু পেয়ে সত্যিকার রুদ্ধ-নিশ্বাসে মেজকর্তার পুঁথি পড়তে শুরু করেছিলাম।
কিন্তু এ কী ধরনের ঘাটের কাছে এসে ভরাডুবি।
তবু শুরু যখন করেছি, তখন যেমন করে হোক শেষ করার জন্যে পাতা উল্টে বাকিটা পড়বার চেষ্টা করলাম।
পড়বার আকর্ষণ কিছু নেই। মেজকর্তা নিজেই তাঁর আশাভঙ্গ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করছেন—
“কিন্তু খাতা বন্ধ করে রেখেই বা লাভটা কী? ঘড়ির কাঁটা ঘুরেই চলেছে। রাত এখন প্রায় তিনটে। কিছুই যে হচ্ছে না, সেটাও লিখে যাওয়া দরকার। এমন ভাবে যে রাতটা শেষ হবে, তা ভাবতেও পারা যায়নি। যা হল, তা যেন বড় বেশি আশা করার মুখে ভাগ্যের থাপ্পড়।
এমনটা যে হতে পারে, তার একটু আভাস একেবারে পাইনি এমন কিন্তু নয়। অবশ্য অখদ্দে স্টেশনটায় নেমে সাইকেল-রিকশা ভাড়া করার সময় কাছাকাছি অনেকে যে অবাক হয়েছিল, তা দেখে অসুখী হইনি। তাদের একটু সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসাতেও না।
‘কোথায় যাবেন বাবু? নৈহারের পাঁচকুঠি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু নৈহার যে শুধু জঙ্গল বাবু, আর পাঁচকুঠির একটাই শুধু ঘাড়মুড় গুঁজে পড়বার জন্যে কোনওরকমে খাড়া থেকে ধুঁকছে।’
তবু রিকশা একটা পেয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত। রিকশাওয়ালার গরজ বা সাহস অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। সেও কিন্তু নৈহারের পাঁচকুঠিতে পৌঁছে দিয়েই চলে যাবার কড়ারে সওয়ারি করেছিল। বেশি ভাড়ার লোভ দেখিয়েও তাকে সকালটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি করানো যায়নি।
রাস্তায় পাঁচকুঠি নিয়ে তার সঙ্গে একটু আলাপ করবার চেষ্টাতেও বিফল হয়েছি। নৈহারের এই জংলা অঞ্চলটা ভাল জায়গা নয়, আর পাঁচকুঠিতে তার বাপ-দাদারাও কখনও মানুষের বাস দেখেনি, এর বেশি সে কিছু জানে না বা বলতে রাজি হয়নি। কেন এই ঘোর অন্ধকার রাতে পাঁচকুঠিতে আমি যাচ্ছি, তাও সে জানতে চায়নি একবারও।
পাঁচকুঠির পোড়ো ভিটের কাছ-বরাবর আমার লাঠি আর কাঁধের ঝোলাটা নিয়ে রিকশা থেকে নামবার সময় অন্য সেই রিকশাওয়ালাকে দেখেছিলাম। আমাদের জন্যেই যেন সে অপেক্ষা করছিল ওখানে। আমাকে অমন জায়গায় একা নামতে দেখে অবাক যদি সে হয়ে থাকে, তার কথায় তা কিন্তু বোঝা যায়নি। কেন যে ওখানে নামছি, নিজে থেকেই যেন বুঝে নিয়ে সে একটু সহানুভূতির স্বরে শুধু বলেছিল, ‘পাঁচকুঠিতে রাত জাগবেন তো! তা জাগুন গিয়ে। কিন্তু তেনাদের কাউকে পাবেন না।’
‘তেনাদের?’ আমি একটু বিরক্তি আর না বোঝার ভান করে বলেছিলাম, ‘তেনারা? কী বলছ তুমি? কাদের কথা বলছ?’
‘ওই যাদের সবাই ডরায়, আবার খোঁজেও’— অন্ধকারেই লোকটার মুচকি হাসি যেন তার গলার স্বরে ফুটেছিল, ‘সোজা করেই তা হলে বলি। বলছি আমাদের ভূত-পেত্নিদের কথা। তাঁরা এখানে নেই।’
মেজাজটা এবার সত্যিই একটু গরম হয়েছিল। বিদ্রুপ করে বলেছিলাম, ‘তাঁরা নেই তো হয়েছে কী? আমি যে তাদের খোঁজে এসেছি, তোমাকে কানে কানে বলেছি সে-কথা?’
‘আজ্ঞে না, তা বলবেন কেন?’ লোকটা লজ্জা পেয়েই অন্ধকারে যেন জিভ কেটেছিল, ‘বেয়াদবি আমার মাফ করবেন।’
এইটুকু বলেই, লোকটা হঠাৎ যেন কান খাড়া করে একটু টান হয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘শুনতে পাচ্ছেন তো?’
ভাড়া নিয়ে আমার রিকশাওয়ালা তখন ফিরে যাচ্ছে। সেদিকে চেয়ে রুক্ষ গলাতেই বলেছিলাম, ‘কী, শুনব কী? ও তো আমার রিকশাওয়ালার ঘণ্টি।’
‘আজ্ঞে না।’ লোকটা এবার জোর দিয়ে বলেছিল, ‘সাইকেলের ঘণ্টি নয়, সরাইল্লার ডাক। সরাইল্লা আজ যখন আছে, তখন ভাবনা নেই।’
কী, বকছে কী লোকটা? পাগল-টাগলই তো মনে হয়। একটু ধমকের সুরেই বলেছিলাম, ‘কীসব বাজে বকছ? সরাইল্লা আবার কী?’
“আজ্ঞে সরাইল কুকুর! ওই শুনুন-না?’ লোকটা পোডড়া পাঁচকুঠির ভিটের দিকেই আঙুল দেখিয়েছিল।
সেদিকে ফিরে বেশ একটু মন দিয়েই শোনবার চেষ্টা করেছিলাম তারপর। কিছুই কিন্তু শুনতে পাইনি। সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে লোকটাকে খুব কড়া বকুনিই দিতাম। কিন্তু দেখি, বকুনিটা অনুমান করেই সে ইতিমধ্যে কখন নিঃশব্দে তার রিকশা নিয়ে সরে পড়েছে।
তার পর থেকে এই নিষ্ফল পাহারাই চলেছে। রাত তিনটে বিশ।
হঠাৎ, ও কী!
না, না, ওই তো! এবার ঠিক শুনতে পেয়েছি। লোকটা তা হলে মিথ্যে বলেনি। কুকুরের ডাক। যে-সে কুকুর নয়, সেই বিখ্যাত সরাইল কুকুরের জাত। কিন্তু ডাকটা আরও যেন হিংস্র আরও বুক-কাঁপানো।
সেই সেকালের পুব বাংলার সরাইল কুকুর এখানে কোথা থেকে আসবে, সে-কথা ভাববার মতো মনের অবস্থা নয়। সমস্ত শরীরটা শুধু যেন হিম হয়ে যাচ্ছে। অথচ লোকটা বলেছিল, সরাইল কুকুর যখন আছে তখন ভাবনা নেই। কেন বলেছিল সে-কথা? বোঝবার চেষ্টা করবার আগেই শিউরে উঠল শরীরটা। হচ্ছে! কিছু একটা হচ্ছে!
একটা শব্দ, না একটা গন্ধ, না শুধু একটা অনুভূতি, তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু মোমবাতির আবছা আলোটাই যেন একটা আতঙ্কের কাঁপুনি ছড়াচ্ছে।
গুপ্তি লাঠিটা কাছে টেনে টর্চের বোতামটা টিপলাম। কিন্তু আলো কই? টর্চ থেকে খানিকটা অন্ধকারের তোড়ই যেন সামনে গিয়ে হাঁ-করা জানলাটার ওপর পড়েছে। আর সেখানে? সেখানে সেই মাথা আর চোখ!
না, পুরুষ কি মেয়ে কি কঙ্কালের মুখ কি চোখ নয়! অজগর! অতি বড় দুঃস্বপ্নের কল্পনা-ছাড়ানো বীভৎস বিরাট ভয়ংকর এক অজগরের মাথা ধীরে ধীরে জানলার দোমড়ানো গরাদ আরও সরিয়ে পিছলে গলে আসছে, কালো বিদ্যুতের মতো কাটা জিভটা পলকে পলকে বার করতে করতে। মুখ আর জিভের চেয়ে ভয়ংকর তার চোখ। তাতে পলক পড়ে না, শুধু যেন সম্মোহনের সাঁড়াশিতে জাঁতাকলের চেয়ে সবলে চেপে ধরে অসাড় করে রাখে।
সেই মুহূর্তে সরাইলটাকে দেখলাম। কুকুর নয়, যেন কালো চিতারই একটা চাবুক-তীক্ষ্ন খুদে নমুনা!
অজগরটা জানলা দিয়ে গলে তখন নিয়তির মতো এগিয়ে আসছে। সরাইলটা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার মাথাটা লক্ষ্য করে।
সম্মোহনটা কি কেটে গেল তাইতেই? সড়কি-লাঠিটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এক লাফে। পাগলের মতো সেই সড়কির খোঁচার পর খোঁচা বসালাম অজগরটার গায়ে মাথায় চোখে। বিরাট কাছির মতো দেহটা তার কিলবিলিয়ে উঠল সেই দারুণ খোঁচায়।
কিন্তু কিন্তু সেই কিলবিলিয়ে ওঠার মধ্যেই সে সরাইলটাকে তার কুণ্ডলীর মধ্যে পাক দিয়ে ফেলেছে যে!
অক্লান্তভাবে সড়কি চালিয়ে চললাম। অজগরের মরণ-খিঁচুনি থেমে গেল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সেই সঙ্গে তার আলিঙ্গনে পিষে গুঁড়ো হওয়া সরাইলটারও।
নিজেকেও প্রায় বেহুঁশ হয়েই মেঝের ওপর শুয়ে পড়তে হল এবার। শুয়ে পড়বার আগে টর্চটা কোনওরকমে একবার অজগর আর সরাইলটার ওপর ফেললাম। না, দুটোই একেবারে শেষ হয়ে গেছে। মেঝেটা রক্তে আর অজগরের মুখের ফেনায় মাখামাখি।
বেশিক্ষণ নয়। মিনিট পাঁচেকের বেশি বেহুঁশ হয়ে থাকিনি। উঠে যখন বসলাম, তখন ঘড়িতে তিনটে পঁয়তাল্লিশ মাত্র।
মোমবাতিটা এরই মধ্যে কখন নিভে গেছে। টর্চের আলোতেই ঘড়িটা দেখে সেটা ঘরের মাঝখানে ফেললাম।
একটা অস্ফুট চিৎকার আপনা থেকে গলা ঠেলে বেরিয়ে এল তৎক্ষণাৎ।
হ্যাঁ, যা ভাবতেও পারিনি, সামনে তারই প্রমাণ।
মেঝের ওপর রক্তমাখা ক্ষতবিক্ষত অজগর কি তার আলিঙ্গনে পিষে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া সরাইল কুকুরটার চিহ্নমাত্র নেই। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে তারা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
তার মানে ‘তেনা’রা বলতে যা বুঝি, সে-ধারণাটা আরও ছড়াতে হবে। নইলে পাঁচকুঠির কোন আদ্যিকালের ওরা এমন করে হঠাৎ আমায় দেখা দিয়ে যাবে কেন?
* এ-কাহিনিটি চোখে পড়লে মেজকর্তা উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে তাঁর খেরোখাতাটা দাবি করতে পারেন। লেখাটি সেই উদ্দেশ্যেই ছাপানো।
এপ্রিল ১৯৭৬
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন