ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু

পৌলোমী সেনগুপ্ত

ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু

ডাকাত-সর্দার ঘণ্টাকর্ণ। ডাকিনীসিদ্ধও বটে, গুণজ্ঞান অনেক কিছু জানা। আসল নাম কেউ জানে না—কান দুটো অতি-বিশাল ও বেঢপ রকমের মোটা, সেজন্য ঘণ্টাকর্ণ বলে। কালাচিনি পাহাড়ের জঙ্গলে থাকে। হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে দলবল নিয়ে, গাঁ-গ্রাম জ্বালায়, ঘরবাড়ি লুঠ করে, মানুষ মারে। মেলা চর পর্বত জুড়ে ছড়ানো— তাদের এড়িয়ে দলের হদিশ পাওয়া দায়। আজ অবধি যে গেছে, সে আর ফেরেনি।

আমিই বা ফিরব কি না কে জানে? পুঁটলি বগলদাবায় তুলে নিয়ে অর্জুন রওনা হয়ে গেল। গাড়িতে যত দূর যাবার গিয়ে, তার পরে পায়ে হাঁটা। হাঁটছে, হাঁটছে—

খাদ বুঝি পাতাল অবধি চলে গেছে, ঝোরা নামছে। চারিদিকে ঝরঝর আওয়াজ তুলে। পথের ধারে গাছের সঙ্গে বাঁধা মড়া একটা—হাতে পায়ে গলায় আষ্টেপিষ্টে বেঁধেছে। শকুনে চোখ খুঁড়ে নিয়েছে, নেকড়েয় লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে— বীভৎস চেহারা। তবু রেখে দিয়েছে এমনি ভাবে। পথচারী তাকিয়ে দেখে ভয়ে পালাবে—মতলব বুঝতে দেরি হয় না।

হাতে গাদা-বন্দুক, গায়ে জবড়জং মোটা কম্বল, লোকটা সুনিশ্চিত পাহারাদার— অর্জুন তার সঙ্গে ভাব জমাচ্ছে, “ঘণ্টাকর্ণের এলাকায় এসে গেছি, তাই না সাহেব? খিদে পেয়ে গেল— জলের ধারে বসে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। তোমার পেটেও হরিমটর, মুখ দেখে বুঝেছি। পাহারা ক’মিনিট মূলতুবি রাখো, মড়া উড়ে পালাবে না। পুঁটলিতে যা আছে, দু’জনের হয়ে যাবে। চলো।”

বয়সে কত ছোট, তবু অর্জুন সমবয়সি বন্ধুর মতো হাতে হাত জুড়িয়ে টেনে নিয়ে চলল। বলে, “রাতদিন পচা মড়ার কাছে থেকে গা-ঘিনঘিন করে না?”

“করে না আবার। কিছুই মুখে দিতে পারিনে—বমি এসে যায়।”

অর্জুন চুক-চুক করে, “আপদ তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দাও দাদা, নইলে তোমাকেও অমনি মড়া হতে হবে। বেশি দেরি হবে না তার।”

প্রস্তাব বুঝে পাহারাদার আঁতকে ওঠে, “ঘণ্টাকর্ণ রক্ষে রাখবে না তা হলে।”

“টের পেলে তবে তো। এমনিই তো অর্ধেকের বেশি খতম। যেটুকু আছে, রিপোর্ট করে দিয়ো, নেকড়ের দল রাত দুপুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গেছে।”

একমুঠো টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে অর্জুন বলে, “অনেকদিন তোমার তো এই ল্যাঠায় গেল। গঞ্জে নেমে গিয়ে মনের সুখে খানাপিনা ফুর্তিফার্তি করোগে এখন। এদিকে যা করবার আমি করছি, তোমায় আর কিছু দেখতে হবে না।”

এদিকে-সেদিক চেয়ে দেখে পাহারাদার নিচু গলায় বলল, “ফাঁকা আছে—এই বেলা তবে সরিয়ে ফেলো। লোক এসে পড়লে হবে না।”

দ্রুত হাতে অর্জুন মড়ার দড়ি খুলছে। পাহারাদার এক পা নড়েনি। বলল, “পায়ের দড়ি খোলো কেন হে? টানতে টানতে বেশ নিয়ে যাবে।”

অর্জুন বলে, “পাথরে ঠোক্কর খাবেন যে!”

পাহারাদার হেসেই খুন। কথা শোন ছেলেমানুযের। মরে গিয়ে নিজেই তো এক পাথর। পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ব্যথা পাবে নাকি?

অর্জুন বলে, “মড়ার ব্যথা লাগবে কি না জানিনে, ব্যথা আমার মনে লাগবে। আজকের মড়া—সেদিন অবধি ইনি মানুষই ছিলেন, সে কথা ভোলা যায় না।”

আড়কোলা করে নিয়ে পরম যত্নে মড়া সে ঝোরার স্রোত নামিয়ে দিল। লহমায় অদৃশ্য।

যাচ্ছে অর্জুন। গাট্টাগোট্টা একজন জঙ্গল ফুড়ে হঠাৎ এসে পড়ল। “ও ছেলে, যাচ্ছ কোথা তুমি?”

“ঘণ্টাকর্ণ যেখানে থাকে।”

“কী দরকার?”।

“খুনে শয়তানকে খতম করব।”

“ভাল, ভাল!”— শতমুখে লোকটা তারিফ করল। বলে, “যেমন মন-ভরা দরদ তেমনি বুক-ভরা সাহস। কিন্তু ছেলেমানুষ যে তুমি।”

“ছেলেমানুষ বলে বুঝি অত্যাচার চুপচাপ দেখব? আমি হারিনে কখনও? ঘণ্টাকর্ণ চারিদিক মেরেধরে বেড়ায়, এবারে শুনতে পাবে মরেছে সে নিজেই।”

লোকটা না-না করে উঠল, “না হে মারার দরকার নেই। বেঁচে থাকবে সে, কান দুটো শুধু কাটা যাবে। তাতেই চরম শাস্তি। এত যে দাপট; মূলাধার হল কান। রূপকথায় শুনে থাকো সাতশো রাক্ষসীর প্রাণ কৌটোর ভোমরার মধ্যে। ভোমরা উড়ল তো রাক্ষসীদেরও শেষ। এ-ও তাই—কান গেলে ঘণ্টাকর্ণের সমস্ত যাবে।”

ঘণ্টাকর্ণের কর্ণছেদন! মজা লাগে ছেলেমানুষ অর্জুনের, হাততালি দিয়ে উঠল সে। ঘণ্টাকর্ণের কর্ণ গিয়ে শুধু ঘণ্টা হয়ে থাকবে সে।

লোকটা বলে, “সহজ হবে না—তা জেনো। গাছে যাঁকে লটকেছিল, তিনি হলেন কড়ুই পালোয়ান। নাম শুনেছ?”

“শুনেছি বইকী। কড়ুই বড্ড কড়কড়ে নাম—একবার শুনেই মনে গেঁথে যায়।”

লোকটা বলল, বুকে থাবা মেরে ‘কড়ুই মশায় এগিয়েছিলেন, পরিণামে তাঁরও ওই দশা। ছ’ মাস গাছের গায়ে ঝুলছিলেন, শেষটা তুমি এসে গতি করলে। এত কোমল মন, মড়ার পায়ের দড়ি ধরে টানতেও মায়া লাগল তোমার।”

চমক খেয়ে অর্জুন বলে, “জানলে কী করে তুমি?”

“ওখানেই ছিলাম তো। কেউ তোমরা দেখতে পাওনি—কী মজা! হি-হি-হি—’’।

আগে আগে চলল লোকটা।

অর্জুন প্রশ্ন করে, “যাচ্ছ কোথা?”

“ঘণ্টার ডেরা চেনো না তুমি?”

“চিনতে কতক্ষণ? কারও ভরসায় ঘর থেকে বেরুইনি— তুমি ফিরে যাও।”

ফেরার লক্ষণ নেই তার। বলে, “ঘণ্টাকে জব্দ করা চাট্টিখানি কথা নয়। তোড়জোড় অনেক করবার আছে।”

অর্জুন সদম্ভে বলে, “যা করবার একাই সব করব। না পারি, মরব। দয়া দেখিয়ে তুমি কেন মাথা বাড়িয়ে দিচ্ছ?” হেসে ফেলল লোকটা, “সুবিধা আছে হে। মাথা বাড়ালে কাটা যাবে না আমার মাথা। সে তাগত কারও নেই। খাপ্পা হচ্ছ কেন? যা করবার, এই তুমি করবে। হাত ছোঁয়াব না আমি, তোমার বাহাদুরির ভাগ নেব না। নিজের পায়ে যাচ্ছি, বলি পথ কি কারও একলার?”

নির্বিকার সে চলল, বেজার মুখে অর্জুন পিছু পিচু যাচ্ছে। একসময় সে বলে উঠল, “উঃ, কী নাছোড়বান্দা! নামটা কী তোমার—কী বলে ডাকব?”

“ভূতানন্দ। ভুতো বলেও ডাকতে পারো।”

পাহাড়-জঙ্গল চড়াই-উতরাই—এক-আধখানা কাঠের ঘর কদাচিৎ। তেমনি এক ঘরের সামনে ভূতানন্দ ঘোরতর চেঁচামেচি জুড়ে দিল, “কে আছ, দরজা খোলো শিগগির।”

খুলল দরজা এক সুন্দরী মেয়ে। নাক ঈষৎ চেপটা, তা ছাড়া নিখুঁত চেহারা। ভূতানন্দ বলে, “তাড়াতাড়ি দু’কাপ চা দাও ম্যাডাম। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি।”

সুন্দরী হাতের দুটো আঙুল দেখিয়ে বলল, “দু’ টাকা—নগদ।”

চোখের ইশারা করল ভূতানন্দ, অর্জুন মুহূর্তের মধ্যে টাকা বের করে দিল। এই রকমই শিখিয়ে এনেছে— ভূতানন্দ মুখে তেমন নয়, ইশারায় প্রায় সব বলবে। এবং ইশারা পাওয়া মাত্র অর্জুন সেই কাজ করবে— তিলার্ধ গড়িমসি নয়, তা হলে র্সবনাশ।

মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল, “জল চাপানো আছে, এক্ষুনি হয়ে যাবে। ঘরে আসুন আপনারা—ঘরের মধ্যে ঠান্ডা কম। আরাম করে বসুন।”

বলে কোণের দিককার মস্ত বড় পাথরখানা দেখিয়ে দিল।

অর্জুন করল একেবারে উলটোটি—নিজেরা না বসে মেয়েটার হাত ধরে দিল প্রচণ্ড ধাক্কা। আচমকা আক্রমণ সামলাতে পারল না সে, হুমড়ি খেয়ে পাথরের উপর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পরমাশ্চর্য ব্যাপার— সুন্দরী মেয়ে হয়ে গেল কুৎসিত কালো থুথুড়ে এক বুড়ি, সেঁটে গেছে সে একেবারে পাথরের সঙ্গে—উঠে দাঁড়ানোর উপায় নেই। মাথা-ভরা জটা— জটা দুলছে লকলক করে অগুনতি হেলেসাপের মতন। আগুনের ভাঁটার মতো বড় বড় চোখ ঘোরাচ্ছে বুড়ি একবার অর্জুনের দিকে, একবার বা ভূতানন্দের দিকে। বলে, “কারা তোরা, কী চাস?”

ভূতানন্দ ব্যঙ্গের সুরে বলে, “মতলব বানচাল হয়ে গেল— আহা রে?”

জটাবুড়ি গজরাচ্ছে, “ছাড় করিয়ে দে এখনি। ভালর তরে বলছি, নয়তো রক্ষে রাখব না।”

ভূতানন্দ ঠান্ডা গলায় বলল, “ধমকধামাকে কাজ হবে না। নতুন যে খাণ্ডা এসেছে— কোথায় সেটা বলে দে। তবে ঘাড় পাবি।”

জটাবুড়ি উড়িয়ে দেয়। “কোন খাণ্ডা কবে এল আমি কিছু জানিনে।”

ভূতানন্দের ঠিক সমান সমান জবাব, “কোন কায়দায় পাথর খসাতে হয়, আমরাও জানিনে কিছু। চলো হে অর্জুন, দুয়োর বন্ধ করে এসো, শয়তান বুড়ি পাথরের সঙ্গে আঁটা হয়ে থাকুক।”

সত্যিই যায় চলে। জটাবুড়ি তাড়াতাড়ি তখন ডাক দেয়। “শোননা হে শোনো। পাশাপাশি দুটো ঘর ছেড়ে তারপরে চৌকো ঘর— ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে এক হাত মাটির নীচে সেইখাণ্ডা। তুলে নাও গে, তার আগে আমায় ছাড়া করিয়ে দিয়ে যাও।”

ভূতানন্দ বলে, “জিনিসটা পাই আগে হাতে, সত্যি বলছিস না মিথ্যে বলছিস পরখ হোক। ছাড়ের বিবেচনা তার পরে।”

দুজনে গেল সেই ঘরে ঘরে— উত্তর-পশ্চিম কোণে। হাতে-নাতে কিছু করবে না, ভূতানন্দ কথা দিয়েছে— সে শুধু নির্দেশ দিচ্ছে, মরছে একা অর্জুনই। না, মিথ্যে বলেনি বুড়ি—মাটির নীচে পাওয়া গেল একটা বাক্স, বাক্সের ভিতর খাণ্ডা। খাঁড়ারই রকমফের। আয়তনে অতি ছোট, ছেলেভুলানো জিনিস মনে হবে, ফলাখানা ইঞ্চি আষ্টেকের বেশি নয়। কিন্তু সাংঘাতিক ধারালো।

প্রাচীন এক ফারগাছের গুঁড়িতে অর্জুন আলগোছে ঠেকাল, খাণ্ডা যেন মাখনের দলা কেটে বেরিয়ে গেল। মহীরূহ হুড়মুড় করে পড়ল। তারপর যত্রতত্র ঠেকাচ্ছে, গুড়ি খণ্ড খণ্ড হচ্ছে।

ভূতানন্দ তাড়া দেয়, “খেলা রাখো অর্জুন, বেরিয়ে পড়ো এইবার।”

অর্জুন শুধায়, “বুড়ির ছাড় হবে না?”

“রক্ষে রাখবে তা হলে? জটা হল ঘণ্টার পয়লা নম্বর ডাকিনী। হাতিয়ারপত্তরসমস্ত ওর হেপাজতে— বেরুনোর মুখে নিয়ে নেয় ঘণ্টারা, কাজ-অন্তে ফেরত দিয়ে যায়। মুখ-পাতে থেকে ঘাঁটি আগলাবে। জটাকে আটকানোই আসল, খাণ্ডা তোমার উপরি লাভ।”

যেতে যেতে অর্জুন বলে, “উঃ, এত সব খবর আছে তোমার ভুতোদা। তুমি না থাকলে সত্যিই অসুবিধা হত।”

ভূতানন্দ বলে, “জটাবুড়ি আটক না হলে ঘণ্টাকর্ণ জেনেই যেত এতক্ষণে। কড়ুই পালোয়ান কম লোক ছিলেন না, সুলুক সন্ধান অনেক ছিল তাঁর। তবু ধরা পড়ে গেলেন, ধরে ফেলে গাছে লটকে দিল।”

আরও একবেলার পথ গিয়ে আবার এক বাড়ির সামনে তারা। পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি, পাথরের পর পাথর সাজিয়ে পাঁচিল বানিয়েছে। ইশারা করেছে ভূতানন্দ, পাঁচিলের দরজায় অর্জুন জোরে জোরে ঘা দিচ্ছে। ভূতানন্দ বলছে, “দুয়োর খোলো। খদ্দের আমরা— খোঁজে খোঁজে বিস্তর দূর থেকে আসছি।”

খুলে গেল দরজা। এখানেও মেয়ে—মাঝবয়সি একজন, হাসি-হাসি মুখ। পাখি ধরার ব্যবসা এদের, উঠোনে পা দিয়েই মালুম হয়। মেলা খাঁচা ঝুলছে এদিক-সেদিকে, খাঁচার ভিতর রং-বেরঙের পাখি। গুলতি তিরধনু সাতনলা— পাখি ধরার নানান সরঞ্জাম। সূক্ষ্ম সুতোর জাল বিছানো উঠোনে উপর— এত সূক্ষ্ম যে পাখির নজরেই পড়ে না, আধার খেতে বসে জালের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।

অর্জুনকে ভূতানন্দ বিড়বিড় করে বলে, “অত সরু সুতো, কিন্তু বিশ মন পাথর ঝুলিয়ে দিলেও ছিঁড়ে পড়বে না।”

মেয়েটা একগাল হেসে শুধায়, “বলুন কী আদেশ।”

ভূতানন্দ বলে, “হীরামন তোতা চাই। মনিব আমাদের ভারী শৌখিন—তাঁর ফরমাস। আছে তোমাদের কাছে?”

“আছে বইকী। এখানে না থাকলে দুনিয়ার কোথাও থাকবে না।”

মেয়ে ঘাড় তুলে তীক্ষ্ণ চোখে ভূতানন্দের আপাদ-মস্তক দেখে নিল একবার। বলে, “হীরামন কি বাইরে রাখার জিনিস? কুঠুরির ভিতর আছে, ঢুকে গিয়ে দেখো। ঘাঁটিয়ে ঘাঁটিয়ে পাখির কথা শোনো গে। হীরামনের নাচ দেখিয়ে দেব এর পর, গানও শোনাব। দাম কিন্তু অনেক পড়বে।”

ভূতানন্দ বলল, “মনিব-মশায় মস্ত বড় ধনী। আসল হীরামন হলে দামের জন্য আটকাবে না।”

কথা বলতে বলতে ছোট্ট এক কুটিরের সামনে এসে গেছে তারা। মেয়েটা দেখায় “পাখি ওই ভিতরে।”

বলার শুধু অপেক্ষা—ভূতানন্দের ইশারা পেয়ে অর্জুন প্রচণ্ড ধাক্কা দিল পিঠে, চৌকাঠ গলে হুমড়ি খেয়ে মেয়ে ভিতরে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তর— খুনখুনে বুড়ি, সর্বাঙ্গে দগদগে ঘা, মাছি ভনভন করছে ঘায়ের উপর। বীভৎস মুখ, তাকিয়ে দেখা যায় না। চোখের মণি একটা গলে বেরিয়ে এসেছে। বাঁ-হাতেরও আধাআধি পচে গলে খসে পড়ছে।

ভূতানন্দ হি-হি করে হাসে, “চুম্বক-কুঠুরিতে আমাদের ঢোকাচ্ছিলি—যেমন কর্ম তেমনি ফল, নিজেই এবার আটক হয়ে গেলি।”

বুড়ির কান্নাকাটি এখন। ‘‘আপনাদের চিনতে পারিনি হুজুর। বাঁ-হাত ধরে কষে একটা হ্যাঁচকা টান দিন, কুঠুরি থেকে বের হয়ে পড়ব।”

“যা বলবি, সমস্ত করব। সুতোর সেতুর বুনন শেষ করে ফেলেছিস—আমরা সকল খবর রাখি। সেতু কোথায় রেখেছিস, বলে দে আগে। কুঠুরি থেকে বেরুনো তার পরে।”

“সেতু বোনা— সে আবার কেমন?” কুটে বুড়ি আকাশ থেকে পড়ে; ‘পাখি ধরা জাল বুনেছি—সে ওই উঠোনের উপর বিছানো। জাল ছাড়া আর আমি কিছু বুনিনে।”

ভূতানন্দ খিঁচিয়ে উঠল, “চালাকি করবি নে কুটেবুড়ি। বুননের তুই বড় ওস্তাদ, ধড়িবাজিতে আরও বড়। প্রাণের পরোয়া না করে সমস্ত খবর আমি জুটিয়ে ফেলেছি। খাল পারাপারের অসুবিধা বলে ঘণ্টাকর্ণ তোকে সুতোর সেতু বুনতে হুকুম দেয়। সেই সেতু শেষ করেছিস ক’দিন আগে। মিহি সুতোয় এমন খাসা বুননি— লম্বায় একশো হাত, তবুনাকি গুটিয়ে থলির মধ্যে ভরা যায়।”

তবু বুড়ি প্রতিবাদ করে, “মিথ্যে কথা। আপনাদের ঝুটো খবর দিয়েছে।”

রাগ দেখিয়ে ভূতানন্দ বেরিয়ে যাচ্ছে, অর্জুন পিছনে। বলে, “দিসনে সেতু—বয়ে গেল। পার হওয়া আটকে থাকবে নাকি—গাছে চড়ে পার হয়ে যাব। তোর জীবন অন্ধকারেই কাবার হবে, পাকা ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। কুলুপ এঁটে দিয়েছ তো অৰ্জুন, চাবি নিয়েছ?”

এগিয়েছে কয়েক পা, পিছনের ব্যাকুল ডাক আসে— “ফিরে আসুন, রাগ করে যাবেন না। দেয়ালের গায়ে থলিতেই ঝোলানো আছে, নিয়ে নিন গে। ধর্ম রাখবেন কিন্তু, কুঠুরির ধার করে দিয়ে যাবেন।”

সেতুর থলি অর্জুন বগলদাবায় নিয়ে নিল। ভূতানন্দ তাড়াতাড়ি বেরুচ্ছে— হেঁটে নয়, উড়ে চলেছে সে যেন। অর্জুন প্রশ্ন করে— ‘‘কুটেবুড়িও আটক থাকবে?”

“ওকে আটকানোর জন্যেই তো এবাড়িতে ঢোকা। ঘণ্টাকর্ণের দু’নম্বুরি ডাকিনী— জটাবুড়ির নজর ফসকে কেউ যদি অ্যাদ্দূর এসে গেল, কুটেবুড়ি তাকে ধরে ফেলবে। সুতোর সেতু আমাদের উপরি লাভ—সেতু খাটিয়ে চট করে খাল পার হয়ে যাব। নয়তো ঝঞ্জাট ছিল অনেক, বিপদের ভয়ও ছিল।”

আবার কিছুদুর গিয়ে টুপির দোকান। দরজার পাশে বসে ওস্তাগর টুপি সেলাই করে, খদ্দের এলে ঘুরে ঘুরে টুপি দেখায়। ভূতানন্দ ও অর্জুন ঢুকে পড়ল। নানা রঙের নানা সাইজের রকমারি টুপি—ভূতানন্দের একটাও তবু পছন্দ হয় না। বলে, “ধুলোয় আর রোদ্দুরে মাল সব লাট হয়ে গেছে। গেল বছর নিয়েছিলাম, তেমনধারা জিনিস দেখছি নে। সে টুপি তুমি পিছনের ঘর থেকে বেছে-গুছে এনে দিয়েছিলে।”

ওস্তাগর বলল, ‘‘পিছনের ঘর থেকে এবারও নিয়ে আসছি। খদ্দের ফিরতে দেব না।”

পিছনের ঘরে গেল। যে-ই না গিয়েছে—আগে থেকে অর্জুনকে তালিম দেওয়া আছে দস্তুর-মতো— চৌকির নীচে থেকে পুরনো ময়লা শতচ্ছিন্ন এক টুপি তুলে নিয়ে দে ছুট। ভূতানন্দও পিছনে রয়েছে। আশ্চর্য টুপি—মাথায় পরলে সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য, জলজ্যান্ত একটা মানুষ ঘুরছে ঘুণাক্ষরে কেউ বুঝবে না।

অর্জুন বলল, “এক টুপিতে তোমার আমার দুজনের কী করে হবে?”

ভূতানন্দ বলে, “তোমার হলেই হবে। আমার মাথায় টুপি লাগে না, মন্তোরে বাতাস হয়ে যাই। কড়ুই পালোয়ানের মড়া ঝুলছিল, আমি তো সেখানেই। দেখতে পেয়েছিলে আমায়? বলো।”

অনতিদূরে খাল। চওড়া সামান্য, কিন্তু স্রোত করাল। কুটোগাছটি পড়লে দু’খণ্ড হয়ে যায়। পারাপারে বিপদের শঙ্কা। ডালপালা-মেলানো গাছ আছে খালের এপারে, এবং ওপারেও। গাছে চড়ে লোকে খালের উপর ডালের শেষ প্রান্ত অবধি চলে যায়, সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ওপারের গাছে। পা ফসকালেই প্রাণ যাবে, গিয়েছেও অনেক প্রাণ এতাবৎ। ভূতানন্দের বন্দোবস্তের গুণে এরা একেবারে নির্বিঘ্নে ঘণ্টাকর্ণের ফরমায়েসি সেতু অর্জুনের বগলদাবায়।

সেতুর এক মাথা গাছের সঙ্গে বাঁধল, ও-মাথায় একটা পাথর বেঁধে ছুঁড়ে দিল অর্জুন ওপারে। তাক অব্যর্থ, ঠিক লক্ষ্যস্থানে গিয়ে পড়েছে— এদিকে-ওদিকে সামান্য টানতেই ফটাস করে পাহাড়ের খাঁজে পড়ে গেল। হাতখানেক মাত্র চওড়া সেতু ভূতানন্দ তার উপর দিয়ে অবলীলাক্রমে পার হয়ে গেল। একটুও টলল না— কলকাতার কোনও মসৃণ পিচের রাস্তায় চলে গেল যেন৷ অৰ্জন কিন্তু টালমাটাল খাচ্ছে খুব। তার মধ্যে হঠাৎ ভূতানন্দ ব্যস্তসমস্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “চলে এসো শিগগির খুব শিগগির লাফ দিয়ে পড়ো ডাঙায়।”

অর্জুন লাফিয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখে, ওস্তাগর দল জুটিয়ে পিছনে ধাওয়া করেছে। তাগড়া তাগড়া জওয়ান, হাতে চকচকে খোলা তলোয়ার সেতুর মাঝামাঝি তারা এসে গেছে। ভূতানন্দ চেঁচাচ্ছে, “সেতু কেটে দাও।” খাণ্ডা ছোয়াতেই সেতু দুই খণ্ড ওস্তাগর দলসুদ্ধ ঝপাঝপ খালে পড়ে ভেসে গেল। আপদের শান্তি।

সামনে দেখা যায় ঘণ্টাকর্ণের ডেরা। আসল কাজ— এইবার— ঘণ্টাকর্ণের কান কাটা। ভূতানন্দ বলে দেয়, “মাথায় টুপি এঁটে চলে যাও এইবার, কানজোড়া টুক করে কেটে নিয়ে ফিরে এসো। এই লতাপাতার উপর ততক্ষণ একটু গড়িয়ে নিই। আমাকে এখানেই পাবে।”

বলতে বলতে ভুতানন্দ আর নেই। বাতাস হয়ে গেছে নাকি? টুপির গুণে অর্জুনও অদৃশ্য। গোড়ায় সেটা মালুম হয়নি তার। কিন্তু ঘণ্টাকর্ণের সাঙ্গোপাঙ্গরা কাজেকর্মে ঘোরাফেরা করছে- অর্জুন সামনের উপর, তার দিকে কেউ তাকিয়েও দেখে না— অবস্থা বোধগম্য হল তখন।।

তবে আর ভাবনাটা কী? ঘণ্টাকর্ণ খেতে বসেছে, অর্জুন কাছে গিয়ে কানে তাক করছে। গণ্ডারের চামড়ার চেয়েও শক্ত চামড়ার কান, হাতির কানের চেয়েও আয়তনে বড়। এহেন বস্তু খাণ্ডার স্পর্শমাত্রেই টুকটুক করে খসে পড়ল। হুঙ্কার তুলেছিল ঘণ্টাকর্ণ, কণ্ঠ সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে গেল। মুহূর্তে রূপান্তরকর্ণহীন ঘণ্টা হাত-পা গুটিয়ে পিণ্ডাকার হয়ে পড়ল। কানদুটোর পাতাতেই ঘণ্টার যাবতীয় দাপট সে কান গেল তো সর্বস্ব গেল। এখন থেকে মেনি বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে বেড়াবে সে।

কাটা কান দুটো কাঁধে তুলে নিয়ে বিজয়ী অর্জুন গটমট করে যাচ্ছে। খালের ধারে এসে টুপি খুলে আবার আপন মূর্তিতে ফিরল। “ভুতো-দা”— ডাকতে-না-ডাকতেই দেখা যায় ভূতানন্দ পাশটিতে দাড়িয়ে হাসছে। বলে, “বাহাদুর বটে অর্জুন! মুখে মুখে যা বলে দিয়েছি— ভুল করোনি, ভয় পেয়ে যাওনি নিখুঁতভাবে হাসিল করে এলে। যেমনটা তুমি চেয়েছিলে— একলা হাতেই সব করেছ, আমি হাত ঠেকাইনি।”

পরক্ষণে বলে, “হাত ঠেকানোর উপায়ও নেই। আমার ভাই।”

“কেন? কেন?”

“হাত-ই নেই যে। থাকলে বাহবা বাহবা বলে নিশ্চয় তোমার পিঠ চাপড়ে দিতাম। ইচ্ছে হচ্ছে খুব, কিন্তু নিরুপায়।”

কণ্ঠস্বর কেমন ভারী হয়ে এল। বলে, “পা-ও নেই। এত যে হাঁটা-চলা করি— পায়ের হাঁটা নয়, মাটির গা ঘেঁষে ভেসে ভেসে বেড়ানো। গায়ে হাত দাও আমার, বুঝতে পারবে।”

অবাক কাণ্ড। চামড়া-হাড়-মাংস নেই, কঠিন বস্তু কিছুই নেই নরমূর্তিতে খানিকটা ধোঁয়া। ধোঁয়া মূর্তি ধরে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে

স্তম্ভিত অৰ্জুন বলে, “কে তুমি ভুতো-দা? সত্যি কথা বলো।”

ভূতানন্দ— “বলেছি তো আগে।”

“মানুষ নও?”

“ছিলাম সেদিন অবধি।—পালোয়ান আনন্দ কড়ুই। মরে ভূত হয়ে গিয়ে আনন্দ কড়ুই আজ ভূতানন্দ।”

৫-১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন