পৌলোমী সেনগুপ্ত
অরণ্যদেব সব কথাতেই একটু রং মাখিয়ে দেয়। ফলে ওর কথা কেউ বিশ্বাস করতেই চায় না। কথাটা হয়তো সত্যি, কিন্তু ও এমনভাবে বলবে যে, মেনে নেওয়াই কঠিন। এই যেমন সে দিন অরণ্যদেব বলল, “জানিস তো বীরভূমে অট্টহাসির মন্দির নামে একটা মন্দির আছে। মন্দিরের ভেতরটা কী ভীষণ অন্ধকার! ভেতরে ঢুকলে নিজেকে ছায়ার মতো মনে হবে।”
“তারপর?” চিত্ররূপ চোখ বড় বড় করে জানতে চেয়েছে। সুহিতা বুঝতে পারছিল, এটা চিত্ররূপের দুষ্টুমি। অরণ্যদেবের পেছনে লাগার চেষ্টা।
“যেই না মন্দিরে ঢুকবি সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে শুরু হবে অট্টহাসি—হাঃ হাঃ হা-হা-হা। কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। ভয়ে শুকিয়ে যাবে বুক। পালিয়ে আসতে পথ পাবি না।”
“সে কী রে! মন্দিরে ঢোকার দরজা দিয়েই তো বেরিয়ে আসব!” চিত্ররূপ ঠোঁট উলটে খুব তাচ্ছিল্য দেখিয়ে বলেছিল।
সুহিতা মৃদু হেসে ওকে থামাতে বলেছে, “আঃ, তুই একটু চুপ করবি! অরণ্যকে বলতে দে-না!”
ঢোক গিলে অরণ্যদেব বলেছিল, “না, না, পালাতে তো পারবিই। সবাই পালায়। আমি বলছিলাম কী, ওই হাসির চোটে মাথা ঘুলিয়ে যায়। দিশেহারা বলে একটা কথা আছে না, তাই হয় আর কী! আবার মন্দির থেকে যেই বেরিয়ে আসবি, সব চুপচাপ। কোথায় তখন বীভৎস অট্টহাসির শব্দ! একেবারে নিঃঝুম।”
“বুঝলাম।” চিত্ররূপ জ্যাঠামশাইয়ের মতো মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, “তা মন্দিরের মধ্যে কে হাসে?”
“একজন হাসে নাকি!” অরণ্যদেব দ্বিগুণ উৎসাহে বলেছে, “অনেকে হাসে। নানা হাসির শব্দ। মন্দিরে কোনও ঠাকুর-দেবতা আছেন কি না আমি অবশ্য জানি না বাবা। তবে…”
অরণ্যদেব আরও কী সব বলতে যাচ্ছিল, চিত্ররূপ ওকে জোর করে থামিয়ে দিয়ে বলেছে, “গুলটা একটু কম করে দিতে পারিস না! যে মন্দিরে লোকজন নেই, দেবদেবী নেই, ভিড়ভাট্টা নেই, সেখানে আবার হাসবে কে রে! যত্ত সব কালার্ড গুল! তোর একটা কথাও বিশ্বাস করি না।”
মৃদু গলায় সুহিতা বলেছিল, “হায়েনার মতো কোনও জন্তুটন্তু কিংবা কোনও অজানা পাখি মন্দিরের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে হয়তো থাকে। ওটাই হয়তো ওদের আস্তানা। মানুষ দেখলে সেই হয়তো ভয় দেখায়।”
“নো সুহিতা।” চিত্ররূপ ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলেছে, “অসম্ভব। তুই তিনটে ‘হয়তো’ বলেছিস। এত ‘হয়তো’ যেখানে এসে যাচ্ছে সেখানে আর যাই থাক, বিজ্ঞানও নেই, সত্যও নেই।”
অরণ্যদেবের মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে একটু বিষাদের ছোঁয়া। সুহিতার তখনই মনে হয়েছিল, অরণ্য পুরোটাই বানিয়ে বলেনি। সবটাই মিথ্যে নয়। বাড়িতে এসেই বিতানদাকে সুহিতা পুরো গল্পটা বলেছিল। বিতান ওর মামাতো দাদা। বড়মামার ছেলে। ওদের বাড়ি ঝাড়গ্রামে। বিতানদা এখন ডাক্তারি পড়ছে মেডিক্যাল কলেজে। তাই সুহিতাদের কলকাতার বাড়িতে এসে আছে। বিতানদা সব ব্যাপারেই সিরিয়াস। কত বিষয়ে ওর আগ্রহ। ঠিক বইয়ের পোকা নয়। অথচ নানা বিষয়ে ওর পড়াশোনা করা আছে। এখনও মাঝে মাঝেই ডাক্তারির মোটা মোটা বই সরিয়ে রেখে অন্য বইয়ের জগতে ডুবে যায়। সুহিতার কাছ থেকে শুনেই বলল, “দাঁড়া, দাঁড়া, এ রকম মন্দিরের কথা কোথায় যেন পড়েছি!”
“অট্টহাসির মন্দির! তাই নাকি!” সুহিতা তো অবাক!
“হ্যাঁ রে, তুই আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দে। আমি তোকে সত্য-মিথ্যে সব জানিয়ে দেব।”
পরদিন সকালে বাড়িতে চায়ের পর্ব চুকে যেতেই বিতানদা ওর ঘরে ডেকে নিয়ে গেল সুহিতাকে। বাংলার মন্দির-মসজিদ-গির্জা বা ওই-জাতীয় কোনও বই থেকে গড়গড় করে বিতানদা পড়ে গেল। হ্যাঁ, অট্টহাস মন্দির নামে একটা মন্দির আছে। তবে অট্টহাসি নয়। বীরভূমের নিরোল নামে একটি জায়গায়। ঈশানী নদীর পাড়ে জঙ্গলে ঘেরা একটি স্থানে সেই মন্দির। কীর্ণাহার থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার বাসে গেলে নিরোল। বাস থেকে আবার চার কিলোমিটার হাঁটাপথে বা রিকশায়। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, অট্টহাস মন্দির সতীপীঠের অন্যতম। এখানে দেবীর ঠোঁট পড়েছিল। ঠোঁটের সূত্রেই হয়তো হাসির অনুষঙ্গটা এসেছে। তবে মন্দিরে ঢুকলে অট্টহাসির শব্দ পাওয়া যায় না। কেউ হাসে না তো বটেই ওই মন্দিরে, কোনও মূর্তিও নেই। দর্শনার্থীর সংখ্যাও কম। যাতায়াতের সুব্যবস্থা নেই বলে লোকে নানুরে বেড়াতে যায়, অথচ নিরোলে যায় না।
বিতানদা হেসে বলেছিল, “তোদের বন্ধু একেবারে বাজে কথা বলেনি। দুর্গম কোনও মন্দির, দুর্গ বা জঙ্গল নিয়ে এমন গালগল্প হামেশাই গড়ে ওঠে। ও হয়তো কারও কাছ থেকে শুনেছে।”
সুহিতা ভেবেছিল পরদিনই চিত্ররূপকে বলবে, ‘দ্যাখ, অরণ্য পুরোপুরি গুল দেয়নি। ওই রকম একটা মন্দির সত্যিই আছে।’ কিন্তু সে দিন চিত্ররূপ বা অরণ্যদেব কেউই ক্লাবে আসেনি। এখন শীতকাল। কলেজ স্কোয়ারে ওদের সাঁতারের ক্লাবে এখন নিস্তরঙ্গ-পর্ব চলছে। পুলের জল শুকিয়ে গেছে। পুকুরের মাঝখানে যেটুকু জল আছে, তাতে সাঁতার কাটা চলে, শেখা চলে না। তবু ওরা বিকেলের দিকে প্রায়ই ক্লাবে আসে। সবাই মিলে গল্পগুজব করে। মিন্টুদার দোকানের গরম-গরম ঝোল-ঝোল ঘুগনি খায়। বন্ধুদের সঙ্গে সুহিতার যে দিন দেখা হল, সে দিন কথায় কথায় ও ভুলে গেল অট্টহাস মন্দিরের প্রসঙ্গটা। ভুলে যাওয়ার অবশ্য আর একটা কারণও ছিল। ওদের ক্লাবের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি শক্তিবাবু সেদিন চিত্ররূপদের দেখতে পেয়ে কাছে এসে বলেছিলেন, “এই যে তিন হুল্লোড়বাজ, এই ভাবে সময় নষ্ট করলে হবে! সুভাষ সরোবরে আশিসের থিয়োরির ক্লাসগুলো তো অ্যাটেন্ড করলে পারো!”
“সার, আমরা দু’দিন গিয়েছিলাম। ভাল লাগেনি।” অরণ্যদেব মাথা চুলকে বলেছে, “জল ছাড়া কি আর মাছেদের ভাল লাগে!”
“খুব পাকা-পাকা কথা বলতে শিখেছ তো?” শক্তিবাবু ঠিক রাগ করেননি, তবে গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, “থিয়োরিটাও জানতে হবে। না জানলে বেশি দূর এগোতে পারবে না। যাকগে, যা ভাল বুঝবে, করবে।”
শক্তিবাবু এমনিতে খুব হাসিখুশি ধরনের মানুষ। বিশেষত সাঁতারের সিজনে ওঁকে ওরা খুব আপন করে পায়। পরিশ্রম করিয়ে, কঠোর অনুশীলন করিয়ে প্রত্যেককে তৈরি করার দিকে সব সময় ওঁর নজর। শক্তিবাবু নিজে যে দিন কোচিং করাতে পুলে এসে দাঁড়ান, সে দিন বাড়ি ফিরতে ওদের রাত হয়ে যায়। কতক্ষণ উনি সবাইকে জলে নামিয়ে রাখেন! কেউ ক্লান্ত হয়ে পুল থেকে উঠে পড়তে চাইলে বলেন, “ভুলে যেয়ো না, একজন সাঁতারুর কাছে জলই জীবন। ওয়াটার ইজ আওয়ার লাইফ, জাস্ট লাইক ফিশ। জলকে ভালবাসো। তবে মাছের সঙ্গে আমাদের একটাই পার্থক্য। সাঁতার কাটতে কাটতে মাছকে কোথাও পৌঁছতে হয় না। আমাদের কিন্তু পৌঁছতে হয়। উই হ্যাভ টু রিচ দ্য গোল।”
ওঁর প্রতিটা কথা অনুপ্রেরণায় ভরা। শক্তিবাবুকে সিনিয়র-জুনিয়ার—সকলেই খুব শ্রদ্ধা করে। ওঁর গম্ভীর মুখ দেখে সুহিতা ভয়ে ভয়ে বলেছিল, “সার, আপনি কি আমাদের ওপর রাগ করেছেন?”
“কই, না তো!” শক্তিবাবু সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলেছেন, “তোমরা সবাই এই ক্লাবের প্রাণ। তোমাদের ওপর রাগ করলে চলবে কেন?”
হঠাৎ একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন শক্তিবাবু। ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ সরু করে কী যেন চিন্তা করেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, “আচ্ছা, সামনে তোমাদের কোনও পরীক্ষা-টরিক্ষা নেই তো!”
“না সার।” অরণ্যদেব বলেছিল।
“আমার আছে। ইংলিশ ক্লাস টেস্ট।” চিত্ররূপ সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল অরণ্যকে কনুইয়ের খোঁচা মেরে।
সুহিতা চুপ করে ছিল। এই সময়ে ওকে কোনও পরীক্ষায় বসতে হবে না।
“কবে তোমার ক্লাস টেস্ট!” শক্তিবাবু চিত্ররূপকে জিজ্ঞেস করেছিলেন।
“দেরি আছে সার। ফেব্রুয়ারির লাস্ট উইকে।”
“ও, তা হলে দেরি আছে।” শক্তিবাবু একটু আশ্বস্ত হয়ে বলেছিলেন, “ভাবছিলাম তোমাদের নিয়ে একটা জায়গায় বেড়াতে যাব।”
“কোথায় সার?” ওরা তিনজনেই হইহই করে উঠেছিল।”
“ঠিক বেড়াতে নয়, একজনের বাড়িতে। আমার এক চেনা ভদ্রলোক ক্যানিং-এ থাকেন। সি-ফিশের বিজনেস করেন। আমাকে অনেক দিন থেকে বলছেন। এ বার ভাবছি যাব। জানো তো, ক্যানিং হচ্ছে ‘দ্য গেটওয়ে অব সুন্দরবন’। সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার। ভদ্রলোক তো ওঁর মাছ ধরার ট্রলারে করে সজনেখালি এবং সুন্দরবনের আরও ভেতরে নিয়ে যাবেন বলছিলেন। তোমরা যাবে?”
“হ্যাঁ সার, এক্ষুনি। কবে নিয়ে যাবেন বলুন?” চিত্ররূপ তো লাফিয়ে উঠেছিল।
“তোমরা বাড়িতে বলো। গার্জেনরা পারমিশন দেবেন। তার পরে একটা দিন ঠিক করা যাবে।” শক্তিবাবু বলেছিলেন, “তোমাদের সঙ্গে আমার মেয়ে কঙ্কণাকেও নিয়ে যাব। ও অবশ্য তোমাদের মতো হুল্লোড়বাজ নয়। তবে ঘুরতে খুব ভালবাসে। ঠিক আছে। আমি ভদ্রলোককে কালই চিঠি দিয়ে দেব।”
সাঁতারে কোনও পুরস্কার পাওয়ার চেয়েও বড় আনন্দে ওরা তিনজন ক’দিন ধরে বিভোর হয়ে আছে। ওদের অভিভাবকরা কেউই আপত্তি করেননি। সুইমিং ক্লাবের শক্তি বসু সম্পর্কে সকলেরই খুব উচ্চ ধারণা। শুধু তাই নয়, ওঁর ওপরে সবার খুব আস্থা। শক্তি বসুর সঙ্গে যাচ্ছে মানেই কোনও ভয় নেই। সহকারী সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও ক্লাবটাকে উনি যে ভাবে বুকে আঁকড়ে আগলাচ্ছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। ওঁর পাশে যেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি—সবাই ম্লান।
ক্যানিং যাত্রার দিন ঠিক হয়ে গেছে। জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে। তবে সাত দিনের জন্য নয়, মাত্র চার দিন।
ঠিক আছে, তাই সই। চিত্ররূপ তো উত্তেজনায় কাঁপছে, “সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়ার মজাই আলাদা! হাজার মাইল পাড়ি দিতে হয় না, অথচ কলকাতা থেকে দুশো কিলোমিটারের মধ্যেই এমন এক ভয়ংকর সুন্দর অরণ্য আছে, ভাবা যায়!”
“তুই এ সব মাইল-টাইলের হিসেব জানলি কী করে?” অরণ্যদেব জিজ্ঞেস করল। এখন ওদের দেখা হলেই সুন্দরবনের আলোচনা।
“বইপত্তর প’ড়ে।” চিত্ররূপ চোখ নাচিয়ে বলল, “ঘুরতে যাওয়ার আগে সব জেনেশুনে যাওয়াই ভাল। তুই গুল মারলে সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারব।”
বিতানদা তো শুনেই সুহিতাকে সুন্দরবন সম্পর্কে এক বিরাট বক্তৃতা দিয়েছে। বারংবার বলেছে, “একটা মুহূর্তও নষ্ট করবি না। সুন্দরবনের একফোঁটা নোনা জল থেকে শুরু করে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সব কিছুই দু’চোখ ভরে দেখার। ডোন্ট মিস ইট। ইস, আমি যদি তোদের সঙ্গে যেতে পারতাম!”
“চলো-না বিতানদা। খুব মজা হবে। শক্তিবাবু তোমাকে পেলে ভীষণ খুশি হবেন, দেখে নিয়ো।”
“না রে, এখন আমার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস চলছে। একদম ছুটি নেওয়ার উপায় নেই। ঠিক আছে, তুই ঘুরে আয়, পরে তোর সঙ্গে যাব। তুই আমাকে গাইড করে সুন্দরবন দেখিয়ে আনবি।”
সুহিতা জানে, বিতানদা ওদের সঙ্গে গেলে সুন্দরবন ভ্রমণের ছবিটাই পালটে যেত। কী আর করা যাবে! ক্লাস আর পরীক্ষার বাধা কবে যে শেষ হবে!
আজ থেকে আর ঠিক পাঁচ দিন বাকি। অরণ্যদেব ঘুগনির ওপর কাঁচা পেঁয়াজের কুচি ছড়িয়ে সকৌতুকে বলল, “কী রে চিত্র, তোর চিত্তে ভয়ের কাঁপন লাগেনি তো!”
“কেন, ভয় পাব কেন?” চিত্ররূপ একটু রুক্ষ স্বরে বলল, “আমি তোর মতো ভিতু নই।”
“জানিস তো, আমার ছোটদাদুর এক বন্ধু স্বপ্নে বাঘের গর্জন শুনে হার্টফেল করেছিলেন। সে কী কাণ্ড!”
চিত্ররূপ সঙ্গে সঙ্গে সুহিতাকে বলল, “চল, চল, উঠে পড়ি। অরণ্য ওর গুলের ঝাঁপি খুলে বসেছে।”
“বিলিভ মি!” অরণ্যদেব বুক চাপড়ে জোর দিয়ে বলল, “ছোটদাদুর বন্ধু ডুয়ার্সের গোরুমারা স্যাংচুয়ারিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ওঁর হার্টের অবস্থা ভাল ছিল না। সকালে কোনও এক নদীর ধারে ইয়াব্বড় একটা বাঘ দেখেছিলেন। ব্যস, সেই যে ওঁর হার্টে চোট লাগল! বাঘ বলে কথা! দু’দিন পরে স্বপ্নের মধ্যে হালুম-হালুম শুনে ঘুমের ঘোরে খাট থেকে নেমে পালাতে গিয়ে পতন এবং মৃত্যু। মরার আগে ডাক্তারকে নাকি কেবল বলতে পেরেছিলেন, বাঘের গর্জন। আমি এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না।”
সুহিতা ফিক করে হেসে ফেলল। অরণ্যদেব গল্প বানাতে ওস্তাদ। চিত্ররূপ চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই সুহিতা, তুই হাসছিস কেন রে? অরণ্য নিশ্চয়ই লাইনে নামিয়ে দিয়েছে গুলের গাড়ি। জঙ্গলের নাম যেখানে গোরুমারা, যেখানে আবার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! হুঁ!”
“আমি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বলিনি।” অরণ্যদেব তেড়ে উঠল।
আবার হাসল সুহিতা। নরম চোখে দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, “হার্টফেলের ঘটনাটা হয়তো সত্যি। কিন্তু গোরুমারায় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার মোটেই নেই। ওখানে অবশ্য গণ্ডার, হাতি, শম্বর, বাঘ, চিতাবাঘ সবই আছে।”
“দেখলি, দেখলি”, সুহিতা বলল, “বাঘ আছে।” অরণ্যদেব যেন একটু দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছে এমন ভাবে বলল, “বাঘ ইজ বাঘ। তার আবার রয়্যাল, কিং, রিগাল—এ সবের দরকার কী!”
“আমরা কিন্তু ওই বিশেষ ধরনের বাঘ দেখতেই সুন্দরবনে যাচ্ছি।” অরণ্যদেবকে কথাটা মনে করিয়ে দেওয়ার মতো করে বলল সুহিতা।
“আমার আর তর সইছে না।” চিত্ররূপ বলল, “প্রতিদিন রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার সময় ভাবি, এই বুঝি কাল সকালের ক্যানিং লোকাল ধরে শিয়ালদা থেকে আমরা বেরিয়ে পড়েছি। দিনটা যেন আসছেই না!”
অরণ্যদেব আর সুহিতারও মনের কথা এমনই। সুন্দরবনের রহস্যময় অরণ্য ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে—ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নে, আপন মুহূর্তে, একান্ত লগ্নে।
ক্যানিং শহরে ঢুকে সুহিতার মনের ওপরে কে যেন কালির আঁচড় টেনে দিল। ক্যানিং সম্পর্কে ও একটু অন্য রকম ছবি এঁকেছিল মনের পাতায়। অথচ সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার আর-পাঁচটা জায়গার চেয়ে আলাদা নয়। সোদপুরে ওর মাসির বাড়ি, নৈহাটিতে বড়পিসির, তমলুকে থাকেন ওর রাঙামামা। এ সব জায়গায় ও গেছে। থেকেছে। ক্যানিং ওই জায়গাগুলোর মতন। ছিটেফোঁটা পার্থক্যও যেন নেই। সেই সাইকেল রিকশা, সরু সরু রাস্তা, নানা আকারের বিচিত্র সব বাড়িঘর। ভিড়। গাড়ির হর্ন। সিনেমা হলের সামনে মানুষের জটলা। কাঁচা নর্দমার দুর্গন্ধ। সুহিতার ভাল লাগল না।
শক্তিবাবুর চেনা ভদ্রলোক হিরু সরকার স্টেশনে গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। রং-চটা পুরনো অ্যাম্বাসাডর। কঙ্কণা ও ওরা তিনজন পেছনের সিটে। শক্তিবাবু ও হিরু সরকার সামনে। হিরুবাবুকে দেখেই মনে হয় খুব শৌখিন প্রকৃতির মানুষ। ধবধবে ধুতি। কাজকরা রঙিন পাঞ্জাবি। গলায় সোনার চেন। মাথার চুল অবশ্য পাতলা। কিন্তু আকারে-প্রকারে শক্তিবাবুর ডাবল। শক্তিবাবু ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরই ভদ্রলোক ভরাট গলায় বলেছিলেন, “এখনকার ছেলেমেয়েদের নামের খুব বাহার—অরণ্যদেব, চিত্ররূপ, কঙ্কণা। আমাদের কালে এ সব ছিল না। আমার নাম হিরু। আমার বাবার নাম বিরু। ঠাকুরদাদার নাম নাড়ু। নাড়ুগোপাল, বিরুগোপাল, হিরুগোপাল। শুনতে কি খুব খারাপ?”
খুব অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন শক্তিবাবু। স্টেশনে নেমেই এই সব প্রসঙ্গের মুখোমুখি হতে হবে, উনি হয়তো ভাবেননি। সুহিতা নীরবে ভদ্রলোককে লক্ষ করছিল। ওর মনে হয়েছে, হিরুবাবু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে বেশি ভালবাসেন। অথবা আদৌ জানেন না কোথায় কী বলতে হয়। ওর অনুমান মিথ্যে নয়। গাড়িতে ওঠার সময় হিরুবাবু হঠাৎ বললেন, “শক্তিবাবু, আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনারা গরিবের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিলেন এও খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে একটা বিষয় মনে রাখবেন, এটা আমার জায়গা। এখানে আমার মতো আপনাদের চলতে হবে। ঠিক আছে?”
শক্তিবাবুর মতো প্রাণোচ্ছল মানুষও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ওঁর কথায়। চিত্ররূপরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছে। কঙ্কণা ক্ষুব্ধ হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। কঙ্কণা বেশ রোগা আর ফর্সা। শক্তিবাবুর মতনই দেখতে। টিকলো নাক, পাতলা ঠোঁট। গলার স্বর দিয়ে রিনরিন শব্দ ঝরে পড়ে। সুহিতা ওর পাশে দাঁড়িয়ে অনুভব করতে পারছিল, কঙ্কণার মোটেই ভাল লাগছে না এই সব কথাবার্তা। কিন্তু হোস্টকে কিছু বলাও যায় না। শক্তিবাবু কোনও রকমে হেসে বলেছিলেন, “সে তো নিশ্চয়ই। আমরা তো এখানকার কিছুই চিনি না। আপনিই ভরসা। আমরা আপনার অতিথি। এ বার সব দায়িত্ব আপনার।”
“ঠিক তাই।” হিরুবাবু মাথা নাড়িয়ে বলেছিলেন, “আমি অবশ্য আপনাদের সবই দেখাব। তবে আমার মতো করে।”
ওরা সকলে নিঃশব্দে ভদ্রলোকের প্রস্তাব বা ইচ্ছে মেনে নিয়েছে। না নিয়ে উপায়ও নেই। শক্তিবাবু অবশ্য ঘাবড়ে যাননি।
গাড়িতে হিরু সরকার আর উলটোপালটা কিছু বললেন না। সারাক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। ওরা চারজন গাড়ির জানলা দিয়ে ক্যানিং শহরটাকে চেটেপুটে নিল। দেখার কিছুই নেই। সুহিতা তো আগেই সোদপুর, নৈহাটি, তমলুকের সঙ্গে ক্যানিংকে মিলিয়ে নিয়েছে। তবু একটা নতুন-দেখা-জায়গার রোমাঞ্চকে ওদের কিশোর মন ফিরিয়ে দিতে পারল না। আধঘণ্টা গাড়িটা একনাগাড়ে কখনও আস্তে কখনও জোরে, কখনও ঘন লোকালয়ের মধ্য দিয়ে, কখনও নির্জন রাস্তা ধরে চলতে চলতে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে থেমে গেল। একটু এবড়ো-খেবড়ো মাঠের মতো। উঁচু-নিচু মাটি। কোথাও কোথাও ঘাস। হিরুবাবু গাড়ি থেকে নেমে বললেন, “আমরা এসে গেছি। ওই যে আমার বাড়ি দেখা যাচ্ছে।”
ওরা সবাই চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখল, টিলার মতো একটা উঁচু জমিতে হলুদ রঙের একটা দোতলা বাড়ি। কেমন যেন দুর্গের মতো। বাড়ির ছাদে অন্তত তিনটে টিভি অ্যান্টেনা। ডিস্ক অ্যান্টেনার মতো আরও একটা কিছু বসানো আছে।
“গাড়ি আমার বাড়ির দরজা পর্যন্ত যেতে পারে। তবে ওই গড়ানে জমিটা উঠতে তোমাদের ভাল লাগবে বলে এখানেই গাড়িটা ছেড়ে দিলাম। আসুন শক্তিবাবু, আসুন।”
যে যার নিজের সুটকেস, ব্যাগ নিয়ে হিরুবাবুর পেছনে হাঁটতে শুরু করল। কলকাতার চেয়ে এখানে শীত বেশি কি না চিত্ররূপ বুঝতে পারল না। সুহিতা বাতাসে শুঁটকি মাছের গন্ধ পেল। কঙ্কণার মনে হল, ওই দুর্গের মতো বাড়িটায় কোনও রহস্য আছে। অরণ্যদেব ভাবল, হিরু সরকার লোকটা মোটেই সুবিধের নয়। শক্তিবাবুর সঙ্গে ওর চেনাজানা হওয়া উচিত হয়নি। শক্তি বসু চিন্তা করছিলেন, হিরুবাবুর মুখের কথায় চার-চারটে ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখানে আসা উচিত হয়নি। ভদ্রলোকের চোখের দৃষ্টি খুব সুস্থ নয়। কথাবার্তাতেও এখন কোনও মার্জিত ভাব নেই। অথচ কলকাতায় যে-ক’বার দেখা হয়েছে, তখন ভদ্রলোককে অন্য রকম মনে হয়েছিল।
বাড়িটা বাইরে থেকে দেখতে যত অদ্ভুত মনে হচ্ছিল ভেতরটা তেমন নয়। স্নিগ্ধ রঙের সব ঘর। প্রচুর হাওয়া-বাতাস। একতলায় বড় ড্রয়িংরুম। দেওয়ালে ঝুলছে নানা রকম মাছের ছবি। শিল্পীদের দিয়ে আঁকানো। প্রায় চার ফুট লম্বা, তিন ফুট চওড়া একটা নীল দাঁড়াওয়ালা গলদা চিংড়ির চিত্রকলার সামনে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। শক্তিবাবুর মুগ্ধ দৃষ্টি লক্ষ করে হিরু সরকার বললেন, “এখন এই একটা মাছই পয়সা দিচ্ছে। এ একেবারে জলের সোনা। এই জন্যে গলদার ছবিটাকে দামি সোনালি ফ্রেমে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রেখেছি।”
একতলায় আর যে ঘরগুলো আছে, সেগুলোর কোনওটা হিরুবাবুর অফিস, কর্মচারীদের বিশ্রাম নেওয়ার ঘর, মাছের আড়তদারদের কনফারেন্স রুম। দোতলায় উঠে হিরুবাবু বললেন, “বাড়ির পেছন দিকটায় আমি আর আমার পরিবার-পরিজন থাকি। সামনের এই দুটো ঘর, শক্তিবাবু, আপনাদের জন্যে গুছিয়ে রাখা আছে। একটা ঘরে মেয়েরা থাকবে। একটায় আপনি আর এই দুই ছোকরা।”
অযথা ওদের ছোকরা বলাতে চিত্ররূপ খুব রেগে গেল। চোয়াল শক্ত করে খুব নিচু গলায় ও অরণ্যদেবকে বলল, “এখানে তো দেখছি বন-জঙ্গলের রাজত্ব।”
চিত্ররূপের ক্ষোভ ও ঠাট্টাটাকে ধরতে পেরে অরণ্যদেব বলল, “বন্যরা বনে সুন্দর, হিরুবাবু ক্যানিং-ক্রোড়ে।”
ওদের ফিসফিসে কথাবার্তা শুনতে পেয়ে শক্তিবাবু তাকালেন। ওঁর দু’চোখে মৃদু ভর্ৎসনা। চিত্ররূপ ও অরণ্য দু’দিকে সরে গেল।
“ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচ্ড বাথ। আশা করি কোনও অসুবিধে হবে না। আমাদের বাড়ির কাজের লোক হালুমের মা আপনাদের জলখাবার দিয়ে যাবে। শক্তিবাবু, আপনারা অবশ্য ডাইনিং স্পেসে গিয়েও খেতে পারেন। দুপুরের খাওয়াদাওয়া অবশ্য ওখানেই হবে।”
“আজই কি আমরা সুন্দরবনের দিকে যাব!” আলতো স্বরে শক্তিবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“না, আজকে নয়। আজকের রাতটা এ-বাড়িতে আমরা কাটাব। কাল যাব গোসাবায়। ওখানেই আমার ওরিজিন্যাল বাড়ি। পৈতৃক গৃহ। সেই বাড়িতে কাল সারা দিন, সারা রাত থাকব। পরশু দিন ট্রলারে করে সুন্দরবনের গভীরে ঢোকার ইচ্ছে আছে।”
ওঁর কথা শুনে সুহিতার মুখের ভেতরটা সঙ্গে সঙ্গে তেতো হয়ে গেল। দুটো দিন যদি এই ভাবে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিয়ে কেটে যায়, তা হলে সুন্দরবনের অফুরান সৌন্দর্য কখন দেখবে! হাতে তো মাত্র চার দিন সময়! সুহিতা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। শক্তিবাবু হাত তুলে নিষেধের ভঙ্গি করলেন।
হিরুবাবু আর দাঁড়ালেন না। শশব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলতে ভুললেন না, “আপনারা বাড়ি থেকে একা একা বেরিয়ে কোথাও যাবেন না। আমরা শহর থেকে অনেকটা বাইরে আছি। পথ হারিয়ে ফেলবেন কিন্তু। আপনাদের সঙ্গে আবার দুপুরবেলায় দেখা হবে।”
অরণ্যদেব রাগে ফেটে পড়ল। শক্তিবাবুর প্রতি ওদের সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার কথা ভুলে গিয়ে ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “সার, এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাই, চলুন। ভদ্রলোক মোটেই সুবিধের নয়।”
‘মনে হয় ওঁর অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে।” চিত্ররূপ রাগ দেখাল বটে, কিন্তু ওর গলার স্বর ভয়ে কেঁপে গেল।
কঙ্কণা বলল, “বাবা, আমার একদম ভাল লাগছে না। তুমি আমাদের বাড়ি নিয়ে চলো।”
কলকাতার বদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে আসার আনন্দটা এই ভাবে মাটি হয়ে যাবে, সুহিতা কল্পনাও করেনি। ও ভেবেছিল, সুন্দরবন থেকে অনেক গল্প কুড়িয়ে নিয়ে যাবে, বিতানদার জন্য। কিন্তু এ যা অবস্থা, তাতে ভালয় ভালয় কলকাতায় ফিরতে পারলে হয়। মলিন মুখে সুহিতা জিজ্ঞেস করল, “সার, ভয়ের কিছু নেই তো!”
শক্তিবাবু নিজেই খানিকটা বিমুঢ় হয়ে গেছেন। এই ভাবে হুট করে চলে আসাটাকে ওঁর মনে হচ্ছে হঠকারিতা। উনি সঙ্গে সঙ্গে সুহিতার কথার কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। একটু সময় নিয়ে জোর করে হেসে বললেন, “ভয়ের কী আছে! আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি। খারাপ যদি কিছু ঘটে, আমিই বুক পেতে দেব সবার আগে। …হিরুবাবুর অত সাহস হবে না। ভদ্রলোক আসলে একটু পাগলাটে টাইপের। মানুষটা কিন্তু ভাল!”
চিত্ররূপরা ওঁর শেষ বাক্যটা মোটেই সহজ ভাবে গ্রহণ করল না। ঘুরঘুরে পোকার মতো ভয়টা ওদের মনের আঙিনায় থেকেই গেল।
দিনের বেলায় চার রকমের মাছ—ইলিশ, বাগদা চিংড়ি, গলদা চিংড়ি আর পমফ্রেট এবং রাতে দু’ধরনের মাংস, নানান মিষ্টি দিয়ে ওদের দারুণ ভাবে আপ্যায়ন করলেন হিরুবাবু। ওদের মনে কোনও ক্ষোভ রইল না খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু দুর্গের মতো এই বাড়িটা থেকে বেরোতে না-পারার দুঃখটা ওরা কিছুতেই ভুলতে পারল না। দুপুরবেলাটা ঘুমিয়ে আর সন্ধে থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত টিভি দেখে ওরা সময় কাটিয়ে দিল। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সুহিতা আর কঙ্কণা ওদের ঘরে বসে শুনল একটানা বিপ-বিপ আওয়াজ। চিত্ররূপ আর অরণ্যদেব শুনল চাপা কান্নার শব্দ। ওটা কীসের শব্দ? এটা কীসের আওয়াজ? ভাবতে ভাবতে ওরা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
কাল সারা দিনের তিক্ততা এক মুহূর্তে ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গেল মাতলা-পুরন্দর নদীর সামনে এসে। বিরাট নদী, উত্তাল জল। এ-পার থেকে ও-পার দেখা যাচ্ছে না। ও-পারে লম্বা ধূসর রেখা। নদীর জলে ইতস্তত নৌকোর মেলা। ওদের জন্য হিরুবাবু একটা ভটভটি নৌকো আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। নদীর জেটিতে দাঁড়িয়ে চিত্ররূপ বলল, “বিউটিফুল! নদী তো নয়, যেন সমুদ্র।”
শক্তিবাবু অপলকে নদীর রূপ দেখতে দেখতে বললেন, “মোহনার কাছে নদীর বিস্তার এমনই ধরাছোঁয়ার বাইরে।”
‘সার, মনে হচ্ছে জলে নেমে পড়ি।” অরণ্যদেব বলল, “অপোজিট কারেন্টে সাঁতার কাটার মজাই আলাদা!”
কৃত্রিম ভয়ে শরীর মুচড়ে উচ্ছ্বসিত সুহিতা বলল, “এমন দৃশ্যের এত কাছে আমরা ছিলাম, অথচ কাল কিছুই বুঝতে পারিনি!”
সত্যিই মাতলা-পুরন্দর হিরুবাবুর বাড়ির খুব কাছে। মোটরগাড়িতে মাত্র পাঁচ মিনিট। চিত্ররূপ ভাবল, বন্যার ভয়েই কি হিরুবাবু মাটির টিলার ওপরে বাড়িটা তুলে নিয়ে গেছেন?
এক সময় শান্ত গলায় কঙ্কণা বলল, “সুহিতা, কাল রাতে যে-শব্দটা শুনছিলাম তা কি দুরন্ত হাওয়ার শব্দ? নদীর বুকের ওপর দিয়ে যে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, উধাও হয়ে যাচ্ছে বনের দিকে!”
চিন্তিত মুখে সুহিতা বলল, “কে জানে! হয়তো…।”
কিছুটা সংকোচ আর কিছুটা ভয় মিশিয়ে অরণ্যদেব হিরুবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “নদীর ও-পারেই কি সুন্দরবন?”
“আজ্ঞে না।” হিরুবাবু যেন একটু ভ্যাংচানোর সুরে বললেন, “বললাম যে ও-পারে গোসাবা। ওখানে আমার পৈতৃক ভিটে। গোসাবা থেকে বিদ্যেধরী নদী পার হওয়ার পর বনের শুরু। এখান থেকে অনেক দূর। তোমরা কি ভেবেছিলে ক্যানিং পেরোলেই সুন্দরবন! অত সোজা! জানো তো কোনও মানুষকেই সুন্দরবন পছন্দ করে না। তাই নদী দিয়ে, সাগর দিয়ে চার দিকে পাঁচিল তুলে রেখেছে। যাতে সহজে কেউ ঢুকতে না পারে। কিন্তু মানুষ ছাড়েনি। বনের ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে সব লুঠ করে আনছে।”
“ভাল বলেছেন তো!” শক্তিবাবু হেসে বললেন।
হিরুবাবু সহসা গম্ভীর হয়ে বললেন, “চলুন, ভটভটিতে উঠি। ঘণ্টা দেড়েক এখন নদীতে থাকতে হবে।”
নৌকো ছাড়ল। অবিরাম ভটভট শব্দে ওদের প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু একটু পরে, হিমেল হাওয়া, জলের কল্লোল, মাথার ওপরে উড়তে থাকা পাখি, আকাশ থেকে চুঁইয়ে আসা রোদ্দুর, অন্য নৌকোর চলাচল, আর দিগন্ত-ছোঁয়া বিস্তীর্ণ প্রকৃতির অপরূপ ছবি, সুহিতাদের মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক করে ফেলল।
গোসাবার নৌকোঘাটায় ওদের জিনিসপত্র যে তাগড়াই যুবকটি নামিয়ে নিল, তার নামই হালুম। ওর মা হিরুবাবুর ক্যানিংয়ের বাড়িতে কাজ করে। হালুম নামটা যেমন মজার, যুবকটি মোটেই তা নয়। মুখটা শক্ত পাথরের মতো। চোখের দৃষ্টি তীব্র। ওদের সঙ্গে কোনও কথা বলল না। চিত্ররূপ দেখল, শক্তিবাবু আবার চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এখন ওরা কলকাতা থেকে দূরে। অনেক দূরে না হলেও, এই রকম দুর্গম জায়গা থেকে কোনও বিপদ-আপদে পালিয়ে যাওয়াই মুশকিল। সবচেয়ে বড় বাধা জল। আদিগন্ত অতলান্ত জল। ওরা অবশ্য সবাই সাঁতার জানে। কিন্তু জলের সঙ্গে খেলা করা আর যুদ্ধ এক জিনিস নয়। চিত্ররূপ ভাবল, যা হওয়ার হবে। নিছক বেড়াতে আসাটা যদি অ্যাডভেঞ্চারে পরিণত হয়, তাতেই বা ভয় পাবে কেন!
হিরু সরকারের গোসাবার বাড়িটাও দোতলা, তবে ছাদ নেই। ওপরে টিনের চাল। বাড়িটাও পুরনো। ক্যানিংয়ের মতো এই জায়গাটা অতটা জমজমাট না হলেও ভিড় মন্দ নয়। ও-পার থেকে যাঁরা এলেন, তারা প্রায় সকলেই ছুটছেন বিদ্যাধরী নদীর দিকে পারাপারের নৌকো-লঞ্চ-ভটভটি ধরতে। সকলেই ব্যস্ত। এখানে যাঁরা থাকেন তাঁরা গায়ে-মাথায় শীতবস্ত্র জড়িয়ে দিনের কাজে নেমে পড়েছে। রৌদ্রস্নাত এই গঞ্জটিকে বেশ মায়াময় লাগছে।
বাড়ির একতলায় বসে ওরা গরম গরম পুরি আর আলু-পেঁয়াজের তরকারি খেল। কেউ কোনও কথা বলছে না। সবাই নিশ্চুপ। হিরুবাবু কোথায় উধাও হয়ে গেছেন। অনেকক্ষণ কোনও পাত্তা নেই। একটু আগে অরণ্যদেব হালুমকে জিজ্ঞেস করেছিল, “নদী পেরিয়ে গোসাবায় কখনও বাঘ চলে আসে?”
হালুম এত জোরে ‘জানি না’ বলেছিল যে, সকলেই চমকে গেছে। হালুম ঘর থেকে চলে যেতেই কঙ্কণা প্রায় অশ্রুত স্বরে বলেছে, “বাব্বা, এ যেন বাঘের হালুম। ওর নাম কেন যে হালুম, এতক্ষণে বুঝতে পারছি।”
এখানেও ওদের দুটো ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে খাট নেই। মেঝেতে ঢালাও বিছানা। শক্তিবাবু ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলেন। এক সময় বললেন, “চলো আশপাশটা ঘুরে দেখে আসি। ভাল লোকের পাল্লায় পড়া গেল! ভদ্রলোক কী যে করতে চাইছেন?”
হালুমকে বলে শক্তিবাবু ওদের নিয়ে বাইরে বেরোলেন। হালুম বাধা দিল না। কেবল কঠিন মুখে বলল, “বেশি দূর যাবেন না। পথ হারিয়ে ফেলবেন।”
অনেকটা দূর এসে চিত্ররূপ হো হো করে হেসে বলল, “হালুমদা ভেবেছে আমরা বাচ্চা ছেলেমেয়ে। কিচ্ছুটি জানি না! পথ হারাতেই এসেছি, আর ও বলে কিনা পথ হারিয়ে ফেলবেন’!”
সুহিতা সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে উঠল, “কী করি আজ ভেবে না পাই/পথ হারিয়ে কোন্ বনে যাই,/কোন্ মাঠে যে ছুটে বেড়াই/সকল ছেলে জুটি।”
ওদের খেয়ালই ছিল না, গোসাবার বাড়ির দোতলায় ওরা ওঠেনি। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ঝুপ করে সন্ধে নামতেই একটা বড় হ্যারিকেন হাতে দুলিয়ে নিয়ে এসে হালুম বলল, “বড়বাবু আপনাদের ওপরে ডাকছেন।”
“হিরুবাবু! উনি কখন বললেন?” শক্তিবাবু বিস্ময় গোপন করতে পারলেন না। একটু থেমে বললেন, “সারাদিন ওঁর দেখা পেলাম না। কোনও কাজে গিয়েছিলেন বুঝি!”
হালুম কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিল না। পুলিশ অফিসারের মতো কড়া গলায় কেবল বলল, “চলুন।”
অরণ্যদেব দেখল, দিনের ম্লান আলো অতি দ্রুত মুছে ফেলে, ঘন আঁধারে পুরো বাড়িটাকে কেমন রহস্যময় করে তুলল। গভীর রাতে কোন বিভীষিকা ধেয়ে আসবে কে জানে!
দোতলায় এসে ওরা হাঁ হয়ে গেল। লম্বা ঘরের মতো ঘরটার মাঝখানে টুলের ওপর হ্যাজাক বসানো। দু’পাশের দেওয়ালে অজস্র শিংওয়ালা হরিণের করোটি। কালো রঙের কাঠের শিল্ডের ওপর লাগিয়ে দেওয়ালে টাঙানো। সামনের দেওয়ালে একটা মুণ্ডুওয়ালা বাঘের ছাল গেঁথে রাখা আছে। বাঘছালের ব্যাকগ্রাউন্ডে বসে আছেন হিরুবাবু। সোফার মতো কোনও একটা জায়গায়। দুর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। হিরুবাবু নীরবে হাসছেন। ওঁর ঝকঝকে দাঁতে হ্যাজাকের আলো ঝিলিক তুলছে। ওই দেওয়ালের দুই কোনায় চার চার আটটা বন্দুক। চিত্ররূপদের চোখের পলক পড়ছে না। শক্তিবাবু চোয়াল শক্ত করে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন।
“কেমন দেখছেন শক্তিবাবু!” গমগমে গলায় হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন হিরুবাবু।
“এ সব কী! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“শিকার। আমাদের তিন পুরুষের শিকার। এগুলো সব সুন্দরবনের বিখ্যাত চিতল হরিণের শিং। শিংগুলো দেখেছেন! কেমন গাছের মতো বড় আর বাহারি।”
“এগুলো আপনি শিকার করেছেন?” শক্তিবাবুর গলার স্বর কেঁপে গেল।
“শুধু আমি নই। আমাদের তিনপুরুষ ধরে হরিণ মেরেছি। গুনে দেখুন, দুই দেওয়ালে ঠিক একশোটা শিং ঝুলছে।”
কঙ্কণা ভয়ার্ত গলায় বলল, “একশোটা?”
“হ্যাঁ, গুনে গুনে একশো। আর এই যে বাঘটা, একে আমিই মেরেছি। হালুমের বাবাকে এই ব্যাটাই খেয়ে নিয়েছিল। ওর মা প্রতিরাত্রে এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।”
ওরা চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দরজার কাছে হালুম পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
“আপনি এত নিষ্ঠুর। অকারণে এত হরিণকে হত্যা করেছেন।” সুহিতা তীক্ষস্বরে বলল। বিস্ময়ের ঘেরাটোপটা সহসা সুহিতার সামনে থেকে যেন সরে গেছে।
ওর দেখাদেখি চিত্ররূপ আর অরণ্যদেবও নড়েচড়ে উঠল। চিতল হরিণের খুলিগুলো যেন আর ভয় দেখাচ্ছে না। বরং করুণ মুখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
“আমি নিষ্ঠুর হব কেন?” হিরুবাবু জোরে হেসে বললেন, “সুন্দরবনে পঞ্চাশ-ষাট হাজার অথবা এক লাখ চিতল হরিণ আছে। বাঘেরা তাদের খায়। সেই এক লাখ থেকে আমরা মাত্র একশোটা মেরেছি। বাঘের চেয়েও কি আমরা নিষ্ঠুর?”
“আপনি কি জানেন, যে-কোনও ধরনের বন্যপ্রাণী হত্যা করা দণ্ডনীয় অপরাধ!” শক্তিবাবুর গলা চড়ে গেল।
অরণ্যদেব চেঁচিয়ে বলল, “ওয়াইল্ড লাইফ লাভাররা জানতে পারলে আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাবে।”
সমস্ত সৌজন্যবোধ হারিয়ে ফেলে চিত্ররূপ চিৎকার করে উঠল, “আপনি খুনি, আপনি খুনি!”
হিরুবাবুর মুখ থেকে তবু হাসি মুছে গেল না। ভদ্রলোক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “শিকার আমার হবি। সুইমিংয়ের মতো হান্টিংও একটা খেলা।”
“কিন্তু প্রাণ নিয়ে খেলা। হরিণের মতো নিরীহ প্রাণীর রক্ত নিয়ে আপনি খেলেছেন।” সুহিতা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল।
‘না, না, খুব মজার খেলা। তোমরা শিকার শিকার খেলা খেলবে? আচ্ছা, দাঁড়াও। হালুম, এদের হাতে বন্দুকগুলো তুলে দে। আমি এক্ষুনি আসছি।” হিরুবাবু প্রায় ছুটে নীচে নেমে গেলেন।
ক্ষিপ্রবেগে এগিয়ে এসে হালুম ওদের হাতে প্রায় জোর করে বন্দুকগুলো ধরিয়ে দিল। শক্তিবাবুও ‘না’ বলতে পারলেন না। হালুমের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে।
মিনিট পাঁচেক পরেই হামাগুড়ি দিয়ে দোতলার ঘরে প্রবেশ করল একটি বাঘ। না, সত্যিকারের বাঘ না। আর-একটা বাঘের চামড়ার মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে এনেছেন হিরুবাবু। দেওয়াল ঘেঁষে পুনরায় নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে হিরুবাবু বললেন, “এই যে তোমাদের সামনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার উপস্থিত। নাও, গুলি করো।”
“এ সব কী তামাশা করছেন হিরুবাবু। স্টপ ইট, স্টপ ইট।” বন্দুকটা মাটিতে ধপ করে ফেলে দিয়ে শক্তিবাবু বললেন।
হিরুবাবু যেন শুনতে পেলেন না। অরণ্যদেবের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “এই যে খোকা, শিকারের খেলায় নামো। তবে ভুলে যেয়ো না, মানুষখেকো অথবা হরিণখেকো যে-বাঘই মারো-না-কেন, হালুমের মায়ের চোখের জল কিন্তু মোছাতে পারবে না। হাঃ হাঃ হা!”
স্থানীয় লোকজন দেখল, রাত আটটা নাগাদ কলকাতার এক ভদ্রলোক শীতার্ত চারটি কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে গোসাবা বাজারের কাছে এক হোটেলে এসে উঠলেন।
২৮ আগস্ট ১৯৯৬
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন