অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার

পৌলোমী সেনগুপ্ত

বারান্দায় চোরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। দরজা খুলে এক পলক দেখে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ‘বলুন, কী দরকার?’

লোকটি পিটপিট করে তাকাল। তারপর হাতজোড় করে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে বাঁচান বাবু। আমি মরে গিয়েছি।’

রোগা এবং বেঁটে লোকটির পরনে সস্তার শার্ট-প্যান্ট। দেখলেই বোঝা যায়, অবস্থা ভাল নয়। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ‘আমি যে আপনাকে বাঁচাতে পারি, এ-কথা কে বলল?’

‘আপনার কথা আমি আগেই শুনেছিলাম। আমার এক শালা রূপমায়া সিনেমাতে টিকিট ব্ল্যাক করে, ও আপনার খুব প্রশংসা করে। বাবু, আমি বড় বিপদে পড়েছি।’ লোকটি তখনও হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে।

‘আপনার নাম কী?’

‘যজ্ঞেশ্বর মাইতি।’

‘কী করেন?’

লোকটি মুখ নামাল, ‘বলতে সংকোচ হয়, তবু বলি, আমি চুরি করি বাবু।’

‘চুরি করেন? চোর!’ অর্জুন অবাক।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কাজকর্ম পাইনি, পয়সাও নেই যে দোকান-টোকান দেব, তাই চুরি করে পেট ভরাই। বাড়িতে বউ আর দুই ছেলেমেয়ে! মুখ দেখে তো কেউ খেতে দেবে না!’

‘আপনার বিপদটা কী? পুলিশ?’

‘না বাবু, চুরির জন্যে পুলিশ আমাকে ধরলে আপনার কাছে আসতাম না।’ রাস্তার দিকে চট করে তাকিয়ে নিল যজ্ঞেশ্বর, ‘এখানে দাঁড়িয়ে বলা কি ঠিক হবে? কেউ যদি শুনে ফেলে!’

অর্জুনদের বাড়ি গলির একটু ভেতরে। গলিটা চওড়া, রিকশা যাচ্ছে, মানুষজন হাঁটছে। একটা চোরকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়ে বসাতে প্রথমে ইচ্ছে হচ্ছিল না, পরে মত বদলে সে ডাকল, ‘ভেতরে আসুন।’

যজ্ঞেশ্বর সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকতেই চেয়ার দেখিয়ে দিল অর্জুন, ‘বসুন।’

‘না, না আমি ঠিক আছি, আপনি বসুন বাবু।’

অর্জুন আর অনুরোধ না করে চেয়ার টেনে নিল, ‘আপনার নাম নিশ্চয়ই পুলিশের খাতায় আছে?’

‘তা তো থাকবেই বাবু। এর আগে চারবার জেল খেটেছি। তবে ওই তিন থেকে ন’মাস। বড় কাজ তো কখনও করিনি। এবার করতে গিয়েছিলাম।’ যজ্ঞেশ্বর হাতজোড় করেই বলল, ‘ওই যে কথায় বলে না বামনের চাঁদে হাত দেওয়ার শখ, তাই হয়েছিল আমার। সেটা করতে গিয়ে ফেঁসে গেছি বাবু।’

‘ফেঁসে গেছেন?’ অর্জুন মাথা নাড়ল, ‘তা আমার কাছে কেন এসেছেন?’

‘আপনি ছাড়া আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। পুলিশের বড়কর্তারা আপনাকে খুব খাতির করে, আপনি বললে ওরা শুনবে।’ ককিয়ে উঠল যজ্ঞেশ্বর।

‘যারা অন্যায় কাজ করে আমি তাদের সাহায্য করি না।’ অর্জুন ঘুরে দাঁড়াল।

‘বিশ্বাস করুন বাবু, আমার বাচ্চার দিব্যি, গত রাত্রে আমি কোনও অন্যায় করিনি।’

‘তা হলে আপনি কীসের ভয় পাচ্ছেন?’

এ বার যজ্ঞেশ্বর সব কথা খুলে বলল। গত রাত্রে সে চুরি করতে গিয়েছিল শিল্পসমিতি পাড়ায়। কয়েক দিন থেকে লক্ষ করছিল ওই বাড়িতে প্রচুর গাড়ি আসছে যাচ্ছে। বাড়িটার সামনে পাঁচিলঘেরা বাগান আছে। বাগানের গেট লোহার। আগে কোনও দিন দরোয়ান ছিল না, গাড়িগুলোর আসা-যাওয়া শুরু হওয়ার পর একটা নেপালি দরোয়ান রাখা হয়েছে। বাড়ির মালিক দীর্ঘকাল জলপাইগুড়িতে ছিলেন না। যজ্ঞেশ্বর খবর পেয়েছে তিনি আমেরিকায় ব্যবসা করেন বলে নিজের শহরে এত কাল আসতে পারেননি। যজ্ঞেশ্বর বুঝতে পারছিল, তার জন্য অনেক সম্পদ ওই বাড়িতে অপেক্ষা করছে। একে আমেরিকার ব্যবসাদার, তার ওপর গেটে দরোয়ান বসানো, এ-সবই ইঙ্গিত করছে ওই বাড়িতে এখন দামি-দামি জিনিসপত্র এসেছে। এই শহরের যে-কোনও বাড়ির ভেতরের ছক জেনে নিতে যজ্ঞেশ্বরদের বেশি সময় লাগে না। ওই বাড়িটারও জোগাড় হয়ে গেল। দরোয়ান থাকলেও সে পরোয়া করেনি। রাতের অন্ধকারে পাঁচিল টপকে নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছিল বাগানে। দরোয়ান টের পায়নি। তারপর জলের পাইপ বেয়ে সোজা তিনতলায়। সে দোতলায় নামেনি। কারণ সেখানে আলো জ্বলছিল। তিনতলাটা অন্ধকারে পড়ে ছিল। ব্যালকনিতে নেমে সে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ সব জরিপ করে নিল। ব্যালকনি থেকে ভেতরের ঘরে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ। এবং সেটা ভেতর থেকেই। অর্থাৎ ওই পথ যজ্ঞেশ্বর ব্যবহার করতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত তাকে দোতলায় নেমে আসতে হল। পাইপ ধরে ঝুলে থেকে যখন নিঃসন্দেহ হল বারান্দার আশপাশে কেউ নেই, তখন সে দোতলায় নামল। ওইভাবে নেমে দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদে পড়তে হবেই, যজ্ঞেশ্বর দ্রুত একপাশে সরে এল। ভেতরে কারও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এ সময় অবশ্য গৃহস্থ জেগে থাকে না। কিন্তু কেউ তো এত আলো জ্বালিয়ে রেখে ঘুমোয় না। একটু অপেক্ষা করে সে উঁকি মারল। ঘরটি খালি। সেটা ডিঙিয়ে সে যে-ঘরে এল, সেখানে অনেক আসবাব। একটি খাটও আছে। কিন্তু কোনও মানুষ নেই। ঘরের আলো জ্বলছে। যজ্ঞেশ্বরের অস্বস্তি হল। অন্ধকার ছাড়া চুরি করতে সে কখনওই পারে না। ঠিক ওই সময় একটা আর্তনাদ তার কানে এল। প্রাণের দায়ে মানুষ এমন আওয়াজ করতে পারে।

কিন্তু চিৎকারটা সম্পূর্ণ হল না। কেউ যেন মুখ চেপে ধরেছিল। যজ্ঞেশ্বর পা টিপে টিপে পাশের ঘরের দরজায় গিয়ে উঁকি মারল। একটা ষণ্ডামার্কা লোকের হাতের থাবা চেপে রয়েছে শুয়ে থাকা বৃদ্ধের মুখে। বৃদ্ধটির হাত-পা খাটের সঙ্গে বাঁধা। একটু দূরে ইজিচেয়ারে বসে খিলখিল করে হাসছে গোল আলুর মতো দেখতে একটি লোক। লোকটি বলছে, ‘কেটে টুকরো টুকরো করে তিস্তায় ভাসিয়ে দেব। আমার সঙ্গে চালাকি? অষ্টধাতুর ব্রজগোপালের মূর্তিটা কোথায়? এখনও সুযোগ দিচ্ছি, বলে ফেলো। হাত সরাও।’

‘আমি জানি না। তুমি তো তোমার মায়ের শ্রাদ্ধের সময় আসোনি, এলে তখনই জানতে পারতে ওঁর মৃত্যুর দু’দিন আগে থেকেই মূর্তিটা নেই। সেই শোকে সেই সতীলক্ষ্মী হার্টফেল করলেন।’ যণ্ডামার্কা হাত সরাতে ককিয়ে ককিয়ে বললেন বৃদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে গোল আলু বলল, ‘নাভিতে পিন ফোটা।’

ষণ্ডামার্কা হুকুম তামিল করতেই আবার চিৎকার, আবার মুখ চেপে ধরা। গোল আলু এবার রেগে গেছে। ‘ব্রজগোপালের অষ্টধাতু-টাতু সব বাজে, ফালতু। আই-ওয়াশ। ওর পেটের মধ্যে ছিল দামি হিরে। অনেক দিন আগে মুঘলদের কাছ থেকে ডাকাতি করে ওটা পেয়েছিল আমার পূর্বপুরুষ। পেয়ে লুকিয়ে রেখেছিল জিনিসটা ব্রজগোপালের পেটে। তুমি ছাড়া কেউ এ-বাড়িতে ছিল না। অতএব না বলা পর্যন্ত তোমাকে আমি ছাড়ছি না।’

এসব কাণ্ড দেখে যজ্ঞেশ্বর বুঝল, ভুল জায়গায় এসে পড়েছে। হাতের কাছে যা পাবে তাই নিয়ে কেটে পড়লেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সে চটপট একটা আলমারি খুলল। জামা-কাপড়ে ঠাসা। হঠাৎ তার মনে হল বড্ড বেশি লোভী হয়ে পড়েছে। ওই ষণ্ডামার্কা লোকটার হাতে পড়লে তার বারোটা বেজে যাবে। সে দ্রুত ব্যালকনিতে বেরিয়ে এল। ওই সময় একটা চেয়ারে তার পা ঠুকে যাওয়ায় শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে গোল আলু চিৎকার করে উঠল, ‘কে, কে ওখানে?’ আর কোনও দিকে না তাকিয়ে পাইপ বেয়ে নীচে নেমে বাগান পেরিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালিয়ে এসেছে যজ্ঞেশ্বর।

অর্জুনের বেশ লাগছিল একজন চোরের আত্মকাহিনি শুনতে। এ বার বলল, ‘আপনাকে তো কেউ দেখেনি, ধরতেও পারেনি। তা হলে ফেঁসে গেলেন কী করে?’

‘ওই তো বিপদ। ওই হাঁক শুনে পালাবার সময় ভয়ের চোটে তাড়াহুড়োতে আমার তালা খোলার যন্ত্রটা ফেলে এসেছি।’ ককিয়ে উঠল যজ্ঞেশ্বর।

‘ওটা যে আপনার, তা কী করে লোকে জানবে?’

‘পুলিশ জানে। এই শহরের সব চোরের হাতিয়ার পুলিশের জানা।’

অর্জুন স্থির করতে পারছিল না সে কী করবে। অন্যের বাড়িতে চুরি করার জন্য গভীর রাত্রে ঢুকে যজ্ঞেশ্বর নিশ্চয়ই অপরাধ করেছে। অপরাধীকে বাঁচানো তার কাজ নয়। কিন্তু একজন বৃদ্ধকে বেঁধে রেখে হিরের জন্য অত্যাচার করা নিশ্চয়ই ন্যায়কর্ম নয়। যজ্ঞেশ্বর যা বলল তা যদি সত্যি হয় তা হলে চুপচাপ বসে থাকার কারণ নেই।

অর্জুন বলল, ‘আপনি আমার সঙ্গে চলুন।’

‘কোথায়?’ ভয় পেয়ে গেল যজ্ঞেশ্বর।

‘থানায়। পুলিশকে এসব কথা খুলে বলবেন।’

‘ওরে ব্বাবা! পুলিশ আমাকে ফাটকে ঢুকিয়ে দেবে।’

‘আপনি নিশ্চয়ই অন্যায় করেছেন। পুলিশ তা করতেই পারে। কিন্তু আমি আপনাকে এ ছাড়া অন্য কোনও ভাবে সাহায্য করতে পারছি না।’

শোনামাত্র যজ্ঞেশ্বর বারান্দা থেকে নেমে চোঁ-চোঁ দৌড় দিল। চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল লোকটা।

অর্জুনের এ বার অস্বস্তি শুরু হল। মাথার ভেতর কিছু ঢুকে গেলে সেটা না বের হলে স্বস্তি নেই তার। মোটরবাইক বের করে থানায় চলে এল সে।

বাইক থামাতেই বড়বাবুর সঙ্গে দেখা। বেজার মুখে তিনি জিপের দিকে এগোচ্ছিলেন। অর্জুনকে দেখে হাসার চেষ্টা করলেন, ‘কী ব্যাপার! সাতসকালে?’

‘আপনার কাছেই এসেছি। চললেন কোথায়?’

‘আর বলবেন না। আমাকে আজকাল ছোটখাটো অপরাধের তদন্তেও যেতে হচ্ছে। ভদ্রলোক আবদার করেছেন এস আই পাঠালে চলবে না, আমাকেই যেতে হবে। শুনছি উনি খুব ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোক। তাই।’

‘কার কথা বলছেন?’

‘এস পি সেন। আমেরিকার বড় ব্যবসায়ী। শিল্পসমিতি পাড়ায় ওঁর আদি বাড়িতে এসেছেন। কাল রাত্রে নাকি সেই বাড়িতে চোর ঢুকেছিল।’

অর্জুন খুশি হল, ‘আমি যদি আপনার সঙ্গে যাই তা হলে অসুবিধে হবে?’

‘অসুবিধে? না, না। কিন্তু এটা চুরিটুরির কেস। খুনটুন তো নয়।’

‘তাতে কী?’

বড়বাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘বেশ, চলুন।’

বড়বাবুর জিপটাকে অনুসরণ করে বাইকে চেপে অর্জুন শিল্পসমিতি পাড়ার যে বাড়িটায় পৌঁছল সেটি সদ্য সারানো এবং সাজানো হয়েছে। পুলিশ দেখে দরোয়ান গেট খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে অর্জুন আন্দাজ করে নিল, কাল রাত্রে যজ্ঞেশ্বর কোন পথে ওপরে উঠেছিল।

এস পি সেন লোকটিকে গোল আলু বলেছে যজ্ঞেশ্বর। একবর্ণ মিথ্যে কথা বলেনি। বসার ঘরে সোফায় শরীর ডুবিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘হোয়াট ইজ দিস? জলপাইগুড়ি শহরের ল অ্যান্ড অর্ডারের অবস্থা এইরকম? আমি সি এমকে জানাব। এন আর আইদের উনি দেশে ফিরতে বলছেন কিন্তু কোন ভরসায় আসব?’

বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কী চুরি গিয়েছে আপনার?’

‘চুরি করতে পারেনি। তাড়া খেয়ে পালিয়ে গেল। যাওয়ার আগে একটা দিশি যন্ত্র ফেলে গিয়েছে। টমি!’ চিৎকার করলেন এস পি সেন।

যজ্ঞেশ্বর যাকে ষণ্ডামার্কা লোক বলেছিল, তাকে দেখতে পেল ওরা। লোকটা দুটো লোহার সরু শিকগোছের জিনিস টেবিলে রাখল। দুটো হলেও মাথাটা একটা তারে বাঁধা। যজ্ঞেশ্বর এই দিয়ে তালা খোলে।

বড়বাবু সেটা তুলে দেখলেন, ‘একদম পাতিচোর। একে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ক্লু যখন রেখে গিয়েছে, তখন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ধরা পড়ে যাবে।’

এ বার অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ‘ও কোন ঘরে ঢুকেছিল?’

‘দোতলায়। পাইপ বেয়ে উঠেছিল।’

‘একটু দেখা যেতে পারে?’

‘শিওর। টমি, এদের নিয়ে যাও।’

দোতলায় উঠে এল ওরা। যজ্ঞেশ্বরের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। বড়বাবু বললেন, ‘চুরি যখন করতে পারেনি তখন এখানে সময় নষ্ট করে লাভ কী? এটা একদম ছিঁচকে ব্যাপার। পেছনে কোনও ব্রেন নেই।’

‘তা ঠিক। আচ্ছা, ওপাশের ঘরে কে থাকে?’ অর্জুন টমিকে প্রশ্ন করল।

‘কেউ না।’

উত্তরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন দরজার পাল্লা টেনে উঁকি মারল। না। ঘরে কেউ নেই। অথচ যজ্ঞেশ্বরের বর্ণনা অনুযায়ী ওই ঘরেই বৃদ্ধের ওপর অত্যাচার হয়েছিল। বৃদ্ধকে কোথায় সরাল ওরা?

সে জিজ্ঞেস করল, ‘এ-বাড়িতে কে কে থাকে?’

টমি বলল, ‘কয়েকজন কাজের লোক, আমি আর সাহেব।’

‘আগে একজন বৃদ্ধ এখানে থাকতেন। তিনি কোথায়?’

‘আমি জানি না। বোধহয় দেশে চলে গিয়েছে।’

‘দেশ! দেশ কোথায়?’

‘আমি জানি না।’

নীচে নেমে এস পি সেন কিছু বলার আগেই অর্জুন বলল, ‘আমরা ছেলেবেলা থেকেই শুনেছি আপনাদের এই বাড়িতে অষ্টধাতুর তৈরি ব্রজগোপালের মূর্তি আছে। খুব দামি। সেটা ঠিক আছে তো?’

‘ব্রজগোপালের মূর্তি!’ এস পি সেন ভ্রূ কোঁচকালেন।

‘আপনি জানেন না? ওহো, আপনি তো সেন। এ-বাড়ির কর্তারা রায় ছিলেন। গেটে তো দেখলাম ‘রায়বাড়ি’ লেখা আছে।’

‘আমার মামা হৃদয়রঞ্জন রায় বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান ছিলেন। মারা যাওয়ার আগে এই সব সম্পত্তি তিনি আমার নামে উইল করে গিয়েছেন। মনে হচ্ছে আমাদের এই বাড়ির ব্যাপারে আমার চেয়ে আপনি বেশি জানেন!’ এস পি সেন বাঁকাস্বরে কথাগুলো বললেন।

‘আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আপনাদের এ-বাড়ির অষ্টধাতুর কথা শহরের সবাই জানে। শুনেছি বাহাদুর শাহ যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন একদল মুঘল সৈন্যের ওপর লুঠতরাজ করে এই বংশের পূর্বপুরুষ অনেক সম্পদ পেয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি বড় হিরে ছিল। সেই হিরে ওই অষ্টধাতুর মূর্তির ভেতর লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। চোর এসেছিল শুনে আমার মনে হয়েছিল ওই মূর্তির সন্ধানেই সে এসেছিল।’ অর্জুন হাসল, ‘যাক, মূর্তিটি চুরি যায়নি?’

‘আমি এমন মূর্তির কথা কখনও শুনিনি। অবাক লাগছে।’

‘যে বৃদ্ধ এ বাড়িতে থাকতেন, তিনিও তো রায়। তিনি জানতে পারেন।’

‘পারেন। কিন্তু আমি আসামাত্র তিনি ছুটি নিয়ে তীর্থে চলে গিয়েছেন। তা ছাড়া ওসব গল্প বিশ্বাস করার মন আমার নেই।’

‘তা হলে অন্য কথা। তবে ওই বৃদ্ধ হাকিমপাড়ায় প্রায়ই যেতেন।’

‘হাকিমপাড়া! কেন?’

‘ওখানে একজন ব্যাচেলর প্রবীণ মানুষ আছেন। অমল সোম। লোকে ওঁকে খুব বিশ্বাস করে। নির্লোভ মানুষ। এমন হতে পারে বৃদ্ধ আপনাকে নিজের বংশের মানুষ নন মনে করে অমল সোমের কাছে মূর্তিটা গচ্ছিত রেখেছেন।’

বড়বাবু বললেন, ‘আমরা অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে ওঁর সময় নষ্ট করছি। মূর্তি সম্পর্কে ওঁর যখন কোনও ইন্টারেস্ট নেই, তখন; আচ্ছা চলি। চোরটাকে ধরতে পারলেই আপনাকে জানাব। নমস্কার।’

বাইরে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বড়বাবুর জিপকে অনুসরণ করে শেষপর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে জিপটাকে থামাল অর্জুন। বড়বাবু অবাক! অর্জুন তাঁকে এ বার সব কথা খুলে বলল। বড়বাবু হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘তা হলে সেই বুড়ো মানুষটাকে ওরা ওই বাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছে?’

‘মনে হয়। ছাদের চিলেকোঠা অথবা মাটির তলার ঘর, যে-কোনও একটা জায়গায় হয়তো এখন সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অমলদা এখন জলপাইগুড়িতে নেই। আজই ওঁর বাড়িতে হানা দেবে এরা। হাবু বাড়িতে আছে। ও কথা বলতে পারে না, কিন্তু গায়ে প্রচণ্ড শক্তি আছে। খুনোখুনি হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। আমাদের উচিত ওঁর বাড়িতে লুকিয়ে পাহারা দেওয়া।’ অর্জুন বলল।

‘ফাঁদ পাততে বলছেন? কিন্তু এস পি সেন আপনার ফাঁদে পা দেবেন?’

‘লোভ বড় মারাত্মক জিনিস।’

‘ঠিক আছে। ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।’

সেই রাত্রে অমল সোমের বাড়িতে কোনও হামলা হল না। অর্জুন একটু অবাক। তার পাতা ফাঁদে পা দেবেন না এস পি সেন, এটা সে ভাবতে পারেনি। সকালে থানায় এল সে। বড়বাবু বললেন, ‘আপনার যজ্ঞেশ্বর হাওয়া হয়ে গিয়েছে।’

‘মানে!’

‘তার বউ বলছে সে নাকি কাজকর্মের খোঁজে শিলিগুড়িতে গিয়েছে।’

অর্জুন বলল, ‘আমি একটু ঘুরে আসছি। যজ্ঞেশ্বরের ঠিকানাটা দিন তো?’

মাসকলাই বাড়িতে যজ্ঞেশ্বরের ভাঙা টিনের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ওর বউ বলল, ‘কবে ফিরবে বলে যায়নি।’

‘টাকাপয়সা কিছু দিয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওর তো হাতে টাকা ছিল না। দিল কী করে?’

‘একজন বুড়োমানুষ এসেছিলেন ওর কাছে। রায়বাবু নাম। তিনি দিলেন।’

‘কবে এসেছিলেন।’

‘কাল সকালে।’

‘কীরকম দেখতে?’

‘খুব রোগা আর বুড়ো।’

বাড়ি ফিরে এসে অর্জুন বড়বাবুকে ফোন করল, ‘বড্ড বোকা বনে গেছি। এস পি সেন কাউকে বেঁধে রেখে অত্যাচার করেননি। সেই বৃদ্ধ বাইরে, আর তার পরামর্শে যজ্ঞেশ্বর ওই বাড়ি থেকে অষ্টধাতুর মূর্তি চুরি করে একসঙ্গে উধাও হয়ে গিয়েছে। লোকটা আর পাতিচোর নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, ও কেন আমার কাছে এল? আমার কাছে আগ বাড়িয়ে মিথ্যে বলে ওর লাভ কী হবে?’

বড়বাবু বললেন, ‘একদিনের জন্যে আমরা ওর দিকে নজর দিতাম না, এটা কি ওর কম লাভ? বুড়োর সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারল। কিন্তু কোথায় পালাবে?’

অর্জুন রিসিভার নামিয়ে রাখল। সে হতভম্ব!

৬ নভেম্বর ১৯৯৬

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন