নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী

পৌলোমী সেনগুপ্ত

স্টেশনের ধারে গোকুলের দোকান থেকে কেরোসিন দিচ্ছে শুনে তোতনের ঠাকুমা আহ্লাদে হাঁসফাস করে তাড়াতাড়ি একটা হাফ-ক্যানেস্ত্রা বার করে এনে হাঁক পাড়লেন, “বাঁটুল, ছুটে যা! এক্ষুনি সব তেল ফুরিয়ে যাবে। যা যা, কুইক!”

এই একটি ইংরেজি শব্দ শিখে নিয়েছেন তোতনের ঠাকুমা কাজের লোকজনদের কাজে পাঠাবার সময় প্রয়োগ করতে। বাঁটুলের জন্যে সর্বদাই এটি বলতে হয়।

কে না জানে বাঁটুল যেখানেই যায় বাঘের মাসি হয়ে যায়। কেরোসিন আনতে যাবার পথে একটা ফলন্ত পেয়ারাগাছ চোখে পড়লেই তো হয়ে গেল। কিন্তু বাঁটুল ছাড়া আর যাবেই বা কে? কার এত সময় আছে? কেরোসিনের লাইন মানেই তো কম করে আধ মাইল লম্বা। বাসন-মাজুনি বাঁটুলের মা’র আট বছরের ছেলে বাঁটুলই একমাত্র ‘বেকার ব্যক্তি’।

তবে এখন বাঁটুল বেকার অবস্থায় ছিল না, রীতিমতো কর্মরতই ছিল। তাই ঠাকুমার তাগাদায় বিরক্ত হয়ে বলল, “কুইক বললেই কুইক? মুড়িগুলান শেষ হতে দ্যাও অগ্রে।”

“ওরে সর্বনাশ!”

তোতনের ঠাকুমা ছিটফিটিয়ে উঠলেন, “তোর ওই এক বস্তা মুড়ি শেষ হতে যে গোকুলের দোকানে ঝাঁপ পড়ে যাবে। যা বাবা, লক্ষ্মী ছেলে, ছুটে যা। এসে খাস। এখন বরং এই নাড়ু দুটো খেতে খেতে চলে যা।”

(এটি অবশ্যই ঘুষ!)

দু’-দুটো নারকেল নাড়ু, একসঙ্গে কবে জোটে? বাটুল তাড়াতাড়ি হাতের মুড়ির ঠোঙাটা জানলার গরাদের খাঁজে খুঁজে রেখে কুইক হাত পেতে বলল, “কই, দ্যাও।”

আর পাওয়ামাত্রই মুখের মধ্যে পুরে ফেলে খালি টিনটা উঠিয়ে নিয়ে ছুট মারল।

কিন্তু বেচারি বাঁটুল!

গোকুলের দোকানের সামনের লাইনের বহর দেখে হাঁ। ওদের পিছুতে তো দাঁড়াতে হবে। ছুট মেরে সামনের দিকে ঢুকে পড়তে গেলে যে কেউ রক্ষে রাখবে না, পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেবে তা জানে বাঁটুল।

আহা, মুড়ির ঠোঙাটা সঙ্গে নিয়ে এলেই হত।

কী আর করা! ক্ষণে-ক্ষণে গা চুলকোনো, মাথা চুলকোনো আর মাটিতে পা ঠুকে মশা তাড়ানো ছাড়া আর কিছু করার নেই।

ঘণ্টা দুই ওইভাবে হত্যে দিয়ে থেকে বাঁটুল দেখল, তার সামনে এখনও দু’কুড়ি লোক, কিন্তু তেল খতম।

শুধু বাতাসে তেলের সৌরভ বইছে।

বাঁটুলের অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না। তেল পায়নি দেখে ঠাকুমা কীরকম চেল্লাবে তাই ভাবতে ভাবতে হৃষ্টচিত্তে খালি টিনটা পেটে চেপে ধরে দু’হাতে পিটোতে পিটোতে গলা ছেড়ে গান ধরল—

তা ধিন তা ধিন ধিন!

রামছাগলে ছাইকেল চালায়—

হাতি পাড়ে ডিম!

আহা তা ধিনা ধিন ধিন!

গানটা বাঁটুলের বিশেষ প্রিয়। কারণ তোতনদা তাকে এটি শিখিয়েছে সুর সহযোগে। আরও লাইন আছে, অত মুখস্থ নেই। তাই ওই দু’লাইনকেই চালাতে চালাতে পা চালিয়ে আসছিল। হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়েই তিন ইঞ্চি জিভ বার করে গলা আর দুই পা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সামনে স্বয়ং গানের গুরু তোতনদা! সাইকেল চেপে আসছে।

সেও সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘোরাতে ঘোরাতে ব্যালান্স ঠিক রেখে হুংকার দিল, “কী বলছিস রে ফলের ঝুড়ি?”

হ্যাঁ, তোতন বাঁটুলের ওই নামকরণ করে রেখেছে, ফলের ঝুড়ি। কারণ তোতনের মতে পেটটা নাকি ইয়া একখানা তরমুজের মতো, মুখটা একটা ডাবের মতো, নাকটা জামরুলের মতো, চোখ দুটো কালো জামের মতো, গলাটা ঘটিপেয়ারার মতো, আঙুলগুলো পাকা কলার মতো, আর হাত-পা চারখানা শুকনো আখের মতো।

ফলের ঝুড়িকে নিয়ে তোতন সর্বদাই মজা করে আর খ্যাপায়। তবু বাঁটুল ‘দাদাবাবু’ বলতে অজ্ঞান। তোতনও তাকে সুচক্ষে দ্যাখে, কিন্তু সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে যদি কানে টিন পেটানোর তালের সঙ্গে খোলা গলার গান বেজে ওঠে—”রামছাগলে ছাইকেল চালায় তা হলে? নিজেই খেপে উঠবে না? হলেও বা এই উচ্চাঙ্গ সংগীতের লাইনটি তারই অবদান!

বাঁটুল শুকনো গলায় বলল, “কিছু তো বলি নাই। শুধু তোমার শেকানো গানটা গাইছি।”

“থাক, আর গান গাইতে হবে না, থাম। টিন নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”

“যাই নাই। ফিরচি। ইয়ে গেছলাম গোকুলদার দোকানে তেল ধরতে। দেল না। ফুইরে গেল।”

“তা যাবেই তো। অকর্মার ধাড়ি।”

বাঁটুল একগাল হেসে বলল, “তা যা কয়েছ। তো তুমি এমন রোদ্দুর মাথায় কোতায় চলেচ?”

তোতন গম্ভীরভাবে বলল, “যাচ্ছি নিরুদ্দেশ হতে।”

“আঁ।”

বাঁটুলের পেটের ওপর থেকে ক্যানেস্ত্রাটা গড়িয়ে পড়ে গেল। বাঁটুল সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ছুটে এগিয়ে এসে সাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরল, “হেই দাদাবাবু! নিরুদ্দিশ হতে যাবে ক্যানো? আঁ?”

‘ক্যানো আবার! জানিস না?”

তোতন আরও গম্ভীরভাবে বলে, “আমার পরীক্ষার রেজাল্ট শুনিসনি?”

বাঁটুল কষ্টে ঢোক গিলে বলে, “শুনিচি, থাট ডিবিশান।”

“আর বাড়িতে বকুনিগুলো শুনিসনি?”

বাঁটুল ভয়ে-ভয়ে ঘাড় কাত করে।

অর্থাৎ তাও শুনেছে।

“তবে? এত অপমান সহ্য করে থাকতে পারে মানুষ? নিরুদ্দেশ যদি না হতে পারি, রেললাইনে গলা দেব, ব্যস!”

“অ্যাঁ।”

বাঁটুল হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, “ওগো দাদাবাবু গো! অমন কাজ কোরোনি গো। মা তাইলে কেঁদে কেঁদে মরে যাবে। আর ঠাক্‌মা চিল্লিয়ে-চিল্লিয়ে পাড়া মাতায় করবে।”

“করুক। যার যা খুশি! আমি এই চললাম! আর ফিরছি না! যা, বাড়ি যা! কাউকে বলবি না আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। খবরদার।”

হঠাৎ ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল বাঁটুলের হাত দুটো।

বোঁ করে কেটে বেরিয়ে গেল।

বাঁটুলও অবশ্য ছুটতে শুরু করল পিছু পিছু, “ও দাদাবাবু! হেই দাদাবাবু, তোমার পায়ে ধরি দাদাবাবু। নিহাত নিরুদ্দিশ হবে তো হও, রেললাইনে গলা দিওনি।”

কিন্তু সাইকেলের সঙ্গে কতক্ষণ ছুটতে পারবে? তাও আবার কাঁদতে কাঁদতে!

অনেকটা দূর থেকে দেখতে পেল দাদাবাবু সাইকেল থেকে নেমে সেটাকে ইস্টিশনের চায়ের দোকানের গায়ে ঠেকিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে চা-ওলাকে কী একটা বলে ছুটে গিয়ে প্রায় ছেড়ে দেওয়া চলন্ততুল্য গাড়িটাতে চেপে বসল।

বাঁটুলের চোখের সামনে দিয়ে রেলগাড়িটা বেরিয়ে গেল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে।

বাঁটুল সেই ধোঁয়ায় দু’চোখে ধোঁয়া দেখে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। বসেই রইল বহুক্ষণ!

আর বহুক্ষণ পরে হঠাৎ মাথায় হাত দিয়ে চাপড়ে তির-বেগে ছুটল বাড়ির দিকে। মনে পড়ল বাড়িতে খবরটা দেওয়ার ছিল। দাদাবাবু বলেছে বাড়িতে না বলতে। কিন্তু তাই কখনও পারা যায়?

তোতনের ঠাকুমা বাঁটুলকে পাঠিয়ে পর্যন্ত ঘরবার করছিলেন কতক্ষণে আসে। এলেই খালি জনতা-স্টোভটায় তেল ভরে ফেলে ভাঁড়ার ঘরে বসে আলাদা করে মোচার চপগুলো ভেজে নিয়ে ছুটির দিনে ছেলেদের খাওয়াবেন। তো হায় কপাল! বেলা গড়িয়ে দুপুর। আর কখন খাবে তারা মোচার চপ?

এই সময় বাঁটুলের শূন্য হাতে আবির্ভাব।

“তেল কই?”

বাঁটুল সবেগে মাথা নাড়ে, “পাই নাই, ফুইরে গেল।”

“পাও নাই, ফুইরে গেল? ফাঁকিবাজের রাজা। দুষ্টবুদ্ধির শিরোমণি! রাস্তায় খেলা করে দেরি করেছিলি বুঝি?”

অপমানে বাটুলের মুখ লাল হয়ে ওঠে, “খেলা করিচি, শুদিয়ে এসোনা গোকুলদাকে! কত বড় লাইন।”

“ও, আমি যাব তোর গোকুলদাকে শুদোতে? তো তেল তো পাস নাই! টিনটা কোথায়?”

“টিন!”

বাঁটুল আবার চোখে ধোঁয়া দেখে। তাই তো। টিনটা কখন কোন ফাঁকে উপে গেল।

ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল। টিন বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে আসছিল। রাস্তার মোড়ে বড় বকুলতলার কাছে তোতনদাকে দেখে—।

তারপর… তারপর…!

বাঁটুল তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “তোমার টিন হুই বড় বকুলতলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।”

“বটে। কেন শুনি? হঠাৎ তোকে ভূতে পেল বুঝি?”

বাঁটুল সবেগে বলল, “ভূতে আমারে ধরবে ক্যানো? ধরবে তোমার আদরের লাতিকে। নইলে তুচ্ছ কারণে এমন সুকের জেবন ছেড়ে নিরুদ্দিশ হতে যায়? রেললাইনে গলাকাটা করতে চায়? পাশ তো করেচ। ফেল তো আর হও নাই। না হয় থাই ডিবিশান। তার জন্যে…’

তোতনের ঠাকুমা রেগে আগুন হয়ে হাঁক পাড়েন, ‘বাঁটুলের মা। দ্যাখো তো এসে তোমার ছেলে কেরোসিন আনতে গিয়ে টিন হারিয়ে কুড়ি ঘণ্টা পরে ফিরে এসে পাগল সেজে কী বকছে আবোল-তাবোল। এইটুকু ছেলে। এমন শয়তান গো! বকুনির ভয়ে পাগল সাজছে!”

অপমানের ওপর অপমান!

বাঁটুল চেঁচিয়ে ওঠে, “পাগল সাজতেচি? দাদাবাবু চেরজন্মের মতো চলে গেল, তাই দেখে আমারে বলে মাতাটা পাগল হয়ে যাচ্ছে! আর তুমি কিনা…”

ঠাকুমার ডাকাডাকিতে বাঁটুলের মা’র সাড়া পাওয়া গেল না। গেছে বোধহয় কোথাও। তবে বাড়ির আর সকলে ছুটে এল। ছুটির দিন তো। সবাই বাড়িতে।

এলেন তোতনের ব্যাচিলর জ্যাঠামশাই, এখনও বিয়ে না হওয়া ছোটকা, বাপের বাড়ি বেড়াতে আসা বিয়ে-হওয়া বড়পিসি আর এখনও স্কুল-পড়ুয়া আইবুড়ো ছোটপিসি।

আর সব আগে তো তোতনের মা।

অনুপস্থিত শুধু তোতনের বাবা। অফিসের কাজে কোথায় যেন ট্যুরে গেছেন।

তো প্রত্যেকের প্রথম কাজ হল অবশ্য বাঁটুলকে একপালা জেরা করা আর ধমক দেওয়া। ছোটকার হাতের দুটো গাঁট্টাও জুটল।

“এই তোর দাদাবাবুকে ভালবাসা? নিরুদ্দেশ হয়ে চলে যাচ্ছে শুনেও ছুটে গিয়ে আটকাতে পারলি না?”

“কেমন করে আটকাব শুনি? ছাইকেলের সঙ্গে ছুটতে পারে মানুষ?”

“মানুষ না পারুক, তুমি ঠিকই পারো জদু। ছাগলছানা ধরতে সাধ হলে মোটরগাড়িকে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারো।”

“ঠিক আছে। আমি দাদাবাবুরে ভালবাসিনে! হল?”

“ওঃ। আবার চোটপাট। (এই সময় গাঁট্টা।)। যাচ্ছিস কোথায়? দাঁড়িয়ে থাক। ভেবেছিস জেরা শেষ হয়ে গেছে?”

বাঁটুল ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, “জেরা কীসের? আমি চোর?”

“আহাহা! চোর কেন হবে তুমি? মহাপুরুষ! বলি দাদাবাবুকে রেলে চেপে চলে যেতে দেখেও ছুটে এসে খবর না দিয়ে অনেকক্ষণ বসে কাটালি কেন?”

“জানিনে। মাতা গুইলে গেল।”

“ওঃ। মাতা গুইলে গেল! তো ঠাকুমা কেরোসিনের জন্য যে টাকা দিয়েছিল সে-টাকা কোথায় গেল?”

“কোতায় আবার যাবে? টাকার কি পা আছে, না ছাইকেল আছে যে পাইলে যাবে? যেখেনে থাকার সেখেনেই আছে।”

হাফ-প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুটো দশ টাকার নোট বার করে সামনে ফেলে দেয় বাঁটুল।

যাক! তবু ভাল৷ বড় পিসির তো সন্দেহ হচ্ছিল, রাস্তায় খেলতে খেলতে টাকাটা কোথায় হারিয়ে ফেলে খুদে শয়তানটা একটা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে তাক লাগাতে বসেছে।

যাক একটা সন্দেহ ভাঙল। টাকাটা হারায়নি। তবে খেলে বেড়িয়ে দেরি করে তেলের টিনটা কোথায় হারিয়ে ফেলে, তেল না নিয়ে ফিরেছে বলেই এই গল্প।

“দ্যাখো, তোতন খানিক পরে ঠিকই ফিরবে। কোথায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। নিরুদ্দেশ অমনি হলেই হল! আর হতে যাবার সময় সেকথা বলে যাবার আর লোক পেল না বাঁটুল ছাড়া? আসলে ছেলেটা মহা ওস্তাদ।”

বাঁটুলের বয়সটা যে মাত্র আট সেকথা কারও বিশেষ মনে থাকে না।

তা থাকবেই বা কী করে?

বাঁটুলের আহারটি যে চার আষ্টে বত্রিশের তুল্য। আর কথাবার্তা? সে তো আট দশে আশির তুল্য।

কিন্তু বাঁটুলের গল্পটা যে স্রেফ গল্প সেটা প্রমাণ হল কই? খানিকক্ষণ পরে এসে পড়ল কই আড্ডাবাজ ছেলে তোতন!

ক্রমেই বেলা বাড়ে। তার সঙ্গে ভয় বাড়ে। বেলা গড়িয়ে বিকেলে পৌঁছয়, হৃদয় বিকল হয়ে যায়।

খাওয়া-দাওয়া তো মাথায় উঠেছে। রান্নাঘরে যেমনকার তেমন সব রান্নাবান্না পড়ে আছে। নেহাত ঘরের দরজায় শেকল তোলা বলে বেড়াল মাছ-দুধ খেয়ে যায়নি।

‘ছেলেটা ফিরলে একসঙ্গে খাওয়া হবে, ভাবতে ভাবতে যদি দেখা যায় ছেলেটা ফিরলই না, কে আবার ভাত বেড়ে খেতে বসবে?

বিকেল হয়ে যেতে তোতনের ছোটকা আর ছোট পিসি পাড়ায় খোঁজ করতে বার হলেন তার বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি। সন্ধের পর ফিরলেন তারা। এসে সংবাদ পরিবেশন করলেন, কেউ কিছু জানে না। তা ছাড়া নেইও সবাই। স্বদেশ গেছে তার মায়ের সঙ্গে মাসির ছেলের জন্মদিনে কলকাতায়, পল্লব গেছে রিষড়ের পিসির মেয়ের পরীক্ষা পাসের খাওয়া খেতে সপরিবারে। বাড়ি বন্ধ। পাশের বাড়ি বলে গেছে। কিশলয়রাও সবাই মিলে কলকাতায় গেছে ছুটির দিনে আমোদ করতে। আর রঞ্জন? সবথেকে যে প্রাণের বন্ধু? সে নাকি পরশু থেকে কলকাতাতেই আছে মামার বাড়ি।

কেউ কোনও হদিশ দিতে পারল না।

তার মানে বাঁটুলের কথাই সত্যি।

আর সেটা বোঝামাত্রই ভেঙে পড়ার পালা।

তবে জ্যাঠামশাইয়ের ভাঙনটাই ধরা পড়ল প্রথম। তিনি উদ্দাম গলায় বলে উঠলেন, “তা হবে না নিরুদ্দেশ? পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলে ছেলেটাকে এত হেনস্থা। এখনকার ছেলে। এত অপমান সইবে কেন? এদিকে বিশ্বসুদ্ধু সবাই জানছে। এবার খাতা দেখা হয়েছে ভুতুড়ে পদ্ধতিতে। অথচ…”

শুনে ভেঙে-পড়া ঠাকুমাও তেড়ে উঠে বললেন, “তা হেনস্থা তো কাকা-জ্যাঠা তোরা দু’জনাই বেশি করলি। বংশের মুখ ডোবালি, বাড়ির মুখে চুনকালি দিলি। এ বাড়িতে কেউ কখনও থার্ড ডিভিশন হয়নি। এর পর কুলিগিরি করে খেতে হবে। কোনও কলেজের চৌকাঠেও ঢুকতে দেবে না।বলিসনি এসব? তুলোধোনা করে ছেড়েছিস ছেলেটাকে। বরং মা-বাপই কিছু বলেনি, চুপচাপ ছিল।”

ঠাকুমার ন্যায্য কথা!

জ্যাঠামশাই মাতৃবাক্যে আরও উত্তেজিত হয়ে বলেন, “তো সেটাই তো বেশি হেনস্থা। চুপচাপের চাপই তো পাথরের চাপ। ভাবটা যেন তোমার মতন অখদ্যে ছেলেকে বকতেও রুচি নেই। যেন তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামানোরও দরকার নেই। হুঁঃ। এতে আর মনে দাগা পাবে না? …বেশ, ঠিক আছে, আমারই দোষ। তো বসে বসে গজালি করলে তো চলবে না? কাজ এগোতে হবে তো? ছোটকু, এই ছোটকু।”

বড়পিসি ওদিক থেকে এসে বললেন, “ছোটকু তো আবার বেরোল!”

“আবার বেরোল? কোথায় বেরোল? কেন বেরোল? কে তাকে বেরোতে হুকুম দিল? ওঃ। সবাই কর্তা। এখন এই যে টিভিতে রেডিয়োতে খবর পাঠাব, কে নিয়ে যাবে?”

বড়পিসি অবাক হয়ে বললেন, “টিভি, রেডিয়ো? সে তো তা হলে কলকাতায় যেতে হবে।”

“তা হবেই তো! কলকাতায় না গেলে কিছু হবে? এই শ্রীরামপুরে ঘরে বসে বসে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই হবে না। ঠিক আছে, আমিই লিখে দিচ্ছি। দরকার হয় নিজেই চলে যাব কলকাতায়।”

ফট করে উঠে গিয়ে একখানা খাতা আর একটা ডটপেন নিয়ে হাঁক দিলেন, “বউমা, বউমা, তোতনের পোশাকি নামটা কী যেন?”

বউমা মানে তোতনের মা। জ্যাঠামশাইয়ের ভাদ্রবউ। তবু ভাসুরের প্রশ্নে হাঁ হয়ে বললেন, “নাম? তোতনের? আপনি জানেন না?”

জ্যাঠামশাই বীর-বিক্রমে বললেন, “জানব না কেন? নিজের ভাইপো। নাম জানব না? তবে গোলেমালে যদি ভুলভাল হয়ে যায়? এই যে বড় বড় গাইয়েরা সভায় এসে গান গায়। গান কি তাদের মুখস্থ থাকে না? তবু হারমোনিয়ামের ওপর গানের বই-খাতা বিছিয়ে রাখে। কেন রাখে, নির্ভুল হবার জন্যে। বুঝলে? সেই জন্যেই…।”

তোতনের মা আস্তে বললেন, “ভাল নাম তথাগত।”

“তথাগত! কারেক্ট। তথাগত, তথাগত কী, ও, তথাগত রায়। রায়বাড়ির ছেলে যখন। হয়ে গেল এক নম্বর। নম্বর দুই গায়ের রং। গায়ের রং কী? অ্যাঁ”

তোতনের মা আরও অবাক হয়ে বললেন, “জানেন না?”

‘কী আশ্চর্য! দিনরাত দেখছি, জানি না? তবু তুমি হচ্ছ মা। তোমার কাছে ভেরিফাই করে নিচ্ছি।”

তোতনের মা আস্তে আস্তে বললেন, “ফর্সা।”

ঠাকুমা বলে উঠলেন, “বউমা, যা জানতে চাইছে কুইক উত্তর দাও। দেখছ তো, রাত বেড়ে যাচ্ছে!”

“ঠিক! তা হলে গায়ের রং ফর্সা। আচ্ছা লম্বায় ক’ফুট ক’ ইঞ্চি?”

তোতনের মা’র কাতর গলা, “তা কী জানি। আমি কি মেপে রেখেছি।”

“অ্যাঁ। মেপে রাখোনি? বলো কী বউমা। রাজ্যসুদ্ধু লোক তাদের যত ছেলে মেয়ে মায় বাড়ির সবাইকে মেপে রাখে আর তোমার একটামাত্র ছেলেকে মেপে রাখোনি। এখন উপায়?”

ঠাকুমা বললেন, “হাঁ রে ভুলু, সবাই ছেলেপুলেকে মেপে রাখে?”

“রাখে না? নিত্যদিন টিভিতে ডজনখানেক নিরুদ্দেশের ডেসক্রিপশান মানে ইয়ে বিবরণ শোনো ? আঃ, কী লিখি তিন নম্বরে?”

ঠাকুমা তাড়াতাড়ি বলেন, “আমার মাথা ছাড়িয়ে পেরায় চার-ছয় আঙুল। তাই লিখে দে।”

“তোমার মাথা ছাড়িয়ে বললেই তো চলবে না। তোমার মাপটা কী সেটা দেখতে হবে তো।”

উঠে গেলেন। কোথা থেকে একটা গজকাঠি নিয়ে এসে মা’কে দাঁড় করিয়ে মেপে নিয়ে বললেন, “বুঝেছি।”

লিখলেন, পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি।

“যাক, অনেকটা এগিয়ে গেল। এখন চটপট বলো তো বউমা শরীরে কোনও বিশেষ চিহ্ন আছে?”

ঠাকুমাই কুইক’ উত্তরটা দিয়ে দিলেন, “ওমা। নেই আবার। খুঁটের চাপড়ার মতন একখানা জড়ুলই তো রয়েছে শরীরে।”

“অ্যাঁ। তাই না কি? খুব ভাল, খুব ভাল।”

জ্যাঠামশাই আহ্লাদে উল্লসিত হলেন।

“তো কই, কোথায় জড়ুল? আমি তো…”

“এখন আর দেখবি কী করে? শৈশবে দেখেছিস। যখন কিছু না পরে উদোম হয়ে বেড়াত, তখন দেখেছিস?”

“অ্যাঁ। তার মানে? ওঃ। বুঝেছি। তো বউমা, ছেলেটির কি তোমার সবই বিদঘুটে! যাতে অন্যের অসুবিধে ঘটে সেটাই হবি। শনাক্ত করতে শরীরের কোনও বিশেষ চিহ্নটা কাজে লাগে। সেটা সবাইয়েরই জানা। তো চিহ্নটা গালে-মুখে কি হাতে-পায়ে কোনও সভ্যভব্য জায়গায় রাখা যেত না? শিক্ষা-দীক্ষার দরকার বউমা! ছেলের শিক্ষা-দীক্ষার দরকার। তো চুলোয় যাক চিহ্ন। এখন বলো নিখোঁজ হওয়ার সময় পরনে কী ছিল?”

“নিখোঁজ হওয়ার সময়? পরনে?”

তোতনের মা এখন চোখে আরও অন্ধকার দেখেন।

সে বেচারি কী করে জানবে পরনে কী ছিল? একশোটা জামা-প্যান্ট। কখন কোনটা পরছে কোনটা ছাড়ছে, কোনটা পরে বেরোচ্ছে, কে তার হিসেব রাখছে? কোথাও যাবার সময় কি বলে যায়? আর বলে গেলেই কি মনে থাকে, ছেলের পরনে চেক শার্ট ছিল না ডোরাকাটা? গোলাপি না নীল, সবুজ না হলদে, মাখনরং না ছাইরঙা?

তখন তো একমাত্র প্রশ্ন থাকে, কোথায় যাচ্ছিস? কখন ফিরবি?

তাই নিয়েই যাত্রাকালে তর্কাতর্কি বকাবকি!

জ্যাঠামশাই গম্ভীর ভাবে বলেন, “বুঝলাম, এটুকুও জানো না। এ ছেলে যদি নিরুদ্দেশ না হয় তো কে হবে? এত নেগলেকটেড চাইল্ড। আশ্চর্য! বউমা, দেখছ তো দিনের পর দিন? নিখোঁজ নিরুদ্দিষ্টদের কীভাবে নিখুঁত বিবরণ দেয়? নিখোঁজ হবার সময় পরনে কী ছিল তা-ই যখন বলতে পারা যাচ্ছে না, তখন আর খোঁজ পাওয়ার আশা বৃথা।”

উপোসে আর দুর্ভাবনায় ঝিমিয়ে পড়ছিলেন ঠাকুমা। আবার তেড়ে উঠলেন, “আজ সবাই তো বাড়ি ছিলি। দেখে রাখতে পারিসনি। যত দোষ নন্দ ঘোষ।”

“আচ্ছা বাবা আচ্ছা। যত দোষ আমার। তুমিও তেমনি মা আমার। যাকগে একখানা ছবি হবে?”

“ছবি!”।

“হা হা, ছবি। তোতনের একখানা ছবি। মানে ফোটো। …কী? একখানা ছবিও নেই ছেলেটার?”।

জ্যাঠামশাই হঠাৎ কোঁচার খুঁট তুলে নাক মুছতে থাকেন। তারপর ধরা গলায় বলেন, “এর পরও বলতে হবে ছেলেটা নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়ে অন্যায় করেছে? এরকম অবহেলিত, অপমানিত, অ-অ-অভাগার বাড়ির থেকে বাইরেটাই শ্রেয় মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা হলে ছবি হবে না? নেই?”

তোতনের মা কষ্টে বললেন, “ছিল তো। বন্ধুদের সঙ্গে স্টুডিয়োয় গিয়ে তুলিয়েছিল তো শখ করে। কোথায় রেখেছে কে জানে। আমার কাছে বাড়ির সকলের গ্রুপ ফোটো আছে।”

“গ্রুপফোটো! গ্রুপফোটো নিয়ে আমি কী করব? টেলিভিশন অফিসে গিয়ে বলব এই সবাই আমরা সপরিবারে নিখোঁজ হয়ে গেছি? হোপলেস। আর এই আমার মেজভাইটির কথা বলছি, জ্ঞানের বালাইমাত্র নেই। ট্যুরে যাবার আর সময় পেল না? ট্যুর পালিয়ে যাচ্ছিল? এই মোক্ষম সময় একমাত্র ছেলেটা নিখোঁজ হয়ে গেল, উনি বাপ, ট্যুরে গিয়ে বসে থাকলেন। এদিকে বাড়িতে ছেলের একখানা ছবি পর্যন্ত নেই। ছেলের পরনে কী ছিল তা কেউ জানে না।”

ঘনঘন কোচার খুঁট তোলেন জ্যাঠামশাই, আর নাক মোছেন।

তারপর গলা ছেড়ে বলেন, “আর তোতনকেও বলি, নিরুদ্দেশ হবার জন্যে যখন বেরিয়েছিস, টেবিলে একখানা ফোটো তো ফেলে যেতে হয়। জানে তো ওটাই জরুরি। বাড়ির সবাই যখন কেয়ারলেস!”

তোতনের বড়পিসি হাই তুলে বলেন, “তা সত্যি দাদা। আমার দেওর তো বলে, টিভিতে ছবি ওঠাবার জন্যেই এইসব ছেলেপুলে হঠাৎ নিখোঁজ হয়। দু’দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকে। ছবিটা উঠলেই ফিরে আসে। নইলে রোজ এই মুঠো মুঠো ছেলে হারিয়ে গিয়ে যায় কোথায়? থাকে কোথায়? খায় কী? পরে কী? ফিরে না এলে শুধু হারানো ছেলেপুলেতেই তো রাজ্য ভরে যেত! তারা একযোগে তাদের জন্য একটা ‘নিখোঁজ ল্যান্ড’-এর দাবি তুলত।”

ভুলু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, “হুঁ। তোর সবজান্তা মহাজ্ঞানী দেওর আর কী কী জ্ঞান দিয়েছে তোকে?”

“আমায় আবার কী জ্ঞান দেবে? তবে বলে যে, অনেক ছেলেমেয়ে নাকি সিনেমায় একটু চান্স পাওয়ার আশায় বম্বে চলে যায়। তারপর ফেরার পয়সা থাকে না, চান্সও পায় না। শেষমেশ রাস্তা ঝাড়ু দেয়, জুতো সাফ করে। ইয়ে…।”

“থাম বুড়ি। থামা তোর…। ওঃ। মাথা ধরিয়ে দিল। টিভিতে ছবি উঠবে বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে হারিয়ে যাবে। ছবি ওঠার আর কোনও উপায় নেই? মাধ্যমিকে ফার্স্ট হওয়া যায় না? রাষ্ট্রপতির পদক পাওয়া যায় না?”

আরও কিছু বলতেন ভুলু, এই সময় ছোটভাই পুলু এসে বসে পড়ে বললেন, “থানায় থানায় খবর দিয়ে এলাম। কলকাতায় লালবাজারে ফোনও করে জানিয়ে এসেছি। তবে ভরসার কথা, আজ সারাদিনে তিনশো মাইলের মধ্যে কেউ কোথাও রেললাইনে গলা দেয়নি।”

জ্যাঠামশাই একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, “দেয়নি তা জানতাম। ছেলেটা তো হৃদয়হীন নয়। প্রাণে দয়া-মায়া আছে। কিন্তু ফোনে-ফোনে কর্তব্য সারলেই তো হল না। এখন তো একবার কলকাতায় যেতে হবে।”

“কলকাতায়? এই রাত দশটায়?”

“দশটা রাত এমন কিছু না পুলু। নাইট শোয় সিনেমা দেখতে যাও না তোমরা? বলছি ডেসক্রিপশান অবশ্য কিছুই পাইনি। একখানা ছবিও না। তবু তো একবার খবরটা দিয়ে আসতে হবে।”

“এখন? এখন ওদের অফিস খোলা আছে?”

“জানতাম এই কথাই বলবি। কথা কাটানো চিরকালের স্বভাব। ঠিক আছে। কাল সকালেই যেয়ো। তবে একখানা ফোটো হাতে না করে যাবি কোন মুখে তাই ভাবছি। আশ্চর্য। ছেলেমেয়ে তো বটেই—যত সব বুড়োহাবড়া, পাগল-ছাগল বোবাকালা, মুটে-মজুর শখ করে নিখোঁজ হয়ে গেলে টিভিতে ছাপতে দিতে একটা অন্তত ছবি থাকে। আর বাড়িতে লেখা থাকে লোকটার নাম কী, মাপ কী, গায়ের রং কী, বয়েস কত, নিখোঁজ হবার সময় পরনে কী ছিল—অথচ আমাদের সবেধন নীলমণি ছেলেটার…।”

ভুলু আবার কোঁচার খুট তুলে ঘনঘন ঘাম মোছেন। তারপর বলেন, “যদি ভগবানের দয়ায় কখনও ফিরে আসে, কেউ একদম বকাবকি করবে না তা বলে রাখছি।”

পুলু বলল, “তুমি মনে রাখলেই হল।”

“অ্যাঁ! কী? আমি..আমি…”।

হঠাৎ এই সময় সদর-দরজায় কড়া নড়ে উঠল।

‘সর্বনাশ করেছে। নির্ঘাত পুলিশ! পুলু,” বলে আবার পুলুর আগেই ভুলু নিজেই ছুটে গেলেন। এবং পরক্ষণেই তার চড়া গলার চিৎকার শোনা গেল, “পুলিশ কীসের তাই আবার জিজ্ঞেস করছিস? বেহেড, বেয়াড়া গোঁয়ারগোবিন্দ লক্ষ্মীছাড়া ছেলে। সাপের পাঁচ পা দেখেছ তুমি? যা ইচ্ছে তাই করবে? না বলেকয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে তুমি, আর বাড়ির লোক থানা-পুলিশ করবে না?”

“নিরুদ্দেশ! ওঃ। বাঁটলা বলেছে বুঝি? দেখাচ্ছি মজা! তো আপনারাই বা কী? পাগলটাকে খ্যাপাতে কী বলেছি, তাই নিয়ে একেবারে থানা-পুলিশ?”

“শুধু থানা-পুলিশ কেন, টিভিতেও তো খবর দিতে যাচ্ছিলাম। নেহাত একটা ছবির অভাবে…।”

“চমৎকার!”

“চমৎকার মানে? এইভাবে বাড়িতে না বলেকয়ে…।”

“বাঃ! না বলেকয়ে আবার কী? মাকে তো বলে রেখেছিলাম আমরা তিনবন্ধু এবারে পনেরোই অগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করব। ইচ্ছেমতো বেড়াব, ঘুরব, সিনেমা দেখব। রেস্টুরেন্টে খাব আর…।”

মা আর থাকতে পারেন না। প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলেন, “রেখেছিলি? কবে বলেছিলি?”

“বাঃ! গত বছর পনেরোই অগস্ট বলিনি তোমায়, সামনের বছর পনেরোই অগস্ট আমরা যা খুশি তাই করব।”

“গত বছর!”

মা আর কিছু না বলে সোজা রান্নাঘরের দিকে চলে যান।

ইত্যবসরে বাড়িতে রব উঠে গেছে, “এসেছে। এসেছে!”

ঠাকুমা আর পিসিরা একহাত নেবার জন্যে ঝাঁপিয়ে আসছিলেন, ভুলু আঙুল তুলে বললেন, “নো নো। কেউ একটি কথা নয়। তোমাদের বকাবকিতেই ছেলেটা মনের দুঃখে…!”

“আমাদের বকাবকিতে? তুই-ই তো রাতদিন তুলোধোনা করছিস ছেলেটাকে!”

“আমার কথা বাদ দাও। আমি যা করি ওর ভালর জন্যেই করি মা! তো এখন আর রাতদুপুরে পঞ্চব্যঞ্জন রাঁধতে বোসো না। চালেডালে চড়িয়ে দাও। খানকতক বরং বেগুনি ভেজো, আর গোটাকতক ডিম। পেটের মধ্যে রাম-রাবণের যুদ্ধ চলছে। সেই সকালে যা চা খাওয়া হয়েছে। বউমা, দু’খানা পাপড়ও -হয় ভেজো। উঃ। পেটের মধ্যে আবার দেখছি যোগ ব্যায়াম শুরু হয়ে গেল।”

তোতন অবাক হয়ে বলে, “কী? তোমরা সারাদিন খাওনি নাকি?”

ঠাকুমা মারমুখী হয়ে তেড়ে আসেন, “বলতে লজ্জা হচ্ছে না বাঁদর ছেলে!”

“মা, ফের?”

জ্যাঠামশাই আবার হাত তোলেন, “কী বললাম? তবে তোমাকেও বলি প্রভু তথাগত, এই দণ্ডে একটি কাজ করতে হবে। করে তবে জলগ্রহণ। ও, তোমার বোধহয় আর খাওয়া-দাওয়ার দরকার নেই। গা থেকে যা চপ কাটলেট-মুরগি-পোলাওয়ের সুবাস ছাড়ছে। আঃ। তা থাক, চটপট এই খাতাটায় লিখে ফেলো দিকি তোমার নাম, ধাম, বয়েস, গায়ের রং, উচ্চতা, ওজন! আর কাল সকালেই প্রমথেশের স্টুডিয়ো থেকে একখানা ভালমতো পোজ দিয়ে ফোটো তুলিয়ে আসবে। ভবিষ্যতের কোনও অসুবিধে রাখতে চাই না আমি। যাবার সময় টাকা নিয়ে যেয়ো আমার কাছ থেকে।”

হঠাৎ কোন অন্ধকারের কোণ থেকে বেরিয়ে আসে একটা ঘন কালো ছায়ামূর্তি, “হেই দাদাবাবু, তালে আমাকেও সাতে নে গিয়ে একটা পোচ করে ফটক তুইলে দিয়ো; আর খাতায় ওইসব নেকানিকি করে রেকো!”

“ওমা! কী কাণ্ড! তুই আবার এসব কী করবি?”

বাঁটুল তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, “আমি আবার কী করব? তোমাদের ভবিষ্যতের সুবিদের জন্যে বলা।”

“আমাদের ভবিষ্যতের জন্যে?”

হা-হা হি-হি হো-হো।

হাসির ঢেউ বয়ে যায় ঘরে।

“তুই আবার কোথায় ছিলি রে ফলের ঝুড়ি?”

ফলের ঝুড়ি আরও তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, “কোতায় আবার? ইস্টিশনের ধারে। ভেবে বসে থেকেচি, রাতভর যত টেরেন আসে দেকব! যদি দেকি দাদাবাবু নিয্যস ফিরল না, আমিও যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব। হাঃ! তো দেকলাম মা কালীর দয়া হল। টেরেন থেকে নামল দাদাবাবু। চায়ের দোকান থেকে ছাইকেলটা নিল, বোঁ করে বেইরে এল! আমিও ত্যাখন গুটিগুটি হাঁটা দিলাম। এয়েছে য্যাখন, আর তাড়া কী!”

তোতন বলল, “ইশ! কী বোকা। এতখানি হেঁটে মরলি! আমায় ডাকলি না কেন? সাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে আসতাম।”

বাঁটুল সতেজে বলে, “আহা রে। বাঁটুলের য্যানো ত্যাখন রা কাড়বার ক্ষ্যামোতা ছিল!”

“তাই না কি? এখন তো একদম খই ফুটছে!”

“অ্যাখোন ফুটবে না ক্যানো শুনি? অ্যাখোন তো গানও ফুটতে পারে। এই তো গাইছি—

তা ধিন তা ধিন ধিন
রামছাগলে ছাইকেল চালায়
হাততি পাড়ে ডিম।

“ঠাকুমা, আমার সেই মুড়িগুলান কোতায় গেল? পেটের মধ্যে শিয়াল ডাকতেছে, বিড়াল আঁচড়াচ্ছে।… তা ধিন তা ধিন ধিন!… ফটকখানা কিন্তু তুইলে দিয়ো জ্যাঠামশাই। কে জানে কোন দিন নিখোঁঝ নিরুদ্দিশ হবার সাধ যায়!”

৭ জানুয়ারি ১৯৮৭

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন