টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী

পৌলোমী সেনগুপ্ত

টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন  -আশাপূর্ণা দেবী

এত কাণ্ডের কিছুই হত না যদি না গাবদাগোবদা টিকটিকিটা আচমকা বেদান্ত বর্ধনের দেওয়াল-ধারে রাখা টেবিলটার ওপর ধপাস করে এসে পড়ত, আর আর্ত বেদান্তর আর্তনাদ আর টেবিল চাপড়ানোর ধাক্কায় তরতরিয়ে দেওয়ালে উঠে যেত।

টিকটিকিতে বড় ভয় বেদান্তর। ওঁর স্থির বিশ্বাস ওই দেওয়ালবাসী প্রাণীগুলোর মধ্যে কোনও অতীন্দ্রিয় শক্তি আছে। ওরা ভাগ্যের ভালমন্দ অথবা ভবিষ্যতের কোনও লাভক্ষতির খবর বয়ে আনে। তবে ওদের ভাষাটা বোঝা চাই। বেদান্তর ঠাকুমা নাকি ওই টিকটিকিদের ভাষা বুঝতেন। মাঝে-মাঝেই তিনি বলে উঠতেন, “সংসারে একটা বিপদ-আপদ আসছে।” অথবা বলতেন, “সংসারে শিগগিরই একটা শুভ ঘটনা ঘটবে।”

কার কাছে এই সব আগাম খবর পেতেন ঠাকুমা?

কার কাছে আবার? ওই অমোঘ জ্যোতিষী টিকটিকিদের কাছে।

তখন বেদান্ত ঠাকুমার এই কথাটথাগুলো তেমন আমল দিতেন না। কেনই-বা দেবেন? স্কুলে পড়ুয়া ছাত্ররা একমাত্র বন্ধুদের কথা ছাড়া আর কারও কথাকে আমল দেয়? বেদান্তও দেননি তখন। কাজেই টিকটিকির ভাষাটি শিখে নেবার চেষ্টামাত্র করেননি। পরে, মানে আর কি এখন তার জন্যে আফসোস হয়। তা কী আর করা? সময় থাকতে শিখে নেননি যখন। এখন তাই টিকটিকি দেখলেই আতঙ্ক হয়, ওই বুঝি কী অমঙ্গল বার্তা বয়ে আনল। ঠাকুমা মারা যাবার পর থেকেই এই ধারণাটি জন্মে বসে আছে বেদান্তর। কারণ একদিনের মাত্র রুগি, জ্বর-জ্বর ভাব ঠাকুমা, রোদে পা ছড়িয়ে বসে তেল-নুন-মাখা মুড়ি খাচ্ছিলেন কাঁচালঙ্কা চটকে-চটকে, হঠাৎ ছড়ানো পায়ের ওপর ধপাস করে একটা টিকটিকি এসে পড়ল।

কোন পায়ে? কোন পায়ে আবার? যত নষ্টের গোড়া ডান পায়ে। সেই পায়ে এক ঘটি জল ঢেলে ঠাকুমা মুড়ির বাটিটা ঠেলে সরিয়ে রেখে ডেকে উঠলেন, “ওরে বেদা, তোর বাপকাকাকে বল খাটিয়া এনে মজুত রাখতে। আজই আমার জীবনের শেষদিন।”

বললে লোকে বিশ্বাস করুক আর না করুক, সেই রাত্রেই ঠাকুমা মারা গেলেন। লোকে বলতে পারে কাকতালীয়। কিন্তু তাই কি? এর পর আর টিকটিকি-আতঙ্ক হবে না বেদান্তর? কিন্তু প্রাণীগুলো এমন, ওর বাসা খুঁজে বার করে উৎখাত করে তাড়াবার কোনও উপায় নেই। ব্যাটাদের আদৌ কোনও বাসাটাসা থাকে কি না তাই বা কে জানে।

বেদান্ত তাই এখন এই তাড়া-খাওয়া টিকটিকিটাকে নির্নিমেষে দেখতে লাগলেন, কোথায় যায়। কিন্তু আশ্চর্য, খানিকটা উঠে গিয়ে আর কোথাও গেল না। হঠাৎ নট-নড়নচড়ন হয়ে দেওয়ালের একটা জায়গায় স্থির হয়ে আটকে গেল।… আর তখনই দেওয়ালটা ভাল করে লক্ষে পড়ল বেদান্তর।

ওটা কী ব্যাপার? ঠিক ওইখানটায় দেওয়ালে একটা চারচৌকো দাগ কীসের? ময়লা দেওয়ালে একটুকরো সাদা ছাপ। ঠিক চারচৌকো নয়, দশ ইঞ্চি বাই ছ’ ইঞ্চি গোছের। কীসের ছাপ? বেশ বোঝা যাচ্ছে, ওখানে দীর্ঘকাল যাবৎ কোনও একটা ওই মাপের ছবিটবি কিছু টাঙানো ছিল, সেটা এখন আর নেই।

বেদান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিক্ষেপ করে দেখতে-দেখতে ভাবতে থাকলেন, কী টাঙানো ছিল ওখানে? কী আর থাকবে ছবি ছাড়া? কীসের ছবি? কোনও নিসর্গচিত্র?

দুর! ওই ছায়া-ছায়া কোণের দিকে একটুখানি দেওয়ালে আবার তেমন ছবি! কারও ফোটোই নিশ্চয়!

কার ফোটো ছিল ওখানে? কার?

সড়াত করে টিকটিকিটা সরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে চড়াত করে মনে পড়ে গেল, ওখানে টাঙানো ছিল বেদান্তর দাদামশাইয়ের একখানা ফোটো। কবে আর তাকিয়ে দেখতে গেছেন? ধুলোয়-ধোঁয়ায় আর মাকড়সার জালে ঢাকাই পড়ে ছিল।

মনে পড়ল কবে যেন একদিন ঘরে ঝুল হওয়া নিয়ে রাগারাগিও করেছিলেন। কিন্তু তারপর? ছবিটা কোথায়?… অন্য কোনও দেওয়ালে টাঙানো হয়েছে? কই? সারা বাড়ি ঘুরে এলেন বেদান্ত। নাঃ, কোনও দেওয়ালেই নেই। কেনই বা থাকবে? বেদান্তর দাদামশাইয়ের ওই ঝাপসা হয়ে যাওয়া হলদেটে ফোটোখানা নিয়ে কার মাথাব্যথা? ছবিটার আদর ছিল বেদান্তর মা বেঁচে থাকতে। তিনিই রোজ সন্ধেবেলা একটা ধূপ জ্বেলে ছবিটার সামনে বারকতক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, সেটা হাতে রেখেই দু’ হাত জোড় করে প্রণাম করে চলে যেতেন। আবার মাঝে-মাঝে একদিন পা উচু করে ডিঙি মেরে আঁচল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছতেন ওই ছবির কাচটা।

তা সে তো কোন কালের কথা!

তারপর আবার কে দেখেছে, ছবিটা আছে কি না আছে।

কিন্তু ‘ছিল না’ বললে তো চলবে না। ছিল তার জাজ্বল্য প্রমাণ হয় দেওয়ালে, ওই ফর্সা ছাপটি।

তার মানে, ছিল। কেউ সরিয়েছে। তার মানে চুরি করেছে।

যেই না ওই কথাটা মাথায় খেলে গেল, সঙ্গে-সঙ্গে বেদান্ত বাড়ি তোলপাড় করা গলায় চিৎকার করে উঠলেন, “আমার ঘর থেকে জিনিসপত্র সরাচ্ছে কে? অ্যাঁ! চুরি করবার জন্যে বাড়িতে আর ঘর পায়নি? ঠিক আমার ঘর থেকেই চুরি। আমি ভালমানুষ, কিছু বলি না বলে তাই। কেমন?”

বেদান্তর উদ্দাম তড়পানিতে এ পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল দিগন্ত, তার বউ, আর ছেলে। ও পাশের ঘর থেকে সুমন্ত, তার বউ, আর মেয়ে। ভাড়ার ঘর থেকে পিসিমা।

“ব্যাপার কী? অ্যাঁ। এত চেঁচামেচি কীসের? চেঁচানো তোমার একটা রোগ দাদা!”

“কী? চেঁচানো আমার রোগ?”

বেদান্ত তুড়িলাফ খান, “ঘর থেকে জিনিসপত্তর হাওয়া হয়ে যাবে, আর চুপ করে থাকতে হবে? তোমাদের এইরকম ভালমানুষিতেই চোরকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তা জানো?”

পিসিমা এক দাবড়ানি দিয়ে বলে ওঠেন, “তোর তো চিরকালই সর্বস্ব ‘চুরি’ যায়। গেঞ্জিটা, তোয়ালেটা, বইটা, কলমটা একবার দেখতে না পেলেই হাঁক পাড়িস চুরি গেছে! চুরি গেছে!’ বলি তোর ঘরে আছেটা কী যে চুরি যাবে?”

“নেই? আমার ঘরে কিছু নেই? জানো, আমার ঘরে যেসব রেয়ার’ বই আছে, তার গোটাকতক হাতাতে পারলেই চোরের ভবিষ্যৎ সোনা দিয়ে বাঁধানো হয়ে যাবে। ওই সব বই—আমি সেই বারো বছর বয়েস থেকে ফুটপাতে ঘুরে ঘুরে!…”

দিগন্ত বলল, “বই চুরি গেছে? কী বই? কীভাবে গেল? বাড়িতে সবসময় এত লোক। তা হলে কেউ পড়তে নিয়ে গিয়ে ফেরত দেয়নি নিশ্চয়।”

বেদান্ত তার টিংটিঙে শরীরটা নিয়ে প্রায় লাফ খান, “বই চুরি গেছে বলেছি এ কথা?”

“বাঃ। তা হলে? কী চুরি গেছে?”

সুমন্ত বলে, “তা হলে কী চুরি গেল দাদা? টাকাপয়সা? তা যেতেই পারে। যেভাবে যেখানে-সেখানে ফেলে রাখো। কখনও টেবিলে, কখনও বইয়ের র‍্যাকের মাথায়, কখনও বিছানার ওপর। চাবিটাবির তো পাট নেই! তো, কত টাকা গেছে তার হিসেব আছে? নাকি তাও নেই?”

বেদান্ত দু’হাতে চুলের মুঠিটা চেপে ধরে (না না, ভাইয়ের চুলের মুঠি নয়। নিজেরই।) আর্তনাদ করে ওঠেন, “ওঃ! বলেছি টাকা চুরি গেছে আমার? হাজার-হাজার টাকা? আশ্চর্য! ভাল করে কিছু না শুনেই রিমার্ক পাস! জ্ঞান দিতে আসা!”

দিগন্তর ছেলে টুকাই আর সুমন্তর মেয়ে মকাই দু’জনে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কী যেন ফিসফিস করছিল, হঠাৎ দু’জনেই হিহি করে হেসে উঠল।

“অ্যাই! হাসলি যে? হঠাৎ হাসলি যে? বল বলছি কেন হাসলি?”

“বলছি, বলছি, হিহি, বলছিলাম রেগে গেলে জেঠুকে ঠিক টিভি-র রামায়ণের রাবণের মতো দেখায়। চোখ একদম গোল হয়ে যায়।”

“বটে! বটে! এই সব ফাজলামি শেখা হচ্ছে? হবেই তো। ইংলিশ মিডিয়ামের ফল।”

সুমন্তর বউ বলে উঠল, “এর মধ্যে আবার ‘ইংলিশ মিডিয়াম’ এল কোথা থেকে বড়দা?”

“এল কোথা থেকে? হুঁ! গুরুজনকে ঠাট্টা করতে নেই, এ শিক্ষা দেয় তোমাদের ওইসব বিলিতি ইস্কুল?” পিসিমা বলে ওঠেন, “তুই থাম তো বেদা! গুরুজন যদি উচ্চিংড়ের মতন তুড়িলাফ খেতে খেতে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে, তো ছেলেমানুষরা হেসে ফেলবে না? বলি এতক্ষণ তো জানতে পারলুম না তোর চুরিটা গেছে কী? তবে বুঝি গেছে তোর সেই রং-জ্বলা পচা পুরনো লুঙ্গিটা? প্রাণ ধরে যেটাকে ন্যাতা করতে দিতে পারছিস না। পরেছিস দেখলেই গা জ্বলে যায়। হাড়কুচ্ছিত।”

বেদান্ত হঠাৎ গুম হয়ে দালানে পড়ে-থাকা একটা টুলের ওপর বসে পড়ে বলেন, “ওঃ, অসহ্য! অনেক দিন ধরেই দেখছি ওইটার ওপর তোমার শ্যেনদৃষ্টি। নিয়ো। আজই ওটাকে নিয়ে তোমার গিয়ে ন্যাতা’ করোগে। কিন্তু পিসি একটু সিরিয়াস হতে শেখো। এই তোমার স্বভাবের দোষেই বাড়ির একটা প্রাণীও সিরিয়াস হতে শিখল না। দোতলায় শোবার ঘরের মধ্যে থেকে একটা জিনিস চুরি গেল, অথচ সেটা কেউ গায়েই মাখছে না। ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝবার ক্ষমতাই নেই কারও! আজ এ-ঘর থেকে না-হয় মোটে একটা জিনিস বেমালুম, বেপাত্তা হয়ে গেল। এর পর ক্রমাগতই সব ঘর থেকে সবকিছুই বেপাত্তা হতে থাকবে না তার গ্যারান্টি আছে?”

দিগন্ত বলে ওঠে, “সে তো নেই-ই। কিন্তু কী গেছে সেটা তো বলছ না। বলো। তা হলে পুলিশে একটা ডায়েরিফায়েরি করিয়ে আসি।”

বেদান্ত বিরক্ত কণ্ঠে বলেন, “পুলিশের কথা উঠছে কেন? অ্যাঁ? খাল কেটে কুমির আনা আর থানায় গিয়ে পুলিশ ডেকে আনা সমতুল্য, তা জানিস ? আর কী গেছে জানলে পুলিশ গ্রাহ্য করবে ভাবছিস?”

পিসি এবার রেগে উঠে বলেন, “তো, বলবি তো কী গেছে? তেমন দামি কিছু গেলে পুলিশের কাছে শরণ নেওয়া ছাড়া গতি কী?”

বেদান্ত বর্ধন গম্ভীরভাবে বলেন, “পুলিশের কাছে ‘তেমন কিছু হবে না পিসি, তবে আমাদের কাছে অনেক দামি। চুরি গেছে দাদামশাইয়ের সেই ছবিটি।”

“দাদামশাইয়ের ছবিটি।”

“দাদামশাইয়ের সেই ছবিটি!”

প্রায় সমস্বরে সকলে মিলে বলে উঠল, “কোন ছবিটি! কার দাদামশাইয়ের?”

বেদান্ত এখন আর উচ্চিংড়ের মতো লাফ খান না। আত্মস্থভাবে গম্ভীর গলায় বলেন, “পিসি বাদে সকলেরই দাদামশাই। আর কোন ছবি? ছবি হচ্ছে সেইটি! মা বেঁচে থাকতে রোজ সন্ধেবেলা যার সামনে একটা ধূপ জ্বেলে চরকিপাক ঘোরাতেন।”

ব্যাপারটা অনেক দিনের পুরনো। বউ-দুটো দেখেছে কি দেখেনি কে জানে। ভাই-দুটোও তেমন মনে করতে পারল না। তবু বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। তো, সেই ছবিটা চুরি গেছে?”

“গেছে। আমার টেবিলের ধারের পুব দেওয়ালের কোণ বরাবর ছিল, হঠাৎ আজ দেখছি নেই। অথচ ওই ঘরেই আমি শুই। কখন কোন ফাঁকে এই ঘটনা ঘটল তাই ভেবে তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি।”

পিসিও সঙ্গে-সঙ্গে খরখরিয়ে ওঠেন, “তার বাড়া তাজ্জব তো তুইই করছিস রে বেদা!.. তোর দাদামশাইয়ের সেই মান্ধাতার আমলের রং-জ্বলা ছবিখানা চোরে চুরি করতে এল! চোরের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই।”

বেদান্ত আরও আত্মস্থভাবে বলেন, “রোসো, একে-একে জবাব দাও। দাদামশাই কারও মান্ধাতার আমলের ভিন্ন আধুনিক আমলের হয় না বুঝলে? আর পুরনো হয়ে গেলেই দেওয়ালে টাঙানো ফোটোর রং জ্বলে যেতে বাধ্য। কাজেই এতে জিনিসটার দাম কমে যায় না।”

কিন্তু, দাদা! ওই ছবিটা চুরি করতে আসবার দায় পড়েছে কার?”

“দিগন্ত, তুইও দেখছি ইংলিশ মিডিয়ামের দোষগুলি আহরণ করে ফেলেছিস। ‘দায় পড়েছে’ শব্দটা কি দাদামশাইয়ের পক্ষে বেশ সম্মানজনক?”

মেজদাকে কোণঠাসা হতে দেখে সুমন্ত বলে ওঠে, “হাঁ, কথাটা ঠিক! ওভাবে বলা উচিত হয়নি মেজদার। তবে কথা হচ্ছে ওই সামান্য ছবিখানাকে চুরি করতে আসবে কে?”

“তুমিও সেই একই ভুল করছ সুমন্ত। ছবিটা সামান্য নয় অসামান্য। বুঝলে? তুমি কি আর একবার দাদামশাইকে সামনে বসিয়ে তার সেই সৌম্যমূর্তির একখানি ছবি তুলে নিয়ে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে পারবে? বলো, পারবে?”

দুই ভাইয়ের দিকে তীব্র দৃষ্টি হানেন বেদান্ত।

পারবে এ-কথা আর কে বলবে? তাই ভাইয়েরা চুপ। তবে ছোট ভাইয়ের বউ বলে ওঠে, “কিন্তু বড়দা, ওই ছবিটি আমাদের কাছে যতই মূল্যবান হোক, ওর তো আর কোনও বাজারদর নেই। যে চুরি করবে, তার লাভ কী? মানে কোন মোটিভে সে

বেদান্ত ক্রমেই গভীর থেকে গভীরে চলে যাচ্ছেন। হাত তুলে বলেন, “থামো বউমা। ‘খুন’ আর ‘চুরি’ এই দুটো ব্যাপারের ‘মোটিভ’ সবসময় রহস্যাবৃত। অপরাধ বিজ্ঞানের বইটইগুলো যদি একটু পড়তে-টড়তে। ওইসব দামি-দামি দুর্লভ গ্রন্থ বাড়িতে পড়ে থেকে থেকে পচছে, অথচ তোমরা একবারও—যাকগে। এখন আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও তোমরা। দাদামশাই নিশ্চয় ছায়া থেকে কায়া হয়ে গিয়ে পায়ে হেঁটে কোথাও চলে যাননি?”

“না, তা মানে সে-কথা কে বলছে?”

“তোমরাই বলছ। আমি তো বলছি কেউ দেওয়াল থেকে নামিয়ে নিয়ে না গেলে…” হঠাৎ আবার আগের মতো তুড়িলাফ খেয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন বেদান্ত, “আলবাত কেউ নিয়েছে। ছবিখানা নিজে নিজে উড়ে চলে যেতে পারে না। চোর কে খুঁজে বার করতেই হবে।”

পিসিও এবার আবার তেড়ে ওঠেন, “তবে, দে, এক্ষুনি পুলিশেই খবর দে। কুকুর নিয়ে এসে তাকে দিয়ে শুঁকিয়ে-শুঁকিয়ে চোরকে খুঁজে বার করুক। সাধে বলি বিয়ে-টিয়ে না করে রাতদিন যত রাজ্যের উনচুটে-উনচুটে বই নিয়ে পড়ে থাকলেই এইরকম উনচুটে-বুদ্ধি হয়। তোর দাদামশাইয়ের ছবিখানা চুরি করে কার কী স্বর্গলাভ হবে তা একবার খেয়াল করছিস না? আসলে ছবিটা ছিলই কি না তা কে জানে।”

“কী? আসলে ছিলই কি না? এসো। দেখে যাও। দেখে যাও সবাই। এসো বলছি…”।

“এই এক পাগলের পাল্লায় পড়া গেল বাবা! যেটা নেই’, ‘চুরি’ গেছে ‘উড়ে গেছে, ‘হাওয়া’ হয়ে গেছে, সেটা আবার দেখবে কী?”

হ্যাঁ। আছে দেখবার। সেই দাগটি। একদা যে ছিল দীর্ঘকাল ধরে, তারই স্মৃতিচিহ্ন বহন করে দাঁড়িয়ে আছে দেওয়ালখানা।

“তবে? এখন পথে এসো সবাই।”

বেদান্ত বলে ওঠেন, “যখনই সেই গাবদাগোবদা টিকটিকিটা বিনা নোটিসে এসে টেবিলে পড়েছিল তখনই বুঝেছি বাড়িতে একটা কিছু ঘটেছে। আশঙ্কাটি সত্যি হল। দেখছি, চিরদিনের দাদামশাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।”

“টিকটিকি!” সবাই হতভম্ব।

পিসি খ্যানখেনিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, “এর মধ্যে আবার টিকটিকি এল কোথা থেকে?”

বেদান্ত আবার গম্ভীর হল, “টিকটিকিরা যে কোথা থেকে আসে, তা ভগবানের ঠাকুর্দাও জানে না। কেউ কখনও ওদের বাসা দেখেছে? ইঁদুর, আরশোলার মতো ছানাপোনা নিয়ে ঘরসংসার? দেখেছ কেউ? কেউ না। থাকলে তো দেখবে? ওঁরা হঠাৎ-হঠাৎ আসেন একটা কোনও খবর দিতে। হয় শুভ নয় অশুভ। যে-কোনও খবর।”

“খবর। তুই যে আমায় হাঁ করে দিচ্ছিস বেদা! টিকটিকি কি খবরের অফিসে চাকরি করে, না ডাকপিয়ন? তাই খবর দিতে আসে?”

“পিসি!”

বেদান্ত জলদগম্ভীর ভাবে বলেন, “আমার ঠাকুমা তোমারই নিজের মা ছিল না? বলো ছিল কি না?”

“তো, আমি কি বলেছি সৎমা ছিল?”

“তোমার ব্যবহারটা অবশ্য সেইরকমই।…বলি—ঠাকুমা যেদিন মারা গেল? মনে নেই? ঠাকুমা বলে ওঠেনি আজই আমার শেষদিন।”

পিসি হাত দুটো জোড় করে একবার কপালে ঠেকিয়ে বলে, “ও কথা বাদ দে। ওকে বলে কাকতালীয়। তারপর থেকে এই আমারই গায়ে-মাথায়, হাতে-পায়ে অন্তত বিশবার টিকটিকি পড়েছে। ভাড়ার ঘরের দেওয়ালে তো রাতদিন টিকটিকি ঘুরছে, তো গায়ে পড়লে আমিও তো মায়ের মতো বলে উঠি, আজই আমার শেষদিন। কই ফলেছে কোনও দিন?”

“অবিশ্বাসীদের কিছুই ফলে না।” বেদান্ত অমোঘ স্বরে বলেন, “বিশ্বাসের জোর থাকলে হাতে-হাতেই ফলত!”

“ভাগ্যিস সে জোর নেই।” পিসি বলে ওঠেন, “মায়ের মতন দুম করে মরে যেতে আমার দায় পড়েছে। টিভিতে কত সব ভাল-ভাল সিরিয়াল চলছে। তা ছাড়া শুনছি আবার নাকি রামায়ণের শেষাংশ দেখাবে। তারপর আবার মহাভারত।… একটা টিকটিকির মান রাখতে মরতে যাব কেন রে?”

“মরতে বলা হয়েছে তোমায়?”

“প্রকারান্তরে তো তাই বললি। বিশ্বাস থাকলে হাতে-হাতে ফল পেতুম।”

“বাজে তর্ক কোরো না পিসি! সাধে বলি, কিছুতেই সিরিয়াস হতে শিখলে না! বাড়িতে একটা অস্বাভাবিক চুরি হয়ে গেল, অথচ কে বলতে পারে ছবিখানা শুধুই ছবিমাত্র ছিল কি না। কোনও দিন তো খুলে দেখা হয়নি পিছনে কোনও গোপন দলিল, কি গোপন উইল, কিংবা পারিবারিক কোনও মূল্যবান হিরেটিরে সঁটা ছিল কি না।… আমরা ভেবে রেখেছি ছবি না ছবি! যে নিয়েছে সে হয়তো সন্ধান-সুলুক জেনে ফেলে…”।

“মাথাটার চিকিৎসা করাও দাদা।”

বলে ভাইয়েরা হাসতে-হাসতে চলে যায়। এবং তাদের বউরাও সেই কাজই করে তবে হাসি চাপতে-চাপতে। শুধু টুকাই আর মকাই, যারা এতক্ষণ জেঠুর নানা দাপট দেখছিল, তারা কাছে সরে এসে বলে, “জেঠু, ছবির মধ্যে থাকে ওসব?”

“থাকেই তা বলছি না। থাকতে পারে। দাদামশাই ছিলেন জমিদার মানুষ! কোনও আশ্চর্য ঘটনা তো থাকতেও পারে! হয়তো-বা কোনও গুপ্তধনের সন্ধানী ম্যাপ একখানা ছবির পিঠে সেঁটে রেখে মেয়েকে দিয়েছিলেন।”

“জেঠু, আমরা খুঁজব?”

“বিশ্বাস থাকে তো খোঁজো মানিকজোড়! তো, আমি পুরস্কার ঘোষণা করছি—যদি কেউ খুঁজে বার করতে পারে নগদ দশ টাকা পুরস্কার।”

“এ মা। মোটে দশ টাকা! বললে যে ছবির মধ্যে ‘গুপ্তধনের ম্যাপ’, উইল না কী যেন, তা ছাড়া দামি হিরেটিরে সাঁটা আছে…”।

“আছেই, তা বলেছি? বলেছি, থাকতে পারে। ঠিক আছে, কুড়ি টাকা!”

“না—আ জেঠু, পঞ্চাশ টাকা!”

বেদান্ত চশমার মধ্যে থেকে ঝিকঝিকিয়ে তাকিয়ে হেসে বলেন, “এই বয়েসে খুব ওস্তাদ হয়েছিস দেখছি। হবেই তো—ইংলিশ মিডিয়াম বলে কথা! ঠিক আছে পঞ্চাশ টাকাই, ব্যাস। আর বাড়বে না!”

“না, না! আর না। তো কোথায় খুঁজব জেঠু?”

“বাঃ। চমৎকার। সেটা আমি বলে দেব? ও পিসি শুনছ?”

পিসি বলেন, “সবই শুনছি। তবে খুঁজে যদি পায় কেউ তোর দাদামশাইকে, তেনার পিঠের ছাল ছাড়িয়ে দেখবি তো কী আছে না আছে?”

“পিঠের ছাল ছাড়িয়ে?”

“তাই তো বলছিস! সেই আশাতেই দুটো পুঁটকেকে পঞ্চাশ টাকা প্রাইজ কবুল! সাতজন্মে শুনিনি এমন কথা। আমাদের ছেলেবেলাতেও হারানো জিনিস খুঁজে বার করতে পারলে বাবা প্রাইজ দিতেন। একটা চকচকে আধুলিই ছিল যথেষ্ট। তেমন দামি জিনিস হলে হয়তো আস্ত একটা টাকা। তাই পেলেই মনে হত রাজ-ঐশ্বর্য।”

বেদান্ত বললেন, “তা সেটা মনে হতে পারে পিসি, তোমাদের ছেলেবেলায় এক পয়সায় একখানা ভাল ঘিয়ের হিঙের কচুরি পেতে। এখন বাদাম, তেলেভাজা, একখানা হিঙের কচুরি খেতে এক টাকা লাগে। তা হলেই হিসেব করো।”

“আমার অত হিসেবের মাথা নেই। সময়ও নেই। এখন ভেবে মরছি ওই দুটো নন্দী-ভৃঙ্গিকে। ‘দাদামশাই’ খুঁজতে লাগিয়ে দিয়ে আমার কী মুণ্ডুপাত করলি। দুটোতে মিলে এখন স্বর্গ মর্ত্য পাতাল তছনছ করে বেড়াবে।”

“পিসি, দুটোর মধ্যে একটা তো মেয়ে। তুমি নন্দী-ভৃঙ্গি পেলে কোথায়?”

“মেয়ে। মেয়ে বলে কোনও কথা আছে নাকি রে এখন বেদা? মেয়েরা তো এখন সেপাইয়ের বাবা। ওই মেয়ে নন্দীটির অসাধ্য বলে কিছু নেই।”

“বাঃ। বাঃ। তা হলে তো অতি উত্তম। জিতে রহো বেটা।”

বলে দুটোর মাথায় ঠোকাঠুকি করে ঘরে ঢুকে যান বেদান্ত।

আর নন্দী-ভৃঙ্গি দু’জন তখনই বাড়ি তছনছ শুরু করে দেয়। সিঁড়ির তলা থেকে আলমারির মাথা, কয়লার ঘর থেকে রান্নাঘর। সারা বাড়িতে অবিরতই চারখানি ছোট-ছোট পায়ের বিপুল ধুপধাপ। স্কুলে স্ট্রাইক চলছে। অগাধ সময়।

“তাই বলে তোরা বালিশ ছিঁড়ে তুলো ছড়াবি?”

টুকাই-মকাইয়ের মায়েরা রেগে আগুন।

“দেখুন দাদা! কী কাণ্ড করছে এরা। সারা ঘরে বালিশ-ছেঁড়া তুলো।”

বেদান্ত গম্ভীর ভাবে বলেন, “তার মানে ওরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই কাজ করে চলেছে। কিছু খুঁজতে হলে এইভাবে গোড়া গেড়েই কাজ করতে হয়। গোয়েন্দা পুলিশরাও এই ওয়ে’তে চোরাই মাল খোঁজে। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে এরাই পারবে হারানো মাল উদ্ধার করতে।”

অতএব ওরা বীরবিক্রমে সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে বাড়ির যত ড্রয়ার উটকে, যত গদি-তোশক উলটে, যত বইয়ের র‍্যাক বিধ্বস্ত করে। শুধু পিসি বলেছেন, খবরদার আমার ঠাকুরঘরের চৌকাঠ ডিঙোবি না। আর চিলেকোঠায় দু’দিন ধরে সর্বদা তালা ঝুলছে, এই যা অসুবিধে।

তালা ঝুলছে কেন?

যারা এই ঘরটার মালিক তারা দু’দিনের জন্যে তালা ঝুলিয়ে দেশে গেছে বলে।

অবশেষে বোধহয় হল সাধনায় সিদ্ধি।

কাঠবিড়ালিতেই সাগর বাঁধল বোধহয়।

উত্তেজিত দুই বীর এসে চুপিচুপি প্রশ্ন করে, “জেঠু, তোমার দাদুর দাড়ি ছিল?”

“দাদুর কী ছিল তা তো আর চক্ষে দেখিনি বাবা! তিনি তো আমার জ্ঞানের আগেই পটল তুলেছিলেন। তবে ছবিটার মনে হচ্ছে ছিল একটু-একটু দাড়ি।”

“জেঠু, তোমার দাদু জামা পরতেন না খালি গায়ে থাকতেন?”

“দ্যাখ, শুনেছি জমিদার মানুষ ছিলেন, জামাটামা কি আর না পরতেন? তবে ছবিটায় বোধহয় পুজো করতে বসার স্টাইলে শুধু ধুতি-চাদর পরে বাবু’ গেড়ে বসে থাকা ছিল।”

টুকাই রেগে উঠে বলে, “তোমার কেবল ‘বোধ হয়, বোধ হয়’! ঠিক করে একটা বলবে তো?”

“ওই তো বললাম। খালি গা, কাঁধে চাদর, ধুতি-পরা। তোরা যাকে ‘চৌকো হয়ে বসা’ বলিস। সেইভাবেই ছিল মনে হচ্ছে।”

“ঠিক?”

“ঠিক।”

“হ্যাঁ রে বাবা, ঠিক, ঠিক। এখন বেশ স্পষ্টই মনে পড়ছে।”

দুই ‘শিকারি’ (তা শিকারি বলা যায়) এখন গভীর আত্মস্থের ভঙ্গিতে বলে ওঠে, “বাস, হয়ে গেছে। চোরাইমালের সন্ধান মিলেছে। চোরও আজ এসে যাবে।”

“চোর এসে যাবে মানে? সে ব্যাটা কি তোদের বলেকয়ে?…”

“অত অধৈর্য হোয়ো না তো জেঠু। গোয়েন্দারা এমন চট করে কথা ভাঙে না। আজ দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করো। হাতে হাতে ধরিয়ে দেব দেখো। ওই…ওই বোধহয় এসে গেলেন চোর-মহারাজ! গলার শব্দ পাচ্ছি।”

‘নাঃ। তোরা দেখছি একখানা ধাঁধা হয়ে উঠলি। দেখি তোদের দুপুর পর্যন্ত।” বলে বেদান্ত বর্ধন তার ঘরে ঢুকে গিয়ে পড়তে পড়তে রেখে-যাওয়া অপরাধ তত্ত্বের বইটা হাতে তুলে নেন। এই বইটাই আজ কদিন ধরে পড়ে চলেছেন।

অবশেষে এল সেই সন্ধিক্ষণ। সেই দুপুর। খাওয়াদাওয়া সেরে ঘরে এসে বসে ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন বেদান্ত। ‘দুপুর’ কাকে বলে? বারোটা? সাড়ে বারোটা? একটা?

হ্যাঁ। ঠিক একটার সময় উত্তেজনায় কম্পমান টুকাই আর মকাই চুপিচুপি এসে চাপা গলায় বলে, “জেঠু চলো এই হচ্ছে সুবর্ণ সুযোগ! চটপট চলো।”

“আরে বাবা, যাবটা কোথায়?”

“ছাতে। চিলেকোঠায়। চলোনা আমাদের সঙ্গে। নিঃশব্দে আসবে। সিঁড়িতে যেন পায়ের শব্দ না হয়।”

টানতে-টানতে নিয়ে আসে জেঠুকে।

“দরজার মাথার ছিটকিনিটা খোলো। দেখো যেন শব্দ না হয়।”

খোলেন বেদান্ত চিলেকোঠা, অর্থাৎ সিঁড়ির মাথার এল’-শেপ ঘরটার দরজাটা।

আর সঙ্গে-সঙ্গে নাকে আসে চমৎকার ধূপের গন্ধ। কী জানি কী ধূপ, ঘর যেন গন্ধে ম ম করছে।

“এখানে কী?”

“ভেতরে এসে দ্যাখোই না।”

মকাই জেঠুর হাতটা চেপে ধরে শক্ত করে। ঢুকিয়ে নিয়ে যায় ‘এল’-শেপের ভিতর দিকটায়। পাশের দেওয়ালের ধারে একটা শতরঞ্চি জড়ানো আজেবাজে বিছানা, আর একটা জলের কুঁজো। আর সামনের দেওয়ালের ধারে দু’ কোণে দু’খানা-চারখানা থান ইট।

কিন্তু শুধুই কি থান ইট?

তা তো আর নয়। একজোড়া ইটের ওপর একখানি মা কালীর পট। তার সামনে দুটো জবা ফুল। আর অন্য একজোড়ার ওপর গলায় নয়নতারা ফুলের মালা পরানো আর সামনে দুটো সাদা টগর ছড়ানো বেদান্তের দাদামশাই!

ওইখানেই একটা হাতে-গড়া মাটির ধূপদানিতে ধূপ জ্বলছে। মানে জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে এসেছে। সুবাস ছড়াচ্ছে।

বেদান্ত অবাক হয়ে বলেন, “এখানে কে থাকে?”

“আহা! জানো না যেন। ন্যাকাচণ্ডী। থাকে চোরমশাই আর তার দিদিমাটি। এখন দু’জনায় আয়েস করে খেতে বসেছে রান্নাঘরের কোণে! বামুনদি আর বামুনদির নাতি বিশু।”

মকাইয়ের মুখ সাফল্যের গর্বে লাল টকটকে।…

“ওরা দু’দিন দেশে চলে গিয়েছিল দরজায় তালা লাগিয়ে, তাই ঢুকতে পারছিলাম না। তবে জানলাটা বিচ্ছিরি ফাটাচটা কাঠের, তার মধ্যে খুন্তি চালিয়ে চালিয়ে সব দেখে নিয়েছি। জানলার নাগাল পাই নাকি? ভাগ্যিস অনেক ইট পড়ে আছে তাই। ওপর ওপর চাপিয়ে চাপিয়ে।”

বেদান্ত হতভম্ব হয়ে বলেন, “কিন্তু আমার দাদামশাইয়ের ছবি চুরি করে এনে ওই বিশু পুজো করবে কেন?”

মকাই হাত উল্টে বলে, “আমরাও তো তাই ভেবে মরছি। কে জানে স্বপ্নাদেশটেশ পেয়েছে কি না। হয়তো উনি বিশুকে স্বপ্ন দিয়েছেন, ওরে দেওয়ালে ঝুলে থেকে থেকে আমার কোমর ব্যথা হয়ে গেল। আমায় নিয়ে গিয়ে কোথাও একটু বসা। তা এইবেলা দরজা বন্ধ করে আবার পালাই চলো জেঠু। নইলে এসে পড়ে দেখে ফেলবে। আর ভাববে আমরা চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে এসেছি। সন্ধেবেলা বাবা আর মেজোজেঠু অফিস থেকে ফিরলে আদালত বসিয়ে জেরা করে সব জানা হবে।”

কিন্তু সন্ধেবেলা কি জেরার আসর বসে?

নাঃ। বসে পরামর্শ। ঘরের দরজা বন্ধ করে। প্রায় গোলটেবিল বৈঠক। তিন ভাই, দুই বউ আর দুই বীর।

বেদান্ত উদারস্বরে বলেন, “আমি বলি কী, কিছু

বলে কাজ নেই।”

“বলে কাজ নেই!”

“হ্যাঁ। মানে বোঝাই তো যাচ্ছে ওই মকাইয়ের অনুমানটি? ঠিক। যতই হোক ইংলিশ মিডিয়ামের ব্রেন! ওই স্বপ্নাদেশই।…মা থাকতে ধূপটুপ দিতেন। সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়…”

“তা, দাদা, স্বপ্নাদেশ দেবার আর লোক পেলেন না দাদামশাই? বামুনদির নাতিকে?”

বেদান্ত আরও উদার হন।

“তাতে কী? কার ভাগ্যে কখন কী হয় কে বলতে পারে? অবশ্যই ছেলেটা খুব সৎ আর ভক্তিমান।”

টুকাই বলে ওঠে, “আহা! সৎরা বুঝি চুরি করে?”

“ছিঃ টুকাই। চুরি চুরি কোরো না। কত ভক্তিভরে ছেলেটা আমার দাদুকে ফুল-চন্দন ধূপটুপ দিয়ে অর্চনা করছে। এর জন্যে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আমি বলি কী…বরং ওই ধুপটুপ কি মিষ্টিটিষ্টির জন্যে ওকে মাসে-মাসে কিছু টাকা দেওয়া হোক। জানতাম! সেইদিনই বুঝেছিলাম। বাড়িতে একটা শুভ কিছু ঘটতে চলেছে। তা নইলে ওইরকম পুরুষ্টু কলার মতো একখানা টিকটিকি এসে ধপাস করে টেবিলে এসে পড়ে? আর সরসরিয়ে সরে গিয়ে দেওয়ালে উঠে ঠিক জায়গাটিতে মার্ক করে স্থির হয়ে বসে যায়? টিকটিকির একটা অতীন্দ্রিয় শক্তি আছে না? সেই শক্তিতেই সে টের পেয়েছিল ওই বিশু স্বপ্নাদেশ পেয়েছে। এবং দাদামশাই পূজিত হচ্ছেন। তা বেচারি গরিবমানুষ, থানইট ছাড়া কিছু জোটেনি। পরে একটা চৌকিটোকি করে দিতে হবে। দেখিস এই নিত্যপূজার পুণ্যফলে ওর ক্রমশ কত উন্নতি হবে। কিন্তু স্পিকটি নট। আমরা যে জেনে ফেলেছি বলে কাজ নেই। লজ্জা পাবে।”

টুকাই এবার হতাশভাবে বলে, “ও জেঠু। তা হলে তোমার দাদামশাইয়ের পিঠের ছাল ছাড়ানোর কী হবে?”

“কী? কী বললি? দাদামশাইয়ের পিঠের ছাল ছাড়ানো? ছি ছি।”

“বাঃ। তুমিই তো বলেছিলে ফোটোর পেছনে গুপ্তধন আছে।”

“আছে বলিনি। বলেছি থাকতে পারে।”

“তা সেটা না দেখলে?”

“টুকাই, আমি বলি কী, দেবধন গুপ্তধন এসবে লোভ রাখা ঠিক নয়। বরং তোমরা অনেক কষ্টে সন্ধান করে ফেলেছ বলে, দু’জনকেই পঞ্চাশ-পঞ্চাশ করে দিয়ে দিচ্ছি। মনে রেখো স্পিকটি নট! যেমন চলছে চলুক।”

কিন্তু টুকাই-মকাইকে সাবধান করলে কী হবে? বাড়িতে আর-একজন নেই? তিনি টের পেয়ে যাননি চোর এবং চোরাইমালের সন্ধান মিলেছে। কেউ না বললেও তিনি কেমন করে যেন সংসারের সব খবর জেনে ফেলেন। এমনকী, কেউ কোনও কথা তার কাছে চেপে যাবার চেষ্টা করলেও তিনি বাতাসে নাক বুলিয়ে সব বুঝে আর জেনে ফেলেন।

কাজেই চিলেকোঠা অভিযান তার জানা হয়ে গেছে। এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাকশান নেওয়াও হয়ে গেছে।

আর তার ফলে কী হল?

তার ফলে এই গোলটেবিল বৈঠক চলাকালেই বন্ধ দরজায় দুমদাম ধাক্কা।

“কে? কে রে?”

কে আবার? সেই সৎ ভক্তিমান বালকটি।

“এই যে জেঠু, ন্যাও তোমার দাদুর ফটক। এর জন্যে আমার ঘর সার্চ। ‘চোর’ অপবাদ! গলায় দড়ি আমার!”

“এ কী? এর মানে কী?”

“মানে আবার কী? দু’দিন দেশে গেছি তার মধ্যে এত কাণ্ড! বলি, খুব তো দাদুভক্তি। তো, ছবিখানা যে মাসখানেক যাবৎ তোমার দেওয়াল ছাড়া, সে খেয়াল হয়েছিল? উঠল বাই তো কটক যাই। ছবি চুরি গেছে চোরকে ধরাই চাই। কী একখানা ‘সোনার মুকুট’ তাই লোকে চুরি করবে?”

মকাই বলে ওঠে, “তো নিয়েছিলে তো দেওয়াল থেকে।”

“আহা, তা আর নয়। দড়ি ছিঁড়ে মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল, কাচ ভেঙে কুচিকুচি। তো, দেখে-দেখে মন নিল বোধহয় রামকৃষ্ণদেবের ফোটো। আহা তেনার এত দুর্দশা। তাই তুলে নিয়ে গিয়ে দিদিমার ঠাকুরের পাশে বোস করিয়ে পূজা করেছি—কে জানত রামকৃষ্ণদেব নয়। এই রইল। এখন চুরির দায়ে জেলেই দাও আর ফাঁসিই দাও, যা মন হয়!”

তেজি ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়ায় বিশু।

কী মুশকিল।

বেদান্ত তাড়াতাড়ি বলেন, “আমি তোকে বলেছি কিছু?”

‘তুমি বলো নাই, তোমার পিসি বলেছে। যার নাম ভাজাচাল তার নামই মুড়ি।…তো তিনি তো বলল, দ্যাখগে, তোর কপালে কী আছে।”

“পিসির ওইরকম। না, না, ও-ছবি ফেরত দিতে হবে না বাবা; তুই যেমন পুজো-অর্চনা করছিলি করগে। আমি বরং ধূপটুপ কিনে দেব।”

বিশু অবজ্ঞাভরে বলে, “তোমার দাদামশাই বুড়োকে পুজো করতে আমার দায় পড়েছে। ভুলক্রমে রামকৃষ্ণ ভেবেই ওই মুখ্যুমি করেছি এত দিন! তো চোর বলে পুলিশে দেবে তো বলো?”

দিগন্ত আর সুমন্ত বলে ওঠে, “এইটুকু ছেলের কথা দ্যাখো। যা, যা, পালা। আর রাগ বাড়াসনি।”

অতএব বিশু বীরদর্পে চলে যায়।

টুকাই বলে ওঠে, “তো, এখন ছবিটার পিঠ ছেঁড়া হোক জেঠু! দেখি।”

বেদান্ত করুণ গলায় বলেন, “ওর আর কী দেখবি বাবা। সেকালের বাজে দোকানের বাঁধাই। পেছনে একটুকরো ব্রাউন পেপার বই আর কিছু নেই। দেখতেই তো পাওয়া যাচ্ছে।…তখনই বুঝেছিলাম সংসারে একটা কিছু অশুভ হতে চলেছে। নইলে আর টিকটিকিটা—ওরকম…’

মকাই বলে ওঠে, “এর আর অশুভ কী জেঠু?”

“বাঃ নয়? বামুনদির নাতির কাছে হতমান্য হতে হল না? ওই একখানা রং-জ্বলা, ঝাপসা হয়ে যাওয়া পচা ছবির জন্যে—ধ্যাত। ওঃ, ভাল কথা, তোমাদের টাকাটা। এসো, আমার ঘরে।”

“না জেঠু, ও আর দিতে হবে না তোমায়। তোমার মন খারাপ।”

“দিতে হবে না মানে?”

বেদান্ত বীরবিক্রমে বলেন, “মন খারাপ, পেট খারাপ, আর মাথা খারাপ যাই হোক—মরদকা বাত, হাতিকা দাঁত— বুঝলে? দু’জনে না-হয়—পুরো একশো করেই পাবে। খেটেছ তো বিস্তর।…তবে হ্যাঁ, ওই অতীন্দ্রিয় শক্তিতে অবিশ্বাসী পিসিকে নিচ্ছি একহাত। কী দরকার ছিল ওঁর ছেলেটাকে শাসাতে যাবার? দিব্যি ফোকটে পুজোটা পাচ্ছিল বুড়ো। সেটা ঘুচল। এখন ওই কাচভাঙা ছবিটা নিয়ে কী করব আমি তাই শুনি?

১১ জানুয়ারি ১৯৮৯

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন