নদুস্কোপ – রূপক সাহা

পৌলোমী সেনগুপ্ত

রেড রোডের মাঝামাঝি এসে গাড়িটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। আর তার পরই ড্রাইভার বাঁকেলাল আঁতকে উঠে বলল, ‘সর্বনাশ, পেট্রল শেষ।’

বিরক্তি চেপে রেখে বললাম, এখন কী হবে? গাড়ি নিয়ে বেরোবার সময় একবার দেখে নিতে পারলে না, পেট্রল আছে কি নেই?

দরজা খুলে বেরোতে বেরোতে বাঁকেলাল বলল, ‘দেখে নিলেই ভাল হত। অফিস গিয়ে পেট্রল নিয়ে আসা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত তিনটে। নাইট ডিউটি করে বাড়ি ফিরছি। যাব বেহালা। তার মাঝে এই বিপত্তি। বাঁকেলাল অফিস ফিরে যেতে চাইছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ। হেঁটে গিয়ে ফিরে আসতে আসতে লাগবে প্রায় আধ ঘণ্টা। গাড়িতে আরোহী বলতে শুধু আমি। বাঁকেলালের অফিসে যাওয়ার অর্থ, গড়ের মাঠে এই নির্জন রাস্তায় গাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য একা আমাকেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বিশ্রী ব্যাপার। ময়দানের এই অঞ্চলটা সুবিধের নয়। ছিনতাইবাজরা তো আছেই, তার ওপর ট্যাক্সিভূত আর স্টোনম্যানের ভয়। একমাত্র আশা, কোনও গাড়িতে যদি অফিস পর্যন্ত লিফট পাওয়া যায়। এত রাতে কোনও গাড়ির দেখা মেলাও ভাগ্যের ব্যাপার।

কী করব ভাবছি, হঠাৎ ফোর্ট উইলিয়ামের আইল্যান্ড থেকে দুটো জোরালো হেড লাইট এগিয়ে এল। মনে হল, পুলিশের গাড়ি। বাঁকেলাল চট করে রাস্তা পেরিয়ে ওদিকে চলে গেল। তারপর হাত নাড়িয়ে ভ্যানটাকে থামালও। উলটো দিক থেকে টুকরো টুকরো কথা কানে আসছিল। এঞ্জিনের শব্দে ভাল করে তা শুনতে পাচ্ছিলাম না। সত্যি বলতে কী, বাঁকেলালের ওপর আমার তখন বেশ রাগই হচ্ছিল। এমন বিপদে ফেলার কোনও মানে হয়! সকাল হতে ঘণ্টা আড়াই দেরি। অফিসেই ফিরে যাব কি না তখন ভাবছি।

রাস্তার এদিক থেকে আমি কিছু বলার আগেই, ওদিক থেকে চিৎকার করে বাঁকেলাল বলল, ‘অফিসে যাচ্ছি। মিনিট পনেরো গাড়ির ভিতর থাকুন। দরজাটা কিন্তু লক করে দেবেন।’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পুলিশের গাড়িটা মিলিয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই টের পেলাম, রেড রোডটা কত বড়। সকাল-বিকেল কত বার এই রাস্তাটার ওপর দিয়ে গেছি। এর মসৃণতা নিয়ে মনে মনে প্রশংসাও করেছি। কলকাতায় এত সুন্দর রাস্তা আর কোথাও নেই। দু’পাশে হলুদ রঙের রেলিং। বাহারি গাছ, স্ট্যাচু। ভিক্টোরিয়ার বাগান বাদে ময়দানের সবথেকে ভাল জায়গা এটা।

কিন্তু ওই গভীর রাতে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার বেশ ভয়-ভয়ই করতে লাগল। এত সোজা আর ঘন কালো, মনে হল গিলে খেতে আসছে। গাড়ির ভিতর বসে থাকাই ভাল, এই কথা ভেবে দরজার হাতলে যেই হাত দিয়েছি, এমন সময় দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটায় চোখ গেল। হালকা সবুজ আর নীল আলোয় ওই জায়গাটা যেন ছেয়ে আছে। চাঁদের আলোর মতো মোলায়েম নয়। একটু অন্য ধরনের। এত রাতে, ইস্টবেঙ্গল মাঠ আর ফোর্ট উইলিয়ামের মাঝে ওই রকম একটা রহস্যময় আলো দেখে, সত্যি বলতে কী একটু অবাকই হলাম।

গা ছমছম করে উঠল। দরজাটা খুলতে যাব, ঠিক সেই সময় শুনলাম মিহি গলায় একজন অন্যজনকে বলছেন, নদুবাবু এই লোকটার কথাই বলেছিল। ময়দানে রোজ দেখি। খবরের কাগজে লেখে।

চমকে উঠে দেখি, আশপাশে কেউ নেই। তবে কি আমার মনের ভুল? হতে পারে। হঠাৎ একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। গাড়ির ভেতরে ব্যাগে মাফলার রাখা ছিল। বের করে গলায় জড়িয়ে নিলাম। মনে মনে ঠিক করলাম, নাইট ডিউটি থাকলে এর পর থেকে আর বাড়ি ফিরছি না। দু’-তিনটে ঘণ্টার তো ব্যাপার। অফিসেই কাটিয়ে দেব।

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মিনিট দুয়েকও কাটেনি। বাঁকেলালের ফিরতে অনেক দেরি। নির্জনতা অনেক সময় মানুষকে দুর্বল করে দেয়। আমিও কেমন যেন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে লাগলাম। বাঁ দিকে বি এন আর ক্লাবের তাঁবু। লনে কয়েকটা চেয়ারও রয়েছে। সন্ধেবেলায় ওখানে জমাটি আড্ডা বসে। বলরাম, অরুণ ঘোষ আরও অনেকে আসেন। ইন্টারভিউ নিতে বেশ কয়েকবার ওই আড্ডায় আমিও গেছি। একবার মনে হল, পাঁচিল টপকে ওই তাঁবুতে চলে যাই। দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে অন্তত নিরাপদ। কিন্তু মালিরা আমাকে চেনে না। এত রাতে একজন অজানা লোকের জন্য ওরা ঘুম ছেড়ে উঠবেই বা কেন?

এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় ঝুপ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। রেড রোডের সব আলো একসঙ্গে নিভে গেল। আর সেই ঘন অন্ধকারের মাঝে টের পেলাম, খুব কাছেই কারা যেন দাঁড়িয়ে আছেন। গা-টা শিরশির করে উঠল। গাড়ির পিছনের দরজার হ্যান্ডেলটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। কানের কাছে একজন ফিসফিস করে বললেন, “আপনি কি রিপোর্টার?”

আতঙ্কে গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোল না। বুকে প্রচণ্ড ধুকপুকুনি, পা দুটো অবশ। আবার ফিসফিসানি, অনেকক্ষণ আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। নদুবাবু আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। কথা শেষ হতে-না-হতেই কে একজন আমার মাথায় বড়সড় হেড ফোন জাতীয় একটা জিনিস বসিয়ে দিল।

তারপর আর কিছু মনে নেই।

আবার চোখ খুলেই দেখি, অন্য পরিবেশ। সামনে একটা ফুটবল মাঠ। চারপাশে কয়েক ধাপ কাঠের গ্যালারি। তিলধারণের স্থান নেই। ফিকে নীল আর সবুজ আলোয় রহস্যময় পরিবেশ। মাথার ওপর মেঘহীন আকাশ। তারাগুলো ঝকমক করছে। পুব দিকে, বেশ দূরে একটা গম্বুজ। আবছা আলো সত্ত্বেও যেন মনে হল, অক্টারলোনি মনুমেন্ট। কোথায় বসে আছি, আন্দাজ করতে লাগলাম। ময়দানে খুব চেনা জায়গায়, অথচ অচেনা। পুব দিকের গ্যালারির পিছনে রাস্তায় গ্যাস বাতি। টিমটিম করে জ্বলছে। রেড রোড? হতে পারে। দু’-একবার শেয়ালের ডাকও শুনতে পেলাম। পশ্চিম দিক থেকে ঠান্ডা বাতাসের ঝলক গায়ে লাগল।

ওই রহস্য-মাখানো পরিবেশে বসে থাকতে থাকতে ইন্দ্রিয়গুলিকে একটু সজাগ করছি। গ্যালারিতে এত লোক, অথচ কোনও শব্দ নেই। হয় আমি কাচের বদ্ধ ঘরে বসে আছি, না-হয় তো কেউ জাদুবলে সাউন্ড সিস্টেম অকেজো করে রেখেছে। গ্যালারিতে সামান্য অস্থিরতাও লক্ষ করছি। কোনও ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে যেমনটি হয়, সেইরকম। দর্শকরা সাগ্রহে কিছু একটা দেখার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন। …কারও মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। অথচ তারা যে উপস্থিত আছেন, তা বুঝতে পারছি। মনে হল, আমি কি তা হলে স্বপ্নের ঘোরে রয়েছি?

ঠিক এই সময় মিহি গলায় একজন বললেন, “নমস্কার, আপনি আসায় আমরা অত্যন্ত খুশি। আমিই নদু মিত্তির। মোহনবাগান ক্লাবে আছি।”

চমকে উঠে বাঁ পাশে তাকিয়ে দেখি, ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মোটাসোটা চেহারা। আতরের সৌরভ ছড়িয়ে কখন যেন হাজির হয়েছেন। আঙুলে সাত-আটটা মূল্যবান আংটিও চোখে পড়ল। কে এই নদুবাবু?

আমাকে চমকে উঠতে দেখে ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। মনে হল, মজাও পেয়েছেন। বললেন, “অবাক হবেন না। বিশেষ উদ্দেশ্যেই আজ আমরা আপনাকে নিয়ে এসেছি। কিছু দিন আগে খবরের কাগজে আপনি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, বাষট্টির জাকার্তা এশিয়ান গেমসে আমাদের টিমই, ভারতের সর্বকালের সেরা ফুটবল টিম৷’ এই মন্তব্যটাতে আমরা খুবই বিচলিত হয়ে উঠেছি।”

মিটিমিটি হাসছেন নদুবাবু। বললেন, “ব্রিটিশ যুগের কিছু টিমের খেলা দেখার সৌভাগ্য আপনাদের হয়নি। সেজন্যই বোধ হয় ওই মন্তব্যটা করেছেন। বাষট্টির চুনী বলরাম পি কে’র দলটাকে যখন-তখন তিন-চার গোলে হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত ব্রিটিশ যুগের দু-তিনটি দল। দুর্ভাগ্য, ওঁরা তেমন প্রচার সে-সময় পাননি।”

হাঁ করে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি বলছেন কী! আস্তে আস্তে যেন বাস্তবে ফিরে আসছি। ফুটবল আমার খুবই প্রিয় বিষয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করতে ভালবাসি। স্বাধীনতার আগের যুগ আর পরের যুগের ফুটবল নিয়ে এই সন্ধেবেলাতেও কয়েক জনের সঙ্গে তুমুল বাকবিতণ্ডা করেছি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ব্রিটিশ যুগে ভারতীয় দলগুলি এলেবেলে ফুটবল খেলত। না ছিল কোনও কোচ, না ছিল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। নদুবাবু না কে, এই লোকটা ফালতু কথা বললে মানব কেন?

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই নদুবাবু শুরু করলেন, “কলকাতার ফুটবলের সঙ্গে বহু দিন জড়িয়ে আছি। কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ টিম—আমরাই তা বলতে পারি। আমাদের মতে, উনিশশো এগারোর শিল্ড-জয়ী মোহনবাগান টিম অথবা তিরিশের দশকের শেষ দিকের মহমেডান টিম—ভারতের সর্বকালের সেরা।”

আর চুপ করে থাকা যায় না। বলে ফেললাম, “বাহাত্তরের ইস্টবেঙ্গল টিম আর আটাত্তরের মোহনবাগান তা হলে কিছুই না?”

নদুবাবু কিন্তু একথা শুনে একটুও উত্তেজিত হলেন না। বললেন, “আমার তো মনে হয় কিছুই না। এই দুটো টিম কমপক্ষে চার গোল করে খেত, যদি এগারোর শিল্ড-জয়ী মোহনবাগান অথবা তিরিশের দশকের মহমেডান স্পোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে খেলত। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি। ওই ম্যাচ যদি নিজের চোখে দেখতে চান, তা হলে সে-ব্যবস্থাও করতে পারি।”

কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোক একটু অদ্ভুত ধরনের বটে, কিন্তু যা বলছেন, এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন যে, থামিয়ে দেওয়াও যাচ্ছে না। নদুবাবু আরও বললেন, “আজ আপনাকে এখানে আনার উদ্দেশ্যটা তা হলে বলেই ফেলি। শিল্ড-জয়ী মোহনবাগানের সেই দলটার সঙ্গে আজ আমরা আটত্রিশের লিগ-জয়ী মহমেডান স্পোর্টিংয়ের ম্যাচ খেলাচ্ছি। এই খেলাতেই ঠিক হয়ে যাবে—ভারতের সর্বকালের সেরা কোন টিম?”

শুনে আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। ভদ্রলোক বলছেনটা কী! উনিশশো এগারো সালের টিমের সঙ্গে আটত্রিশ সালের একটা টিমের ম্যাচ? কী ভাবে সম্ভব? কোনও সন্দেহ নেই, দুটো দলই দুর্দান্ত। মোহনবাগান প্রথম শিল্ড জিতেছিল ব্রিটিশ টিমদের হারিয়ে। সেকালে যা ভাবাই যেত না। ভারতের খেলার ইতিহাসে ওই জয় একটা বিরাট মাইলস্টোন। অন্য দিকে চৌত্রিশ থেকে আটত্রিশ—এই পাঁচ বছর টানা কলকাতার লিগ-চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল মহমেডান দল। সে-সময় এই সাফল্য কোনও ব্রিটিশ দলেরও ছিল না। মহমেডানের এই কৃতিত্ব ছাপিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। সত্তর দশকে। অর্থাৎ কিনা তিরিশটা বছর মহমেডানের রেকর্ড অটুট ছিল।

তা নয় হল। কিন্তু নদুবাবুর এই ম্যাচ কী করে সম্ভব! মোহনবাগানের শিল্ড-জয়ী টিমে এমন অন্তত পাঁচজন প্লেয়ার ছিলেন, যাঁদের বয়স তিরিশের বেশি। সাতাশ বছর পর আটত্রিশে, তাদের বয়স ষাটের কাছাকাছি। কী করে তারা শ্রেষ্ঠত্বের পরীক্ষা দেবেন মহমেডানের যুবকদের সঙ্গে!

নদুবাবু বোধ হয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পারলেন। তাই বললেন, “দুই টিমের প্লেয়ারদের বয়সের কথা ভাবছেন বুঝি। ভাবনাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যুগে এখন অনেক কিছুই সম্ভব। এই তো কিছু দিন আগে, ব্রাজিলে এমন একটা ম্যাচ হয়ে গেছে। ওদের বাষট্টির জুলে রিমে কাপ-জয়ী টিমের সঙ্গে সত্তরের টিমের। পেলে দুটো টিমের হয়েই খেললেন। এক-একটা হাফে খেলাটা শেষ পর্যন্ত ১—১, ড্র থেকে গেল। একটা গোল পেলে-র। অন্যটা গ্যারিঞ্চার। এইরকম ম্যাচ বা লড়াই সারা বিশ্বে এখন আকছার হচ্ছে।”

আমার চোখে-মুখে অবিশ্বাসের চিহ্ন দেখে নদুবাবু ফের বলতে শুরু করলেন, “এই তো সেদিন ফিলাডেলফিয়ায় হয়ে গেল হেভিওয়েট জো লুই আর মহম্মদ আলির লড়াই। সারা আমেরিকা জুড়ে সে কী হইচই। বারো রাউন্ড লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কিন্তু জিতলেন জো লুই। ওদের ফিরতি লড়াই আগামী শুক্কুরবার।”

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের টানাপোড়েনে তখনও আমি দুলছি। নদুবাবু যা বলছেন, তা কি সত্যি? সারা বিশ্বে এত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তার কিছুই জানি না!নদু মিত্তির বোধ হয় এবারও আমার মনের কথা পড়ে ফেললেন। তারপর বললেন, “শুনতে যতই অবাস্তব মনে হোক, যা বলছি তা ঘটনা। মস্কোতে এই মুহূর্তে একটা দাবা ম্যাচ চলছে, যা কয়েক দশকের একটা বিতর্ককে থামিয়ে দেবে। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু কে, এই প্রশ্নেরও মীমাংসা করে দেবে। হ্যাঁ, আমেরিকার ববি ফিশার আর রাশিয়ার গ্যারি কাসপারভের কথাই বলছি। কিছু দিন আগে কাসপারভ রেটিংয়ে ছাপিয়ে গেছেন ফিশারকে। আর তার পরই এই ম্যাচের ব্যবস্থা। পনেরো রাউন্ডের খেলা। সাত রাউন্ড হয়ে গেছে। ফিশার ৪-৩ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। এই খবরটা তো আপনার জানা উচিত।”

নদুবাবুর এই কথাটায় খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম, “আপনি যা বলছেন, তা খুবই ইন্টারেস্টিং। তবে, দু’যুগের দুই খেলোয়াড়কে নিয়ে এই ধরনের খেলা কী ভাবে সম্ভব? ধরুন, ডন ব্রাডম্যান আর সুনীল গাওস্কর—কে সেরা, সেটা বিচার করবেন কী করে?”

নদুবাবু হাসলেন। আত্মবিশ্বাসের হাসি। অর্থাৎ কিনা, এতক্ষণ যা বোঝাতে চাইছেন, শেষ পর্যন্ত আমার মাথায় তা ঢোকাতে পেরেছেন। বললেন, “আপনাকে তো প্রথমেই বলেছি, বিজ্ঞানের যুগে অনেক কিছুই সম্ভব। টাইম মেশিনের কথা কখনও শুনেছেন? টাইম মেশিনের দ্বারা এখন সব কিছুই সম্ভব। কথাটা হয়তো একটু বাড়িয়েই বললাম। টাইম মেশিন দিয়ে এখন অনেক কিছুই সম্ভব। সারা বিশ্বে গত একশো বছরে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই এখন ইচ্ছে করলে প্রত্যক্ষ করতে পারেন। বিজ্ঞানীরা এই মেশিন আরও উন্নত করেছেন। এখন তো এক যুগের ঘটনার সঙ্গে অন্য যুগের ঘটনাবলির তুলনাও করতে পারছেন। তবে কিনা, সেই একশো বছরের মধ্যেই। এখন যদি আপনি প্রশ্ন তোলেন, পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট জিততে পারতেন কি না, টাইম মেশিনের এখনও পর্যন্ত যা পাল্লা, তাতে বলা সম্ভব হবে না। কিন্তু যা দিন আসছে…ভবিষ্যতে একদিন তা সম্ভব হলেও হতে পারে। সেসব কথা থাক, আজকের কথা বলি। নিজের চোখেই আজ একটা ম্যাচ প্রত্যক্ষ করে যান। আমাদের মতে, ভারতের সেরা দুটো টিমের। তারপর আপনি নিজেই না-হয় সিদ্ধান্ত নেবেন, ভারতের সর্বকালের সেরা টিম কোনটি?”

মাঠের দিকে তাকালেন নদুবাবু। তারপর বললেন, “ফেন্সিংয়ের ধারে ওই যে সোফাটা দেখছেন, তাতে খাতাকলম নিয়ে বসে আছেন তিন প্রাক্তন ফুটবলার। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ টিমের নৰ্মান প্রিচার্ড, মোহনবাগান ক্লাবের গোষ্ঠ পাল এবং ই বি আর টিমের সামাদ। নিশ্চয়ই জানেন, এই তিনজন অতীতের দিকপাল খেলোয়াড়। তবে তুলনায় নর্মান প্রিচার্ড একটু কম পরিচিত। কেননা, উনি এই শতাব্দীরই খেলোয়াড় নন। কলকাতার ফুটবলে এই প্রিচার্ডই প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। শুধু ফুটবলার হিসেবেই নন, অ্যাথলেটিকসেও তিনি দক্ষ ছিলেন। উনিশশো সালে প্যারিস অলিম্পিক থেকে প্রিচার্ড দুটো ব্যক্তিগত পদক জিতে এনেছিলেন। এশীয় হিসেবে তিনিই প্রথম, পান ওলিম্পিক পদক।”

একটু থেমে নদুবাবু আবার বললেন, “প্রিচার্ডের ডান পাশেই বসে আছেন গোষ্ঠ পাল। ইংরেজরা যার নাম দিয়েছিলেন ‘চাইনিজ ওয়াল’। খুব বেশি পরিচয় দেওয়ারও বোধ হয় দরকার নেই। গোষ্ঠ পালের পাশে আছেন সামাদ। বল নিয়ে এমন ভেলকি দেখাতেন যে, সবাই তাকে বলতেন জাদুকর সামাদ। এই তিন শ্রেষ্ঠ ফুটবলারকে আমরা আজ খেলার পর সংবর্ধনা দিচ্ছি। এরা আবার আজকের ম্যাচের বিচারকও।”

এই নদুবাবুকে একটু গণ্ডগোলে মার্কা লোক বলে মনে হচ্ছিল। একে তো, যে ম্যাচ দেখাবেন বলছেন, সেটাই অবাস্তব। তার ওপর আবার সাইড লাইনে বিচারক বসিয়ে রেখেছেন! ফুটবল মাঠে তো রেফারিই বিচারক। ভদ্রলোক আমাকে ভেবেছেনটা কী? আরও আশ্চর্য, দেখা হওয়ার পর থেকে আমি মনে মনে যা কিছু ভাবছি, ভদ্রলোক যেন সব কিছু টের পেয়ে যাচ্ছেন। মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ঝটপট তার উত্তর দিচ্ছেন। নদুবাবু কি অন্তর্যামী? এ কথাটিও বোধ হয় বুঝে ফেললেন নদুবাবু। মিটিমিটি হেসে বললেন, “আপনি যে ধরনের ম্যাচের কথা ভাবছেন, মোটেই এটা সে-ধরনের হচ্ছে না। ফুটবল বিজ্ঞান এখন এমন এগিয়েছে, শবব্যবচ্ছেদের মতো একটা ফুটবল ম্যাচও আমরা কাটাছেঁড়া করতে পারছি। একটা টিমের সঙ্গে অন্য একটার তুলনা করতে পারছি। খোলসা করেই বলি। ফুটবল ম্যাচকে আমরা দুটো ভাগে ভাগ করেছি। দু’ দলের ফরোয়ার্ড লাইন আর ডিফেন্স—কতটা দক্ষ, পালটাপালটি করে আমরা সেটা যাচাই করব। এই ম্যাচে যেমন মোহনবাগানের অ্যাটাকিং লাইন কতটা দক্ষ, সেটা প্রথমে যাচাই করব মহমেডান স্পোর্টিংয়ের ডিফেন্সের বিরুদ্ধে তারা কেমন খেলেন তা দেখে। এর জন্য চল্লিশ পয়েন্ট। এর পর উলটোটা হবে, অর্থাৎ কিনা, মহমেডানের ফরোয়ার্ড লাইন মোহনবাগান ডিফেন্সের বিরুদ্ধে কেমন খেলছে সেটাও দেখা হবে। এর জন্যও বরাদ্দ চল্লিশ পয়েন্ট। তা হলে দাঁড়াল মোট আশি পয়েন্ট। বাকি কুড়ি পয়েন্ট গোলকিপিং দক্ষতার জন্য। ম্যাচ চলার সময়ই পয়েন্টগুলি দেবেন ওই তিন বিচারক, যাঁদের নাম আপনাকে আগে বলেছি। এর পরও একটা কথা আছে। প্রতি দশ পয়েন্টে আমরা ধরব একটা করে গোল। একটা টিম যদি ৬০ পয়েন্ট পায়, আর অন্য দল ৪০, তা হলে ম্যাচের ফল দাঁড়াবে ৬-৪ গোলে। অর্থাৎ এক টিম অন্য টিমকে হারাবে ২-০ গোলে। এই পদ্ধতিটা আমাদের নিতে হচ্ছে টাইম মেশিনের সুবিধার্থে।”

এইসব অদ্ভুত নিয়ম-টিয়ম শুনে মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। এত সব অঙ্ক কষে একটা দলের উৎকর্ষ যাচাই করাও সম্ভব কি না, সে প্রশ্নও জাগছিল। টাইম মেশিনের কথা অবশ্য আগেও পড়েছি—প্রোফেসর শঙ্কুর লেখা ডায়েরিতে। কিন্তু তাতেও সব কিছু পরিষ্কার হল না। এই কথা ভাবার মাঝেই নদুবাবুর পাশে উদয় হলেন ঢ্যাঙামতন এক ভদ্রলোক। হাতে ছোট একটা বাক্স, পোর্টেবল টাইপরাইটারের মতো। বাক্সটি নদুবাবুর হাতে তুলে দিয়ে ঢ্যাঙা ভদ্রলোক কী যেন বললেন, শুনতে পেলাম না। বস্তুত গ্যালারির মাঝে এতক্ষণ বসে আছি, এত লোকের মাঝে। নদুবাবুর গলা ছাড়া আমি আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। কী অদ্ভুত জায়গায় এসে পড়েছি, নিজেও জানি না। সেই ঢ্যাঙা লোকটি নদুবাবুর সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলেই যাচ্ছেন। মুখের ভঙ্গি দেখে আন্দাজ করলাম, ছোট বাক্সটা নিয়ে সম্ভবত কোনও কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন। তারপর, যেমন ভাবে উদয় হয়েছিলেন, চোখের পলকে ঠিক তেমন ভাবেই ঢ্যাঙা ভদ্রলোক মিলিয়ে গেলেন। ঠিক সিনেমায় যেমনটি হয়, সেই রকম।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নদুবাবু এবার বললেন, “তা হলে ম্যাচটা শুরু করা যাক।”

মাথায় চট করে একটা হেডফোন লাগিয়ে ছোট বাক্সটা কোলের উপর তুলে নিলেন তিনি। “এই হচ্ছে, টি এম এফ—ফোরটিন। ভাবা রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে আনা। খুবই সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি। একেবারে যাকে বলে কম্পিউটারাইজড। এই টাইম মেশিনটির সাহায্যে গত একশো বছরের ফুটবল আপনি প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। সেই সময়ে উপস্থিতও হতে পারবেন। সে যাক, এবার মাঠের দিকে তাকান। দয়া করে আপনার মাথা থেকে হেডফোনটা খুলবেন না। আমি সাউন্ড বাড়িয়ে দিচ্ছি। এখন থেকে মাঠের সব কিছুই আপনি শুনতে পাবেন।”

সঙ্গে সঙ্গে দু’কানে একটা তীক্ষ্ণ চিঁ চিঁ শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর বিরাট একটা আওয়াজ। ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান টিম মাঠে নামার সময় ঠিক এই ধরনের আওয়াজই আমরা শুনতে পাই। নীল আর সবুজ আলোটা আর নেই। মাঠের সব কিছু আমি দেখতে পাচ্ছি। সব কিছু দিনের আলোর মতো ঝকঝকে। মাইক্রোফোনে কে যেন বললেন, ‘বহু প্রত্যাশিত এই ম্যাচ আজ পরিচালনা করবেন খ্যাতনামা রেফারি ক্লেটন। তাকে সাহায্য করবেন পঙ্কজ গুপ্ত এবং রমাকান্ত গাঙ্গুলি।’ সঙ্গে সঙ্গে টানেল দিয়ে উঠে এলেন রেফারির পোশাক-পরা এক ইংরেজ আর দুই ভারতীয়। গ্যালারির দিকে হাত নাড়লেন ক্লেটন। কিন্তু কেউ টুঁ শব্দটি করলেন না। স্পষ্টই বুঝতে পারলাম, এই রেফারিটিকে দর্শকরা ঠিক পছন্দ করছেন না। আই এফ এ-র গোল্ডেন জুবিলি স্মারক পত্রিকায় এই ক্লেটন সাহেবের একটা ছবি দেখেছিলাম। গোষ্ঠ পালের মুখেও শুনেছি, ইংরেজদের দিকে টেনে খেলানোর ব্যাপারে ক্লেটনের খুব বদনাম ছিল।

নদুবাবুর গলা হেডফোনে শুনতে পেলাম। এইবার মোহনবাগান টিম মাঠে নামবে। কিন্তু টানেল দিয়ে বেরিয়ে এলেন একদল ইংরেজ ফুটবলার। মাঠ পর্যন্ত পৌঁছে তারা ছোটাছুটিও শুরু করে দিলেন। দু-একজনকে দেখলাম, ক্লেটনের সঙ্গে গল্পও করছেন। ইংরেজদের দেখে গ্যালারির দর্শকরা খুব চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। কোথায় মোহনবাগান টিম? আমাদের সঙ্গে চালাকি? ইস্ট ইয়র্কশায়ার টিমকে নামিয়ে মোহনবাগান বলা হচ্ছে। দর্শকরা দেখলাম, ইংরেজ টিমটা সম্পর্কে খুবই ওয়াকিবহাল। প্লেয়ারদের নাম ধরে টীকা-টিপ্পনীও করতে লাগলেন অনেকে।

পাশে তাকিয়ে দেখি, কোলের ওপর রাখা ছোট্ট বাক্সটা নিয়ে গলদঘর্ম হয়ে উঠেছেন নদুবাবু। একবার সুইচ ঘোরাচ্ছেন, আর একবার সাংকেতিক লাল, সবুজ আর গোলাপি আলো কমাচ্ছেন বাড়াচ্ছেন। কিছু একটা অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, পারছেন না। আমার দিকে চোখ পড়তেই বললেন, “টাইম মেশিনটা সামান্য একটু ট্রাবল দিচ্ছে। ঘাবড়াবেন না, ঠিক হয়ে যাবে। এগারো সালে আই এফ এ শিল্ড ফাইনাল ম্যাচে মোহনবাগানের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এই ইস্ট ইয়র্কশায়ার। ম্যাচের দিন ওরাই আগে মাঠে নেমেছিল। তার মিনিট পাঁচেক পর মোহনবাগান। টাইম মেশিনে পাঁচ মিনিট ফাস্ট করে দিলেই ঝামেলা চুকে যেত। কিন্তু ফাস্ট ফরোয়ার্ড করার সুইচটা ঠাহর করতে পারছি না। তাই এই গণ্ডগোল। দেখুন, এখনই ইস্ট ইয়র্ক টিমটাকে ইরেজ করে দিচ্ছি।’

মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি ভৌতিক কাণ্ড। ইস্ট ইয়র্কশায়ার টিম নেই। হেডফোনে নদুবাবুর গলা শুনতে পেলাম, দর্শকদের উদ্দেশে বলছেন, “আপনারা অধৈর্য হবেন না। মোহনবাগান দল এবার মাঠে নামছে। যার হাতে বল তিনি দলের অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি। তার পিছনে গোলকিপার হীরালাল মুখার্জি, ডিফেন্ডার সুধীর চ্যাটার্জি, হাফব্যাক নীলমাধব ভট্টাচার্য, রাজেন সেন, মনোমোহন মুখার্জি, ডিফেন্ডার ভুতি সুকুল, ফরোয়ার্ড কানু রায়, হাবুল সরকার, অভিলাষ ঘোষ আর সবার শেষে বিজয়দাস ভাদুড়ি।”

চোখ কচলে দেখলাম, সত্যি-সত্যিই এগারোর শিল্ড জয়ী দলের নায়করা টানেল দিয়ে উঠে এলেন। গায়ে সবুজ-মেরুন জার্সি, ঢোলা প্যান্ট। কারও পায়ে অ্যাঙ্কলেট, কারও শাড়ির পাড় জড়ানো। একমাত্র সুধীর চ্যাটার্জি ছাড়া আর কারও পায়ে বুট নেই। খুব সুশৃঙ্খল ভাবে ওই এগারোজন মাঠের মধ্যিখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। মাঠের পূর্ব দিকে বিরাট ইলেকট্রনিক স্কোর বোর্ড। এগারোজনের পরিচিতি জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্কোর বোর্ডের পর্দায় এক-একজনের মুখ ভেসে উঠছে আর মাইক্রোফোনে তার নাম আর কৃতিত্ব নাটকীয় ভাবে জানাচ্ছেন ঘোষক। গলাটা খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। ঘোষক কি নামকরা ভাষ্যকার বেরি সর্বাধিকারী? হয়তো হবে। দর্শকরা তুমুল অভিনন্দন জানালেন শিবদাস ভাদুড়িকে। যখন শুনলেন ফাইনাল ম্যাচে জয়সূচক গোলটা শিবদাসবাবুই করেছিলেন। পরিচিতির পালা শেষ হয়ে গেল। অবাক লাগল দেখে, মোহনবাগান মাত্র এগারোজনের দল এনেছে। শিল্ড জয়ী দলে কি রিজার্ভ কোনও প্লেয়ার ছিল না? কেউ চোট পেলে মোহনবাগানকে কি তা হলে দশজনেই খেলতে হত?

মাঠের মধ্যে আশি বছর আগের একটা টিমকে চোখের সামনে দেখে একটু উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। নদুবাবুর কথা একটু একটু করে বিশ্বাস হচ্ছে। সত্যিই তা হলে আমার সামনে এমন একটা ম্যাচ হতে যাচ্ছে, যা আধ ঘন্টা আগে ভাবতেও পারতাম না। ঘোষকের গলা ভেসে এল, এবার মহমেডান স্পোর্টিং দল মাঠে নামছে। খেলোয়াড়দের নামগুলো পর পর বলে যাচ্ছি। টিমের অধিনায়ক আব্বাস, গোলকিপার ওসমান, দুই ব্যাক জুম্মা খান আর সিরাজুদ্দিন, হাফ ব্যাক মাসুম, নুর মহম্মদ আর রশিদ খান, ফরোয়ার্ড লাইনে নুর জুনিয়ার, রহিম, রশিদ আর সাবু।’

গ্যালারি থেকে যেন গর্জন উঠল। মনে হল, দর্শকদের দুই-তৃতীয়াংশই মহমেডানের সমর্থক। একজন উৎসাহী দর্শক বিরাট একটা টাকার মালা পরিয়ে দিয়ে এলেন গোলকিপার ওসমানের গলায়। মাথায় কোঁকড়া চুল, পাঠানদের মতো শরীর। ওসমান সেই মালা জুম্মা খানের হাতে তুলে দিলেন।…দু’দলের খেলোয়াড়রা মাঠের মাঝখানে সার বেঁধে দাঁড়ালেন। তিন বিচারকের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। আর তার পরই হঠাৎ মাঠে নৈঃশব্দ্য নেমে এল। নদুবাবু আমাকে বললেন, “খেলা এবার শুরু হয়ে গেল। একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার বলে মনে করছি। এই ম্যাচের বাজির দর ৯-৬। মহমেডানের পক্ষে। প্রচুর লোক বাজি ধরেছেন। কয়েক কোটি টাকার ব্যাপার।”

যাই হোক, খেলা সত্যি সত্যিই শুরু হয়ে গেল। আর চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই গোল! তাও মাত্র চার টাচে। অভিলাষ ঘোষ কিক-অফ থেকে বল দিলেন লেফট উইংয়ে শিবদাসকে। রাইট ব্যাক জুম্মা খানকে ছোট্ট ডজে কাটিয়ে নিয়েই শিবদাস তরতর করে উঠে গেলেন কর্নার পোলের কাছে। ততক্ষণে জায়গা বদলে রাইট ইন হাবুল সরকার চলে এসেছেন লেফট ইনে। শিবদাসকে বাধা দিতে এসেছিলেন রাইট হাফ মাসুম। তিনি ট্যাকল করতে যাওয়ার আগেই শিবদাস বল বাড়িয়ে দিলেন হাবুল সরকারের উদ্দেশে। বলটা না ধরে ছোট্ট একটা টোকা দিলেন হাবুল। অভিলাষ ঘোষ যেন আগেভাগেই জানতেন, বলটা কোথায় পাবেন। বল ধরেই হাফ টানে তিনি দুর্দান্ত শট নিলেন গোল লক্ষ্য করে। গোলকিপার ওসমানের দু’ হাতের ফাঁক দিয়ে বল গোলে ঢুকে গেল। রেফারি ক্লেটন কিন্তু গোল দিলেন না। অভিলাষের দিকে ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিলেন, অফ সাইডে ছিলেন।

গোল না হলেও, দুটো ব্যাপার বেশ নজরে পড়ল। এক, মোহনবাগান ফরোয়ার্ড লাইনের সমঝোতা আর জায়গা বদল করে খেলা। দুই, ওসমানের অদ্ভুত বল গ্রিপিং। আমাদের দেশে পাঁচ ফরোয়ার্ডের ছকে যখন খেলা হত, সেই সময় জায়গা বদল করে খেলাটা তেমন চালু ছিল না। দুই ইনসাইড উঠে-নেমে খেলতেন। দুই আউটসাইড ভেতরে ঢুকতেন না। সেন্টার ফরোয়ার্ড ঘুরঘুর করতেন গোল এরিয়ায়। পঞ্চাশের দশকে এই খেলাটা আমূল বদলে দেন হাঙ্গারির কোচ গুস্তাভ সিবেস। তার সময়েই পুসকাস, হিদেকুটি আর কোজিসরা নিজেদের মধ্যে জায়গা বদল করে খেলে সারা বিশ্বকে চমকে দেন। কিন্তু পুসকাসদেরও চল্লিশ বছর আগে সেই খেলাটা মোহনবাগানের ফরোয়ার্ডদের খেলতে দেখে অবাক হলাম। সেই সময় কোচ ফোচ ছিল না। টিম দেখতেন নাকি শিবদাস ভাদুড়িই। দেখে ভাল লাগল, ফুটবল নিয়ে শিবদাস তা হলে সে-সময় গভীর চিন্তাভাবনা করতেন।

ওই অল্প সময়ের মধ্যে আর চোখে পড়ল গোলকিপার ওসমানের গ্রিপিং। তিরিশের দশকে এই ওসমান ছিলেন কলকাতা লিগের সেরা স্টাইলিশ গোলকিপার। কোয়েটার লোক। এখন ওই জায়গাটা পাকিস্তানে। তিরিশের দশকের সেই সময়টায় মহমেডানের সেক্রেটারি আবদুল আজিজ। কোয়েটা থেকে বলিষ্ঠ চেহারার চার-পাঁচজন প্লেয়ার তিনি ধরে এনেছিলেন। জুম্মা খান, ওসমান তাদেরই অন্যতম। যাই হোক, ওসমানকে দেখলাম, বল ধরার চেষ্টা করলেন, দুই পাশ থেকে হাত এনে। এখনকার গোলকিপাররা তো এ ভাবে বল গ্রিপ করার কথা ভাবতেই পারেন না। তারা দুই হাত বলের পিছনে নিয়ে যান। কী জানি, হয়তো সে যুগে ওসমানের ওই গ্রিপিংই হয়তো ছিল তাঁর স্টাইল!

এইসব ভাবছি, খেলা ততক্ষণে বেশ কিছুটা সময় এগিয়ে গেছে। খেলা তখনও ড্র। মোহনবাগান চেপে ধরেছে। আরও দু’বার গোলের সুযোগ পেলেন অভিলাষ ঘোষ আর রাজেন সেন। কিন্তু এক বার ছররা মেরে বাঁচিয়ে দিলেন ব্যাক সিরাজুদ্দিন। আর অন্য বার রাজেন সেনের হেড-করা বল ফিরিয়ে দিলেন জুম্মা খান। নদুবাবু আমাকে বললেন, “ওই সিরাজুদ্দিনকে দেখছেন, কার ভাই জানেন? ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের। মহমেডানের এই দলটায় মাত্র দু’জন বাঙালি ছিলেন। ক্যাপ্টেন আব্বাস আর এই সিরাজুদ্দিন।”

খেলার মধ্যে ক্রমশই ডুবে যাচ্ছি। হেডফোনে মাঝে মাঝে একটা তীক্ষ্ণ চিঁ চিঁ শব্দ শুনছি। রেডিও-র অজানা স্টেশন ধরলে যেমনটি হয়। ফাঁসের মতো মাথায় চেপে বসে আছে যেন হেডফোনটা। একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। মাঠের দিকে নজর দিলাম।

এবার মহমেডান ফরোয়ার্ড লাইন জোরালো আক্রমণ করছে। রশিদ, রহিম আর সাবুর মধ্যেও দেখলাম দারুণ সমঝোতা। বল দেওয়া-নেওয়া করে তারা চমৎকার এগোচ্ছেন। কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলছেন গোলের কাছাকাছি গিয়ে। সুন্দর পজিশনাল প্লে দেখলাম, মোহনবাগানের রাইট ব্যাক সুধীর চ্যাটার্জির খেলায়। সেই শিল্ডজয়ী টিমের সব থেকে কমজোরি প্লেয়ার ছিলেন এই সুধীর চ্যাটার্জি—অনেকের মুখেই এ কথা শুনেছি। আমার কিন্তু তা মনে হল না। রহিম আর রশিদ বল ধরলেই উৎসাহে ফেটে পড়ছে গ্যালারি। ভুতি সুকুল একবার কড়া ট্যাকল করলেন রহিমকে। গ্যালারি থেকে দু’-একটা ইট উড়ে গেল রেফারি ক্লেটনকে লক্ষ্য করে। সমর্থকদের খুশি করার জন্যই বোধ হয়, ক্লেটনসাহেব দৌড়ে গিয়ে খুব ধমকে দিলেন সুকুলকে। এ ছাড়া আর কীই-বা করতে পারতেন তিনি? সেই সময় তো আর হলুদ কার্ড বা লাল কার্ডের নিয়ম ছিল না!

একটু সময় বাদেই, মহমেডানের মাসুম পিছন থেকে ট্রিপ করলেন বিজয়দাস ভাদুড়িকে। গোল এরিয়ার সামান্য বাইরে ডান দিকে। ইনডাইরেক্ট ফ্রি-কিক। ক্লেটনের এই সিদ্ধান্তে কিন্তু সমর্থকরা সন্তুষ্ট হলেন না। আবার চার-পাঁচটা ইট উড়ে গেল মাঠের মধ্যে। এখন পেশাদার ফুটবলে একে বলে ‘গেমসম্যানশিপ’। এটা তা হলে তখনও ছিল!

ফ্রি-কিক নিচ্ছেন শিবদাস। তার ফরোয়ার্ডরা এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে। শিবদাসের সামনে পাঁচ ডিফেন্ডারের দেওয়াল। আর তার পিছনে গোলকিপার ওসমান। দেওয়ালটা আরও জমাট করার জন্য চেঁচিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন ওসমান। তারপর নিজে ডান গোলপোস্টের দিকে সরে দাঁড়ালেন। ক্লেটন বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন। শিবদাস শট নিতে যাবেন। ঠিক এই সময় তার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে এলেন দাদা বিজয়দাস। হাত নেড়ে এমন ভঙ্গি করলেন, শিবদাস যেন ফ্রি-কিক না নেন। দু’ভাইয়ের মধ্যে কী যেন কথাও হল। আর কথা বলার মাঝেই শিবদাস বল ঠেলে দিলেন দাদাকে। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, গা-আলগা দেওয়া মহমেডান ডিফেন্ডাররা সজাগ হয়ে ওঠার আর সুযোগই পেলেন না। জোরে শট নেওয়ার ভঙ্গি করে বিজয়দাস প্রথমে ডিফেন্সের দেওয়াল ভেঙে দিলেন। তারপর, ভেতরে ঢুকে আসা হাবুল সরকারকে লক্ষ্য করে বল তুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাইভিং হেড। গোলকিপার ওসমান কিন্তু ঠিক জায়গায় সরে এসেছিলেন। কিন্তু হাবুল সরকার অত ঝুঁকি নিয়ে, শুন্যে শরীর ভাসিয়ে হেড দেবেন ভাবতেই পারেননি। দু’জনের শরীরে লাগল প্রচণ্ড ধাক্কা। দু’হাতে মাথা চেপে শুয়ে রইলেন হাবুল সরকার। আর বুকে হাত দিয়ে জমিতে ছটফট করতে লাগলেন ওসমান। দূর থেকে আমার মনে হল, পাঁজরের কোথাও তার চোট লেগেছে। এবং বেশ ভাল চোটই।

ব্যস, গ্যালারিতে যেন বিস্ফোরণ ঘটে গেল। মাঠে ফেন্সিং নেই। চারপাশের গ্যালারি থেকে হুড়মুড় করে কিছু লোক মাঠে নেমে গেলেন। তাড়া করলেন ক্লেটনকে। ইট, ছাতা, জুতো বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বোমার আওয়াজ। বিশৃঙ্খল অবস্থা। মাঠে পুলিশও ঢুকে পড়ল।

দু’দলের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কাঁদানে গ্যাসের তীব্র ঝাঁঝ চোখে এসে লাগল। পাশে তাকিয়ে দেখি নদুবাবু নেই। পালিয়ে গেছেন। যাওয়ার সময় টাইম মেশিনটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছেন। গ্যালারির উত্তর দিকে পুলিশ হোস পাইপে জল ছেটাচ্ছে। দর্শকদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য দেখলাম, ডজন খানেক বিরাট চেহারার অ্যালসেশিয়ান কুকুরও পুলিশ গ্যালারিতে ছেড়ে দিয়েছে। তাতেও দর্শকদের সামলানো যাচ্ছে না। একজন দর্শক আমার পাশ দিয়ে নেমে গেলেন, হাতে রিভলভার। ওই ভয়ানক পরিস্থিতিতে কী করব ভাবছি। এমন সময় ঠাস করে আধখানা ইট এসে পড়ল আমার হেডফোনে…

আর তারপরই—বাঁকেলালের ডাক শুনতে পেলাম। গাড়ি স্টার্ট নিতে নিতে ও বিরক্তির সুরে বলল, ‘শুধু শুধু আধ ঘণ্টা নষ্ট হল।

২ মে ১৯৯০

সকল অধ্যায়

১. ভারত যুদ্ধে পিঁপড়ে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২. বিড়ালের চোখ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
৩. শরচ্চন্দ্রের সন্ধিভেদ – শিবরাম চক্রবর্তী
৪. ঝুনুমাসির বিড়াল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৫. বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৬. সাধু কালাচাঁদের পালাকীর্তন – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
৭. ‘তেনা-রা’ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৮. লালটেম – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৯. অশরীরী – লীলা মজুমদার
১০. রাজপুত্তুরের অসুখ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. ভূতেরা বড় মিথ্যুক – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১২. রুকু আর সুকু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৩. রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
১৪. ম্যাজিশিয়ান – বিমল কর
১৫. ঘণ্টাকর্ণের কান গেল – মনোজ বসু
১৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
১৭. বনকুঠির রহস্য – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৮. একদম রূপকথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. তারিণীখুড়ো ও ডুমনিগড়ের মানুষখেকো – সত্যজিৎ রায়
২০. অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য – সত্যজিৎ রায়
২১. দেবতার ভর – সুকুমার সেন
২২. মজারুমামা – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. দুঃখহরা বড়ির শিশি – লীলা মজুমদার
২৪. গঙ্গারামের কপাল – সত্যজিৎ রায়
২৫. গোরক্ষনাথবাবুর নোটবুক – সমরেশ বসু
২৬. ভুনিকাকার চৌরশতম্‌ – বিমল কর
২৭. অনুকূল – সত্যজিৎ রায়
২৮. ক্যাপ্টেন – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২৯. তুরুপের তাস চুরি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হতে গেলে – আশাপূর্ণা দেবী
৩১. রুপোর গাছ – বাণী বসু
৩২. বনঝাউয়ার রহস্য – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৩৪. একটি লাল লঙ্কা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৩৫. টিকটিকি অতীন্দ্রিয় শক্তি ও বেদান্ত বর্ধন -আশাপূর্ণা দেবী
৩৬. নদুস্কোপ – রূপক সাহা
৩৭. আতাপুরের দৈত্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩৮. নিখোঁজ চারু – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৯. গাবু – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪০. কপালের নাম গোপাল – আশাপূর্ণা দেবী
৪১. শিমুলতলার মাধবী লজ – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৪২. কানকাটা বাঘ – শৈলেন ঘোষ
৪৩. হিংসুটে – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৪. হরিণ-শিকারির বাড়ি – হর্ষ দত্ত
৪৫. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৪৬. কেউ কি এসেছিলেন – বিমল কর
৪৭. হরিমতির বাগান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৮. মজাদার এক ফুটবল ম্যাচ আর দানাপুরি – বিমল কর
৪৯. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৫০. বন্ধু – তিলোত্তমা মজুমদার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন