পৌলোমী সেনগুপ্ত
এ আমাদের ছেলেবেলার গল্প। বছর পঁয়ষট্টি আগেকার। তখন আর কতই বা বয়েস, এগারো-বারো চলছে। যে মফস্সল শহরটিতে থাকতাম সেটি দেখতে ছিল চমৎকার। টিলার মতন ছোট ছোট পাহাড়, বালিয়াড়ি, দেদার গাছপালা— নিম কাঁঠাল বট থেকে বড় বড় দেবদারু, কুলঝোপ। কলকে ফুল আর কাঠচাঁপার গাছই কি কম ছিল! ওদিকে চাঁদমারি, বরফকল, ছোট লাইনের কু ঝিকঝিক গাড়ি, ব্রাঞ্চ লাইন।
আর ছিল বদুদা। মানে বৈদ্যনাথদা। বদুদার বন্ধুরা ডাকত, বোঁদে বলে, আমরা বলতাম বদুদা।
বাজারে বদুদার একটা মনিহারি দোকান ছিল। সেখানে বড়দের জিনিস ছাড়াও আমাদের জন্যে থাকত কাগজ, পেনসিল, খাতা, জেবিডি কালির বড়ি, কলমের নিব, লজেন্স, জলছবি, ডালমুট আরও কত কী!
বদুদা দেখতে ছিল রোগা, লম্বা! টিঙটিঙে বললেও চলে। সাইকেল চালাত পনপন করে। সাইকেল ছাড়া বদুদা নড়ত না। ধুতি পরত মালকোঁচা মেরে, গায়ে হাফ-হাতা শার্ট। প্যান্ট পরার রেওয়াজই তখন হয়নি। রেলের গার্ড সাহেব, টিকিট কালেক্টার ছাড়া আর কাউকে প্যান্ট পরতে আমরা দেখতাম না। দুই ডাক্তারবাবু—ঘটক আর মিত্তির জেঠাও ধুতি পরে রোগী দেখে বেড়াতেন।
বদুদার সাধ স্বপ্ন ভালবাসা বাতিক—যাই বলি না-কেন—সেটা ছিল তার ক্লাব নিয়ে। ফুটবল ক্লাব। ক্লাবের পোশাকি নাম ছিল, ফ্রেন্ডস ক্লাব। লোকে বলত, বদুর ক্লাব। আর বদুদার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলত, ‘বোঁদে ক্লাব’।
সেবার একটা বড়সড় ম্যাচ ছিল বদুদার ক্লাবের সঙ্গে লালবাঁধ কোলিয়ারির জুনিয়ার টিমের। এটাই ফাইনাল। চার-পাঁচটা গাঁট পেরিয়ে বদুদার ক্লাব— মানে আমাদের শহরের ক্লাব ফাইনালে উঠেছে। চাট্টিখানি কথা নাকি! ওদিকে লালবাঁধ হল তল্লাটের সেরা।
খেলা আমাদের শহরেই। চাঁদমারির গায়ে যে মস্ত মাঠ আছে সেখানে। ওটাই দিশি লোকের ফুটবল মাঠ। বড় মাঠ রেলের, সাহেবসুবো অ্যাংলোদের জন্যে। অনেক কাঠখড় পোড়ালে তবে সে মাঠ পাওয়া যায়। তার দরকারই বা কী! চাঁদমারির মাঠ কম কীসে! সেখানেই তো আমাদের ফুটবল খেলা হয়।
খেলার দিন একটু বেলা হতে-না-হতেই এক জোড়া সাইকেল আর টিনের চোঙা নিয়ে বদুদার দুই শাগরেদ পাড়া ঘুরতে বেরিয়ে পড়ল। আজ বিকেল চারটেয় চাঁদমারির মাঠে ফ্রেন্ডস ক্লাবের সঙ্গে লালবাঁধ কোলিয়ারি ক্লাবের ফাইনাল খেলা। আপনারা সকলেই মাঠে আসুন। আপনাদের শহর, আপনাদের ক্লাব; এই শহর ও ক্লাবের ইজ্জত রাখতে সবাই আসুন আপনারা। খেলার শেষে ফ্রি বরফজল আর লেবুর শরবত। আসুন আসুন। এমন খেলা আগে আর দেখেননি।
পাড়ায় পাড়ায় বার্তা রটিয়ে বদুদার চেলারা ফিরে গেল। আমরা বাচ্চাকাচ্চারা নাচতে লাগলাম। বদুদার বন্ধুরা রগড় করে বলতে লাগল, আজ বোঁদে ভার্সেস ল্যাংচার খেলা। আমাদের বোঁদেদা মরবে; দশটা গোল বাঁধা, এগারোটা হতে পারে। তবে খেলতে এসে কি অতটা বেইজ্জত করবে ওরা আমাদের! একটু দয়ামায়া দেখালে দশ, না হলে এগারো!
যে যাই বলুক আমরা একেবারে তিনটে বাজতে-না-বাজতেই চাঁদমারির মাঠের দিকে ছুট দিলাম। সবে জ্যৈষ্ঠমাস শেষ হয়েছে, আষাঢ় নেমেছে। এরই মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে দু’-একদিন। সেদিনও আকাশ মেঘলা মেঘলা ছিল।
চারটে বাজার আগেই কোলিয়ারির হতকুচ্ছিত কয়লার গুঁড়োয় কালো এক লরি চেপে লালবাঁধের ছেলেগুলো এসে গেল। প্লেয়ারদের সঙ্গে এক গুচ্চের লোক। কারও হাতে ছাতা, কারও হাতে মোটাসোটা লাঠি। একজন এসেছে ভেঁপু নিয়ে, আর-একজন একেবারে সঙ সেজে।
ওদের দেখে গা জ্বালা করতে লাগল! ভেবেছে কী আমাদের? ছাতা লাঠি আমাদের নেই নাকি! পঞ্চু ওস্তাদ আছে আমাদের, লাঠি খেলার রাজা। আর ভেঁপু কী রে, আমরা বললে বানোয়ারির ব্যান্ড পার্টি চলে আসবে।
দেখতে দেখতে মাঠ ভরে গেল। ছেলে জোয়ান বুড়ো—না হোক শ’ দুই লোক। মাঠের পাশে সবাই বসে পড়েছে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে।
বদুদাও তার ক্লাবের টিম নিয়ে হাজির। চারটে এক্কাগাড়িতে আমাদের প্লেয়াররা। ওরা আসতেই আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম; লম্ফঝম্প শুরু হল।
লালবাঁধের—ল্যাংচার দল যেন মুখ বেঁকিয়ে একবার দেখল আমাদের। ভাবল, আমরা নেহাতই ছাগল আর ওরা বাঘ সিংহ।
ঘড়িতে চারটে বাজে বোধ হয়। আকাশ মেঘলা হয়ে এল। লালবাঁধের কর্তা লোকটি একবার গোল পোস্ট দেখে এল। বাঁশ পুঁতে গোল পোস্ট করা হয়েছে এখানে। জালটাল নেই। তবে যেখানে যেখানে চুনের লাইন দেওয়ার কথা—দেওয়া আছে।
রেফারি লাইন্সম্যান মাঠে নেমে পড়লেন। ও হরি, রেফারি যে রেলের টিমের কদমকাকা। খুব কড়া লোক। নিজে ভাল খেলোয়াড়। হাত-পা চালাবার উপায় নেই। লাইন্সম্যান একজন আমাদের, অন্যজন ওদের। আমাদের লাইন্সম্যান জগদীশকাকা একেবারে লেবা। অন্য লোকটাকে চিনি না।
বদুদা তার টিমের প্লেয়ারদের কপালে মা কালীর পুজো-দেওয়া জবা ফুল ছুঁইয়ে মাঠে নামিয়ে দিল।
আকাশ আরও মেঘলা হয়ে এল। বাতাসও আসছিল ঠান্ডা।
খেলা শুরু হল।
পাঁচ-সাত মিনিটও হয়নি, লালবাঁধের বেঁটে গাট্টাগোট্টা ছেলেটা—ওদের রাইট ইন, দিল একটা গোল ঢুকিয়ে। তখনকার দিনে আজকালকার মতন হরেক রকম সিস্টেম—ছকটক বেরোয়নি। তা ছাড়া মফস্সল শহরে কে আর ছকের খবর রাখে। পাঁচ ফরোয়ার্ড, হাফ ব্যাক, ব্যাক, গোলকিপার নিয়ে খেলা। খেলতে খেলতে কেউ এগোল, কেউ পিছিয়ে গেল—সে অন্য কথা।
আমাদের গোলকিপারের ডাকনাম ভোঁদা। নামেও যেমন, কাজেও তেমনই। ভোঁদড় একেবারে! নয়তো ওই গোল কেউ খায়! ছি!
গোল হওয়ামাত্র লালবাঁধের লোকগুলো কী বিশ্রী চেল্লাতে লাগল। ভেঁপুঅলা মুটকু দিল ভেঁপু বাজিয়ে।
আমরা ভাবছি, ঠিক আছে—একটা তো মাত্র গোল। অত আহ্লাদের কী আছে, এখনই শোধ হয়ে যাবে। বদুদার ক্লাবেও চার-পাঁচটা ভাল প্লেয়ার আছে, জিতু রতন মানিক নন্তু। রতন ভীষণ মারকুটে, ল্যাংচা চালায় ফার্স্ট ক্লাস, তার ওপর দু’-পাঁচটার হাঁটু জখম করাও ওর কাছে কিছু নয়। বৃষ্টি পড়লে ছররা চালাবে। আর জিতুর পায়ে ম্যাগনেট লাগানো। একবার ঠিকমতন বল ধরলে দেখিয়ে দেবে লালবাঁধকে। ভাল কথা, তখন খেলা হত খালি পায়ে। বুট-ফুটের চলন হয়নি। রেলের মাঠে দু’-একজন অ্যাংলো সাহেবকেই যা বুট পরতে দেখেছি।
জিতু দু’-চারবার বল পেল, কিন্তু এগোতেই পারল না। ওদের হাফ ব্যাকের একটা যেন দৈত্য। যেমন চেহারা, তেমনই তাগড়াই। কার সাধ্য, ওকে ফাঁকি দিয়ে এগোতে পারে! বদুদার টিম এগোতেই পারছে না।
দেখতে দেখতে আবার একটা গোল। এ বারের গোলটা দিল লালবাঁধ—মানে ল্যাংচাদের রোগা পটকা সেন্টার ফরোয়ার্ড ছেলেটা। হেড করে গোল দিল। লালবাঁধের লোকগুলো আবার নাচতে লাগল। ভেঁপু বেজে উঠল আবার। ছাতা খুলে লাফ মারল ক’জন।
হাওয়া এল বাদলা। বৃষ্টি নেমেছে দূরে কোথাও।
হাফ টাইমের আগেই লম্বা চারটে গোল খেয়ে গেল আমাদের ক্লাব। না, আর কোনও চান্স নেই। আরও চার-পাঁচটা ওরা পরের হাফের জন্যে তুলে রেখেছে। বদুদা একেবারে মিইয়ে গিয়েছে। আমাদের প্লেয়াররা ঘেমে নেয়ে নেতিয়ে পড়ল।
কাতুকে বললাম, ‘চল বাড়ি যাই। এ-খেলা দেখে আর লাভ কী!’
কাতু বলল, “দাঁড়া। খেলার শেষে ফ্রি বরফজল আর শরবত খেতে হবে না!’
‘ধ্যুস! এর পর আবার শরবত।’
হাফ টাইম শেষ হল। খেলাও শুরু হল আবার। ফাইভ হয়ে গেল ওদের। আমরা আর মুখ তুলে তাকাতে পারছি না লজ্জায়। চেঁচাবার উদ্যমও ফুরিয়ে গিয়েছে।
এমন সময় দেখি আমাদের মগনলালবাবু আসছেন। সঙ্গে তাঁর সেই ফেরোশাস ভেড়িয়া— মানে ভেড়া। ওই ভেড়াটা লম্বায় হাত চারেক, গতরে মনখানেক তো হবেই। আর তার বেঁকানো পাকানো শিং যেন আরও ভয়ংকর। লোকে যেমন তার পোষা কুকুরের গলায় বকলস আর চেন বেঁধে বেড়াতে বেরোয়, মগনলালবাবু সেই ভাবে মোটা দড়ি দিয়ে তাঁর ভেড়ার গলাটি জুত করে বেঁধে নিয়ে বেড়াতে বেরোন মাঝেসাঝে। মগনবাবু এখানকার ফলপটির মালিক। তিনি দু’-তিনটি ভেড়িয়া পোষেন, আর এই ভেড়াদের নিয়ে আশেপাশে মায় কাতরসগড় পর্যন্ত ভেড়ার লড়াইয়ের কম্পিটিশানে লড়তে যান। তিনি বরাবরের ভেড়া-চ্যাম্পিয়ান।
পরনে চেক কাটা লুঙ্গি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, মুখ ভর্তি পান—মগনবাবু মাঠে এসে হাজির। ওঁর চেহারাটিও দশাসই।
মগনবাবু এসেই বদুদাকে ডাকলেন, ‘এ বদুয়া, রেজান (রেজাল্ট) কিয়া রে?’
বদুদা কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘পাঁচ গোল খেয়ে গিয়েছি।’
‘পাঁচ!… তো উতনা ভাবিস কাহে রে। আর ভি দো তিন মারতে দে।’
আট-ন’?
হাঁ হাঁ, মারতে দে।’
‘হেরে ভূত হয়ে যাব।’
‘কুছ হবে না। আমি এতনা বরফ পানি, শরবত ফালতু পিলাতে টাকা দিয়েছি! তুই ঘাবড়াস না। হামার টিম দশ মেরে দেবে। সবুর কর।’
ওদের সাত হয়ে গেল। কী লজ্জা।
মগনবাবু তার লড়ুইয়ে ভেড়িয়াকে যে দড়িতে বেঁধে এনেছিলেন, সেটি মোটা তো বটেই, তার ওপর লম্বার মাপও কম নয়। বিশ-ত্রিশ হাত তো হবেই। দড়িটি পাকিয়ে গোল করে তাঁর হাতে ধরা রয়েছে।
আটটা গোল যখন হতে যাচ্ছে মগনবাবু তাঁর ডেঞ্জারাস ভেড়াটিকে কানে মন্ত্র দিয়ে পিঠ থাপড়ে হঠাৎ বললেন, ‘এ দানাপুরিয়া বেটা, যা লাগ যা।’ বলে ভেড়াটিকে মাঠে ঠেলে দিলেন। অবশ্য দড়ির শেষ প্রান্তটি তাঁর হাতে।
দানাপুরিয়া ভেড়া তার মারাত্মক শিং নিয়ে ঘাড় নিচু করে মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
লালবাঁধ থমকে গেল। ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল প্লেয়ারগুলো।
রেফারি কদমকাকা বাঁশি বাজিয়ে খেলা থামিয়ে দিলেন।
মগনবাবুকে ডাকলেন কদমকাকা।
‘মগনবাবু, এটা কী! দিস ইজ ফুটবল, ভেড়ার লড়াই নয়। আপনি ভেড়া ছেড়ে দিচ্ছেন কেন মাঠে?
মগনলাল হাসলেন। ‘ভেড়িয়া তো ছুটে যায় কদমকাকা। দানাপুরি আছে না! ইজ্জত হুঁশ রাখে। বহুত তেজি!’
‘না। আপনি দড়ি সামলান। মাঠে আপনার ভেড়া ঢুকতে পারবে না।’
‘তো ঠিক আছে। আমি চুনা-দাগির পাশ মে থাকব।’
খেলা শুরু হল আবার।
কিন্তু মগনবাবু এমন ভাবে তার দানাপুরিকে লেলিয়ে দিতে লাগলেন পাশ থেকে যে, লালবাঁধের প্লেয়ারগুলো ভয়ে গুটিয়ে গেল। তাদের মনে হচ্ছিল—এই বুঝি ওই মারাত্মক ভেড়াটা ছুটে এসে তাদের গুঁতিয়ে শেষ করে দেবে।
বদুদার ক্লাব ফটাফট দুটো গোল শোধ করল।
লালবাঁধ দাঁড়িয়ে পড়ল।
বদুদার ক্লাব চারটে গোল মেরে দিল।
হে ভগবান, আর চারটে।
আমরা চেঁচাতে লাগলাম। ‘মার মার, আর চারটে মেরে দে। ল্যাংচাকে শেষ করে দে!’
শেষপর্যন্ত দেখা গেল, খেলা শেষ হওয়ার আগে আট আট হয়ে গিয়েছে।
মগনবাবু বললেন, ‘এ বদুয়া বরফপানি আর শরবত পিলা দে সবকে।’
কদমকাকা বললেন, ‘ব্যাপারটা ফেয়ার হল না।’
মগনবাবু বললেন, “আরে আমি থোড়াই মাগনায় এদের বরফপানি শরবত বাটব! তো ঠিক আছে, আউর একঠো ম্যাচ হয়ে যাবে কোই দিন।’
লালবাঁধের প্লেয়ার আর লোকজনরা চটেমটে বরফজল শরবত মুখে দিল না। তাদের লরি চেপে ফিরে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
মগনলালবাবু তাঁর ভেড়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, ‘আরে দানাপুরি, তোকে দেখেই ওরা ডর পেয়ে গেল রে! চল, ঘর যাই।’
ততক্ষণে বৃষ্টিও এসে গেল।
৩ জুন ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন