পৌলোমী সেনগুপ্ত
দু’ভাইয়ের খেলার মাঠের ঝগড়াটা শেষ পর্যন্ত বাড়ি অবধি এসে পৌঁছল। বড় রুকু গেট পেরিয়ে আগে-আগে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে ঢুকছে। পেছনে আসছে ছোট সুকু, বুক ফুলিয়ে। তার মুখে কোনও ভয় বা অপরাধের চিহ্নই নেই। সে বরং ঢোকার মুখে গেটের পাশের খাড়া ইউক্যালিপটাস গাছের তলা থেকে গোটাকতক ঝরাপাতা তুলে নিয়ে, হাতে রগড়ে নিজের নাকের কাছে ধরে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলল, “আঃ, কী সুন্দর গন্ধ! যাদের বারো মাসই সর্দি তাদের এই পাতা রোজ শোঁকা উচিত।”
কথাটা সে তার দাদাকে উদ্দেশ করেই বলল আর-একটু খেপাবার জন্যে। অন্য দিন হলে রুকু নিশ্চয় এর কোনও জবাব দিত। আজ কিছু বলল না। সে বেচারা ভাল করে হাঁটতেই পারছে না। সুন্দর একটা একতলা বাংলো বাড়ির দিকে তারা এগিয়ে চলেছে। দু’পাশে কেয়ারিকরা গোলাপের বাগান। বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে বসে মা মোজা বুনছেন একমনে। শীত এল বলে। ডাল্টনগঞ্জে শীতটা বেশ জমিয়ে পড়ে। এ বছর তিন জোড়া মোজাই তাঁকে বুনতে হবে। দু’ছেলের আর স্বামীর। রুকু আর সুকুর বাবা স্থানীয় মিশনারি হাসপাতালের নামকরা সার্জেন। স্থানীয় লোকেরা বলে, ডাক্তারবাবু মানুষ কেটে জোড়া লাগাতে পারেন। এমন হাত।
মার চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। সব সময় পরতে হয় না। এই বোনাটোনার সময়েই নাকে ওঠে। তখন যেন আরও সুন্দর দেখায়। সোনার মতো গায়ের রঙের সঙ্গে চশমার রং মিলে যায়। শুধু কাচ দুটো খাড়া টিকলো নাকের পাশে জ্বলজ্বল করতে থাকে। মানুষটি যেমন ভাল তেমনি কড়া। যোধপুরের মেয়ে। চেহারাটা অনেকটা রাজপুত মেয়েদের মতো।
রুকুকে ল্যাংচাতে দেখে রাজ্যেশ্বরী জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে রে তোর?”
রুকুটা ভীষণ ভালমানুষ। কী হয়েছে ঠিক ঠিক বলতে গেলে—সুকুর নামে বলতে হয়। রুকু তাই কোনও কথা না বলে সিড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে এল। পেছনেই সুকু। উত্তরটা সেই দিল—আমি ওকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছি মা। এই হল সুকুর স্বভাব। তার কাছে কোনও লুকোচুরি নেই। যা করে তা বলে। এই তো সেদিন হাতের আঙুলে গোলমতো মোটা একটা লাঠি খাড়া করে শোবার ঘরে ব্যালেনসিং অভ্যাস করছিল। লাঠিটা হঠাৎ বেকায়দা হয়ে সোজা গিয়ে পড়ল দেরাজ-আয়নাটার ওপর সপাটে। ভেঙে চুরমার। রুকুও সে-ঘরে ছিল। বহুবার ভাইকে বারণ করেছে—‘‘ওরে সুকু, ওরকম করিসনি। একটু আগে আর একটু হলেই আমার মাথাটা ফাটত।” সুকু শশানেনি, বলেছিল, “বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সারাদিন বই পড়লেও ওরকম বিপদ একটু-আধটু হতেই পারে।” রুকু আর কিছু বলেনি। মাথায় আইসব্যাগের মতো একটা বালিশ চাপিয়ে সুকুর লাঠির হাত থেকে মাথা বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল!
কাচ ভাঙার ঝনঝন আওয়াজে মা যখন দৌড়ে এলেন, সুকু বললে, “সরি মা! অন্যায় হয়ে গেছে। লাঠিটা যে ওর ওপর পড়বে আমি বুঝতে পারিনি। বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়ে থাকলে ওরকম একটু হবেই।” রাজ্যেশ্বরী এমন ছেলেকে কী আর বলবেন। বাবা শুনে বলেছিলেন, “হ্যা, বাপকা বেটা…আমিও ছেলেবেলায় ওর মতোই ছিলাম, সাহসী, বেপরোয়া, সত্যবাদী। এই তো চাই।”
সেই দিনই ফকরু মিঞা বিকেলের দিকে এসে দেরাজের আয়নাটা নতুন করে লাগিয়ে দিয়ে গেল।
রাজ্যেশ্বরী বোনাটা কোলের ওপর ফেলে দিয়ে বললেন, “তুই দাদাকে ল্যাং মারলি কেন? এখন পা মচকে এই যে বিছানায় পড়ে থাকবে কে দেখবে?”
সুকু ভালমানুষের মতো মুখ করে বললে, “আমার অভ্যাস, মা। কী করব বলো?”
“ল্যাং মারাটা তোর অভ্যাস? বলিস কী রে? তুই খেলতে গেছিস না ল্যাং মারতে গেছিস।”
“তুমি জানো না মা, আমাদের গেম ইনস্ট্রাক্টর মিস্টার বেঞ্জামিন বলেছেন, ভাল ফুটবলার হতে হলে ভাল ল্যাং মারা শিখতে হবে। টুক করে এমন কায়দায় পা-টা চালাবে যেন সার্জেনের ছুরি। রেফারি ধরতে পারবে না, এমনকী যাকে মারলে সেও বুঝতে পারবে না। বল-ফল ছেড়ে চিতপাত হয়ে পড়ল, তুমি মেরে-মেরে বেরিয়ে গেলে। সেই কায়দাটাই মা দাদাকে দেখিয়েছি।”
রুকু আর চুপ করে থাকতে পারল না। আর-একটা খালি বেতের চেয়ারে বসে ডান পা-টা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তুই একটা কাওয়ার্ড। ব্যাকে খেলার তোর কোনও যোগ্যতাই নেই, তুই যেই দেখলি আমি কাটিয়ে গোললাইনে ঢুকে পড়েছি, সিয়োর গোল, পেছন থেকে সট করে ল্যাং মেরে দিলি। একে খেলা বলে না সুকু, একে বলে গুন্ডামি।”
“কী বললি? কাওয়ার্ড? সুকু কাওয়ার্ড! তুই খেলার খও জানিস না। থলথলে ভুড়ি নিয়ে হোঁতকা হোঁদলকুতকুতের মতো ওই স্পিডে দৌড়লে ল্যাং মারতেই ইচ্ছে করে। আমি কাওয়ার্ড নই, ক্র্যাফটি।”
রাজ্যেশ্বরী উঠে দাঁড়ালেন। রুকুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “বাঃ সুকু। তোমার ল্যাঙ্গোয়েজের খুব উন্নতি হয়েছে দেখছি। দাদাকে হোঁতকা বলছ, হোঁদলকুতকুত বলছ।”
রাজ্যেশ্বরী রুকুর পায়ের কাছে উবু হয়ে বসলেন।
সুকু বললে, “এসব কথা তুমি সেদিন আমাকে যে বাংলা বইটা উপহার দিলে সেই বইটা থেকে শিখেছি। বইটার পাতায়-পাতায় যেসব ছবি আছে তার মধ্যে দাদার ছবিও আছে। সেখানে এই গল্পটাও আছে মা—হোঁদলকুতকুতের বাবার আলকাতরার ব্যবসা ছিল। হোঁদল ঘামত আর তার বাবা টিনে ধরে ধরে বিক্রি করত।”
“বইটা তোমাকে দিয়ে খুব ভুল করেছি বাবা। ভেবেছিলুম বাংলা শিখবে, এখন দেখছি কতকগুলো বাজে অ্যাডজেকটিভ শিখে বসে আছ।”
বাইরে গাড়ি দাঁড়াবার শব্দ হল। বাবা ফিরলেন হাসপাতাল থেকে। সামনে আসছে ডাক্তারি ব্যাগ হাতে সুখন। পেছন পেছন আসছেন ডাক্তার মুখার্জি। লম্বা চওড়া সুপুরুষ মানুষ। মুখে সবসময় একটা হাসি লেগে আছে। বারান্দার কাছে এসে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, “বাড়ির খবর? আরে বড়টা দেখছি মানুষ হয়েছে। চেয়ারে বসতে শিখেছে?”
রুকু বললে, “গুড ইভনিং ফাদার!”
“গুড ইভনিং বয়। কী হয়েছে তোমার পায়ে?”
উত্তর দিলেন রাজ্যেশ্বরী, “সুকুর গুন্ডামির ভিকটিম। গোলের মুখে সুকু পেছন থেকে ল্যাং মেরে দিয়েছে।”
“ফাউল হয়নি?”
এবার উত্তর দিল রুকু, ‘কী করে ফাউল হবে বাবা! ও তো বলেইছে, বাবা যেভাবে হাতে ছুরি চালায়, ও সেইভাবে পায়ে ল্যাং চালায়।”
ডাক্তার মুখার্জি হো হো করে হেসে উঠলেন, “বেড়ে বলেছে তো। তা তুই কীভাবে পড়লি।”
“হাত পা দুমড়ে মুচড়ে ধপাস করে পড়ে গেলুম। আর ও বলটা ক্লিয়ার করে দিল।”
“দেখি সরো, ও তুমি বুঝতে পারবে না, আমার কাজ আমাকে করতে দাও।”
ডাক্তার মুখার্জি ছেলের মাকে সরিয়ে নিজেই উবু হয়ে বসলেন, “বেশ ফুলে উঠেছে রে। না, ভাঙেনি, মচকে গিয়েছে। ক’দিন একটু ভোগাবে। ও খেলতে গেলে একটু-আধটু হবেই, চিয়ার আপ মাই বয়। একটু গুলার্ড লোশন লাগাতে হবে।”
রাজ্যেশ্বরী দেবী বললেন, “কাল থেকে তোমাদের দু’জনের ফুটবল খেলা চিরদিনের জন্যে বন্ধ।”
“ও, নোনো,” ডাক্তার প্রতিবাদ করে উঠলেন, “ও ব্যবস্থা ঠিক হল না, এক্সকিউজ মি, খেলবে, রোজ খেলবে, তবে আলাদা টিমে নয়, একই টিমে, তা হলে আর ল্যাং মারতে পারবে না।”
‘সুকুকে তুমি চেনো না, তা হলেও ঠিক ল্যাং মেরে দেবে। ও কী বলেছে জানো, কাউকে ছুটতে দেখলেই ওর নাকি ভীষণ ল্যাং মারতে ইচ্ছে করে। উনি নাকি ল্যাং স্পেশালিস্ট। হ্যা, তোমাকে কী বলছে জানো, হোঁদলকুতকুতের বাবা।”
সুকু তিরবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে এল, “না বাবা, আমি তোমাকে বলিনি, আমি দাদাকে কেবল হোঁদলকুতকুত বলেছি।”
“তা হলে দাদার বাবা কী হল?” রাজ্যেশ্বরী প্রশ্নটা রেখে ঘরে ঢুকে গেলেন।
সুকু আধহাত জিভ কেটে মাথায় দু’ হাত চেপে ধরে বললে, “আমি ভেবে বলিনি বাবা।” তারপর দৌড়ে গিয়ে দু’ হাতে বাবার কোমর জড়িয়ে ধরে বললে, “বাবা, আমায় ক্ষমা করো।”
ডাক্তার মুখার্জি হাত দিয়ে ছেলের মাথার নরম চুল এলোমেলো করতে-করতে বললেন, “পাগল ছেলে, একটা কথা জেনে রাখো, একজনের আনন্দ কখনও যেন আর-একজনের দুঃখের কারণ না হয়। খেলা মানে মারামারি নয়। দ্যাখো তো, দাদা এখন ক’দিন ভাল করে আর হাঁটতে পারবে না।”
সুকুর মুখটা হঠাৎ করুণ হয়ে গেল। দাদার সামনে গিয়ে বললে, “তুই ওভাবে পড়ে যাবি, আমি বুঝতে পারিনি রে দাদা। নে, আমার কাঁধে ভর দিয়ে ভেতরে চল।”
রুকুর একটা হাত সুকুর কাঁধে, সুকুর একটা হাত রুকুর কোমরে। দুই ভাই ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকছে। ডাক্তার মনে মনে বললেন, ঈশ্বর আমি কত ভাগ্যবান!
পড়াশোনার পর রাতের খাওয়া-দাওয়া। খাবার ঘরে লম্বা টেবিলে ধবধবে সাদা টেবিলক্লথ, ঝকঝকে সাদা চিনেমাটির প্লেট, কাঁটা চামচ। বাবুর্চি নিজামত একে-একে গরম-গরম সব খাবার এনে সাজিয়ে রাখছে। ডাক্তার মুখার্জির মুখে তখনও পাইপ। অল্প অল্প ধোঁয়া ছাড়ছেন। অন্য দিন রুকু আর সুকুর সারাক্ষণ বকবকানি চলে। আজ দু’জনেই চুপ। চুপ রুকুই। সুকু সন্ধে থেকে দাদার সঙ্গে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। রুকু তেমন সাড়াশব্দ করেনি। হুঁ হাঁ করে ছেড়ে দিচ্ছে। সুকু নিজের থেকেই গুলার্ড লোশন দিয়ে দাদার পায়ের পটি দু’বার ভিজিয়ে দিয়েছে। তাও রুকু ভীষণ গম্ভীর।
সুকু তো বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না। সে বাবার সঙ্গেই নানা রকম কথা শুরু করেছে। যতক্ষণ খাওয়া চলল ততক্ষণই সুকু কাঠবেড়ালি সম্পর্কে হাজার রকম প্রশ্নে বাবার প্রাণ বের করে দিল। কাঠবেড়ালিকে ওরকম দেখতে কেন? ডিম হয় না বাচ্চা হয়? অত চটপটে কেন? পিড়িক পিড়িক করে ডাকবার সময় ন্যাজটা ওঠানামা করে কেন? কোথায় বাসা করে? বাসাটা দেখতে কেমন?
রাজ্যেশ্বরী চামচে দিয়ে পুডিং কাটতে কাটতে বললেন, “আজ মাথায় কাঠবেড়ালি ঢুকেছে। কাল ঢুকেছিল টিয়া, সেটা উড়ে গেছে।”
খাবার টেবিল থেকে কাঠবেড়ালি বসার ঘর পর্যন্ত এলেও সেতার আর গানে চাপা পড়ে গেল। শুতে যাবার আগে এ বাড়ির এইটাই নিয়ম। রেকর্ড প্লেয়ারে ঘণ্টাখানেক বাছা-বাছা রেকর্ড চলবে। কোনও দিন গান, কোনও দিন যন্ত্রসংগীত। ডাল্টনগঞ্জে আকাশ ছেয়ে রাত ঘন হচ্ছে। তারাদের জ্যোতি বাড়ছে। মিষ্টি হাওয়ায় ইউক্যালিপটাসের গন্ধ ভাসছে। গানের সুরে, চার্চের ঘণ্টার আওয়াজে, রাতজাগা পাখির ডাকে পাহাড়ের গা বেয়ে, বনস্থলীর মধ্যে দিয়ে ঘুম আসছে স্বপ্ন নিয়ে।
দু’ভাই একই ঘরে দু’দিকে দুটো খাটে শোয়। অন্য দিন শুয়ে শুয়ে ঘুম না আসা পর্যন্ত দু’জনে বকর-বকর করে। সুকুই শুরু করে। কখনও পড়ার কথা, কখনও খেলার কথা, কখনও বইয়ে পড়া কোনও অ্যাডভেঞ্চারের কথা। ইয়োরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকার সব পথ-ঘাট-পাহাড়-পর্বত-বন-জঙ্গল সুকুর ভীষণ চেনা। মশারির মধ্যে ঢুকে বালিশে মাথা রেখে সুকু বললে, “জানিস দাদা, আমাদের বাগানের পুবদিকে বাদাম গাছের তলায় কাঠবেড়ালির বাসা হয়েছে রে। কাল সকালে তোকে দেখাব।”
রুকু কোনও জবাব দিল না।
সুকু বললে, “এখনও কোনও বাচ্চা হয়নি রে। আমি গর্তের মধ্যে এতখানি হাত পুরে দিয়েও কিছু দেখতে পেলুম না। খালি একগাদা বাদাম পেলুম।”
অন্য দিন হলে রুকু ভাইকে সাবধান করে দিত, “যেদিন সাপে কামড়াবে সেদিন তোর সাহস বেরিয়ে যাবে।” আজ কিন্তু কিছুই বলল না। চুপ করে পাশ ফিরে শুয়ে রইল।
সুকু মশারি তুলে বেরিয়ে এল। রুকুর মশারির মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে একটা হাত দাদার কপালে রেখে জিজ্ঞেস করল, “তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস না কেন রে দাদা? রাগ হয়েছে?”
রুকু আবার বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারে না। তার ফেরানো মুখ থেকেই উত্তর এল, “হুঁ।”
“রেগে গেলি কেন?”
রুকু বললে, “তুই সবসময় বন্ধুদের সামনে। আমাকে ল্যাং মারবি, মোটা বলবি, অপদস্থ করবি। কেন আমি কি তোর ভাই নই।”
সুকু একটু চুপ করে ভাবল। তারপর বললে, “আমি তো কাউকে ছাড়ি না, আমি সবাইকেই তো ওরকম করি।”
“তারপর তুই সেদিন কোন ফাঁকে চুলে চুইংগাম আটকে দিয়েছিলি। আমি টের পাইনি। তিনদিন পরে মা চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেখতে পেয়ে কাঁচি দিয়ে এক খাবলা চুল কেটে দিলেন। জানিস আমার কোঁকড়া চুল। কিছু ঢুকে থাকলে দেখা যায় না। সেই থেকে মাথার মাঝখানে একটা টাক হয়ে আছে।”
“চুইংগামের শেষটা যে চুলে আটকাতেই ইচ্ছে করে রে দাদা। আমি তো দাদার চুলেই আটকেছি রে, দাদা কি কারও পর। তুইই বল।”
“হ্যাঁ, এর পর তুই আমার মুখে চুনকালি মাখিয়েও ওই একই কথা বলবি—আমার দাদার মুখেই তো মাখিয়েছি! এখন তুই কেমন স্কুলে যাবি, খেলার মাঠে যাবি, আর আমি বাড়িতে ঠ্যাং তুলে শুয়ে থাকব, কত দিন কে জানে!”
সুকু মাথাটা বের করে নিয়ে মশারিটা গুঁজে দিল। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ঘরের বাইরে।
সুকু বেরিয়ে যেতেই রুকু বিছানায় উঠে বসল। ওই পা নিয়ে তার আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না, তা না হলে সে সুকুর পিছু নিত।
কিছুক্ষণ পরেই সুকুর গলা পাওয়া গেল, “মা, বাবাকে ডাকো।”
তারপর রুকুর কানে এল মা আর বাবা দু’জনেরই গলা। মা বলছেন, “ইস, কী ভীষণ রক্ত বেরোচ্ছে রে।”
বাবা বলছেন, “একদম উতলা হবে না, আমাকে দেখতে দাও। আজকের দিনটাই খারাপ। তুমি বরং ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ তৈরি করে। একটা এ টি এস দিতে হবে।”
রুকু খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এল। বাথরুমের সামনে সুকু। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা থেঁতলে গিয়ে রক্ত পড়ছে। সুকু সোজা দাঁড়িয়ে আছে। সারা মুখে দুষ্টু-দুষ্টু একটা হাসি।
বহু দিন চলে গেছে। রুকু আর সুকু এখন কত বড়! শুধু বড় নয়, নামী মানুষ, প্রতিষ্ঠিত মানুষ। রুকু থাকে মাদ্রাজে, মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার। সুকু বিশাল বড় ডাক্তার, থাকে দিল্লিতে। যেখানেই থাকুক বছরে একবারে শীতকালে ডিসেম্বর মাসে দু’ ভাই এসে মেলে ডাল্টনগঞ্জে তাদের জন্মস্থানে, ছেলেবেলার সেই বাংলো বাড়িতে। বাড়িটাকে তারা খুব যত্নে রেখেছে। রং, পালিশ, ফার্নিচার, বিছানা, সাজানো বাগান সব সেই আগের মতো আছে। একজন কেয়ারটেকার আছেন। নেই কেবল বাবা আর মা। দুটো বিশাল ছবি ঝুলছে বসার ঘরের দেয়ালে।
সন্ধের মুখে সবাই বসেছে বসার ঘরে। রুকুবাবু, সুকুবাবু, তাদের স্ত্রী, ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা। প্ল্যান হচ্ছে, আগামিকাল দু’খানা ঝকঝকে নতুন গাড়ি নিয়ে তারা জঙ্গলে যাবে শিকারে। সুকুর ডান পা-টা বাঁ পায়ের ওপর তোলা। বুড়ো আঙুলের নখটা একটু গুটিয়ে পাকিয়ে আছে। রুকুর সেদিকে নজর পড়তে বলল, “সুকু, তুই তো এত বড় ডাক্তার, আমার হাতের পোড়া দাগটা ভাল করে দিলি, তোর পায়ের নখটাকে মেরামত করতে পারলি না?”
সুকুর চেয়ারের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে দু’ হাত দিয়ে গলা জড়িয়েছিল রুকুর বড় মেয়ে। সে জিজ্ঞেস করল, “কাকামণি, আঙুলটায় কী হয়েছিল তোমার?”
“শোধবোধ করেছিলাম রে, মা।”
“সে আবার কী?”
রুকু বললে, “শোন তা হলে। তখন আমরা তোদের মতো ছোট। ওই যে সেদিন আমাদের স্কুলটা তাদের দেখালুম, সেই স্কুলের মাঠে হচ্ছে ফুটবল খেলা। গোলের মুখে বল নিয়ে কোনওরকমে ঢুকছি, তোদের কাকামণি পেছন দিক থেকে বলটা কেড়ে নিতে গেল। ছেলেবেলায় আমি একটু মোটাসোটা থলথলে ছিলুম। পড়ে গেলুম ধড়াস করে। ব্যাস। পা মচকে কুপোকাত। এইবার আমার পাগলা ভাইয়ের কেরামতি শোন। তিনি করলেন রাত দশটার সময় আমার পা মচকে দেবার প্রায়শ্চিত্ত—সোজা বাথরুমে ঢুকে জলভর্তি একটা বালতি দু’ হাতে করে ওপরে তুলে পায়ের আঙুলটা তার নীচে রেখে, দিল ছেড়ে। দু’জনেই পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে পড়ে রইলুম বিছানায় দিন পনেরো। এইরকম ভাই হয় না রে।”
সুকু বললে, “এরকম দাদাও কি কারুর হয়?”
রুকু বললে, “তার আগে বলো, কত ভাগ্য করলে তবেই না ওরকম বাবা মা পাওয়া যায়! কত জন্মের তপস্যা।”
সুকু বললে, “মনে আছে দাদা, বাবা সেই চেয়ারটায় ঠিক তুই যে ভাবে বসে আছিস সেই ভাবে বসে থাকতেন। তোকে অনেকটা বাবার মতো দেখতে হয়েছে।”
রুকু ধরাধরা গলায় বলল, “আর ওই চেয়ারটায় বসতেন মা। কী সুন্দর দেখতে ছিলেন।”
কারুর মুখে আর কোনও কথা নেই। সেই একই ঠান্ডা হাওয়া পাহাড় ভেঙে, বনপথ পেরিয়ে, রাতজাগা পাখির ডাক নিয়ে ভেসে আসছে। সেই ঘর, সেই চেয়ার, সেই পড়ার টেবিল, সেই বাথরুম, সব, সব, ঠিক যেমন ছিল তেমনই আছে।
কেবল রুকু আর সুকু বড় হয়ে গেছে।
মে ১৯৭৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন