পৌলোমী সেনগুপ্ত
মহাভারতে নেই
ভারত-যুদ্ধে পিঁপড়ে! সে আবার কী?
শুনে হাসি পাচ্ছে তো? কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না! কাঠবিড়ালিরাও যেমন কাজে লেগেছিল, ভারত-যুদ্ধে মানে কুরুক্ষেত্রের সেই মহাযুদ্ধে পিঁপড়েদের সেইরকম কোনও মদত ছিল বলে মনে হচ্ছে হয়তো।
না, সরাসরি ভারত-যুদ্ধে পিঁপড়েদের কোনও পার্ট ছিল বলে জানা নেই।
তবে, যাক বলেই ফেলা যাক —পিঁপড়েদের—না, বহুবচনটা ভুল, আসলে—একটি ক্ষণজন্মা পিঁপড়ে তার কেরামতিটুকু না দেখালে ভারত-যুদ্ধের প্রামাণিক ইতিহাসে ওই পাঁচ লহমার ফাঁক মানে ফাঁকিটুকু থাকত না।
ক্ষণজন্মা পিঁপড়ে! তার কেরামতিতে ভারত-যুদ্ধের ইতিহাসে ফাঁক?
কেরামতিটা কী?
তা বোঝাবার জন্যে গোড়া থেকে শুরু করা উচিত। একেবারে বাহাত্তর নম্বরের সেই দোতলার আড্ডাঘরে বত্রিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে শুরু এক রবিবারের গুমোট সকালবেলায়।
কাগজে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে— সারাদিন ভ্যাপসা গরম, বিকালে বজ্রবিদ্যুৎসহ প্রচুর বৃষ্টির সম্ভাবনা।
কাগজে তো হপ্তাভর রোজই ওই ভাওতা দিচ্ছে। কিন্তু সব ভরসাই ফরসা। না আকাশ, না টঙের ঘর থেকে এক ছিটেফোঁটা বর্ষণের লক্ষণ পাচ্ছি।
আকাশে কি টঙের ঘরে বজ্র-বিদ্যুৎ অবশ্য নেই। কিন্তু তাতেই তো আরও জ্বালা।
বজ্রবিদ্যুতের জায়গায় দু-বেলা কোকিলের বদলে দাঁড়কাক-গিলে-খাওয়া গলায় অমৃতসমান মহাভারতের কথা শুনছি।
কখনও—
গোপালের চরিত্র দেবের অগোচর।
অন্য কে কহিতে পারে ত্রৈলোক্য ভিতর॥
ব্রহ্মাণ্ড বলি যে এক চতুর্দশ লোকে।
বিরাট পুরুষ ধরে এক লোমকূপে॥
তিল অর্ধ কোটি সে ব্রহ্মাণ্ড ধরে গায়।
এমত বিরাট যার নিঃশ্বাসে প্রলয়॥
কখনও বা—
অশ্বত্থামা নামে হস্তীতার তুল্য অন্য নাস্তি
এমনি উত্তম গজবর।
বর্ণে তিনি জলধর, ঈর্ষা সম দন্ত সর
দেখিতে বড়ই ভয়ঙ্কর॥
তাহে আরোহণ করি, আসে কুরু অধিকারী
যথা আছে বীর বৃকোদর।
হাতে গদা ঘোরতর, রোষযুক্ত নৃপবর
ভীমসনে করিতে সমর ॥
গলাটি কার তা আর বলে দিতে হবে না নিশ্চয়।
হ্যাঁ, সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ তেতালার টঙের ঘরের তিনি কিছু দিন ধরে আর সব ছেড়ে মহাভারত ধরেছেন। আমরাও সেইসঙ্গে পথে বসেছি।
সময়ে অসময়ে তাঁর নিজস্ব ট্রেডমার্ক-মারা গলায় ওপর থেকে কাশীরাম দাসের পয়ার ভেসে আসে। সে পয়ারের ঢেউ ঠেলে কোনও রকমে যদি তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছই তিনি যেন মহাভারতের অমৃতরসে ডুবে আমাদের দেখতেই পান না।
তাঁর মতিগতি একটু ফেরাবার আশায় স্বস্ত্যয়নের উপচার জোগাতে আমরা কিছু ত্রুটি করিনি এ পর্যন্ত। কখনও আমিষ কখনও নিরামিষ, সাত্ত্বিক বা তামসিক বেশ কিছু আমাদের সমভিব্যাহারে গিয়েছে।
নৈবেদ্য সামনে ধরে দিয়ে আমরা একান্ত বশংবদ হয়ে এধারে ওধারে বসেছি। তার শূন্য দৃষ্টি দু’-একবার আমাদের দিকে ফিরলেও এ স্থূল বর্তমান ভেদ করে সেই সুদূর হস্তিনাপুরেই বোধহয় চলে গেছে। আমরা যে তাঁর গোচরীভূত তার কোনও প্রমাণ পাইনি।
শুধু দক্ষিণ হস্তটা তাঁর নিজের অজান্তেই প্লেটের প্রত্যক্ষ বর্তমানের ওপর প্রসারিত হয়েছে। অচেতনভাবেই মুখে গিয়ে পৌঁছেছে তারপর।
সেখানে যান্ত্রিক দন্ত নিষ্পেষণ চলতে চলতে হঠাৎ ক্ষণিকের জন্যে থামায় আমরা শশব্যস্ত হয়ে বলার সুযোগ পেয়েছি—কবিরাজিটা কি জুত হয়নি ঘনাদা ? একেবারে টাটকা ভাজিয়ে এনেছি কিন্তু!
ঘনাদার কর্ণকুহরেই বোধহয় কথাগুলো প্রবেশ করেনি। সাড়ে তিন হাজার বছর ছাড়িয়ে গিয়ে কৃষ্ণার্জুনের কাছে অগ্নিদেবের ক্ষিদের বায়নাই তিনি তখন শুনছেন।
হাসিয়া কহেন পার্থ, কহ বিচক্ষণ।
কোন ভক্ষ্য দিলে তৃপ্ত হইবা এক্ষণ॥
আমি অগ্নি, বলি দিয়া নিজ পরিচয়।
আশ্বাস পাইয়া বলে অগ্নি মহাশয়॥
ব্যাধিযুক্ত বহুকাল আমার শরীর।
নিব্যাধি করহ মোরে পার্থ মহাবীর॥
খাণ্ডব বনেতে বহু জীবের আলয়।
সেই বন ভক্ষ্য মোরে কর ধনঞ্জয়॥
উদর পুরিয়া খাই এই অভিরুচি।
কোনও পশুপক্ষী মৎস্যে নাহিক অরুচি॥
অগ্নিদেবের ক্ষিদের আবদার শোনাতে শোনাতে খাণ্ডব বনের অভাবে সামনে ধরে দেওয়া প্লেটগুলো ঘনাদা চেটেপুটে সাবাড় করেছেন। আমাদের উপস্থিতি টের পাবার কোনও লক্ষণই কিন্তু দেখা যায়নি।
মনে মনে গজরাতে গজরাতে নীচে নেমে এসেছি সবাই। আর তারপরই ঘনাদাকে কাত করবার এই নতুন মতলব ভাজা হয়েছে।
ফন্দিটা বিষে বিষক্ষয়, মানে যাকে বলে অটোভ্যাক্সিন। যা দিয়ে আমাদের জ্বালাচ্ছেন তাই দিয়ে ঘনাদাকে জব্দ করা। অর্থাৎ তাঁর ওপরই মহাভারত চাপানো।
সকাল থেকেই আমাদের তর্কটা শুরু হয়েছে। ঘন্টার কাঁটা ছ’টা থেকে সাতটার দিকে যত এগিয়েছে আমাদের গলা ধাপে ধাপে তত চড়ে তেতালার টঙ পর্যন্ত পৌঁছেছে নিশ্চয়।
এক দিকে শিবু আর আমি, অন্য দিকে গৌর আর শিশির।
তর্ক তো নয় যেন দ্বিতীয় কুরুক্ষেত্র।
ছ’টা একত্রিশে শিবুর হাঁক ন্যাড়া সিঁড়িটা বোধহয় পেরিয়ে গেছে—আলবাত হারত পাণ্ডবেরা।
কখখনো না।—শিশিরের প্রতিবাদ খোলা ছাদ পর্যন্ত নিশ্চয়।
কচুকাটা হত তা হলে!—আমি গলাটা টঙের ঘরে পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পেরেছি বোধহয়।
ওপরে ঘনাদার সুরেলা মহাভারত শোলোক আওড়ানো হঠাৎ যেন থেমেছে। এই ‘জিরো আওয়ার’ বুঝে নিজেদের গলার পেছনে আমরাও এবার ন্যাড়া সিঁড়ি বেয়ে টঙের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি। পেছন দিকে তাকিয়ে খাবারের ট্রে সমেত বনোয়ারি ঠিক হিসেব মতে হাজির হবার জন্য তৈরি কিনা দেখে নিতে ভুলিনি।
তারপর টঙের ঘরে গিয়ে দোতালার তর্কট একেবারে যেন তপ্ত খোলা থেকে নামিয়ে দিয়েছি ঘনাদার সামনে।
গৌর প্রায় বিধানসভার মেজাজ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ঘনাদার কাছে স্পিকারের রুলিং চেয়েছে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে—শুনেছেন শুনেছেন এদের কথা! বলে পাণ্ডবরা নাকি গোহারান হারত কুরুক্ষেত্রে!
হারতই তো—শিবু তাল ঠুকেছে ঘনাদার তক্তপোশটাই চাপড়ে—দুর্যোধন অমন গবেট না হলে তুলোধোনা হত পাণ্ডবেরা।
তুলোধোনা হত পাণ্ডবেরা!—শিশির আর গৌর যেন অর্জুনের গাণ্ডীব আর ভীমের গদা-ই হাতে নিয়ে হুংকার দিয়েছে—কে তুলোধোনা করত, কে? দুর্যোধনের নিরানব্বইয়ের বদলে আরও ন’শো নিরানব্বইটা ভাই থাকলেও, তাতে কুলোত না।
দুর্যোধনের ভাইয়েদের আবার ডাকা কেন?— আমি গলায় একেবারে লঙ্কাবাটা মাখিয়ে বলেছি, তাদের মাঠে নামবার দরকারই হত না। গ্যালারিতে বসেই তারা ফাইনাল দেখতে পেত। দেখত কর্ণ— হ্যাঁ একা সূতপুত্র কর্ণ কেমন করে কুরুক্ষেত্রের কাঁকুরে মাটিতে পাঁচ ভাই পাণ্ডবের নাকগুলো ঘষে দেয়। নেহাত দুর্যোধন নিজের আহাম্মকিতে রেফারিকেই খচিয়ে দিলে তাই।
কথাগুলো বলতে বলতে আড়চোখে ঘনাদার দিকে অবশ্য নজর রেখেছি। এত পাঁয়তাড়া যে জন্যে কষা সে মতলব একটু হাসিল হচ্ছে কি?
কোথায়?
ঘনাদা তাঁর কাশীরাম দাসের বিরাট গন্ধমাদনটি সামনে খুলে ধরে শোলোক আওড়ানো থামিয়েছেন বটে, কিন্তু নিজে যেন তাঁর এই টঙের ঘরেই আর নেই। দেহটা শুধু ফেলে রেখে কুরুক্ষেত্রেই বুঝি চরতে গেছেন।
তা গেছেন যান। ফিরতে যাতে হয়, তার জন্য নারাচ, নালিক, পাশুপত থেকে ব্রহ্মাস্ত্র পর্যন্ত সবরকম অস্ত্রের ব্যবস্থা না করে আজ আমরা আসিনি।
দু’-এক সেকেন্ডের ফাঁক যা পড়েছিল রেফারি কথাটার খেই ধরে তা ঢেকে গৌর খিঁচিয়ে উঠল— রেফারি! রেফারি আবার কে?
রেফারি কে জানো না। সঙ্গে সঙ্গে শিবুর টিটকিরি আর আমার নব মহাভারত পাঠ শুরু।
শিশির আর গৌরের দিকে চেয়ে কানমলা দেওয়া গলায় বললাম, মহাভারতটাও পড়িসনি! শোন তা হলে
মহাভারতের কথা কী কহিব আর।
কী হলে যে কী হইত অন্ত পাওয়া ভার॥
দুর্যোধন দুর্ভাগার মতিচ্ছন্ন হইল।
পদতল ছাড়িয়া বুদ্ধু শিয়রে বসিল॥
তাই না চটে চতুর কৃষ্ণ গাড়োয়ান হইয়া।
পাণ্ডু বয়েজ টিমকে দিলেন ম্যাচটা জিতাইয়া॥
চালের ভুলে রুষ্ট যদি না হতেন রেফারি।
কুরুক্ষেত্রে যায় কুরুরা পেনাল্টিতে হারি?॥
ঘনাদার দিকে চোখ রেখেই পদগুলো আওড়াচ্ছিলাম, কিন্তু শুভলক্ষণ কিছু দেখলাম না। ঠিক কুরুক্ষেত্রে না থাকলেও এখনও হস্তিনাপুর ছেড়ে তিনি আসতে প্রস্তুত নন মনে হল।
ঠিক ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিটে বনোয়ারি তখন ঘরে ঢুকে ঘনাদার সামনে খাস্তার কচুরি আর অমৃতির প্লেট দুটো ট্রে থেকে নামিয়ে রাখছে।
ঘনাদার মুখের ভাব দেখে মনে হল এবারে তাঁর হস্তিনাপুরের প্রবাস থেকেই তিনি আনমনে সে প্লেটে হাত বাড়াতে দেরি করবেন না।
ব্রহ্মাস্ত্রটা চটপট তাই প্রয়োগ করতে হল এবার।
ঘনাদার লুব্ধ হাত প্লেটে এসে পৌঁছবার আগেই দু’দিক থেকে গৌর ও শিবু চক্ষের নিমেষে দুটি প্লেট তুলে নিয়ে বনোয়ারিকে ধমকে উঠল—কী হচ্ছে কী এসব! যখন-তখন খাবার দিলেই হল! এখন এসব কে আনতে বলেছে!
বনোয়ারি অভিনেতা নয়। আগে থাকতে অনেক শেখানো পড়ানো সত্ত্বেও গৌর শিবুর ধমক খেয়ে সে সব ভুলে তোতলা হয়ে গিয়ে দু’বার শুধু ‘হামি হা…মি… তো’ গোছের কিছু একটা উচ্চারণ করল। আমাদের মতলব হাসিলের পক্ষে তাই কিন্তু যথেষ্ট।
ঘনাদার মুখের চেহারাটা তখন সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার হস্তিনাপুর থেকে এক ঝটকায় উনিশশো পঁচাত্তরের বাহাত্তর নম্বরে এসে পড়ার জন্যেই বোধহয় বেশ একটু ভ্যাবাচাকা।
আর যাই হোক এরকম একটা অবস্থার কথা তিনি কল্পনা করতেই পারবেন না জেনে মতলবটা ভাঁজা হয়েছিল।
কচুরি অমৃতির প্লেট দুটো বনোয়ারির ট্রেতে তুলে তাকে চলে যাবার হুকুম দেওয়ার সঙ্গেই কাজ যা হবার হল।
ঘনাদা অবশ্য এইটুকুর মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়েছেন। সেই ভ্যাবাচাকা ভাবটা মুখ থেকে মুছে এতক্ষণে যেন আমাদের সম্বন্ধে সচেতন আর বনোয়ারির প্রতি করুণাময় হয়ে উঠলেন, আহা বেচারাকে মিছে কষ্ট দেওয়া কেন? আবার তো সেই আনতেই হবে ওকে!
ওগুলো রেখে যেতেই বলছেন! আমাদের গলায় একটু মৃদু প্রতিবাদের সুরই ফোটালাম—কিন্তু আমাদের জরুরি কথাগুলো…
কী তোমাদের জরুরি কথা বলো-না! ঘনাদা বনোয়ারির হাত থেকে পুরো ট্রেটা একরকম কেড়ে নামিয়ে নিলেন—এগুলোর তো আর গলা নেই যে গোলমাল করবে। বলে ফেলো কী তোমাদের জরুরি কথা!
ঘনাদার শেষ কথাগুলো মুখে ঠাসা কচুরি ভেদ করে একটু জড়ানো অবস্থাতেই বার হল। আবার পাছে মুখের গ্রাস ফসকে যায় এই ভয়ে তিনি তখন প্রায় দু হাতে কচুরি আর অমৃতি মুখে বোঝাই করছেন।
তা যা করেন করুন। আমরা এত দিনে তাঁকে বাগে পেয়েই খুশি। বেশ একটু জমিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, জরুরি কথাটা কী, তা এখনও বোঝেননি? শুনুন-না ওই আহাম্মকদের কথা। বলে কিনা পাণ্ডবরা কিছুতে হারত না!
আহাম্মকেরা মানে শিশির গৌর। তারাও ঠিক সিনারিও মাফিক ঝাঁপিয়ে উঠল, কখখনো হারত না, কিছুতেই হারত না।
শুনলেন? শুনলেন তো! একটা জমজমাট বৈঠকের আশায় জ্বলজ্বলে চোখে ঘনাদার দিকে তাকালাম—এই ওদের মহাভারতের বিদ্যের দৌড়। কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডবদের জিত নাকি হতই! আপনিই বলুন তো ঘনাদা!
ওই উসকানিটুকু দিয়েই আমরা চুপ। ঘনাদার বাঁধানো দাঁতে মচমচে অমৃতি চিবোনোর শব্দ ছাড়া ঘরে আর আওয়াজ নেই। যে খেইটা জুগিয়ে দেওয়া গেছে তা থেকে কী গুলগল্পর গালিচা ঘনাদা বুনে তোলেন তা দেখবার জন্যে আমরা একেবারে উদ্গ্রীব।
কিন্তু ঘনাদা অমন করে শোধ নেবেন তা কি জানি! শোধ তাঁর মুখের খাবার সরিয়ে নিয়ে তাঁকে দাগা দেবার।
গালচের আশা একেবারে খঞ্চেপোশে কুঁকড়ে দিয়ে ঘনাদা যেন মর্স কোডে জানালেন, তাই!
তাই! কী তাই? আমরা যেমন হতাশ তেমনি অস্থির।—পাণ্ডবদের জিত হতই বলতে চান?
হাঁ! এবার ঘনাদার সংক্ষিপ্ত সরল জবাব।
দুর্যোধন যদি দলে টানতে গিয়ে ঘুমন্ত শ্রীকৃষ্ণের শিয়রে না বসে পায়ের দিকে বসত তবুও!—আমরা শেষ আশায় যেটুকু সাধ্য চাগাড় দিলাম।
যদি কেন, পায়ের দিকেই তো বসেছিল দুর্যোধন! ঘনাদা এতক্ষণে বোমাটি ছাড়লেন।
পায়ের দিকেই বসেছিল দুর্যোধন? চোখগুলো যতটা পারি ছানাবড়া করে বললাম, কিন্তু মহাভারতের কোথাও তো নেই! পায়ের বদলে মাথার দিকেই দুর্যোধন বসেছিল বলে তো লেখা আছে।
লেখা যা আছে তাও ঠিক!
তাও ঠিক? ঘনাদার ধাঁধায় এবার একটু কাবু হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম—পায়ের দিক মাথার দিক হয় কী করে?
হবার কারণ অতি সোজা! ঘনাদার মুখে যেন একটু অনুকম্পার হাসি, শ্রীকৃষ্ণ ঘুমের মধ্যে উলটে শুয়েছিলেন বলেই পায়ের দিকটা মাথার দিক হয়ে গিয়েছিল।
ঘুমের মধ্যে উলটে শুয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ? এবার আর আমাদের অবাক হবার ভান করতে হল না।
হ্যাঁ, উলটে শুয়েছিলেন। ব্যাখ্যা করলেন ঘনাদা, দুর্যোধন বোকা যেমন নয়, তেমনি গড়িমসি আলসেমিও তাঁর ধাতে নই। অর্জুন রথে ঘোড়া জুতে রওনা হতে-না-হতেই দুর্যোধন শ্রীকৃষ্ণের শিবিরে এসে হাজির। বাসুদেব ঘুমোচ্ছেন শুনে সে শোবার ঘরেই গেল অপেক্ষা করতে। ঘরে ঢুকেই সে কিন্তু একটু ফাঁপরে পড়ল। ঘুমন্ত বাসুদেবের মাথার দিকে যেমন পায়ের দিকেও তেমনি একটি করে আসন পাতা। এখন কোথায় তার বসা উচিত। ভেবে চিন্তে শেষ পর্যন্ত সে পায়ের দিকেই বসল।
শ্রীকৃষ্ণ এবার পড়লেন মুশকিলে। তাঁর তো কপট নিদ্রা। যা ভেবেছিলেন দুর্যোধন তার উল্টোটা করেছে জেনে, আর কোনও উপায় না পেয়ে নিজেও তিনি ঘুমের মধ্যেই যেন স্বপ্নে উঠে পড়ার ভান করে উলটে শুলেন।
দুর্যোধন আহাম্মক নয় কিন্তু অহংকারী। শ্রীকৃষ্ণকে ঘুমের মধ্যে উলটে শুতে দেখে তার দেমাকে একটু সুড়সুড়িই লাগল। ভাবল, বাসুদেবের ঘুমের মধ্যেও তার মতো রাজাগজাকে পায়ের দিকে রাখতে বাধছে। এই দম্ভেই হল তার মরণ। নইলে মাথা থেকে আবার পায়ে গিয়ে বসতে পারত না!
কিন্তু? আমরা সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এসব কথা মহাভারত থেকে সরালে কে? সেই আপনার ভীমসেন দারুক আর বন-বরা মার্কা মূষিক কোম্পানি?
না। ঘনাদা বনোয়ারির সদ্য এনে হাজির করা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে একটু হাসলেন, এ বৃত্তান্ত সরাবার দরকার হয়নি, কারণ লেখাই হয়নি মহাভারতে।
লেখাই হয়নি। আমরা সত্যিই তাজ্জব—কেন?
কেন জানতে চাও? ঘনাদা শিশিরের ধরিয়ে দেওয়া সিগারেটে রামটান দিয়ে তার ধোঁয়ার সঙ্গেই চোখ বুজে যেন ধ্যানস্থ হয়ে গেলেন।
এ ধ্যান কি ভাঙবে?
আমরা গরুড়পক্ষী হয়ে তার দিকে চেয়ে আছি।
ধ্যান শেষ পর্যন্ত ভাঙল আর চক্ষু উন্মীলন করে সামনের দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে তিনি ত্রিকালদৃষ্টির যে নমুনা দেখালেন তাতে আমরা হাঁ।
কেন লেখা হয়নি তা, সামনের ফাঁকা দেয়ালটার দিকে সিগারেট-ধরা আঙুল দুটোই উঁচিয়ে তিনি বললেন, ওই ওর তস্য তস্য আদি সপ্তশত সঙ্ঘভ্রাতা হয়তো বলতে পারত!
মাথাগুলো তখন ঘুরতে শুরু করেছে। ঘোরার আর অপরাধ কী? সঙঘ ভ্রাতা, তস্য তস্য, আদি সপ্তশত—এসব কী বলছেন ঘনাদা! আর বলছেন কিনা ওই সেদিনের চুনকাম-করা সাদা দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে।
ওখানে ওসব বলে সম্বোধন করছেন কাকে?
যাকে করছেন অনেক কষ্টে তাকে আবিষ্কার করা গেল এর পর। আবিষ্কার যা করলাম চক্ষু তাতে চড়কগাছ। ঘনাদার দিকে ফিরে হতভম্ব হয়েই তাই বলতে হল, ওখানে তো একটা শুধু সুড়সুড়ে পিঁপড়েই দেখছি!
হ্যাঁ, ওই। ঘনাদা ধ্যান নিমীলিত হয়েই বললেন।
হ্যাঁ, ওই। সুড়সুড়ে পিঁপড়ে। ওরই কি বললেন, তস্য তস্য সার্ধতিনসহস্র-আদি…
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঘনাদা আমাদের থামিয়ে দিয়ে জ্ঞান দিলেন। ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, কুরুক্ষেত্রের ভারত-যুদ্ধের আগে পরে যা যা হয়েছে দিব্যদৃষ্টিতে সবই ব্যাসদেবের জানা। তিনি রেখে ঢেকে কিছু বলবার মানুষ নন আর যত ঝড়ের বেগেই বলুন গণেশ ঠাকুরের শর্টহ্যান্ডে তা ধরা না পড়েই পারে না। তবু যে মহাভারত থেকে ওই মোক্ষম খবরটুকু বাদ পড়েছে তার মূল হল ওই সুড়সুড়ে পিঁপড়ে। ও মানে, ওরই সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার তস্য তস্য কোনও বাসাতুতু ভাই। পরমায়ু ওদের চার থেকে সাত বছরের বেশি নয় বলে গড়পড়তা হিসেবে আদি সপ্তশত সঙঘ-ভ্রাতা বলছি। কথায় কথায় বুকের মধ্যে যিনি বিশ্বরূপ দেখান, বিশ্বচরাচর যাঁর রেফারিগিরিতে চলে সেই চতুর চুড়ামণি শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মান বাঁচাতে ওই সামান্য পিঁপড়েটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। পিঁপড়ে তো নয়, ও আদি কীটাবতার, একাই পৃথিবীর প্রথম পঞ্চমবাহিনী।
ঘনাদা থামলেন। আমাদের ধরা গলায় আর টুঁ শব্দটিও নেই দেখে ঘনাদা শেষ জ্ঞানটুকুও দিলেন।
দুনিয়া যাঁর নখের টেলিভিশনে, কোথায় কী হচ্ছে তা তো আর তাঁর জানতে বাকি থাকে না। দ্বারকায় বসেই তিনি টের পেলেন ব্যাসদেব তাঁর কপট নিদ্রার বৃত্তান্ত এবার বলতে শুরু করছেন। গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন ব্যাসদেব, সড়সড় করে কলম চলছে গণেশ ঠাকুরের, এমন সময় লেখার চৌকির ওপরই গড়িয়ে রাখা গণেশ ঠাকুরের শুঁড়টা সুড়সুড়িয়ে উঠল। অনেক চেষ্টা করেও সামলাতে পারলেন না গণেশ ঠাকুর। দুর্দান্ত একটি হ্যাঁচ্চোতে পুঁথির পাতা উড়ল, কলমও থামল কটি পলকের জন্যে। আবার যখন চলল ব্যাসদেবের ডিক্টেশন, তখন কেষ্টঠাকুরের কারসাজি পার হয়ে গেছে।
জুন ১৯৭৫
অলংকরণ: সুধীর মৈত্র
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন