২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে আমি তখন জাগে, সেই আমিটা কে?

আঠারো ঘায়ের এক ঘা। কীসের ওপর দাঁড়িয়ে দিদি গলায় ফাঁস আটকেছিল? এই সন্দেহ তুলে দারোগামশাই জোরে জোরে সিগারেট টানতে লাগলেন। ওটা নাকি একটা ইম্পর্টান্ট পয়েন্ট। একটা টুল, একটা চেয়ার, যা হয় একটা উঁচু কিছু থাকা উচিত ছিল ঘরে। নেই কেন?

সিগারেটের ধোঁয়ায় পাক মারছে দারোগামশাইয়ের প্রশ্ন।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে আপনি কী সন্দেহ করছেন?

সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরোটা মেঝেতে ফেলে দিয়ে, ঠোঁট ছুঁচোলো করে ধোয়া ছেড়ে অফিসার বললেন, বিশ্রী রকমের একটা সন্দেহ। ইট মে বি এ কেস অফ মার্ডার। আগে মেরেছে তারপর ঝুলিয়েছে।

কে মেরেছে? কাকাবাবুর প্রশ্ন।

সেটা তো আপনারাই বলবেন।

কেন, পোস্টমর্টেম বলতে পারবে না?

তা অবশ্য পারবে। অপেক্ষা করে বসে থাকতে হবে। সেই সন্ধে পর্যন্ত। জটটা আমাদেরই ছাড়ানো উচিত, তা হলে আর ইনভেস্টিগেশন কী হল! ভাবছি আর একবার যাই ঘটনাস্থলে।

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, সেই পাঁচ! পুলিশি প্যাঁচ মারছেন! ভুলে গেলেন আমাদের সম্পর্ক!

দারোগামশাই ফিক করে হেসে বললেন, আইনের সঙ্গে মানুষের একটাই সম্পর্ক, বিচার অথবা অবিচার? আমি যদি অবিচার করি, পাঁচজনে বলবে ব্যাটা ঘুষখোর! পাঁচ হাজার পকেটে পুরে, নিজে খেয়ে অন্যকে খাইয়ে, খুনকে আত্মহত্যা বলে চালাচ্ছে। পাবলিকও কিছু অন্যায় করবে না, এইরকমই তো হচ্ছে আজকাল। আর এ পাড়ার পাবলিক তো একজন, মেনি মুখার্জি। এই এল বলে, মুখে জরদা-পান ঠুসে!

কাকাবাবু বললেন, আর বলতে হবে না, একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তবে পাঁচ হাজার পারব না, দেড় হাজার। দেড় একটা ভাল সংখ্যা। সবসময় এককে ঘিরে থাকবেন। একে চন্দ্র! আমি আমার ভাইপোকে বলছি, এখুনি নিয়ে আসছে।

আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। ধরেছেন ঠিক। যে-দেবতার যে-নৈবেদ্য! দেড় খুবই কম। কেস তো সিরিয়াস! অনেককেই খিলাতে-পিলাতে হবে। যাই হোক আপনাকে কী আর বলব! আপনি গুণী মানুষ!

কাকাবাবু থানার বাইরে এসে আমাকে খুব আস্তে আস্তে বললেন, বাড়িতে ক্যাশ কিছু আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, হাজার পাঁচেক আছে।

যাও একটা খামে ভরে দেড় নিয়ে এসো। যেমন কর্ম তেমন ফল। এবার তোমার একটু সাবধান হবার সময় এসেছে। আর ওই মেয়েটির খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসো। ও তোমার জীবনের রাহু, গ্রাস করে বসে আছে। সংসার তোমার হবে না বাপু। একমাত্র সন্ন্যাস, সন্ন্যাসই তোমার পথ। গতানুগতিক জীবন তোমার নয়। তোমার কোষ্ঠী আমার মুখস্থ। যাও টাকাটা তুমি নিয়ে এসো। দারোগাকে ততক্ষণ আমি একটু মালিশ করি।

বাড়ির সামনে থেকে ভিড় সরে গেলেও, মেনিদা ঠিক ঘুরঘুর করছেন। চোখ-মুখ যেন পুরুষ্টু লাল একটি লঙ্কার মতো। চনমন চনমন করছেন। মানুষের সর্বনাশে মহা উল্লসিত! আমি যখন চাকরি পেলুম, মেনিদা তখন বিষ্টুদার দোকানে চা খেতে খেতে বলেছিলেন, চাকরি পেলে কী হবে, মাইনে পাবে না। এ পাড়ায় কেউ পরীক্ষা দিলে মেনিদা তার জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন, কী হে। তোমার রেজাল্ট কবে বেরোবে! কেউ পাশ করেছে শুনলে ভীষণ দুঃখ পান। কারও অসুখ করেছে শুনলে, দু’বেলা দেখতে ছোটেন! পরিবার পরিজনকে নানাভাবে ভয় পাইয়ে দিয়ে আসেন। ইদানীং এক ভণ্ডামি ধরেছেন, ভোরবেলা একটা খঞ্জনি হাতে নগর-পরিক্রমায় বেরোন। খাই খাঁচা শব্দে আর মিনমিনে গলার মিলনে সে এক অপূর্ব মহানাম। ভালভাবে উচ্চারণ করারও ক্ষমতা নেই। হরে। কৃষ্ণ, হরে রাম হয়ে দাঁড়ায়, হচে কৃষ্ণ, হচে রাম। ঈশ্বরের কী মহিমা! হরে উচ্চারণ করলে যে উদ্ধার পেয়ে যাবেন। নাকের ওপর পাউডারের তিলক-সেবা। পাউডার আর সাবু একসঙ্গে ফেটিয়ে ওই শিল্পকর্মটি করেন। এক রাউন্ড মেরে এসেই তেলেভাজার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। গনগনে উনুন। কড়ায় টইটম্বুর তেল। গোল গোল ফুলুরি সাঁতার কাটছে। সামনে মেনিদা আর ভোলা ষাঁড়। দোকানির নাম নিত্যানন্দ। মেনিদা তেল মারছেন, নিত্যানন্দ প্রেম বিলোতে। এসেছিলেন। তুমি এসেছ ভক্তজনকে প্রেমসে তেলেভাজা বিলোতে। নিত্যানন্দ প্রথমে ষাঁড়কে একটি বেগুনি খাওয়াবে, পরে মেনিদাকে দুটি ফুলুরি শালপাতায় মুড়ে দেবে। সেটিকে কপালে ঠেকিয়ে মেনিদা মিনমিনে গলায় বলবেন, জয় রাধে!

আমাকে দেখে মেনিদা এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, স্কোয়ার আপ স্কোয়ার আপ। সব শত্রুতা ভুলে যাও। জানবে, ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল। শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে মহামতি গোখলে অগ্নিযুগে আমাদের বলেছিলেন। আমরা তখন দেশের স্বাধীনতার জন্যে আলুপটলের মতো প্রাণ দিচ্ছি। সংসার টংসার সব চুলোয় গেছে। টেগার্টকে টার্গেট করে আমরা তখন ছাতা মাথায় ঘুরছি। জামার পকেটে রিভলভার। গলায় গুলির মালা। শ্রীরঙ্গমে যাই। এক এক দিন এক এক মেকআপ। লালবাজারের সামনে ঘুরি। কাওয়ার্ড। সায়েব ভয়ে আর বেরোয় না। এর নাম ইংরেজের বাচ্চা! সাহস থাকে বুক পেতে দে রিভলভারের সামনে। আমরাও ছদ্মবেশে, সে ব্যাটাও। ছদ্মবেশে। একদিন দেখি বোরখা পরে বেরিয়ে আসছে। ধরেছিলুম ঠিকই, ভেরিফাই করতে গিয়ে পালাল। ভেরিফাই করতে গেলুম কেন জানো, ক্ষুদিরামের কে যেন না হয়ে যায়– বড়লাটকে। মারতে গিয়ে মারলাম ইংলন্ডবাসী। সত্যিই যদি মুসলমান রমণী হয় তা হলে তো কম্যুনাল রায়ট বেধে যাবে! বিপ্লবের পথ বড় কঠিন পথ! তা ওই মেয়েমানুষটি কে?

গা আমার জ্বলে যাচ্ছিল। ভদ্রলোক আমার পিতার ভাষায় ক্রিস্টালাইজড ইডিয়েট। তবু ভদ্রতার খাতিরে উত্তর দিতে হল, এই তো আপনিই বললেন, বোরখা-পরা টেগার্ট।

আরে ধুর! মেনিদা কাকতাড়ুয়ার মতো নেচে উঠলেন, আরে আমি অতীত থেকে বর্তমানে চলে এসেছি, গলায় দড়িটা কে? তোমাদের বাড়িতে তো আগে দেখিনি কখনও।

জানার খুব প্রয়োজন?

বাঃ জানতে হবে না। বাইবেলে আছে, লিভ ফর আদার্স। অন্যের জন্যে বাঁচো। বি এ গুড সামারিটান। তুমি তো জানো আমি অক্ষরে অক্ষরে সেই নির্দেশ পালন করি। নিজের ঘরসংসার তো ছেড়েই দিয়েছি। জনহিতকর কাজে সারাদিন ঘুরছি। আর মনে মনে বলছি, তোমার পকাতা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শতকি।

কানে খট করে লাগল, এ আবার কী? পকাতা? শতকি?

বলে পারলুম না, পকাতা শতকি মানে?

মেনিদা খাত খ্যাত করে হেসে বললেন, একে বলে ম্যালাপ্রপিজম। রোগটা ইংরেজদেরই হয় তবে আমারও তো সাদা চামড়া। ক’জন বাঙালির এমন গায়ের রং ছিল বলো! এখন একটু পুড়ে। গেছে পৃথিবীর শোকে-তাপে। তোমার বউদি তো বাসরঘরে প্রথম প্রশ্নটাই করেছিল ইংরেজিতে হোয়াটস দ্যা টাইম নাও। বোককা মেয়ে, বোককা মেয়ে, ভেবেছিল পাঞ্জাবি পরা সায়েব! ওটা হবে পকাতা। না না পকাতা নয়, পতাকা, শতকি নয় শকতি। আরে লাইনটা তো তুমি বহুবার শুনেছ, তোমার পকাতা, না দাঁড়াও, ধরে ধরে বলি, তোমার পতাকা…।

আমার ভয়ংকর তাড়া! পরে শুনব।

আমারও অনেক কাজ; তবে কী জানো, বিপ্লবী ছিলুম তো, তাই নিজের স্বার্থে দিয়া বলি পরের স্বার্থে ছুটি। এখন আবার মহাপ্রভু ঘাড় ধরেছেন। নিজের কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। নাম প্রচার। ঘুমন্ত মানুষের কানে ঢেলে দাও মধুর হরি নাম। উঃ, গায়ে কাঁটা দেয়। মহাপ্রভু স্বপ্ন দিলেন, ওরে যা, তাপিত আর্তজনে নাম বিতরণ কর। আর ঘুমায়ো না মন। মায়াঘরে কত দিন আর রবে অচেতন। কে তুমি কী হেতু এলে, আপনারে ভুলে গেলে। দেখো রে নয়ন মেলে অরুণ তপন। নিজেকে ভুলে যেয়ো না পিন্টু। সব আন্ডিল বান্ডিল বেঁধে প্রভুর শ্রীচরণে নিবেদন করে দাও। বাই এনি চান্স, তোমার কাছে গোটাদশেক টাকা হবে? জানোই তো আমার দিন চলে মাধুকরী করে।

এক টাকা আছে।

ঠিক আছে, নাইন শর্ট। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। আলু কিনে বাড়ি যাই; কিন্তু মেয়েমানুষটি কে ছিল? সাক্ষাৎ বৈষ্ণবী। ওই নাক, ওই কপাল। রসকলি করলে রস যা জমত! হঠাৎ আত্মহত্যা করল কেন? গর্ভবতী হয়েছিল নাকি?

আবার আমার মনে হল, সেদিনের মতো মারি এক থাপ্পড়। লোকটা যেন বজ্জাতের জিলিপি। নিজেকে যথেষ্ট সংযত করে বাড়িতে ঢুলুম। গোটা বাড়ির পরিবেশ থমকে গেছে। মৃত্যুর গন্ধ। সিঁড়ির প্রথম ধাপে মুকু বসে আছে। গালে হাত। কাজের মেয়েটি বলছে, একেই ভূতের বাড়ি, আরও একটা ভূত বেড়ে গেল। রাতের বেলা সব থাকবে কী করে! আমার তো এখনই গা ছমছম করছে। পুজোটুজো দাও। তোমাদের বাড়িতে গ্রহ লেগে গেছে।

মুকুর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করল না। পাশ দিয়ে সোজা উঠে এলুম ওপরে। দেড় হাজার টাকা নিয়ে এখনই আমাকে থানায় ছুটতে হবে। আলমারিতে কাপড়ের ভাঁজে আমার ব্যাগ আছে। সেই ব্যাগে আছে টাকা। আলমারি খুলে যথাস্থানে হাত বাড়াতেই ব্যাগটা পেয়ে গেলুম। চামড়ার ব্যাগ। সোনালি মনোগ্রাম, এইচ এস। হরিশঙ্কর। ব্যাগটার একটা ইতিহাস আছে। আমার জ্যাঠামশাই কোনও এক কালে আমার পিতাকে উপহার দিয়েছিলেন। তিনি আবার উপহার দিয়েছিলেন আমাকে। কারণ তার ব্যাগের কোনও প্রয়োজন হত না। তিনি টাকা রাখতেন খামে। সোনার হাতঘড়ি খাপেই থাকত। কখনও হাতঘড়ি পরতেন না, কারণ বিলাসিতা।

ব্যাগটা খুলেই চক্ষু স্থির। একটাও টাকা নেই। সব হাওয়া। পাগলের মতো আলমারি হাঁটকাতে লাগলুম। নিমেষে সব ওলটপালট। আমার স্পষ্ট মনে আছে ব্যাগে আমার সব জমানো টাকা অত্যন্ত সাবধানে রেখেছিলুম। আলমারির চাবি খোলা কেন? খোলা থাকার তো কথা নয়। অদ্ভুত একটা শূন্যতা নেমে এল। সব ঝিমঝিম করছে। আমার নিজেরই আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হচ্ছে।

আলমারির সমস্ত মাল মেঝেতে ছড়িয়ে ফেলেছি। কোথায় কী? টাকার নামগন্ধ নেই। মুকু এল গম্ভীর মুখে। বিমর্ষ গলায় প্রশ্ন করল, কী খুঁজছ অমন লন্ডভন্ড করে?

আমার টাকা। এই ব্যাগে আমার পাঁচ হাজার টাকা ছিল। ব্যাগ খালি।

তার মানে?

তার মানে ব্যাগে টাকা নেই। আলমারি যদুর জানি চাবি দেওয়া ছিল, এখন দেখছি চাবি খোলা।

মুকু মেঝেতে বসে পড়ে বললে, আমি তখনই জানতুম, চিল যখন পড়েছে কুটো না নিয়ে উড়বে না।

আলমারির তালা ভেঙে টাকা নিয়ে হাওয়া।

কী হবে এখন? থানায় যে দেড় হাজার টাকা দিতে হবে!

আমার কাছে ঠিক দেড় হাজার টাকাই আছে, নিয়ে যাও। দিয়ে এসো খেসারত।

নীচে নেমে এলুম। কাজের মেয়েটি বললে, দেখুন তো এটা কোনও দরকারি কাগজ কি?

এক টুকরো কাগজ। একটা ক্যাশমেমোর পেছন দিক। পরিষ্কার লেখা, পিন্টু, চলে যাওয়াই ভাল। তবে পৃথিবীর কোথাও নয়, একেবারে পৃথিবীর বাইরে। যে-হারটা নিয়ে এত সমস্যা, সেটা আমারই। আমার মামার বাড়ির বহুমূল্য চন্দ্রহার। আমার দিদিমা গোপনে আমাকেই দিয়ে গিয়েছিলেন। এতকাল বুকে করে আগলে রেখেছিলুম। শেষ পর্যন্ত পেরেছি। গগন ওইটার সন্ধানেই এসেছিল। ময়দার তালের মধ্যে ঢুকিয়ে গগনকে বোকা বানিয়েছিলুম। আর যাই হোক আমি চোর নই। পিন্টু, ওই হারটা তোমার বিয়ের সময় মুকুর গলায় পরিয়ে দিয়ে। তোমার হতভাগিনী গরিব দিদির উপহার। আমাকে মনে রেখো না। আমার জন্যে দুঃখ কোরো না। পৃথিবীতে আমরা এইভাবেই আসি, যাই। তোমার দিদি।

স্বার্থপরতার কী খোলতাই রূপ! কোথায় অসহায় এক মহিলার প্রতি অবিচারের জন্যে মর্মাহত হব, তা না, মনে হল হাতে স্বর্গ পেয়েছি। এই তো সেই আত্মহত্যার চিঠি। অপূর্ব ওই হারটার জন্যে মনে লোভও জেগেছিল। এখন সেইটা বুঝতে পারছি, যাক পুলিশের হেফাজত থেকে হারটা আমাদের হাতে এসে যাবে এই এক চিঠির জোরে। তিরবেগে থানার দিকে দৌড়োলুম। যেতে যেতে ভাবলুম, দেড় হাজার টাকাও তত বাঁচানো যায়। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ হাজারের শোক ভুলে গেলুম।

কাকাবাবু আর দারোগাসায়েব কেউই অফিসঘরে নেই। সেকেন্ড অফিসার বললেন, দুজনেই কোয়ার্টারে। যান না, চলে যান। পাশের গলিতে ঢুকলেই দোতলার সিঁড়ি।

বারান্দায় বসে আছেন দু’জনে মুখোমুখি। কাকাবাবুর হাতে সেই পরিচিত লেন। দরজার সামনে এক রাগী চেহারার ভদ্রমহিলা। দারোগাবাবুর স্ত্রী। মাঝে মাঝেই স্বামী সম্পর্কে একটা-দুটো মন্তব্য ছুড়ছেন। প্রথম যেটা কানে এল তার ভাবার্থ, গাধারাও নাকি ওই ভদ্রলোকটির চেয়ে বুদ্ধিমান।

কাকাবাবুর কানে কানে বললুম, একটা চিঠি পেয়েছি।

চিঠিটা তার হাতে দিলুম। টেবিলের আড়ালে কোলের ওপর রেখে দ্রুত পড়ে নিলেন।

কানে কানেই বললুম, আর টাকা দেওয়ার প্রয়োজন আছে? হারটাও চেয়ে নিন।

কাকাবাবু চিঠিটা এগিয়ে দিলেন অফিসারের দিকে। দিয়ে বললেন, কেসটা মনে হয় একটু সহজ হল। এটা হত্যা নয়, আত্মহত্যাই। আর হারটাও আমাদের সম্পত্তি।

দারোগাবাবু চিঠিটা পড়লেন ভুরু কুঁচকে। তারপর একটা প্যাঁচ মারলেন, দিদি কে? নাম কোথায়? সবাই তো দিদি। কোন দিদি? এই চিঠিটা তো ম্যানুফ্যাকচার্ড হতে পারে!

কাকাবাবু বললেন, হাতের লেখা মেলান।

হাতের লেখা পাব কোথায়? বেশ বললেন যা হোক!

আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। বললুম, পুঁটলিতে একটা পকেট গীতা আছে। তার মধ্যে। হাতের লেখা থাকতে পারে।

দারোগাসায়েব হেসে বললেন, অশান্তি করে লাভ কী? কেস তো ফয়সালা হয়েই গেছে। তবে হারটা আমাদের কাস্টডিতেই থাকবে। ওটার জন্যে সেপারেট ইনভেস্টিগেশন। অমন একটা মূল্যবান জিনিস এমন একজন রেচেড মহিলার অধিকারে আসে কী করে? একটা সাধারণ সাদামাটা হার হলে কিছু বলার ছিল না। তা ছাড়া এর পেছনে আর একটা আনোন লোকের কানেকশন আছে। দেখতে হবে কোনও থানায় কোনও কেস জমা পড়ছে কি না? উই আর টু ওয়েট। আমাদের একটা রেসপন্সিবিলিটি আছে। নিন আমার স্ত্রীর হাতটায় ঝপ করে একবার চোখ বুলিয়ে নিন।

কাকাবাবু বললেন, টাকাটা কি তা হলে দেওয়ার প্রয়োজন আছে?

অবশ্যই আছে। খরচ নেই? কত খরচ! গলায় দড়ি কি যে-সে জিনিস মশাই? ক’টা গলায় দড়ি দেখেছেন?

কাকাবাবু আমার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটা চালান করে দিলেন স্ত্রীর হাতে। যেমন দ্যাবা তেমনি দেবী। তিনি যেন কপ করে মিড অনে একটা ক্যাচ ধরলেন। মুকুর দেড় হাজার আউট হয়ে গেল। ওই টাকাটা এখুনি আমাকে যেমন করেই হোক জোগাড় করে মুকুকে ফিরিয়ে দিতে হবে। একমাত্র উপায়, ব্যাঙ্কে চলে যাওয়া।

দারোগাসায়েব আমাকে জানালেন, আপনি এখন আসতে পারেন, আমাদের একটু অ্যাস্ট্রলজি হবে।

কাকাবাবু আমাকে ইশারায় জানালেন, সরে পড়ো। ফিরে এলুম স্বগৃহে। মুকু ভীষণ ভেঙে পড়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে, চিরকুটে কী লেখা ছিল?

আর জেনে কী হবে?

আমার ওপর রাগ করেছ? তোমাদের ব্যাপারে নাক গলিয়েছি বলে? রাগ করিনি মুকু।

আমার ভীষণ অভিমান হয়েছে একজনের ওপর, তিনি হলেন আমার পিতা। তিনি যদি আমাকে পরিত্যাগই করবেন ভেবেছিলেন, তা হলে সেই শৈশবেই ফুটপাথে বসিয়ে দিয়ে এলেই পারতেন! জীবনটা ভিখিরি হয়েই শুরু করতুম। তার নিজের অতীতটাও কেন আমার ঘাড়ে চাপিয়ে গেলেন। আমার অতীত আমিই তৈরি করে নিতুম। এই বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে আমার। কোনও ভবিষ্যৎ তৈরি হবে।

মুকু ছলছলে চোখে বললে, তোমার ভবিষ্যৎ থেকে আমি নিজেই সরে দাঁড়াতে চাই। মনে হয় । আমি একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলছি।

দিদি আমাদের একটা জবরদস্ত আঘাত দিয়ে গেলেন। ওই হারটা চোরাই নয়। ওটা দিদিরই। হার। গগনের গ্রাস থেকে বাঁচাবার জন্যে ময়দার তালের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। চিরকুটে সব লিখে দিয়ে গেছেন। চিরকুটে আছে, হারটা আমি মুকুকে দিয়ে গেলুম, বিয়ের উপহার। সেই হার এখন পুলিশের গ্রাসে। আমাদেরই পাকামোর ফল। নিজেকে সবজান্তা ভাবা উচিত নয়। সবসময় ইনটিউশন কাজে লাগে না। অহংকার বেড়ে যায়। মাঝখান থেকে কপর্দকশূন্য হয়ে গেলুম। পাঁচ-পাঁচ হাজার টাকা হাওয়া হয়ে গেল। তোমার কাছে ধার হয়ে গেল দেড় হাজার। তা ছাড়া এই আশ্রয়টুকুও গেল। এ বাড়িতে থাকব কেমন করে? কেবলই মনে পড়ে যাবে একটা মৃতদেহ ঝুলছে। কেবলই শুনতে পাব পায়ের শব্দ, একটা গলার আওয়াজ। ওপরে উঠে আসার সময় তিনি আমাকে করুণ গলায় বলেছিলেন, পিন্টু, আমি তো তোমার আশ্রয়ে এসেছিলুম। বড় বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে। গেছে মুকু। নিজেকে দৈবশক্তির অধিকারী ভাবলে এই হয়! ঠাস করে গালে এক চড় মেরে ভগবান উচিত শিক্ষা দিয়ে যান!

মুকু আমার হাতদুটো ধরে বললে, ক্ষমা করে দাও। আজই আমি চলে যাচ্ছি।

ভীষণ রাগ হয়ে গেল। রণে ভঙ্গ দেওয়াটাই সহজ কাজ। বললুম, তা তো যাবেই। সব লন্ডভন্ড। করে দিয়ে চলে যাওয়াটাই সহজ কাজ, বুদ্ধিমানের কাজ। এক মুহূর্তও সময় লাগে না। তোমার যা মন চায় তাই করো, আমি এখন ব্যাঙ্কে যাই। এ বাড়িতে তো আর হাঁড়ি চাপবে না। কাগজপত্র নিয়ে নেমে এলুম পথে। গলগলে রাস্তা রোদে ভাসছে। সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে চোখে প্রশ্ন নিয়ে। রাষ্ট্র হতে আর বাকি নেই। মাননীয় হরিশঙ্কর। ততোধিক মাননীয় তার পিতা। ঊনবিংশ শতকের নামী এক শিক্ষাবিদ। সুপণ্ডিত। সুলেখক। সাধকোপম এক চরিত্র। সেই বাড়িতে বিধবা রমণীর আত্মহত্যা! সেই বাড়িতে পুলিশ! আমার মনে হচ্ছে মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাঁটি। একটা মানুষ নয়, পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে মানুষের একটা খোলস। মন না মতিভ্রম! কবিতা আর রোমান্টিক উপন্যাস পড়ে প্রেমিক হতে চেয়েছিলে জানোয়ার! শ্রীরাধার সন্ধানে কলির কেষ্ট! রাসলীলা হচ্ছিল। এইবার তুমি মরো। তোমার মানসম্মান পথের ধুলোয় লুটোতে লুটোতে যাক। এ তো বিবস্ত্র হয়ে যাবার মতোই একটা ঘটনা।

ব্যাঙ্কের কাউন্টারে গিয়ে চেক জমা দিয়ে হাতে একটা টোকেন নিয়ে ঘিজিমিজি ভিড়ে বেঞ্চের একপাশে সরে এসে বসে আছি জড়োসড়ো হয়ে। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। সারারাত ঘুম নেই। দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা। ডাক পড়ল। চেক ফিরে এসেছে। সই মেলেনি। আবার সই করুন। চেকটা হাতে নিয়ে একপাশে সরে এসে ভাবছি, জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে কী সই ছিল, পুরো নাম, না ইনিশিয়াল! একা একা এই আমার প্রথম টাকা তোলা।

পাশে এক মহিলা এসে দাঁড়ালেন। প্রথমে গ্রাহ্য করিনি। হাতের ওপর ফরসা একটা হাত এসে পড়ল। অবাক কাণ্ড, মুকু। তুমি! তুমি এলে কী করে?

সাইকেল রিকশা করে। বাড়ি চলল। তোমার টাকা পাওয়া গেছে। তুলতে হবে না।

কোথায় ছিল?

আস্তে! আস্তে কথা বলো। চলো, বলছি।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন