১.৬৩ I could give all to time

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

I could give all to time, except what I
myself have held.

তম্বুরাটি বেশ মনের মতো বাঁধা হয়েছে। মাতামহ ঠিক যেমনটি চান। মাতুল হারমোনিয়মে ছোট ছোট তান ছাড়ছেন, ঠুংরির মুখ মোচড় মেরে মেরে উঠছে। আমার কাঁধে তানপুরা। সামনে পাশাপাশি বসেছেন মাতামহ আর পিতৃদেব। সন্ধে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। এইমাত্র চা হল। এইবার আসর বসবে। কারুর মনেই তেমন সুখ নেই। সকলেরই মন বলছে, কিছু একটা ঘটবে। কী ঘটতে পারে জানা নেই। আজ অক্ষয় কাকাবাবু এলে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান দেখে বলতে পারতেন, কার ভাগ্যে কী নাচছে! মাতুলের একটু রেওয়াজের প্রয়োজন। আগামীকাল তিন তিনটে সিটিং এ আই আর-এ। সকালে খেয়াল। গাইবেন দেশি টোড়ি। সন্ধেবেলা গাইবেন ইমন। রাতে ঠুংরি!

মাতুল হারমোনিয়মে একটা সাপট তান মেরে সুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আহা, আজ যদি প্রফুল্লদা থাকতেন!

পিতা বললেন, আমার শরীরটা ঠিক থাকলে তোমার সঙ্গে সংগতে বসতে পারতুম। বুকটা এখনও ইনফ্লেমড হয়ে আছে।

মাতুল ঘাড় নিচু করে বার দুয়েক সুর ভেঁজেই গান ধরে ফেললেন। নিমেষে ঘরের আবহাওয়া পালটে গেল। শ্রোতারা স্তম্ভিত। এত বেলায় খাওয়া হয়েছে, তবু মাতুলের গলা অসাধারণ বলছে। ডি শার্পে গান ধরেছেন। তারায় গিয়ে যখন সুর টেনে দাঁড়িয়ে পড়ছেন ঘরের কাঁচের শার্সি চিনচিন করে উঠছে। পাশে-রাখা চায়ের খালি কাপডিশ উল্লাসে গলা মেলাচ্ছে। গানে বসলে মাতুলের চোখমুখ, হাবভাব একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়। পুরো ব্যক্তিত্বটাই একেবারে পালটে যায়। মনে। হতে থাকে বহু দূরের মানুষ। পৃথিবীর সব সম্পর্কের বাইরের এক সুরসাধক। মীড়, মূৰ্ছনা, গমক, চক্ৰধা তানে ইমনের রূপকল্পনা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।

মাতামহ যে-জায়গায় বসেছেন সেদিকে আলোর শেড একটা ছায়া ফেলেছে। তপ্তকাঞ্চনের মতো গাত্রবর্ণ, স্থির বসে থাকার ভঙ্গি, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, মহাদেব যেন গান শুনতে এসেছেন। চোখদুটি নিমীলিত। মুখে অসাধারণ এক তৃপ্তির ছোঁয়া লেগেছে। ছেলের মতো ছেলে হলে কোন পিতার না গর্ব হয়! আমিও যদি কিছু একটা হতে পারি, পুত্রগর্বে আমার পিতার বুক ভরে যাবে। আমার দ্বারা আর কী হওয়া সম্ভব? দরকচা মেরে গেছি।

মাতুল আমার হাতে কনুইয়ের খোঁচা মেরে ইশারায় বললেন, ধর, ধরে ফেল।

আমার গলা সি শার্পে, ডি-তে তুলি কী করে? মাতামহ চাপাস্বরে বললেন, ধর, ধর, ধরে ফেল। মাতুল ছোট্ট একটি তানের কাজ করে গানের মুখটি আমায় দিয়ে দিলেন। আর উপায় নেই। সময় সময় মানুষের ভেতরটা জেগে ওঠে। তখন অসম্ভবও সম্ভব হয়। দুর্বলও লোহার গরাদ বাঁকিয়ে ফেলতে পারে। আমারও তাই হল। সুর আমার পরিচিত। আরোহণ অবরোহণ বাদী সমবাদী জানা। গানের বাণী আমার কাছে তেমন স্পষ্ট নয়। উচ্চাঙ্গ সংগীতের বাণী অধিকাংশ সময়েই অস্পষ্ট। সুরের তলায় লুকিয়ে থাকে। কীভাবে জানি না মুখটাকে ঘুরিয়ে সমে ফেলে দিলুম। মাতুল বললেন, বহত আচ্ছা!

সুরকে কী কী ভাবে কত ভাবে যে মোচড়ানো যায়! কত বিচিত্র যে তার গতিপথ! প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল একই ইমন চলছে, তবু একঘেয়ে ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে না। লয় চলেছে ঘড়ির মতো। সুরে আর সময়ে টানাপোড়েন চলেছে। সুরের একটা আবরণী তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে সময় আর শ্রোতা স্তব্ধ।

শেষ চরণটি গেয়ে মাতুল গান ছাড়লেন। চোখ আধ-বোজা, ফরসা মুখে চাপা আলো খেলছে। ফিসফিস করে আমাকে বললেন, গান শেখ গান শেখ। বড় আনন্দ পাবি! কোথায় যে চলে যাবি!

ম্যাজিশিয়ানের দড়ির খেলার মতো সুর ওপরে উঠতে উঠতে তোকে অনন্তে নিয়ে যাবে। লেগে যা। ব্যাটা।

মাতামহ তৃপ্ত মুখে মৃদু মৃদু হাসছেন আর হাঁটুতে ধীরে ধীরে চাপড় মারছেন। পিতা বললেন, নিজের মেজাজের জন্যে তুমি একঘরে হয়ে রইলে। বাইরের জগতের সঙ্গে একটু যদি মানিয়ে চলতে শিখতে?

মাতুল হারমোনিয়মে সুর টিপে বললেন, গান আমি ফেরি করতে পারব না। এ আমার অহংকার নয়, আমার আদর্শ। এর জন্যে না খেয়ে মরতে হলেও আমি প্রস্তুত।

তুমি যে সংসার করে ফেলেছ জয়।

বাউলেরও তো সংসার থাকে। সেইভাবেই নেচে নেচে আকাশবৃত্তি করে বেড়াব।

মাতুল হঠাৎ প্রচণ্ড আবেগে গান ধরলেন। দেশ রাগে ঠুংরি। ধরামাত্রই বাতাসে একটা ব্যাপার ঘটে গেল। নির্বাপিত হোমকুণ্ডে আঘাত করলে চারপাশে যেমন স্ফুলিঙ্গ উড়তে থাকে, সেইরকম, কণা কণা সুর সারাঘরে লম্বা লম্বা আলপিনের মতো ছুটতে লাগল। মাতুল গাইছেন, সেঁইয়া করো তোরে শ্যাম। দেশ, একেবারে কান্নার রাগিণী। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দেয়। প্রথম লাইনটাই মাতুল কতভাবে গাইছেন!

সেঁইয়া করো তোরে শ্যাম
করত জিয়া বিমতি রাতি ।।
মানত নেহি মেরি বাতিয়া।
ক্যায়সে কাটডি দিন রাতিয়া ॥

এক একটি শব্দ যেন সুরের ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে। কোনওটা জানলা গলে উড়ে যাচ্ছে দূর তারাভরা আকাশের দিকে। কোনওটা লাট খেয়ে ফিরে আসছে। কী যে হচ্ছে, বলে বোঝানো যাবে না। ফিনফিনে সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি পরে মাতুল বসেছেন। অনামিকায় হিরের আংটি চিকমিক করছে। সিনেমা সব নিয়েছে, আংটিটা নিতে পারেনি। ঘাড়ের কাছে চুল নেমে কুঁকড়ে আছে।

সেদিন চিৎপুরে বড় মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্বজন্মের হঠাৎ যে অনুভূতি হয়েছিল, আজও যেন তাই হচ্ছে। ছায়াছায়া নির্জন রাস্তা ধরে জুড়িগাড়ি চেপে চলেছি। মধ্যরাতের নির্জন পাতাকাঁপানো বাতাস। ঘোড়ার গলার রুপোর ঘণ্টা বাজছে শৌখিন সুরে। দূর থেকে ভেসে আসছে বাইজির গলা। কাফি সিন্ধুতে দাদরা ধরেছে। তবলার লগগি চলেছে। কতকাল আগের সেই নেশার রাত আজ আবার ফিরে এসেছে। গোলাপি বেনারসির আবরণে সুঠাম শরীর। এক হাতে কান চেপে আর এক হাত শূন্যে ভাসিয়ে তেহাই মেরে সমে আসছে। নাকছাবির হিরের চোখ মাঝে মাঝে আলোর ছোবল মেরে যাচ্ছে। তবক লাগানো পানের খিলি, মোহরের থলি। আমি যে তখন। কী ছিলুম! কী থেকে কী হলুম! একই সংগীত আমরা তিনজনে শুনছি। পিতার চোখ মুদ্রিত। মাতামহের অশ্রুসজল। আর আমার? বড় সংসার করতে ইচ্ছে করছে। একে একে তারা আসছে। কনক, অপর্ণা, মুকু, এমনকী আমার প্রথম প্রেম মায়া। রাতের উতলা বাতাসে সুরের পথ বেয়ে তারা সব একে একে আসছে। এ যেন আমার ফুলশয্যার রাত।

রাস্তা দিয়ে হেঁকে চলেছে সেই চেনা ফেরিঅলা, ভারী চাপা গলা, মালাই। এ গলা আমি পূর্বজন্মে বহুবার শুনেছি। তখন হাঁকত, বেলফুল। পিতৃদেব বলেছিলেন, কোথাও-না-কোথাও আমাদের একটা অশরীরী ছাচ আছে। দেহগত আত্মার ক্ষণ আবেগে প্রতি মুহূর্তে সেই ছাঁচের আদল পালটাচ্ছে। সেনসিটিভ ফটোগ্রাফিক প্লেটের মতো পরবর্তী ব্যবহারের জন্যে সব ইমোশনের ছাপ ধরা থাকছে। সৃষ্টিকর্তা আলোর দিকে এক্সরে প্লেটের মতো তুলে ধরবেন, পরবর্তী জন্মের সময় মেপে মেপে হৃদয়বৃত্তি, দেহবৃত্তির পাওনা বুঝিয়ে দেবেন। এই নাও তোমার অর্জিত ফল। প্রারব্ধ বুঝে নিয়ে প্রবেশ করো মাতৃজঠরে জ্বণের আকারে। এই মুহূর্তে আমার মন ছেয়ে গেছে অদ্ভুত এক কামমিশ্রিত আধ্যাত্মিক ভাবে। একজন মানবীকে পেতে চাইছি উপাস্য দেবী হিসেবে।

মাতুল গান শেষ করলেন। সুর জলপ্রবাহের মতো ছোট বড় তরঙ্গের আকারে অসীমে ধাবিত হল। বাইরের জগতের প্রাত্যহিক কোলাহলের ছিটেফোঁটা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। গাড়ির শব্দ, লোক চলাচলের শব্দ, পথচারীর বাক্যালাপ।

মাতামহ হঠাৎ গান ধরলেন। সেই এক সুর। দেশ। উগ্রচণ্ডা ভাবে নয়। মৃদু সুললিত। মাতামহের এত সংযত সুর ভঁজা আগে কখনও শুনিনি। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, যার অর্থ তানপুরাটা আমার হাতে দাও। মাতুল হারমোনিয়মে অনুসরণ করছেন। মাতামহ সোজা বসেছেন। কাঁধে তানপুরা। ধীরে সুর ছাড়ছেন। আলাপে সুরের অবয়ব তৈরি হল। গান ধরলেন,

উঠো গো করুণাময়ী খোলো গো কুটির দ্বার।
আঁধারে হেরিতে নারি হৃদি কাঁদে অনিবার ॥

দুটি চরণই বারেবারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছেন। সুর থেকে এতটুকু সরে যাচ্ছেন না। আবেগে মাঝে মাঝে গলা বুজে আসছে। ক্রমশই বুক চিতিয়ে উঠছে। মেরুদণ্ড সোজা হচ্ছে, হৃদি কাঁদে অনিবার বলার সময় সত্যিই কেঁদে ফেলছেন। দু’চোখে ধারা নেমেছে। মুখে অদ্ভুত এক ধরনের দ্যুতি খেলছে। বহু আসরে বসে বহু নামজাদা সংগীত গুণীর পরিবেশন শুনেছি, এমন জীবন-মরণ সংগীত আগে কখনও শুনিনি। সুর মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ বর্শার ফলার মতো আমাদের অন্তরাত্মা ভেদ করে যাচ্ছে। মাতুলের সংযত হারমোনিয়ম অনুসরণ করে চলেছে। দরজার চৌকাঠে কাকিমা এসে বসেছেন। সারাঘর ঝিমঝিম করছে। মাতামহ তারা থেকে মুদারায় নেমে এসে করুণ আকুতিতে বললেন, খোলো গো কুটিরদ্বার, তারপর নাভিপদ্ম থেকে একটি শব্দ তুললেন, ওঁ। এমন ওঁকার ধ্বনি শুনিনি কখনও। পর্বতের নির্জন গুহার নিবিড়তা থেকে মেঘ গর্জনের শব্দের মতো উচ্চারিত হল। আমাদের সমস্ত শরীর শব্দতরঙ্গে কেঁপে উঠল। তানপুরাটি মাতামহের শিথিল হাত থেকে ধীরে ধীরে মাটির দিকে নেমে আসছে। হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললুম। পিতৃদেব আর মাতুল দু’জনে। একসঙ্গে বললেন অপূর্ব, স্বর্গীয়!

মাতামহের কোনও ভাবান্তর নেই। নিশ্চল, ভাষাহীন। সারাঘরে অপূর্ব এক সুগন্ধ। একই সঙ্গে গোলাপ আর চন্দনের সুবাস। পিতা বললেন, কোথা থেকে ধূপের গন্ধ আসছে!

মাতুল বললেন, মৃগনাভি।

মাতামহ স্থির নিশ্চল। পদ্মাসনে বসে আছেন। সারা মুখমণ্ডলে অদ্ভুত এক দ্যুতি। মুদ্রিত চোখে কাকে যেন দেখেছেন, যিনি সচরাচর সাধারণ মানুষকে দেখা দেন না।

পিতা বললেন, এবার আপনি একটু বিশ্রাম করুন।

কোনও উত্তর নেই।

মাতুল হারমোনিয়ম ছেড়ে পাশে সরে এসে বললেন, আপনাকে প্রণাম করি। আপনার গান শুনে সময় সময় কত ব্যঙ্গ করেছি, আজ যা শোনালেন, তার কোনও তুলনা হয় না।

মাতুল পায়ের আঙুল স্পর্শ করে চমকে উঠলেন, একী, বরফের কুচি! চাটুজ্যেমশাই একবার দেখুন তো!

পিতা সামনে ঝুঁকে মাতামহের মুখের দিকে তাকালেন, হামাগুড়ি দিয়ে বুকে কান রাখলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ধীর কণ্ঠে বললেন, হরি ওঁ, হরি ওঁ।

মাতুল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, কী হল?

উঠে দাঁড়াও।

আমরা দুজনেই উঠে দাঁড়ালুম।

এদিকে এসো। এই দেখো ব্ৰহ্মতালু খুলে গেছে। সাধক দেহত্যাগ করেছেন।

মাতুল হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লেন। দু’হাতে মুখ ঢেকে শুধু একবার বললেন, বাবা। সকলের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেন ধরতে পারলুম না!

পিতৃদেব প্রহরীর মতো পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। দু’চোখে জল নেমেছে। মায়ের ছবির দিকে তাকালুম। চোখের ভুলও হতে পারে। মনে হচ্ছে মা যেন কিছু একটা বলে ঠোঁট বোজাচ্ছেন। কী বললেন তাও যেন শুনতে পাচ্ছি–বাবা চলে এসো। অনেকদিন হয়ে গেছে, আর না। এবার ঘরে ফিরে এসো।

কাকিমা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন। আমি আর সইতে পারলুম না। মৃত্যু যতই মহান হোক, সব থেকেও মানুষের ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে যেতে পারে, সেই প্রথম অনুভব করলুম। শূন্য একটা খোলসের মতো মাতামহের পায়ের কাছে পড়ে গেলুম। সতীমা গঙ্গার ঘাটে যেদিন আমাকে স্পর্শ করেছিলেন সেদিন আমার ঠিক এইরকমই হয়েছিল। সেই ভয়াবহ প্রান্তর আবার ফিরে এসেছে। প্রদোষের অন্ধকার। ছাইছাই রঙের মাঠ, গাছপালা, কাটাঝোঁপ। ছোট ছোট টিলা। মাতামহ আগে আগে চলেছেন। সোনালি গেরুয়া বসন। মনে হচ্ছে পা যেন ফেলছেন না, অথচ আমি তাকে কিছুতেই ধরতে পারছি না। সব সময়েই একটা নির্দিষ্ট ব্যবধান থেকে যাচ্ছে। দূর থেকে ঝক ঝক বাদুড় উড়ে আসছে। ডানার সামান্যতম আস্ফালন নেই। তারা যেন ঘন অন্ধকারের চাদর টেনে আনছে। বহুবার ডাকার চেষ্টা করছি, বলার চেষ্টা করছি দাদু, আপনি কোথায় চলেছেন? গুঁড়ো গুঁড়ো মাটি দিয়ে সাজানো, অদ্ভুত চেহারার একটা-দুটো বাড়ি। মনে হচ্ছে ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। পত্রহীন একটি গাছের তলায় মাথায় হাত রেখে দুটি মানুষ পাশাপাশি উবু হয়ে বসে আছে। যেন উইয়ের ঢিবি। ফুটো ফুটো, বিধ বিধ হয়ে গেছে। মাতামহ সোজা চলেছেন। হঠাৎ আমার চোখ ঝলসে গেল। সামনে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সোনার পাতে মোড়া দিগন্তে রুপোর চাঁদ উঠেছে। আমার সামনে বিশাল এক জলাশয়, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সোনালি আর রুপোলি তরঙ্গ খেলছে। মাতামহ ধীরে ধীরে সেই জলের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তার সোনালি ছায়া ক্রমশই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সেই জলের কিনারায় দাঁড়িয়ে আমি সেই অভাবনীয় দৃশ্য দেখছি। রুপোলি সমুদ্রে স্বর্ণপ্রতিমার ধীর নিমজ্জন। স্বচ্ছ জলে একটি স্বর্ণমুদ্রা। ফেলে দিলে যেমন হয়, মাতামহ ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরে নেমে গেলেন, স্বর্ণদ্যুতি নিক্ষেপ করতে করতে। আর তাকে দেখা গেল না। অসীম শূন্যতায় নির্জন দিগন্ত। হঠাৎ কোথা থেকে এক ঝক নীল পাখি এসে জলের ওপর নিঃশব্দে উড়তে লাগল। মনে হল আমি এক তরল হোমকুণ্ডের তটভাগে এসে দাঁড়িয়েছি।

অচৈতন্য হয়েছিলুম কি না জানি না, হঠাৎ পরিবেশে ফিরে এলুম একটি শব্দতরঙ্গ ধরে– জয় রাম, জয় রাম। এ যেন আর এক স্বপ্ন। ঘরে প্রবেশ করছেন হরিদ্বারের সেই সন্ন্যাসী। মাতামহের গুরুদেব। বেটা হাম আ গিয়া। ঠারো ঠারো।

মাতামহকে উপবিষ্ট অবস্থা থেকে শায়িত করার চেষ্টা চলেছে। কাকিমা দরজার কাছ থেকে ঘরের আর একটু ভেতরে এসেছেন। পিতৃদেব আর মাতুল দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সন্ন্যাসীকে দেখে দু’জনেই অবাক হলেন, গুরুজি, আপ?

হাঁ বেটা, হাম আ গিয়া।

সন্ন্যাসী পরপর কয়েকটি কাজ করতে বললেন। বেলপাতা চাই, তুলসীপাতা চাই, চন্দনবাটা চাই। গঙ্গাজলের প্রয়োজন। ফুল, ফুলের মালা, একটি সোনার তবক। মৃত্যুর পর মানুষের শরীর শিথিল হয়ে এলিয়ে পড়া উচিত। মাতামহ কিন্তু প্রস্তর মূর্তির মতো একই ভাবে মৃত্যুস্থ। ধ্যানস্থ বলি কী করে!

আমার আচ্ছন্নভাব কেটে এসেছে। এখন অনেক কাজ। তুলসীপাতা বাড়িতেই আছে। বেলপাতা চাই। সোনার তবক, সে কোথায় পাব? পিতা কাকিমাকে বললেন, বউঠান, একটু চন্দন ঘষে ফেলো। অন্তত এক বাটি। আমাকে বললেন, বেলপাতা, ফুল, ফুলের মালা নিয়ে এসো। যত তাড়াতাড়ি পারো। কোনও কৃপণতা কোরো না। সন্ন্যাসী মাতামহের পাশটিতে আসন করে বসেছেন। মৃদুস্বরে একইভাবে বলে চলেছেন, জয় রাম, জয় রাম। বেরোবার সময় পিতৃদেব বললেন, বাইরে তুমি এই মৃত্যুর কথা বলবে না।

রাস্তায় নেমে গোটাকতক কথা ভাবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। রাত নেহাত কম হয়নি। ফুল পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে। সমস্যা বেলপাতার। আজ বৃহস্পতিবার হলে কথা ছিল না। মায়াদের পেছনের বাগানে বেলগাছ আছে। পুকুরধারে। টাটকা বেলপাতা। কিন্তু যাই কোন মুখে? বহুকাল মায়ার খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। ভয়। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার ভয়। স্বার্থপর ভাবে ভাবুক আমাকে যেতেই হবে। দু-চারটে কথা শোনাবে বাঁকা বাঁকা। তা শোনাক।

বেড়ার পাশ দিয়ে অন্ধকার ছায়াঘেরা পথ। আঁস্তাকুড়ে সাদামতো একটা বেড়াল বসে ছিল। পায়ের শব্দে থমকে থমকে পালাল। মন্দিরের দরজা বন্ধ। রাতের মতো দেবী শয্যা নিয়েছেন। ধূপ আর ধুনোর গন্ধ এখনও বাতাসে ভাসছে। মায়ার পিসিমা দাওয়ায় বসে দুলে দুলে মহাভারত। পড়ছেন। অনেকটা গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। মাটির উঠোনে তার ছায়া দুলছে।

মায়া দেয়ালে পিঠ দিয়ে সামনে পা ছড়িয়ে বসে ছিল। আমি দাওয়ার পাশে দাঁড়াতেই সে হাই তুলল। গোটাকতক তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে? অন্ধকারে আমি তেমন স্পষ্ট নই। উত্তর দিলুম, আমি পিন্টু।

তুমি? তা কী মনে করে? পথ ভুলে গেছ নাকি?

মায়া উঠে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর দু’হাত তুলে আড়ামোড়া ভাঙল। এত দুঃখেও আমি দেখলুম, মায়ার শরীরে জোয়ার এসেছে।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন