১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
কোথায় যেন কসুর থাকে;
জমে না হায়, গান থেমে যায়
পরাণ-ভরা হাহাকারে।

পরতে পরতে কাগজ জড়ানো পার্সেল খুলতে একটু সময় লাগল। বই। বেশ স্বাস্থ্যবান। প্রথমেই যে-দিকটা বেরুল, সেটা মলাটের পেছন দিক। হঠাৎ কে আবার বই পাঠালেন! বইটা ওলটাতেই মনে হল আমি আচমকা একটা গুলি খেলুম। সরাসরি একেবারে বুকে। জিভে তামাটে স্বাদ। পা দুটো থিরথির করে কাঁপছে। বরফশীতল সরীসৃপ পা বেয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বুকের দিকে উঠে আসছে। সামনে আয়না থাকলে দেখতে পেতুম, আমার মুখ নীল হয়ে গেছে। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। বইটাকে কোনওরকমে উপুড় করে রেখে, প্রায় মাতালের মতো টলতে টলতে নিজের ঘরে ঢুকে খাটে বসে পড়লুম।

সামলাতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। ছি ছি, ভাবা যায় না। এ কার কাজ! তাকে হাতের কাছে পেলে, খুন করে জেলে যেতেও রাজি ছিলুম। পিতাকে এভাবে অপমান করার শোধ তুলতুম। মানুষের ভেতরে ভেতরে কত বড় বড় পয়ঃপ্রণালী চাপা আছে? ওপর দেখলে বোঝা যায় না। হাসছে। জোড় হাতে নমস্কার করছে। সহৃদয়তায় গলে পড়ছে। দেখা হলেই, কী কেমন আছেন, বলে দাঁত বের করছেন। বিজয়ায় কোলাকুলির ঘটা। পিতৃদেব সেই কারণেই মাঝেমধ্যে বাথরুমে। গেয়ে ওঠেন, জগতে তোক চেনা ভার মুখ দেখে। মুখে সবাই পরম বন্ধু, হৃদয় ভরা বিষ। এই। পৃথিবীর সব ভাল, বৃক্ষ, লতা, স্রোতস্বতী, আকাশ বাতাস, সব ভাল। কুৎসিত হল মানুষ! বাঁদর যে। আমাদের পূর্বপুরুষ! কেমন করে ভোলা যায় আমাদের সেই সলাঙ্গুল অতীতকে। একটু আগে আমিই বা কী করে এলুম! নিঃসঙ্গ পবিত্র এক যোদ্ধাকে অহংকারের বল্লম দিয়ে খোঁচা মেরে এলুম। আমি এক মূর্খ।

পিতা বারান্দায় সেই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে যেন বয়ে চলেছে দিকহীন জীবনের নদী, যার পরপার ঝাঁপসা অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন। পায়ে হাত রেখে প্রণাম করায় চমকে উঠলেন, কে? হঠাৎ কী হল তোমার?

আমায় ক্ষমা করুন।

সন্তান তো সবসময় ক্ষমার স্রোতেই ভাসছে। পিতার অপরাধের ক্ষমা কোথায়?

আপনার কোনও অপরাধ নেই। কোন সমাজে আমরা বাস করছি আমার জানা ছিল না। ওই দেখুন, কী বিশ্রী নোংরা এক বই পাঠিয়েছে অদৃশ্য কোনও এক প্রেরক।

আমি অনুমান করেছিলুম। একটি মহাপুরুষ বাক্য তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যব হাতি চলে বাজার, তো কুত্তা ফুকে হাজার। ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। মানুষকে এই ভাবেই এগিয়ে যেতে হবে বন্ধুর পথে, ডোন্ট ফ্লিকার মাই বয়। ন্যায়কে অন্যায় কোনও দিনই পরাস্ত করতে পারে না, কোনওদিন পারেওনি, থমকে দিতে পারে। যাও, কেরোসিনে চুবিয়ে বইটাকে উনুনে ফেলে দাও। তুমি আমার বন্ধু। সমালোচনার অধিকার তোমার আছে। সংশোধনের প্রয়োজন থাকলে নিজেকে সংশোধন করার উদারতা যেন আমার থাকে। মৃত্যুর আর এক নাম ‘রিজিডিটি’, জীবনের আর এক নাম ‘ফ্লেক্সিবিলিটি’। পিন্টু, লেট আস লাভ লাইফ, নট ডেথ।

কুৎসিত কদর্য বইটা যত তাড়াতাড়ি পুড়িয়ে ফেলা যায় ততই ভাল। আর এক মুহূর্ত ফেলে রাখা উচিত হবে না। তার আগে আর একটা কাজ বাকি। কাকিমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। বড় অন্যায় করে ফেলেছি। মহিলার সব গেছে, আছে শুদ্ধ জীবনের সামান্য আশা। কে না বাঁচতে চায়! ফুটপাথে সারারাত ভেঁড়া কাপড় জড়িয়ে যে পড়ে আছে, তার সামনে মৃত্যু এসে দাঁড়ালে সেও একটু সময় চেয়ে নেবে। রোজ সকালে সূর্যোদয়ের দিকে তাকিয়ে সে-ও মনে মনে ভাবে, হয়তো আমারও দিন আসবে, দেখি না আর একটু অপেক্ষা করে।

মহিলা ওপরের কোনও ঘরেই নেই। কোথায় গেলেন? নীচে! সেই বিমর্ষ, মৃত্যু-শীতল কোটরে যেখানে উচ্চুঙ্খল, আশাহত একটি মানুষের প্রেত নিঃশব্দে জীবনকে গ্রাসের অপেক্ষায় আছে। একী? সেই চাবির থোলোটা ড্রয়ারের মাথায় পড়ে আছে, যেটা একটু আগেও কাকিমার আঁচলে ছিল। এবার যদি আমার চোখে জল এসে থাকে, সে কি আমার দুর্বলতা, আমার কোমলতা! সংসার আমার জন্যে নয়। এ বড় করুণ স্থান। প্রতি মুহূর্তেই কাঁচের ফলার ওপর দিয়ে রক্তাক্ত হতে হতে হাঁটা।

নীচের ওই ঘরে ঢুকতে ইদানীং আমার ভীষণ ভয় করে। মনে হয় হাঙরের মতো এখুনি আমাকে আবার মুখে পুরে ফেলবে। অতীত ফিরে আসবে অনুশোচনা নিয়ে। প্রায়ান্ধকার ঘর থেকে একটা ফোঁসফোঁস শব্দ আসছে। দরজার কাছ থেকে খুব মৃদু সুরে ডাকলুম, কাকিমা! কোনও সাড়া পেলুম না। ফোঁসফোঁসানিটা সামান্য কমে এল।

আবার ডাকলুম, কাকিমা।

এবারে চাপা গলায় উত্তর এল, এসো।

নিরাভরণ ঘরে দেয়ালের দিকে মুখ করে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ভদ্রমহিলা বসে আছেন। নোনা-ধরা ড্যাম্প ঘরের চারপাশ থেকে হিলহিল করে উঠছে মৃত্যুর শীতল নিশ্বাস। অনেকদিন আগে বোতলে একটা পাথরকুচি গাছ রেখেছিলুম। একদিন নির্জন দুপুরে বোতলটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে আঁতকে উঠলুম। নীলচে সবুজ জলে, জালি জালি অসংখ্য সাদা সাদা শিকড় জীবন্ত প্রাণীর মতো, অক্টোপাসের মতো কী যেন খুঁজছে। মনে হল কাঁচের আবরণের বাধা না থাকলে, আমাকেই জড়িয়ে ধরতে পারে। এই ঘরেও দৃষ্টিকে আমি তেমনভাবে চারপাশে ফেরাতে পারি না। ভয় করে। চারপাশে ঝুলে আছে আমার কৃতকর্মের সরু সরু কীট।

সেই রাতে আমি যতটা কাছে যেতে পেরেছিলুম, আজ আর তা পারলুম না। চিরকালের জন্যে মনে পাপ ঢুকে গেছে। মন অপরিষ্কার হয়ে গেলে মানুষ কেঁচোর মতো গুটিয়ে যায়। বেশ কিছুটা দূর থেকে বললুম, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।

চোখ থেকে আঁচল সরিয়ে কাকিমা আমার দিকে ফিরে তাকালেন। চোখের বড় বড় পাতা জলে ভিজে ভারী হয়ে ঝুলে আছে। গালে এক বিন্দু পলাতক জল টলটল করছে। এই কি বিধবা হবার বয়েস! কথাটা মনে হওয়ামাত্রই চমকে উঠলুম। এ আমি কী ভাবছি?

কাকিমা ধরাধরা গলায় বললেন, তুমি তো কোনও অন্যায় করোনি। ঠিকই করেছ। আমার বোকামি এখন আমি বুঝতে পেরেছি। পর কখনও আপন হয় না, পিন্টু। তুমি ঠিক করেছ, ঠিক করেছ।

ঠিক করেছ ঠিক করেছ বলতে বলতে কান্নায় গলা ভেঙে এল। এখন তো আমার আর কিছু করার নেই। ছোঁড়া পাথর, ওলটানো দুধ আর বলা কথা, কোনও ভাবেই ফিরিয়ে আনা যায় না। আর কাছের মানুষ নই, দূরের মানুষের মতোই বললুম, আমার ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে, ওপরে চলুন।

কান্না সামলে কাকিমা বললেন, পিন্টু, তুমি আমার একটা উপকার করবে?

বলুন, সম্ভব হলে নিশ্চয় করব।

মামাবাবু আজ রাতে চলে যাচ্ছেন, ওঁর সঙ্গে তোমরা আমার যাবার ব্যবস্থা করে দাও। তখন আমি না বলেছিলুম, এখন আমি হা বলছি। আমাকে কোথাও একটা যেতেই হবে। এখানে সত্যিই আর থাকা যায় না। আমি বুঝতে পেরেছি, কী থেকে কী হয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। আমি বড় খারাপ মানুষের বউ ছিলুম। আশেপাশে এমন একজন কেউ ঘুরছে, যে আমাকে সুখে থাকতে দেবে না। আমাকে কোথাও একটা যেতেই হবে।

এসব কথা আপনি আমাকে না বলে, ওপরে এসে বাবাকে বলুন। আমি কে?

উত্তরে কোথা থেকে আবার একটু রাগের ঘেঁয়া এসে গেল। মেয়েদের চরিত্রটাই এইরকম। এক ইঞ্চি পেলে, এক বিঘত চাইবে। ক্ষমা চাইলুম, তাতে হল না, অন্যায় হয়ে গেছে বললুম, তাতেও হল না। যাঁর কেউ নেই, তার এত অভিমান সাজে না। কীসের অভিমান! কার ওপর অভিমান? পত্রশূন্য বৃক্ষের ছায়ার অভিমান!

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মনে হল, আমি হয় দেবতা, না হয় শয়তান! যতদিন মোহ ছিল, ততদিন আকর্ষণ ছিল। এখন শুধু পড়ে আছে ঘৃণা। আমার দ্বিতীয় কাজটি এবার করা যাক। কে থাকবেন আর কে যাবেন আমার জানার প্রয়োজন নেই। এ সংসার ভেঙেই আছে। দু’-একটি উটকো পাখি মাঝেমধ্যে উড়ে এসে গান শুনিয়ে যায়, তাকে বসন্ত বলে ভুল কোরো না মন!

গিধঘোড় বইটার প্রথম মলাটের তলায় একটা চিঠি। মহামান্য হরিশঙ্করবাবু, অনেকদিন সব ভুলেটুলে গেছেন। আবার নতুন করে যখন শুরু করলেন, বইটা যথেষ্ট সাহায্য করবে। আপনি জ্ঞানী মানুষ। চরিত্রের অহংকারে মাথা উঁচু করে চলেন। দ্বিতীয় পক্ষের প্রস্তাব ঝাটা মেরে উড়িয়ে দেন। তা মুনিদেরও তো মতিভ্রম হয়। নিজে কিনতে লজ্জা পাবেন ভেবে আমরা যৌতুক পাঠালুম। যে বউভাত হল না, মনে করুন এটি সেই বউভাতেরই উপহার। খাওয়াটা পাওনা রইল মাইরি। অন্নপ্রাশনে যেন বাদ না পড়ি। বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখি। ইতি জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী।

আগুন আর বাইরে জ্বলবে কী! আগুন আমার ভেতরে জ্বলছে। আমি যদি পিতৃদেব হতুম, তা হলে চারপাশে চার জোড়া নহবত বসিয়ে, আকাশে তারাবাজির লহর তুলে, সকলের চোখের সামনে ওই মহিলাকে বিবাহ করতুম। কেন, বাংলার শ্রেষ্ঠ পুরুষ বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রথা চালু করে যাননি! তিনি তা পারবেন না। অন্য জাতের মানুষ। অন্তরে যাঁর সন্ন্যাস তার চিন্তায় এসব কখনও আসবে না। এ পল্লিতে আমাদের আর থাকা উচিত হবে না। আমাদের প্রচ্ছন্ন অহংকার আর আভিজাত্য এতকাল যেসব শত্রু তৈরি করেছে তারা এইবার সুযোগ নেবে। এই হল প্রথম আঘাত। এরপর একে একে আসবে।

চিঠি সমেত যৌনবিজ্ঞানকে কেরোসিন-স্নাত করে আগুনে সমর্পণ করামাত্রই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। শিখায় শিখায় সঙ্ঘর্ষে একটা অট্টহাসির মতো শব্দ উঠছে। এ হাসি আমার পিতার পূত চরিত্রের, না নোংরা প্রতিবেশীদের!

মোটা বই পুড়তে বেশ সময় নিল। রান্নাঘর ধোঁয়ায় ভরে গেছে। প্রেতিনীর চুলের মতো ধোঁয়া ভেতরের ছাদে পাক খাচ্ছে। ডাইনির নৃত্য। চোখ জ্বালা করছে। পেছন থেকে ধরাগলায় কাকিমা বললেন, একী, এ আবার তুমি কী করছ? এখুনি যে অগ্নিকাণ্ড হয়ে যাবে!

এই চিঠি, ওই বই, এই মহিলা, সেই দুষ্ট প্রতিবেশী আমার মনেও কদর্য ভাব ঢুকিয়ে ছেড়েছেন। একেই বলে দ্রব্যগুণ। পেঁয়াজের সংস্পর্শে গন্ধ ধরবেই। চকিতে মনে উঁকি মেরে গেল, হলেও হতে পারে। নারী আর পুরুষের সম্পর্ক অনেকটা ঘৃত আর অগ্নির মতো। যিনি এই কয়েক মাসে সদ্গুরু সঙ্গ প্রায় মুখস্থ করে ফেললেন তার তো জানা উচিত, নারী কী বস্তু। গোস্বামীজি স্পষ্ট বলছেন, স্ত্রী-দেহ এমনই উপাদানে গঠিত যে, নির্বিকার পুরুষের শরীরকেও তা আকর্ষণ করে। ইহা বস্তু-গুণ। অর্থ ও স্ত্রীলোক বড়ই ভয়ানক।

যে-বস্তু পুড়ে ছাই হচ্ছে, তার নাম তো এই মহিলাকে বলা চলে না। ওই গ্রন্থ আজ পর্যন্ত আমার খুলে দেখার সাহস হয়নি। না হলেও, ওই জ্ঞান শাস্ত্র পড়ে লাভ করার প্রয়োজন হয় না। রক্তে আছে। যত দিন যায় তত স্পষ্ট হয়, ততই প্রত্যক্ষ হয়। ধমনীতে ধমনীতে আর্তনাদ করে, আমি চাই, আমি চাই।

নির্বিকার গলায় বললুম, আগুন লাগার ভয় নেই। কিছু কাগজ পুড়ছে।

তোমাকে ডাকছেন।

যাচ্ছি।

উনুনের মুখে একটা লোহার ঢাকনা টেনে দিলুম। দেহবিজ্ঞান ছাই হয়ে গেল। ইন্দ্রিয় কিন্তু রয়েই গেল। সাংঘাতিক এক ইঙ্গিত চেতনাকে জাগিয়ে দিয়েছে। আমি আর ভাল করে কারুর দিকেই তাকাতে পারব না। কেবলই মনে হবে, হলেও হতে পারে। মানুষের পক্ষে সবই যে সম্ভব?

পিতৃদেবের মুখে একটা বিষণ্ণ ছায়া নেমেছে। বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বহু দূর থেকে বললেন, বোসো, তোমার সঙ্গে পরামর্শ আছে। ক’টা বাজল?

সাড়ে চারটে।

জয়ের ট্রেন কটায়?

আটটা কি সাড়ে আটটা হবে। আমার সঠিক সময়টা জানা নেই।

যাই হোক এখনও সময় আছে। শোনো, এ পাড়ায় আমাদের অনেক শত্রু আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। বাঙালির স্বভাব তোমার অজানা নয়। আমরা কারুর সঙ্গে বড় একটা মিশি না। আমাদেরও এক ধরনের উন্নাসিকতা আছে। নিজেদের বড় বেশি শ্রেষ্ঠ ভাবি। নেকড়ের মতো মানুষও সমাজবদ্ধ জীব। সমাজচ্যুতকে কামড় খেতেই হবে। আমি প্রস্তুত। তবে আমি আর লড়াইয়ে অকারণ শক্তিক্ষয় করতে চাই না। আমার সব শক্তিকে এখন অন্য কাজে লাগাতে হবে। দিন শেষ হয়ে আসছে, কাজের কাজ এখনও কিছুই করা হল না। ঝুলিতে কিছুই তেমন ভরা হয়নি, একেবারেই শূন্য। কিছু না নিয়ে, ম্লান মুখে আমি যাই কী করে! তুমি পবিত্র কোরান পাঠ করেছ?

আজ্ঞে না, আমার পড়াশোনা খুবই কম।

সময় পেলে পড়ে দেখো। তোমাকে আজ একটা কথা বলে রাখি, পরে আর হয়তো সময় পাব না। পৃথিবীতে আমাদের থাকার সময় বড় কম। এক জীবনে সব করে ওঠা যায় না। এলোমেলো পড়াশোনার কোনও দাম নেই। একটা ধারা ঠিক করে নিতে হয়। সেই জিনিসই পড়বে যা তোমাকে পজেটিভ কিছু দিতে পারে, তোমার সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে, ধীরে ধীরে তোমার শূন্যতায় পূর্ণতা আনতে পারে। জগৎটাকে টুকরো টুকরো করে দেখো না! সব এক। সব মানুষ এক, সব ধর্ম এক, সব অনুভূতির উৎসও এক। কোরান কী বলছেন জানো, যে-ব্যক্তি পরলোকে ফসল কামনা করে আমি তার জন্যে পরলোকের ফসল বর্ধিত করে দিই। যে-কেউ ইহলোকের ফসল কামনা করে আমি তাকে তারই কিছু দিই। পরলোকে এদের জন্যে আর কিছুই থাকবে না। তোমাদের যা কিছু দেওয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ, কিন্তু আল্লাহর কাছে যা আছে তা উত্তম ও স্থায়ী। বিশ্বাসীরা কিয়ামতের দিন বলবে, ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যারা নিজেদের ও নিজেদের পরিজনবর্গের ক্ষতিসাধন করেছে। শোনো, আমি আমার হঠকারিতা দিয়ে তোমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে চাই না। আমি পণ্ডিতের সঙ্গে পাণ্ডিত্য দিয়ে লড়তে পারি, অহংকারীর সঙ্গে লড়তে পারি অহংকার দিয়ে, অভিমানীর সঙ্গে অভিমান দিয়ে। অন্ধকারের সঙ্গে অন্ধকার দিয়ে লড়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমার ভেতরে কোথাও একটা ছোট্ট শিখা জ্বলে উঠেছে। সেই শিখাঁটিকে সাবধানে আগলাতে হবে, বাড়াতে হবে। নিবে গেলে, আমার আর কিছুই থাকবে না।

হঠাৎ থেমে পড়লেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, এক গেলাস জল পেলে হত। আজকাল গলাটা বড় শুকিয়ে যায়। অ্যাসিডে বুকটা আমার ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

আমি জল এনে দিচ্ছি।

উদাস সুরে বললেন, দেবে দাও। বয়েসটা সত্যিই বাড়ছে। আগে অন প্রিনসিপল কাউকে কখনও হুকুম করিনি।

তাতে কী হয়েছে?

না না, মানুষের একটা আদর্শ নিয়েই চলা ভাল, অন্তত চেষ্টা করা উচিত।

এক গেলাস জল এনে হাতে দিলুম। গেলাসটা আলোর দিকে তুলে জলটা ভাল করে দেখতে দেখতে বললেন, এই দেখো, কী সব ভাসছে।

কী ভাসছে? আশ্চর্য হয়ে গেলাসটা হাতে নিলুম। জল গড়িয়েই নিয়ে চলে এসেছি। তেমন খুঁটিয়ে দেখিনি। সত্যিই গুঁড়ো গুঁড়ো কী সব ভাসছে।

আমি পালটে আনছি।

কী বুঝলে?

আজ্ঞে?

স্নেহের বড়ই অভাব। বলো ঠিক কি না! আমি একজন ‘পারফেকশনিস্ট’ পিন্টু, আর সেইটাই আমার চরিত্রের মহা দোষ। আর একটা শিক্ষা কী হল বলল তো?

আজ্ঞে?

ব্রত ভঙ্গ করলে হতাশ হতেই হবে।

আমারই অপরাধ। আমি এখুনি আনছি পরিষ্কার জল।

জল খেয়ে গেলাসের গায়ের জল কেঁচার খুঁটে মুছে টেবিলে সাবধানে রাখলেন। কত সাবধানী। জলের দাগে টেবিলের পালিশ নষ্ট হতে পারে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সময় নষ্ট করে দিচ্ছি না তো!

আজ্ঞে না, আমার আবার সময়ের দাম কী?

তা হলে বোসো। তোমার আর পাঁচ মিনিট সময় নিই। আমার একটা আশঙ্কা হচ্ছে বুঝলে? আর সেটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। যে-চক্রান্ত প্রফুল্লকে পৃথিবী থেকে সরিয়েছে, সেই চক্রান্ত এবার আমাদের চারপাশে তার জাল বিস্তার করছে। এই মহিলাকে তারা সহজে ছাড়বে না। এমনও হতে পারে এই মহিলা হয়তো তাদেরই একজন। তোমার কী মনে হয়?

আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, এর পেছনে ওই মামাশ্বশুরটি আছেন।

তিনি কী কারণে থাকবেন?

তার স্বভাব।

পয়সার তো অভাব নেই? ভাত যখন ছড়াতে পারেন তখন কাকের অভাব হবার তো কথা নয়।

শুনেছি…

যা বলতে চাই, তা গুরুজনের সামনে বলা যায় না।

কী হল, ইতস্তত করছ কেন? সাহস করে বলো। উই আর ফ্রেন্ডস।

আজ্ঞে, কোনও কোনও মানুষ বিশেষ কারণে কোনও কোনও মহিলায় আসক্ত হয়ে পড়তে পারেন, তখন তারা যে-কোনও সীমায় যেতেও পিছপা হন না।

দ্যাটস রাইট। তা হলে চক্রটাকে ভাঙতে হয়।

সে তো আমাদের কাজ নয়। পুলিশের কাজ।

পুলিশ যথেষ্ট ‘ইন্টারেস্ট’ না-ও নিতে পারে।

নিলে না নেবে। আমরা আর কী করতে পারি?

আমরা খোঁচাতে পারি। আমাদের সন্দেহের কথা পুলিশকে জানাতে পারি।

যা গেছে তা গেছে, শুধু শুধু ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ কী? ব্যাপারটা তো খুবই নোংরা।

নোংরামি বলে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে? ভদ্রলোকদের এই ঠুনকো সেন্টিমেন্ট ক্ষমা করা যায়?

নোংরায় ঢিল ছুড়লে যে নিজেদের মুখে ছিটকে আসবে। অনেক জল ঘোলা হবে।

তোমার মতে আমাদের তা হলে এখন কী করা উচিত?

ওঁকে এখান থেকে কিছুদিনের জন্যে সরিয়ে দেওয়া।

কোথায়?

মামার ওখানে উনি যেতে রাজি হয়েছেন।

আমাকেও সেই কথাই বলছিলেন। হঠাৎ রাজি হবার কারণ?

তা জানি না, জেনেও কাজ নেই। যেতে রাজি হয়েছেন, বাধা না দেওয়াই ভাল। এখানে থাকলে অশান্তি দিনে দিনে বাড়বে।

তা হলে তুমি একবার জয়ের কাছে যাও। আর বেশি সময় নেই। জয় শ্রাদ্ধের কাজটা এখানে করলেই পারত!

এখানে যে কেউ নেই।

ওখানেই বা কে আছে? যাক যা ভাল বুঝছে করুক। আমার আর সেদিন নেই যে জোর করব। সিঁড়িতে চুটুরপুটুর চটির শব্দ হচ্ছে। এই দুঃসময়ে কে আবার আসছেন? বড় সুললিত পদধ্বনি।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন