২.১৮ If one calls you a donkey

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

If one calls you a donkey, ignore him
If two call you a donkey, check for hoof prints
If three call you a donkey, get a saddle.

আগুন আগুন, বলে ধেইধেই করে আমি একটা বাঁদর নাচ নাচলুম। তারপর এক লাফে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করলুম। মুকু এক ধাক্কা মেরে আমাকে নিজের অজান্তেই সাহায্য করল। যে-থালায় ময়দার তাল, তার পাশেই বিশাল এক ঘটিতে জল ছিল। দিদির আঁচলে আগুন তখন সাপের মতো কিলবিল করছে। চুল পর্যন্ত লাফিয়ে উঠছে। মুকুর হাতে ঘটি। দিদি দু’হাত তুলে সতীদাহের সতীর মতো স্থির। পুরো ঘটির জল দিদির গায়ে ঢেলে দিল মুকু। তারপর দু’হাতে জাপটে ধরে মেঝেতে উলটে পড়ে দু’জনে গড়াগড়ি, জল সপসপে মেঝেতে। গগন কোথাও কিছু। নেই, একটিন ময়দা উপুড় করে দিল দু’জনের গায়ে। দুটো বিশাল আকারের পুলি পিঠে যেন মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। আগুন যখন নিবে গেছে, তখন আর ভয় কী! আমি বীর দর্পে ঘরে ঢুকলুম। আর মোচার খোলার মতো সড়াক করে হড়কে পড়ে গেলুম। জলেতে ময়দাতে যে মেঝেটা এত পিচ্ছিল হয়ে আছে, আমি ভাবতেও পারিনি। গগন ছেলেমানুষের মতো হাততালি দিতে দিতে সুর করে বলতে লাগল, পড়েছে পড়েছে। উলটে তো পড়েছে। মনে হচ্ছে, উঠে কষে এক থাপ্পড় লাগাই। ও হতভাগার জন্যেই এত কাণ্ড। দুটো মেয়ে এখনই পুড়ে মরত।

মুকু উঠে বসেছে। দিদি ওঠার চেষ্টা করছে। দু’জনকেই বৃদ্ধার মতো দেখাচ্ছে। মুকু আমার দিকে তাকিয়ে বললে, তোমার লজ্জা করে না! তখন ভয়ে পালাচ্ছিলে, এখন চালাকি করতে এসেছ। তুমি এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। তোমাকে দেখলে আগুনে পোড়ার চেয়েও শরীর জ্বলে উঠছে। তুমি এত স্বার্থপর! আত্মপর! কাপুরুষ! ওপরচালাক! দয়া করে ওই পাঁঠাটাকে নিয়ে ঘরের বাইরে যাও। গেট আউট ফ্রম হিয়ার। কাওয়ার্ড। নিনকমপুপ!

কতটা পুড়ল একবার দেখি। ফাস্ট ডিগ্রি, না সেকেন্ড ডিগ্রি? হসপিট্যালাইজ করতে হবে কি?

তোমাকে আর ডিগ্রি দেখতে হবে না। দয়া করে সরে পড়ো। যা করার আমি করব।

রাত তখন প্রায় বারোটা। অগ্নিপর্ব শেষ করে মুকু ঘরে ফিরে এল। খাওয়াদাওয়া মাথায় উঠেছে। দু’জনেই অল্পবিস্তর পুড়েছে, তবে তেমন মারাত্মক নয়। দেহের চেয়ে মন পুড়েছে বেশি। বিশ্রী একটা এলোমেলো কাণ্ড। কোথা থেকে একটা চটাস চটাস শব্দ আসছে কানে। মুকুর মুখ ভয়ংকর গম্ভীর। তবু সাহস করে জিজ্ঞেস করলুম, শব্দটা কীসের?

গিয়ে দেখে এসো। আমি জানি না।

মুকু সসাফার ওপর গোঁজ হয়ে বসল। বাইরে থেকে গগনের গলা ভেসে এল, একে খাওয়াদাওয়া নেই, যেটুকু রক্ত ছিল সব শালা মশায় শুষে নিলে। এরা মাছের চাষ না করে মশার চাষ করেছে। বাড়িটা দেখছি পাগলের আখড়া!

আমি হেসে ফেললুম। মুকু উঠে গিয়ে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এল।

কী করলে? এ যে চরম অভদ্রতা! দিদি কী মনে করবে।

মনে করুক। আমি সেইটাই চাই। এ বাড়িটা মগের মুলুক নয়। ভবিষ্যতে এই বাড়িটা আশ্রম হবে। এটা পাগলা গারদ নয়। অনাথ আশ্রম নয়।

তোমার হঠাৎ মন ঘুরে গেল কেন?

কারণ আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। একের পেছনে আর এক, তার পেছনে আর এক আসবে। আমার গভীর সন্দেহ, এই পাগলটা তোমার দিদিরই ছেলে। ভদ্রমহিলা ডাহা মিথ্যে কথা বলছেন।

নিজের ছেলে থাকলে কেউ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না। ছেলের ওপর নির্ভর করে নিজেই সংসার পাতে। আমার পিতারও ছেলে আছে, কিন্তু তিনি আজ পথে পথে ঘুরছেন। ছেলের ওপর । কীসের ভরসা?

মেসোমশাইয়ের ওটা স্পিরিচুয়াল ক্রাইসিস। তিনি বেরিয়েছেন অন্বেষণে। পরমার্থের সন্ধানে। আমাকে প্রায়ই বলতেন, পাহাড় আমি ভালবাসি। ভালবাসি নদীর উৎসমুখ। হরিদ্বার আমার প্রিয় জায়গা। শ্রবণনাথ ঘাট, হর-কি-পৌরি, কংখল, নিরঞ্জনী সাধুদের আখড়া। চণ্ডীপাহাড়। অলকানন্দা। মৃত্যু আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। ভাগ্য আমার প্রিয়জনদের একে একে কেড়ে নিয়েছে। সন্তানটিকে স্বাবলম্বী করাই ছিল আমার শেষ কর্তব্য। করেছি। এইবার শিকল কাটার সময়। সময় হয়েছে নিকট, এবার বাঁধন ছিড়িতে হবে। এর সঙ্গে ওটাকে এক করে ফেলো না! সংসার হরিশঙ্করের পক্ষে একটা অত্যন্ত ছোট জায়গা। তোমার এই মহিলাটি মোটেই সুবিধের নয়। এই ছেলেটির জন্মবৃত্তান্তে গভীর কোনও রহস্য লুকোনো আছে। দিদির মুখের সঙ্গে অনেক মিল। পিতার পরিচয় ছেলের পক্ষে জানা। সম্ভব নয়, একমাত্র মা-ই বলতে পারে পিতা কে?

তুমি কী বলছ মুকু?

ঠিকই বলছি পিন্টু। তুমি সর্ব অর্থে একটা গবেট।

যাই হোক, আমাদের একটা কর্তব্য আছে। কোথায় শোবে, কী খাবে, দিদির যন্ত্রণা হচ্ছে কি না?

যেখানে খুশি শোবে। বাড়িতে শোয়ার জায়গার অভাব নেই। আর খাওয়া! একদিন উপোস। করলে মানুষ মারা যায় না। ঘড়া ঘড়া জল আছে, তাই খাবে।

শোয়ার জায়গাটা ঠিক করে দিয়ে এসো।

আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার হাত দুটোর কী অবস্থা দেখেছ! আমার গালেও আগুনের আঁচ লেগেছে। তোমার যদি অতই চক্ষুলজ্জা, নিজে গিয়ে বিছানা পেতে শুইয়ে দিয়ে এসো। পদসেবা করতে চাও তো, তাও করে এসো।

আমি গুম মেরে গেলুম। এরপর আর আমার কিছু করা চলে না। যা হয় তোক। আমি পরিস্থিতির কাছে একেবারে বিকিয়ে গেছি ব্যক্তিত্বের অভাবে। কোনও স্বাধীনতাই আমার নেই। এ বলছে ওই করছি, ও বলছে এই করছি। আমিও এক চরিত্রহীন। আমার পিতার ভাষায় ক্রিস্টালাইজড ইডিয়েট। সংসারের বাইরে আশ্রমজীবনই আমার ভাল। আটকে গেছি তো গেছিই। দাঁড়ের চন্দনা। পায়ে রিং লাগানো। সোনার শেকলও শেকল। বিষয়ের কথা ছেড়ে দিলে, লোকে বলে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। ঈশ্বরের কথা বললে, বলে ভণ্ড। বিষয়ী লোক দেখলে পালাতে ইচ্ছে করে। সংসারে পঁচিশ বছর হল, সব ফক্কাবাজি। সব অসার। সব দু’দিনের জন্যে। সংসারে আছে কী? আমড়ার অম্বল, খেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আমড়াতে আছে কী? আঁটি আর চামড়া, খেলে অম্লশূল। কোথাও এতটুকু শান্তি নেই, নির্জনতা নেই। সবাই হটটেম্পার। বন্ধ দরজার বাইরে হঠাৎ খঞ্জনি বেজে উঠল, সঙ্গে হেঁড়ে গলা, হরে কৃষ্ণ, হরে রাম, নিতাই গৌর রাধেশ্যাম। মুকু সঙ্গে সঙ্গে টানটান। মুখ লাল। এইবার কী হয় কে জানে! দু’পালটা গাইতে-না-গাইতেই, ধড়াব্বড় মারের শব্দ। লাঠি দিয়েই পেটাই হচ্ছে। গান থেকে কান্না, মা আর মেরো না। মহাপ্রভু নাম সংকীর্তন করতেন আর কাজি ধোলাই দিত। তুমি কি মা সেই কাজি! বিধর্মী খ্রিশ্চান। আর মেরো না মা। তুমি কি নালিকুল থানার বড় দারোগা? মার থামছে না। হরেক রকম আওয়াজ। বেশ খেলিয়ে মার চলেছে। মুকু ঝড়াক করে উঠে পড়ল। সোজা এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

দু’জনেই বেরিয়ে এলুম। ছাতে ওঠার সিঁড়ির ধাপে দু’হাতে মাথা ঢেকে বসে আছে গগন। পাখার হাতল দিয়ে দিদি পেটাচ্ছে। মারে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এলোপাথাড়ি চলছে। দিদির পরনে কোনও শাড়ি নেই। সায়া আর ব্লাউজ। দৃশ্যটা হজম করা শক্ত। এলো চুল। মুকু এক ঝটকায় পাখাটা ছিনিয়ে নিল। ছুঁড়ে ফেলে দিল দোতলার বারান্দা থেকে নীচে। পাখাও পাখা মেলে। মুকুর পরবর্তী আক্রমণ হল খঞ্জনির ওপর। একটানে গগনের কোল থেকে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে, তারও সেই এক দশা করে দিল। সোজা বাগানে, ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে। আঁচলটা কোমরে ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে বললে, এইবার? আর কী কী খেলা তোমরা দেখাতে চাও? সারারাত আমরা জেগে থাকি ক্ষতি নেই, পাড়ার আর পাঁচটা মানুষ একটু ঘুমোবে তো? না তাও তোমরা দেবে না? এটা গ্রাম নয়, শহর! একটু আক্কেল হবার মতো বয়েস হয়েছে।

দিদি একেবারে বিস্মৃত। কী পরে আছেন সে খেয়ালটুকুও নেই। থাকলে এইভাবে কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়াতে পারত না। চোখের সামনে দুটো ছেলে। শরীরের বসন্ত এখনও বিদায় নেয়নি। এখানে আসার আগে যথেষ্ট তোয়াজে ছিলেন বলেই মনে হয়। আমাকে চোখ নামাতে হল। নিজের লজ্জা নিজের কাছেই।

দিদি বললে, এই জানোয়ারটাকে দূর না করা পর্যন্ত আমাদের শান্তি নেই। নড়া ধরে বাইরে বসিয়ে দিয়ে এসো। গগন অত ধোলাই খাওয়ার পরেও বলতে পারলে, কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনও নয়। আয় মা সাধনসমরে। দেখি মা হারে, না পুত্র হারে। ভ্যাপ্পোর, পাপ্পোর, পোঁ।

দিদি প্রায় দোকাদো গলায় বললেন, আজ বোধহয় একাদশী। একাদশী অমাবস্যাঁতে ও একেবারে পাগল হয়ে যায়।

মুকু কঁজিয়ে উঠল, জানোই যখন, তখন ঠিকানাটা দয়া করে দিয়ে এলে কেন? ঝাড়ের বাঁশ। ঝাড়েই থাকত।

গগন বললে, আমি ডিটেকটিভ মোহন। ঠিকানা ছাড়াই চলে এসেছি। এর আগে তিনবার তুমি আমাকে ফেলে পালিয়েছিলে। সেখানেও আমি গিয়েছিলুম। তুমি আমার কী করতে পেরেছিলে মা? তোমার সেই রেলের গার্ডসায়েব আমাকে পিটিয়ে পানাপুকুরে ফেলে দিয়েছিল। তবু আমি। মরিনি। আমি মরছি না, মরব না।

দাঁত কিড়মিড় করে দিদি বললে, মাঝে মাঝে মনে হয়, তোর গলা টিপে শেষ করে দিই। যতদিন বাঁচবি, ততদিন জ্বালাবি!

এখন আমাকে কিছু খেতে দাও। আমার পেট খালি থাকলে আমি ঘুমোতে পারি না। সেই কাল রাত্তিরে আমি মুড়ি তেলেভাজা খেয়েছি। আর আজ এই রাত্তির। আমার যে ভীষণ খিদে পেয়েছে। মা!

গগনের শেষ মা ডাকটা হাহাকারের মতো শোনাল। যে-কোনো নিষ্ঠুর বুক ফেটে যাবে।

মুকুর টানটান শরীর একটু আলগা হল। মুকু বললে, পেট পুরে খাইয়ে দিলে লক্ষ্মী হয়ে ঘুমোবে?

গগন দু’হাতে মাথা ধরে বললে, আমি পাগল। তাই খেতে চাইলে সবাই আমাকে মারই খাওয়ায়। মুকু কিছুক্ষণ থমকে থেকে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আমি আর থাকতে না পেরে বললুম, দিদি, একটা কাপড় পরে এসো।

দিদি একটু থতমত হয়ে বললেন, পরতে পারছি না ভাই। কোমরের কাছটা পুড়ে গেছে। কোনওরকমে সায়াটা ধরে আছি। সবই তো সহ্য করছ, ক’দিন এইটুকু সহ্য করে নাও।

মুকুর ডাক এল, গগন, খাবে তো এদিকে আলোয় এসো।

বিশাল বাটি। দুধে মুড়ি ভিজছে বিজবিজ শব্দে। তার ওপর গোটা চারেক দানাদার। গগনের সত্যিই খিদে পেয়েছিল। হুপুস হাপুস করে খাওয়া শুরু করল।

মুকু বললে, হাত ধুয়ে, বাটি ধুয়ে, সোজা কোথাও গিয়ে শুয়ে পড়বে। শোওয়ার জায়গার অভাব। নেই। অভাব মশারির। একটা চাদর দিচ্ছি, আপাদমস্তক মুড়ি।

মশা আমার কী করবে! তখন চটাস চটাস করছিলুম ইচ্ছে করে, বদমাইশি করে।

আজ রাতে আর কোনও বদমাইশি কোরো না ভাগনে।

গগন লক্ষ্মী ছেলের মতো মাথা নাড়ল। তার দুঠোঁটে দুধ। কোণের দিকে একটা মুড়ি। ডান হাত বাটিতে। কপালের একটা পাশ সুপুরির মতো ফুলে উঠেছে। পাখার বাঁটের নির্দয় প্রহারে। মুকু আমার সঙ্গে ঘরে এসে দরজার ছিটকিনি তুলে দিল।

তোমার সঙ্গে আমার অনেক পরামর্শ আছে।

রাত অনেক হল।

তাতে আমাদের বয়েই গেল। বোসো আমার সামনে।

পেট চোঁচো করছে, দাঁড়াও আগে জল খাই এক গেলাস।

অ্যায়, এইবার শুরু হল তোমার খেলা।

জলযোগ সেরে ফিরে এলুম। মুকু বললে, দরজার ছিটকিনি তুলে দাও। আমাদের এখন ক্লোজড ডোর কনফারেন্স হবে।

বিছানার ওপর বেশ জুত করে বসল মুকু, ষষ্ঠীঠাকরুনের মতো। আমি বসলুম কিছুটা দূরে। যাকে বলে সম্মানজনক দূরত্বে। মুকু উদাস হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বললে, এখানকার পাট আপাতত কিছুদিনের মতো ওঠাতে হবে। এইসব অবাঞ্ছিত চরিত্র আমাদের জীবন আর সাধনা একেবারে বরবাদ করে দেবে। মেসোমশাইয়ের এই মন্দির শেষ হয়ে যাবে। এই তীর্থ আমাদের রক্ষা করতে হবে জীবন দিয়ে।

বলো, তোমার পরিকল্পনাটা কী?

কাল সকালে আবার আমি হস্টেলে ফিরে যাব।

নেবে কেন?

অবশ্যই নেবে। এখন সেশন নেই, নতুন মেয়ে আসার সম্ভাবনাও নেই।

আর আমি কী করব?

তুমি একটি বড় তালা ঝুলিয়ে সরে পড়বে কিছুদিনের জন্যে।

কোথায়?

তোমার সামনে তিনটে পথ খোলা আছে। প্রথম পথ, তোমার জীবিকা। সোজা দেরাদুন। বসে থাকলে তোমাকে তো আর কেউ খাওয়াবে না! তোমার জমিদারিও নেই। মেসোমশাইয়ের গচ্ছিত টাকায় মরে গেলেও হাত দেবে না। নিজের রোজগারের ওপর নির্ভর করবে। দ্বিতীয় পথ, তোমাকে আমি ছেড়েই দিলুম, তুমি আশ্রমে চলে যেতে পারো। চেষ্টা করে দেখো সন্ন্যাসী হতে পারো কি না! মনে হয়, পারবে না। মনে হয় কেন, একেবারে সুনিশ্চিত, পারবে না তুমি। আজকের আগুন লাগার ঘটনায় তোমার চরিত্রের পুরো পরিচয় স্পষ্ট। তুমি ভীরু। আত্মকেন্দ্রিক। একেবারে। নীচ ধরনের গৃহী। নিজেরটি ছাড়া তুমি আর কিছু বোঝে না। এই চরিত্রের মানুষ কখনও সন্ন্যাসী হতে পারে না। অসম্ভব। গেরুয়া গেরুয়া খেলা করে। ভেতরে ভোগ বাইরে যোগ। গেরুয়ার। ডেকরেশন। তৃতীয় পথ, তোমার জীবন-মরণের পথ। তুমি এদের নিয়ে এইখানেই পড়ে থাকো। এরাই তোমাকে রান্নাবান্না করে খাওয়াবে। তোমার আধারটাকে নষ্ট করবে। তোমাকে বিয়ে করার মেয়ের অভাব হবে না। মেয়েরা তোমাকে সহজেই বাঁদর নাচ নাচাতে পারবে। তোমার প্রথম ইন্দ্রিয় অতিশয় প্রবল। কী হবে হরিশঙ্করের জন্যে ব্যাকুল হয়ে? প্রায় ভুলেই তো এসেছ। আর মাসখানেকের মধ্যে তিনি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। তোমাকে নাকি সুরঞ্জনার দাদার মতো দেখতে! ওখানে টোপ ফেলো, বড়লোক শ্বশুর পাবে। হাতের কাছেও একটা মেয়ে আছে, টিপ। যাই বলো, যতই অস্বীকার করো, ওখানেও তোমার দুর্বলতা। তোমার মতো জামাই পেলে ওরা হাতে স্বর্গ পাবে। মেসোমশাইকে খুঁজে বের করার ধৈর্য, সাহস, ইচ্ছে কোনওটাই তোমার নেই। তোমার সে ব্যাকুলতাই নেই। মৃত্যুর মতো ব্যাপারটাকে তুমি মেনে নিয়েছ। কী করে ভাবলে, তুমি ঈশ্বরের অন্বেষণে বেরোবে! সে যে সহস্র গুণ কঠিন কাজ। এই বিশ্বরচনার কোনখানে তিনি বসে আছেন। কেউ জানে না। সেই অধরাকে তোমার মতো ধৈর্যহারা ধরবে? বামন হয়ে চাঁদে হাত দেবার শখ! জেনে রাখো, আমি সারাজীবন বসে থাকব আমার মেসোমশাইয়ের জন্যে। সারাভারত একা ঘুরে বেড়াবার সাহস আমার আছে। আমি তার পায়ের কাছে বসে, ত্যাগ আর বৈরাগ্যের শিক্ষা নোব। তোমার মতো অর্ধনারীশ্বরদের জীবনসঙ্গিনী হওয়ার চেয়ে ঈশ্বরের গলায় মালা দেওয়াই ভাল। এই আমার শেষ কথা। গুড নাইট।

দমাদ্দম গোলা ছুড়লে দুর্গের যা অবস্থা হয়, আমার সেই অবস্থা। প্রাসাদ প্রাকার বিধ্বস্ত। তবু শেষ চেষ্টা। নিজের ইজ্জতের সওয়াল। হঠাৎ আবিষ্কার করলুম, মেয়েরা যত মারমুখি আর আক্রমণাত্মক হয় ততই তাদের আকর্ষণ বাড়ে। লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বই পড়েছিলুম। লেখা ছিল, বিলেতে মানুষ পয়সা খরচ করে মেয়েদের হাতে চাবুক খেতে যায়। তাইতে নাকি ভীষণ আনন্দ!

আমার শেষ চেষ্টা। যে-জাহাজ ডুবছে তাকে ভাসিয়ে রাখতে চাইছে কাপ্তেন। মুকু ছাড়া আমার জীবন অচল, এটুকু বুঝে গেছি। বললুম, মুকু, আগুন আর সাপ মানুষকে দিশাহারা করে। একে বলে প্রিমিটিভ ফিয়ার। স্বীকার করছি, আমি তোমার মতো সাহসী নই। সকলেই সাহসী হয় না। তার মানে এই নয় আমি স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। আর মেয়েপাগল বললে আমাকে! ওটা পৃথিবীর একটা আদি ব্যাধি। মুনিঋষিরাও নিস্তার পাননি। কোনও পুরুষই পুরোপুরি পুরুষ নয়, কোনও নারীই পুরোপুরি নারী নয়। শাস্ত্র বলছে, মূলে বসে আছেন ভগবান। সৃষ্টিই তার খেলা। খেলাটা তুমি বিজ্ঞান দিয়ে বোঝার চেষ্টা করো। সৃষ্টিকে চালু রাখার জন্যে তিনি কী করলেন? মজা করলেন, দক্ষিণ অঙ্গ পুরুষ বাম অঙ্গ স্ত্রী। একটিতে দুটি, দুটিতে একটি। দু’জনে মিলে ধারণ করেন অনন্ত রূপ। এই কারণে পুরুষের আকর্ষণ নারীতে, নারীর আকর্ষণ পুরুষে স্বাভাবিক। এইটা প্রকৃতির কারসাজি। আমরা অসহায়। তুমিও অসহায়, আমিও অসহায়। পৃথিবীর তাবৎ মানুষ অসহায়। কিছুই করার নেই। পঞ্চভূতের ফাঁদে পড়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর কাঁদে।

আমি মোটেই অসহায় নই। আমার কোনও আকর্ষণ নেই। আমি নিজেকে সেইভাবে শিক্ষিত করেছি।

মুকু, আমার সাফ কথা, তুমি চলে গেলে আমি একেবারেই অসহায় হয়ে যাব। তোমার প্ল্যান বাজে প্ল্যান।

আমাকে পরীক্ষা দিতে হবে।

অবশ্যই হবে। তুমি এই বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করো। আমি এই অবসরে কাশ্মীর ঘুরে আসি।

কাশ্মীর? সেখানে কী?

আমার সেই স্বপ্নে দেখা নদী, যার তীরে বসে আছেন তিনি।

তোমার মাথা। স্বপ্ন কখনও সত্য হয় না। নিজের চিন্তাই স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। সময় আর পয়সার অপচয় হবে।

হোক। তবু আমি স্বপ্নকেই অনুসরণ করব। স্বপ্নকে অনুসরণ করেই মানুষ বাস্তবে পৌঁছোয়। কাল আমার অফিসে গিয়ে প্রথমেই চাকরিটা ছেড়ে দোব। ওঁদের আর ঝুলিয়ে রেখে লাভ নেই। জীবনটাকে অনিশ্চিত না করতে পারলে আমার রোক আসবে না। নিরাশ্রয়, ছন্নছাড়া। তা না হলে আমার আত্মসমর্পণ আসবে না যাকে বলে রেজিগনেশন।

চাকরি ছাড়ার কী কারণ ঘটল?

কারণ একটাই, আমার আর ছুটি পাওনা নেই।

চাকরি ছাড়লে চাকরি পাবে?

আমাদের লাইনে চাকরির অভাব নেই। যত পালটাব তত মাইনে বাড়বে। তোমাকে শুধু একটাই অনুরোধ, আমার সঙ্গে তুমিও চলো।

কেন খরচ বাড়াবে? এ কি তোমার প্রমোদ ভ্রমণ?

তা কেন? আমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়েই যাচ্ছি। তবে পেতেও পারি, না-ও পারি। আমরা হরিদ্বার হয়ে ফিরে আসব।

সে তো এক মাসের ধাক্কা। আমার পরীক্ষা? আমার ক্লাস?

বিষয়টা আজ ধামাচাপা থাক। কাল আবার ভাবা যাবে।

যাই ভাবো, কাল এই বাড়ির সদরে তালা পড়বে। অদ্যই শেষ রজনী।

দিদিকে দূর করে দেবে এই অবস্থায়, কোমর পিঠ সব পুড়ে গেছে? দেখলে তো, বিপদ আসার আগে কেমন ইঙ্গিত দিয়েছিল!

মুকুর মুখ একটু গম্ভীর হল। ভাবতে বসল। ঘটনার প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে আসছে। মুকু ক্রমশই স্বচ্ছ হচ্ছে। হৃদয় ফিরে আসছে হৃদয়ে। আমি তোমাকে একটা বিকল্প পরামর্শ দিচ্ছি মুকু। তুমি পনেরোটা দিন এই বাড়ির দায়িত্ব নাও, একটু কষ্ট করো, আমি কাশ্মীর থেকে ঘুরে আসি।

মুকু একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দড়াম করে সদর দরজার খিলটা খুলে পড়ে যাবার শব্দে বাড়ি কেঁপে গেল।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন