২.৩৭ Is man one of God’s blunders

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

Is man one of God’s blunders
Or is God one of man’s blunders?

ঝোঁপঝাড় গাছপালা সব মিলিয়ে বাগানের মতো একটা জায়গা। তারই মাঝে কয়েকটা কুঁড়েঘর। দুপুরে পাখির ডাকে একটা ক্লান্তির ভাব। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে দামোদরের জল চিকচিক করছে। নদীটা পেছন দিক দিয়ে ঘুরে চলে গেছে তার সমুদ্রযাত্রায়। এই হল বিমলার ভিটে।

ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে বাচ্চা একটা ছেলে ছপটি হাতে ঘুরছে। বড় বড় চোখ। আদুড় গা, একমাথা ফুরফুরে চুল। নিজের মনেই বকবক করছে আর হাতের ছপটিটাকে ঘোরাচ্ছে মাঝে মাঝে। অচেনা আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

কোথায় আমি নাম জিজ্ঞেস করব! না, সে-ই আমার নাম জিজ্ঞেস করে বসল।

আমার নাম পিন্টু। তোমার নাম?

আমার নামও পিন্টু।

ছেলেটি বললে, তুমি কি আমার মামা?

হ্যাঁ, আমি তোমার মামা।

তুমি মাছ ধরতে পারো?

পারি না বললে ছেলেটির কাছে হেরে যেতে হয়। মামা মাছ ধরতে পারে না, সে আবার কেমন মামা! বেশ একটা বীরত্ব এসে গেল ভেতরে। বুক চিতিয়ে বললুম, নিশ্চয় পারি।

ছেলেটি আমার কাছে এগিয়ে এসে নিচু গলায় বললে, তুমি মাছি ধরতে পারো?

মহা দুষ্টু ছেলে। চোখেমুখে বুদ্ধি খেলা করছে। পরিষ্কার হাফপ্যান্ট। ফরসা রং। গ্রামের ছেলে বলে মনেই হয় না। হঠাৎ কোথা থেকে একটা ভোমরা উড়ে এল। মাথার চারপাশে ভো ভো উড়ছে। আমাকে ভয়ে আড়ষ্ট দেখে ছেলেটি বললে, দুর বোকা, নিজের নামটা বলে দাও না, তা হলেই তো চলে যাবে।

আমি বললুম, পিন্টু। ভোমরাটা সত্যিই উড়ে চলে গেল আর একদিকে।

ছেলেটি বললে, দেখলে? ওরা নাম জিজ্ঞেস করতে আসে।

কেন, নাম জিজ্ঞেস করতে আসে কেন?

তাও জানো না? ছেলেটি হাসল আমার অজ্ঞতায়, ওরা হল কোটাল। রাজপুত্রের কাছ থেকে আসে। তোমাকে তোমার মা বলেনি?

না তো?

তোমার মা জানে না। আমার মা সব জানে।

তোমার মা কে?

আমার মা বিমলা। ছেলেটি হঠাৎ ধেই ধেই করে খানিক নেচে নিল, বিমলি মা কলমি খায়। বাঘের সঙ্গে কথা কয়। তুমি আমার বিমলি মাকে চেনো না? তুমি কোত্থেকে এলে গো? বৃন্দাবন থেকে?

না তো, কলকাতা থেকে।

ও তা হলে তুমি আর এক মামা? বৃন্দাবনে আমার আর এক মামা আছে। আসে না, কেবল চিঠি লেখে। বিমলি মা কেবল বলবে ঝুলনে আসবে ঝুলনে আসবে। আসেই না। মিথ্যে কথা।

তুমি ওই ছড়াটা কোথায় শিখলে?

আমার মোহনমামা শিখিয়েছে। মোহনমামা আমাকে কত শেখায়! তোমার মামা আছে?

হ্যাঁ আছে।

কিছু শেখায়?

হা গান শেখান।

ঠোঁট উলটে বললে, আমার মোহনমামাও আমাকে গান শেখায়। দেখি তুমি একটা গান ধরো তো? কেমন শিখেছ দেখি।

তুমি একটা গাও আগে।

তোমার লজ্জা করছে? আমি না হয় চোখ বুজোচ্ছি। নাও নাও, তাড়াতাড়ি ধরো।

সত্যিই আমার যেন একটু লজ্জালজ্জা করছে। এমন একজন শ্রোতা। যেন গানের পরীক্ষা দিচ্ছি। এক পিন্টু চোখ বুজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর এক পিন্টু গান ধরেছে, মন রে কৃষি কাজ জানো না। এমন মানবজীবন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।

গান যতক্ষণ চলল ছেলেটা একভাবে চোখ বুজিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গান শেষ হতেই চোখ খুলে বললে, ভালই শিখিয়েছে। তা তুমি আর একটু চড়াতে পারলে না? তা হলে শোনো।

পিন্টু ওই গানটাই ধরল। ধরামাত্রই অবাক হয়ে গেলুম। যেমন সুরে গলা, তেমনি উচ্চারণ আর ভাব। এ ছেলে নির্ঘাত বড় গাইয়ে হবে। মন রে বলে যখন সুর টানছে, তিরের মতো বুকে এসে লাগছে। পাতার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে মুখে। মুখটা লাল। হঠাৎ গান থামিয়ে বললে, ঠিক হচ্ছে তো? দে মা আমায় তবিলদারিটা জানো?

না গো।

ইস! তা হলে শিখে নাও, আমি গাইছি।

পিন্টু গাইতে লাগল, আমায় দে মা তবিলদারি। আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী। প্রথম লাইনটা গেয়েই বললে, নাও ধরে ফেলল। চুপ করে থাকলে শিখবে কী করে?

ডি-শার্পে ধরেছে। আমি পারব কেন? তবু হেরে যাওয়ার ভয়ে ধরতে হল। জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন এসে গেছে। ধরে ফেললুম, আমায় দে মা তবিলদারি। অন্তরায় গিয়ে আর রাখতে পারলুম না। গলা ফেল করল। প্রসাদী গানের যত কেরামতি তো চড়ায়। পিন্টু আর গ্রাহ্যই করল না আমাকে। তার ভাব এসে গেছে। সে গেয়েই চলল প্রাণ খুলে। এত ভাল গাইল, রেকর্ড কোম্পানি শুনলে রেকর্ড করে নিত। গান শেষ করে আবার সে প্রতিযোগিতায় ফিরে এল, তুমি আর কী জানো? গাছে উঠতে পারো?

না গো, গাছে চড়তে ভয় করে।

পিন্টু কিছুক্ষণ ভেবে বললে, ও ভয় করে! তা হলে তো তুমি কোনওদিন পেয়ারা জামরুল খেতে পারবে না। তুমি ক’দিন থাকবে? ওটাও তোমাকে শেখাতে পারি। খুব সহজ। হাত আর পা দিয়ে গাছটাকে জড়িয়ে ধরবে। প্রথমে কিন্তু নম করে নেবে। গাছ তো দেবতা। মনে মনে বলবে, গাছ, তুমি আমাকে ফেলে দিয়ো না। তারপর তো একটু উঠলেই ডাল পেয়ে যাবে। ওগুলো হল গাছের হাত। ডাল ধরে ধরে তুমি কত ওপরে উঠে যাবে। একটুও ভয় পাবে না কিন্তু। এখনই শিখবে নাকি?

ভয়ে ভয়ে বললুম, এখন থাক। কাল সকালে শিখব।

সাঁতার জানো নাকি?

সে একটু একটু।

তা হলে তো ভালই। কাল পুকুরে দু’জনে সাঁতার কাটব।

সাঁই সাঁই করে গাছের ভাঙা ডালটাকে এদিকে-ওদিকে বারকতক দুলিয়ে দিয়ে বললে, কেন এইরকম করলুম বলো তো? একগাল হেসে বললে, করতে হয়। তা না হলে রাগ হয়।

কার রাগ হয়?

ছপটির রাগ হয়। মাঝে মাঝে এটা দিয়ে মারতে হয়।

কাকে?

যাকে হোক। তা না হলে এর মন খারাপ হয়।

তুমি কত কী জানো!

বড় হলে আরও কত কী জানব! তুমি লেখাপড়া করো না?

করি তো। তুমি?

আমিও করি। তুমি ফাস্ট হও?

তুমি?

আমি ফার্স্ট ছাড়া হতেই পারি না। কী যে আমার হবে।

তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

ফোর। জানো তো আজ আমি একটু পরে পায়েস খাব।

কেন?

পায়েস কেন খায়?

তোমার জন্মদিন।

ঠিক বলেছ। আজ আমার জন্মদিন। তোমার জন্মদিন কবে?

আমার জন্মদিন পুজোর সময়, আশ্বিন মাসে।

তোমাকে কেউ পায়েস করে দেয়?

আমার যে মা নেই।

তা হলে তুমিও আজ আমার সঙ্গে পায়েস খাবে। এখন চলো আমরা বাড়িতে যাই। এখুনি বিমলি মা খুঁজতে আসবে এখানে।

বাগানটাকে আমরা দুজনে মিলে একবার পাক মারলুম। গাছের জটলা। একপাশে একটা পরিত্যক্ত ভিটে। বিশাল বিশাল গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল। কিছু ফুলগাছ, আগাছা। হঠাৎ ঝোঁপের আড়াল থেকে টুসটুসে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন, শিশুটির সামনে দাঁড়িয়ে একটু নিচু হয়ে বললেন, এই যে গোপাল আমার! আজ একবারও আসা হল না কেন মানিক?

পিন্টু বললে, আজ আমাদের বাড়ি অনেক লোক এসেছে। দেখছ না, এই যে আমার মামা। আমার পিন্টুমামা।

গোপালের প্রসাদটা তা হলে আমি কী করব?

নিজেই খেয়ে নেবে কুপুর কুপুর। তুমি তো পেটুক।

বৃদ্ধা হাহা করে হেসে উঠলেন, কাল রাতে আমার খুব জ্বর হয়েছিল গো কত্তা।

যাও না, পুকুরে খুব করে চান করো গে না। তোমার তো খুব গরম!

একটু ওষুধ দিবি না?

তোমার ওষুধ আমার এই ছপটি। পিঠটা পাতো।

আমি এমন ডাক্তার চাই না।

তা হলে যাও বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ো।

বৃদ্ধা কিছু দূর গেছেন, পিন্টু ছুটে গিয়ে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরল, দিদা, আমার চালভাজা রেখো কিন্তু, বিকেলে আসব। বৃদ্ধা আদর করতে করতে বললেন, লুডোটা আনবি। অনেকদিন আমাদের খেলা হয়নি। বেলাবেলি আসবি কিন্তু। বৃদ্ধা সঁড়িপথ ধরে গুটগুট করে চলে গেলেন। কাঁধের পাশে একটা ঝোলা।

পিন্টু বললে, তুমি চালভাজা খেয়েছ কোনওদিন, কুসুমবিচি ভাজা দিয়ে?

শুধু চালভাজা খেয়েছি। পিন্টুকে এখন সমবয়সি বন্ধু মনে হচ্ছে।

তা হলে বিকেলবেলা আমার সঙ্গে যাবে। লুডো খেলতে জানো?

হ্যাঁ তা জানি।

তা হলে ঠিক আছে, আমরা তিনজনে খেলব। তুমি আর কী খেলা জানো? ডান্ডাগুলি?

সে তোমার মতো যখন ছোট ছিলুম।

আচ্ছা পিন্টুমামা, তুমি আমাকে একটা কথা বলতে পারো, বড় হতে ক’দিন লাগে?

বেশ শক্ত প্রশ্ন। উত্তরের বদলে প্রশ্ন করলুম, কেন বলো তো! বড় হয়ে কী হবে, ছোট থাকাই ভাল। পিন্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ কুঁচকে একবার আকাশের দিকে তাকাল। একটা ব্রাহ্মণ চিল উড়ছে। সাদা চিল সহসা দেখা যায় না। আমি তাকিয়ে রইলুম হাঁ করে। পিন্টু বললে, আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে।

কেন বলো তো?

তুমি জানেন কি, কানপুর বলে একটা দেশ আছে?

হ্যাঁ, জানি তো।

সেই কানপুরে আমার বাবা আছে। বাবার সঙ্গে আমার বিমলি মায়ের আড়ি। ধরো, আমি যদি তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাই, তা হলে একদিন ট্রেনে চেপে কানপুরে চলে যাব। গিয়ে বাবাকে ধরে আনব। বলব, চলো, এক্ষুনি চলো। তুমিই বলো, সব্বাইয়ের বাবা আছে, আমার বাবা নেই। ভাল লাগে! আমার কেবল মামা। সবাই আমার মামা। তুমি আবার কোথা থেকে চলে এলে এক মামা আমার মা কেবল সবসময় পুজো করে আর কাঁদে। কী করে তাড়াতাড়ি বড় হওয়া যায় বলো তো! গাছের গোড়ায় মোহনমামা গোবর দেয়, গাছ বড় হয়। আমি একটু গোবর খাব মামা?

দাঁড়াও, আমি একটু ভেবে দেখি। তবে কী জানো, মানুষ বছরে বছরে বড় হয়। অঙ্কের মতো। যেমন ধরো, এই তো আজ তোমার জন্মদিন, সামনের বছর এই দিনে তুমি আর এক বছর বড় হবে।

কত বছর হলে মানুষ বড় হয়?

তা ধরো কুড়ি বছর।

পিন্টু ভুরু কুঁচকে বললে, আচ্ছা, তখন কি আমার বাবা আর মা বেঁচে থাকবে?

কেন থাকবেন না?

এই তো তোমার মা নেই।

সে তো অন্য ব্যাপার গো। আমি যখন তোমার চেয়েও ছোট সেইসময় আমার মায়ের খুব অসুখ করল। সে আর আমি কী করব বলো! ডাক্তাররা কিছুই করতে পারলেন না। শোনো, তুমি বড় হয়ে ডাক্তার হবে কেমন? খুব বড় ডাক্তার। তোমার এই ছপটির মতো। অসুখের গায়ে সপাসপ হাঁকাবে, অসুখ মরে যাবে, রুগি ভাল হয়ে যাবে। তোমাকে দেখামাত্রই সব অসুখ চিৎকার করবে, পালা পালা, পিন্টু ডাক্তার এসে গেছে।

পিন্টুর ভীষণ ভাল লাগল কথাটা। খুব হাসি, আমি তো ডাক্তারই হব। জানো তো, আমার মোহনমামার গলায় কী হয়েছে? ডাক্তারবাবু বললেন, মোহন, তুমি খুব সাবধান হও। খুব শক্ত রোগ। তিন বছরও বাঁচতে পারো, আবার দু’বছরও বাঁচতে পারো, তবে জেনে রাখো মোহন মরতে তোমাকে হবেই। ইস, এই সময়ে যদি আমি তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ডাক্তারটা হয়ে যেতে পারতুম!

পিন্টু আবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ একেবারে স্বচ্ছ নীল। সেই চিলটা আর নেই। পিন্টুর চোখে জল। হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল, আমার মোহনামা মরে যাবে। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলুম, তুমি কঁছি কেন? কে বলেছে, মোহনমামা মারা যাবে? কে এক ডাক্তার বললেই হল? জানো তো, আমার যে দাদু এসেছেন, তার খুব শক্তি। আমরা দুজনে মিলে ধরব। মোহনমামার অসুখ ভাল করে দেবেন।

বুক থেকে মাথা তুলে চোখ মুছতে মুছতে পিন্টু বললে, কখন বলবে?

যখন সব কাজ হয়ে যাবে, তখন গিয়ে বলব, দাদু, আমার মোহনমামাকে ভাল করে দিন।

আমরা এসে দাওয়ার একধারে বসলুম। ছোটদাদু ঠাকুরঘরে পুজোর আসনে বসেছেন। তার চওড়া ফরসা পিঠ দেখতে পাচ্ছি। বসে আছেন নিশ্চল ধ্যানে। হরিশঙ্কর এমন এক চেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানেন। একটা হারিকেন নিয়ে পড়েছেন। কল গোলমাল করেছে, পলতে উঠছে না। সেইটাকে চেষ্টা করছেন ঠিক করার। চারপাশে ছড়ানো যন্ত্রপাতি। কোনওভাবে খবর পেয়েছেন কল কাজ করছে না, আর তো তাকে নিরস্ত করা যাবে না। কাজই ঈশ্বর, এই তার বিশ্বাস।

তাঁর পাশে বসে কানে কানে বললুম, আজ বিমলাদির ছেলের জন্মদিন।

ইজ ইট? বেশ, ব্যবস্থা হবে। চলো তা হলে কায়দা করে একবার বাজারে যাই।

এখন তো সব বন্ধ।

ক্যাশ টাকা দেওয়া তো ভাল দেখাবে না, তুমি একবার চুপি চুপি বেরিয়ে দেখো না! গঞ্জে কাপড়ের দোকান, বাসনের দোকান, এসব খোলা থাকে। এটা তো বিজনেস সেন্টার। দুটো জেলার বর্ডার। যাও, বেরিয়ে যাও।

একা পারব? যদি হারিয়ে যাই?

হরিশঙ্কর ভীষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, স্ট্রেঞ্জ! তুমি মেয়েছেলে হলে না কেন? ইউ নিড এ শাড়ি অ্যান্ড পেটিকোট।

আমি তার হাতে সামান্য চাপ দিয়ে বললুম, একটু আস্তে, সবাই শুনতে পাচ্ছেন।

ফিসফিস করে বললেন, এই লজ্জা যাতে পেতে না হয় সেইভাবে চরিত্র সংশোধন করো না! এটা ইউরোপ আমেরিকা নয়, একটা গঞ্জ, এখানে তুমি কোথাও হারাতে পারো?

বেশ উত্তেজিত অবস্থায় পথে বেরিয়ে এলুম। নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরের সমস্ত মহিমায় মণ্ডিত হয়ে পড়ে আছে জনশূন্য পথ। মাঠের পর মাঠ। ছোট ছোট ডোবা। জলে ভাসছে নীল আকাশ। লেজের বহর নিয়ে ডালে বসে শিস দিচ্ছে ফিঙে পাখি। শীর্ণ চেহারার গাভী টুকুস টুকুস করে হেঁটে চলেছে অনিশ্চিত কোনও গন্তব্যে। একটা বাচ্চা মেয়ে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে চলেছে। হাতে খোলামকুচি, ছেলেবেলায় যাকে আমরা বলতুম চাপ্পা। সেইটাকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এক পায়ে। আবার তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। রংচটা ফ্রক। পিঠের বোতাম নেই। একটাও। ছোট্ট একটা বিনুনি লাফানোর ছন্দে দুলছে এদিক-ওদিক।

মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলুম, তোমাদের এদিকে দোকানবাজার কোন দিকে?

মেয়েটি ফিক করে একটু হাসল। আমি তার মাথায় হাত রেখে বললুম, বলো, কোন দিকে?

মেয়েটি ঘাড় হেঁট করে জড়োসড়ো হয়ে গেল।

দোকানবাজার নেই?

ফিসফিস করে বললে, আছে।

বলো কোন দিকে?

দিগন্তের দিকে হাত তুলল। এইটুকু একটা হাত। বললে, ওই দিকে।

তুমি কোথায় যাচ্ছ?

লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে বললে, জানি না।

এমন সময় পেছন দিক থেকে এক প্রবীণ মানুষ টুকটুক করে আমাদের অতিক্রম করে গেলেন। দেখে মনে হল পণ্ডিতমশাই। তাঁকেই ধরলুম, অনুগ্রহ করে বলবেন, এদিকে দোকানবাজার কোন দিকে গেলে পাব?

তিনি ঘোর সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কেন?

আজ্ঞে, আমি কিছু জিনিস কিনতে চাই।

সহজে ছাড়ার মানুষ নন, পালটা প্রশ্ন করলেন, উদ্দেশ্য?

ঘোর সমস্যা। কোনও কিছু কেনার উদ্দেশ্যটা কী? তিনি থামেননি। চলতে চলতেই যাবতীয় প্রশ্নোত্তর। সংকটে নিদানকালে মাগো আমি তোমার শরণ মাগি। পণ্ডিতমশাই বললেন, কী ধরনের বস্তু তুমি কিনতে চাও? তুমি কি নবাগত? নবাগত হওয়াই স্বাভাবিক, তা না হলে প্রশ্ন করবে কেন? তুমি কি চন্দ্রচূড় চৌধুরীর জামাতা?

আজ্ঞে না। তিনি কে?

পণ্ডিতমশাই নিজের মনেই বললেন, বিনীত ও সভ্য। অবশ্যই সদ্বংশোদ্ভূত। আমার চরিত্র বিশ্লেষণের পর তার মনে হল একটু ঘনিষ্ঠ হওয়া চলে। আমরা কিন্তু হেঁটেই চলেছি। পণ্ডিতমশাই প্রশ্ন করলেন, আমার বয়স তোমার অনুমানে কত?

নিজের অজান্তেই শুদ্ধ ভাষা বেরিয়ে এল, আজ্ঞে পঞ্চাশোর্ধ্ব।

তিনি বিজয়ী হাসি হেসে বললেন, অর্বাচীন! তিরিশ বর্ষ পূর্বেই আমি পঞ্চাশ অতিক্রম করেছি। এবং আমার মাতা আজও জীবিত। এই অঞ্চল একদা অতি সমৃদ্ধ ছিল। আজ অতিশয় শ্রীহীন। হেতু দুর্ভিক্ষ, ম্যালেরিয়া। মশককুল নিশ্চিহ্ন করেছে সভ্যতা সংস্কৃতি। শ্রীমান চন্দ্রচূড় ছিলেন এতদ। অঞ্চলের বদান্য ভূস্বামী। ওই দেখা যায় তার প্রাসাদ। কালগর্ভে বিলীন। একটি প্রান্তে তার বংশধরেরা অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন এবং মরা হাতি লাখ টাকা। তা বাবাজি তুমি তা হলে কে?

আজ্ঞে, সেইভাবে বলতে গেলে আমি কেউ নই। আমরা সোনামুখি অঞ্চলের এক গ্রামে যাচ্ছি।

সঙ্গে সঙ্গে পণ্ডিতমশাই চেপে ধরলেন, বহুবচন ব্যবহার করলে কেন? তুমি তো এক এবং একক।

আজ্ঞে, আমার পিতা এবং দাদু মোহনবাবুর অতিথি হয়েছেন।

কেমন দাদু? পিতামহ না মাতামহ?

আজ্ঞে পিতার ক্ষুদ্র মাতুল।

ক্ষুদ্র হবে না বাবাজি, বলো কনিষ্ঠ। মোহন অতি সদাশয় চরিত্র। বড় বংশের সন্তান। চন্দ্রচূড়ের সম্পর্কিত। বিমলার ওই বংশে বিবাহ হয়েছিল, সে বিবাহ সুখের হয়নি। বিমলা ঐশী শক্তির অধিকারী। তার ছেলেটি প্রতিভাধর। আমার বিশ্বাস মোহনের পিতামহ পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন বর্ধমানরাজের সভাসদ, সংগীতগুণী। মোহনের বাস্তুভিটে দামোদর নিয়ে গেছেন। মোহনের পিতামহ এক যবনির আকর্ষণে পড়ে সংসারে দুর্যোগ নিয়ে এলেন। মোহনের পিতা ছিলেন সৎ, সাত্ত্বিক। সৎ মানুষের পক্ষে বিত্ত প্রভুত্ব অর্জন করা অসম্ভব। তোমার কী ধারণা? পৃথিবীটা কার?

বেশ একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। আধুনিক ধারণা বলব, না প্রাচীন? মানুষটি যখন প্রাচীন তখন প্রাচীন বিশ্বাসই পছন্দ করবেন, আজ্ঞে, সৃষ্টি তো ভগবানের।

বৃদ্ধ খাঁইখাঁই করে উঠলেন, অর্বাচীন! পৃথিবী শয়তানের। ভগবানের হলে তিনি এখানে বসবাস করতেন। মানুষ হল শয়তানের চেলা। শয়তানের সন্তান। এখানে যারা ঈশ্বরের ভজনা করে তারা। সব বিদ্রোহী। বিধর্মী। কোথায় আছ? তুমি কে? কিছুই খবর রাখো না! ট্যাকোস ট্যাকোস করে এঁড়ে বাছুরের মতো পৃথিবীর পথে হেঁটে মরছ। এসো আমার সঙ্গে।

সামনেই আটচালা। বাইরে বড় বড় করে লেখা–বলরাম চতুষ্পঠী। সামনে একটু বাগানমতো। মাঝখান দিয়ে পথ চলে গেছে। বালিবালি মাটি। প্রচুর সাদা ফুল। সাদা জবা ডালের ডগায় নিশ্বাসের মতো প্রকৃতির ফিকে বাতাসে টুলুর টুলুর দুলে উঠছে। বৃদ্ধ আগে আগে চলেছেন টরটর করে।

চতুষ্পঠীর দরজা খুললেন। মেঝেতে পাটি পাতা আমাকে বললেন, বোসো। পাদুকা বাইরে।

একটু ইতস্তত করে বললুম, আমি যে জামাকাপড়ের দোকান—

বৃদ্ধ খিঁচিয়ে উঠলেন, হস্তীমূর্খ! এই বেলায় তুমি কোন চুলোয় যাবে, কে বসে আছে তোমার জন্যে?

একপাশে বসে পড়লুম। এপাশে ওপাশে কয়েকটা লেখার চৌকি। দোয়াত কলম।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন