১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

ছায়া, মায়া, কায়া

রান্নাঘরে এক ডেকচি জলের মতো ঝোলের তলদেশে ছাল-ছাড়ানো আস্ত একটা মাগুর কাঁচকলার বালিশ মাথায় দিয়ে শেষ শয্যায় শুয়ে আছে। জমাট অশ্রুবিন্দুর মতো গুটি পাঁচেক মরিচ শোকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর একটি পাত্রে শ্রাদ্ধের পিণ্ডের মতো অতি পুরনো চালের এক ড্যালা ভাত। পিতাঠাকুর পেটরোগা ছেলের আহার প্রস্তুত করে রেখে, চোগাচাপকান চাপিয়ে অফিসে চলে গেছেন। খাখা বাড়ি। পৃথিবীর চাকা ঘুরছে। এখানে মুহূর্ত যেন স্থির। কিছুই করার নেই। মোটা মোটা ভারী ভারী বই আছে। দেয়ালে দেয়ালে জ্ঞানভাণ্ডার ঝুলছে ঝুলের আবরণে। পণ্ডিত হতে চাইলে হওয়া যায়। মগজে গোবর। দাঁতের জোর থাকলে ইঁদুরের মতো চিবোনো যেত। সেও তো পোকা খেয়ে ভাঙা, আধভাঙা হয়ে বসে আছে। প্রায়ই পিতার সামনে হাঁ করে দাঁড়াতে হয়। ভাগ্য ভাল, তার সঁতও তেমন সুবিধের নয়। আমার গেছে যত্ন না নিয়ে, তার গেছে অতি যত্নে। যখনই সময় পান শক্ত বুরুশে ইঞ্চিখানেক পেস্ট নিয়ে খসর খসর করে ঘষতে থাকেন। ঘর্ষণে পাথর খয়ে যায়, দাঁতের এনামেল তো কা কথা।

বিজয়দা বলেছিলেন, সাইকেল শিখতে চাস? তা হলে সাইকেল হাঁটাতে শেখ।

বিজয়দা একটা মোটা খাতা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ট্যাক্স আদায় করতেন, আর আমি তার পেছন পেছন বিশাল ভারী এক র‍্যালে সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে পায়ের খিল খুলে মরি। মাঝে মাঝে। লগবগে হয়ে নর্দমায় পড়ে যাবার মতো হয়। প্যাডেলের খোঁচা খেয়ে পায়ের ছালচামড়া উঠে যায়। মাঝে মাঝে সংশয় জাগে, এতে আমার কী লাভ হচ্ছে! বিজয়দার মতে, এ হল জোড়ে হাঁটা। অনেকটা বিয়ের মতো। গাঁটছড়া বেঁধে সাত পা হাঁটলেই বোঝা যায়, যার সঙ্গে ঘর করতে চলেছ, তার ধাতটি কেমন! তিনি কোন দিকে টাল খান, চলন কেমন? জোড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় আরও কিছুটা বুঝে গেলে। সঙ্গে সঙ্গে তোমার ব্যালে এসে গেল। বুঝে গেলে, কীভাবে চড়তে হবে, চালাতে হবে। দু’চাকার সাইকেল আর স্ত্রীজাতি একই জিনিস। নাড়াচাড়া না করলে, দূর থেকে ধাত কি স্বভাব বোঝা যায় না। চালাতে জানলে চলবে, নয়তো ফেলে দেবে নালায়।

পিতারও সেই এক কথা। এ জীবনটা বইয়ের ধুলোটুলো ঝেড়ে নাও, নেড়েচেড়ে দেখে যাও, আসছেবার ভেতরে ঢুকতে পারবে। মানুষের মতো চেহারা হলেই মানুষ হয় না। জন্ম হল অঙ্কের। ব্যাপার, ফ্রিকোয়েন্সির ব্যাপার। এককোষী প্রাণী থেকে বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করে বহুঁকোষী। প্রাণী, ভেড়া, ছাগল, গাধা, ঘোড়া, বাঁদর, প্রথম মানুষ জনম। দেহ আকৃতি মানুষের মতো, ভেতরটা গাধা-বাঁদর কম্বিনেশন। গাধা যুক্ত নর ইজ ইকোয়াল টু গানর। গাবানর। সেই গল্পের মতো, মনুষ্যচর্মাবৃত একটি গর্দভ, লাস্ট বেঞ্চে বসে পেনসিল চিবোচ্ছে। দিনের অর্ধেক কেটে গেল নিলডাউন হয়ে হাতে থান ইট নিয়ে। এইবার জন্মে যাও। জন্মাতে জন্মাতে জন্মাতে নিউটন কি। রাসেল, র‍্যাফেল কি রোদেনস্টাইন। লাখখাবার জন্মালে তবেই আকৃতি আর প্রকৃতি দুটোতেই মানুষ। হবে। তার আগে নয়। দু’জন পাশাপাশি বসে আছে, ট্রেনে কি ট্রামে। দু’জনই মানুষের মতো। দেখতে। হলে হবে কী? একটু নাড়াচাড়া করে দেখলেই বেরিয়ে পড়বে, একজন মানুষ আর একজন কোটপ্যান্ট পরা বনমানুষ।

সোম থেকে শনি, বইয়ের ধুলো ঝাড়ার ক্যালেন্ডার তৈরিই আছে। রবিবার যেন লিপ ইয়ার। কাজের ওপর কাজ। সারা বাড়িতে গোটা চোদ্দো মোগলাই আলমারি। তার মাথা আছে, তলা আছে, দেয়ালের দিকে পিছন করা পৃষ্ঠদেশ আছে। চেয়ারের ওপর টুল ফিট করে মাথা সাফ করো। টুলের চারটে পায়াই স্ট্যান্ড-অ্যাট-ইজের ভঙ্গিতে ছেতরে থাকে। চেয়ারে তিনি কোনওক্রমে খাড়া হবেন। সবসময়েই ভয়, সীমানা ছেড়ে যে-কোনও একদিকে ঝুলে না পড়েন। জয় তারা বলে সেই মনুমেন্টে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, রাখে কেষ্ট মারে কে, মারে কেষ্ট রাখে কে! হাতে একটি ঝাড়ন। ঝাড়ো ধুলো। প্রথম ঝাঁপটাতেই নাকে কিছু ঢুকবে। সঙ্গে সঙ্গে গোটাতকত হাচি গেট-খোলা কুকুরের মতো তেড়ে বেরিয়ে আসবে। স্বর্গের কাছাকাছি জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই বিপুল হাঁচির বেগে টুলচ্যুত হয়ে দেবতার মর্তে পপাত হবার সম্ভাবনা যোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা হবে। পিতা তখন হয়তো এমরি পেপার ঘষে পোর্টম্যানের মরচে তুলছেন। কমলালেবু রং পালটে এবার নীল রং হবে। নিত্যনতুন রূপে সংসারকে সাজাতে হবে। নয়তো জীবনরসে ভাটা পড়বে। মাই ডিয়ার স্যার, স্ট্যাগনেশন ইজ ডেথ। শূন্যে তাকিয়ে পিতা বললেন, নাক টিপে, নাক টিপে।

সময় সময় নাকে রুমাল বেঁধে রঘু ডাকাতের বাচ্চা হয়ে ধুলো ঝাড়া চলে। সে বড় অসুবিধের। ডাকাতি আর ডাস্টিং, ডকারান্ত হলেও আকাশ পাতাল প্রভেদ, এক নয়। মাথা সাফাইয়ের পর তলা সাফ। সারা সপ্তাহের মালমশলা তলদেশে তরিবাদি করে জমিয়ে রাখা হয়েছে। হাঁটু গেড়ে বসে, ঘাড় হেঁট করে, খাটো ঝাটা দিয়ে টেনে টেনে বের করো। ইঁদুরের ডাইনিংরুম। শালপাতার ঠোঙা, পাউরুটির খোল, ভঁটার ছিবড়ে, মাছের কাটা, যখন যা পেরেছে, টেনে টেনে নিয়ে গেছে। ভোজের পর বিয়েবাড়ির বাইরের আঁস্তাকুড়ের অবস্থা। তকতকে পরিষ্কার চাই। মনে রাখবে, ক্লিনলিনেস ইজ নেক্সট টু গডলিনেস। দেয়াল আর আলমারির মাঝখানের অংশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাঘা বাঘা এক্সপ্লোরারদেরও অজানা, ডার্কেস্ট আফ্রিকা। মানচিত্রে স্থান নেই। ঝুল, মাকড়সা, আরশোলা। ড্রাকুলা, এমনকী ভ্যাম্পায়ার বেরোলেও অবাক হবার কিছু নেই।

সব শেষ, ভেতর। মাল নামাও, ঝাড়ো, আবার মাল তোলো৷ ওঠ বোস। বোস ওঠ। তখনই ভাবনা আসে, সংসার এক বিচিত্র পুতুলখেলা। কিছু বই, কিছু বাক্সপ্যাটরা, কৌটোকাটা, ন্যাকড়াচোপড়া, গোটাকতক শাল, আলোয়ান, জাম্পার, মাফলার, পুলওভার। সব নিয়ে ন্যাজেগোবরে। একবার এদিকে রাখছে, ওদিকে রাখছে। হিয়া কামাল হুয়া, হুয়া কা মাল হিয়া। তালা, চাবি, হিসেবের খাতা, ক্যাশবাক্স। রাবিশের হিসেব সামলাতে চুল পড়ে মাথায় মসৃণ টাক।

ভব পান্থবাসে এসে
কেঁদে কেঁদে হেসে হেসে
ভুগে ভুগে কেশে কেশে
দেশে দেশে ভেসে ভেসে

জীবনটা যে এত হিসেবের, আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না। সবসময়েই যেন যুদ্ধ চলেছে। একটু তালে ভুল হলেই ছিটকে চলে গেলে। আর ফেরার পথ নেই। শুধু এগিয়ে চলল, এগিয়ে চলো। কোথায়? আর কোনও জবাব নেই। থাকলেও, খুব হেঁয়ালির উত্তর। কেন? জীবনের লক্ষ্যে। কে যে কীসের লক্ষ্যে পৌঁছোচ্ছে। সবাই যেন সুকুমার রায়ের সেই লড়াই-খ্যাপা। কখনও যায় সামনে তেড়ে, কখনও যায় পাছে। উৎসাহেতে গরম হয়ে তিড়িং বিড়িং নাচে। মাতামহের কাছ থেকে পিতাঠাকুর একটি কথা শিখেছেন, ভোগ একপ্রকার রোগ বিশেষ। উঠতে বসতে এখন সেই নয়া বিধানের প্রয়োগ। ওই এক ব্ৰহ্মাস্ত্রে সব চাওয়া-পাওয়া ওঠাবসা খারিজ।

কেউ এসে বললেন, আহা ছেলেটার শরীর বড় খারাপ, একটু মেটের ঝোল, সঙ্গে একটি গুর্দা। দিতে পারলে গত্তি লাগত। সঙ্গে সঙ্গে খারিজ, ভোগ একপ্রকার রোগ বিশেষ। একটা করে নরম পাকের শাঁখ সন্দেশ? সঙ্গে সঙ্গে সেই এক খারিজ মন্ত্র। এর ওপর কোথা থেকে পাড়ায় এক মেনিদা নামক ভদ্রলোক এসেছেন! এসব মানুষের খবর পিতার বীর ভাণ্ডারে আসবেই। তিনি দশমাইল পথ হেঁটে অফিসে যান, হেঁটে ফিরে আসেন। অভাব নয়, স্বভাব। সব অসুখই তার প্রাকৃতিক চিকিৎসায় সারে। সর্দি-জ্বর! নাসে, মাসে, বাসে। তিনি প্রথম দুটি রেখে মাঝের মাংস দাওয়াইটি বাতিল করে দিয়েছেন। এ বেলা একটু সরষের তেল দু’নাকে সাঁ করে টেনে নাও, মেরে দাও এক গেলাস জল। ও বেলাও তাই। নাস আর উপবাস। তারপর ছোট্ট একটি গালাগাল সহ উপসংহার, সর্দিজ্বরের বাবা সারবে শালা। পেটের গোলমাল? তলপেটে মৃত্তিকার প্রলেপ। প্রথমে উলঙ্গ। দ্বিতীয় ধাপে, মাটি ফাইন করে মেড়ে সেরটাক তলপেটে চাপিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকো। শুকোতে শুকোতে একসময় ঝরতে থাকবে। পেটে তিনবার চাটি মেরে উঠে পড়ো। এই সর্বনেশে মানুষটি আমার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। চেহারা শুষ্কং কাষ্ঠং। মানুষের পক্ষে এর চেয়ে রোগা হওয়া সম্ভব নয়। এই বস্তুটির সঙ্গে একজন স্ত্রীজাতি আছেন। তার তৈরি প্রায় আধ ডজনের মতো ভবিষ্যতের স্ত্রী-পুং মেনি আছে। আমার বন্ধু সুখেন একটু অকালে পেকেছে। নরনারীর যৌন জীবন নিয়ে তার নিত্যনতুন আলোকপাতে আমরা সময় সময় বেসামাল হয়ে পড়ি। সে বলে পুং মেনি আর স্ত্রী মেনির ঘর্ষণে রাতে ওঁদের উত্তরের ঘরে আগুন জ্বলে। কাঠে কাঠে ঘষা লাগলে কী হয় রে ব্যাটা? দুটোই তো চকমকি? ডজন কমপ্লিট করে রিটায়ার করবে। সে যাই হোক। কে কী করবে, তা নিয়ে সুখেনের মাথাব্যথা থাকলেও আমার নেই। সেদিন গভীর রাতে মেনিদা বাড়ি ফিরে শোবার ঘরের জানলার গরাদে হাত আলুলায়িত করে মিসেস মেনিকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছেন। গলা প্রেমরসে টসটসে। ঘুমচোখে স্বামীর মুখ দেখে স্ত্রী বুবু করে অজ্ঞান। মুখে গাজলা। ছোট্ট পাড়া। তা ছাড়া যে-পাড়ায় সুখেনের মতো প্রতিভা, সে পাড়ায় এমন একটা ঘটনা, কাগজে ছাপা না হলেও, ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয় না।

এই ক’দিন একটু বিশ্রাম পাওয়া গেল। শরীর ঢকঢকে হয়ে আছে। সবসময় ঘুম পাচ্ছে। মনের দেয়ালে আরাম হারাম হায় বাণীটি সবসময় ঝোলানো থাকলেও, শুলে উঠতে ইচ্ছে করে না, বসলে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। বেশ ঘুমঘুম চোখে, হাই তুলে তুলে দিন কাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আকাশ, গাছের পাতা, পাখি, রাস্তায় মানুষের স্রোত দেখে দেখে ক্রমশই দার্শনিক হয়ে উঠছি। আমি চাই না মাগো রাজা হতে। উঠতে গেলে হাত পা কাপে। বেশ আছি মা এলিয়ে বসে!

দোতলার বারান্দা। জানলার কাছে বেঞ্চ পাতা। দেয়ালে পিঠ। ঠ্যাং দুটো সোজা ছড়ানো। পায়ের পাতার ওপর পাতা। বাঁ পাশে টেবিল। টেবিলের ওপর বাঁ হাত আলগোছা ঝুলছে। এক বিঘত দূরে একটি বই, রজেটস থেসারস। একটি ইংরেজি কাগজ। কর্মখালির বিজ্ঞাপনের পাতায় এখানে-ওখানে লাল পেনসিলের ঢ্যাঁড়া মারা। কর্মস্থলে যাবার আগে দুটি নির্দেশ আমার জন্যে রেখে গেছেন। থেসারস মুখস্থ করে যাও। ওই বিদ্যেটি তো ভালই জানা আছে। অঙ্কের মগজ থাক আর না-থাক। ইংরেজিটা যদি ভাল করে রপ্ত করতে পারো, তা হলে কোনওমতে দু’বেলা দুটো অন্ন হয়তো জুটবে। পিতার হোটেল চিরকাল ভোলা থাকবে না রে দামড়া। দ্বিতীয় নির্দেশ, ঢ্যাঁড়ামারা জায়গায় চিঠি ছেড়ে যাও। বলা যায় না লাগলেও লেগে যেতে পারে। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো ভাই, মিলিলেও মিলিতে পারে পরশপাথর। দুটো কাজই বেশি এগোয়নি। আকাশে মেঘের ফর্মেশনে হিমালয়। শরীরে তাগত এলেই, একদিন উড়বে সাধের ময়না। মাটির চেয়ে আকাশ কত উদার! এখানে কচু, ঘেঁচু, মুলো, ময়লা, আবর্জনা, গোঁফ, দাড়ি, ঘামের গন্ধ, তিরস্কার। ওপরে, ট্রপোস্ফিয়ার, আয়নোস্ফিয়ার, ইথার, ওজোন, মেঘ, পাখি, মহাওঙ্কারধ্বনি। নীচে ভাগাভাগি, মারামারি, পাঁচিল তোলাতুলি, পার্টিশন, ডিক্রি। অস্থির পঞ্চম অবস্থা।

রাস্তার দিকেই চোখ ছিল। একটা গাড়ি আসছে। আমাদের বাড়ির সামনেই থামল। এই ভূতমহলে, অসময়ে, বিনা নোটিশে কার আগমন রে বাবা! দরজা খুলে সামনের আসন থেকে যিনি নামলেন, তার চেহারা ডবলডিমের ওমলেটের মতো। সাদা জিনের প্যান্ট, হাফহাতা সাদা জামা, মাথায় একটা শোলার টুপি। মুখ দেখা যাচ্ছে না। সামনে ভুড়ি ঠেলে আছে আধ হাত। জল-ভরা বেলুনের মতো থিরিথিরি নাচছে। বাড়ির ঠিকানা দেখে হুংকার ছাড়লেন, হ্যাঁ, এই তো সাতান্ন নম্বর। ঠিক এসেছি। নেমে আয়।

নেমে আয় বলামাত্রই আমি পা গুটিয়ে নিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছি। কে নামে, কে নামে! পেছনের আসন থেকে একটা পা ঝুলে পড়ল। সুন্দর মনোহর লেডিজ স্লিপার। ফুলফুল শাড়ির প্রান্ত। সর্বনাশ! মহিলা। একজন নয়, ওয়ান আফটার এনাদার, দু’জন। বুড়ি নয়, যুবতী। খেল খতম, পয়সা হজম। নির্জন বাড়িতে বেঞ্চে বসে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হবার বারোটা বেজে গেল। বুকের মধ্যে ভয় হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে। কী করে সামলাব এই অপ্সরাদের। জিভ উলটে টাগরায় গিয়ে ঠেকেছে। মেয়ে দেখলেই আমি অবশ হয়ে পড়ি। খাটের তলায় কি জালার কোণে ঢুকে লুকোতে ইচ্ছে করে। আমি তো সুখেন নই।

সদরের কড়া নড়ে উঠল। মাথায় টুপি থাকায় ভদ্রলোক আমাকে দেখতে পাননি। টুপির কার্নিসে দৃষ্টি ঠোক্কর খেয়েছে। মেয়েদুটি ওপরে চোখ ঘুরিয়েই আমাকে দেখে ফেলেছে। আমার ছাগলদাড়ি, শীর্ণ ঘোড়ার মতো মুখ, দুটো ড্যাব ড্যাবা নির্বোধের মতো চোখ, বকের মতো গলা। এমন ভজুয়া-মার্কা চেহারা আর দুটি নেই।

সদর খুলে সামনে দাঁড়াতে হল। ভদ্রলোক টুপি খুলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি? হরিবাবুর ছেলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বাবা কোথায়?

অফিসে।

জানতে আমরা আসব?

আজ্ঞে না।

একটা চিঠি পাওনি তোমরা?

না তো!

তা হলে জানো না আমরা কে?

আজ্ঞে না।

না জানাই স্বাভাবিক।

চৌকাঠের এপারে আমাকে সাসপেন্সে রেখে ভদ্রলোক ড্রাইভার আর মেয়েদের বললেন, এই সামান উতারো। মেয়ে দুটির নজর আর আমার ওপর নেই। একবারই চোখে চোখে ঠোকাঠুকি হয়েছিল। এমন কিছু দর্শনীয় বস্তু নয়। অনেকটা রামছাগলের মতো। চারটের বদলে দুটো কেঠো কেঠো লিকলিকে পা। বরং বাড়িটা দর্শনীয়। নাম্বার ওয়ান নাম্বার টু-কে চোখ উলটে বললে, দেখেছিস মুকু, বাড়িটা কী ভীষণ পুরনো। ঘাড়ে ভেঙে পড়বে না তো!

যাক, একজনের নাম জানা গেল মুকু। পরক্ষণেই জানা গেল আর একজনের নাম, কনক। ভদ্রলোক ভেতরে থেকে একটা সুটকেস বের করে বললেন, দাঁড়িয়ে থেকো না কনক। সাহায্য করো, সাহায্য করো।

মুকু ছোট, কনক বড়। মুকু খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললে, দিদি, এ যেন স্বর্গের সিঁড়ি রে। দু’জনেরই হাতে মালপত্র। আমার ভাগে পড়েছে সুন্দর একটি বেতের বাস্কেট। জীবনে এমন বস্তু দেখিনি, দেখবও না। সর্ব অঙ্গে কারুকাজ। পিতার ভাষায় বলতে হয়, আহা, একটা ওয়ার্ক অফ আর্ট। নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে, মন খারাপ করে ঘণ্টাখানেক বসে থাকো। অনুশোচনায় অন্তশুদ্ধি হয়।

দোতলার বারান্দায় মালপত্তর এসে জমল। বেশি কিছু না, গোটা তিনেক সুটকেস, একটা বেডরোল, বিশাল একটা স্টিল ট্রাঙ্ক। ওপরে আনতে ভদ্রলোক আর গাড়ির ড্রাইভার হিমশিম খেয়ে গেলেন। রিয়েল মাল যদি কিছু থাকে তো ওর মধ্যেই আছে। আরও গোটা দুই বেতের বাস্কেট আর হাতব্যাগ। দুই বোন, একবার এদিকে ফিরছে, একবার ওদিকে ঝুঁকছে। একবার এটা তুলছে, ওটা নামাচ্ছে। চুলের বেণি চাবুকের মতো, গোরুর ন্যাজের মতো সপাসপ ডাইনে বাঁয়ে দোল খাচ্ছে। কথায় বলে, আহা, তিনি যেন ঘর আলো করে বসে আছেন! সত্যিই তাই। দুই বোন যেখানে যাচ্ছে, যেদিকে ছুটছে সেই দিকটাই আলো হয়ে যাচ্ছে। অমাবস্যা আর পূর্ণিমার একই সঙ্গে আবির্ভাব। স্বামী ঘুটঘুটানন্দের হাত ধরে দুই ফুটফুটান। এখন বেশ গলা ছেড়েই গাওয়া যায়, আমার ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো কে দেখবি আয়।

অস্পষ্ট একটা পরিচয় পাওয়া গেল। মেজ জ্যাঠাইমার বোনের স্বামী। বহুকাল আগে একবার এসেছিলেন। থাকতেন রেঙ্গুনে। আইনজীবী ছিলেন। তখন আমাদের সংসার জমজমাট। সুন্দরী। সুন্দরী বউ। পিসিমাদের আসাযাওয়া। অতিথি অভ্যাগত। গানবাজনা। পায়ে পায়ে ঘুরছে সাদা সাদা কাবলি বেড়াল। হাজার টাকার ঝাড়বাতি জ্বলছে। বাড়িটাও তখন এত জরাজীর্ণ হয়ে যায়নি। তারপর অদৃশ্য মৃত্যু এল কালো ওড়না গায়ে দিয়ে। আমরা তখন গভীর ঘুমে। ফুঁ দিয়ে একটি একটি করে বাতি নিবিয়ে দিয়ে গেল। সব মৃত্যুই শেষ রাতে। অদ্ভুত অদৃষ্ট লিপি। অসুখ, মৃত্যু, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বোঝার মতো বড় তখনও হইনি। খুব ছোট গাছ। ঝড় বইছে ওপরে। ডালপালা নড়ছে। শব্দ শুনছি। গায়ে লাগছে না। ভোরে উঠে দেখি দীপ নিবে গেছে। ফিকে ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে। পাকিয়ে। যে ছিল সে আর নেই। শূন্য ঘর। শূন্য শয্যা। এ কেমন যাওয়া! কেউ তেমন সহজ করে বলতেই পারে না। কেন যাওয়া, কেনই বা তবে আসা। শিশুকে বোঝানো হত, তিনি গেছেন, দূরে, আসবেন, তবে দেরি হবে। এই নাও, তোমার ছবির বই, খেলনা, এয়ারগান। ভুলে যাও, ভুলে থাকো। মেতে থাকো। সংসারে অনেক কাজ, অনেক আশা। খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে খোলা ছাদে। রাতে যার মাথার ওপর থমকে থাকে তারা-চমকানো আকাশ। সেই সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে। সন্ধেবেলা রোজই গা ছমছম করে উঠত। মনে হত আজও সে আসবে নাকি! ভোরে উঠে দেখব আমাদের আর একজন কেউ নেই। সেই চলে যাওয়া আর ফিরে না-আসার অভিমান মনের সুরটাই চিরকালের জন্যে এমনভাবে বেঁধে দিয়ে গেছে, এখনও ঠোঁট ফোলে। মনে হয় তারা আছেন যাঁরা নেই। নির্জন দুপুরে এ বয়েসের সংলাপ:

যারা ছিল একদিন; কথা দিয়ে, চলে গেছে যারা;
যাদের আগমবার্তা মিছে বলে বুঝেছি নিশ্চয়;
স্বয়ম্ভ সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয়
আকস্মিক দুরাশায় থেকে থেকে করিবে ইশারা ॥

কিছুই তো মনে নেই সেদিনের কথা। শীতের সকালে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। অস্বচ্ছ পরদার আড়ালে পড়ে আছে জীবনের ফেলে আসা দিন। কে হাত ধরেছিল; কে কোলে নিয়েছিল, কে চুমু খেয়েছিল আদর করে! সবই অস্পষ্ট, ভাসা ভাসা। কল্পনা করা যায়, জোর করে কিছু বলা যায় না। আজ জ্যাঠাইমাও নেই, জ্যাঠামশাইও নেই। কিছু আগে পরে দু’জনেই চলে গেছেন।

টেবিলের ওপর টুপি নামিয়ে রেখেছেন। মাথার চুলে কমান্ডার কাট। চোখদুটো মাংসর চাপে ছোট ঘোট। মুখ গোলাকার। দুটি চিবুক তৈরি হয়েছে। বেল্টের চাপে পেট ফাটোফাটো। মানুষের মন কত খারাপ দিকে ছোটে! হঠাৎ মনে হল, এইরকম ভদ্রলোকের কেমন করে এমন সুন্দর দুটি মেয়ে হল? অবাক কাণ্ড! জন্ম রহস্যটা যদি জানা যেত! মনকে এক ধমক, ব্যাটা! পড়াশোনা চুলোয় গেল, যা জানলে কাজ হয় তা জানা হল না। জন্ম-রহস্য!

দু’পাশে দুটো পা ছড়িয়ে ভদ্রলোক বসেছেন। মাথার চুলে কুচুর কুচুর হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, আমি তা হলে গিয়ে তোমার মেসো হলুম।

যা হয় একটা কিছু হলেই হল। একটা ব্যাপার লক্ষ করে বেশ অবাক হচ্ছি। সেটা হল আমার শরীর। এতক্ষণের দুর্বলতা, কিছু না করার ইচ্ছে, আলস্য, সব হাওয়া। শরীরে যেন বেশ বল এসে। গেছে। কামিনী আর কাঞ্চন, এর চেয়ে ভাল টনিক আর কী আছে! আমার কথা নয়, নির্মল পাগলার। খুব জ্ঞানী মানুষ। গোটাকতক বিষয়ে এম এ সব ক’টাতেই ফার্স্টক্লাস। পড়ে পড়ে পাগল। জমিদারের ছেলে। নেই নেই করে এখনও বেশ আছে। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন। মালকোঁচা মারা ধুতি। শার্টের ওপর গেঞ্জি। ধুতির ওপর আন্ডারওয়ার। লোকে যা করে তিনি তার উলটোটাই করবেন। নির্মলদার গল্প, বাহাত্তর বছরের বুড়ো, খাবিখাওয়া অবস্থা। উঠোনে কেত্তন-পার্টি রেডি। খোলের ওপর হাত নিসপিস করছে। বুড়ি ঘর থেকে কেঁদে উঠলেই কপাক কপাক করে খোল বেজে উঠবে। বুড়োর চোখ গেল দরজার দিকে। রকে বসে মানদা বাসন মাজছে কোমর দুলিয়ে। বেশ উঁশা যৌবন। বুড়ো থপাক করে খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল। আরে করো কী করো কী?

বড় অশ্লীল!

নির্মলদা বলবেন, চপ শালা। সারা পৃথিবীতে মানুষের শরীরে মাদল বাজছে। কামের জন্যেই come. পুড়ে ছাই হলে তবেই calm, ওসব সাধুগিরি আমার কাছে ফলাতে আসিসনি। নির্মলদার রণহুংকার:

I storm and I roar, and I fall in a rage,
and, missing my whore, I bugger my page.

কী জানি বাবা, কীসে কী হয়। আমার এই ভাবনা পিতাঠাকুর কোনওক্রমে জানতে পারলে হতাশায় আত্মহত্যা করবেন। উঃ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! কেন যে ছেলেরা পিতার হাতছাড়া হয়ে যায়! বড় ভাবনার কথা!

একটু গরম জল হলে…মেসোমশাই কিন্তু কিন্তু গলায় বললেন।

চা? আমার প্রশ্ন! একটু চা করে এঁদের সেবা করতে পারলে ভাবব, তবু একটা কাজের কাজ হল।

না, চা আমরা কেউই খাই না। তোমার নামটা কী বাবা? ভুলে গেছি, অনেকদিন আগে একবারই তো এসেছিলুম, তখন তুমি এতটুকু।

আমার নাম পিন্টু। গরম জল কী করবেন?

স্নান করতে হবে। নতুন জায়গা, ঠান্ডা জল গায়ে ঢালতে চাই না।

খুবই চিন্তার কথা। প্রাইমাস স্টোভে চায়ের জল গরম হতে পারে, তিনজনের স্নানের জল গরম করতে হলে উনুন ধরাতে হবে। সে এক ভয়ংকর ব্যাপার।

একটু বসুন তা হলে, উনুন ধরাই।

তুমি ধরাবে কেন? কনক! মেয়েকে ডাকলেন।

দু’বোন কিছু দূরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। কীভাবে কী করবে বুঝতেই পারছিল না। শূন্য বাড়ি। কোনও মহিলা নেই। প্রায় ধর্মশালার মতোই।

আসি, বলে কনক জানলার ধার থেকে সরে এল।

তুমি সব দেখেশুনে নাও। তোমাদের দু’বোনকেই সব করতে হবে বাপু। আসার পথে বাজার দেখে এলুম, আমি কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে আসি।

সবই বাড়িতে আছে। আপনাকে আর বাজারে যেতে হবে না। ডিম আছে, তরিতরকারি আছে, চাল, ডাল সব আছে।

তা হলেও!

তা হলে আবার কী?

বেশ, যা আছে তাইতেই হোক। তোমার বাবা আসুন, তারপর যা-হয় হবে। কনক, তুমি ওদিক। সামলাও, মুকু, তুমি এদিকে সব খুলেটুলে ফেলো। আগে স্নান, তারপর কাপড়টাপড় ছেড়ে রান্না। সামান্য কিছু করলেই হবে। বেশি বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই।

আমাদের রান্নাঘর আর এক মহলে। দুটি মহল বারান্দা দিয়ে জোড়া। বারান্দার বাঁক ঘুরতে ঘুরতে কনক বললে, বাঃ, তোমাদের বাড়ির এদিকটা তো ভারী সুন্দর। ওদিকটা শহর, এদিকটা গ্রাম।

আজ্ঞে হ্যাঁ, গাছপালা রয়েছে তো। একটু এগোলেই গঙ্গা।

আমাকে অত ভক্তি করে আজ্ঞে বলতে হবে না। আমি তোমার দিদি নই।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আবার সেই আজ্ঞে?

কী করি বলুন, কীরকম একটা অভ্যাস হয়ে গেছে।

আবার বলুন! আমার সঙ্গে খবরদার আপনি আজ্ঞে করবে না। নীচেটায় পাতকো বুঝি? বারান্দার ভাঙা রেলিং ধরে সামান্য ঝুঁকতেই আ-হা আহা করে হাতের ওপরদিকটা ধরে আমি টেনে নিলুম, ভাঙা, ভাঙা, পড়ে যেতে পারেন।

কোথায় ভাঙা?

এই যে রেলিং। সারা বাড়িটাই তো ভেঙেচুরে খলখলে।

একটু সারাওটারাও না কেন? এমন সুন্দর বাড়ি! কত বড় বলো তো।

টুকটাক সারাই বাবা নিজের হাতেই করেন। বিরাট ব্যাপার তো, একা ঠিক সামলাতে পারেন না। আর আমি তো একটা অপদার্থ।

তুমি কী করবে? মিস্ত্রি লাগালেই তো হয়!

বাবা বলেন, সেলফ হেলপ ইজ বেস্ট হেলপ।

পিতাঠাকুর রান্নাঘরটিকে সকালেই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখে গেছেন। কথায় কথায় বলেন, এ হল পুরুষের কিচেন, মেয়েদের হেঁশেল নয়। আঁস্তাকুড় আর আঁতুড় এই হল বাঙালির দুই বৈশিষ্ট্য। রান্নাঘরের সামনে বারান্দা পুব দিকে কিছু প্রশস্ত। সেই অংশে গুছিয়ে রাখা কয়লা আর ঘুঁটে। ওই যে নীচের বাগানে পড়ে আছে কয়লার রঙে কালো একটি পাথর, পাশেই সদ্যোজাত সন্তানের মতো গড়াগড়ি যাচ্ছে একটি হামানদিস্তের হাতল। কয়লা আগে ওইখানে আসবে। ঘণ্টাখানেকের পরিশ্রমে টুকরো টুকরো হয়ে, ভারে ভারে ওপরে উঠবে।

কনক বললে, বাঃ ভারী পরিষ্কার তো! কে এমন সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে? তুমি?

না, ফাদার।

বাব্বাঃ, মেয়েছেলেও হার মেনে যাবে!

মনে মনে ভাবলুম মেয়েছেলে? মেয়েছেলে সম্পর্কে পিতার ধারণার কথা জানলে মেয়েছেলে হয়ে জন্মাবার সাধ চিরকালের মতো ঘুচে যাবে।

আমি তা হলে লেগে পড়ি, কী বলে?

শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে কনক কয়লার গাদার সামনে উবু হয়ে বসল। শাড়িটা মনে হয় বেশ দামি। কয়লার গুঁড়োয় ময়লা হয়ে যাবার সম্ভাবনা। এ কার্যটি তো রোজ সকালে আমাকেই করতে হয়। আমিই কেন হাত লাগাই না! এর নামই বোধহয় দুর্বলতা! কোনও গুফো লোক যদি এই মুহূর্তে কয়লার গাদায় বসতেন আমার মন কি এমন আকুলি-বিকুলি করত!

সরুন, আমি উনুন সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে দিই।

কেন?

শাড়িতে কালি লেগে যাবে যে!

বাঃ, লজ্জা তো বেশ কেটে এসেছে! জিভ তো আর তেমন জড়িয়ে যাচ্ছে না। কেমন মিঠি মিঠি বাত বেরোচ্ছে! এর নামই কি অ্যাটাচমেন্ট! পিতা যেমন মাঝেমধ্যে জগৎ-সংসারের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়েন, ছায়া, মায়া, কায়া।

কয়লা তোলার, নিয়ে যাবার অনেক সাজসরঞ্জাম আছে। পিতার উদ্ভাবন। হাত না ঠেকালেও চলে। যেমন মিনি বেলচা। ছোট বালতি। কয়লার গাদায় বেলচা চালাতেই এঁকেবেঁকে কিলিবিলি করে লাল মতো যে প্রাণীটি বেরিয়ে এল, সেটি একটি মধ্যম মাপের দাঁড়াটাড়াঅলা তেঁতুলে বিছে। গেঁটে গেঁটে শরীর।

মা গো, বলে কনক স্প্রিং-এর ইঁদুরের মতো লাফিয়ে সরে গেল। আমার তো তেমন সাহস নেই। ভিতুই বলা চলে। কনকের শরীরের আড়াল থেকে সেই রসহীন শুষ্ক প্রাণীটিকে একবার দেখে। নিলুম। চালচলন আমার মতোই উদ্দেশ্যহীন। নিতান্ত ভীরু ব্যক্তিও বাহবার লোভে বড় কাজ করে ফেলে। আমার উক্তি নয়, স্বামী বিবেকানন্দের। ভাগ্যিস পা দিয়ে ঘেঁতো করার চেষ্টা করিনি। বেলচা দিয়ে এক ঘা লাগাতেই তিনি কেতরে কেতরে আবার কয়লার গাদায় গিয়ে ঢুকলেন।

কনক বললে, এইবার কী হবে?

বীরের উক্তি, কী আবার হবে? পাশ থেকে কয়লা নিয়ে উনুন ধরাব।

যদি কামড়ায়?

ওষুধ আছে। কেরোসিন তেলে কয়লা ঘষে লাগিয়ে দোব। কিছুক্ষণ জ্বলবে, তারপর সব ঠান্ডা।

তোমাদের বাড়িতে আর কী কী আছে?

আর এক রকম বিছে আছে, তার নাম কঁকড়া বিছে। নীচের বাগানে গোটাকতক পোষা সাপ আছে। বড় বড় পাঞ্জামাপের মাকড়সা আছে। টনখানেক আরশোলা আছে। ইঁদুর আর ছুঁচোর অভাব নেই। সন্ধেবেলা বেশ বড় সাইজের একটা চামচিকি বেড়াতে আসে। মাঝরাতে চিলেকোঠায় বসে। ডাকে একজোড়া প্যাচা।

মহীশুরের টানাটানা চোখ, পাঞ্জাবের খাড়া নাক আর কুলু আপেলের রঙে রাঙানো গাল নিয়ে কনক অবাক হয়ে চেয়ে রইল। নাকের ডগায় ছাঁট-হিরে ঘাম।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন