২.৩৫ জীব আজ সমরে

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

জীব আজ সমরে, রণবেশে কাল প্রবেশে তোর ঘরে।
ভক্তিরথে চড়ি, লয়ে জ্ঞানতৃণ, রসনাধনুকে দিয়ে প্রেমগুণ,
ব্রহ্মময়ীর নাম ব্রহ্ম-অস্ত্র তাহে সন্ধান করে।।

সিল্ক টুইলের সাদা ধবধবে শার্ট। গলার একেবারে ওপরের বোতামটা পর্যন্ত টাইট করে লাগানো। একমুখ পান। বেঁটেখাটো হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। সামনে সিঁথি। বসে আছেন হরিশঙ্করের ছোটমামা। অকৃতদার। তন্ত্রসাধক। বেশিরভাগ সময় তারাপীঠেই থাকেন। শবসাধনা করেছেন। অলৌকিক শক্তির অধিকারী। বাইরে থেকে দেখলে কিছুই বোঝা যাবে না। যারা অন্তরঙ্গ তারা ভয় আর ভক্তি দুটোই করেন। একটু খোঁচাখুঁচি যিনিই করেছেন তিনিই মরেছেন। প্রত্যেক মানুষের জীবনেরই একটা গোপন দিক থাকে। সর্বসমক্ষে তার গোপনীয়তা উন্মোচিত হলে লজ্জার একশেষ। এই সাধক তার অহংকার চূর্ণ বিচুর্ণ করে দেন, তখন আর তিনি পালাবার পথ পান না। এঁর অন্তর্দৃষ্টির সামনে সবাই কাঁচের মানুষ। আমার সামনেই কতবার এমন ঘটনা ঘটেছে।

একবার এক বড় ডাক্তার এসেছেন খোঁচাখুঁচি করতে। সন্দেহবাদী, অলৌকিকে বিশ্বাস নেই। বিলিতি ডিগ্রিধারী। বিশাল পসার। এসেছেন শক্তি পরীক্ষা করতে। খুব দগদগে কথা বলছেন, শবসাধনা? কী আছে মশাই শবে! জাস্ট এ ডেডবডি। বরং একটা কঙ্কালের প্রয়োজনীয়তা আছে। অ্যানাটমির ছাত্রের কাজে লাগে। অমন ডেডবডি আমরা বহুবার ডিসেক্ট করেছি। তা হলে তো । আমরাও অলৌকিক শক্তির অধিকারী, কী বলেন মিস্টার ব্যানার্জি?

ছোটদাদু মিচকি হাসছেন।

ডাক্তার বলছেন, আমাদের ধর্ম থেকে এই বুজরুকিটা না গেলে শিক্ষিত লোক কোনওদিনই ভিড়বে না। বোকা আর অশিক্ষিত মানুষরাই এই ফঁদে পা দেবে। গুরুদের এই ব্যাবসাদারি ক্রিমিনাল অফে।

ছোটদাদুর মুখে পান ছিল। ছিবড়েটা ফেলে মুখ খালি করলেন। ভঁজ করা সাদা রুমালে পাতলা ঠোঁটদুটো সাবধানে মুছলেন। প্রস্তুত হচ্ছেন। আমরা যারা জানি, বসে আছি থম মেরে। পরিচিত

যে-ভদ্রলোক ডাক্তারবাবুকে এনেছেন তিনি মহা বিব্রত।

ছোটদাদু বললেন, কেন এসেছেন?

ডাক্তার বললেন, খুব প্রচার আপনার, মুখ দেখে মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দেন!

ছোটদাদু বললেন, তিনটেই জানতে চান, না চারটে? ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান এই নিয়ে ইহকাল, তারপর একটা আছে পরকাল।

ডাক্তার বললেন, পরকাল তো একটা আজগুবি গল্প, যা বলবেন তাই মানতে হবে! ইহকালটাই হোক। তবে তাই হোক, বলে ছোটদাদু অদ্ভুত হাসলেন। এক টিপ নস্যি নিলেন। এইবার জামার পকেট থেকে একটা রুমাল বেরোল। খাড়া খঙ্গের মতো নাক। নাক মুছলেন, তারপর বললেন, অফিসের ক্যাশ ভেঙে জেলে যেতে হচ্ছিল, আত্মহত্যা করলেন, তারপর মামার বাড়িতেই মানুষ। মামাদের প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতা জানালেন মামাতো বোনটিকে নষ্ট করে। ভালই করেছেন। কিন্তু আপনার এমন স্বাস্থ্য, পারেন না কেন? ইমপোটেন্ট হয়ে পড়েছেন। স্ত্রী তো অন্যভাবে অন্য লোকের সঙ্গে জীবন কাটাচ্ছে। ডিসগ্রেসফুল। রোজগার তো কম নয়, জীবনের শান্তি কোথায় ডাক্তার? আমাকে পরীক্ষা না করে নিজেকে পরীক্ষা করান। ফিজিশিয়ান হিল দাইসেলফ। নিজের স্ত্রীকে অন্যের সঙ্গে দেখতে ভাল লাগে ডাক্তার? ডিসগ্রেসফুল। মাত্রাতিরিক্ত সেলফ অ্যাবিউজের ফল। বউ এখন ব্ল্যাকমেল করছে। সো স্যাড। আপনারই পয়সা অন্যের জন্যে দু’হাতে ওড়াচ্ছে। ছেলেটা যে আপনার নয় সে আপনি ভালই জানেন। বাবা বলে যখন ডাকে লজ্জা পান, তাই না ডাক্তার?

ডাক্তার স্তম্ভিত। মুখ কালো। মাথা হেঁট। শেষে কাঁদোকাঁদো অবস্থা।

ছোটদাদু বলেই চলেছেন, আপনার বাড়ির উত্তর দিকের হলদে বাড়ির ফরসামতো ছেলেটা এখন আপনার স্ত্রীর ইজারা নিয়েছে। অতীত আর বর্তমানের একটুখানি হল, এইবার ভবিষ্যৎ। পাঁচ বছরের মধ্যেই আপনার স্ত্রী পাগল হয়ে যাবে। আর যে আপনার ছেলে বলে পরিচিত, সে । আপনাকে বাড়ি ছাড়া করবে। ভবিষ্যতের দিকে আর একটু এগোই? আপনার পার্কিনসনস ডিজিজ হবে। সেটা কী নিশ্চয় জানেন। ভেবে দেখো, শেষের সেদিন কী ভয়ংকর! কেন এমন হবে! প্রারব্ধ। কেন এমন হবে? তামসিক অহংকার হল আপনার ঘোড়ার জকি। সে যেমন চালাচ্ছে, তেমনি চলছেন আপনি। টাকার গরম, পসারের গরম, মোসায়েবদের মালিশ আর আলগা চরিত্রের কিছু মহিলা দিলে সর্বনাশ করে। এরপর ময়লা বিছানায় শুয়ে থরথর করে কাপবেন। কাপড়েচোপড়ে মাখামাখি। পাশে থাকবে একজন, সে আপনার বিধবা বোন, যাকে আপনি এখন বাড়ি ঢুকতে দেন না। আর কিছু জানতে চান ডাক্তার? সামথিং কংক্রিট? অ্যান্ড হিয়ার ইট ইজ। আপনার কাছে এখন তিন হাজার সাতশো কুড়ি টাকা বারো আনা আছে। দুটো মরফিনের অ্যাম্পুল আছে, সন্ধেবেলা আপনার নিজেরই লাগবে। গাড়িতে এক বোতল বিলিতি হুইস্কি আছে। নোংরা ছবির বই আছে। একটা। আরও গভীরে যাব? আপনার প্রাইভেট পার্টসে সম্প্রতি একটা ঘা হয়েছে। ওপাশে ক’দিন হল পাইলস খুব ভোগাচ্ছে। ফিসচুলার দিকে যাচ্ছে। আরও চাই ডাক্তার? এনিথিং মোর ইউ। ওয়ান্ট!

ডাক্তার কেঁদে ফেললেন। একটা তালগোল পাকানো মাংসপিণ্ডের মতো হয়ে গেলেন। অতিকষ্টে বললেন, আমাকে বাঁচান।

ছোটদাদু বললেন, বাঁচানো যায় না, তবে সহ্যশক্তিটা বাড়িয়ে দেওয়া যায়, টলারেন্স। ফুটবাথের মতো। ভীষণ গরম জল। ধীরে ধীরে সহ্য করার শক্তি বেড়ে গেলে আর পা ডুবিয়ে বসে থাকতে অসুবিধে হয় না। সহজ ব্যাপার। এর জন্যে কী করতে হবে? স্লেটের সব লেখা সাত্ত্বিক ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফেলতে হবে। ত্যাগ আর তিতিক্ষার পেনসিল দিয়ে ফোঁটাতে হবে নতুন বর্ণমালা।

সেই ডাক্তার এখন দাদুর প্রধান শিষ্যদের একজন। বেশিরভাগ সময় আশ্রমেই থাকেন। শান্ত সমাহিত এক নতুন মানুষ। এইরকম অজস্র ঘটনা আছে দাদুর জীবনে। একবার একদল গুন্ডা। কালীপুজোর রাতে দাদুকে মারতে এসেছিল। সামনে গিয়ে দু’হাত তুলে দাঁড়ালেন। সব স্থাণু। কেউ আর নড়েও না চড়েও না। শেষে ছোটদাদু বললেন, আচ্ছা! তা হলে তোমরা এইবার যাও। একটা মৌন মিছিল ধীরে ধীরে চলে গেল। সব যেন নেশায় বুঁদ।

হরিশঙ্কর মুখে না বললেও এই ঘোটদাদুকেই গুরু বলে মেনে নিয়েছেন। হরিশঙ্কর অলৌকিক কিছু বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান, কর্ম, সাধনা আর পবিত্র জীবন। বিয়ে করে কেউ সংসারে ঢুকলে আক্ষেপ করে বলেন, যাঃ হয়ে গেল। জীবনের ডানা ভেঙে গেল। ছোটমামা বিয়ে। করেননি, সেটা একটা পয়েন্ট। বিয়ে তো করেননি, অনেকে বিয়ে না করেও নারীসঙ্গের জন্যে ছেকছেক করেন, ছোটমামা তা করেন না। কামজয়ী সাধক। পয়েন্ট দুই। তিন নম্বর, প্রবল সাধনভজন করেন। চার নম্বর, পবিত্র জীবনযাপন, কদাচারী তান্ত্রিক নন। পরমাশক্তির উপাসক। ছোটদাদুকে আমি শ্রদ্ধা করি, কারণ তিনি আমাকে ভয়ংকর ভালবাসেন। আমার চোখের সামনে তুলে ধরেন আমার ভবিষ্যৎ মহৎ জীবনের ছবি। কেবল বলেন, তুমি কী হবে তুমি নিজেই জানো না। আমার সব হতাশা সব দুর্বলতা ঝরে যায়, একটা আকাঙ্ক্ষা জাগে। শ্রদ্ধার দ্বিতীয় কারণ, আমি তার মধ্যে অলৌকিক শক্তির বিকাশ দেখেছি। সেটা কী, তার মধ্যে বিজ্ঞান আছে না তন্ত্র আছে না ম্যাজিক আছে আমার জেনে দরকার নেই। ছোটদাদুকে প্রশ্ন করেছি। তিনি হেসে বলেছেন, সাধনাই সব। সেইটাই দেখবে। বিভূতির দিকে নজর দেবেনা। অমন হয়। সাধনভজন করলে সকলেরই হবে।

সেই ছোটদাদু বসে আছেন দক্ষিণের জানলার দিকে পেছন ফিরে, হাতলঅলা চেয়ারে। সামনে একটা গোল কাঠের টেবিল। মুখোমুখি বসে আছেন হরিশঙ্কর। আমি ঘুরঘুর করছি। হঠাৎ হরিশঙ্কর টেবিলে একটা আঙুল ঠুকে বললেন, হোয়াই? ক্যান ইউ টেল মি হোয়াই? কেন এমন হবে? আমরা মানবই বা কেন?

দুজনেই সমবয়সি। একই সঙ্গে লেখাপড়া করেছেন, তাই তুই-তোকারির সম্পর্ক।

ছোটদাদুও হরিশঙ্করের প্রশ্নের প্রতিধ্বনি করলেন, হোয়াই। কেন মানব আমরা! আমাদের অধিকার কেন ছাড়ব? হোয়াই!

হরিশঙ্কর আর একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, দ্যাটস রাইট। একজন মহিলা যেই বিধবা হবে, অমনি পুত্র-কন্যা সমেত তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে দূর করে দেওয়া হবে কেন? বাঙালির এ কী অসভ্যতা! প্রতিবাদ করা হয় না বলে, বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। আমরা তা হলে কী করতে আছি! উই মাস্ট ফাঁইট। জীবনটা বড় শান্ত হয়ে আসছে। বহুকাল বড় ধরনের কোনও মারামারি হয়নি। এখনও দশ-বিশটা লোকের মহড়া নিতে পারি। ছোটদাদু খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, লাস্ট কবে মারামারি করেছিস?

তা বছর দশেক হল। কলকাতার ময়দানে গোটা পাঁচেক বাঁদরকে দিনকতকের জন্যে শুয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলুম।

তোর টেকনিকটা কী?

বেধড়ক ঘুসি আর যুযুৎসুর প্যাঁচ, রদ্দা।

আমি আবার কুস্তির লাইনটা প্রেফার করি। একবারে মাথার ওপর তুলে বারকতক ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিই। মহাভারতের স্টাইলটাই আমার হাতে খোলে ভাল। দুটো পা ধরে ফেঁড়ে ফেললুম, কি মুণ্ডটা ঘুরিয়ে দিলুম। ঝামেলা অনেক কম। সময়ও অনেক কম লাগে।

তুই লাস্ট কবে করেছিস?

পরশু দিন। তারাপীঠের শ্মশানে। খুব মাস্তানি করছিল। সবকটাকে ল্যাংটা করে রামপুরহাটে পাঠিয়ে দিলুম।

বেশ করেছিস। দু-একটাকে নিরামিষ করে দিতে পেরেছিস?

হ্যাঁ, পালের গোদাটার মনে হল সবকটা দাঁতই ঝরে গেছে।

মানুষের মধ্যে পশুও আছে দেবতাও আছে। সব এক ট্রিটমেন্ট হলে তো হবে না। পশুদের শায়েস্তা করার জন্য প্রয়োজন পশুবলের। ধর্মের কথা, জ্ঞানের কথা, সদুপদেশ, কিছুই কিছু হবে না। মায়ের নাম করো, মায়ের নাম, তারা শালা বলে তেড়ে আসবে। যেমন রোগ তার তেমন দাওয়াই হওয়া উচিত। ভূত ছাড়াতে ওঝার ঝাটা। গ্রীক মাইথোলজিতে আছে সেন্টর-এর কল্পনা, যার আধখানা পশু আর আধখানা মানুষ। মানব-দানব কমবাইন্ড। তিনি আবার শিক্ষক। রাজপুত্রদের গুরু। ভবিষ্যৎ রাজা কী শিখতেন? দানবদলনে দানব হবে, মানবপালনে দেবতা হবে। আমাদের নৃসিংহ-অবতার! সেই একই কল্পনা। আমাদের দশ মহাবিদ্যা। ত্বং কালী তারিণী দুর্গা সোড়শী ভুবনেশ্বরী/ ধূমাবতী ত্বং বগলা ভৈরবী ছিন্নমস্তকা ॥ ত্বমন্নপূর্ণা বাগদেবী ত্বং দেবী কমলালয়া/ সর্বশক্তি-স্বরূপা ত্বং সর্বদেবময়ী তনুঃ ॥ আমাদের দশাবতার– মীন, কূর্ম, শূকর, নরহরি, বামন, ভৃগুপতি, ক্ষত্রিয়-রুধিরময়ে, রঘুপতি, হলধর, বুদ্ধ, কল্কি। কী কনসেপশন! জগৎ যেমন, শাসনও ঠিক তেমন। কী, তুই আমার সঙ্গে একমত তো?

অবশ্যই। কালই চলো বেরিয়ে পড়ি অসুর নিধনে।

একটা ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকতে হবে, সেটা হল সংযম। এমন কিছু করব না, যাতে থানা-পুলিশ হয়। অ্যাবসলিউট সংযম।

অ্যাবসলিউট। প্রথমে আমরা ভয় দেখাব। তাতে না হলে লোভ দেখাব। লোভ দেখিয়ে বের করে আনব, তারপর আমাদের এলাকায় এনে দাঁড়া হুল, সব ঘেঁটে দেব।

তোর অলৌকিক কিছু করবি নাকি?

এই অলৌকিক শব্দটা সম্পর্কে আমার সামান্য আপত্তি আছে। তোর কাছে যা অলৌকিক আমার কাছে তা ভীষণ স্বাভাবিক। তুই অবিশ্বাসী, তোকে বোঝাতে হলে বিজ্ঞানের রাস্তায় যেতে হবে। যেমন ধর, একটা দেশলাই কাঠি। দেখলে বোঝা যায় আগুন আছে? যায় না। এইবার বারুদের গায়ে ঘষো, ফাঁস! এটা কি অলৌকিক! কিছু শক্তি ধারণ করা যায় বৎস! একটু সাধনা করলেই হয়। তুই যে এসরাজ বাজাস, ওটা কি অলৌকিক? কেউ দশ সেকেন্ড দম বন্ধ করে থাকতে পারে না, আমি দশ মিনিট পারি। আমি অভ্যাস করেছি। আমি প্রাণায়াম করে আসন ছেড়ে ভেসে উঠতে পারি, আমি পারি। কেন পারি, কীভাবে পারি, তা আমি কী করে বলব! প্রবল ইচ্ছাশক্তিতেই পারি হয়তো। ত্রৈলঙ্গস্বামী সারাটা দিন কাশীর গঙ্গায় পদ্মফুলের মতো ভেসে বেড়াতেন। হাঁস জলে ভাসে, পাখি আকাশে ওড়ে, এর মধ্যে অলৌকিক তো কিছু নেই। সেই আর্ট আমার আয়ত্তে এসেছে গুরুর কৃপায়। আমি কী করতে পারি! এখনই দেখবে, বিনা চেষ্টায় আমার ভেতর থেকে কোন অনাহত শব্দ বেরোবে? ঠোঁট ফাঁক হবে না, নড়বে না, বুক পেটে কোনওরকম আন্দোলন হবে না। সেই শব্দে ঘরের সমস্ত জিনিস কাপবে। তোমাদের শরীর শিরশির করবে। শুনতে চাও?

হরিশঙ্কর কিছু বলার আগে আমিই লাফিয়ে উঠলুম। আজ্ঞে হ্যাঁ।

হরিশঙ্কর বললেন, অকাল্টের দিকে এর খুব ঝোঁক।

ছোটদাদু চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে নেমে বসলেন পদ্মাসনে। দেহ স্থির। চোখ নিমীলিত। প্রথমে আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে এক ঝাঁক প্লেন উড়ে গেলে যেরকম শব্দ হয়, সেইরকম শব্দ শুরু হল। তারপরেই উঠল সেই ভয়ংকর শব্দ, একটানা। কোনও ছেদ নেই। টানেলের ভেতর দিয়ে রেলগাড়ি যাচ্ছে। গোমুখে গঙ্গার অবতরণ হচ্ছে। একটা দড়িতে ছোট একটা লোহার পাত বেঁধে কেউ বনবন। করে ঘোরাচ্ছে। একাক্ষর শব্দ, ওঁ। হচ্ছে তো হচ্ছেই। কী তার রেজোনেন্স। ঘরের সমস্ত জিনিস চিনচিন করে কাঁপছে। আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে ঝংকার হচ্ছে। মনে হচ্ছে পাউডার হয়ে যাব।

হরিশঙ্কর বললেন, স্টপ ইট। স্টপ ইট।

ধীরে ধীরে শব্দ স্তব্ধ হল। ছোটদাদু আবার চেয়ারে ফিরে এলেন।

হরিশঙ্কর বললেন, এ হল সাউন্ড স্প্যাজম। নাদ-সাধনায় এটা হয়।

ছোটদাদু বললেন, আমি এটা সাধনায় পেয়েছি, বাঘ পেয়েছে জন্মসূত্রে। যে-কোনও বাঘই এটা পারে। শব্দটা একটু অন্যরকম হবে। বাঘের ভাষায় হবে, কিন্তু সাউন্ড-কোয়ালিটি এক। এটা কি অলৌকিক?

না। এটা টেকনোলজি।

এখন দেখো, এই শব্দের পিচ যদি আমি আরও বাড়াই, এই ঘরের সবকিছু ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। বিশ্বাস করো?

করি। অনেক সময় প্লেনের শব্দে আলমারির কাঁচ ভেঙে যায়।

আমি এইরকম কিছু ভেলকি দেখাতে চাই ওখানে। অলৌকিক নয় তবে হাইলি-টেকনিক্যাল। তোর আপত্তি আছে?

না। সে তুই করতে পারিস। সাউন্ডকেই অনেক ভাবে ব্যবহার করা যায়, যেমন ভেনট্রিলোকুইজম।

সে বিদ্যাটাও আমার আয়ত্তে আছে।

সঙ্গে সঙ্গে চেপে ধরলুম, ছোটদাদু একবার, কখনও শুনিনি।

বলামাত্রই শুনলুম, নীচের রাস্তা থেকে কে আমার নাম ধরে ডাকছে। বোকার মতো রাস্তার দিকের জানলায় ছুটছিলুম। ছোটদাদু হেসে ফেললেন। ওপাশে রান্নাঘরের দিক থেকে কে বললেন, ওদিকে নয় এদিকে এসো।

হরিশঙ্কর বললেন, বাঃ, বেশ ভালই আয়ত্ত করেছিস। দিস ইজ অ্যান আর্ট।

ছোটদাদু বললেন, তোর কন্ট্রোলে এইরকম কিছু আছে?

নাঃ, আমার কন্ট্রোলে আছে শক্তি। আমি মেঘের মতো হাসতে পারি। বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠতে পারি। হাতির মতো সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে পারি। আবার একটু একটু করে সব গড়ে তুলতে পারি। আমি কখনও শ্মশানের চিতা, কখনও উনুনের আগুন। জীবন আর মৃত্যুর সীমানায় মহাকালের দোলকের মতো দোল খাচ্ছি।

ছোটদাদু বললেন, তোমার একটা জিনিস হয়, রঙের পরিবর্তন। কখনও ছাইয়ের মতো ধূসর, কখনও লোহার মতো কালো, কখনও রক্তের মতো লাল, কখনও মঠের মতো সাদা।

শুনেছি বটে, তবে কোনওদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখিনি। মনের ভাবের সঙ্গে রঙের পরিবর্তন হয়। আমার ভিতরে মনে হয় বহুরূপীর মশলা আছে। স্কিনের পিগমেন্টেশন পালটে যায়। বলে না! রেগে লাল। আমি হয়তো সত্যিসত্যিই লাল হয়ে যাই। মনের ভাব অনুসারে। আমার দেহের উত্তাপ বাড়ে কমে। পঁচানব্বই থেকে একশো এক চলাফেরা করে। এর কোনওটাই বিভূতি নয়। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ভাই! অষ্টসিদ্ধির একটা সিদ্ধি থাকলে আমায় আর পাবে না। তোমার একটু শক্তি হতে পারে, এই মাত্র! গুটিকা সিদ্ধি, ঝাড়ানো, ফেঁকানো, দাওয়াই। তবে লোকের একটু উপকার হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, সিদ্ধাইয়ের জন্যে লোক পঞ্চ-মকার তন্ত্রমতে সাধন করে। কিন্তু কী হীনবুদ্ধি! সিদ্ধাই থাকলে মায়া যায় না, মায়া থেকে আবার অহংকার। কী। হীনবুদ্ধি! ঘৃণার স্থান থেকে তিন টোসা কারণবারি খেয়ে লাভ কী হল? না মোকদ্দমা জেতা! তুই তো এইসব করেছিস!

ছোটদাদু বললেন, যে-সাধনের যা নিয়ম তা তো আমায় করতেই হয়েছে গুরুর নির্দেশে। সিদ্ধাই এসেই পড়ে, যেমন বৃষ্টিতে দাঁড়ালে মানুষ ভেজে। আটটা সিদ্ধিও আমার এসেছে-অনিমা লঘিমা ব্যাপ্তি কাম্য মহিমা ঈশিত্ব বশিত্ব কামাবসায়িতা, এই হল অষ্টসিদ্ধি; কিন্তু আমি প্রকাশ করি না। সবই আমার আছে, প্রকাশ করলে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে যাবে। যেমন ধর অনিমা, আমি নিজেকে ছোট করতে করতে একেবারে অদৃশ্য করে ফেলতে পারি গুরুর কৃপায়। ব্যাপ্তি, সেটাও এসেছে। বিশালও করে ফেলতে পারি নিজেকে। নিজেকে ভারী করে ফেলতে পারি পর্বতের মতো।

আমি আবার লাফিয়ে উঠলুম, ছোটদাদু অনিমাটা একবার দেখাবেন?

হরিশঙ্কর ধমকে উঠলেন, কী ভেবেছ তুমি? এটা কি যোগের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস? যাও, তোমার কাজে যাও।

ছোটদাদু বললেন, তোমার যখন আকাঙ্ক্ষা এত প্রবল, সাধনভজনে চলে এসো না?

হরিশঙ্কর বললেন, ঈশ্বর কে চায়, সবাই চায় ম্যাজিক! ও প্রসঙ্গ বাদ দে, এখন প্রস্তুত হবাঁকুড়ায় যাওয়ার জন্যে। সেখানেই দেখা যাবে তোর অনিমালঘিমাদি অষ্টসিদ্ধি। আজই গেলে কেমন হয়?

না আজ নয়। আজ আমাদের দিন ভাল নয়। কাল হল উৎকৃষ্ট দিন।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন