২.২৮ Like a sword that cuts

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

Like a sword that cuts but cannot cut itself,
Like an eye that sees but cannot see itself.

দুধের মতো সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি। হাঁসের পালকের মতো সাদা ধুতি। ব্যাকব্রাশ করা লম্বা লম্বা চুল। চাঁপাফুলের মতো গায়ের রং। কুচকুচে কালো মোটরগাড়ি। মাতুল নেমে এলেন। মাতুল জয়নারায়ণ। হালকা আতরের গন্ধ। নেমেই বললেন, অবাক হবার কিছু নেই রে ব্যাটা। ট্রেন দুঘণ্টা লেট। ঝড়বৃষ্টিতে তিন ঘণ্টা ডিটেল্ড। অ্যান্ড দি ক্লক স্ট্রাইকস টুয়েলভ। চাটুজ্যেমশাইয়ের এইটাই তো টি-টাইম।

পাঞ্জাবি চালক হাসতে হাসতে গাড়ির পেছন দিকের ডালাটা খুলছেন। তাঁর খুশির ভাব দেখে মনে হচ্ছে সারাটা পথ মামা মজার মজার কথা বলতে বলতে এসেছেন। মামার সঙ্গে একটানা এক মাস বসে থাকলেও কারও বিরক্তি লাগবে না। কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যাবে বোঝাই যাবে না। মজলিশি মানুষ। কত সত্য ঘটনা যে সঞ্চয়ে আছে। তেমনি রসবোধ।

গাড়ির পেছন থেকে একটা ঝুড়ি নেমে এল। তাইতে দশ-বারোটা ছোট ছোট ফুলগাছের টব। মাতুল বললেন, কী দেখছ! চাটুজ্যেমশাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যাবেন। রাঁচির সেরা নার্সারির সবচেয়ে সেরা গোলাপ। ফুল দিয়ে পৃথিবী সাজাব বন্ধু। দুঃখ ম্লান হয়ে যাবে। প্রিয়জন ছেড়ে গেছে যাক। গোলাপ এসেছে ফিরে।

ছোট একটা সুটকেস নেমে এল। ভাড়া বকশিশ বুঝে নিলেন চালক। বললেন, এমন ইনসান খুব কমই দেখেছি। সদরে ঢুকে সুরেলা পঞ্চমে মামা হাঁকলেন, চাটুজ্যেমশাই!

আমি তখন বললুম, মামা, তিনি নেই।

জয়নারায়ণও সেই সংবাদে থমকে গেলেন। প্রশ্ন করলেন, নেই মানে? ইয়ারকি করছিস আমার সঙ্গে! নেই মানে? কোথায় গেছেন?

জানি না। চলে গেছেন কোথায়, কারওকে কিছু না বলে।

বলিস কী? তা আমাকে একটা চিঠিতে জানাতে কী হয়েছিল?

আপনার ঠিকানা?

আমার ঠিকানা তোর কাছে নেই?

আপনি দিয়ে যাননি।

সে কী রে? এমনও হয়!

গুম মেরে রইলেন কিছুক্ষণ। আপনমনেই বললেন, জানতুম। এইরকম একটা কিছু হবে। সংসারের ছোট্ট আঁধারে অত বড় একটা মানুষকে ধরে রাখা শক্ত।

মামা পা টিপে টিপে, অতি সন্তর্পণে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগলেন।

আমি বললুম, ফুলের ঝাঁকাটা?

মামা বললেন, ফুল এনে ফুল বনে গেলুম। ফুলের মর্ম এবাড়িতে আর কে বুঝবে? ভাগ্যিস কুকুরবাচ্চাটা আনিনি! বাড়ি তো শ্মশান।

মেনিদা দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির মাথায়। সেই একই বৈষ্ণবের পোশাকে। দু’হাত বাড়িয়ে বললেন, এসো, জয় এসো। তুমি ঠিক সময় এসে গেছ।

মামা প্রথমে চিনতে পারেননি। পরে চিনতে পেরেই বললেন, আরে, মাস্টারমশাই আপনি? আপনি এখানে?

অনেক কাণ্ড ঘটে গেছে বাবা। ছেলেটা যাতে ভয় পায় তাই রাত-পাহারা দিতে এসেছি।

চাটুজ্যেমশাই তো নিরুদ্দেশ? এ ছাড়া আর কী হয়েছে?

পরে শুনো। আগে জামাকাপড় ছাড়ো। খাওয়াদাওয়া করো।

আমাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে মেনিদা কানে কানে বললেন, কী খাওয়াবে?

এখনও কচুরি আলুরদম আছে।

কচুরিটচুরি খাবে তো? শিল্পী মানুষ। এখুনি বলবে, গলা খারাপ হয়ে যাবে।

সে তত তিনটে জিনিসে হয়। চাটনি, দই আর আইসক্রিম।

তবু তুমি জিজ্ঞেস করো। সেরকম হলে আমরা স্টোভ ধরিয়ে কিছু করে দোব।

মামা ততক্ষণে অন্য সমস্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ধুতির কাছার দিকে একটু কাদা ছিটকে লেগেছে। আমাকে বললেন, খাওয়াদাওয়া নিয়ে অত ভাবছিস কেন? চা আছে তো। আগে আমাকে একটা কাপড় কাঁচা সাবান দে।

এত রাতে কাপড় কাঁচতে বসবেন? কাল সকালে হবেখন। তা না হলে আমাকে দিন, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

শোন, কাপড়ে কাদার দাগ, চরিত্রের কলঙ্ক প্রায় পার্মানেন্ট। সহজে তোলা যায় না। আলাদা কায়দা। ধীরে ধীরে, ঘষে ঘষে, যেন ছড়িয়ে না যায়!

আমি জানি মামা। কায়দাটা আমার জানা আছে।

জানলেও আমি তোমাকে করতে দেব না। আমার অস্বস্তির কারণ হবে।

কচুরি আর আলুরদম আছে। রাতটা চলে যাবে?

খুব যাবে। তুই কি আমার জন্যে এখন রান্না করতে বসবি? শোন, আমাকে মনে হচ্ছে সারারাত জাগতে হবে। কাল ভোরেই আমার রেডিয়ো প্রোগ্রাম। বিলাসখানি টোড়িটা এক রাউন্ড ভেঁজে নিতে হবে তো!

নেবেন। অসুবিধে কী আছে? হারমোনিয়ম বার করাই আছে।

তা হলে লেগে যাই কর্মযজ্ঞে!

বহুকাল পরে সময় লজ্জা পেয়ে গেল। ভেবেছিল বেহুশ ঘুমে সবাই অচেতন হয়ে পড়বে। নিঃশব্দে একটি দিনের আয়ু হরণ করে চলে যাবে। তা আর হল না। সব আলো জ্বলে উঠল। অসম্ভব এক কর্মব্যস্ততা। যেন সবে দিন শেষ হয়ে সন্ধে নেমেছে। পিতা হরিশঙ্কর যখন ছিলেন তখন এইরকম সব উদ্ভট কাণ্ড প্রায়ই হত। সময়ের দাসত্ব মেনে নিতে তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। না সময়ের, না মানুষের, না অভ্যাসের, কোনও কিছুর তিনি দাস ছিলেন না। তিনিই ছিলেন প্রকৃত প্রভু। রাজার রাজা রাত বারোটার সময় চা-টা খেয়ে যখন বইপত্তর খুলে বসতেন, তখন মনে হত এই সবে শাঁখ বাজিয়ে সন্ধে হল। ছুটির দিন বেলা পাঁচটার সময় গঙ্গার স্নান করে উঠছেন। বৈকালিক ভ্রমণকারীরা ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করছেন, আর ইউ লেট অর টু আরলি ফর টোমরো?

একটা মোড়ার ওপর জয়নারায়ণ বসেছেন, কোলের ওপর তোয়ালে, তার ওপর কাপড়ের সেই অংশটা যেখানে লেগে আছে কাদার ছিটে। রুমালে সাবান মাখিয়ে সন্তর্পণে ঘষছেন আর বলছেন, এ ভেরি ডেলিকেট অপারেশন। ছড়িয়ে ছেতরে না যায়!

মেনিদা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, জয় কী খাবে! এত রাতে ঘিয়ে ভাজা খেলে অম্বল হবে, কাল সকালে আর গাইতে পারবে না। এই মানুষটি সম্পর্কে এখন দেখছি আমার কিছুই জানা হয়নি। এঁর অবশ্যই একটা গৌরবের অতীত আছে। যে-অতীতের আমি সাক্ষী নই। গৌরবের অতীতটাকে কী কায়দায় ভদ্রলোক ঘৃণার বর্তমান করে তুললেন, জানতে ইচ্ছে করে। মানুষ কীভাবে পড়ে যায়! কে তাকে পেড়ে ফেলে? মামার মতো একজন সেরা ছাত্রের শিক্ষক ছিলেন। এখন ভোরবেলা ফুলুরি ভিক্ষে করেন! এর-তার ব্যাপারে নাক গলান। অসভ্য অসভ্য কথা বলেন। গৌরব কোথাও একটা মস্ত বড় খোঁচা মেরেছে।

মামা তন্ময় হয়ে কাদার দাগ তুলছেন আর জয়জয়ন্তী ভঁজছেন–এই সো না বোলো লাগরি রাধা। গলায় যেন মিছরির চাক। বাদ্য বাজনা ছাড়াই যে কী কাণ্ড করছেন! চেহারা আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। মুখে জ্বলজ্বল করছে একটা জ্যোতি। যে-ঝড় বইছিল জীবনের ওপর দিয়ে, সে ঝড় কিছুটা কেটেছে। আমার তাই বিশ্বাস!

মেনিদা খুব চিন্তিত মুখে বললেন, জয়, এত রাতে কচুরি না-ই বা খেলে!

মামা এক মুখ হেসে বললেন আপনি আমার জন্যে এত ভাবছেন কেন? ঘড়ির দিকে তাকান, আর কিছু খাওয়ার প্রয়োজন হবে না। এখুনি পাখির ডাক শুনতে পাবেন। আসুন আমরা সবাই মিলে চা খাই!

মামা আমাকে বললেন, সুটকেস খুলে একটা পাজামা আর গেঞ্জি বের করে আনতে। পাশের ঘরেই সেই সুটকেস। শৌখিন মানুষের শৌখিন সুটকেস। চাপ দিতেই খুটুস করে খুলে গেল। ডালা ওঠাতেই ভুরভুরে সুগন্ধ। সিল্কের পাঞ্জাবি, ধুতি, পাট করা রুমাল, আন্ডারওয়্যার। দাড়ি কামাবার সেট। গানের খাতা। কিটসের কবিতার বই। একেবারে তলায় পাজামা আর গেঞ্জি। সবই পরিচ্ছন্ন, যেন একেবারে নতুন। হঠাৎ নজরে পড়ে গেল জিনিসটা। রুমালে জড়ানো ছিল। একটা পাশ খুলে গেছে। সেই খোলা অংশ দিয়ে উঁকি মারছে একটা চশমার খাপ। শরীর অবশ হয়ে গেল। এই তো সেই চশমার খাপ! এরই মধ্যে থাকত পিতা হরিশঙ্করের গোল্ড ফ্রেমের চশমা। এদিক ওদিক তাকিয়ে খাপটা খুললুম। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ভেতরে সেই চশমা। নিভৃতে শুয়ে আছে। ফ্রেমের একটা উঁটি ভেঙে গেছে। তা হলে? মালিক কোথায়? মামা এতক্ষণ অভিনয় করছিলেন আমার সঙ্গে। সব জানেন তিনি! মহা অপরাধীর মতো খাপটাকে কাপড়চোপড়ের অন্তরালে রেখে। ফিরে গেলুম। সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। সন্দেহ, অভিমান, চাপা একটা রাগ উথলে উঠছে ভেতরে। ধরতে পারছি না ষড়যন্ত্রটা কী? কীসের জন্যে এই লুকোচুরি!

পাজামা আর গেঞ্জি পরে মামা হারমোনিয়মের সামনে বসেছেন। হাতে চায়ের কাপ ধোঁয়া ছাড়ছে। ঘড়িতে ঠিক দুটো। মেনিদা অদূরে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে ধ্যানস্থ। মামাকে বেশ তৃপ্ত। দেখাচ্ছে। মুখে একটা হাসির ভাব। অর্থাৎ সব জেনেও না-জানার অভিনয়। মেনিদার দিকে তাকালুম, মনে হল ঢুলছেন।

খালি কাপটা একপাশে রেখে মামা বললেন, কী রে! অমন গুম মেরে গেলি কেন?

মামার দিকে আরও কিছুটা সরে গিয়ে ফিসফিস করে বললুম, আপনি সব জানেন, তাই না?

কী জানি বল তো? অকৃত্রিম অভিনয়।

তিনি কোথায় আছেন।

আমি কেমন করে জানব? আর জানলে তোকে বলব না!

মামা, জীবনে একটা সত্যি কথা বলুন। আমার মনের অবস্থাটা একবার চিন্তা করুন। পরপর যা ঘটে গেল আপনাকে বলা হয়নি। আরও যা ঘটবে তার আভাস আছে। শুনলে স্তম্ভিত হয়ে যাবেন।

মেনিদা তন্দ্রা-জড়ানো গলায় বললেন, জানলে বলে দাও। বড় কষ্টে আছে। হাতে-পায়ে ধরে ফিরিয়ে আনুক সম্রাটকে। নয়তো ধ্বংস অনিবার্য।

মামা আশ্চর্য হবার ভান করে বললেন, জানলে বলব না? তা কখনও হয়! তা হলে অত কষ্ট করে বয়ে বয়ে গোলাপ আনলুম কার জন্যে!

মামা হারমোনিয়মে সাপাট একটা তান বাজালেন। লম্বা ফরসা আঙুল বিজলির মতো খেলে গেল। অনামিকার আংটির পাথর ঝলসে উঠল।

আমি হাতটা খপ করে চেপে ধরে বললুম, একটা সত্যি কথা বলুন না আমার এই দুর্দিনে!

সংগীতে বাধা পড়ায় আমার রাগী মামা যেন একটু বিরক্তই হলেন, তোর এই ধারণার কারণটা কী?

আপনার সুটকেসে ওটা কার চশমার খাপ?

চশমার খাপ? মামা অবাক হবার ভান করলেন। আমার সন্দেহ আরও ঘোরতর হল।

হ্যাঁ, চশমার খাপ, রুমালে জড়ানো। আমার গলা আর স্বাভাবিক নেই। মেনিদা সোজা হয়ে বসলেন উত্তেজনার গন্ধ পেয়ে। আমার কানদুটো গরম আগুন। দু’জনে ষড়যন্ত্র করেছেন, জামাইবাবু আর শ্যালকে। একটা অশুভ আঁতাত তৈরি হয়েছে আমাকে শিক্ষা দেবার জন্যে। এই শ্যালক সম্পর্কেই একদিন আমাকে কত সাবধান করেছিলেন, বি কেয়ারফুল, মামার মতো ফুলবাবুটি হোয়ো না। ওর অনেক গুণ, মানাবে। ইউনিভার্সিটি ব্লু, শিল্পী। তুমি মিডিয়কার, ট্যালেন্টলেস। ভাল-মন্দ খেয়ে পেট খারাপের সান্ত্বনা আছে। কুমড়োর ঘাট খেয়ে কাত হলে, অতিশয় দুঃখের। তোমার একমাত্র সম্বল চরিত্র, আদর্শ, সততা।

হারমোনিয়মটা ভ্যাক করে বন্ধ করে মামা বললেন, অ, ওটা নজরে পড়ে গেছে!

হ্যাঁ পড়েছে। না পড়ে উপায় ছিল না। রুমালের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ভেতরে সেই চশমা।

ওটা আমার শ্বশুরমশাইয়ের চশমা।

কেন আমাকে ভোলাবার চেষ্টা করছেন? বাবার চশমা আমি চিনব না! কানের কাছে নাকের ব্রিজে মাদার অফ পার্লস দিয়ে মোড়া। গোল ফ্রেম।

তোর ধারণা পৃথিবীতে ফ্রেম যখন তৈরি হয়, এক পিসই হয়? আমার সঙ্গে বউবাজারে চল। দেখবি একই ফ্রেম একশোটা পাশাপাশি রয়েছে।

আমি অসহায়ের মতো মেনিদার দিকে তাকালুম।

তিনি মামাকেই সমর্থন করলেন, তা অবশ্য হতে পারে। জয়ের চোখে যে-চশমাটা রয়েছে আমি আরও অনেকের চোখে এমন চশমা দেখেছি।

মামা সমর্থন পেয়ে বললেন, তবে! শুনলে তো!

আমার লড়াই থামল না, এটা তো প্রাচীন ফ্রেম।

মামা বললেন, চাটুজ্যেমশাই আর আমার শ্বশুরমশাই দু’জনেই তো প্রাচীন। প্রায় সমবয়সি।

আমি ঝট করে উঠে গিয়ে চশমার খাপটা নিয়ে এলুম। আমি তো পিতা হরিশঙ্করের শুধু সন্তানই ছিলুম না, বিশ্বস্ত কুকুরও ছিলুম। প্রভুর সমস্ত সামগ্রীর বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ আমার জানা। এতটা ভুল তো আমার হবার কথা নয়। খাপটা বহু ব্যবহারে ছাল ওঠা-ওঠা হয়ে গেছে। মাঝখানে একটু টাক। আমি তো চিনি। কতবার আমি ওই চশমা টেবিল থেকে তুলে খাপে ভরেছি। নরম সিল্কের কাপড় দিয়ে সোনালি অংশ আর কাঁচ পালিশ করেছি। আমার কখনও ভুল হতে পারে? কাঁচের দিকে তাকিয়েই হরিশঙ্করের বড় বড় দার্শনিক চোখ আমি দেখতে পেয়েছি। যে-চোখে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাব খেলা করত। কখনও অ্যাডমিরাল। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অনন্ত নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন যেন। কখনও কবি। প্রকৃতির সবুজ শোভায় বিভোর। কখনও রুদ্র ভৈরব। কখনও রসিক। কখনও ধারালো ব্যঙ্গ। আকাশের মতো রূপ পালটাত ক্ষণে ক্ষণে।

চশমাটা হারমোনিয়মের ওপর রেখে বললুম, এই চশমাটা বাবার নয়? এই খাপটা বাবার নয়? আমার চিনতে এত ভুল হবে?

মধ্যরাতে আলোর ভোল্টেজ বাড়ে। সেই চড়া আলোয় মামার ফরসা মুখ ফসফরাসের মতো জ্বলছে। খাঁড়ার মতো অহংকারী নাক। তিনি যেন একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, আচ্ছা মুশকিল তো! তুই বুঝছিস না কেন, চশমা আর খাপ একই হবে! যে-চশমার যে-খাপ। বউবাজারের একই বড় দোকান থেকে হয়তো একই সময়ে দু’জনে চশমা করিয়েছিলেন। আমি কী করতে পারি বল!

চশমাটা ভাল করে পরীক্ষা করলুম। একটা উঁটি খুলে গেছে।

প্রশ্ন করলুম, চশমাটা এনেছেন কেন?

এটা একটা আন-ইনটেলিজেন্ট প্রশ্ন হল। দেখতেই পাচ্ছিস ভেঙে গেছে। মেরামত করতে হবে।

আপনার শ্বশুরমশাই তো দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন। রাঁচি গেলেন কেন?

তুই তো দেখছি পুলিশের জেরা শুরু করলি। রাঁচিতে গেছেন বায়ু-পরিবর্তনে। মেয়ের কাছে কিছুদিন থাকবেন বলে। হয়েছে!

হঠাৎ আমার মাথায় খেলে গেল, পিতা নিজেই একজন বড় মেকানিক। এই সামান্য মেরামতির জন্যে দোকানের শরণাপন্ন হবেন কেন? পরমুহূর্তেই মনে হল, স্কুটা হারিয়ে গেছে বলেই হয়তো নিজে মেরামতি করতে পারেননি।

মামা আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, কী? জেরায় সন্তুষ্ট তো?

মেনিদা বললেন, এরপর আর কী প্রশ্ন থাকতে পারে? আর কেনই বা তুমি মিথ্যে কথা বলবে? চশমার খাপটা সুটকেসে ঢোকাতে ঢোকাতে পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাসের কাহিনি মনে পড়ে গেল। এ যেন অনেকটা সেই রকমেরই ঘটনা। মামা একজন মস্ত বড় অভিনেতা। তার পক্ষে ছোট-বড় যে-কোনও মিথ্যাকে সত্য বলে চালানো কোনও ব্যাপারই নয়। এর বহু নজির আছে। সত্য আর মিথ্যার সীমারেখা ভেঙে চুরমার করে জীবনকে দাঁড় করিয়েছেন। চশমাটাকে একান্তে আরও ভাল করে পরীক্ষা করলুম। বড়ই চেনা। পিতা হরিশঙ্কর বলতেন, আমার হল ‘হক নোজ। আর একজনের এইরকম নাক ছিল, তার নাম চেঙ্গিজ খান। সেই নাকের ওপর এই চশমাটাই কি ঝুলত না! চশমা, তুমিই বলো। নিজের সত্য নিজেই উদঘাটন করো।

মামা আলাপ শুরু করে দিয়েছেন। যেন সুরের মিছরি ভাঙছে গলায়। সেই বিখ্যাত গান, আঁখিয়া ভর আয়ি। দরশ তুহে লাগি। বিলম্বিত একতালে সুরের রাজহাঁস হেলেদুলে চলেছে। আমার। চোখও জলে ভরে এল। বড় সময়ের গান। আমিও তো তার দর্শন চাইছি। দরশ কুঁহে লাগি। DUR37 US OVITI Who rides so late through the night and storm? It is the father with his child, ওঘরে ভোর যেন ধীর পায়ে ঢুকছে রাতের অবগুণ্ঠন মোচন করে।

মামা সুরের সমুদ্রে তলিয়ে গেলেন। চোখ-মুখের চেহারা একেবারে অন্যরকম। এমন মানুষ মিথ্যে কথা বলেন কী করে! মেনিদার রাতজাগা মুখে একটা গর্বের ভাব। দেখো দেখো, এই ছেলেটা একসময় আমার ছাত্র ছিল। আমি পতিত, ও উথিত।

ঘরের অন্ধকার হামাগুড়ি দিয়ে কোণে কোণে পালাচ্ছে। অনেক আগেই আলো নেবানো হয়ে গিয়েছিল। জানলায় পরদার মতো ঝিলঝিল করছে সদ্যোক্ষুট নতুন একটি দিন। গান শেষ হল। মামা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। মেনিদা ঠিং করে খঞ্জনিতে একটা শব্দ তুলে বললেন, বেরিয়ে পড়ি এইবার। আমি এক দিনের ফেরিঅলা।

মামা শুয়ে পড়লেন খাটে। সামান্য একটু নিদ্রা তো চাই। আমি জানি, এই সময় তার একটু চায়ের প্রয়োজন হবে। চিত হয়ে শুয়ে আছেন বেদি থেকে নামানো গ্রিক দেবতার মতো। অনেকটা কিটসের মতোই রূপ। ঘুমিয়ে পড়েছেন। মসলিনের মতো ফিনফিনে নিশ্বাস পড়ছে। বহুক্ষণ তাকিয়ে রইলুম সেই নিদ্রিত নিভাঁজ শান্ত মুখের দিকে। গুণের আধার। ভেতরে সুরের সমুদ্র। ওই মুখে কি আমার মায়ের মুখের আদল ভাসছে?

চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে, পায়ে হাত ঠেকালুম। এইভাবেই নাকি নিদ্রিত মানুষকে জাগাতে হয়। পাতলা ঘুম। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকালেন। কিছুক্ষণ সময় লাগল পরিবেশটা বুঝে নিতে। চায়ের কাপ তুলে ধরলুম। মৃদু হেসে বললেন, তোর কী ভালবাসা রে!

চা শেষ করে মামা উঠে পড়লেন। আড়মোড়া ভেঙে বললেন, বেশ ফ্রেশ লাগছে। জাস্ট এ লিটল স্লিপ। ঠিক ছ’টার সময় মামা বেরিয়ে গেলেন গাস্টিন প্লেসের রেডিয়ো অফিসে। যাবার সময় বলে গেলেন, প্রোগ্রামটা শুনিস। যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে রইলুম তার চলে যাওয়ার দিকে। সেই নিদ্রিত মানুষ নয়। আত্মসচেতন, কিঞ্চিৎ অহংকারী এক শিল্পী। জিজ্ঞেস করা হল না, কখন ফিরবেন? যতই অহংকার করুন, এ-ও এক নিঃসঙ্গ মানুষের ছবি।

গোলাপের ছোট ছোট টব। একে একে সব ছাতে তুললুম। প্রত্যেকটায় একটা-দুটো করে কুঁড়ি লেগে আছে। জীবন্ত, সতেজ গাছ। সারারাত বাইরে থাকায় তাজা লকলকে। এবাড়ি আর পাশের। বাড়ি গায়ে গায়ে। লাগোয়া পাঁচিলটা বেশ উঁচু। পাঁচিলের ওপাশে হঠাৎ একটা মাথা জেগে উঠল।

কী করছ তুমি একা একা?

জবা! সেই ভয়ংকরী, ডাকাবুকো মেয়েটা। যে ওই পাঁচিল বেয়ে এই ছাদে লাফিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। বিয়ে হয়েছে। ছেলেপুলে হয়েছে। সে যৌবন আর নেই। এখন শান্ত এক মা। আগে লাল শাড়ি আর লাল ব্লাউজ পরা জবার দিকে তাকালেই শরীর খারাপ হত! জবা কত ছেলেকেই যে গোল্লায় পাঠিয়েছিল! প্রশ্ন করলুম, কবে এলে?

কাল। সব পাট চুকিয়ে এলুম। জানো তো, ওরা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে! কী মজা! এরাও বলছে তাড়িয়ে দেবে। এইবার বেশ ঝি-গিরি করে বাঁচব। তোমাদের বাড়িতে আমাকে রাখবে? খাওয়া-পরা।

জবা হাসছে। ঝকঝকে দাঁত। বিশাল খোঁপা। জবা কান্নার শব্দে হাসছে।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন