১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম

দিন যেন ঝলসে যাচ্ছে। চনমনে রোদ। চারপাশ ঝনঝন করছে। সামনে গঙ্গা। জোয়ারে ভারভরন্ত। সারাশরীরে ঢেউয়ের কুচুরমুচুর। একটু আগে একটা স্টিমার চলে গেছে। তলপেটে চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে। বড় ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে ঘাট পর্যন্ত চলে এসেছে। পইঠেতে জলের ধাক্কা লেগে লপাত লপাত শব্দ হচ্ছে। শ্মশানের কাঠকয়লা তালে তালে নাচছে- এই ছিল এই নেই সুরে। নৌকো ভেড়ার বাঁশের সাঁকো তলিয়ে গেছে জলের তলায়। নৌকো বাঁধার খোঁটাটি শুধু জেগে আছে দূরে। একপাশে পতিত মাঝির বৃদ্ধ নৌকো দুলে দুলে উঠছে। ঝুলনের মেলায় সেই প্রৌঢ়া নর্তকীর কোমর দুলিয়ে নাচার মতো। যে নাচ দেখতে গিয়ে তাঁবুর ভেতরেই শশাঙ্ককাকার কানমলা খেয়েছিলুম। বাইরের পোস্টারে মাকড়সা কন্যার জাল বোনার কথা সাড়ম্বরে লেখা ছিল। ভেতরে যে ঘাঘরা নাচের আয়োজন কেমন করে জানব। সুখেন হয়তো জানত! তা না হলে ঢুকবে কেন? কন্যাটন্যার। মর্ম সেই বয়েসে সুখেনের চেয়ে ভাল কে আর জানত। প্রথমে প্যান্ট পরা চোয়াড়ে মার্কা একটা লোক কাঠের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে খুব খানিক অসভ্যতা করে, সিক সিক দু’বার সিটি মারতেই ততোধিক অসভ্য সেই মহিলা পেছনের ঘেঁড়া চটের পরদা ঠেলে বেরিয়ে এল। মুখে খড়ি, ঠোঁট লাল। বুকদুটো ঠেলে বেরিয়ে আছে। সুখেনের মতো অ্যানাটমিই বা কে জানে? ফিসফিস করে বললে, ফক্স। শুরু হল অশালীন ক্রিয়াকলাপ। ভদ্ররুচির কোনও মানুষের সেসব দেখা উচিত নয়। উঠে পালাবার উপায় নেই। সুখেন চেপে ধরে রেখেছে। আমাদের পাশে লুঙ্গি পরা সব লোক বসেছে। মদের গন্ধ, রসুনের গন্ধ, তেলের গন্ধ, বিড়ির গন্ধ। মঞ্চের লোকটা মাঝে মাঝে সেই মহিলার বিশাল পাছায় পটাস পটাস চাপড় মারছে, আর সকলে হায় হায় করে উঠছে। বুকফাটা আর্তনাদ। মানুষের কখন কী যে কেমনভাবে ফেটে যায়! চিতায় বেলের মতো ফটাস করে মাথা ফাটে। দুঃখে বুক ফাটে। এ আবার কী ফাটা! আমার পাশের লোকটা কনুইয়ের খোঁচা মেরে বলল, মাগির রস আছে। রসগোল্লার রস হয়। এ আবার কী রস বাবা! কিন্তু শশাঙ্ককাকার মতো প্রবীণ মানুষ কী জন্যে ওই রসমঞ্জরীর কাছে গিয়েছিলেন? জবাব নেই।

এমন মজা, সেই থেকে কিছু দুললেই কান সুড়সুড় করে ওঠে, আর সেই মেয়েমানুষটির কথা মনে পড়ে। আহা, এ যেন ভক্ত প্রহ্লাদ, ক বললেই কৃষ্ণের কথা ভেবে হাপুস। কিন্তু দূরে ঘাট-মাঝি চট পেতে ক্যাশব্যাক্স নিয়ে বসে আছেন। গঙ্গার ধারে সারাদিন বসে থেকে থেকে, নৌকোর পারাপার দেখে দেখে কেমন যেন দার্শনিকের মতো মুখ। বসে আছেন তো বসেই আছেন। ইনি যেন সিদ্ধার্থের সেই ঘাট-মাঝি। হেরম্যান হেসের ওই বইটা কতবার যে পড়েছি। যতই পড়ো বাবা! জীবন অনেকটা চুনো মাছের মতো। আঁশটে গন্ধ কি সহজে যেতে চায়। ছাঁকা তেলে কড়কড়ে করে ভাজা না হলে!

পশ্চিমে রোদ ঝুলছে। জল থেকে মাঝে মাঝে হিরের আঙুল বেরিয়ে এসে চোখে খোঁচা মেরে যাচ্ছে। বাঁ পাশে বিশাল একটা বাগানবাড়ির জলটুঙি অতীত গৌরব হারিয়ে, আধ-ভাঙা হয়ে জলের ওপর ঝুঁকে আছে। ছেলেবেলায় ওখানে সুন্দরীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। চুল উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। সময় উড়ছে, টাকা উড়ছে, পাখি উড়ছে। যাহা যায়, তাহা যায়। ডাকলেও আর আসে না। ফাটা রেকর্ড বাজতেই থাকে, শূন্য এ বুকে পাখি মোর, আয় ফিরে আয়, ফিরে আয়।

মাতামহ পাশে বসে আছেন গুম হয়ে। কনকের হাতের রান্না খেয়ে সেই দুপুর থেকে স্তব্ধ হয়ে আছেন। নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন বুঝি? খাবার সময় ছাড়া ঠোঁট ফাঁক করবেন না। জল থেকে রোদের ঝিলিক উঠে মুখে লেগেছে। তপ্ত কাঞ্চনের বর্ণ হয়েছে। মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছি, যদি কিছু কথা বলেন।

ভস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কী দেখছিস? কতদিন হয়ে গেল এই পৃথিবীতে এসেছি। জীবন যেন আর ফুরোতেই চায় না। যে শেষে যায় সে বড় কষ্ট পায়। একে একে হাত ধরে নৌকোয় তুলে দিয়ে, চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে থাকো। দিন যায়, দিন যায়, সে আর আসে না।

কে দাদু?

মৃত্যু রে বোকা, মৃত্যু।

মৃত্যুর কথা আসছে কেন? সব বুড়োরই এক রোগ।

ওই জলটুঙিটার দিকে তাকিয়ে দেখ।

সেই তখন থেকেই তো দেখছি।

ওইটার মতোই আমি জীর্ণ আর প্রাচীন। হুহু করে জল বয়ে চলেছে। পোস্তা ভাঙছে আর ভাঙছে। একদিন ধস করে ধসে পড়ে যাবে। ওর আর কী কদর আছে বল? আমার মতোই। ভেঙে এসেছে। ভাঙল বলে।

এ তুলনার কোনও মানে হয় না। জড় পদার্থের সঙ্গে সজীব পদার্থ বিজ্ঞান মানবে না।

রাখ তোর বিজ্ঞান। জড়ে আর বৃদ্ধের জীবনে বিশেষ তফাত নেই রে! দেহে সে শক্তি নেই, মনে সে জোর নেই, উপার্জনের ক্ষমতা নেই। বেঁচে থাকার অধিকার কোথায়? এ পৃথিবী হয় ভোগীর না হয় যোগীর। আমি যে কোনওটাই নই।

বাবা আপনাকে বকেন বলে মনে দুঃখু হয়েছে?

তোমার বাবা? ও তো মানুষ নয় দেবল। তুই চিনতে পারিস না?

না।

তা পারবি কেন। পিতা সূর্যসমং জ্যোতিঃ মাতা সমুদ্রসমং সরঃ। পিতা পৃথিবৈঃ বর্ষীয়ান্ মাতুর্মাত্রা ন বিদ্যতে ॥ বুঝলে কিছু? ও আমার পাগলা ছেলে। এই কড়া কথা, এই নরম কথা, এই দূর দূর করছে, এই আবার কোলে তুলে নিচ্ছে। ওর নখের যোগ্য হতে পারলে তোমার জীবন তরে যাবে।

একটু একগুঁয়ে।

গোঁ না থাকলে পুরুষকে মানায় না। গন্ডারের মতো গো চাই। একেবারে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে বেরিয়ে যেতে হবে। পৃথিবী কি তোমার সহজ জায়গা ভেবেছ? ওর তেজ তো তোমরা কিছুই দেখোনি। সে আমরা দেখেছি। সবাই বলত আপনার জামাই নয় তো আগ্নেয়গিরি। ওর সেই বিয়ের রাতের ঘটনাটা! একেবারে প্রথম রাতে বেড়াল কাটার মতো। এখনও মনে পড়লে একা একা কুঁই। কুঁই করে হাসি।

কী দাদু?

হ্যাঁ রে শালা, বাপের বিয়ের ঘটনা শোনার খুব শখ। আচ্ছা শুনে রাখ, তোরই হয়তো কাজে লাগবে। বাপকো বেটা হতে হবে তো। তোর বিয়েও তো লাগল বলে!

হ্যাঁ, তাই তো? ও পথে বাড়াস নে তুই পা।

তুই বাড়াবি কেন রে শালা, আমরাই বাড়িয়ে দোব।

আমি সারাজীবন ব্রহ্মচারী থাকব ভীষ্মের মতো।

আমরা বেঁচে থাকতে তুমি ধর্মের ষাঁড় হয়ে ঘুরবে ভেবেছ? ষণ্ড আর ভণ্ড এক জিনিস। পাত্রী উজিয়ে এসে ঘরে বসে আছে। একেবারে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। চোখদুটো দেখেছিস, যেন মা দুর্গা। হাতের রান্না দেখেছিস? আমি খাব কী, আমাকেই খেয়ে ফেললে। কাপড়ের কষি কোথায় নেমেছে দেখেছিস? মেয়েটিকে বড় পছন্দ হয়েছে আমার। মায়ায় বেঁধে ফেলেছে। ছোটটা তেমন নয়। একটু গুমোরে।

এতই যখন পছন্দ তখন করে ফেলুন।

হ্যাঁ রে শালা, তোর মতো বয়েসে আমাদের কালে দশ-বিশটা বিয়ে করে ফেলত তেমন-তেমন পুরুষ। কী সব দাপট ছিল তাদের। বিয়ের নামে তোর মতো এমন কোঁচার খোট মুখে পুরে ছাগলের মতো চিবোত না। বংশবৃদ্ধি করার সময় কারুর মুখের দিকে তাকাত না। পাশের ঘরে মা তালপাতার চ্যাটাইয়ে পড়ে খাবি খাচ্ছে। মাথার কাছে এনামেলের চটা-ওঠা বাটিতে সর-পড়া বার্লি। ডেওপিঁপড়ে বিড়বিড় করছে। পাশের ঘরে পতিতপাবন মাগ জাপটে পড়ে আছে। মৃত্যু এসে দু’জানলাতেই উঁকি মারলে। ওরে ব্যাটাচ্ছেলে, গর্ভধারিণীকে নিয়ে চললুম। তখন তোর বীজ যিনি গর্ভে ধারণ করছেন, খাতায় তার নামও লেখা আছে। গর্ভধারিণী হয়ে ওই খাট থেকে চ্যাটাইয়ে একদিন নামতেই হবে, তখন দেখা যাবে। দৃকপাত নেই। সব শালা চার্বাকের ব্যাটা। বললে, অঙ্গনালিঙ্গনাদি জন্যং সুখম এব পরুষার্থঃ। যাবজ্জীবং সুখং জীবেৎ নাস্তি মৃত্যোরগোচরঃ। কী ভয় দেখাও মৃত্যু! বড় বউ, মেজ বউ, সেজ বউ। বড় ছেলে, মেজ ছেলে, ছেলের পর ছেলে। রোলকল করে রাতে ঘরে তুলতে হয়। মুথো ঘাসের বংশ। শিকড়ে বাকড়ে জড়িয়ে মুকুজ্যে বংশ কুঁড়োজালি তৈরি করে বসে আছি। টান মারলে মাটিসুদ্ধ উপড়ে চলে আসবে। কী ভয় মরণে। ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ। ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ। এক বাপ মরলে আরও একশো বাপ রয়ে গেল। যমরাজ তুমি কত নেবে? ধিনতাকের ব্যাটা তিনতাক, আমি দিতে থাকি তুই নিতে থাক।

পালের ভারে কাত হয়ে তীব্র বেগে নৌকো ঘাটে এসে ভিড়ল। দু’জন মাঝি লগির ঠেকনা দিয়ে সানবাঁধানো সিঁড়িতে নৌকোর মাথা ঠোকা অদ্ভুত কায়দায় বাঁচিয়ে দিল। নিত্য করে করে এমন অভ্যস্ত হয়েছে, টাল খায় না, ফসকায় না, পেটে খোঁচা লেগে ভুঁড়ি ফঁসে না। নৌকোর মাঝখানে সাইকেল নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে ছিলেন, বাহনের ওপর বাহন। বেশ মজা। তিনি ঠেলেঠুলে আগে নামতে চাইছিলেন। পারলেন না। ছইয়ের ভেতর থেকে ডুরে শাড়ি পরা বেশ পাঠঠা চেহারার এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। পানের রসে পুরুপুরু ঠোঁটদুটি বেশ লাল। শরীরের ঊর্ধ্বভাগে অদ্ভুত এক ঝাঁকুনি দিয়ে কোমরে শাড়ির আঁচল জড়াতে জড়াতে কাঁচ-ভাঙা গলায় বললেন, যাচ্ছেন কোথায়? মাছের ঝুড়ি না নামলে নামবেন কী করে? যাঁরা শেষে নামবেন বলে উদাস উদাস মুখে বসেছিলেন, মহিলা তাদের মাথার ওপর দিয়ে টপকাতে টপকাতে গলুইয়ের পাশ দিয়ে টাল খেতে খেতে, মাঝিদের কোমর জাপটাতে জাপটাতে সামনে চলে এলেন। কে একজন বলে উঠলেন, গন্ধ। মহিলা ঘাড় ঘুরিয়ে ফোঁস করে উঠল, তোমার বউয়ের গায়ে কীসের গন্ধ? গোলাপের?

রসিক ছোকরা উত্তর দিল, বউ নেই গো আমার।

ঝুড়িটা মাথায় চাপিয়ে কোমর দুলিয়ে মেয়ে উত্তর দিলে, তা হলে রাতের বেলা লণ্ঠন জ্বেলে পাড়ায় এসো, চাঁদা মাছ পাবে।

এনকোর, এনকোর! গরবিনি মাছ নিয়ে, হেলে দুলে, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ওপরে উঠে এল। ওপারের যাত্রীরা এপারে পারানির কড়ি ফেলে। এপারের যাত্রীরা ওপারে। মহিলাকে কিছুই দিতে হল না। তিরছি নজরিয়াকি বাণ মেরে, ঘাটমাঝিকে কাত করে দিয়ে সরে পড়ল। পৃথিবীতে আদিরসের বড় ছড়াছড়ি। মৎসগন্ধা হলেও যৌবনে ডগমগে। আর যায় কোথায়? পৃথিবী ছেড়ে কথা কইবে? ঝুলনের মেলায় আধবুড়ি ঘাঘরা পরে মুখে রং মেখে নাচছে। সমঝদার খোঁচা মেরে বলছে, রস অছি। পরেশ মাঝরাতে ঘেঁটে গামছা পরে ছানার তালের ওপর নাচছে। জবা মাথার ওপর হাত তুলে চুল আঁচড়াচ্ছে। ফুলগাছের টবের আড়ালে বসে শিকারের চোখ অজগরের নিশ্বাসের টানে গুটিগুটি এগিয়ে চলেছে। আগুনে পতঙ্গের আত্মাহুতি। ও থাক। ও যেখানে লেখা আছে সেইখানেই থাক, দুঃখং সর্বং অনুস্মৃত্য কামভোগান্নিবর্তয়েৎ, অজং সর্বং অনুস্মৃত্য জাতং নৈব তু পশ্যতি। পাগলা জগৎ দুঃখময়। এই দুঃখের পৃথিবীতে সকাম হয়ে মরিসনি। সবই অজ। কিছুই নেই। তবে তুই ব্যাটা দামড়া ছাগল আঠাঅলা বটপাতা দেখে ব্যা ব্যা করে ছুটিস কেন? ডুরে শাড়ির ফাঁদ দেখলি। আর খোঁপা মাথায় মাছের ঝুড়িটা দেখতে পেলি না। চিদানন্দ সাগরে মাছ খেলছিল, টোপ ফেলে, বঁড়শি গেঁথে, আঁশ চুবড়িতে লাদাই করেছে। দশ টাকা সের, দশ টাকা সের।

শেষ যাত্রী নেমে গেল। পাটাতনে লগি রাখার শব্দ হল। শিকলে বাঁধা নোঙর ঝপাং করে জলে পড়ল। মাতামহ বললেন, নে উঠে পড়। কখন ছাড়বে কে জানে?– ঢেউয়ের তালে তালে নৌকো দোল খাচ্ছে। আই অ্যাম হেলপলেস, আই অ্যাম হেলপলেস। পাপীর মাথা নড়ছে। পুণ্যাত্মার মাথা নড়ছে। জজসাহেবের মাথা নড়ছে, আসামির মাথা নড়ছে। আমার কাঁধে হাতের ভর রেখে মাতামহ উইকেটকিপারের ভঙ্গিতে টাল খেতে খেতে নৌকোয় উঠলেন।

ঘটের মাথায় কঁঠালি কলার মতো নাতি আর মাতামহ নৌকোর মাঝখানে পাল টাঙাবার বাঁশের পাশে গাট হয়ে বসেছি। এ সময় এপার থেকে ওপারে কে আর যাবে! এখন সব ফেরার সময়। কলকারখানায় ছুটির সময়। মাতামহ জোরে জোরে দু’বার নিশ্বাস নিয়ে বললেন, জলের কেমন মিষ্টি গন্ধ দেখেছিস? ভেতরটা যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। আসছে বার জন্মে মাঝি হব। মাঝিরা খুব তাড়াতাড়ি ঈশ্বরকে পায়। মরে স্বর্গে যায়। তুই কী হবি?

আমি গভীর জলের মাছ হব।

খুব ভাল ইচ্ছে। কারুর বাপের ক্ষমতা নেই ধরে। মাঝে মাঝে শুধু ঘাই মেরে যাবি। তবে এ জন্মের সংস্কারে আসছে বার তুই লেংটি আর চিমটে নিয়ে জন্মাবি। এই পথের মাঝখানে বসে বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না রে, চল গলুইয়ের ওপর গিয়ে বসি।

যদি টাল খেয়ে পড়ে যাই!

ঠিক মামার ধাতটি পেয়েছিস। ভয়েই আধমরা। পুরুষমানুষকে একটু ডাকাবুকো হতে হয়। আমার শরীরে কত জায়গায় কাটার দাগ আছে জানিস? এই দেখ।

সামনে একটা ঠ্যাং ছড়িয়ে দিলেন। গুলি থেকে উরু পর্যন্ত বড় ছোট নানা ধরনের দাগ।

দাদু, আপনি কি যুদ্ধে গিয়েছিলেন?

দুর ব্যাটা। যুদ্ধ কি থেমেছে নাকি? এখনও চলছে। এই দাগটা কীসের জানিস?

উরুর মাঝখানে বেশ বড় মাপের গভীর এক ক্ষতচিহ্ন।

এই দাগটা বেনারসের স্মৃতিচিহ্ন। বিশ্বনাথের গলিতে ষাঁড়ের লড়াই। যাঁড়ে ষাঁড়ে নয়। ষাঁড়েতে আর আমাতে। সেই চাঁদবদনিকে বাঁচাতে গিয়ে এই অবস্থা। তুই হলে?

কোন চাঁদবদনি দাদু? আপনার প্রেমিকা?

জিভের ডগাটা সামনে একটু বের করে বললেন, তুই চাঁদবদনি বলিসনি। তোর গুরুজন, দিদিমা। সবে বিয়ে হয়েছে। মনের যমুনায় তখন প্রেমের ঢেউ। রেল কোম্পানির ‘পাসে’ ভারত-ভ্রমণ হচ্ছে। তখনও তো পুরনো হয়নি বউ। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনি গোছের অবস্থা। আর তোর কানে কানে বলি, প্রথম যৌবনে সেই মেয়েমানুষটিকে দেখলে তুইও ভিরমি যেতিস। টকটক করছে গায়ের রং। তেমনি চেহারা। যেন উড়িষ্যার মন্দিরের খোদাই করা পাথরের মূর্তি।

ছবি দেখেছি দাদু।

ধুস, ও ছবিতে সে চেহারাই নেই। ঘি আর মালাই খাইয়ে খাইয়ে কুমড়োপটাশ করে দিয়েছি। তোকে আর একটা কথা বলে রাখি, সোহাগ ভাল অতি সোহাগ ভাল নয়। আদরের জিনিস তাড়াতাড়ি সরে পড়ে।

তারপর সেই ষাঁড়ের লড়াই?

হ্যাঁ, ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াই। বিশ্বনাথের গলি, একটা গাভী, দুটো ষাঁড়।

নিজেকে ষাঁড় বলুন ক্ষতি নেই, দিদিমাকে গাভী বলাটা উচিত হচ্ছে?

তুই তো তার ভুড়ি দেখিসনি। দেখলে তুইও তাই বলতিস। আমি আদর করে নাম রেখেছিলুম ভগবতী। ঘর অন্ধকার করে যখন ঘুমোত, দুর থেকে নিশ্বাসের শব্দ শুনলে মনে হত, মাঝরাতে গোয়ালে এসেছি। যা যা শালা, নিজের বউকে আমি যা খুশি বলতে পারি। তোর বউকে তো বলিনি!

সকালে বাবা আপনাকে যে সারমন দিলেন ভুলে গেলেন। এই এত কথা বলছেন? অভ্যাসটা থেকে যাবে, রাতে বকুনি খাবেন।

রাতে তোর বাপের চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনতে যাচ্ছে কে? নিজের মসনদে গিয়ে একগুলি আফিং খেয়ে বেটির পায়ের তলায় পেছন উলটে পড়ব।

কনক যখন জিজ্ঞেস করল, রাতে কী খাবেন? তখন লম্বা এক ফিরিস্তি ছাড়লেন কেন?

তুই বুঝিস না কেন? এক বেলা খেতেই আমার লজ্জা করে। জামাই আমার বলেছে বলে দু’বেলাই খেতে হবে। আমি কি তোর তেমন হ্যাংলা দাদু?

কনক রাগ করবে।

রাগ করবে কেন?

বাঃ, রান্না নষ্ট হবে না?

তাও তো ঠিক। নাতবউকে তো রাগানো চলবে না।

কেন বউ বউ করছেন? ব্যারিস্টারের মেয়ে। সকালে ফট করে যখন বললেন মেসোমশাইয়ের মুখটা কীরকম গামলার মতো হয়েছিল, দেখেছিলেন?

রাখ তোর ব্যারিস্টার। এমন সোনারাদ ছেলে পাবে কোথায়?

দু’আঙুলে আমার গাল টিপে দিলেন। নৌকো দুলে উঠল। টকটকে লাল পাড় শাড়ি পড়া এক বর্ষীয়ান মহিলা নৌকোয় ডান পা রেখে সঙ্গের ছেলেটিকে বলছেন, বিষ্ণু, আমাকে ঠেলে তোল। দেখিস যেন দেবে যাসনি।

বিষ্ণু বললে, মা জননী, তুমিও একটু চেষ্টা করো।

আমি কি আর চেষ্টা করছি না বাবা, এ তো আর সানবাঁধানো পইঠে নয়, নৌকো যে ভর সইতে পারছে না। বিষ্ণু ঠেলছে আর বলছে, হেঁইও মারি হেঁইও, আউর ঘোড়া হেঁইও, বয়লট ফাটে হেঁইও।

মাতামহ উঠে দাঁড়ালেন। পালের খোঁটা ধরে টাল সামলে, সামনে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আসুন মা, আমার হাত ধরে উঠুন।

শাঁখা পরা, গোল, টকটকে একটা হাত দাদুর হাতে ধরাতে ধরাতে সেই মা বললেন, বিষ্ণু, আর ভাবনা নেই, আমার বড়ছেলে এসে গেছে।

কপালে এতখানি গোল সিঁদুরের টিপ পড়ন্ত বেলার সুর্যের মতো টকটক করছে। গলায় গোটা গোটা রুদ্রাক্ষের মালা। এক এক আঙুলে ঝিলিক মারছে এক এক রকম পাথরের আংটি। দিদিমা বেঁচে থাকলে মনে হয় এইরকমই দেখতে হতেন। চোখদুটো ভারী অদ্ভুত। নীলার মতো। যার দিকেই তাকাচ্ছেন দৃষ্টি যেন তাকে ছুঁড়ে চলে যাচ্ছে। সামলেসুমলে বসতে হয়। অস্বস্তি হয়। মনে হয় উলঙ্গ হয়ে যাচ্ছি।

মহিলা পালের খোটা ধরে দাঁড়াতেই মাতামহ হাঁসের মতো পেছন উলটে পায়ের কাছে প্রণামে। নামলেন। গাঙের জল ছলকে উঠল, মা, মা, জগদম্বে, সর্বমঙ্গলা, মঙ্গল্যে, মা, মা।

ওরে পা ছাড়, ওঠ পাগল ওঠ, নৌকো দুলছে, পড়ে যাব বাবা। এইখানটাতেই বসি। ছইয়ের ভিতরে গিয়ে কাজ নেই। বিষ্ণু বললে, পড়ন্ত বেলার রোদ লাগবে গো।

ওরে মুখপোড়া, বেলা যার পড়ে এসেছে তাকে একটু দিনের আলোয় থাকতে দে। ঘরে ঘরে আলো দেখে লাগে ভাল, মোর হৃদি গেহ অন্ধকারে কালো। হ্যাঁগো বড়ছেলে, তোমার গান আসে?

কথা বলতে বলতে মহিলা আসনপিড়ি করে নৌকোর মাঝখানে বসলেন। আহা! একেই বলে। মায়ের কোল। তেমন মানুষ হলে বলত, মা জননী আমার এক কাঠা জায়গা নিয়ে চারপাশ আলো। করে বসেছেন। টুক করে আমিও একটি প্রণাম সেরে নিলুম। দুহাতে আমার মাথাটি আঁকিয়ে দিয়ে বললেন, ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলে বড় কষ্ট রে! এটি বুঝি তোমার নাতি? মেয়ের মেয়ে?

মাতামহ বসে পড়েছেন। তুমি কী করে বুঝলে মা?

ও আমি বুঝতে পারি। কী করে পারি তা বলতে পারব না। সবই গুরুর কৃপা। এই ছেলেটি পৃথিবীতে স্নেহ ছাড়া সবই পাবে। মরুভূমিতে হাঁটতে হবে, কঁটাগাছ চিবোতে হবে উটের মতো। তোমার জীবন বাবা খুব সুখের হবে না। তবে ঘাবড়ে যেয়ো না। শত দুঃখ শত জ্বালা আসিবে আসুক। জীবন হল কাঁচের ফানুস। আলো যদি জ্বালাতে পারো অন্ধকারে চাঁদের মতো দেখাবে। ধারা নৈবপতন্তি চাকমুখে মেঘস্য কিং দূষণম/ ষৎ পূর্বং বিধিনা ললাট লিখিত তন্ মার্জিতুং কঃ ক্ষমঃ? চাতকের মুখে যদি জল না পড়ে তাতে মেঘের কী দোষ বলো? বিধি তোমার ললাটে যা। লিখেছেন, কার ক্ষমতা আছে তা মুছে দেয়? তবু পথ আছে। বিপদি মহতাং ধৈর্য।

নৌকোর নোঙর উঠল। বাতাস লেগে পাল ফুলে উঠেছে। একপাশে কাত হয়ে জলে ফেনা কেটে কেটে নৌকো সবেগে ছুটেছে। বড় বড় ঢেউ উঠছে হিসহিস করে। নৌকোর ধাক্কা লেগে ঢেউ। ভেঙে পড়ছে টুকরো টুকরো কাঁচের মতো। গায়ে জলের কণা এসে লাগছে। ভয়ে বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাতামহ উন্মুখ হয়ে বসে আছেন। চোখদুটো জ্বলছে। মনের মতো সঙ্গ পেয়ে গেছেন। এ আর এক চাতক। না চাইতেই জল পেয়ে গেছেন।

মহিলা আমার মাথার পেছনে একটা হাত রাখলেন। কী ভারী হাত! এ হাতে জগৎকে দাবিয়ে রাখা যায়। বললেন, কী রে ভয় করছে? পরান মাঝি হাল ধরেছে, ভয় কীসের বোকা! তুই না পুরুষমানুষ! তুই বলবি, হরিফে জোশিশে দরিয়া নহি খুদাদারি-এ সাহিল। উদ্বেল সমুদ্রের শত্রু আমি নই, আমি তটের দম্ভ। আমি পুরুষ। কীরকম পুরুষ? জানতুম পর নিসার করতা হুঁ। মৈ নহি। জানতা দুআ ক্যা হৈ। তোমার পায়ে নিজেকে ফেলে দিয়েছি, প্রার্থনা ফ্রার্থনা জানি না।

মাতামহ বললেন, একী? এ তো দেখছি উর্দু! তুমি উর্দু শিখলে কোথা থেকে?

হঠাৎ নৌকো চরকিপাক খেয়ে গেল, মোচার ভোলার মতো। মাঝিদের হইহই, পালের দড়ি ছিঁড়ে গেছে, সামাল সামাল। সামনের দিকে যাঁরা বসে ছিলেন তারা চিৎকার জুড়লেন, গেল গেল। নৌকোর দুলুনি দেখে প্রথম থেকেই আমার আত্মা খাঁচাছাড়া হচ্ছিল। সাধিকা মাথায় হাত রেখে চেপে ধরেছিলেন। এখন মনে হল জলে ডুবে মরার আগে একবার বাথরুমে যেতে পারলে ভাল হয়। খোলসা হয়ে মরার আর এক আনন্দ। মাতামহ তারা তারা বলে চিৎকার শুরু করলেন। দড়ি-ছেঁড়া পাল ছিটকে বেরিয়ে গেছে। নাগালের বাইরে পতপত করে উড়ছে। মাঝে মাঝে হ্যাঁচকা। টান মেরে যাত্রীসমেত নৌকো উলটে দেবার চেষ্টা করছে। হালমাঝি যেন লড়াই করছে। হাত আর পা দুটোই চলছে। এত ভয়েও সে দৃশ্য দেখে মনে হল, একেই বলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জার লড়াই। মাতামহ এরই মাঝে ফিসফিস করে বললেন, পইতে থেকে সিন্দুকের চাবিটা খুলে নে। নামতে নামতে একেবারে নীচে নামবি, দেখবি একটা ছোট্ট বালিশ। বালিশটা তোর। বাকি সব ফেলে দিবি।

ডুবলে, আমরা দু’জনেই তো ডুবব। চাবি নিয়ে করবটা কী?

তুই তো সাঁতার জানিস।

সে সাঁতারে এ নদী সাঁতরানো যাবে না।

সাধিকার কিন্তু কোনও ভাবান্তর নেই। মুখ দেখলে মনে হবে বেশ মজা পাচ্ছেন। বিষ্ণুও বসে আছে গাট হয়ে। নিমীলিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। ঠিক মনে হল পেতলের চোখ। সে দৃষ্টি একমাত্র স্বপ্নেই হয়তো দেখা যায়। আমাকে বললেন, তোকে দুটো জিনিস শিখিয়ে দিই।

এখন শেখাবেন? সে শিক্ষা কি আর কাজে লাগানো যাবে? একমাত্র সাঁতার ছাড়া আর কোনও শিক্ষাই এখন কাজে লাগবে না।

কথার ফাঁকেই নৌকো আর একবার বাঁই করে ঘুরে গেল। যাঁরা আরও বেশিদিন বাঁচতে চান তারা সেই ঘূর্ণায়মান পদ্মপত্রে বসে পতনোম্মুখ জলবিন্দুর মতো হায় হায় করে উঠলেন। মাঝিরা পালের দড়িটাকে ধরবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ভূত না হলে অত বড় হাত পাবে কোথায়? সাধিকা ছেলেমানুষের মতো বলে উঠলেন, বাঃ, বেশ মজা তো! নাগরদোলায় চেপেছি রে বিষ্ণু।

দেরিতে হলেও বিষ্ণু এবার ভয় পেয়েছে। সে বলল, মা, তুমি একটা কিছু করো।

আমি কী করব? আমি কি ভগবান? তোরা বড় চিৎকার করছিস। মরবি তো মানুষের মতো মর। এমন করছিস যেন ঘোড়ার আস্তাবলে আগুন লেগেছে। বড়ছেলে?

মাতামহ ফ্যাকাসে মুখে শুকনো গলায় বললেন, বলো মা।

দড়িটাকে চেপে ধরো না বাবা।

আমি কি পারব মা? আমার যে বয়েস হয়েছে।

তা হলে হাওয়া কমুক। এমন ঝোড়ো বাতাস এল কোথা থেকে! তোমরা একটু স্থির হও, মনে স্থির, দেহে স্থির। সেই পেতলের চোখদুটি অর্ধনিমীলিত হয়ে রইল কিছুক্ষণ। হালের মাঝি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর পারছে না যেন সামাল দিতে। হঠাৎ বাতাস পড়ে গেল। নদীর জল সম্পূর্ণ স্থির। বহু টাকা উড়িয়ে বড়বাবুর দাপট যেমন কমে আসে, পালের ফটফটানিও সহসা থেমে গিয়ে নেতিয়ে পড়ল। ঘরের ছেলে ঘরে এসো বাবা। মাঝিরা দড়িটা আবার যথাস্থানে বেঁধে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার সতীমাইকি জয়।

নৌকোর মুখ কিন্তু ঘুরে গেছে। যে-পার থেকে ছেড়েছে সেই পারের দিকেই মুখ। সতীমা চোখ খুললেন। হাসিহাসি মুখে তাকিয়েছিলুম। তিনি উদাস কণ্ঠে বললেন, বিষ্ণু, ছেলেটা মারা গেল বাবা।

সেকী মা? এই তো দেখে এলে, হাসছে, দুধ খাচ্ছে।

নাঃ, বাতাস বড় জোরে বইছিল। প্রদীপ নিবে গেল। মাঝি, তোরা বাবা নৌকোর মুখ আর যোরাসনি। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চল।

মাতামহ জিজ্ঞেস করলেন, কে মারা গেল মা?

আমার এক ভক্তের ছেলে। এই নিয়ে তিনটি গেল। সবাই কি আর মা হতে পারে? হয় ছেলে মরে, নয়তো মা মরে। আমি কী করব? তোমরা সব পাপ করবে, পাপের বোঝা নিয়ে আসবে। ফল ভুগতে হবে না!

তোমার কে মা বুঝবে লীলে। তুমি কী নিলে কী ফিরিয়ে দিলে ।

নৌকো কোনাকুনি পাড়ি মেরে যে-ঘাটে ভিড়ল, সেটা পারঘাটা নয়। চৈতন্যঘাট। ইতিহাসের কোনও এক কালে এই ঘাটে শ্রীচৈতন্য নৌকো থেকে নেমেছিলেন। সময় সময়ের নদী দিয়ে বয়ে চলেছে। ঘাট পড়ে আছে আধভাঙা হয়ে জলধারার পাশে। ক্ষয়া ক্ষয়া পাথরে কালচে সবুজ শ্যাওলার পুরু আস্তরণ।

বিষ্ণু আগে নামল। বিষ্ণুর কাঁধে ভর রেখে তিনি সাবধানে নামলেন। ঘাট বেশ পিছল। মাতামহও নেশাগ্রস্তের মতো পেছন পেছন চলেছেন। মন পড়ে আছে সাধিকার দিকে। নৌকোর দুলুনিতে তাই বোধহয় টালমাটাল হচ্ছেন না। আমাকেও নামতে হল। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। কোথায় চলেছি, কেন চলেছি জানি না। পিছলে পা হড়কাচ্ছে। পড়ে না যাই।

প্রভু যেমন পেছনে ন্যাজ নাড়তে নাড়তে আসা কুকুরের দিকে ‘কী রে কেন আসছিস’ দৃষ্টিতে তাকান, সেইভাবে তিনি আমাদের দিকে তাকালেন। হাতে বিস্কুট নেই, তবু সেই ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, কী রে কোথায় চললি তোরা?

মা, একটু কৃপা। একটু কৃপা দিয়ে যাও মা। মাতামহ জমিদারের পেছনে হাতকচলানো নায়েবের মতো সামনে কুঁজো হয়ে সিঁড়ি ভাঙছেন। মাঝে মাঝে পিছলে যাবার মতো হচ্ছেন। কৃপাটুপার কথা আমার কিছু মনে হচ্ছে না। আমি কেবল ভাবছি বাতাস উঠল কেন? বাতাস পড়ল কেন? এ কি শক্তি? না কোনও স্বাভাবিক ঘটনা। কে মরল! সে খবরও কি বাতাসে ভেসে এল! নৌকো তীর ছেড়ে চলে গেল।

মা মহাদেবের বুকে দাঁড়ানো জগদম্বার মতো দৃপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, কৃপা কি ভিক্ষে করে পাওয়া যায় বাবা? এ কি ছেলের হাতে মোয়া যে তুমি খাবে ভোগা দিয়ে! আধার প্রস্তুত কর। যন্ত্রটাকে বেঁধে নে তবে তো সুরে বাজবে।

সিঁড়ির দু’ধাপ নীচে আমি উদোবন্ধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্যাচালো মন। সহজে যেন বিশ্বাস আসতে চায় না। নাস্তিকের রক্ত শরীরে বইছে। আমার ঘোড়ার মতো মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ডাকলেন, এদিকে উঠে আয়। তোকে কানে কানে দুটো কথা বলে যাই।

নিশ্বাসে গোলাপের গন্ধ। কানে কোঁদল ফিট করে তপ্ত সিসের মতো গুটিকতক কথা তিনি ঢেলে দিলেন, তুই কখনও কাউকে ভালবাসার চেষ্টা করবি না, তা হলে তার মৃত্যু হবে। কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করবি না, সে পালিয়ে যাবে। সুখে থাকার চেষ্টা করলে অসুখে পড়বি। নিজেকে খুব কষ্টে রাখবি তা হলেই তোর সুখ হবে। তুই হলি শনি। নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম। ছায়ায়া গর্ভসস্তৃতং তং নমামি শনৈশ্চরম ॥ ওই তোর পথ, ওই দেখ। ধুধু প্রান্তর। ধুলো উড়ছে। সাদা উত্তরীয় উড়িয়ে তুই চলেছিস, চলেছিস, ছায়া নেই, মায়া নেই, কায়া নেই, মমতা নেই, কনককান্তি নেই।

কী হল কে জানে? চোখের সামনে যেন মরীচিকা দেখছি। নদী অদৃশ্য। জনপদ লুপ্ত। সব যেন ভোজবাজি হয়ে গেল। সত্যিই ধুলো-ওড়া, রোদ-জ্বলা প্রান্তর। দূরে বহু দূরে আমি আমাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভীষণ ভয়ে আমার চিৎকার, এ তুমি কী করে দিলে? উত্তর এল দূর থেকে, ভয় পাসনি খোকা, আবার দেখা হবে, আবার, আবার।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন