১.০১ যাত্রা শুরু

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

প্রথম খণ্ড

অবতার বরিষ্ঠায় শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ

মাতাজী
পরমারাধ্যা
ব্রাজিকা মোক্ষত্রণার
শ্রীচরণকমলে

.

যাত্রা শুরু

এ আমার আত্মজীবনী নয় তবে আত্মজীবনীর মত করে লেখা অসংলগ্ন প্রলাপ। বস্তু আছে কি না জানি না তবে বাস্তব কিছু থাকতে পারে। পৃথিবীতে অনেকেই অনেক কিছু করতে আসে। আমার স্কুলের প্রধানশিক্ষক মশাই ক্লাসে এসে প্রায়ই বলতেন, ওরে এসেছিস যখন তখন দেয়ালে একটা। আঁচড় রেখে যা। স্বামী বিবেকানন্দ, যুগাবতার রামকৃষ্ণ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, হুড়হুড় করে একগাদা নাম উচ্চারণ করতে করতে রবীন্দ্রনাথে এসে স্তব্ধ হয়ে যেতেন। চোখ ছলছলে হয়ে উঠত। তারপর চটাক করে সেই চটকা ভেঙে শেষ বেঞ্চের কোণের দিকে বসে থাকা শম্ভু সাঁতরার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলতেন, অ্যায়, উঠে দাঁড়া। শম্ভ কলের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াত। ইংরিজি কর, রামেরা দুই ভাই। শম্ভ বারকতক রাম নাম করে চেত্তা-খাওয়া ঘুড়ির মতো একপাশে কেতরে পড়ত। সেই বয়েসেই বুঝেছিলুম, ত্রেতায় রাম নামের যথেষ্ট পাওয়ার থাকলেও কলির শেষপাদে একেবারেই শক্তিহীন; কারণ এর পরেই হেডমাস্টারমশাই শম্ভুর পিঠে লিকলিকে বেত দিয়ে সপাসপ আঁচড় কাটতে শুরু করেছেন। এরপর ওই রাম তার যোগ্য ভ্রাতাকে নিয়ে ইংরিজি হবার জন্যে ঘুরে ঘুরে আমাদের সকলের কাছেই আসছে আর আমরা যথারীতি বেত্রাহত হয়ে আঁচড়-কাটা মহাপুরুষ না হয়ে আঁচড়-খাওয়া মানবসন্তান হয়ে নেতিয়ে নেতিয়ে পড়ছি। একটি প্রশ্ন এবং পর্যায়ক্রমে ক্লাসের বড়, ছোট, দামড়া ষাটজন মনুষ্যশাবককে পেটাতে পেটাতেই সময় কাবার হয়ে যেত। টেবলের ওপর বেত ফেলে দিয়ে হেডমাস্টারমশাই কোঁচার খোঁটে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে দিনের শেষ কথাটি বলতেন, তুমি যখন এসেছিলে, তখন তুমি কেঁদেছিলে জগৎ হেসেছিল, তুমি যখন যাবে হাসতে হাসতে যাবে, আর সারা জগৎ তোমার জন্য কাঁদবে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুটি বাতাসা বের করে তিনি মুখে ফেলতে-না-ফেলতেই স্কুলের দারোয়ান এসে বেত, ডাস্টার আর মোটা ডিকশনারিটা তুলে নিয়ে চলে যেত। কাঁধে চাদর ফেলে আমাদের প্রধানশিক্ষক উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে সাবধানে নেমে আসতেন, তারপর আপন মনে আঁচড় কেটে যা আঁচড় কেটে যা বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে চলে যেতেন। আমরা সদলে ডোরা কাটা জেব্রার মতো বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবতুম দাগ রেখে যাওয়া ব্যাপারটা কত সহজ! কিছুই না, একটা বেত আর মনুষ্যরূপী গাধাদের কালো-সাদা পিঠ আর একটি প্রশ্ন। এই তিন মালকে মেলাতে পারলেই মহাপুরুষ। মার খেতে খেতে শম্ভু সত্যিই মহাপুরুষ হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলে তার পিঠের আর কোনও সাড় নেই। মারলেও লাগে না। কানমলার চোটে ডান কান বাঁ কানের চেয়ে দু’সুতো লম্বা হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে সাচ্চা সাধুর মতো সবসময় শালা বেরোচ্ছে।

পেটাই হতে হতে পেটাই হতে হতে, জলছাত তৈরি হয়। গোটা কুড়ি পাঠঠা মেয়েমানুষ জলের আরক ছিটোয়, পিচিক পিচিক করে খইনির থুতু ফেলে আর কাঠের মুগুর দিয়ে পেটাতে থাকে যদ্দিন না পেটাইয়ের কাঠ তড়াং তড়াং করে লাফিয়ে ওঠে। এইভাবে হিট প্রুফ, ওয়াটার প্রুফ ছাদ তৈরি হলেও অভিমানশূন্য মানুষ তৈরি হয় কি? কেরিয়ারও কি তৈরি হয়? হলে আমি সত্যিই মহামানব হয়ে যেতুম। ওটা আলাদা ব্যাপার। আমার সম্পর্কে একদিন একটি মন্তব্য শুনে বড় মুষড়ে পড়লুম। হাজারবার ধুলেও কয়লা সাদা হয় না। পেতল মাজলেও সোনা হয় না। মানুষ নিয়ে আসে। অদৃশ্য একটি পুঁটলি নিয়ে কুঁজো হয়ে অন্ধকার রাতে মাতৃজঠরে মুক্তোর পেটে স্বাতী নক্ষত্রের জলের মতো ঢুকে, ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তারপর একদিন অয়েলক্লথে ওঁয়া ওঁয়া করে গড়িয়ে পড়ে। গর্ভে মহাপুরুষ এলে মায়ের জ্যোতি বেড়ে যায়। শেষরাতে পিতা স্বপ্ন দেখেন, আষ্টেপৃষ্ঠে বটের ঝুরি জড়ানো ভগ্ন দেউল থেকে জ্যোতিষ্মন এক দেবশিশু বেরিয়ে এসে বলেন, আমি তোর কাছে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে পিতার ঘুম ভেঙে যায়। স্বেদ, কম্প, পুলক প্রভৃতি দেখা দেয়। তিনি মাকে ঠেলা মারতে মারতে বলতে থাকেন, ওগো, শুনছ শুনছ, তিনি আসছেন, তিনি আসছেন। শেষের দিকে আনন্দে গলা ভেঙে আটরকম শব্দ বেরোতে থাকে। আগমন সংবাদ অকটেভে খেলে বেড়ায়। ঘুম-চোখে মা হয়তো জিজ্ঞেস করেন, কে আসছে গো? পিতা মশারির মধ্যে গাট হয়ে বসে ভাবাশ্রু বর্ষণ করতে করতে বলেন, যেসাস হতে পারেন, কৃষ্ণের অবতার হতে পারেন, স্বয়ং মহাদেব হতে পারেন। কে বলতে পারে, সময়ের ঘূর্ণনে দ্বিতীয় শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব হচ্ছে কি না! ক্ষুদিরাম তোতা এইভাবেই গদাধরকে পেয়েছিলেন। জগন্নাথ পেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যকে। মায়ের খাতির অমনি বেড়ে যায়। মহাপুরুষের ডিম্ব ধারণ করেছেন। অলৌকিক জ্যোতি দেখা দিয়েছে লৌকিক শরীরে। যৌথ পরিবারের ছাদে ভাদ্রের চাদি-ফাটা রোদে বসে বসে বড়ি কি কয়লার গুল আর দিতে হবে না। বাগানের পাঁচিলে থ্যাপাক থ্যাপাক করে ঘুঁটে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য তলব করা হল। তাঁরা প্রত্যেকেই একবাক্যে ঘোষণা করলেন, এ বস্তুটির আবির্ভাব-মুহূর্তে ছোটবউদির চেহারায় কোনও অলৌকিক পরিবর্তন আসেনি। স্বপ্ন একটা দেখেছিল মনে হয়, বাবা পঞ্চানন ষাঁড়ের পিঠে চেপে আসছেন। পঞ্চাননতলার পঞ্চানন? সে দেবালয় ভেঙে কালের গর্ভে চলে গেছে। তা ছাড়া বাবা পঞ্চাননের তেমন দেবমর্যাদা ছিল না। পূজারি বেচারা গাঁজায় দম মেরে মেরে অকালেই দমহারা হয়ে পরপারে। মনে পড়েছে, তিন বছর বয়েসে ওকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে মাথা ন্যাড়া করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরেই পুঁয়ে পেয়ে ছেলে শুকোতে লাগল। সাত সমুদ্রের কডলিভার মালিশ করে করে মালিশ করে করে, রোদে ফেলে রাখা হত ধুতি চাপা দিয়ে। কী বরাত! যে বয়েসে শিশু কোলে কোলে, বুকে বুকে ত্যাত্যা, ব্যাব্যা করে বেড়াবে, গোলগাল মোটা মোটা হাতের কচি কচি আঙুল দিয়ে নাক খামচাবে, চশমা ধরে টানবে, সেই বয়েসেই অস্পৃশ্য মৎসগন্ধ হয়ে দাওয়ায় পড়ে রইল। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে কাছে এগোতে হত, এই যে আমার বাবুটা, এই যে আমার ব্যাবাটা। মুখে শিশুর স্বর্গীয় হাসি ছিল না। নাড়গোপালের মতো হামা ছিল না। কোমরের লাল ঘুনসিতে তামার ফুটো পয়সা কাপ হয়ে বসে ছিল না। সংসারের চাতালে এক দুঃস্বপ্নের আবির্ভাব। তিমিরে কডলিভার-মর্দিত তিমিশিশু। হাতে তার গুনচুঁচ। তবিল ফুটো করে সব সঞ্চয় লিক করিয়ে দিলে। এ মহাপুরুষ হল চৌবাচ্চার সেই বিখ্যাত ছেদা। যাঁর আগমনে সংসারটাই ড্যামেজ হয়ে গেল।

পুত্রের জন্মে পিতার ভূমিকা কী আমার জানা হল না। তবে মা আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে-থাকা। মাতুল বংশের অবদানে আমি যে একটি গেঁজে যাওয়া পদার্থ এ সত্যটি পাকেপ্রকারে নানাভাবে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা হয়েছিল। ওই যে তোমার কাঠামো, ওটা তোমার মামার দিকেই গেছে। বাপু। এ বংশে কারুর বত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি ছিল না। মিনিমাম ছত্রিশ, ম্যাক্সিমাম ছেচল্লিশ। হাতের কবজি কারুর অমন পাকাটির মতো ছিল না। ঘড়ি পরবে কী? পরতে হলে বাজুবন্ধ করে পরতে হবে। অমন সখীমার্কা চুল ওই বংশেরই পেটেন্ট করা জিনিস। বকের মতো লম্বা ঘাড়। ঘোড়ার মতো মুখ। ও মুখে আর ও মাথায় বাস্তব বুদ্ধি থাকতে পারে না। ইমোশন, সেন্টিমেন্ট, ক্রোধ এইসবই ভ্যাট ভ্যাট করছে। অহংকার, আলস্য, ঈর্ষা যাবতীয় তমোগুণে শরীর পাকতেড়ে। এরপর একটি ইংরেজি বাক্যে আমার চরিত্র সম্পূর্ণ, হি ইজ গুড ফর নাথিং। ওকে একটা নরম বিছানা আর গোটাকতক তুলতুলে বালিশ দাও, ঘুমিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিক। অগ্নিতে ঘৃতসংযোগের লোকের অভাব সংসারে হয় না। তারা কুটুস কুটুস করে বলতে লাগলেন, ওর মায়ের লিভারটা কমজুরি ছিল তাই গায়ে গত্তি লাগে না। ওর মায়ের সর্দিকাশির ধাত ছিল, টনসিল ছিল, তাই বারো মাসই হাঁচি কাশি সর্দি লেগেই আছে। এই যার স্বাস্থ তার জন্যে সংসার নয়, স্যানাটোরিয়ামই উপযুক্ত স্থান। মা ঊর্ধ্বলোকে পালিয়ে বেঁচেছেন, আমি পালাতে পারিনি। ফ্যাস্তা কলে পড়ে ফেঁসে গেছি। মায়ের জন্যে মাঝে মাঝে বড় কষ্ট হয়। রোজই একটা না একটা কারণে তাকে নামানো হয়, আর তার অপদার্থ সন্তানকে উপলক্ষ করে বাক্যবাণে এফেঁড়-ওফেঁড় করে আবার ওপর দিকে তুলে দেওয়া হয়।

আমার মরুভূমিতে মরূদ্যান ছিল না, ছিল মরীচিকা। সকলের মুখই কঠিন কঠোর। নিজের মুখ যতই বিষণ্ণ করি না কেন অন্যের মুখে স্নেহের নরম ছায়া নামে না। একটু ভালবাসা কোথায় পাওয়া যায়? গোকুলে নিশ্চয় কেউ বাড়ছে যে এই অধমকে ভালবাসবে। কল্পনায় সেই মুখটিকে পোস্টারের মতো বুকে সেঁটে একদিন খুব আবেগের গলায় গাইছি, বাঁকা ভুরু মাঝে আঁকা টিপখানি; কীভাবে জানি না, আমার সেই আবেগ চর্চা পিতৃদেবের কানে গিয়ে পৌঁছোল। তিনি রায় দিলেন, ছোকরা সঙ্গী খুঁজছে। হরমোন সিক্রিশনের এই তো বয়েস। তা বাপু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একটি বাঁকা ভুরু খুঁজে নিলেই হয়।

কে বোঝাবে ও গান হর্মোন গাওয়ায়নি। চৈত্রের খাঁ খাঁ দুপুরে কাঠঠোকরা যখন সশব্দে নারকেল গাছ ফুটো করে, ঘুঘু যখন নির্জন বাগানে দুপুরকে উদাস করে তোলে, ঘাস-জ্বলা মাঠে গাভী যখন কষ্টের হাম্বাস্বরে বোঝাতে চায় বড় কষ্ট, বড় কষ্ট, তখন মনে একটু বিরহের সুর.আসতেই পারে। তাতে শরীরস্থ গ্ল্যান্ডের কোনও কারসাজি নেই। কথা শুনে মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। বিদ্যে যদুর হয়েছে তন্দুর ভাল। আর না। এবার ভাগ্যান্বেষণ। একটা কিছু হতে হবে। হয়ে দেখাতে হবে, আমিও হতে পারি।

আমি যা হতে পারি তার একটা ছবি বেশ ভালভাবেই আঁকা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার হতে পারব না, বড়ই দুর্বল। অঙ্কে মাথা নেই। যার সরল করো-র উত্তর বেরোয় ন’হাজার সাতশো সত্তর বাই আঠারোশো ছত্রিশ, তার দ্বারা ব্রিজ বানানো কি ড্যাম তৈরি অসম্ভব ব্যাপার। ও ওই চুল উলটে মিনমিনে গলায় সখী সংবাদ করুক। বড় ইচ্ছে ছিল ফ্যামিলিতে একজন ডাক্তার হোক। বিধানচন্দ্র কি নীলরতন না হোক আমাদের ভুজঙ্গভূষণের মতো হলেও চলত। রাতবিরেতে কারুর শরীর খারাপ কি আত্মীয়স্বজনের ডেলিভারি কেস। হায় ভগবান! সে গুড়ে বালি। যে-ছেলে রক্ত দেখলে অক্ত অক্ত করে লাফায়, রাস্তায় বলহরি শুনলে একলা ঘরে শুতে পারে না, ভূত দেখে, সে হবে ডাক্তার! ওর ওই চুল উলটে চোখ বড় বড় করে, রে বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোরই ভাল। এর বেশি কিছু আশা করাই অন্যায়। আইনের জগতে রাসবিহারী, সেও কি সম্ভব? না, সম্ভব নয়। মেটাল দেখলেই বোঝা যায় ধারালো কিছু হবে কি ভোতা কোদাল হবে। যে লোক দেখলে লাজুক হেসে তোতলাতে থাকে তার পক্ষে সেলসম্যান হওয়াই অসম্ভব, বাঘা ব্যারিস্টার তো বহু দূরের কথা। সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ ফোড়ন কাটলেন, ধাতু দৌর্বল্য। অভিভাবক মেনে নিলেন, হতে পারে, নরানাং মাতুলক্রম। টাইপ আর শর্টহ্যান্ড শিখতে বলো, মাস গেলে যা হোক তিন-চারশো হবে। ওইতেই বাঁকা ভুরু হবে, আঁকা টিপ হবে। আমাদের সব স্বপ্ন ওই ছোকরা ভেস্তে দিলে।

কী হতে পারব না যখন স্পষ্ট, কী হতে হবে তাও যখন নির্দিষ্ট, তখন একটা নতুন পথ বেছে নিতে হবে। দেখিয়ে দোব, কোন পথে কে চলে। পৃথিবীটা ভোদকা মানুষে ছেয়ে গেছে। চওড়া চওড়া বুক, মোটা মোটা কবজি, ভুড়ি, কলাগাছের মতো উরু, থামের মতো ঠ্যাং। এক একবারে পাহাড়প্রমাণ ভাত উড়ছে, পাঁঠার ঠ্যাং, ডবল ডিমের ওমলেট। ঢক ঢক করে জল খাওয়া, ঢেউ ঢেউ ঢেঁকুর তোলা, চ্যাকর চ্যাকর পান চিবোনো। সমস্ত ব্যাপারটাই লাউড, নয়েজি, অ্যান্ড ভালগার। আমার উক্তি নয়, আমার মাতুলের। কাঁধে লাল ভিজে গামছা, ঢাকের মতো পেটের তলায় লুঙ্গির কষি বাঁধা, বুকের পাটা দুটো থলথল করে ঝুলছে, মোটা মোটা চুলের কুঁড়ি পথ উঠে গেছে ওপর দিকে। ঘাম গড়াচ্ছে। নাকের ফুটো থেকে চুল ঝুলছে খান্ডার গোঁফের ওপর। থেকে থেকে থুথু ফেলছে হ্যাঁক থু। গামছায় ফেঁ ফোঁ করে নাক ঝাড়ছে। মেয়েকে ডাকছে পুঁটি পুঁটি। ছেলের নাম রেখেছে হুলো। একপাল ছেলেমেয়ে আর ধুমসি বউ নিয়ে বাঙালি কত্তার সংসার। চুলোচুলি, ঠ্যাঙাঠেঙি। এই হ্যাঁহ্য করে হাসছে, এই প্যানপ্যান করে কাঁদছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গালগলা ফুলিয়ে হাঁকছে, হুলো, হুলো, নস্যির ডিবেটা দিয়ে যা, মা’র কাছ থেকে পাঁচ আনা পয়সা নিয়ে আয়। জানলা খুলে প্রতিবেশীর প্রশ্ন, পুঁটির পেট ধরেছে? উত্তর, না, আম পড়ছে। প্রশ্ন, বায়ু আছে, বায়ু? উত্তর, আরে বায়ুতেই তো মেয়েটাকে খেলে। সিদ্ধান্ত, গাঁদালের ঝোল খাওয়াও।

সকালে বেশ করে তেল মেখে চান। পাট করে আঁচড়ানো চকচকে চুল। পেটের কাছে পাট করা কোঁচা। গায়ে কামিজ। সাদা কাপড়ের ব্যাগে টিফিন কৌটো। ভেতরে আধডজন রুটি, একদা কুমড়োর ঘাট। কত্তা চললেন অফিসে৷ দুগগা দুগগা। সবচেয়ে ছোটটা দোরগোড়া থেকে চেল্লাচ্ছে, বাবা, থিগিগর থিগিগর আছবে। এই কত্তাই বিয়ের ভোজে বসে চিৎকার ছাড়ছেন, মাছটা আর একবার ঘুরিয়ে দাও। দইয়ের মাথা, দইয়ের মাথা। লেডিগেনিটা আর একবার। মন্দিরে গিয়ে ঠ্যাং ঠ্যাং করে ঘণ্টা বাজিয়ে বিকট ডাক, মা, মা, জগদম্বে! বুউ উ উ বুম, ব্যোম, শিব শ্যাম্ভ। চোখ উলটে কয়েক সেকেন্ড দণ্ডায়মান। তারপর হনহন করে ছুটছেন পাঁচুর পেছনে বাঁশ দিতে।

মন ভেবে দেখ, তুই কি ওইরকম হতে চাস? মন বললে, না। তা হলে? মামার সঙ্গে নিজাম ফ্যামিলির এক আত্মীয়ের বাড়িতে গানের আসরে গিয়েছিলাম। মামার সে কী সুন্দর পোশাক! গলাবন্ধ সিল্কের ঝকঝকে কোট। পা-চাপা পাজামা। সোনার চেন ঝুলছে বুকপকেটের কাছে। চোখে রিমলেস চশমা, মিহি আতরের গন্ধ। চলার মধ্যেও একটা হালকা নাচের ছন্দ। নবাব। পরিবারের বিরাট গাড়ি চেপে আসরে যেতে যেতে মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার দুটি মেরু, হয় রাজা না হয় মহারাজ। মহারাজ মানে সন্ন্যাসী। এর মাঝে যা কিছু সবই উঞ্ছবৃত্তি। ইয়া পুরু কার্পেট মোড়া বিশাল হলঘর। ঝাড়লণ্ঠনের ঝাড় দেখে মাথা ঘুরে যায়। বেনারসি কেটে জানলার পরদা হয়েছে। বাড়ি বললে ভুল হবে। প্যালেস। গৃহস্বামীর গায়ের রং চাপাফুলের মতো। পোশক রূপকথার মতো। আর সেই বাড়ির মহিলারা! স্বপ্ন দিয়ে তৈরি। একঝলক দু’ঝলকের দেখা। যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ডিমের মতো মুখ। খাড়া খাড়া নাক। পটলচেরা চোখ। দুধেআলতা রং ধনুকের মতো বাঁকা বাঁকা ভুরু। এমন পরিবেশ, এমন আদবকায়দা-নড়তেচড়তে ভয় লাগে। আমার মাতুলের এসব রপ্ত ছিল। গান ধরলেন যমুনা কা তীর। কিছুক্ষণের মধ্যে মনে হল, চাঁদের আলোয় তাজমহল তৈরি হচ্ছে। স্বয়ং সাজাহান বসে আছেন আরাম চেয়ারে। ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে ধীরে ধীরে নাচাচ্ছেন। নাগরার জরি তারের আগুনের মতো চমকে চমকে রিরি করে উঠছে। কফিনের ডালা খুলে মমতাজ আসছেন চাঁদের আলোর পোশাক পরে। সেদিন যমুনার তীর ধরে। হাঁটতে হাঁটতে কেবলই মনে হয়েছিল, ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করলে মন্দ হয় না। এই শেরোয়ানি, এই আচকান, এই আতরদান, এই মলমল, মখমল, মেহেন্দির আলপনা আঁকা চাঁপার কলি আঙুল, সুরমা-টানা তীক্ষ্ণ চোখ, উর্দু শায়ের। মসজিদ উঠে গেছে আকাশের চাঁদোয়ায়, আজানের শব্দ। রোগনজুস থেকে ভেসে-আসা জাফরান আর আতরের গন্ধ। না, ধর্ম বদলালে কিছু হবে না। চালকলা বাঁধা বামুনের রক্তে রং ধরবে না। চ্যাটাই পেতে মেটে দাওয়ায় আড় হয়ে শুয়ে আমার বৃদ্ধ প্রপিতামহ চ্যাটাস চ্যাটাস করে মশা মারতেন আর প্রপিতামহীকে গালাগাল দিতেন। সকালে ফতুয়া পরে বগলে রংচটা ছাতা নিয়ে পাঠশালে গিয়ে বাঁদরদের শুভঙ্করী শেখাতেন। সকালের নাস্তা বেগুনপোড়া দিয়ে একবাটি মুড়ি। বড়াখানা আলোচালের পিন্ডি, কঁচকলা ভাতে, পপিতা সেদ্ধ, থানকুনি পাতার ঝোল, হিংচে শাক। তস্য পিতা উদুখলে চালভাজা গুঁড়ো করে ফোকলা মুখে ফকফক করে খেতেন। বুড়ি বুড়োকে গালাগাল দিয়ে বলতেন, মরবে এইবার পেছন পটকে। মাঝে মাঝেই পরিবারে চালু নানান চুটকির মধ্যে যেটি কানে আসে, খুব সূক্ষ্ম নয় স্থূল, যথা: পণ্ডিতং পণ্ডিতং মুখ কেন সিটকেতং? উত্তর, কেঁচায় পট্টতং। প্রশ্ন, যাও না কেন নদী? উত্তর, বাকি আছে। দধি। সেই রক্তে কি আর পারস্যের বুলবুল গান গাইতে পারে? তৈমুর কি চেঙ্গিজের সন্তান হলে দেখা যেত। এ তো অসি ধরা মেজাজ নয়। মসি ধরে চলে আসছে জীবিকার ধারা। গাড়ু হাতে মাঠ। ভেঙে প্রাতঃকৃত্য। কেঁতা বগলে শয়ন। দাঁতন মুখে প্রভাতে উত্থান।

রক্তে যদি গানের বীজ থাকত তা হলে একবার চেষ্টা করে দেখতুম। মামার মতো ক্ল্যাসিক্যাল মেজাজ নিয়ে রাজা মহারাজার বাড়িতে আসর মারতুম। সুরের পথ বেয়ে বেয়ে চলে যেতুম অতীতের ঐশ্বর্যে। মামার মতো ব্যাকব্রাশ করা চুল। ঘাড়ের কাছে বাবরি। আঙুলে হিরের আংটির ঝিলিক। চারপাশে সুন্দরী। দিনকতক মামার কাছে তালিম নিতে বসলুম। প্রথমেই গলা সাধা। ভূপালি, এ তানা যোবানা পরমা নানা করিয়ে। কেঠো সুর। অর্ধেক পরদা লাগে না। এ তানা যোবানা পরমা, একটু থমকেই সপাট তান, সারে গাপা ধাসা, গাপা গারে সা, হাঁটুতে এক চাপড়, এ তানা। যোবানা। সেই অঙ্কের ব্যাপার। ফাঁক, সম। তিন তালের তা ধিন ধিন তা, তা তিন তিন তা। লয় চলেছে টুকুস টুকুস। যে যেখান থেকে পেরেছে পৃথিবীটাকে জটিল করে রেখেছে। গলা শুনে গুরু বললেন, হচ্ছে, তবে নাকি সুর এসে যাচ্ছে দোক্তা বাঁড়ুজ্যের মতো। ভদ্রলোকের আসল নাম লোকে ভুলে গেছে। পানদোক্তা ঠেসে গান ধরেন, সোনে কা থালমে খা রাহি হ্যাঁয়, এ কালী কমলি সুঘারা। বানাও। চড়ার দিকেই যত গোলমাল। পাঠাকাটা গলা। তালে লয়ে মাস্টার। স্টক অনেক। শুধু গলা নিয়েই গণ্ডগোল। গলা কাটা গাইয়ে।

মামা বললেন, তোর ন্যাক আছে। থাকতেই হবে। আমাদের বংশের ব্লাড ঘুরছে শরীরে। তবে সাধতে হবে। বারো ঘণ্টা, তেরো ঘণ্টা। সারে, গাপা, ধাসা, ধাপা, গারে, গাসা। আর ওই নাকটাকে বাদ দিতে হবে। ওই তানা পরমা না না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সামনে আধ হাত জিভ বের করে সিংহের মতো আ আ করবি। একগলা জলে দাঁড়িয়ে নাদ সাধনা করবি হুম, হুমমম। সংগীত মানে নাসিকাবাদ্য নয়, গলা বাজানো।

দাদু বললেন, দিনকতক আমার হাতে ছেড়ে দে। ধ্রুপদ দিয়ে গলার গাদা বের করে দিই, তারপর মোচড় দিয়ে মুচড়ে খেয়াল, ঠুংরি, গীত, গজল। মামা বলে ফেললেন, গলা হয়তো হবে, তবে জীবনে আর সুরে বলবে না। আপনার মতো বাজখাই হয়ে যাবে। বাস, লেগে গেল ঝটাপটি দু’জনে। জানিস আমি মণি মুকুজ্যের ছাত্র। আজ্ঞে হ্যাঁ অস্বীকার করছি না, তবে যেমন গুরু তেমন চেলা। গানের গ্রামার তিনি ভালই বুঝতেন, জানতেন, গাইতে পারতেন না। দাদু বললেন, অহংকার। অতি দর্পে হত লঙ্কা। আমার গলা আকাশের ব্রহ্মতালু স্পর্শ করে। আর তোর মিনমিনে গলা দু’হাত এগিয়ে ঝরা ফুলের মতো নেতিয়ে পড়ে।

মামার সঙ্গে দাদুর তেমন বনিবনা নেই। তেহাই মেরে কথা চলে। দাদু হলেন পুরুষসিংহ। মুখের চেয়ে হাত চলে বেশি। পাঠানদের মতো দশাসই চেহারা। জাপানি আপেলের মতো গায়ের রং। বাড়ির বাইরে আউটহাউসে থাকেন। স্বপাকে খান। তন্ত্রসাধনা করেন। রোজ চণ্ডীপাঠ। প্রতি বছর কালীপূজা। কোথা থেকে এক কাঁপালিক এসে পুজোয় বসেন। সেদিন একটু কারণবারি চলে। মায়ের মূর্তিও অসাধারণ। শিবের বুকে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন আধহাত জিভ বের করে। পূজারি আর তন্ত্রধারক দু’জনেরই পরনে রক্তাম্বর। গলায় গোটা গোটা রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল লাল টিপ। সব লাল। জবা লাল, মা লাল, চাঁদোয়া লাল। চোখ লাল। লালে লাল। সেই পুজো দেখতে গা ছমছম করে উঠত। বাইরের মিশকালো আকাশে বাজি উঠছে। দুমদাম শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপছে। মাতামহ পুজোর আসনে বসে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন হাঁড়িকাঠে গলাটা ফিট করে দিয়ে ঘপাং করে একটা কোপ মারলেই হয়। কপালে হোমের টিপ পরাতে পরাতে হাত কাঁপত। আমার গা কেঁপে উঠত। গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, মা, মা। উহ্য থেকে যেত, মেয়ের ছেলে মা, তাই লোভ সামলাতে হল, নয়তো ধড় মুন্ডু আলাদা করে ফেলে দিতুম তোমার পায়ে। লাভের মধ্যে প্রসাদ লুচি মাংস। মাংস আসত কালীঘাটের মন্দির থেকে। এক ঝটকায় কাটা ছাগশিশু।

মাতামহের স্নেহের কমতি ছিল না। কথায় কথায় বলতেন, তুই আমার সুদের সুদ। আদর করে নাম রেখেছিলেন পান্তুরানি। কেন রেখেছিলেন কে জানে! ভীষণ পান্তুয়া খেতে ভালবাসতেন সেই কারণেই বোধহয় পান্তুরানি। ছোট্ট ঘরে বিশাল এক সিন্দুক। সেই সিন্দুকেই যত স্থাবর সম্পত্তি। মাঝে মাঝে খুলতেন আর বন্ধ করতেন। খোলার সময় সন্দেহের চোখে চারপাশে তাকাতেন। বন্ধ করে নিশ্চিন্ত হতেন। কী যে রহস্য ছিল ওই বিশাল কাঠের বাক্সে! আর ছিল একটি তানপুরা।

মাতুলের তালিমে নানা ফ্যাচাং। এতই শাস্ত্রসম্মত ও আটকাঠ বাঁধা যে সুর থাকে তো তাল থাকে না, তাল থাকে তো লয় থাকে না। একঘর সুন্দর সুন্দরীর সামনে বিড়ম্বনার একশেষ। মাঝেমধ্যে কানমলা, গাট্টা, দাঁতখিচুনি। সুরের মধ্যে এত যে অসুর থাকে কে জানত! এমনিই তো বেশ গাওয়া যায়, জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো, সমাধি পরে মোর জ্বেলে দিয়ো। অভিমানে টসটসে মন, কান্নাকান্না গলা। কার জন্যে এই অভিমান বলা শক্ত। অবশ্যই অদৃশ্য কোনও রমণী। ইতিমধ্যে যে দু’-একজন রমণীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তারা কেউই যে আমার জীবনে দীপ জ্বালাবার জন্যে। জন্মায়নি, এ সত্যটি আবিষ্কার করা গেছে। রমণীরা একটু ডাকাবুকো ফচকে ঘোড়াদেরই পছন্দ করে। রসের কথাটথা বলবে। সাহস করে এমন কিছু করবে যা ভাবলেও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তেমন ছেলের তো অভাব নেই। এমন রমণী কোথায় আছে যার কাছে জ্যামিতির একস্ট্রা করে দেখালে, মাই লাভ বলে গলা ধরে ঝুলে পড়বে! তা ছাড়া আমার পথ তো আলাদা। আমি তো সংসার করতে আসিনি। ত্যাগ করতে এসেছি। মনে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠলে দোষ আমার নয়। ট্রেনিংয়ের অভাব। সাধনা তেমন হয়নি। কামার্ত সন্ন্যাসী গরম বালিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলেন, পুড়ে যা পুড়ে যা, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যা।

আমার মাতামহই ভাল। আমি আসর মারতে চাই না। সুর দিয়ে চরণ ছুঁতে চাই। যাঁকে ছুঁতে চাই তাঁর কাছ থেকে সামান্য সিদ্ধাই টিদ্ধাই পেতে চাই। যৎসামান্য, যাতে মানুষকে একটু ভয় পাইয়ে দেওয়া যায়। কারুর ক্ষতি করতে চাই না। একটু ভড়কে দিতে চাই। সেই ভাবটি চাই যাতে মনে হতে পারে, তোক না পোক। আগে শক্তি চাই। তারপর প্রেমিক হব। রমণীর নয়। জীবের। চোখদুটো হয়ে যাবে কাঁচের মতো। উদাস। উজ্জ্বল মুখ। বুকের মাঝখানটা সিঁদুরে লাল। যেমন ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের। সাধকের কী কী লক্ষণ হতে পারে সবই আমার জানা। বই পড়ে জেনেছি। আমেরিকার থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে স্বামী বিবেকানন্দ দাঁড়িয়ে আছেন। একমাথা চুল। চোখদুটো অদ্ভুত সুন্দর। যোগীর চোখ। দ্যুতি বেরোচ্ছে। বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স বলে শুরু করে সব স্তব্ধ করে দিয়েছেন। অ্যা মঙ্ক ফ্রম দি ইস্ট। আঃ স্বামীজির মতো যদি হতে পারা যেত! ওইরকম স্বাস্থ্য, সাহস, বাগ্মিতা, মেধা। ব্রিটানিকার পাতায় একবার চোখ বুলিয়েই পুরোটা মুখস্থ হয়ে গেল। আর আমি! হাজার চেষ্টা করেও গ্লুকোজের স্ট্রাকচার মনে রাখতে পারি না। ডক্টর ব্যানার্জির কাছে ধমক খেয়ে মরি। রহস্যটা কী? সবই নাকি রেতর খেলা। বীর্য ধারণ করে ঊর্ধরেতা হতে হবে। মাতুলের আসরে মন বড় চঞ্চল হয়ে ওঠে। স্বামীজির বদলে জি বাদ দিয়ে যা থাকে সেইটি হবার সাধ জাগে প্রাণে। হাঁটুতে হাটু বেঁকিয়ে বসে থাকে উমা। তারও এ তানা যোবানা, আমারও এ তানা যোবানা। গলায় গলা মিলিয়ে কোরাসে, এ তানা, সারে গাপা ধাসা। গানের চেয়ে গায়িকার আকর্ষণ বড় বেশি। আমাকে সংসারে টেনে নামাবার জন্যেই যেন উমার এই মর্তে আগমন। ঠোঁট এত লাল হয়! গাল এত গোলাপি হয়! শরীরে এত বিদ্যুৎ থাকে! গায়ে গা ঠেকলেই সেই ব্যাংনাচানো সাহেবের ব্যাঙের মতো কেঁপে কেঁপে উঠতে হয়। রাতের স্বপ্নে উমা রাজকাপুরের নার্গিসের মতো ধোঁয়ার স্রোত ঠেলে এগিয়ে আসতে থাকে। আতঙ্কের চিৎকার, আর আর না। স্বপ্নের উমাকে থামায় কার পিতাব সাধ্য! প্রাতে বড়ই বিমর্ষ। স্বপ্নে স্বামীজি এলেন না পরিব্রাজক বেশে। রামকৃষ্ণ এলেন না সমাধিস্থ হয়ে। এসে গেল উমা। বাস্তবে এলেও না হয় বোঝা যেত। স্বামীজিকে উলটে রেখে ওমর খৈয়ামকে টেনে নামানো যেত। ও লাইনে লায়লা মজনু, হীর রনঝা কম্বিনেশন তো রয়েই গেছে। ইতিহাসের দিকে আর একটি জুটি ঠেলে দেওয়া যেত, উমা পিন্টু। এতক্ষণে আমার নাম প্রকাশ করা গেল। ভাল নামে দরকার নেই। পিন্টুই ভাল। বেশ পয়েন্টেড। ইন্টুর মতো।

পিতৃদেব নাস্তিক, মাতামহ আস্তিক। মায়ের বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা জানা নেই। নাস্তিকের আর আস্তিকের রক্তে আমি বোধহয় এক জগাখিচুড়ি। পিতাঠাকুর বললেন, যাচ্ছ কোথায়? বিশ্বরহস্য খানিক শুনে যাও। স্বর্গ নেই নরকও নেই মানিক। আছে কেবল কর্ম। এ জন্মে যদি ভাল করে তন-মন-ধন হয়ে জ্যামিতি করো তা হলে আসছে জন্মে ইউক্লিড। যদি পদার্থবিদ্যায় মন দাও, পরের জন্মে বাথটব থেকে লাফিয়ে উঠে রাজপথ ধরে রাজবাড়ির দিকে ছুটবে ইউরেকা ইউরেকা করে। মাতামহ বললেন, ওই দেখো দেয়ালে ঝুলছেন জগদম্বা। ও মাগি যা করাবে তাই করতে হবে।

এ সব খেপা মেয়ের খেলা
যার মায়ায় ত্রিভুবন বিহ্বলা
সে যে আপনি খেপা, কর্তা খেপা, খেপা দুটো চেলা ॥
কী রূপ কী গুণভঙ্গি, কী ভাব কিছুই না যায় বলা
যার নাম করিয়ে কপাল পোড়ে, কণ্ঠে বিষের জ্বালা ॥

উতারো তানপুরা। লাগাও সুর। আহা, যেন ওঁকার ধ্বনি উঠছে চরাচর ব্যাপ্ত করে। উঁহু, ওভাবে বসলে চলবে না। বসতে হবে হাঁটু গেড়ে বজ্রাসনে। এখন সকাল। ধরো ভায়রো, মা মা রবে মনসুখে মন ত্রিতন্ত্রী একবার বাজা রে। মা মা বলবে অনেকটা সেঁকুর তোলার মতো করে। তলপেট থেকে ঠেলে উঠবে হৃদয়ের দিকে। কুলকুণ্ডলিনী চমকে চমকে উঠবে। একবার যদি জেগে যায়, আর পায় কে? নাও ধরো, মা মা রবে মনসুখে। মামা ঠিকই বলেছিলেন। আবেগে, বীরভাবে, রাগে দাদুর গলা ছেড়ে যে-জিনিস মুক্তি পেল, তাতে সুর নেই, ভায়রো, ভৈরবী, ধানেশ্রী, পুরিয়া, বেহাগ সব মিলে মিশে একাকার। দরদর করে জল ঝরছে দু’চোখ বেয়ে। এত অশ্রু কেন? ও গলার সঙ্গে আমি পারব কেন? মাঝে মাঝে চিঁহি চিঁহি করে মা রব ছাড়ছি। মূলাধার চমকে চমকে উঠছে কই! দাদু পাছে হার্টফেল করেন এই ভেবে নিজের হার্টই ধড়ফড় করছে। খালি হাত আকাশে বাতাসে কিছু একটা খামচে ধরার চেষ্টা করছে। উত্তাল সমুদ্রে জাহাজের মাস্তুলের মতো তানপুরা দুলছে সামনে, পেছনে, ডাইনে, বাঁয়ে। রাস্তার দিকের জানলায় সারি সারি কুচোকাঁচার মুখ। পথে চ্যাংড়া ছেলেরা ঘেউ ঘেউ করছে। দাদু মন ত্রিতন্ত্রীকে বাজাবার চেষ্টা করছেন। মহরমের হাসান হোসেনের মতো বুকে চাপড় মারছেন। তানপুরার পঞ্চমের তারটা পটাস করে ছিঁড়তেই দাদুর ভাবসমাধি হল। সমাধি ভাঙতেই জানলার দিকে তাকিয়ে অশ্লীল খিস্তি করলেন। মুখের সারি ভেংচি কেটে সরে গেল। জগদম্বার ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, বেটি আজ খুব দিয়েছে। আমায় মাতিয়ে দে মা। আমি এমন করে মেতে যাই যেন এক মাতা হাতি!

চিঁ চিঁ করলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না, বুঝেছ পান্তুরানি। সিংহের মতো ডাকতে হবে। নাদ ছাড়তে হবে। নাদ ব্রহ্ম। চিঁ চিঁ করে মেয়েছেলেকে ডাকা চলে, ওগো, শুনছ? দ্যাকো তো আমার পিটের এখানটায় যেন কী একটা কামড়েছে? এট্ট চুলকে দাও। ওই বেটিকে পেতে হলে পুরুষকার চাই। আয় মা রণে, দেখি মা হারে কি পুত্র হারে! এই বসলুম আসনে। দেহ শুকিয়ে ঝরে যাক, কুছ পরোয়া নেই, তুমি সামনে এসে না-দাঁড়ানো পর্যন্ত উঠছি না। সাধন করনা চাহি রে মনুয়া, ভজন লাগল ন্যাজের মতো। নট নড়নচড়ন। ব্যস, বাবু ফিনিশ। মৃত-স্ত্রী পিতারা বড় বেপরোয়া হন। শাসন করার কেউ থাকে না তো সংসারে! মা থাকলে সম্ভব হত কি ওই সুড়ঙ্গে ঢোকা! নাও এবার বোঝে ঠ্যালা! গোলমাল শুনে পাশের বাড়ির প্রবীণ মানুষ আশুবাবু দৌড়ে এলেন, কী হয়েছে বাবা?

মিস্ত্রী: বাবু ঘুঁষা।

প্রবীণ মানুষদের যে-কোনও জিনিসই বুঝতে বেশ দেরি হয়, কিন্তু একবার বুঝলে আর রক্ষা নেই। কে ঢুকেছে বাবা? তোমার বাবা? আজ্ঞে হ্যাঁ। পাতকোর পাড়ে দাঁড়িয়ে সাবধানে উঁকি মারলেন। দড়ি ঝুলছে, মানুষ নেই। কিছুতেই বুঝতে পারেন না ব্যাপারটা কী? পাতকের মাঝামাঝি জায়গায় সুড়ঙ্গ? কোথায় এমন আছে? ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান ব্যাবিলনেই ছিল। একে রামে রক্ষে নেই, দোসর লক্ষণ। পাতকো বসাতেই ভিটেমাটি চাটি, মাঝে আবার সুড়ঙ্গ। কোন পাঁঠার কাজ? এমনভাবে তাকাতে লাগলেন যেন আমি এক রামছাগল! খুব বকাঝকা করে আশুবাবু সিদ্ধান্তে এলেন, তোমার বাবা প্রায়ই দুঃখ করেন, তুমি একটি অপদার্থ; এখন মনে হচ্ছে তোমার বাবা তোমার চেয়েও অপদার্থ। যাও, মা-টিকে তো খেয়েছ এখন বাবাটিও পাতাল প্রবেশ করলেন। নাও এবার গলায় কাছা নেবার ব্যবস্থা করো। আচ্ছা, দড়িটাকে একটু টেনে দেখলে হয় না?

কার সাহস হবে ওই দড়ি টেনে দেখার? আমার অত সাহস নেই। দড়ি ধরে টানলে যে-মানুষটি বেরোবেন তাকে আমি চিনি। আমি খ্যাকশেয়াল হলেও তিনি ব্যাঘ্র। সব জল্পনা কল্পনা থেমে গেল। ঝোলা দড়ি আরও খানিকটা ঝুলে গেল। ঝুলেছে ঝুলেছে বলে আশুবাবু কিঞ্চিৎ উল্লাস প্রকাশ করলেন। তোমার বাবা ব্যাক করছেন পিন্টু। অবশেষে একটি মুখ দেখা গেল। চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে সম্ভবত পিচ্ছিল পথে হড়কে হড়কে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। হাত নেড়ে বললেন, খিচো। সুড়ঙ্গ-মুক্ত পুরুষ মাঝামাবি: জায়গায় ঝুলতে ঝুলতে বললেন, ওয়ান্ডারফুল। এ গ্রেট ওয়র্ক অফ কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং।

ওপরে উঠে এলেন। হাতে একটা কী যেন রয়েছে। আশুবাবু উদগ্রীব, হ্যাঁগো, গুপ্তধন টুপ্তধন কিছু আছে নাকি? সংক্ষিপ্ত উত্তর, থাকলে আশ্চর্য হব না। আবার প্রশ্ন, হাতে ওটা কী? কচ্ছপের খোলা। বলো কী? তা হলে তো এ জায়গাটা দেখছি পীঠস্থান। কূর্মপীঠ। তা কতদূর গিয়েছিলে? মাইলখানেক হবে?

হাত তিনেক গিয়েছিলুম। আহা! এলিসের ওয়ান্ডারল্যান্ড। সোঁ সোঁ করে ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসছে। ছোট একটা ছেলে পেলে দেখে নিতুম, শেষ কোথায়?

এইরকম একটি বাড়িতে রক্ত আমাশার মতো অসুখ। কার্বাইডের ড্রামে ভরতি জল। প্রায় শেষ করে ফেলেছি। একতলার পাতকোর থেকে টেনে টেনে জল ভরতে হবে ভাবলেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে। খালি যখন করেছি ভরতে তো হবেই। আইন হল আইন। শুনেছি এই আইনের ঠ্যালায়। আমার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনই আধমরা হয়ে ছিলেন। সারা ভারত জুড়ে মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন চললেও, গঙ্গার তীরবর্তী এই ক্ষুদ্র জনপদের ভুতুড়ে বাড়িতে আইন অমান্যের সাহস কারুর ছিল না। দুঃখের দিনে শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে মনের দেয়ালে সারি সারি বীর, যোদ্ধা, মহাপুরুষদের ঝুলিয়ে রাখতে হয়। সামনে দাঁড়াও। চোখ বুজিয়ে বলল, শক্তি দাও, একটু স্পিরিট ধার দাও। রোমেলকে স্মরণ করি। এই অবস্থায় রোমেল না হলে উদ্ধারের আশা খুবই অল্প। শুয়ে শুয়ে মার খেতে হবে। সেই অনুচ্ছেদটি একবার ঝালিয়ে নিই। রোমেলের জীবনীর তেত্রিশ পাতায় নীচের দিকে আছে। ১৯১৪ সাল। আমি তখন কোথায়? ২২ অগাস্ট! ভোর পাঁচটা। স্থান, ফরাসি দেশ। গ্রামের নাম ব্লিইড। ফরাসিদের আক্রমণ করতে চলেছেন যুবক রোমেল। ধরা যাক, এখন আমার যা বয়েস, তখন তার সেই বয়েস। রোমেল যাবেন যুদ্ধে, আমি যাব ড্রামে জল ভরতে। দু’জনের শরীরের অবস্থাই সমান। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে রোমেল ঘোড়ার পিঠে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার ওপর খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে পেট ছেড়েছে। শরীর ভেঙে আসছে। ঘোড়ার জিন থেকে পড়ে যাবার মতো অবস্থা হচ্ছে। তবু পড়ছেন না, কারণ তিনি রোমেল। রোমেল অসুস্থ হতে পারেন, কিন্তু মুখ চুন করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে আসতে পারেন না। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন ঘোড়ার পিঠে। জ্ঞান ফিরে এলেই বলছেন, নেভার মাইন্ড। জার্মান ভাষায় নেভার মাইন্ডের অনুবাদ জানা নেই। ইংরেজির মতো অতটা মোলায়েম হবে না। গাবদা গোবদা ভাষা। উচ্চারণে হাপরের মতো বাতাস বেরোবে। শব্দেই চাঙ্গা। ঠিক হোকনা-হোক আমারও একটা শব্দ চাই। রোমেল কুয়াশা ভেদ করে যুদ্ধের দিকে চলেছেন। আমি ধেড়ে বালতি হাতে ভাঙাভাঙা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামব। রোমেলের ফুডপয়জনিং, আমার পেটে মাতামহের খাদ্যতালিকার প্রলয় নাচন। ও নটরাজ, নটরাজ, প্রলয় নাচন নাচবে যখন। আলোচালের ফ্যানটাই মনে হয় প্রধান আসামি। নেভার মাইন্ড! গুটেনবার্গেন হ্যাফট হাফেভেন।

জল-ভরতি বালতির টানে উলটে ডিগবাজি খেয়ে পাতকোর মধ্যে পড়ে যাবার মতো হচ্ছে। হঠাৎ হোয়াইট নাইটের কথা মনে পড়ল। জলকে আমার দিকে আকর্ষণ না করে, জল যদি আমাকে জলের দিকে আকর্ষণ করত তা হলে বাপারটা অনেক সহজ হত। মাঝে মাঝে পৃথিবীটাকে ঘুরিয়ে নিতে পারলে বেশ হয়। আপসাইড ডাউন। আমি জল না তুলে জল যদি আমাকে তুলত! তেমন একটা শরীর পেলে দেখিয়ে দিতুম। এক বালতি তুলেই মনে হল, রোমেল যে-ধাতুতে তৈরি ছিলেন আমি সে ধাতুতে তৈরি হইনি। ব্যর্থ চেষ্টা। হেলে কখনও কেউটে হতে পারে না।

চৌবাচ্চার পাড়ে বসে একটু দম নিচ্ছি আর ভাবছি আর একটা ঘটনার কথা। বেশিদিন আগের নয়। দুপুরে পইতের মধ্যাহ্নভোজনে পঙক্তিতে বসেছি। পাশেই পিতাঠাকুর। আমরা একটু বেশি খাতিরের নিমন্ত্রিত। তাই আহার চলেছে কলাপাতা মাটির গেলাসে নয়। কাঁসার থালা, ধুম্বো কাঁসার গেলাস। তীষণ তেষ্টা। জলের গেলাস এত ভারী, যতবার চেষ্টা করি তুলতে আর পারি না। আঙুলে লেগে আছে তেল ঘি। মাটি থেকে সামান্য ওঠে আর ঠকাস করে পড়ে যায়। ভেবেছিলুম কেউ দেখছেন না। গৃহস্বামীর চোখ এড়াল না। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, দাঁড়াও, আমি তুলে ধরি, তুমি খা। পিতাঠাকুরও দেখছিলেন আড়চোখে। তিনি বললেন, খবরদার, নো সাহায্য। নিজে তুলতে পারে খাবে, না হলে খাবে না। আচ্ছা, আমি তা হলে একটা হালকা গেলাসে জল এনে দিই। আজ্ঞে না। সমস্যাকে সহজ করে দেবার কোনও অধিকারই আপনার নেই। জীবন যখন যে-ভার কাঁধে চাপিয়ে দেবে সে ভার বইবার শক্তি অর্জন করতে হবে। এই বয়েসে ওই গেলাস তোলা উচিত। দিস ইজ এ ডিসগ্রেস। আহা! হাতে ঘি লেগে আছে যে! থাক না। সো হোয়াট! এই তো আমি তুলছি। আমার গেলাসটা তিনি বারকতক তুললেন আর নামালেন। এক, দুই, তিন। গৃহস্বামীকে বললেন, কিছু বলার আছে? বলার আর কী থাকতে পারে? অত ঝামেলা জানলে কে আর সাধ করে এগিয়ে আসত! তিনি এমন একটা মুখ করে চলে গেলেন, যেন, আপনার পাঠা আপনি বুঝুন! আমার কী?

আমি সেই পাঁঠা, রোমেল হবার ব্যর্থ চেষ্টায় পেট খামচে বসে আছি। দোতলার বারান্দা থেকে। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন, কী হল কী তোমার? ওখানে লাট খাচ্ছ?

জীবনীকার লিখছেন, রোমেল মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন কিন্তু কখনও ঊর্ধ্বতনের কাছে গিয়ে নাকে কাঁদতেন না, আমার মাথা ঘুরছে, পেট ব্যথা করছে। সুতরাং উত্তর, না কিছু হয়নি তো!

তবে কি জৈন ধর্ম অবলম্বন করেছ? মশাকে রক্ত খিলাচ্ছ?

তেড়েফুঁড়ে উঠতে গিয়ে লাট খেয়ে পড়ে গেলুম। চেতনায় ভাসতে ভাসতে মনে হল মচকাব তবু ভাঙব না। তারপর আর কিছু মনে রইল না। কঠোর মানুষ যখন কোমল হন তখন একেবারে কুসুমের মতো হয়ে যান। সে প্রমাণ এ সংসারে মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়।

পরের দৃশ্যে নিজেকে দোতলার বিছানায় আবিষ্কার করলুম। ঘরে দুই বিশাল ছায়া। পিতাঠাকুর আর মাতামহ। দু’জনে একটু ঝগড়ার ভাবেই রয়েছেন মনে হল। দাদু বলছেন, তোমাদের নিয়মটা বাপু বুঝি না, হোমিওপ্যাথি দিয়ে শুরু, বিভূতিতে শেষ। ওই করে আমার মেয়েটাকে মারলে।

আমি মারলুম না আপনার কবরেজে মারল?

কবিরাজে মারে না হরিশঙ্কর, একেবারে শেষের সময় প্রদীপ যখন নিবুনিবু তখন ডাক্তার গুডিভ এলেও কিছু করতে পারতেন না।

আপনি মাননীয়, আপনার সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না। আপনি বসুন, আমি শ্যামবল্লভকে কল দিয়ে আসি।

আমার মনে হয় নগেন কবিরাজই ভাল হত। নাড়িতে একবার আঙুল রেখেই ধরে ফেলত বায়ু, পিত্ত কি কফ! কোন নাড়ি অতি প্রবলা। এ ব্যাপারে অবশ্য কথা বলা মানেই অনধিকার চর্চা। তোমার পাঁঠা, তুমি ন্যাজেই কাটো আর মুড়োতেই কাটো কিছু বলার নেই। তবে মেয়ের ছেলে তো, একটিমাত্র নাতি। মড়ার মতো পড়ে থেকে দু’জনের বাক্যালাপ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, জামাই আর শ্বশুরমশাইয়ের সম্পর্ক কখনওই মধুর হয় না। এক ধরনের শত্রুতা থেকেই যায়। সুযোগ পেলেই ঠুসঠাস। এ পক্ষ ও পক্ষকে একটু আঘাত করতে পারলেই বড় খুশি। অপদস্থ মাতামহকে পাশে রেখে পিতৃদেব হোমিওপ্যাথকে কল দিতে ছুটলেন।

ঘর খালি হতেই দাদু বললেন নিজের মনেই, বড় একরোখা। কারুর কথাই শুনতে চায় না। অনেকটা আমার মতোই। তেটিয়া স্বভাবের। আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে কপালে আঙুল রেখে ইড়িরবিড়ির করে নাড়াতে লাগলেন। চোখ পিটপিট করে দেখলুম ঠোঁট নড়ছে। বীজমন্ত্র চলেছে। কালীনামের গণ্ডি পড়ছে চারপাশে। জগদম্বা বলে ভীষণ এক হুংকার ছাড়লেন। চোখ খুলে গেল।

কী রে ব্যাটা?

পেট ছেড়েছে দাদু। তিন দিনে তিন জামবাটি আনোচালের ফ্যান খেয়েছি। আধসের ছোলা, এপো চিনেবাদাম। মাতামহ হা হয়ে গেলেন। সর্বনাশ! ভাগলপুরী ধূম্বো গাইয়ের খোরাক যে রে বাপ! তা একেবারে আলোতে গেলি কেন? সেদ্ধ দিয়ে শুরু করলে কী হত!

গণেশের মায়ের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। বিধবা মানুষ। একবেলা আলোচালের ভাত খান, আলু কঁচকলা পেঁপে ভাতে দিয়ে। সেদ্ধর ফ্যান পাচ্ছি কোথায়!

দাঁড়া, ও ব্যামোর ওষুধ আমার কাছে আছে। শরীর গরম হয়ে গেছে। শীতল করতে হবে। ভাল গাওয়া আছে! রান্নাঘরে ঘিয়ের টিন ছিল। ঘি তেল মোটামুটি ভালই চলে এ বাড়িতে। ভোগী আর যোগী দু’তরফেরই ঘৃত বিধি। ভোগেও ঘি, যোগেও ঘি। এক চামচে কাঁচা গব্যঘৃতের সঙ্গে একটু কাশীর চিনি মেড়ে দাদু আমার মুখে ফেলে দিলেন। মাতামহের ওপর অপার আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে সেই অপূর্ব দাওয়াই গিলে ফেললুম। সন্দেহ রইল, মরে না যাই। শুনেছি ব্যাসিলাই ডিসেন্ট্রি বড় সাংঘাতিক অসুখ। পাহাড়ে পর্বতে বহু বড় বড় সাধু ওইতে দেহত্যাগ করেছেন। খুবই অপমানজনক মৃত্যু। ব্রহ্মতালু ফেটে শ্রীশ্রী আটলক্ষ বাবার মহাসমাধি নয়।

.

প্রবীণ হোমিওপ্যাথ যখন এলেন তখন আমাদের ঘি-পর্ব শেষ হয়ে গেছে। আমরা তখন হরিদ্বারে কালীকমলির ধর্মশালায় সবে গিয়ে পৌঁছেছি। পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গার হর হর শব্দে দু’জনেই বিভোর। স্টেশন থেকে বেরোলেই চৌমাথায় মহাদেবের মূর্তি। ঘটি ধরা একটি হাত মাথার ওপরে তোলা। অবিরাম জল পড়ছে হুড়মুড় করে। সেই পাথরের শিবই দাদুর চোখে আসল শিব। থাকেন আর আহা আহা করে ওঠেন। হ্যারা হ্যারা শব্দে জল পড়ছে।

ডাক্তারবাবু ছোটখাটো খুরথুরে মানুষ। ভারী উজ্জ্বল চেহারা। নিজের হাতেই হাজারখানেক ওষুধ, তাই বয়েস হার মেনেছে যেন। একযুগ আগে যে-চেহারা ছিল এখনও তাই বজায় আছে। একটুও টসকায়নি। কুচকুচে কালো চুল। ধবধবে শরীর। ধবধবে সাদা ধুতি, সিল্কটুইলের শার্ট। উজ্জ্বল প্রসন্ন মুখ। হাতে ওষুধের বাক্স। গলায় বুক পরীক্ষা করার যন্ত্র। ছেলেবেলায় খোকাবাবু বলতেন, এখনও তাই। খোকার এদিকে গোঁফ বেরিয়ে বসে আছে, বাবা হবার হাঁকডাক চলেছে রক্ত নদীর ধারায় ধারায়। শিরশিরিয়ে যৌবন এসেছে। চাহনি তেরছা হয়েছে।

কী হয়েছে খোকাবাবু?

সারা বছরের আমার অসুখবিসুখের একটি নির্ঘণ্ট পিতাঠাকুর করেই রেখেছেন। সিজন শুরু হয় অক্টোবরে। শিশির এল, শিউলি এল, টনসিল তেউড়ে উঠে ঘুংরি কাশি। নভেম্বরে সর্দি জমে শ্বাসকষ্ট, ঘুসঘুসে জ্বর। ডিসেম্বরে হাঁপানি। সারারাত গলায় অর্গান বাজছে, খণ্ডন ভব বন্ধন গ। জানুয়ারি জকারান্ত শব্দ সুতরাং জ্বর হবেই। কেঁপে কেঁপে আসবে ঘাম দিয়ে ছাড়বে। এইভাবেই ঋতুর রথচক্রে ব্যাধিচক্র বাঁধা। আমাকে আর উত্তর দিতে হল না। উত্তর দিলেন অভিভাবক।

পাতকোতলায় দাঁত চিরকুটে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, মনে হয় হিস্টিরিয়া।

ফ্যামিলিতে হিস্টিরিয়ার হিস্ট্রি আছে নাকি?

এ বংশে নেই, যদি থাকে মাতুল বংশে।

মাতামহ তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন, কী বললে হরিশঙ্কর? গঙ্গানারায়ণ মুকুজ্যের বংশে হিস্টিরিয়া? নিজেদের দিকটা ভাল করে খুঁজে দেখো। মনে পড়ে তোমার মেজো ভাই কালাজ্বরে ফৌত হয়ে গেল।

আজ্ঞে, ওটা হিস্ট্রি নয় জিওগ্রাফি। আসামের জঙ্গল থেকে ধরিয়ে এসেছিল। আপনি গেলে আপনারও হত।

তা হলে তোমার বড় ভাই কেন দোতলার বারান্দা থেকে লাফ মেরে অণ্ডকোষ ফেটে মারা গেল?

আজ্ঞে, ওটা হিস্ট্রি নয় সাইকোলজি। অত বড় ব্যাবসা পুড়ে ছাই হয়ে গেলে আপনি মনুমেন্ট থেকে লাফ মারতেন।

তা হলে, তোমার মাথার সামনের দিকের চুল উঠে গিয়ে টাক বেরিয়ে পড়ছে কেন? এই বয়েসেও আমার চুল দেখো।

আজ্ঞে, ওটা হিস্ট্রি নয় ব্যাড মেনটেনেন্স। ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার। যত্ন আর তদারকির অভাব।

সাধুদের জটা দেখেছ? তারা চুলের কি যত্ন করে হরিশঙ্কর?

আপনি অন্য লাইনে চলে যাচ্ছেন। তা হলে বলতে হয় আপনারা সকলে অকালপক্ক কেন?

অকালপক্ক? হাসালে। পঁয়ষট্টিতে চুল পাকবে না? চুলের বাবা পাকবে।

তা হলে ওই দেখুন, আমার পিতাঠাকুরের ছবি। কুচকুচ করছে একমাথা কালো চুল।

ওটা কলপ হরিশঙ্কর। গোঁফজোড়া দেখেছ? পেকে ফটফট করছে।

ডাক্তারবাবু মৃদু হেসে বললেন, আপনারা কী আরম্ভ করলেন দু’জনে। শুনুন শুনুন, হিস্টিরিয়া হল মেয়েদের অসুখ। কোথা থেকে কোথায় চলে গেলেন!

পিতৃদেব অম্লান মুখে বললেন, ওকে আমি পুরুষ বলে মনে করি না, মহিলা, এফিমিনেট স্বভাবের। চুল আঁচড়াচ্ছে তো আঁচড়াচ্ছেই, গালে রুমাল ঘষছে তো ঘষছেই। ভাল করে গোফ পর্যন্ত বেরোল না। মাতুল বংশের দিকে চলে গেছে। চুলের বাহার দেখেছেন। খোঁপা বাঁধলেই হয়।

দাদু বললেন, ওহে হরিশঙ্কর, একতরফা খুব তো বলে যাচ্ছ, ফঁকা মাঠে হারোয়া লাঠি ঘুরিয়েই চলেছ। আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো। গোঁফজোড়া দেখেছ। দেউড়ির দরোয়ানকেও। হার মানায়।

আপনার কথা আলাদা। আমি বলেছি মাতুল বংশ।

মাতামহ ছাড়া মাতুল আসে কোথা থেকে বৃন্দাবনচন্দ্র।

আমার নাম হরিশঙ্কর। নাম বিকৃত করা আপনার এক বদ স্বভাব। শাস্ত্র বলছে, নরানাং মাতুলক্রম, মাতামহক্রম নয়। ধর্মের পথে আছেন যখন একটু শাস্ত্রটাস্ত্র উলটে দেখলে লাভ বই লোকসান হবে না।

ডাক্তারবাবু এবার বেশ সশব্দে হাসলেন, স্ত্রীবিয়োগ হলে মানুষের মস্তিষ্ক যে বিকৃত হয়, আপনারাই তার প্রমাণ।

তার মানে? দু’জনেই প্রতিবাদ করে উঠলেন। আমরা পাগল?

পাগল বললে ভুল হবে, সামান্য ছিটগ্রস্ত। সামান্য বিষয় নিয়ে যেভাবে কচলাকচলি করছেন। দু’জনে?

দাদু বললেন, প্রতিবাদ করো হরিশঙ্কর, প্রতিবাদ।

আই প্রোটেস্ট, কে বলেছে স্ত্রীবিয়োগ হলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। আপনার হ্যাঁনিম্যান সায়েব? মুখুজ্যেমশাই, আপনি কত বছর উইডোয়ার?

তা হবে, বছর তিরিশ তো হবেই।

আমার হাফ, প্রায় পনেরো বছর। আমার কী ইনস্যানিটি আপনি দেখলেন?

দাদু ভালমানুষের মতো মুখ করে বললেন, কিছুই না, যা ছিল তাই আছে।

তার মানে? পিতাঠাকুর আবার তেড়ে উঠলেন।

ডাক্তারবাবু ওঁদের দু’জনকে অগ্রাহ্য করে এবার আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বাপু?

সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি, উনি এইভাবেই কথা বলেন। রোগীদের মনে হয় বয়স বাড়ে না। যতটা সম্ভব চাপা গলায় বললুম, রক্ত আমাশা।

রক্ত আমাশা? পিতৃদেবের কান এদিকেও ছিল, লাফিয়ে উঠলেন, হরিগিরির ডালবড়া। বাজার থেকে মারা কাঁচা পয়সা পকেটে গজগজ করছে, ডালবড়া চলছে, ফুলুরি চলছে, কচুরি ঘুগনি চলছে, পেটের আর দোষ কী! নাও এবার তিনমাস বিছানায় লটকে পড়ে থাকো। পিতার হোটেলে। দাদু সঙ্গে সঙ্গে যোগ করলেন, শখের প্রাণ গড়ের মাঠ।

ডাক্তারবাবু শান্ত গলায় বললেন, আহা, আপনারা অত উতলা হচ্ছেন কেন? আমাকে যখন আনলেন, একটু দেখতে দিন। তা বাবা, কী খেয়েছিলে? কোনও গুরুপাক কিছু?

দাদু চোখ টিপলেন। অর্থাৎ ফ্যানের কথাটা গোপন রাখ।

আজ্ঞে না, তেমন তো কিছু খাইনি।

পিতৃদেব সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, মিথ্যে কথা। কার্য না থাকলে কারণ থাকে না। কিছু না খেলে কিছু হয় না। একে লিভার নেই, তার ওপর গোটা চল্লিশ ডালবড়া, তার ওপর কনস্টিপেশন, যাবে কোথায়? বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘুঘু তোর–।

তুমি তখন থেকে অত ডালবড়ার দিকে ঝুঁকে আছ কেন বলো তো? মাতামহের প্রশ্ন।

আমি যে ওর উইকনেস জানি। আপনার যেমন ছোলার ডাল আর লুচি ওর তেমনি ডালবড়া।

এটা তুমি ঠিক বলেছ হরিশঙ্কর। চাপ চাপ ছোলার ডাল, আর গোটা চল্লিশ ফুলকো ফুলকো লুচি আর শেষে তোমার হাতের ঘি-চপচপ হালুয়া। আহা, ওটা তুমি যা বানাও না! খেতে খেতে মনে হয় কে যেন পটাপট পটাপট কাথবার্টসন হার্পারের বাড়ির জুতো হাঁকড়াচ্ছে গালে। অনেকদিন হয়নি, একদিন হয়ে যাক।

আড়চোখে একবার দেখে নিলুম, পিতাঠাকুরের মুখ নিমেষে প্রসন্ন হয়ে উঠেছে। স্বভাব অনেকটা শিবঠাকুরের মতো। অল্পেই তুষ্ট। মাতামহ এই মুহূর্তে খুবই মনের মানুষ। মোহনভোগ বস্তুটিতে বাবা সিদ্ধিলাভ করেছেন। বড়ে গোলাম আলি যেমন মালকোষ রাগে। সুজি শুকনো কড়ায় কতক্ষণ নাড়তে হবে, কখন, কতটা ঘি দিতে হবে, প্লাস্টারের মশলার যেমন ভাগ আছে, এতটা বালিতে এতটা সিমেন্ট, সেইরকম চার কাপ সুজিতে এক কাপ চিনি, ফোর ইজ টু ওয়ান। জলের মাপ আরও সাংঘাতিক, একটু এদিক-ওদিক হলেই মোহনভোগ হয়ে যাবে লেই। মোগলাই ব্যাপার। ময়ূর সিংহাসনে বসে বাদশাহরা খেতেন সুর্মা-টানা চোখে।

পিতাঠাকুর মহোৎসাহে বললেন, হলেই হয়। আজই হতে পারে। রাতে আমার মনে হয় রোগীর পথ্য হবে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা চারখানা লুচি আর একটু নুন। কী বলেন ডাক্তারবাবু?

ডাক্তারবাবু বললেন, হতে পারে, তবে রুগিকে তো এখনও ঠিকমতো দেখাই হল না।

আমি মনে মনে বলছি, হে ডাক্তারবাবু, বাগড়া দেবেন না। দাদু বললেন, এর আর অত দেখার কী আছে! ইয়ংম্যান পেটটা একটু ছেড়েছে। তা ছাড়ক না। এক ডোজ অ্যাকোনাইট থ্রি এক্স দিলেই তো মিটে যায়।

অ্যাকোনাইট থ্রি এক্স দোব কেন? মার্কসলও তো দিতে পারি।

পিতাঠাকুর বললেন, হোয়াই নট মার্ককর!

মাতামহ বললেন, হোয়াই নট

নাম! ডাক্তারবাবু খুটুস করে ওষুধের ব্যাগ বন্ধ করে বললেন, আমি উঠি। রোগের চেয়েও আপনারা মারাত্মক। চিকিৎসা আপনারাই করুন।

কুছ পরোয়া নেহি। মাতামহ উল্লাসে ফেটে পড়লেন। বেশ শুট জলে ফুটিয়ে, তোকমারি দিয়ে মেড়ে, চিনি সহযোগে প্রাতে সেবন করিয়ে দোব। মধ্যাহ্নে পেট সিলমোহরকরা লেফাফা।

তোকমারি? সে তো ফোঁড়া ফাটায়! আপনি ভুল করছেন। পিতার সংশয়।

ভুল করব কেন, ওই তো সাদা সাদা হড়হড়ে, ভু ভু… আটকে গেলেন। স্মৃতি কমছে। বয়েস হচ্ছে।

ইসবগুল, ইসবগুল। ডাক্তারবাবু ভীষণ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আসল বস্তুটির নাম বলে দিলেন। তা দিতে পারেন, ভালই হবে। এমনিই লুজ আরও লুজ হয়ে যাবে।

তুমি ডাক্তারির কি জানো না। হতে পারে।

তবে আপনিও যে খুব বেশি জানেন, এমন প্রমাণ পাওয়া গেল না।

দাদুর মুখে অদ্ভুত এক ধরনের হাসি খেলে গেল। তিনি ডাক্তারি থেকে সরে আধ্যাত্মিক লাইনে চলে গেলেন। আচ্ছা ডাক্তার, তুমি তো সব তীর্থ ঘুরে এসেছ, কৈলাস, মানস, অমরনাথ, গঙ্গোত্রী। বেশ, বলো দেখি স্বয়ম্ভু পূষন কাকে বলে?

ডাক্তারবাবু বললেন, পারব না মুকুজ্যেমশাই! শাস্ত্রজ্ঞানে আপনার জুড়ি নেই। আমি জানি, নাক্‌স, ইপিকাক, অ্যালো, জেলসিমিয়াম। আমি ঘুরি দেশ দেখার ধান্দায়। আপনি খোঁজেন ভারতাত্মা, আমি খুঁজি মানবাত্মা।

হাঃ হাঃ তাই বলো। তা হলে দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ কাকে বলে তাও নিশ্চয় জানো না!

আজ্ঞে না।

সেই শঙ্খ গভীর রাতে আপনি বাজতে থাকে। সাধকের ইড়া পিঙ্গলায় তখন ওঁকারধ্বনি ওঠে।

ডাক্তারবাবু ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে বসতে বসতে বললেন, তা হলে অ্যাকোনাইট থ্রি এক্সই দিয়ে যাই।

দাদু বললেন, দেবেই তো, দেবেই তো। ও ছাড়া আর কোনও ওষুধই নেই। দক্ষিণাবর্ত শঙ্খের মতো আমার মুখ দিয়ে বেটি ঠিক ওষুধের নামটি বের করে দিয়েছে। জানো তো সিদ্ধপুরুষের বাক্যে বজ্রপাত হয়। ত্রেতায় হত, দ্বাপরে হত। মহাকলিতে সব গেছে। এক ডোজ ওষুধ দাও না। ডাক্তার যাতে কুলকুণ্ডলিনীটা খুলে যায়।

মাতামহ প্রায় ধ্যানস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তারবাবু এক পুরিয়া ওষুধ বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে পড়তে আমার জিভে উজাড় করে দিলেন। দাদু বললেন, এক একটা গুলি এক একটা বীজমন্ত্রের মতো পেটে পড়ে দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দিক। ডাক্তার, তোমাকে নয়, তোমার বিশ্বাসকে আমি ভক্তি করি। এবার যখন পাহাড়ে যাবে আমার জন্যে একটু শিলাতু আর এক ডেলা মৃগনাভি আনবে।

আচ্ছা মনে থাকবে, বলে ডাক্তারবাবু চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের বাইরে প্রায় চলে গেছেন, দাদু তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন, ডাক্তার, ডাক্তার আহারের বিধানটা দিয়ে গেলে না?

সকালে উপবাস। মিছরির জল চলতে পারে। রাতে টাকা সাইজের চারখানা লুচি, নুন দিয়ে লুচি। ভাজার আগে ঘিয়ে কয়েক কুচি আদা ভেজে নেবেন। অত ভজঘট করবে কে?

পিতাঠাকুর হাঁটুতে তাল ঠুকে বললেন, কেন আমি!

আপনার অফিস?

অফিস আগে না ছেলে আগে ডাক্তার!

শ্যামবল্লভ মৃদু হেসে চলে যেতেই মাতামহ বললেন, দাঁত থাকতে লোকে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। কী, এখন তোমার মনে হচ্ছে না হরিশঙ্কর, স্ত্রী বেঁচে থাকলে কত সুখে থাকতে পারতে?

আজ্ঞে না, সুখ আমার জীবনে নেই। আমি জন্মেছি বেঁচে থাকার মাশুল দিতে। ওর মা বছর তিনেক সুস্থ ছিল, তারপরই তো শয্যাশায়ী। সারাজীবন আপনি ঘি খেয়ে, দুধে কাঁঠালের ক্ষীর খেয়ে, তীর্থ আর মহাপুরুষ করেই কাটিয়ে গেলেন। ছেলেমেয়ের কথা যদি একটু ভাবতেন?

বলো কী হরিশঙ্কর? হরিশঙ্কর ঠিকই বলে, কারুর পরোয়া করে না। আপনার মেয়ের মতো অত ক্ষীণ স্বাস্থ্যের মহিলার সংসারধর্ম করতে আসাটাই অন্যায় হয়েছিল। আমাকে অনাথ করে, স্মৃতিটুকু ফেলে রেখে চলে গেল ড্যাং ড্যাং করে। স্বার্থপর, সেলফিশ, এসকেপিস্ট। ওপরে গিয়ে একবার দেখা হলে আমি গায়ে গায়ে শোধ তুলব। নাঃ, ওপর বলে তো কিছু নেই! সবই এখানে। সবই এখানে। হিয়ার, হিয়ার অ্যান্ড হিয়ার। চোখে জল। দু’জনের চোখেই জল।

অধ্যায় ১ / ১২৪

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন