২.১৯ Come let us ask life

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

Come let us ask life
To show a way out to those who are lost
on endless streets;

আমরা হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলুম ঘর থেকে। চোরে সদর দরজার খিল খুলেছে। তড়বড়িয়ে মুকু এগোচ্ছে নীচে নামার সিঁড়ির দিকে। ভয়ে আমার গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। চোর শব্দটা শুনলেই মানুষের গলা বসে যাবে। যাবেই যাবে। চোর যেন ফ্যারেঞ্জাইটিস। ফিসফিস শব্দ বেরোল, মুকু, অন্ধকারে একা নেমো না। ওদের হাতে অস্ত্র থাকে।

আমার মুঠোয় ঘুসি আছে। আলোটা জ্বেলে দাও।

আমাদের গলা শুনে দিদি বেরিয়ে এসেছে, কী হল আবার?

শুনতে পাননি, নীচে খিল খুলে পড়ার শব্দ হল?

শব্দ একটা পেলুম বটে। অপেক্ষা করছিলুম, আবার হয় কি না?

মুকু ততক্ষণে নেমে গেছে নীচে। ভেসে এল তার চড়া গলা, কী হচ্ছে? এই এত রাতে খিল খুলে তুমি যাচ্ছ কোথায়? আবার শুরু করলে পাগলামি!

আমরা তরতরিয়ে নেমে এসেছি। সদর হাট খোলা। বাইরে রাত রাস্তা হয়ে পড়ে আছে। আকাশ-চোঁয়ানো নিশুতি আলো। জমাট ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গগনচন্দ্র। হাতে একটা ব্যাগ। হাত বাড়িয়ে নীচের গলির আলোটা জ্বাললুম। আলোয় গগনকে দেখে চমকে গেলুম। নিখুঁত সায়েবি। পোশাক। চোখে চশমা। চশমা আগে ছিল না। মাঝরাতের ফড়ফড়ে ফড়িং-এর মতো বাতাসে মাথার চুল এলোমেলো। গলায় নেকটাই। আমার প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো অবস্থা। আলোয় ওই চেহারা দেখে মুকুও স্তম্ভিত। এ কে? এই সুদর্শন যুবকটি! এ তো সেই একটু আগের আধ-পাগলা গগন নয়। গগন হাসছে। পরিষ্কার বিশুদ্ধ বাংলায় বললে, আমাকে এইবার যেতে হচ্ছে। আমার কাজ শেষ। তোমরা একটা ভুল করেছিলে, বাইরেটা দেখে মানুষের বিচার। আমি এভাঞ্জেলিক্যাল সার্ভিসে আছি। আমি একজন ডি ডি। ডি ডি কী তা নিশ্চয় জানো! ডক্টর অফ ডিভিনিটি। আমাকে সারাপৃথিবী ঘুরে বেড়াতে হয়।

আমি মনে মনে গুটিয়ে গেলেও মুকু সমান তেরিয়া, আপনি আমাদের বোকা বানালেন কেন? কাজ শেষ বলছেন? কী কাজ?

আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করা। আজ সাত বছর পরে আমি ডেনমার্ক থেকে ফিরছি।

যাকে মা বলছেন, তিনিই বা কেন আমাদের বোকা বানাতে চাইলেন?

লজ্জায়। নিজের পাপ চাপা দেবার জন্যে। ওই ভদ্রমহিলার আমি জারজ সন্তান। আমার বাবা একজন ড্যানিশ মিশনারি। এই পাপে তিনি বিতাড়িত হয়েছিলেন চার্চ থেকে। তিনি আর নেই। হি ইজ। লং ডেড। আমার এই মা আজও আমাকে স্বীকার করে নিতে পারলেন না। নিজের পাপকে ঘৃণা না করে তিনি ঘৃণা করছেন আমাকে। এখনও সেই এক অভিনয়! যে-সমাজ দেখল না, সেই সমাজকে ভয়। অথচ মনে মনে সন্তানের অধিকার ছাড়তে পারছেন না। পাখা দিয়ে যখন পেটাচ্ছিলেন আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল- এই তো আমার মা। যিশুর চেয়ে মা বড়। ওই মুহূর্তে আমি শিশু হয়ে গিয়েছিলুম।

আপনিই বা কেন পাগলের অভিনয় করছিলেন!

তোমরা ছিলে না। আমি এলুম। এই বেশেই এসেছিলুম। আমাকে দেখে মায়ের কোথায় আনন্দ হবে, তিনি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যান আর কী! তিনি আমার পিতার ঘোস্ট দেখছেন। সেই বিশাল নাক। সেই মুখ। পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেলে এই শেষ আশ্রয় যদি চলে যায়। আমি অভিনয়ে রাজি হলুম। পরে আমার মধ্যে একটা বিদ্রোহের ভাব এল। টুথ, সত্য, তাকে কি চাপা যায়! কেন এই অভিনয়! কার জন্যে এই অভিনয়? বোকা রমণী! তোমরা সাক্ষী রইলে। বিচারের ভার রইল তোমাদের ওপর।

বিচার তো আপনারই হওয়া উচিত। মা পথে পথে ঘুরছেন, আপনি নেকটাই চড়িয়ে বেড়াচ্ছেন!

আমি অনুরোধ করেছি, হয়নি। প্রায়শ্চিত্ত করবেন। পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আমার আর কিছু করার নেই। আমার কাজ আমি করে গেলুম।

বারেবারে কাজ বলছেন, কাজটা কী?

সত্য প্রকাশ। ছায়ার মতো আমি অনুসরণ করব।

মুকু বললে, এটাও আপনার অভিনয়। আসলে আপনি একটা পাকা চোর। আর এই মহিলাটি আপনার এক শাগরেদ। আপনি আমাদের ঘরের আলমারির তালা ভেঙেছেন। কায়দা করে লক খুলেছেন। জিনিসপত্র হাঁটকেছেন। গয়নাগাটি পাননি কিছুই। আমরা খুবই লজ্জিত। এমন কিছু ঘটতে পারে জেনেই লকারে দিয়ে এসেছি। অতি চালাকের গলায় দড়ি। আপনি আজ আসেননি, এসেছেন কাল রাতে। কাপড়ে আগুন লাগিয়ে সিগন্যাল দিয়েছিলেন, আমি এসে গেছি, গেট রেডি। এই মহিলাকে নিয়েই পালাতেন। বিধি বাম। কাপড়ে সত্যিই আগুন লেগে গেল।

মুকুর কথা শেষ হবার আগেই, সেই জোচ্চর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মুকু আমাকে ঝাজিয়ে। উঠল, হা করে দেখছ কী? ছুটে গিয়ে ধরো। ব্যাগটা সার্চ করতে হবে।

আর ধরো। বহু দূরে ছুটে চলেছে এক ছায়ামূর্তি। একটু আগেই যে বলছিল, তোমরা মানুষ চিনতে ভুল করেছ। সত্যিই মানুষ চেনা অতিশয় কঠিন। সিঁড়ির একপাশে প্রায় বিবসনা এক রমণী স্থাণু হয়ে আছেন। পাথরের মূর্তি। এখন আর আমার তাকাতে লজ্জা করছে না। মহিলা আমার দিদি নয়। হয়তো বিগত-যৌবনা দেহব্যবসায়ী। কোনও রাগ নয়, আমার দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছে। কী লজ্জা! যাচাই করার উপায় নেই, হয়তো সম্পর্কে দিদি। তুলসীদাসজি, আপনাকে প্রণাম। সেই দোহাঃ উদর ভরণকে কারণে, প্রাণী ন করতয়ি লাজ। নাচে বাঁচে রণ ভিরৈ, বাঁচে ন কাজ অকাজ ॥ পেটের জন্যে সব লাজলজ্জা বিসর্জন দিতে হয় মানুষকে, কেউ সভায় নাচছে, কেউ উত্তাল সমুদ্রে নৌকোর বাইচ খেলছে, কারও শরীরে বল নেই তবু যুদ্ধে যাচ্ছে। পেট। সব পেট। কাজের বাছবিচার নেই।

মুকু সিঁড়ির শেষ ধাপে দু’হাতে মাথা চেপে বসে পড়ে বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, আর কতভাবে পরীক্ষা করতে চান আপনি? আর কতভাবে?

দিদি মুকুর পায়ের কাছে বসে পড়লেন। হাঁটুদুটো ধরে বললেন, বিশ্বাস করো ভাই, ও কিছু নিতে পারেনি। চেষ্টা করেছিল। পায়নি কিছুই।

সোনার জরি বসানো মাসিমার বেনারসি?

সন্ধান পায়নি।

এ আপনার সেই ভাগনের ছেলে?

অনেকটা তাই।

অনেকটা আবার কী? জানেন, আমি যদি থানায় যাই কী হবে?

আমাকে ধরে নিয়ে যাবে ভাই। অত্যাচার করবে। পুরনো জীবন থেকে আমি আর বেরোতে পারব না। আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানেই পেছন পেছন তেড়ে আসছে আমার পাপ। আমি কী করি? যাই কোথা?

আমাদের কাছে চাপা দেবার চেষ্টা না করে, প্রথম থেকেই বলতে পারতেন। আপনি কি জানেন না, সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না!

আমি যে ফিরতে চাই। আমি ফিরে আসতে চাই সুস্থ জীবনে। সংসারে। রান্নাঘর, ঠাকুরঘর, মন্দির, মেলা, রুগির বিছানার পাশে। আমাকে তুমি একটু সাহায্য করো ভাই। যা জোর করে আমার ঘাড়ে চাপানো হয়েছ, তার থেকে আমাকে আমার মুক্তির পথ বলে দাও। তুমি পারো, একমাত্র তুমিই পারো।

মুকুর হাঁটুতে মাথা রাখলেন দিদি। আমার মনে হচ্ছিল, এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিই। আমাদের বংশের কলঙ্ক। যা শুনেছিলুম ছেলেবেলায় তা ঠিকই, বড় জ্যাঠাইমার চরিত্রে অনেক ছিদ্র ছিল। সেই ছিদ্রেরই একটি ফসল এই মেয়ে। বিষ-জারুলের গাছে কি আর অমৃত ফল ধরে!

মুকুর ব্যবহারে কোনও ঘৃণা নেই, ক্রোধ নেই, হতাশা থাকতে পারে। দিদির মাথার পেছন দিকে হাত রেখে মুকু বললে, আমি কী করতে পারি দিদি! আপনি যা করে এসেছেন, তার ফল তো ভোগ করতেই হবে। পাপ ভূমিসে ভারী। পৃথিবীর চেয়ে ভারী মানুষের পাপ। আপনি তো পড়ে আছেন অতীতের খপ্পরে। এখন কী হবে! আমার মাথায় তো কিছু আসছে না!

হঠাৎ মুকু গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। আপন মনেই বললে, তাই তো, এটা তো ভেবে দেখা হয়নি!

মুকু দিদির মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বেশ বুঝতে পারছি দিদির বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। মুকু খপ করে দিদির ডান হাতটা চেপে ধরে বললে, তাই তো বলি, তুমি যাও ডালে ডালে আমি যাই পাতায় পাতায়। চলো ওপরে চলো, আমি তোমার পোঁটলা সার্চ করব।

মুকু বলে কী? পাগল হয়ে গেল নাকি! নিজেকে ভাবে কি সবজান্তা স্বর্গীয় পুরুষ! পুরুষ তো নয়, নারী। পোঁটলা সার্চ করে পাবেটা কী? মাথায় পোকা নড়েছে।

দিদি বললেন, সে আবার কী? গরিব মানুষের পোঁটলায় তুমি পাবেটা কী? তুমি এইভাবে আমাকে অপমান করছ কেন? অভাবে পড়েছি বলে? অসহায় বলে?

অত কথার তো দরকার নেই। আমি দেখতে চাইছি দেখব। তুমি এই জায়গা ছেড়ে এক পা-ও নড়বে না। আমি আগে ওপরে যাব।

অহংকারে তোমার মাথা বিগড়ে গেছে। রূপের অহংকার, শিক্ষার অহংকার, পয়সার অহংকার।

একটু পরেই তোমার মাথা বিগড়োবে।

তারপর মুকু আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ও নীচেই থাক। তুমি দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ওপরে এসো আমার সঙ্গে। কাণ্ডটা দেখে যাও।

অসহায় সেই মহিলার দিকে একবার ফিরে তাকালুম। আমার চোখে জল এসে গেছে। মানুষের হাতে মানুষের কী অপমান! কেন যে মানুষ এমন করে! মেয়েরাই মেয়েদের এইরকম অপমান করে। ছেলে হলে পারত না। দিদি জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি মুখের ওপর সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে ওপরে উঠে এলুম।

দোতলার ঘরে মুকু ততক্ষণে পোঁটলা খুলে সব জিনিস ছড়িয়ে ফেলেছে। কী-ই বা আছে সম্বল! কিছুই তেমন নেই। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই বললে, কী হল? আমার হিসেবে তো কোনও ভুল হবার কথা নয়। তা হলে?

আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, তা হলে কী মুকু! তুমি কী পাবে ভেবেছিলে?

চোরাই মাল।

চোরাই মাল মানে?

মানে খুবই সহজ। চুরি করে আনা মাল।

সে আবার কী?

মুকু রেগে গেল, থেকে থেকে সে আবার কী সে আবার কী কোরো না তো!

মুকু এক লহমার জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে তিরবেগে রান্নাঘরের দিকে ছুটল। আমিও অনুসরণ করলুম। মুকু ঘরে ঢুকেই ডেকচিটা উলটে ফেলল। থালার ওপর বিশাল একতাল ময়দা। সেই ময়দার তালের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল। কিছুক্ষণ। মুকু আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ইউরেকা!

আর্কিমিডিসের পর এই বোধহয় আর একবার উল্লাসের চিৎকার। ইউরেকা। কী পেয়েছে? কিছু একটা বেরিয়ে আসছে তালের ভেতর থেকে।

মুকু বললে, দেখে যাও।

পাশে গিয়ে বসলুম। পাথর সেট করা একটা হার বেরিয়ে এল। হারটায় কত যে পাথর! কত রকমের পাথর! ময়দা লেগে আছে জায়গায় জায়গায়। তবু মনে হচ্ছে বহুমূল্য। কোনও রানি-মহারানির গলায় ছিল। মুকু বললে, জলের ঘটিটা নিয়ে এসো।

ঘটির জলে একবার ডোবাতেই রূপ বেরিয়ে পড়ল। পাথরের কী ঝিলিক!

মুকু বললে, এই চারটে হিরে। তিনটে দামি রুবি। এই দেখো, এইগুলো পোখরাজ। লাখখানেক টাকা দাম কি তারও বেশি। ব্যাপারটা এইবার বুঝলে, মোটা মাথা? রান্নাঘরে ঢুকে হুলুস্থুলুসের কারণটা। আমরা হঠাৎ এসে পড়ায় তোমার ওই দিদি মালটা ময়দার তালের ভেতর ঢুকিয়েছিল।

মালটা এল কোথা থেকে?

বুঝতে পারলে না! মালটা গগন চোর কোথা থেকে হাতিয়ে এনেছিল। জানত এইখানে কিছুকাল চেপে রাখতে পারলে পুলিশ কোনও সন্ধান পাবে না। তারপর পাচার করে দেবে ঠিকমতো জায়গায়। ওই কারণেই গগন রান্নাঘর থেকে বেরোতে চাইছিল না। হ্যাঁচড়ামো করছিল।

ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। আওয়াজ বেরোচ্ছে না। চোরাই মাল রাখার অপরাধে জেলে যেতে হবে। বরাতে এইটাই বাকি ছিল। কোনওরকমে জিজ্ঞেস করলুম, এখন কী হবে মুকু?

কী আবার? পুলিশ আসবে, তোমার কোমরে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে।

জিনিসটাকে হাতে নিয়ে দু-চারবার চোখের সামনে ঘুরিয়ে মুকু বললে, তাকে ডেকে আনো নীচে থেকে। মাল আর মালের জিম্মাদার দুটোকেই বিদেয় করতে হবে এখান থেকে। এখুনি, এই মুহূর্তে।

বার্তাবাহক চলল নীচে। নীচের দালানের রকে বসে আছেন মহিলা। প্রেতিনীর মতো আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। বেশ কঠিন গলায় বলার চেষ্টা করলুম, এ আপনি কী করলেন? কান্না এসে গেল। কারওকে অসহায় দেখলে মনে হয়, সে আমি। আমিই সেই অসহায় মানুষ। আমিই সেই ভুক্তভোগী। পৃথিবীটা কেন যে এমন বিশ্রী রকমের জটিল! কেন জানিনা, কেবলই মনে হচ্ছে, ওই কাজ এই মহিলার নয়। আর যাই হোক, আমাদের বংশের মেয়ে চোরের দলে ঢুকতে পারে না। পরিস্থিতির শিকার।

অতি কষ্টে বললুম, ওপরে আসুন।

দিদি পায়ে পায়ে অপরাধী শিশুর মতো দোতলার ঘরের দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন। নিপাপ মুখে অপরাধের ছায়া নেই, আছে ভয়। মুকুর গর্জন শোনা গেল, এটা কী? ভেতরে এসো। এসে বলো এটা কার, এল কোথা থেকে?

দিদি ঘরে ঢুকে মেঝের ওপর ধপাস করে বসে পড়ে বললেন, সত্যি বলছি আমি কিছুই জানি না। আমার জানার কথা নয়।

এটা চোরাই মাল।

হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে।

এটা চোরাই মাল।

বেশ, তাই না হয় হল।

এখন কী হবে? থানা-পুলিশ কে সামলাবে?

এতে থানা-পুলিশ আসছে কোথা থেকে?

খুব সহজেই আসছে। কাল না হয় পরশু। তখন কী হবে?

দিদি পালটা প্রশ্ন করলেন, কী হবে তখন?

তখন হবার আগেই এখন হবে। এখন রাত তিনটে প্রায়। এই মহামূল্য চোরাই মাল নিজের পোঁটলায় পুরে সোজা দক্ষিণমুখো হাঁটা দাও। ওই দিকেই যমের দক্ষিণ দুয়ার। আর তোমার কোনও ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনতে আমি রাজি নই। এই মুহূর্তে তুমি এই বাড়ি ছেড়ে বিদেয় হয়ে যাবে। তোমার ওই পাপমুখ আমি দেখতে চাই না।

দিদি অসহায় মুখে আমার দিকে তাকালেন। আমিও সমান অসহায়। সম্রাজ্ঞী মুকুর মুখের ওপর কথা বলার সাহস আমার নেই। মুকুর যুক্তি আর তর্কের সামনে আমি দাঁড়াতে পারি না। হরিশঙ্করের চেয়েও প্রখর।

দিদি বললেন, এই গভীর রাতে আমি যাই কোথা! আমাকে তো ছিঁড়ে খাবে। আমার একটা অনুরোধ তুমি রাখো। ভোর হলেই আমি চলে যাব!

আমি বললুম, সেই ভাল। আর তো কিছুক্ষণ!

মুকু গুম মেরে রইল। কী ভাবল কে জানে! সময় যেন থম মেরে গেছে। অবশেষে বললে, বেশ, ঠিক আছে, তাই হোক। সূর্যোদয়ের আগে, পাড়া জেগে ওঠার আগে, তুমি ঠিক যেভাবে এসেছিলে সেইভাবেই ফিরে যাবে। কোথায় যাবে আমার জানার দরকার নেই।

সেই বহুমূল্য গয়নাটি মেঝেতে ফেলে দিয়ে মুকু উঠে গেল। আমিও চলে যেতে চেয়েছিলুম, দিদি আমার হাতটা চেপে ধরলেন, পলাশ, এ বাড়ি তো তোমার? আমি তো তোমার আশ্রয়েই এসেছিলুম ভাই! তুমিও কি আমাকে তাড়াতে চাও? আমার শরীরের পেছন দিকের অবস্থাটা কি একবার দেখেছ? আমার জ্বর এসে গেছে।

আমি কী করব? আপনি নিজের পাপেই ভুগছেন।

যদি বলি, পাপ আমি করিনি। পাপই আমার ঘাড়ে এসে চেপেছে। পেছন পেছন ফিরছে তাড়া করে। কার দোষ? দোষ আমার না দোষ তাদের? কার বিচার হবে? সেই ভাগনে, সেই ভাগনের বুড়ো মামা, আমার মা, সেই ফাদার, সেই পুরোহিতমশাই, সেই থানার বড়দারোগা, সেই কোল্ডস্টোরের মালিক, সেই নেতা, সেই স্কুলমাস্টার, হুগলি আদালতের সেই উকিল, এদের, এদের বিচার হবে না ভাই?

আমি জানি না। আপনার সামনে সাপের মতো ওই যে জিনিসটা পড়ে আছে, সাপের চোখের মতো আলো ঠিকরোচ্ছে, ওটা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে জানেন? হাজতে ওইটার জন্যে এখানকার আমাদের তিন পুরুষের বাস উঠে যেতে পারে। কেন, কেন আপনি আমাদের জেনেশুনে এই বিপদের মধ্যে টেনে আনলেন? আমাদের পরিবার আপনার কী ক্ষতি করেছিল?

একেবারেই কোনও ক্ষতি করেনি তা বলি কেমন করে! এই পরিবারেরই এক পুরুষ আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন। আমার মাকে ছেড়ে তিনি স্ফুর্তি করতে গিয়েছিলেন অন্য মেয়েছেলের সঙ্গে। হয়ে গেলেন পাগল। একবারও ভাবলেন না, তার ছেলেমেয়েদের কী হবে! তোমারই পরিবারের অন্যান্যরা আমার মাকে গুমোরে, ঠেকারে বলে বাড়ি ছাড়া করলেন। তারপর? তারই তো সব পরপর, পরপর হয়ে গেল। এক থেকে আর এক। নিজেদের অত নিরপরাধ ভাবছ কেন পলাশ? তুমি কতটুকুই বা জানে! তোমাদের পরিবারের ভারী সুন্দর একটা গুণ, বিপদ দেখলেই সরে পড়া। যেমন আগুন দেখেই তুমি এক লাফে ঘর ছেড়ে পালালে। তোমাদের ধরন হল, যা শত্রু পরের পরের।

আপনি একটা অন্যায়কে আর একটা অন্যায় দিয়ে ঢাকতে চাইছেন। জেনে রাখুন, আপাতত মুকু যা বলেছে তাই হবে। অন্যরকম হবার উপায় নেই।

আমি আমার ঘরে চলে এলুম। মাথা দিয়ে আগুন ছুটছে। পেছন দিকটা আগুনে যার ঝলসে গেছে, সে কেমন করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে কোথাও একটা যাবে? সেই কোথাওটা কোথায়? দিদি একটা কথাও ভুল বলেনি। অপ্রিয় সত্য। সহ্য করা শক্ত। সত্য এইরকমই। প্রখর আলোর মতো। বোধহয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। যত দুশ্চিন্তাই থাক, ঘুমের প্রলেপ পড়বেই। প্রচণ্ড এক ঠেলায় ঘুম ভেঙে গেল। মুকু ডাকছে, শিগগির ওঠো, শিগগির ওঠো, সর্বনাশ হয়ে গেছে।

জানলায় দুলছে ভোরের পরদা। পাখির ডাকের অভ্রখণ্ড বসান। এমন একটা গোলাপি শুরুতেই সর্বনাশ! এত সর্বনাশের পরেও সর্বনাশ। ধড়মড় করে উঠে বসলুম ঘোর লাগা চোখে। কোথায় এতক্ষণ পড়ে ছিলুম তাও জানি না। জানলার ধার। তক্তপোশ। ভোরের ভিজে বাতাস।

আবার কী সাশ হল মুকু? যা হবার তা তো হয়েই গেছে।

মুকু হঠাৎ আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগল। রুদ্ধ গলায় বললে, দিদি চলে গেছে।

তুমি তো তাই চেয়েছিলে, এখন আবার কাঁদছ কেন?

মুকু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললে, আমি তো বাড়ি ছেড়ে যেতে বলেছিলুম, দিদি যে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।

সেকী? সে আবার কী?

দিদি গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে নীচের ঘরে ঝুলছে। আমারই সিল্কের শাড়ি।

সেকী?

আমার শরীর পাথরের মতো হয়ে গেল। অদ্ভুত একটা ধাক্কা। বজ্রের মতো। একই সঙ্গে একরাশ চিন্তা মাথায় খেলে গেল। সেই থানা পুলিশ। সেই পাড়ার লোক জড়ো হয়ে যাওয়া। ছি ছি, ধিক্কার। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলুম। কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেলুম। গৃহদেবতা হরিশঙ্কর চলে গেছেন। মাথার ওপরের ছাদ ধসে গেছে। দুর্যোগ থেকে বাঁচার রাস্তা নেই। বাঁচাবারও কেউ নেই। যা ঘৃণা করতুম, তাই ঘটছে একের পর এক।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন