২.৪৩ Every man is a volume

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

Every man is a volume, if you know how to read him.

রাত হয়েছে, তাও কী জমজমাট মেলা। প্রায় দামোদরের তীর পর্যন্ত চলে গেছে। মানুষ ঘুমোবে না। ঘুম তো আছেই। তিনটে দিন না হয় জাগল। এত আনন্দ একসঙ্গে এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। একপাশে একটু নিরালা জায়গায় রামায়ণ হচ্ছে। বাঁকুড়ার বিখ্যাত পাঠক হারমোনিয়ম বাজিয়ে রামায়ণ গান করছেন। বেশ ভিড় হয়েছে। এক ছাউনির তলায় এসেছে কৃষ্ণনগরের পুতুল। পুতুলের কী আকর্ষণ! বিমলাদি আর আমি দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছি। জীবন্ত সব চরিত্র। কৃষ্ণ। গোপাল হামা দিচ্ছে। কলসি কাঁখে মহিলা। জাল কাঁধে জেলে। সাপুড়ে সাপ খেলাচ্ছে। কী নেই! হ্যাঁজাকের জোরালো আলোয় কল্পনার জগৎ।

বিমলাদি বললেন, কিনতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ভীষণ দাম।

আমি আপনাকে কিনে উপহার দিই। বলুন, আপনার কোনটা পছন্দ?

আমি নোব কেন?

ভাই দিচ্ছে বলে।

আপনি আপনি করলে বোন হয়!

এই কথা? বেশ তুমি বলছি। বলো দিদি তোমার কোনটা পছন্দ!

বাঁশি হাতে কৃষ্ণ। এখন কিনো না, আগে সবটা ঘুরে আসি। নাগরদোলায় চড়ব। ভীষণ মজা লাগে! মনে হয় ছোট হয়ে গেছি।

আমার যে ভীষণ ভয় করে দিদি।

দুর! তুমি আমার পাশে বসবে, আমি তোমায় দু’হাতে শক্ত করে ধরে থাকব। চিনেবাদাম খাবে? গরম চিনেবাদাম খেতে ভীষণ ভাল লাগে।

এত রাতে বাদাম খাবে দিদি? পেট ভরে যাবে।

তোমার মাথা! একমুঠো বাদাম থেকে বড়জোর পঞ্চাশটা পুঁচকে পুঁচকে দানা বেরোবে। এইতে যদি পেট ভরে যায়, পেট কেটে বাদ দাও। মেলায় এসে হিসেব করতে নেই। যা প্রাণ চায় তাই করতে হয়। বালির খোলায় চিনেবাদাম নাড়ার গন্ধটা কী সুন্দর লাগে! মনে হয় মেলার গন্ধ। বছরে তো এই একবারই মেলা বসে গো। তাও তুমি এইরকম করছ!

দিদি ছেলেমানুষ হতে হতে একেবারে ছেলেমানুষ হয়ে গেছেন। মুখচোখের চেহারা পালটে গেছে। আমরা নাগরদোলার দিকে এগোচ্ছি। পরপর এক সার চট-ঘেরা খুপরি। অনেকে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। চটের পরদা তুলে টুপ টুপ ঢুকে পড়ছে। দিদি আমার হাত চেপে ধরলেন;

সাবধান।

কেন দিদি?

অনেক সময় হাত ধরে টেনে নেয়।

কে টেনে নেয় দিদি?

ওই যে ওর মধ্যে যারা আছে, সেই মেয়েরা। পা চালাও পা চালাও।

ওদের এখানে কেন আসতে দিয়েছে দিদি?

মেলায় আসে অমন। ওদেরও তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে।

মাঝে মাঝে খিলখিল হাসি আসছে কানে। অল্প অল্প ঘুঙুরের শব্দ। আমরা প্রায় ছুটে জায়গাটা পেরিয়ে এসে এমন এলাকায় পড়লুম, যেখানে শুধুই কাঁচের জিনিসপত্র। আলোয় ঝলমল করছে। যেন কোনও মুঘল রাজার শিশমহলে এসে পড়েছি।

দিদি, দেখো কী সুন্দর! কিছু কিনবে?

কাঁচের জিনিস থাকে না। একদিন-না-একদিন ভেঙে যায়। কাঁচ পাথর খুব সাবধানে রাখতে হয়। একটু পরেই কত পাথরের কাজ দেখবে। শুশুনিয়ার পাথর কেটে তৈরি। লোভ লেগে যাবে। কিনতে ইচ্ছে করবে। আমাদের ঘরে কাঁসার জিনিসই ভাল।

আমরা নাগরদোলার কাছে চলে এলুম। দাঁড়ানোমাত্রই একটা পালা শেষ হল। দিদি বললেন, আমাদের ভাগ্যটা ভীষণ ভাল। একটুও অপেক্ষা করতে হল না।

নাগরদোলা কোম্পানির লোক আমাদের একটা দোলায় বসিয়ে দিলে। একটু না ধরলে তো বসা যায় না। আমরা যেটায় বসলুম সেটা এক ধাপ ওপরে উঠে গেল। পরেরটা ভরে গেল। আমরা আর। একটু ওপরে উঠে গেলুম, শেষে একেবারে টংয়ে। শুরু হল ঘুরপাক, আর কাঁচ ক্যাচ শব্দ। প্রথম নাগরদোলায় চড়া। যখন হুস করে নীচের দিকে নামছে, মনে হচ্ছে আছড়ে মাটিতে ফেলে দেবে। আমার ভয় দেখে দিদি ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁধে কাধ ঠেকে আছে। যখন সবেগে নীচের দিকে নামছে, দিদি সুরেলা গলায় চিলের মতো শব্দ করছেন। বাঁইবাই করে ঘুরছে দোলা। মনে হচ্ছে ছিটকে আকাশের দিকে উঠে যাব। শরীরের কোনো ওজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। দিদির কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজিয়ে ফেললুম। দোলা ঘুরছে। নিবিড় স্নেহে জড়িয়ে রেখেছেন দিদি। এইসময় মনে হল নাই বা থামল এই দোলা। কিন্তু থামল।

দিদি বললেন, নামবে? না আর একপাক ঘুরবে?

ঘুরব। আমার ঘুম এসে গেছে।

দেখেছ তো অভ্যাস হয়ে গেলে কেমন ভাল লাগে!

আমি হাসলুম। আবার শুরু হল ঘোরা। এইবার দিদিকে আমি দুহাতে জড়িয়ে ধরলুম। ধূপ ধুনোর গন্ধ শরীরে। তুলোর মতো নরম। পাথরের মতো শীতল। অদ্ভুত একটা ভাব আসছে মনে। আনন্দের হিমপ্রবাহ নেমে আসছে অদৃশ্য উৎস থেকে। এইবার শেষ পাকে আমাদের দোলাটা থামাল সবার ওপরে। শূন্যে ঝুলে রইলুম বেশ কিছুক্ষণ!

মাটিতে নেমে এলুম। শরীর টলছে। নেশা লেগে গেছে। পাইপাঁই করে ঘুরলে খিদে পায়। আমরা চিনেবাদামের কাছে গেলুম। বাদাম কিনে আমরা একটা কদমগাছের তলায় গিয়ে বসলুম। সেখানে আমাদের জন্যে কেউ একটা গোরুর গাড়ির চাকা ফেলে রেখেছিল। আমরা পাশাপাশি সেই চাকার ওপর বসলুম। চিনেবাদামের খোলা ভাঙার পুটুসপুটুস শব্দ। দিদির সাদা শাড়ি অন্ধকারে আরও সাদা দেখাচ্ছে। আমাদের পেছন দিকে একটু দূরে লোহার জিনিসের স্টল। কড়া, চাটু, হাতা, খুন্তি। সামনের দিকে একসঙ্গে অনেক কিছু চলছে। ইন্দ্রজালের তাবুর সামনে দাঁড়িয়ে। একটা লোক ভয়ংকর চিৎকার করছে।

দিদি বললেন, ভীষণ ভাল লাগছে। আরও ভাল লাগছে তুমি আছ বলে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে তুমি আমার কৃষ্ণ। সংসারের বাঁধাধরা আমার একদম ভাল লাগে না। কী ছাই হাতা-খুন্তি-বেড়ি! মাঝে মাঝে মনে হয় বাউল হয়ে যাব। কেমন দেশে দেশে ঘুরব গান গেয়ে। অত দূরে বসেছ কেন? কাছে সরে এসো, গায়ে গা লাগিয়ে বোসো। দাঁড়াও বাদামগুলো আমার কোলে ঢালি। নাও এইখান থেকে তুলে তুলে নাও। আজ আকাশের রং দেখেছ? একেবারে শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রং।

আমার শরীরে দিদির শরীর ঠেকে আছে। আকাশের রং শ্রীকৃষ্ণের মতো বলার সঙ্গে সঙ্গে দিদির শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। ফিসফিস করে বললেন, শিগগির শিগগির, আমাকে নামিয়ে আনন।

ভয় পেয়ে গেলুম। কোথা থেকে নামাব! কোথা থেকে নামাব দিদি? তুমি তো আমার পাশেই রয়েছ।

দিদির কাঁপুনি আরও বেড়ে গেছে। ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপছেন ঠকঠক করে। কোনওরকমে বললেন, আমার মন ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি। শিগগির আমার বুকে হাত রাখো।

অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলুম। কোনও চিন্তার অবকাশ নেই। খুব ভয়ে ভয়ে বুকে হাত দিলুম। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনার অতীত। মেলার নেশা-ধরানো রাত। শ্যামকৃষ্ণ আকাশ। স্ফটিকের টুকরো তারা। ঝাপুর ঝুপুর কদমের পাতায় বাতাসের হিমসিম শব্দ। ইন্দ্রজালের চিৎকার। নাগরদোলার। ছুঁচোর ডাক। আমার হাত। দিদি আমাকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরলেন। এই প্রথম একটা। অনুভূতি হল, দেহ দিয়ে দেহের বাইরে যাওয়া যায়। আমার অস্তিত্ব মন্দিরচূড়ার পতাকার মতো পতপত করে উড়তে লাগল। আমার এমন কিছু দর্শন হল, যা অতীন্দ্রিয়। অলৌকিক। দিদি আমার । শরীরের সর্বত্র হাত বোলাচ্ছেন। সাধারণ কোনও মানুষ আড়াল থেকে দেখলে ভাববে অশ্লীল একটা। কিছু হচ্ছে। একমাত্র আমিই জানি কী হচ্ছে! ইন্দ্রিয়ের জট খুলে বেরিয়ে আসছে নিরাসক্ত বিশুদ্ধ অনুভূতি। সমস্ত শরীরে যেন অমৃতক্ষরণ হচ্ছে। সারাশরীর মধুর মতো চটচটে। মাথার ঢাকনা যেন খুলে গেছে। সেখানে কে যেন একখণ্ড বরফ বসিয়ে দিয়েছে। কানে শুনতে পাচ্ছি ঠিঠিন খঞ্জনির শব্দ। দেখতে পাচ্ছি সামনে জমিতে চূর্ণ চূর্ণ চাঁদের টুকরো। নাকে আসছে পদ্মের গন্ধ। কখনও মনে হচ্ছে আমি বিশাল, কখনও মনে হচ্ছে বিন্দুর মতো ক্ষুদ্র প্রসারিত হচ্ছি, সংকুচিত হচ্ছি। কখনও মনে হচ্ছে আমি জমাট বরফ, কখনও তরল নদী।

কতক্ষণ এই অবস্থায় ছিলুম জানি না, যখন সংবিৎ ফিরে পেলুম, তখন মেলা প্রায় ভেঙে এসেছে। স্থির নাগরদোলা সামনের জমিতে। ইন্দ্রজালের চিৎকার নেই। রামায়ণ গান কানে আসছে না। দিদির এখন অন্য ব্যক্তিত্ব। আদেশের কণ্ঠস্বর, চলো, বেশ রাত হয়েছে। বুঝতে পারছ, বাতাস ঘুরে গেছে! হাওয়া দিয়ে সময় ঠিক করা যায়।

দিদি, তোমার কৃষ্ণ?

মাটির কৃষ্ণের আর দরকার নেই। আমি জ্যান্ত কৃষ্ণ পেয়ে গেছি। শোনো তোমাকে একটা কথা বলি, যা হল, যা পেলে, আরও যা পাবে, তোমার দাদু তোমার বাবাকে বলবে না। তোমার কেমন লাগল?

আমি বলতে পারব না। বলা যায় না।

হঠাৎ কী হয়ে গেল! জানো তো অনেকেই এসব বোঝে না। অপবাদ দেয়। দিদি, তোমার শক্তির পরিচয় আমি পেয়েছি। তোমার জীবনে এর দাম আছে। আমার এসবে কী প্রয়োজন।

প্রয়োজন? তোমার কি ধারণা এসব চাইলেই পাওয়া যায়! তোমার মনে হল, আর তুমি পেয়ে গেলে! তোমার মনে হল আমি চাই না, আর সব ফিরে গেল! মানুষের জীবনে না চাইতেই আসে। সকলের জীবনে আসে না। যার আসে তার আসে। এরই নাম কৃপা। করা থাকলে তবেই পাওয়া যায়। করে পাওয়ার নাম কৃপা। ধরো, তোমার চুল পড়ে যাচ্ছে, তুমি চাইলেই কি পড়া বন্ধ হবে? পড়ার হলে পড়বে, থাকার হলে থাকবে। সময় হলে শিশুর দাঁত উঠবে, বয়স হলে পড়ে যাবে, চোখে যখন ছানি আসবে আসবেই, তুমি না চাইলেও আসবে। শোনো, তোমার আগের জন্মে বেশ কিছু করা আছে। তুমি সে খবর রাখো না। তোমার দাদু আজ তোমাকে কিছু দেখিয়েছেন, বলো ঠিক কি না?

হ্যাঁ দিদি।

তোমার বাবার শক্তি তোমাকে ঘিরে আছে। তোমার ভেতরে ভোগ আর যোগ দুটোই সমান সমান মাত্রায় আছে। তোমাকে ভোগের পর্বটা আগে শেষ করে নিতে হবে। তোমার স্ত্রীর শক্তি তোমার চেয়ে বেশি হবে। তোমার স্ত্রীকে ধরেই তোমাকে এগোতে হবে। এইটাই তোমার পথ, কিন্তু আসতে হবে অনেক ঘাটের জল খেয়ে ঘুরপথে।

সেই অদ্ভুত মহিলা আমাকে একটি অসাধারণ গল্প বলেছিলেন। হরিশঙ্কর প্রায়ই বলেন, জ্ঞানের মনোপলি হয় না। তোমার কাছেই সব জ্ঞান। কৃপা করে তুমি ছাড়বে, তবেই আমার বরাতে সামান্য জুটবে, এই একটি ক্ষেত্রে সেই ব্যাবসা অচল। জ্ঞান সকলের। সকলেই জ্ঞানী হতে পারে। যদি ইচ্ছে। থাকে, যদি চেষ্টা থাকে। মানুষের ভেতরে জ্ঞান উদিত হয় সূর্যের মতো। এই মহিলাও সেইরকম জ্ঞানী। শুধু জ্ঞানী নন, সাধিকাও।

দিদি বলছেন, একটা কুঁড়েঘর। একটা লণ্ঠন জ্বলছে। একজন লোক শুয়ে ছিল। হঠাৎ উঠে বসল। এক ছিলিম তামাক খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। হুঁকো কলকে বেরোল। এইবার চাই টিকে। খুঁজে খুঁজে কয়েকটি টিকেও বেরোল। এইবার যে একটু আগুন চাই। আগুন না হলে যে টিকে ধরবে না। তার যে চকমকি পাথরটা ছিল, সেটা হারিয়ে গেছে। পাথর আছে প্রতিবেশীর বাড়িতে, কিন্তু এই মাঝরাতে ডাকাডাকি করাটা কি উচিত হবে! সবাই ঘুমোচ্ছে। কিন্তু তামাকের নেশা! একটু না হলে যে প্রাণ ছটফট করছে। লণ্ঠন হাতে লোকটি বেরিয়ে পড়ল রাতের অন্ধকারে। প্রতিবেশীর দরজায় গিয়ে ধাক্কাধাক্কি। বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন বাড়ির কর্তা। কী চাই? বড় তামাক খাওয়ার ইচ্ছে। হয়েছে। টিকে ধরাতে হবে। একটু আগুন চাই। আপনার চকমকি পাথরটা যদি একবার দেন কর্তা! কর্তা বললেন, আগুন ধরাবে? তা তোমার হাতে ওটা কী? আজ্ঞে লণ্ঠন। লণ্ঠনের ভেতর ওটা কী? আজ্ঞে, তাই তো। তোমার নিজের হাতে আগুন, আর তুমি মাঝরাতে প্রতিবেশীর ঘুম ভাঙিয়ে আগুনের খোঁজ করছ?

দিদির বক্তব্য, তোমার ভেতর আছে, তোমার হুশ নেই। সেই হুশটা তোমার করিয়ে দিতে হবে। সেইটা হবে তোমার গুরুর কাজ। ভেতরে থাকলে তবেই তাকে টেনে বের করা যায়। যেমন গান, শিল্প, সাধনা। ভেতরে থাকা চাই। তোমার আছে। প্রকাশ নেই। তীর্থে তীর্থে ঘোরো, সাধুসঙ্গ করো। তা না হলে, তোমার এদিকও যাবে ওদিকও যাবে। সংসার তুমি করবে। শুরুটা ভালই হবে, শেষটা গোলমেলে। নির্জনে একা। তখনই হবে মুখোমুখি।

সারাটা পথ এই ধরনের অদ্ভুত সব কথা বলতে বলতে দিদি এসে ঢুকলেন বাড়িতে। ঢুকেই হরিশঙ্করের গলা, এই নে কিস্তি। সামলা।

দাওয়ায় বসেছে দাবার আসর। হ্যারিকেনটা ঝুলছে বাঁশের বাতায়। গাওয়া ঘিয়ে একটা কিছু ভাজা হচ্ছে। গন্ধে আকাশ বাতাস ভরে গেছে। মোহনদা নেমে পড়েছেন রান্নায়।

ছোটদাদু টুক করে একটা খুঁটি সরিয়ে বললেন, এই নাও বন্ধনমুক্ত করে দিলুম, কিন্তু এইবার তোমার বিপদ।

হরিশঙ্কর চালটার খুব তারিফ করলেন। আমি একপাশে বসলুম। ছক থেকে মুখ না তুলেই ছোটদাদু বললেন, কেমন হল মেলা?

আমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে একটা খুঁটি চেলে বললেন, কিস্তি।

হরিশঙ্কর বলছেন, এ একেবারে জীবনমরণ লড়াই চলেছে। একবার এদিক যায় তো একবার ওদিক।

ছোটদাদু হাসছেন, রাজারাজড়ার ব্যাপার। রাজ্যপাট সামলানো কি মুখের কথা! আচ্ছা নে এইবারও সামলে দিলুম, কিন্তু তোর মন্ত্রী ইন ডেঞ্জার।

খেলার কোনও সমাধান শেষ পর্যন্ত হল না। খাওয়ার ডাক পড়ে গেল। হরিশঙ্কর আসনে বসতে বসতে বললেন, কাল শেষরাতেই কিন্তু আমরা বেরিয়ে যাব।

ছোটদাদু হঠাৎ বললেন, শেষরাত নয়। এই রাতেই বেরোব। অদৃশ্য নির্দেশ।

মোহনদা পরিবেশন করছিলেন। বললেন, কিছুতেই কি কারও কথা শুনবেন না?

ছোটদাদু বললেন, অবশ্যই শুনব একজনের কথা। তিনি বসে আছেন অন্তরে।

পথটা ভাল নয়। কেন অমন করছেন। একবার ইনি বলছেন। ইনি শান্ত হলেন তো আপনি। আর তো কয়েকঘন্টা! তারপরেই তো পোর!

এক মুহূর্তে বিশ্ব জুড়ে কত কাণ্ড হয়ে যায় মোহন! এই মুহূর্তে কত জন্মাল, কত মরল, কত খুন হল, কত সংসার ভাঙল! কত বরফ জল হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ল। কত মানুষ এগোল, কত মানুষ পেছোল। এই মুহূর্তে একটা ট্রেন গন্তব্যের দিকে কতটা এগিয়ে গেল! সে খবর রাখো মোহন?

সবই ঠিক, তবে এই কষ্ট। আমরা আরামে ঘুমোব, আপনারা হাঁটবেন!

পুরোটাই মনের ব্যাপার মোহন। কেউ ঘুমিয়ে আরাম পায়, কেউ পায় বনের পথে হেঁটে।

খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর হাত ধুচ্ছি, বিমলাদি বললেন, কোনওরকমে আটকাও না! রাতে তোমাকে নিয়ে যে একটু বসব ভেবেছিলুম। এমন একটা ক্রিয়া তোমাকে শেখাব ভেবেছিলুম যা তোমার সংসারপথের সহায় হবে।

কী দিদি!

বজ্রোলি মুদ্রা। এক মহাযোগী আমাকে শিখিয়েছিলেন। তুমি কোনওরকমে বোঝাও।

ছোটদাদু প্রস্তুত হচ্ছেন। হরিশঙ্কর প্রায় তৈরি। ছোটদাদুকে আস্তে আস্তে বললুম, ছোটদাদু, আর তো কয়েকঘণ্টা, একেবারে ভোরবেলা বেরোলে হয় না?

গম্ভীর গলায় বললেন, না হয় না!

এই রাত! এতটা পথ! জঙ্গল! ডাকাত!

তাতে তোমার কী? তুমি কি সঙ্গে মোহরের থলে নিয়ে চলেছ?

বেশ রাগের গলা! বিমলা ওপাশে ছিলেন। গিয়ে বললুম। বিমলাদি বললেন, তুমি বলো, আমি থাকছি। ফেরার পথে আপনাদের সঙ্গে চলে যাব।

আমি একটা ভেড়ার মতো সেই কথা বলার জন্যে ফিরে এলুম। একটা অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে পরিচালিত করছে। একটা ঘোরের মধ্যে আছি।

ছোটদাদুর সামনে দাঁড়ানোমাত্ৰই, তিনি খপ করে একটা হাত ধরলেন আমার। ভয়ংকর একটা ঝাঁকুনি মারলেন। তারপর টানতে টানতে একেবারে রাস্তায়। হরিশঙ্কর অনুসরণ করছেন। ছোটদাদু আমাকে নিয়ে হাঁটছেন হনহন করে।

নিমেষে চলে এলুম পণ্ডিতমশাইয়ের চতুষ্পঠীর কাছে। মিটমিট একটা আলো জ্বলছে ভেতরে। এসে গেল সেই সাঁকো। পথ ঢালু হল। সামনেই সেই মেলার জায়গা। অন্ধকারে দৈত্যের মতো খাড়া হয়ে আছে নাগরদোলা। টিং টিং আলো এখানে ওখানে। সেই মেয়েরা এখন বেরিয়ে এসেছে। অসংলগ্ন কথা, চুটকি হাসি, মাতালের প্রলাপ। আমরা যেন বাতাসে উড়ে চলেছি পক্ষীরাজের মতো। বিশাল একটা ধ্বংসাবশেষ এগিয়ে আসছে। হরিশঙ্কর পেছনে আসছেন সৈনিকের মতো মার্চ করে।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন