১.৫৪ About, about, in reel and rout

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

About, about, in reel and rout
The death-fires danced at night;
The water, like a witch’s oils,
Burnt green and blue and white.

রাত ধীরে ধীরে গড়াচ্ছে। ক’টা বাজল কে জানে। দশটা-টশটা হবে হয়তো! বাইরে বাতাস ছেড়েছে। নারকেল গাছের পাতা থেকে থেকে দুলে উঠছে। আমরা তিনটি প্রাণী গোল হয়ে বসে আছি। মাঝখানে পড়ে আছে একগাদা ওষুধপত্তর। কোনওটা সোনালি রাংতা মোড়া, কোনওটা রুপালি। ছোট বড় ওষুধের ফাঁইলে তরল টলটল করছে। পিতার মুখ অসম্ভব গম্ভীর। দরজায় পিঠ রেখে বাহাদুর তুলছে। মাতামহের মুখ যথারীতি প্রসন্ন। শিশু যেন চলন্ত গাড়ির জানলায় বসে জগৎ দেখছে।

হঠাৎ মাতামহ নীরবতা ভঙ্গ করলেন, তোমরা অত ভাবছ কেন বলো তো? যেতে হয় যাব। আবার ফিরে আসব, আবার যাব। একদিন তো যেতেই হবে হরিশঙ্কর। আজ আর কাল। কে থাকবে চিরকাল!

হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে আপনি একটা রেকর্ড নষ্ট করে দিলেন।

কী রেকর্ড! আমি তো কোনও কিছু নষ্ট করিনি।

আমার একটা গর্ব ছিল, আপনি অন্তত মিনিমাম নব্বই বছর থাকবেন, একশো হলে আরও খুশি হতুম। শুধু থাকা নয়, বহাল তবিয়তে থাকা। দাঁত থাকবে, চোখ থাকবে, হাত, পা, বুদ্ধি নিজের বশে থাকবে। আমার বিশ্বাস ছিল, আপনি হয়তো ফেল করবেন না। ইউ হ্যাভ মিজারেবলি ফেলড।

মাতামহ খুব আশা নিয়ে বললেন, তোমার কি মনে হয় পঁচাত্তর খুব একটা কম বয়েস?

পঁচাত্তর একটা বয়েস হল! বিদেশে পঁচাত্তর বয়সে প্রাইম মিনিস্টার হয়, প্রেসিডেন্ট হয়। গ্ল্যাডস্টোনের কথা ভাবুন। কেন চার্লি চ্যাপলিন! সত্তর না আশি বছর বয়েসে আবার বিবাহ। করলেন। জানেন, রাশিয়ার একটি অঞ্চলে মানুষের পরমায়ু দেড়শো, একশো আশি, দুশো। তার মানেটা কী? জীবনটাকে ভাগ করুন, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়, বার্ধক্য। পঁচিশ বছরে তাদের দুধের দাঁত পড়ে, নতুন দাঁত ওঠে। পঞ্চাশে শুরু হয় যৌবন। আশিতে প্রৌঢ়, একশোতে বার্ধক্য। আপনি আমার মনোবল ভেঙে দিলেন। আমাদের ব্যায়াম, কুস্তি, আপনার সাধনভজন, উপবাস, সব, সব ভস্মে ঘি ঢালা।

মাতামহ অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, এবারকার মতো তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও হরিশঙ্কর। আর কখনও এমন হবে না। কেন এমন হল বলো তো!

ত্রৈলঙ্গস্বামী কত বছর বেঁচে ছিলেন মনে আছে?

সবাই বলে তিনশো বছর।

সেই জায়গায় সেভেন্টি ফাইভ! হোপলেস। আপনি আমাকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে দিলেন। এর চেয়ে বড় পরাজয় ভাবা যায় না।

তোমার কি মনে হয়, আমার অসুখটা খুবই খারাপ?

শরীরের দুটো মেজর পার্টস একেবারে নষ্ট করে ফেলেছেন। কমপ্লিটলি আউট অফ অর্ডার। আর আপনি এতই উদাসীন, ভেতরে এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে চলেছে, কিছু টেরই পেলেন না। ধরা পড়ল শেষ সময়ে। এখন কী হবে!

কেন? এইসব ওষুধ খাব। চুপ করে শুয়ে থাকব। যা তা খাব না। খাবার ইচ্ছে থাকলেও খেতে পারব না। আচ্ছা, আমার কী হয়েছে বলো তো?

আপনার কিডনি দুটো আর কাজ করছে না।

যাক গে, না করুক গে। চোখদুটো আর মাথাটা তো কাজ করছে। হাতদুটো দেখো, এখনও গুলো ফোলালে অনেক নবকার্তিক ঠিকরে বেরিয়ে যাবে। এ বয়েসে কিডনি নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায় না। নাতিটা রয়েছে, বলা ঠিক হবে কি?

হ্যাঁ হ্যাঁ, ও এখন সাবালক।

মাতামহ ফিসফিস করে বললেন, হাবসি খোঁজাদের ও দুটো কেটেই দিত। আপদ একেবারে চুকেই যেত। পিতা হতাশ হয়ে বললেন, ও মাই গড! কোথায় কিডনি আর কোথায় কী! অ্যানাটমি সম্পর্কে কোনও জ্ঞানই নেই। হোয়্যার ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস, দেয়ার ইট ইজ ফলি টু বি ওয়াইজ।

মাতামহ বিষণ্ণ হলেন। জগদম্বার ছবির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন।

পিতা বললেন, নিন, প্যাক আপ। আপনার আর এখানে থাকা চলবে না। এখানে থাকলে সেবা হবে না। কে দেখবে! ওষুধ আছে, পথ্য আছে।

বাহাদুর ঘুম-জড়ানো গলায় বললে, আমি পারব বাবু। আমাকে সব বলে যান।

তুমি পারবে। তোমাদের আমি ভীষণ বিশ্বাস করি, শ্রদ্ধা করি। তোমরা হলে গ্যালান্ট ফাঁইটার, তবে একটা কথা কী জানলে, একটু লেখাপড়ার জ্ঞান না থাকলে সব উলটে-পালটে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তা ছাড়া ও বাড়িতে একজন সেবাপরায়ণা মহিলা আছেন। যদ্দিন আছেন তদ্দিন একটু দেখাশোনা করতে পারবেন। তারপর তো নিজেদের আপনজন এসেই যাচ্ছে। তখন আর আমাদের পায় কে?

মাতামহ বললেন, তার মানে?

আপনার নাতবউ আসছে। এই মাসেই আমি আশীর্বাদ সারব।

ও সেই মেয়েটি! একেবারে তুলসী কেটে বসানো। হরিশঙ্কর তদ্দিন আমি বাঁচব, কী বলে? এইতে তো আমার পরমায়ু, তাই না।

সোনালি একটা ওষুধের ফয়েল হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, একটা খেয়ে নেব এখন?

না, খালি পেটে নয়। কিছু খেয়ে তারপর।

অ’, তা আশীর্বাদে আমি যাব তো!

আপনি ছাড়া আশীর্বাদ হবে?

কী মজা! কী দিয়ে আশীর্বাদ হবে?

হিরের নাকছাবি।

ফাসক্লাস, ওই নাকে যা মানাবে না? তুলসীর নাকে একটা হিরের নাকছাবি ছিল, কী হল বলল তো?

পুড়ে গেল।

পুড়ে গেল?

হ্যাঁ, পুড়ে গেল। নাকেই ছিল, দেহের সঙ্গে ছাই।

হিরেও পোড়ে?

সব পোড়ে, সব পোড়ে। পৃথিবী একটা হোপলেস প্লেস। একটা জিনিসও থাকে না। সবই চলছে, চলেই যাচ্ছে। আমি পঙ্কজকে বলব, ও তোমার শীতের শেষফেস চলবে না, সুনার দি বেটার। আমি সময়কে বিশ্বাস করি না, ট্রেচারাস টাইম। আচ্ছা, আপনার কি দয়ামায়া নেই?

কেন? কেন?

আমি এখনও অফিসের জামাকাপড় ছাড়িনি। নিন উঠুন, আর কত দেরি করবেন?

আমি যদি কাল যাই হরিশঙ্কর!

আবার আপনি কালকে বিশ্বাস করছেন? এই মুহূর্তে আপনি কি জানেন, কাল কী হতে পারে আর না পারে! কেউ জানে? এই যে তুলসী ভীষণ দই খেতে ভালবাসত। কবিরাজ বলে গেলেন, বেশ আমি আর বাধা দেব না। চামচে দুয়েক ভাল মিষ্টি দই রুগিকে দিতে পারেন। সন্ধেবেলা বলে। গেলেন। আমি ভাবলুম, অত তাড়ার কী আছে, কাল সকালে দেওয়া যাবে। ভোররাতে তুলসী চলে গেল। রাসকেল কাল। আই হ্যাভ নো ফেথ অন হিম। বর্তমান ছাড়া আমি কিছু জানি না, জানতে চাই না। অতীত আমার স্মৃতিতে। ভবিষ্যৎকে আমি হাসিমুখে গ্রহণ করি। গেট আপ।

মাতামহ মিউমিউ করে একটা ছুতো বের করলেন, বাড়িটা হরিশঙ্কর এতটুকু একটা ছেলের ভরসায় ফেলে রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে!

বড় আপনি বিষয়মুখী! কী সোনাদানা আছে যে চোরে নিয়ে যাবে! ভিত থেকে উপড়ে বাড়িটা তো আর চোরে নিয়ে যেতে পারবে না।

সঙ্গে কী কী নোব?

নিজেকে নেবেন। আর আমরা নোব ওষুধ। নাথিং লেস, নাথিং মোর।

রাত বেশ হয়েছে। তবু রিকশা পাওয়া গেল। একটু পরেই সিনেমার রাতের শো ভাঙবে। পাশেই সিনেমা হল। সব তীর্থের কাকের মতো সিটে পা তুলে বসে ছিল। রিকশা নিয়েও দু’জনের কিছু বচসা হয়ে গেল। মাতামহ বললেন, একটা রিকশাই যথেষ্ট। নাতিটাকে কোলে নিয়ে নোব। পিতা বললেন, না দুটো। দুটো, একটা, একটা, দুটো।

একজন রিকশাঅলা রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়েই রইল। আর একজনের ভাগ্য দুলতে লাগল। দুটো বলমাত্র সে তড়াক করে লাফিয়ে নামে, একটা শুনলেই সিটে উঠে পড়ে। পিতার সিদ্ধান্তের ওপর কারুর চড়ে বসার ক্ষমতা নেই। শেষে আমরা দুই এক ভাগে দুটো ঝকঝকে রিকশায় উঠে বসলুম। ফুরফুরে বাতাসে রিকশা ভেসে চলল। মাতামহ আমার পাশে। আমার একটা হাত নিজের মুঠোয় চেপে ধরে বললেন, কেমন আছিস রে?

ভাল দাদু।

আমার কী মনে হচ্ছে জানিস, আমরা যেন কলকাতার বাইরে চেঞ্জে এসেছি। তোর মনে হচ্ছে না!

আমারও তাই মনে হচ্ছে।

হ্যাঁরে, আমরা আর কোনওদিন একসঙ্গে বাইরে যেতে পারব না!

কেন পারব না? আপনি ভাল হয়ে উঠলেই আমরা মধুপুর কি শিমুলতলা যাব।

না রে, হরিদ্বার। সেই স্টেশন থেকে বেরোলেই মহাদেবের মূর্তি। মাথার ওপর এক হাত তুলে ঘটি ধরে জল ঢালছে। ওদিকে গঙ্গা বয়ে চলেছে, হর হর শব্দে। আহা, সে কী জায়গা রে! সব প্রদীপ ভাসিয়েছে ভক্তরা, ফুল ভাসিয়েছে। নেচে নেচে, ভেসে ভেসে চলেছে। সে কী দৃশ্য রে! হর হর গঙ্গে।

মাতামহ ভাবে বিভোর হয়ে গঙ্গা স্তোত্র আবৃত্তি করতে শুরু করলেন,

দেবি সুরেশ্বরী ভগবতি গঙ্গে
ত্রিভুবনতারিণী তরল তরঙ্গে।
শঙ্কর মৌলিনিবাসিনী বিমলে।
মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে ॥

হঠাৎ স্তোত্র থামিয়ে নিজের মনেই বলতে লাগলেন, ওঃ কত বছর বেঁচে আছি! পাগল বলে কিনা আমি রেকর্ড খারাপ করে দিলুম। একশোর আগে যাওয়া যাবে না। আমার দিন যায় বৃথা কাজে, রাত্রি কাটে নিদ্রায়। শূন্য জীবনে একশো বছর বেঁচে লাভ কী? তারা, কোন অপরাধে সংসারগারদে দাসখত লিখে নিয়েছ হায়! মাতামহ হঠাৎ ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন।

কী হল? আপনি কাঁপছেন কেন? জ্বর আসছে?

কাঁপতে কাঁপতে বললেন, মাঝে মাঝে আমার ওরকম হচ্ছে রে! ভয় নেই। তুই আমাকে একটু জড়িয়ে ধর। ঠিক হয়ে যাবে।

মাতামহ যেন শিশুর মতো হয়ে গেছেন। বেশ করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলুম। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরে কেমন একটা পরিবর্তন এসে গেল। মনে হল দেবালয়ে কোনও পবিত্র বিগ্রহকে আলিঙ্গন করেছি। ধূপ, ধুনো, গুগুল, চন্দনের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। তরঙ্গের মতো মাতামহের শরীর থেকে একটা কিছু আমার শরীরে চলে আসছে।

বাড়ি পৌঁছেও মাতামহের কাপুনি থামল না। অতটা প্রবল না হলেও কাঁপছেন। সেই অবস্থাতেই আমরা বিছানায় শুইয়ে দিলুম। বেশ মোটা একটা চাঁদরের তলা থেকে মুখটি শুধু বেরিয়ে রইল। মুখে এক ধরনের হাসি, যেন পুরো ব্যাপারটাই বড় মজার। শরীর শরীর খেলা।

পিতা বলতে লাগলেন, ইমিডিয়েটলি ওষুধ।

টেবিলের ওপর রাখা নানারকম ওষুধ থেকে তিনি সঠিক ওষুধটি খুঁজতে লাগলেন। কাকিমা একপাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি চা খাবেন?

না, এত রাতে আর চা নয়। তুমি বরং একটু গরম জল আনন। ওঁকে চট করে একটু ওষুধ খাইয়ে, দিই।

ওষুধটা দেখিয়ে দিয়ে আপনি জামাকাপড় ছাড়ুন। আমি ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছি।

পারবে তো বউঠান?

আপনি দেখুন না পারি কি না।

পিতৃদেবের ওপরেও কাকিমার স্বাভাবিক একটা কর্তৃত্ব এসে গেছে। মেয়েরা চট করেই কেমন সংসারের হাল ধরে নেয়। ভয়ডরও কম।

মাতামহ বললেন, হরিশঙ্কর, তুমি এবার সেরে নাও। রাত অনেক হল। তুমি আমার জন্যে অত ভেবো না। তোমার ভাবনা কে ভাববে গো?

কাকিমা বিছানার দিকে সরে গিয়ে সামনে ঝুঁকে মাতামহর কপালে হাত রাখলেন। পিতা সেদিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, কী? গরম?

হ্যাঁ, সামান্য ছ্যাকহ্যাঁক করছে।

তুমি বরং দু’পাশে দুটো পাশবালিশ দিয়ে বেশ ঘন করে দাও। মাথার দিকের জানলাটা বন্ধ করে দেওয়াই ভাল। পায়ের দিকেরটা খোলা থাক।

কাকিমা মাতামহের দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার?

না বউমা, তেমন কষ্ট কোথাও হচ্ছে না। তোমরা সব খাওয়াদাওয়া করে নাও। আমি ততক্ষণ একটু বেড়িয়ে আসি।

বেড়িয়ে? কোথায় বেড়াতে যাবেন?

যেসব জায়গায় গেছি, সেইসব জায়গায় মনে মনে বেড়িয়ে আসি।

কাকিমা খাটের কাছ থেকে সরে আসতে আসতে বললেন, জ্বর বেশ বাড়ছে।

পিতা ইশারায় কাকিমাকে ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন। ডক্টর সেন কী বলে গেলেন আমিও শুনেছি। শরীরের প্রধান একটি যন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। যে-যন্ত্রের ওপর নির্ভর করছে। মানুষের জীবনমরণ।

কেমন এক গা-ছমছমে পরিবেশে রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হল। অনেকটা নমো নিত্যং ভঙ্গিতে। ঘড়ি জানিয়ে দিলে রাত বারোটা হল। কাকিমা আজ মাতামহের ঘরে মেঝেতে বিছানা করে শোবেন। পাশের ঘরে পিতৃদেব। দু’ঘরের মাঝের দরজাটা ভেজানো থাকবে। ওপাশে আমার ঘরে আমি। সাতসকালেই আমাকে বেরোতে হয়। আমার নাকি নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় ঘুমোনো উচিত।

পিতৃদেব বললেন, তুমি এখুনি আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ো। অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। টেক কমপ্লিট রেস্ট। প্রয়োজন যদি হয় ডেকে তুলব।

কাকিমা বললেন, তুমি ঘরে যাও। তোমার দুধ আমি দিয়ে আসব।

দুধ? দুধ আমি খাই না।

তা খাবে কেন? খালি চা খেয়ে শরীর নষ্ট করবে।

পিতা বললেন, ঠিক হয়েছে, এইবার তুমি শক্ত পাল্লায় পড়েছ।

ঘরে এসে অবাক হয়ে গেলুম, কাকিমা কখন এসে পরিপাটি করে আমার বিছানাটি করে রেখে। গেছেন। আলোটা আপাতত নেবানোই থাক। জানলার বাইরে প্রশস্ত রাত। বাতাস আজ খুব। উতলা। কেন? কার জন্যে! কোথাও যেন একটা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আবার কি আসছে ঘাতক?

জানলার দিকে মুখ করে চেয়ার টেনে বসলুম। কালো আকাশের গায়ে জানলার গরাদ লম্বা লম্বা। লাইন টেনেছে। বহু দূরে শ্মশানের দিক থেকে সমবেত কণ্ঠ ভেসে আসছে। আসছে, বলো হরি হরি বোল। বামুণ্ডুলে প্রবীর ওপাশের বাড়িতে বেহালা ধরেছে। সরু সুতোর মতো সুর ভেসে আসছে। পৃথিবী ক্রমশই যেন নেতিয়ে পড়ছে। যারা পেরেছে তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। যারা জাগবার তারা জেগে আছে।

ধীরে ধীরে ভেজানো দরজা খুলে গেল। পদশব্দ, কাঁধের কাছে কোনও স্পর্শ, কাপড়ের আঁচল থেকে উঠে আসা বাতাসের ঝাঁপটার অপেক্ষায় আড়ষ্ট হয়ে রইলুম। জোর করে একটা ভাবতন্ময়তা আনার চেষ্টা। দরজা থেকে জানলার কাছ, সামান্য ব্যবধান। সময় চলে যায়। কোথায়। কী? কেউ তো এলেন না। আর ধৈর্য নেই। ঘাড় ঘোরাতেই হল। ভেবেছিলুম অন্ধকার এই ঘরে একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পাব। হাতে দুধের গেলাস। লাল মেঝের দিকে তাকালে দেখব সাদা দুটি পা। কোথায় কী! দরজার একটা পাল্লা সম্পূর্ণ খোলা। বাতাসে মৃদু মৃদু কাঁপছে। শূন্য বারান্দা সোজা চলে গেছে উত্তরে। দরজা খুলে গেছে, কেউ কিন্তু আসেননি।

ব্যাপারটা কী হল? দখিনা বাতাসে উত্তরের দরজা খোলে কী করে! যত গা-ছমছমে ব্যাপার কি আমার জীবনেই ঘটবে! বারান্দা পেরিয়ে মাতামহের ঘরে এলুম। খাটের এক পাশে পিতা, আর এক পাশে কাকিমা। মাতামহ বলছেন, আমার তানপুরাটা নিয়ে আয় পিন্টু। বাঁধ, আজ ডি-শার্পে বাঁধ। সুর দিয়ে বেটির চরণ ছোব। আহা! কী সুন্দর জায়গা। ওই দেখ, আকাশের গায়ে উত্তরাখণ্ডের পাহাড়। হেসে হেসে আমার মা চলেছে। দে দে তানপুরোটা দে।

পিতা বললেন, কী হল বলো তো! এইটুকু সময়ের মধ্যে এত প্রবল জ্বর এসে গেল! ডিলিরিয়াম!

মাতামহ বললেন, আমি হারিনি, হরিশঙ্কর। আমি হারিনি। আমি এখনও দৌড়োচ্ছি। ঠিক পারব। পেরে যাব। আমার এখনও দম আছে।

কাকিমা বললেন, জলপটি দোব বটঠাকুর?

তার আগে থার্মোমিটার লাগাব?

কী দরকার! আমি হাতেই বুঝতে পারছি তিনের ওপর, চারের কাছাকাছি।

মাতামহ বলতেন, খুলে ফেল, খুলে ফেল, সিন্দুকের ডালাটা খুলে ফেল, ওরে গুপ্তধন আছে। গুপ্তধন।

আমি অবাক হয়ে বললুম, এই তো ভাল ছিলেন, এর মধ্যে জ্বর এসে গেল, এত প্রবল জ্বর!

তাই তো ভাবছি! আমার মনে হয় ডাক্তারের কথা শুনে মনোবল ভেঙে পড়েছে। মন দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। নিয়ে এসো, জলপটিই নিয়ে এসো। তুমি পা দুটো দেখো তো!

চাদর তুলে পায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলুম, বরফের মতো ঠান্ডা। পিতা বললেন, জ্বর আরও বাড়বে। দেব নাকি এক পুরিয়া হোমিওপ্যাথি?

কাকিমা বললন, দিন না।

অ্যালোপ্যাথি চলছে।

চলুক।

টেবিলের ওপর ওষুধের বাক্স তুলে পিতা ওষুধ খুঁজতে লাগলেন। গোল গোল গর্ত থেকে একটি করে শিশি তুলছেন, লেবেল পড়ে ছেড়ে দিচ্ছেন, টুকুস করে শব্দ হচ্ছে। শব্দ মৃদু, কিন্তু এই পরিবেশে বড় ভৌতিক। যেন যমে-মানুষে দাবা খেলা চলেছে। কোলরিজের কবিতার লাইন মনে 9965: The naked hulk alongside camel And the twain were casting dicel The game is done! I have won! I have won! Quoth She, and whistles thrice.

চারটি মাত্র ওষুধের গুলি, তাও তিনটি গেল মুখে, একটি গড়িয়ে পড়ে গেল। পিতা বললেন, হবার হলে তিনটিতেই হবে।

দুটো বোতলে গরম জল ভরে পায়ের পাতায় সেঁক চলতে লাগল। ওদিকে জোয়ারের জলের মতো রাত ক্রমশই বাড়ছে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব শব্দ উঠছে। কাদের বাড়ির শিশু কাঁদছে। ব্রঙ্কাইটিসের রুগি কেশে উঠছে। ছাদের আলসেতে বসে পেঁচা ডেকে গেল। বাসার পাখি রাত শেষ হয়েছে ভেবে দু’বার ডেকে উঠেই মায়ের পাখার ঝাঁপটা খেয়ে থেমে গেল। কে একজন ও মা করে ডেকে উঠলেন। প্রবল বাতাস থেকে থেকে চারপাশ দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। রাতের আসর খুব জমেছে।

রাত দুটো নাগাদ মাতামহ একটু শান্ত হলেন। জ্বরের প্রকোপ সামান্য কমেছে। অবশেষে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বেশ জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে। শিশু যেমন ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে হেসে ওঠে, মাতামহের মুখেও সেইরকম হাসি খেলে যাচ্ছে। কিছু একটা হচ্ছে যা আমরা জানি না। মানুষ কখন যে কোন জগতে চলে যায়!

পিতা বললেন, নাও বউঠান, তুমি এবার একটু শুয়ে পড়ো।

পিন্টুর দুধটা স্টোভ জ্বেলে আর একবার গরম করে দিই।

তুমি এখনও দুধের কথা ভাবছ? মেয়েরা কাজের হলে যে কত কাজের হয়! তোমার স্বভাবটি ঠিক তুলসীর মতো। সংসার একেবারে মাথায় করে রেখেছ। আচ্ছা সে কোথায় গেল, প্রফুল্ল! বড় ভাবিয়ে তুললে তো!

কাকিমা করুণ মুখে বললেন, বটঠাকুর, আপনি একটু সন্ধান করবেন! তার তো কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই।

হ্যাঁ, এবার করতে হবে। আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। দাঁড়াও, এদিকটা একটু সামলে নিই। নাও, তুমি দুর্গা বলে শুয়ে পড়ো। আজ আর দুধের হাঙ্গামা করতে হবে না। ঘড়ি কী বলছে দেখেছ! রাত ফিকে হয়ে আসছে।

নিজের ঘরে ঢুকে কেমন যেন একটা অতিপ্রাকৃত অনুভূতি হল। আকাশে একখণ্ড সাদা মেঘ উঠেছে। গোটাকতক তারা নেমে এসেছে নীচে। দপদপ করে জ্বলতে জ্বলতে একটা উল্কা মাটির কাছাকাছি এসে হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হতে লাগল, আমার ঘরের দেয়াল ছাদ সমস্ত ঘেরাটোপ অদৃশ্য হয়ে গেছে। মহাশূন্যে চেয়ার পেতে বসে আছি। প্রচণ্ড বাতাসে চুল উড়ছে। এলোমেলো। বিশালের এই অনুভূতি বেশিক্ষণ সহ্য করা গেল না। নিজেকে এত অসহায়, এত নগণ্য মনে হল, কেমন যেন একটা ভয় এসে গেল। নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালতে জ্বালতে মনে হল, আমরা কীসের এত বড়াই করি, বিশাল শূন্যতায় মুঠো মুঠো প্রাণ অসংখ্য জোনাকির মতো জ্বলছে আর নিবছে। সৃষ্টিবৃক্ষের ডালে ডালে কখনও নাচছে, কখনও স্থির। ড্রয়ার টানার শব্দে নিজেই চমকে উঠলুম। তারছা আলোয় মুকুর সেই খাম। যেন এক জীবন্ত প্রাণী। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। শেষ প্রহরের ঘণ্টা বাজছে। দূরে।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন