২.২৫ Life is like an Onion

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

Life is like an Onion. You peel
away layer after layer and when
You come to the end you have nothing.

কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না মানুষটিকে। আমরা সিক্ত বস্ত্রে সিক্ত পদে শ্মশান ছেড়ে বাইরে চলে এলুম। পুব আকাশে জবাফুলের রং ধরেছে। মেনিদা বললেন, প্রমাণ করে দিলুম, রাজদ্বারে আর শ্মশানে যে সঙ্গী হয় সে-ই প্রকৃত বন্ধু। আমরা তোমার শাস্ত্রসম্মত বন্ধু। তোমার সেই ঘটোৎকচ, দেখলে তো, কোন এক সময় কেটে পড়েছে খুস করে! দ্যাটস ভেরি ব্যাড, অফুলি ব্যাড।

আমাদের অনুসরণ করে আসছে আমাদেরই ভিজে কাপড়ের সপাত সপাত শব্দ, আর পায়ের ছাপ। মেনিদা আমার পাশে পাশে আসছেন কথা কইতে কইতে। হঠাৎ বললেন, তোমার খুব একা লাগে, না? বাবা চলে গেলেন, তোমার সেই মেয়েটিও চলে গেল। যা-ও বা একটা দিদি এসেছিল, সে-ও সরে পড়ল। এইবার তুমি কী করবে! একেবারে একা একা পৃথিবীতে বাঁচা যায়?

আমার কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। কোনওরকমে বললুম, হুঁ।

মেনিদা বললেন, কোনওদিন অচলাকে দেখেছ?

অচলা? কে অচলা?

অচলা আমার মেয়ে। নিশ্চয় দেখেছ। তাকে না দেখে উপায় নেই। তার যা রূপ, যে-কোনও ছেলেকে তাকাতেই হবে। উঠতি বয়সের ছেলে। আর তা না হলে বুঝতে হবে কোনও অসুখ আছে। আমি নিজেই অনেক সময় হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। একটা পারফেক্ট ক্রিয়েশন। সিনেমাঅলারা পেলে একেবারে খামচাখামচি করবে। ওকে বেশিদিন আর এইভাবে ফেলে রাখাটা সেফ নয়। ধামায় করে প্রেমপত্তর ফেলতে হয়। তাই ভাবছি তোমাদের দু’জনকে গেঁথে দিয়ে চলে যাব। তোমাকে কিছু করতে হবে না, শুধু একটু সাবধানে রাখবে, যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়! ঠিক এই সময় কথাটা কেন বলছি জানো? ইংরেজি প্রোভার্ব, স্ট্রাইক দি আয়রন হোয়াইল ইট ইজ হট। তোমার মনটা এখন সম্পূর্ণ ফঁকা হয়ে আছে। ফঁকা দেয়ালেই ছবি ঝোলাতে হয়। ঝুলিয়ে দিলুম, তুমি এইবার তাকিয়ে থাকো। রুমাল দিয়ে মোছো। ভাব আনো মনে। একটা অভাববোধ। এরই মাঝে টুক করে একদিন অচলাকে পাঠিয়ে দোব। সে তোমার মন মেরামত করে দেবে।

কেমন করে বুঝলেন আমি বিয়ে করব?

তোমার হাবভাব রকমসকম দেখে।

সে আবার কী?

তুমি পায়রা দেখেছ? পায়রার মেটিং!

আজ্ঞে না, সুযোগ হয়নি, ইচ্ছেও নেই।

নেচারকে অবজার্ভ করবে, স্টাডি করবে, দেখবে কত কী জানতে পারবে। পুরুষ পায়রা গালগলা ফুলিয়ে পেখম ছেতরে, একবার এদিক যায়, একবার ওদিক যায়। কোঁক কেঁক শব্দ করতে থাকে। গায়ের রংটং আরও উজ্জ্বল হয়ে যায়। স্ত্রী-পায়রা তখন বুঝতে পারে। প্রকৃতির সে এক অদ্ভুত লীলা। তুমি সাপের মেটিং দেখেছ?

আজ্ঞে না। আমি তো ন্যাচারালিস্ট নই। আর মেটিং দেখা উচিত না। অসভ্যতা।

মেনিদা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, তোমার মাথা! মানুষ ছাড়া আর কিছু চতুষ্পদ ছাড়া, প্রাণীজগতের মেটিং স্বর্গীয় দৃশ্য। কী আর্ট! কী বিউটি! জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঝকঝকে পিচের রাস্তা চলে গেছে। ফটফট করছে চাঁদের আলো। আমরা একটা গাড়ি করে যাচ্ছি। বসেছি সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে। সামনে চাঁদের আলোয় ধোয়া পথ। আহা! হোয়াট এ ম্যাগনিফিশিয়ান্ট সাইট! ড্রাইভার ঝপ করে ব্রেক কষে দিল। ঠিক হাত-কুড়ি দূরে একজোড়া শঙ্খচূড়। মেল সাপটা পেছনের লেজে ভর রেখে খাড়া দাঁড়িয়ে পড়েছে আর ফিমেলটা তার সারাশরীর পেঁচিয়ে ওপরে উঠেছে, দুটো মাথা হেলছে-দুলছে, যেন অদৃশ্য কোনও সংগীতের তালে তালে। এ একবার ছোবল মারে তো, ও একবার। দড়ির ফঁসের মতো জড়িয়ে গেছে দুটো শরীর। একটা সার্কল করে দু’জনের শরীরের নীচের অংশ খেলে বেড়াচ্ছে। সাপ দুটোর শরীর যেন ফসফরাসের মতো জ্বলছে। আর একটা সুগন্ধ, যেন কেউ কোথাও কামিনীভোগ চালের পায়েস রাঁধছে। আর একটা ঝুনঝুন শব্দ। দু’জনের শরীরের কাটার মতো হাড়ের শব্দ। উঃ সে কী দৃশ্য! গড, আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ।

তোমার কৃপায় এই মেনি, হাড়হাবাতে এই মেনি তোমার সৃষ্টির এই লীলা দেখে ধন্য হয়েছে। কী বিরাট, স্বরাট, মহারাজ। একটা গাছকে জড়িয়ে ধরে আমার কঁদতে ইচ্ছে করছে। কী বিশাল বিচিত্র এই সৃষ্টি! কোথায় তুমি বসে আছ মহারাজ? কেন তোমাকে দেখতে পাই না! তোমার সৃষ্টির পথ। রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে, হে ছলনাময়ী।

মেনিদা ঝরঝর করে কাঁদছেন। আশ্চর্য চরিত্র! আমাদের বাঁ পাশে গঙ্গা। বড় বড় অশ্বথ আর বট গাছ। আকাশের গা থেকে অন্ধকারের নির্মোক একটু একটু করে খুলে পড়ছে। দ্রুত ধাবমান ট্রেনের জানলায় যেমন একটি-দুটি নিরীহ আত্মভোলা মুখ দেখতে পাওয়া যায়, সেইরকম একটি কি দুটি তারা আকাশের চাদোয়ায়। গাছের পাতায় বাতাসের ভিজে জাল টানার শব্দ। মেনিদা অবরুদ্ধ। গলায় বলে চলেছেন,

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত
তার তরে রাখোনি গোপন রাত্রি
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ
সে যে চিরস্বচ্ছ
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জ্বল
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু
এই নিয়ে তাহার গৌরব
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।

মেনিদা একটা দম নিলেন বড় করে। চোখ মুছলেন জামার হাতায়। ভিজেভিজে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এক্সকিউজ মি। বিশ্রী একটা ভাব এসে গিয়েছিল। আসলে আমি তো খুব দুঃখী মানুষ। কেন মাঝে মাঝে বজ্জাতি করি জানো? তুমি কি শেকসপিয়ারের রিচার্ড দি থার্ড পড়েছ?

আজ্ঞে না।

তোমরা কেন লেখাপড়া করো না বলো তো, ইয়াংম্যান? আরে, আমরা একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। সেই থেকে! ছেলেরা কোথায় গেল?

এগিয়ে গেছে।

চলো চলো, সর্বনাশ! ভিজে কাপড়ে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।

আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি আমি। কী করে বুঝলেন আমি বিয়ে করব? আমার কোন রকমসকম দেখে আপনার এই ধারণা হল!

ও তুমি এখনও ওইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছ? প্রথমত, দেখো তোমার চুল। একেবারে এ-ক্লাস বাবরি। শিল্পী-শিল্পী ভাব। দ্বিতীয়ত, তোমার সাজপোশাক। তুমি স্টিমলন্ড্রিতে জামাকাপড় কাঁচাও। সবসময় ফিটফাট ধোপদুরস্ত। তৃতীয়ত, তুমি রোজ দাড়ি কামাও, মুখে স্নো-পাউডার মাখো। গায়ে সেন্ট মাখো। চতুর্থত, তুমি মেয়ে ছাড়া থাকতে পারো না। আর পঞ্চম, নরানাং মাতুলক্রমঃ, তোমার মামার ধারায় রয়েছে গান, সিনেমা, নায়িকাসঙ্গ। এইবার তুমিই বলো। নিজেকে নিজেই বিচার করো। তোমার ভেতরে প্রেম জাগছে।

আমরা হনহন করে হাঁটছি। একজন-দু’জন জ্ঞানার্থী গঙ্গার দিকে চলেছেন নিদ্রার আলস্য নিয়ে। হঠাৎ মেনিদা পাকা ওস্তাদের গলায় গান ধরলেন, ওগো! কেমনে বলো না ভাল না বেসে থাকি গো তোমায়!

ভদ্রলোকের মাথায় একটা কিছু হয়েছে। কত রকমের ভাব খেলা করছে। মেনিদা কিছু দূর আমার সঙ্গে এলেন, তারপর বিদায় নিলেন। নিত্যকর্ম করবেন। পথে পথে নামগান গেয়ে বেড়াবেন। মেনিদার গুরু বলেছেন, মেনি, নাম ছেড়ো না। নামেই মুক্তি।

বাইরের রকে অক্ষয় কাকাবাবু গুম মেরে বসে আছেন। সদরের চাবি আমার কাছে। ঢুকতে পারেননি। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, তবু প্রশ্ন করলুম, কখন চলে এলেন?

জানো না?

আজ্ঞে না। খেয়াল করিনি।

এতই যখন বেখেয়াল তখন আর জেনে কী হবে?

আশ্চর্য কথা বলছেন আপনি! নিজেই উদাস হয়ে বসে রইলেন দলছাড়া হয়ে, আমাদের পেছন দিকে। এক ফাঁকে টুপ করে উঠে চলে এলেন। কেমন করে জানব? আপনার রাগের কারণটা কী?

সে আর তোমার জেনে কাজ নেই। দয়া করে দরজাটা খোলো, আমার জিনিসপত্তর নিয়ে সরে পড়ি। খুব শিক্ষা হয়েছে আমার।

কাকাবাবু, অত রাগ ভাল নয়। এই রাগের জন্যেই আপনি আজ সংসারছাড়া।

শুকনো ঘাসে আগুন পড়লে যেমন দপ করে জ্বলে ওঠে, কাকাবাবুও সেইরকম দপ করে জ্বলে উঠলেন, শোনো পিন্টু, বয়সকে সম্মান দিতে শেখো। জানি তোমার অনেক ইয়ারবকশি জুটেছে। ইহকাল-পরকাল দুটোই চিবিয়ে শেষ করবে। তোমার অধঃপতনে আমি অবাক।

বেশ কড়া একটা জবাব জিভে এসেছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, সন্ন্যাসী আমাকে অমৃতফল খাইয়েছিলেন। সহজে বিচলিত হলে তো চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে জিভে লাগাম চড়ে গেল। রাগ রাগ ভাবে তালাটা খুলতে যাচ্ছিলুম। সংযত ভাব এল। ধীরে দরজা খুললুম। সঁাতাতে একটা বাতাস ঝাঁপটা মেরে চলে গেল। পেছন থেকে কে খুব মিষ্টি গলায় ডাকল, পিন্টুদা।

টিপ আর টিপের মা। টিপের হাতে একটা নিমডাল। বউদির হাতে গঙ্গাজলের ঘটি। মিষ্টির বাক্স। হাঁ করে তাকিয়ে আছি। বউদি বললেন, কী দেখছ অমন করে?

আপনারা? আপনারা এলেন আমার জন্যে?

হ্যাঁ এলুম। দেখো ঠিক সময়ে এসে গেছি। দাঁড়াও, ঢোকার আগে নিমপাতা চিবোও। কাকাবাবু বসেই আছেন। বউদি বললেন, চান করেননি আপনি?

না, আমি আমার সময়ে চান করব।

শ্মশানে যাননি?

গিয়েছি।

তা হলে?

শ্মশানেই আমার ঘরবাড়ি। আমার চানের দরকার হয় না।

কাকাবাবু ভেতরে চলে গেলেন। টিপ বললে, মনে হচ্ছে, কোনও কারণে বেশ রেগে আছেন।

বউদি বললেন, কী হল?

কিছু হতে হয় না। উনি দুর্বাসার বংশধর।

তোমার জীবনে দেখছি অশান্তির পর অশান্তি।

ঈশ্বরের পরীক্ষা।

তা যা বলেছ।

কাকাবাবু তার ঝোলা ব্যাগ নিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন বীরের মতো। আমরা কেউ বাধা দিলুম না। টিপ আর বউদি দু’জনেই হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। শুনেছি ভদ্রলোক এইভাবেই একদিন সামান্য কারণে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছিলেন। আমার পিতার সামনে বিশেষ ট্যাঁ ফোঁ করতে পারতেন না। তার ব্যক্তিত্বের সামনে কেঁচো হয়ে থাকতেন। পৃথিবীতে এই ধরনের মানুষের জন্যে প্রয়োজন ভাল রকমের চাবকানির।

কিন্তু হঠাৎ আমার কী হল ভেতরে? রাগ আর ঘৃণার বদলে একটা ভালবাসার ভাব এল। প্রচণ্ড একটা দুঃখের বোধ। আহা! মানুষটার কেউ নেই। এত বড় পৃথিবীতে একেবারে একা। চাকরি অবসর দিয়েছে। যৎসামান্য পেনশন। একেবারেই অনিকেত। কলকাতার এক পরিবারে একটু আশ্রয় পেয়েছেন। এই মেজাজ নিয়ে কতদিনই বা সেখানে থাকতে পারবেন। এই বৃদ্ধ বয়েস। বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরছেন।

তিরবেগে দৌড়োলুম। যেমন একদিন দৌড়েছিলুম আমার পিতার পেছন পেছন। সে ছিল অদ্ভুত এক ঘটনা। নতুন এক কথা শেখার বিড়ম্বনা। সেইদিনই স্কুলে বাংলার শিক্ষকমহাশয় নতুন এক শব্দ শিখিয়েছিলেন, পরাকাষ্ঠা। বেশ নতুন ধরনের কথা। নিজেকে খুব ঐশ্বর্যশালী মনে হচ্ছিল। সেইদিনই সন্ধেবেলা বাড়িতে পুরোহিতমশাই এলেন, পিতা বললেন, প্রণাম করো। সঙ্গে সঙ্গে পরাকাষ্ঠা শব্দটি লাগাবার সুযোগ পেয়ে গেলুম। প্রণাম করতে করতে বললুম, প্রণামটাই ভক্তির পরাকাষ্ঠা নয়। পিতা গুম মেরে গেলেন। পুরোহিতমশাই চলে গেলেন। হঠাৎ বামুনদি এসে বললেন, তুমি কী বলেছ, ছোটবাবু বেগে বেরিয়ে গেলেন! নির্বোধ কিশোরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। পনপন করে। ছুটলুম বাজারের দিকে। রাতের অন্ধকার রাস্তা, গুচ্ছের সাইকেল, রিকশা। দৃকপাত নেই। তিনি ফিরে এলেন, কিন্তু পুরো একটা মাস বাক্যালাপ বন্ধ রইল। কাকাবাবুকে ধরার জন্যে ছুটছি, আর সেই অতীত ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই একই হাঁকপাক ভাব। বেশ কিছুটা যাবার পর কাকাবাবুকে দেখতে পেলুম। খাড়া হেঁটে চলেছেন। একমাথা এলোমেলো পাকা চুল। বাঁ দিকে দুলছে সাইড ব্যাগ। রাস্তার দু’পাশের লোক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার ছোটার দিকে।

মোটরবাইক আরোহী সার্জেন্ট যেভাবে আইনভঙ্গকারী গাড়ির পথ অবরোধ করেন, আমিও সেইভাবে কাকাবাবুর সামনে গিয়ে পড়লুম। হাপরের মতো হাঁপাচ্ছি। কথা বলতে পারছি না। তার। হাতদুটো ধরে আবেগে কেঁদে ফেললুম। কোনওরকমে বললুম, ক্ষমা করুন। ফিরে চলুন আপনি। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

রাস্তার একপাশে সরে এলুম আমরা। কাকাবাবু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি ফুলছি ক্রমশই। কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, কে কাকে ক্ষমা করে! আমিও তো এক পাঠা। চলো চলো, বাড়ি চলো।

সাতসকালেই রাজপথে এক নাটক। সকলেরই চোখে প্রশ্ন। উৎসুক মানুষের মধ্য দিয়ে আমরা দু’জনে ফিরে এলুম। বাড়িতে ঢুকেই কাকাবাবু বললেন, আমি তোমার ওপর কেন অমন রেগে গেলুম। বলো তো, ছোটলোকের মতো?

বউদি বললেন, থাক ওসব ফয়সালা। মুখহাত ধুয়ে ফেলুন। সকালের চা-টা হয়ে যাক আগে। কাকাবাবু দু’হাতে আমার কাধদুটো ধরে, সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমিই হরিশঙ্করদার ছেলে হবার উপযুক্ত। বোম্বাই আম গাছে বোম্বাই আমই হয়। আসল ব্যাপারটা কী। জানো, তোমাকে আমি বোধহয় সর্বাধিক ভালবাসি। আমারও তো কিছু আশা ছিল। শান্ত সংসার, তোমার মতো একটি ছেলে, হরিশঙ্করদার মতো ভাই। সবই তো মরীচিকা হয়ে গেল। ভালবাসার। কোনও ব্যাখ্যা হয় না পিন্টু। ইট ফ্লোজ। যেমন করে ধমনিতে রক্ত প্রবাহিত হয়। তোমাকে এত, ভালবাসি বলেই তোমাকে অন্য কেউ অধিকার করলে আমার অভিমান হয়। হোয়াট ক্যান আই ডু? আই অ্যাম হেলপলেস।

এক প্রবীণ আর এক নবীন দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সময় যেন থমকে গেছে। আমরা কত অসহায়! ভেতরে শূন্যতার তেপান্তর। কারওই কেউ নেই। সকলেই সকলকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছি। চাঁদের বাইরে মায়াবী আলো। সে আলোও আবার ধার করা আলো। চাঁদের পিঠে বীভৎস যত গর্ত। প্রাণহীন এক মহাশ্মশান। বউদি আর টিপ দু’জনেই রান্নাঘরে। হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। মনে হওয়ামাত্রই রাতের শ্মশানের দৃশ্য আবার ভেসে উঠল। স্যার ওয়াল্টার র‍্যালের কথা, পৃথিবীটা কী? বিশাল এক কারাগার। প্রতিদিনই কিছু কিছু কয়েদিকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা আর ফেরে না।

কাকাবাবুকে বললুম, আপনি একটু হাসুন। তা না হলে আমার মন ঠিক হবে না।

হাহা করে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। বউদি ছুটে এলেন, কী হল?

কাকাবাবু বললেন, ভয়ের কিছু নয় বউমা। জীবন বেলাইন হয়ে গিয়েছিল, আবার তাকে লাইনে ভেড়ানো হল। সুর কেটে গিয়েছিল না!

বারান্দার টিনের চালে এক ঝাক পায়রা এসে বসেছিল। কী কারণে সবকটা ফটফট করে উড়ে গেল। কিছু পরেই কারণটা বোঝা গেল। সেই বাঘা বেড়ালটা ছাত থেকে লাফ মেরে টিনের চালে নেমেছে। বড়ই আফসোস। একটাকেও যমের বাড়ি পাঠাতে পারল না।

.

দুপুর এল। মুকুর শাড়িটা বউদি তার থেকে তুলে পাট করে রেখে গেছেন। কোনও মেয়েলি ব্যাপার আর চোখে পড়ার উপায় নেই। বর্শার ফলার মতো রোদের রেখা নতুন টিনের চাল থেকে ঠিকরে। চোখে এসে লাগছে। নারী শূন্য বাড়িতে অনেকদিন পরে আমার শৈশবকে যেন ফিরে পেলুম। কেউ তখন ছিল না। আমি আর পিতা হরিশঙ্কর। আমাদের ঘিরে ছিল উচ্চ আদর্শ, ত্যাগ আর তিতিক্ষা। ছিল এসরাজ, হারমোনিয়ম, তানপুরা, বাঁয়া-তবলা। একটা আশ্রমিক পরিবেশ। পিতা যেন বাঘছাল পরা, ত্রিশূলধারী মহাদেব। তিনটে জিনিসকে শূলে বিধে হত্যা করা হয়েছিল কাম, ক্রোধ আর লোভ।

আজ যেন সেই অতীত সাঁতার কেটে বর্তমানের পইঠায় উঠে পড়েছে। শুধু কাকাবাবুকে পিতা ভেবে নিলেই হল। ভদ্রলোক এই মুহূর্তে কঠিন এক অঙ্ক নিয়ে পড়েছেন। হরিশঙ্করের জন্মসময় আর সাল-তারিখ নিয়ে হিসেব চলেছে। কোথায়, কোন দিকে যেতে পারেন? সবার আগে দেখা দরকার। বেঁচে আছেন কি না! ছক পড়ে গেছে। গ্রহনক্ষত্রের ডিগ্রি বেরিয়ে গেছে। দশা-অন্তর্দশার হিসেব চলছে।

দূর থেকে মানুষটির তন্ময়তা দেখছি। কেটলিতে চায়ের জল ফোঁটার সিসি শব্দ। একটু আগে কাজের মহিলা এসে জবাব দিয়ে গেছে। কাজ করতে পারবে না। আসলে ভূতের ভয়। গলায় দড়ি। সাংঘাতিক এক ব্যাপার। না আসে, না আসবে! সিদ্ধান্ত হয়েই গেছে, বাড়িতে কিছুদিন তালা পড়বে। সংসার গুটিয়ে রাখা হবে গালচের মতো। আমরা একটা পরিক্রমায় বেরোব। হরিশঙ্করকে যেভাবেই হোক উদ্ধার করে আনতে হবে। কাকাবাবু মুখ তুলে তাকালেন, শোনো, কী করছ ওখানে একা একা! ও, চা বসিয়েছ? গুড বয়। আচ্ছা হরিদার কি হারপিস হয়েছিল? হারপিস জোস্টার? এনি ফর্ম অফ ভাইরাল ইনফেকশন?

আজ্ঞে হ্যাঁ, হারপিস জোস্টার।

বাঃ বাঃ, কী আনন্দ! কাকাবাবু উল্লাসে আটখানা, সে ফাইভ ইয়ারস ব্যাক?

আজ্ঞে হ্যাঁ, ওইরকমই হবে।

মিলছে মিলছে। আচ্ছা, এনি অ্যাকসিডেন্ট? অ্যা

সিডে পুড়ে গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ হ্যাঁ, দ্যাট আই ক্যান রিমেম্বার। তা হলে তো লং লাইফ! তিনি আছেন। বেঁচে আছেন। আচ্ছা দেখি সন্ন্যাসযোগ আছে কি না! নাউ হি ইজ পাসিং থ্রু স্যাটার্ন।

কাকাবাবু আবার ঝুঁকে পড়লেন। বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ হল।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন