১.৬১ One life, one death, one heaven

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

One life, one death, one heaven
one hell, one immortality and
one annihilation

‘দিদি আত্মহত্যা করেছে বলে মনে হয় না। দিদিকে তোমার চেয়ে আমি ভাল চিনি। দিদি ভয়ংকর একরোখা মেয়ে, তেমনি সাহসী। অভদ্র নয়, বাঁচাল নয় কিন্তু অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়ায়। শ্রদ্ধেয় গুরুজনকে শ্রদ্ধা করে, গুরুজন শুধু বয়সে কি সম্পর্কের দাবিতে দিদির কাছ থেকে শ্রদ্ধা আদায় করতে পারবে না। বাবা ইদানীং যা যা করেছেন তোমাকে আমি জানিয়ে এসেছি। আমার যা সন্দেহ দিদি যদি তাই করে থাকে আমি বলব ভালই করেছে।’

মুকুর চিঠি ক্রমশই রহস্যময় হয়ে উঠছে। মেসোমশাই ইদানীং কী করছেন! মাসিমা তো শ্যামদেশ থেকে হাঁটাপথে আসার সময় আরাকানের জঙ্গলে দেহ রেখেছেন। পথের ক্লেশ সহ্য করতে পারেননি। বিপত্নীক মেসোমশাই কি তা হলে ইন্দ্রিয়ের কাছে হার মেনেছেন? প্রৌঢ় মানুষটির কি তা হলে পদস্খলন হয়েছে! কী জানি! সেসব বৃত্তান্ত ছিল মুকুর রেখে যাওয়া লেফাফায়। কনক কী এমন ভাল কাজ করলে! হোমচৌধুরিটি কে? কনকের কোনও পূর্ব পরিচিত। গড নোজ। এসব ব্যাপারে আমার আর কোনও আকর্ষণ নেই। বাতাস ঘুরে গেছে। হাওয়া-মুরগির। মুখ এখন অন্য দিকে। সব ধর্মগুরুই আমাকে নেতিবাচক কথা শুনিয়েছেন। এখন না, পরে। সতীমা ভয় দেখিয়েছেন। ঘুরঘুরে বাবা ভূত দেখিয়েছেন। জয়ামাতা বলে গেছেন বছর চারেক পরে। একমাত্র স্বামী নির্মলানন্দের কাছে কিছু পজেটিভ কথা শুনেছি। ঈশ্বর নয়, ভক্তিরস নয়, জ্ঞানমার্গ। নিজেকে ধরো। হাত জোড় করে বলো–দুর্বল আমি, সবল হও। ক্ষুদ্র হৃদয় দৌর্বল্যং তক্তোতিষ্ঠ পরন্তপঃ। নিজের ওপর নিজে উঠে পড়ে লাগাম ধরে বোসো। সেই আমির বশে এই আমিকে সঁপে দাও। সেখানে মুকুর ভালবাসা নেই, কনকের আকর্ষণ নেই, অপর্ণার আগমন-প্রত্যাশা নেই, কাকিমার কী জানি কী নেই। প্রফুল্লকাকার মৃত্যুর খবর অফিশিয়ালি জানাজানি হয়ে যাবার পর আমি কাকিমাকে হিন্দুর ঘরের বিধবার মতোই দেখতে চাই। শুদ্ধ, সাত্ত্বিক, আচারনিষ্ঠ। তবু কেন জানি না,নারীর মন জয় করার আনন্দে ভেতরটা থেকে থেকে গুনগুন করে উঠছে। কী একটা হচ্ছে। যা বলে বোঝানো যায় না। কোয়েলিয়া গান থামা এবার বললেও গান থামছে না। তাই চিঠির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। সারি সারি মুক্তো দিয়ে সাজানো জ্বলজ্বলে যৌবনের আবেগ।

‘তোমার চিঠি আমি আশা করিনি। তুমি জানো না, আমি জানি, তোমার মধ্যে চাপা একটা অহংকার আছে। অহংকার তোমাদের রক্তে। তোমার দোষ নেই। তোমার চেয়ে বয়েসে আমি অনেক ছোট, রাগ কোরো না, তোমাকে একটা কথা বলি, নিজেকে বেশিদিন ভোলা ফেলে রেখো না। আমার শ্রদ্ধেয় পিতাকে দেখে এই শিক্ষাই হল, মানুষ বড় জটিল প্রাণী। কখন কীভাবে কোন আবেগে কেঁপে উঠবে নিজেই জানে না। লক্ষ প্রলোভনের তরঙ্গ খেলছে। কখন কোন বাতাস পালে ধরবে কেউ জানে না। আদর্শের শৌখিন পেয়ালা খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়বে। তুমি কি জানো মেয়েরাও ভালবাসতে পারে। ছেলেরা ভালবাসার কিছুই জানে না। পেট্রলও জ্বলে, কয়লাও জ্বলে, পাটও জ্বলে। একটা দপ করে জ্বলেই নেবে। আর একটা ধীরে জ্বলে, নেবেও ধীরে। জ্বলতেই থাকে, জ্বলতেই থাকে, নিঃশেষে ছাই হয়। শেষবারের মতো আজ আমি তোমাকে একটা কথা নির্লজ্জের মতো বলে যাই, আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকে কাছে পেতে চাই। তোমার কল্পনাবিলাস, তোমার ছেলেমানুষি, তোমার পবিত্রতা, তোমার চাপা অহংকার, বেদনা, নিঃসঙ্গতা, সবকিছু আমি ভালবেসে পেতে চাই। কেন চাই, তা জানি না। তোমাকে ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারি না। এ আমার কী হল!’

মুকু রসিকতা করছে, না সত্যি কথা বলছে? মেয়েরা এমন প্রাণখুলে লিখতে পারে? কোনও মেয়ে আমার মতো ছেলেকে ভালবাসতে পারে? বিশ্বাস হয় না। কোনও মেয়ে কখনও আমাকে প্রেমপত্র লেখেনি। কো-এডুকেশন কলেজে মেয়েরা আমার পাশ দিয়ে চলে যেত, ফিরেও তাকাত না। সুন্দরী মেয়েদের বেশ অহংকার থাকে। মুকু তো সুন্দরীই। ভরাট গোল চাঁদের মতো মুখ। ছোট চুল-ঢাকা কপাল। উচ্চতায় আমার মাথায় মাথায়। মেয়েরা যাকে গড়ন বলে, সেই গড়নও বেশ সুন্দর। পাশ দিয়ে চলে গেলে ভোগী মানুষকে ফিরে তাকাতেই হবে। সে কেন আমার মতো এক শুকনো ঘেঁকুরে বাবাজিকে প্রেমপত্র লিখবে? পৃথিবীতে কি এখন প্রেমের জোয়ার বইছে, যে নালা নর্দমা সব ভেসে যাবে!

‘প্রথম প্রথম তোমাকে আমি আর পাঁচটা ছেলের মতোই ভাবতুম। একটু চালিয়াত, বড় বড় কথা বলে। একটু বেশি বকে। পরে আমার সে ধারণা একেবারে পালটে গেল। মনে হল, তোমার। ভেতরের শিশুটি আজীবন শিশুই থেকে যাবে। যত ঝড়ঝাঁপটাই আসুক তুমি সহজে ভেঙে পড়বে না। তোমার ঈশ্বর-বিশ্বাস লোকদেখানো নয়, অন্তরের জিনিস। জন্মসূত্রে পাওয়া। তোমার এ বিশ্বাস এসেছে মাতামহের দিক থেকে। জীবন সম্পর্কে আমার নিজের একটা পরিকল্পনা আছে। অনেক মানুষকে আমি ভয় পাই। যারা দেহের ভেতর মানুষের আত্মাটাকে দেখতে পায় না তারা জন্তু। তুমি। আমার পাশে এসে দাঁড়ালে আমরা দুজনে একটা কিছু করতে পারি। চলার পথে মনের মতো। একজন সঙ্গী পেলে পথ যত দুর্গম আর দীর্ঘ হোক না কেন, জানার আগেই ফুরিয়ে যায়। তুমি অবশ্যই আমার এ চিঠির উত্তর দেবে। ঈশ্বরকে যেমন জ্ঞানের পথে ত্যাগের পথে পাওয়া যায়, ভালবাসার পথেও পাওয়া যায়। তা যদি না হবে ঈশ্বর নারী সৃষ্টি করলেন কেন? তোমাকে আমার কিছুই দেবার নেই। তুমি আমার সব নিয়ে বসে আছ। ইতি, মুকু।’

মুকুর চিঠিতে অদ্ভুত এক মাদকতা রয়েছে। সারা শরীর কেমন যেন করে উঠেছে। ভালবাসা খুব। সহজেই মানসিক স্তর থেকে দেহের স্তরে নেমে যেতে চায়। সামান্য একটা চিঠিতেই আমার এই অবস্থা। মুকু কলকাতায় আসবে। শুধু আসবে না। কয়েক বছর থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তখন আমার কী হবে!

আমার মনের ধাঁচটা বেশ বুঝে গেছি। জুয়া খেলার চাকার মতো। হাত ঠেকাবারও প্রয়োজন হয় না। সামান্য ফুঁ দিলেই ঘুরতে থাকে। মুকু খুব খাঁটি কথা বলেছে, নিজেকে বেশি দিন খোলা ফেলে রেখো না। তোমার কথাই ঠিক। সব ফঁকফোকর এইবার ভরাট করব, তবে তোমাকে দিয়ে নয়। এমন কিছু দিয়ে যা বঞ্চনা করে না, শিশিরের মতো যা ভোরের প্রথম সূর্যেই উবে যায় না।

তবু চিঠিটা আমি ছিঁড়ে কুচিকুচি করতে পারলুম না। সাবধানে ড্রয়ারে ভরে রাখলুম মূল্যবান ট্রফির মতো।

শ্রীনাথদার সেলুনের দোল-খাওয়া দরজায় নতুন কাঁচ বসেছে। কাঁচে আবার নকশা খেলছে। গাছের ডাল ধরে শকুন্তলা দাঁড়িয়ে। ভেতরের দেয়ালে নতুন রং পড়েছে। বেশ একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। তেমন ভিড় নেই। একজন মাত্র খদ্দেরের দাড়ি চাচা হচ্ছে। খুব খুঁতখুঁতে মানুষ। থুতনির তলায় হাতের উলটো পিঠ ঘষে বলছেন, এই জায়গাটায় আর একবার মারো কবিরাজ, খড়খড় করছে।

চামড়ার ফিতেতে ক্ষুর ঘষতে ঘষতে শ্রীনাথ বলছেন, দাড়ি উলটোপালটা টানলেই পেকে যায়। এই বয়েসে এত শক্ত দাড়ি করে ফেলেছেন! এরপর তো তরোয়াল দিয়ে কামাতে হবে।

ভদ্রলোক বললেন, আমাদের বংশ একটু কড়াধাতের। মেজাজ কড়া, পায়ে কড়া, দাড়ি কড়া, সব কড়া। তুমি শ্রীনাথদা বকবক না করে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও তো।

শ্রীনাথদা চোখের ইশারায় আমাকে দ্বিতীয় চেয়ারে বসতে বলে, খুনির মতো ক্ষুর হাতে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন। দাড়ি কামাবার সময় শ্রীনাথদার ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে যায়। যেমন অন্যের মুখে খাবার ভরে দিতে গিয়ে অনেকের নিজের মুখ হাঁ হয়ে যায়।

দাড়ি কামানো শেষ হল। ভদ্রলোক ঠ্যাং করে পয়সা ফেলে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমার গায়ে আধময়লা মার্কিনের টুকরো জড়াতে জড়াতে শ্রীনাথদা বললেন, দাড়ি কখনও উলটো টানবে না। টেনেছ কি মরেছ। তারের বুরুশ হয়ে যাবে। জামার কলারটা উলটে ভেতর দিকে খুঁজতে খুঁজতে বললেন, চুল ভীষণ বড় হয়েছে যে গো! তোমার ভীষণ চুলে মাথা। বেশ কবি কালিদাস কবি কালিদাস চেহারা হয়েছে।

মার্কিনের গাঁট বাঁধতে বাঁধতে বললেন, দাঁড়াও, একটু বিড়ি ফোঁকা করে নিই। একটা দাড়ি নামাতে জীবন বেরিয়ে গেল।

বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে শ্রীনাথদা ঘাড়ের কাছে এসে সামনে ঝুঁকে পাউডারের কৌটো তুলে। নিলেন। এতদিনে পাফটা নতুন হয়েছে। পাউডারে ফুলের গন্ধ লেগেছে। দাড়ির চেয়ে চুলে আর পাউডারে দাদার হাত খুব দ্রুত চলে। ঘাড়ের কাছে ঝপাঝপ পাউডারের থুপপি চালাতে চালাতে বললেন, মেয়েছেলেটি তা হলে তোমাদের বাড়িতেই রয়ে গেল?

কাঁধের ওপর দিয়ে সামান্য ঝুঁকে পাউডারের কৌটোটা ঠকাস করে সামনের তাকে রাখলেন। ভদ্রলোকের জামায় বিশ্রী একটা সেলুন-সেলুন গন্ধ। এমন একটা কথা বললেন যা এই গন্ধের চেয়ে দুর্গন্ধময়। মেয়েছেলে শব্দটাই কুৎসিত। হাতদুটো কাপড়ের টুকরোয় জড়ানো। উঁচু চেয়ারে আয়নার তলার তাকে পা পুরে বেকায়দায় আছি তাই, তা না হলে ছিটকে রাস্তায় নেমে যেতুম। ঠান্ডা গম্ভীর গলায় বোকার মতো বললুম, নতুন মেয়েছেলে?

ওই যে গো সেই তবলচির বউটা।

কানের পাশে মুখ রেখে কথা বলছেন। বিড়ির গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে। কত ব্যাপারেই না মানুষের মাথা ঘামে! কে বলেছে, চার দেয়ালে আমাদের সকলের পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষা হয়! দেয়ালের অসংখ্য চোখ, অসংখ্য কান। আমরা হাটের মাঝে জীবন মেলে বসে আছি।

শান্ত গলায় বললুম, কোথায় আর যাবেন? মহিলার কেউ কোথাও নেই।

খুব বেশি বয়েস হবে বলে মনে হয় না! কী ভাগ্য বলো তো?

কথা এইবার নিজের রাস্তা ধরেছে। পারিবারিক কথা পেঁয়াজের মতো। যত ছাড়াবে তত কেচ্ছার গন্ধ বেরোতে থাকবে। শ্রীনাথদার কথায় যে সহানুভূতির আভাস, তা অনেকটা মাছধরা। চারের মতো। কেচ্ছার রুইকাতলা গভীর জল থেকে টোপে ভেড়াতে হলে চার ফেলতে হয়। ভালমানুষ সাজতে হয়, ন্যাকামো করতে হয়। সেলুন এমন একটা জায়গা যেখানে এলেই সমাজের নাড়ি ধরা পড়ে। ভাগ্যিস এসেছিলুম, মাত্র এই কয়েক দিনেই তা হলে অর্কেস্ট্রা শুরু হয়ে গেছে।

ঘাড়ের কাছে কাঁচির খেলা শুরু হয়েছে। সেই আবহসংগীতে শ্রীনাথদার গলা ভাসছে, ওই, তবলচি শুনেছি খুব সুবিধের লোক ছিল না। মামাটা তো খুব পয়সাঅলা লোক?

তা হবে।

সে তো আবার বিয়েথা করেনি?

কে জানে!

আরে আমি সব জানি। লোকটার একটা মেয়েমানুষ আছে। এখন ব্যাবসা-ফ্যাবসা সব লাটে তুলে দিয়ে সেইখানেই পড়ে থাকে।

যে যা করে করুক, তাতে আমাদের কী?

তা ঠিক। তবে কী জানেনা, মানী গুণী লোকের কিছু হলে গায়ে বড় লাগে। কষ্ট হয়।

কার কথা বলছেন?

এই তোমার বাবার কথা।

অ্যাসিড-ট্যাসিড নিয়ে কাজ করতে গেলে ওরকম দুর্ঘটনা যে-কোনও মুহূর্তেই হতে পারে। ভয়ের কিছু নেই।

অ, হরিদার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে বুঝি?

হ্যাঁ, আপনি জানেন না?

শুনছিলুম, কী যেন একটা হয়েছে। পাঁচজনে পাঁচকথা বলছে, কোনটা যে কী বুঝি না বাপু। মাথা-ফাথা খারাপ হয়ে যায়। মেয়েছেলে বড় সাংঘাতিক জিনিস মাইরি! বাঘের মতো। ছুঁলে আঠারো ঘা।

মেয়েছেলে মানে?

ওই যে তবলচির বউ! স্বামীর ঘর তো ভাল করে সাধ মিটিয়ে করতে পারলে না। না পারলে যা হয়, খাইখাই স্বভাব। আর তো সে দিনকাল নেই, ধর্মটর্ম সব আলগা হয়ে গেছে। বিধবাদের আগে কত বাঁধন ছিল! মানুষের মন তো খুব নোংরা! পাঁচজনে পাঁচকথা বললে বড় খারাপ লাগে। তোমাদের পরিবারের একটা সুনাম ছিল।

এখন কি দুর্নাম হচ্ছে?

হলেই হল।

শ্রীনাথদার কাঁচি চলছে ‘হলেই হল’ ছন্দে। মনটা ভীষণ দমে গেল। মানুষ দেখি সব পারে! আমার আদর্শবাদী একরোখা পিতৃদেবের অনেক শত্ৰু, সুযোগ পেলেই বোলতার হুল চালাবে। ছাড়বে না। বিবর্তনের ধারায় জীবচক্রে ঘুরতে ঘুরতে মানুষের আগমন। বাঘের রক্তলোভী স্বভাব মানুষে এসে কুৎসালোভী হয়েছে।

শ্রীনাথদাকে তাড়া লাগালুম, আর বসা যাচ্ছে না, অত মেলামিলি, দশআনা-ছ’আনার প্রয়োজন নেই। একেবারে মুড়িয়ে কদমছাট করে দিন।

দাঁড়া রে বাবা। চুল কাটতে বসে অধৈর্য হলে হয়! বেশি ছোট করলে কামড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। সবকিছুর একটা শো আছে। যে-মুখে যেমন মানায়।

আমি যা বলছি তাই করুন। একেবারে কদমছাঁট।

হ্যাঁ, কদমছাঁট! তুমি বললেই আমি করছি! আরে লোকের কথায় রাগ করতে আছে! চোরের ওপর রাগ করে ভাই ভুয়ে ভাত খেয়ো না। যে যা করার তা করবেই। তুমি চুল বড় রাখলেও করবে, তুমি চুল ছোট রাখলেও করবে। এই যে গজেনবাবু, ছেলের জন্যে পাত্রী দেখতে গিয়ে নিজে বুড়ো বয়েসে বিয়ে করে চলে এলেন। বেশ তো আছেন বাবা! লজ্জা নেই, নিন্দের ভয় নেই। বুক ফুলিয়ে আসা-যাওয়া করেন। ছেলেটা বিবাগী হয়ে সরে পড়ল। বোকামি, বোকামি! তুই গৃহত্যাগ করলি কোন দুঃখে! তোর বাপের চোখের সামনে থেকে বাপকে আরও বেশি শাস্তি দিতে পারতিস। তোকে চোখের সামনে দেখত, আর বুড়োর বিবেকে খোঁচা লাগত। যাকে বউমা বলার কথা, তাকে বউ বলছে! পৃথিবীটা মানুষেই নষ্ট করে দিলে। হরিদাকে আমি চিনি। কোনও ছোট কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয়। যারা অপবাদ রটাচ্ছে, তারা সব ঘেয়ো কুত্তা।

শ্রীনাথদা ক্ষুর দিয়ে ঝুলপি সমান করছেন। কুত্তা বলার সময় উত্তেজনায় হাত কেঁপে গেল। লাগল, ভাগ্য ভাল কাটেনি। আর একবার চারপাশে পাউডার মেরে যখন খরখরে বুরুশ দিয়ে চুল ঝাড়তে লাগলেন, তখন প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়। মনে হচ্ছে ছালচামড়া গুটিয়ে যাবে। মার্কিনের টুকরোটা খুলতে খুলতে বললেন, এ পাড়াটা হল ছোটলোকের পাড়া। একসময় ভাল। ছিল। যত দিন যাচ্ছে…।

কাপড়ের টুকরোটা এত জোরে ঝাড়লেন, বন্দুক ছোঁড়ার মতো শব্দ হল। ধীরে ধীরে রাস্তায় নেমে এলুম। শ্রীনাথদা মোটামুটি লেখাপড়া জানা মানুষ। শুনেছি ম্যাট্রিক পাশ। নানারকম বই। পড়েন। একমাত্র ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। ভদ্রলোক আবার কবিতা লেখেন। একবার দুবার পড়ে শুনিয়েছেন। নেহাত ফেলে দেবার মতো নয়। পাতে দেওয়া চলে। ছেলের পর, পরপর দুটি মেয়ে হয়ে ভদ্রলোককে বড় বেকায়দা করে দিয়েছে। সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চুল দাড়ি, দাড়ি চুল, এই কেবল চলছে।

বাজার একেবারে জমজমাট। সাইকেল, মোটর, ভ্যান, যাচ্ছে আসছে। মিষ্টির দোকানে জিলিপির পাহাড়। গরম শিঙাড়া ভাজার গন্ধ বেরোচ্ছে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রবীণে প্রবীণে কথা হচ্ছে। পাকার খড় নিয়ে ঠ্যালা চলেছে। ওপর দেখে বোঝার উপায় নেই, সমাজের কোথায় পচন ধরেছে।

সারাবাড়িতে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা নেমে এসেছে। মাতামহের মুখের দিকে তাকালেই মনে হয়, প্রদীপের তেল ফুরিয়ে আসছে। এইবার বুকোটা দপ করে জ্বলে উঠবে। কথা বললে মনে হয়, কোন সুদূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর। যেন কোনও পর্বতের ওপার থেকে উঠে আসছে মেঘের মতো, জলভারে সিক্ত। হাসি! আর সে প্রাণ নেই। চোখমুখ সবসময় থমথমে। আমাদের অনেক অব্যবহৃত ঘরের কোনও একটায় মৃত্যু যেন অদৃশ্য অতিথির মতো এসে বসে আছে তার ফোল্ডিং স্ট্রেচার নিয়ে। গভীর রাতে সে আমাদের উত্তরের বারান্দায় ধীর পায়ে চলে বেড়ায়। তালা-আঁটা ঘরের দিকে আমি দিনের বেলায় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। তুমি এসেছ, আমি জানি। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তোমার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে।

পিতৃদেব সেরে উঠছেন। তবে সে মানুষ আর নেই। বিশাল একটা বোঝা নিয়ে চৈত্রের দুপুরে কোনও মানুষ মাইলের পর মাইল হেঁটে এলে মুখচোখের অবস্থা যেরকম হয়, তার মুখের অবস্থাও সেইরকম। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বীতশ্রদ্ধ। বই নিয়ে বসে থাকেন, চোখ চলে যায় সুদূরে। যেন কাউকে খুঁজছেন। এমন কেউ, যে পাশে এসে দাঁড়ালে জীবন আবার সহনীয় হয়ে উঠবে।

মাতামহ আমার চুলের দিকে তাকিয়ে পুরনো দিনের মতো রসিকতা করার চেষ্টা করলেন। এ কী করে এলে, তিরুপতি গিয়েছিলে নাকি? একেবারে কচুকাটা করে এলে। ঘাসহঁটা করে দিয়েছে।

পিতৃদেব একবার মুখ তুলে তাকালেন। কোলের ওপর খবরের কাগজ এলোমেলো। তিনি কোনও মন্তব্যই করলেন না। দু’জন খেয়ালি করিতকর্মা মানুষ আজ কর্মময় জগতের একপাশে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছেন। ইচ্ছে থাকলেও কিছু করার সামর্থ্য নেই। মাতামহ তীর্থে যাবার জন্য ছটফট করছেন। পিতৃদেবের ইচ্ছে ছিল পুত্রবধূকে আনার আগে, এই জরাজীর্ণ বাড়িটাকে ভেঙেচুরে নতুন করবেন। ভেবেছিলেন চারপাশে খুশির ফোয়ারা ছুটবে। সবই বোধহয় ভেস্তে গেল।

কাকিমা চা তৈরি করছেন রান্নাঘরে। শাড়ির রং বদলে সাদা হয়ে গেছে। সাজগোজের আর সে ঘটা নেই। আঁচলে এক থোলো চাবি। পিতৃদেব সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। বিষণ্ণ মন আরও বিষ হয়ে গেছে। যে-ভদ্রলোকের অসাবধানতায় বুকে অ্যাসিড ছিটকে লেগেছে, সেই ভদ্রলোককে ট্রান্সফার করা হয়েছে গাজিপুরে।

কাকিমা মুখ তুলে তাকালেন, চা খাবে?

এক চুমুক।

আজ কিন্তু বাজার করতে হবে।

করব।

দু’জনেই চমকে উঠলুম, নীচে কাশির শব্দ হচ্ছে। দমকা, একটানা। ব্রঙ্কাইটিস বেশ চেপে ধরেছে। এক ফাঁকে শোনা গেল, কই গো কোথায় গেলে?

গলা শুনে দু’জনেরই মুখ শুকিয়ে গেল। সেই আলগা চরিত্রের মামাশ্বশুর। চুলে পমেড, মুখে পাউডার, গায়ে আতর। সর্বনাশ, আবার এসেছেন। কাকিমার হাত থেকে চামচে পড়ে গেল। বাঘের সামনে শিকার যেমন কাঁপতে থাকে, কাকিমা সেইরকম কাঁপছেন। আমাকে বললেন, তাড়াও তাড়াও, যেমন করে পারো তাড়াও।

আমি তাড়াবার কে? ভদ্রলোক বড় চটচটে। ধরলে সহজে ছাড়ানো যায় না।

ভদ্রলোক উত্তর না পেয়ে বললেন, ওপরে বুঝি!

জুতোর মুচমুচ শব্দ উঠোন পেরিয়ে এগিয়ে আসছে। পেছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছেন। উঠে বাঁয়ে বাঁক নিলেই রান্নাঘর। কাকিমা আতঙ্কের গলায় বললেন, বটঠাকুরকে খবর দাও। পেছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।

আসুন না, ভয় করার কী আছে? জোর করে নিয়ে যেতে পারবেন?

না না, ওকে দেখলেই আমার গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। আমাকে টেনে নরকে নামাতে চায়। পিতৃদেব চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে উত্তরের বারান্দায় দাঁড়ালেন। সিঁড়ি ভেঙে ভদ্রলোক উঠে আসছেন ধাপে ধাপে। চেহারা দেখলেই মনে হয় অন্য জীবনের মানুষ। ফোকরে চামচিকি থাকে। এ বাড়ির কোনও ফোকরেও এঁর স্থান হতে পারে না। হাতের আঙুলে আঙুলে লাল, নীল, সবুজ। আংটি। ঠোঁটে এতখানি একটা পাইপে লাগানো সিগারেট। মাথার চারপাশ দিয়ে ফিনফিন করে ধোঁয়া ছুটছে। সাদা পাঞ্জাবির বুকের কাছে ধোঁয়ার পুঁয়ে সাপ লিকলিক করছে।

পিতৃদেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আসুন। সামনেও একটা সিঁড়ি ছিল।

একছিটে কাশি মিশিয়ে বাবু বললেন, যে-কোনও এক দিক দিয়ে এলেই হল। তা আছ কেমন?

ভালই।

ভাল তো থাকবেই। সেবাযত্ন পাচ্ছ!

পিতৃদেবের চোখদুটো জ্বলে উঠল। হাত মুঠো হল। অসীম সংযমে নিজেকে ধরে থাকলেন। হাওয়ার মুখে পেপার ওয়েট চাপা কাগজের মতো। ধীর গলায় বললেন, তা হবে।

আঙুর গেল কোথায়? ঝি-গিরি করছে!

আপনার কি তাই মনে হয়?

মনে হবে কেন, তাই হয়। সুখে থাকতে মানুষকে ভূতে কিলোয়। এখানে ওর পড়ে থাকার রাইটটা কী? কী অধিকারে পড়ে আছে?

প্রশ্ন আমাকে না করে তাকেই করুন।

সে এখন নেশার ঘোরে আছে।

কীসের নেশা?

যৌবনের নেশা।

তার মানে?

মানে বুঝে নাও।

পিতৃদেবের চোখদুটো আবার জ্বলে উঠল। হাত মুঠো হল। আক্রান্তকে রক্ষা করার জন্যে মাতামহ উঠে এলেন। অসুস্থ হলে কী হবে! সেই ছ’ফুট লম্বা, সাত্ত্বিক চেহারা। গায়ের রং টকটক করছে। জীবিত স্তম্ভের মতো পিতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই মুহূর্তে লোকটিকে মনে হচ্ছে ইন্দ্রিয়সেবী মর্কট। ভোগের দুর্ভোগে চোখের কোলদুটো টেপারির মতো ফুলে আছে। মাতামহের এইসব পরিস্থিতি সামলাবার অসীম ক্ষমতা। জোঁকের মুখে নুন ছিটোতে জানেন। সাধনলব্ধ একটা শক্তিও আছে। এখন আমি অবাক হয়ে ভাবি, কাকিমা এই মামাশ্বশুরকে একদিন বলেছিলেন দেবতুল্য মানুষ। সাত ভরি সোনার গহনা গড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন তো হাত পেতে নিতে পেরেছিলেন। রাতের বেলা নির্জনে মামাশ্বশুরের বাতের সেবা করতেন। প্রফুল্লকাকা সন্দেহ করেছিলেন, যে-সন্তানটি এসে নষ্ট হয়ে গেল সেটি কার? মানুষের মন বড় অপবিত্র! সেই কাকিমা এখন মানুষটিকে দেখে গোসাপের সামনে সাপের মতো জড়োসড়ো। মেয়েদের চেনা বড় শক্ত। হতে পারে, এই পরিবারে থাকতে থাকতে কাকিমার রুচি পালটে গেছে।

মাতামহ মানুষের চেহারা দেখে সঙ্গে সঙ্গে একটা নাম উদ্ভাবন করেন। সেই নামেই কথাবার্তা চলতে থাকে। মাতামহ বললেন, এই যে মর্কটানন্দ, সকালেই সেজেগুঁজে হাজির!

ভদ্রলোক থতমত হয়ে গেলেন। সামলে নিয়ে বললেন, আমার পিতৃদত্ত একটা নাম আছে। সেই নামে ডাকলে সুখী হব।

তোমার সব নাড়িনক্ষত্র আমি যে জানি প্রভু, সে নামে তোমাকে ডাকি কী করে! বাপ যদি আদর করে কানা ছেলের নাম রাখে পদ্মলোচন, তাতে কি লোচন পদ্মের মতো হবে!

ভদ্রভাবে কথা বলুন।

নিজে আগে ভদ্র হও। তুমি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলবে, আর আমরা তোমার প্রজার মতো শুনে। যাব, তা তো হয় না মানিক!

পিতা মাতামহের দিকে তাকিয়ে বললেন, অপমান করার অধিকার আমাদের নেই, অপমানিত হবার মতো উদারতা আমাদের আছে। ওই মহিলার সঙ্গে ইনি সম্পর্কিত। একমাত্র আত্মীয়ও বলা চলে। ব্যাবসা করে পয়সা করেছেন। শিক্ষা আর সংস্কৃতি না থাকলে অর্থ মানুষকে একটু অসভ্য করে। ওঁর এই আচরণ আমাদের মেনে নিতেই হবে।

তুমি বলেছ ঠিক। মুখে মেয়েদের মতো কীরকম পাউডার মেখেছে দেখো। যেন যাত্রার দলের মিনসে মাগি!

পিতৃদেব দু’হাতে মাথার দু’পাশ চেপে ধরে বলে উঠলেন, আরে ছি ছি। আপনি ভীষণ ভালগার হয়ে যাচ্ছেন।

রাখো তোমার ভালগার! সারাজীবন আমি অনেক ভাগাড়ে ঘুরেছি। সংসারের ট্র্যাফলগারে সময় সময় ভালগার না হলে, মানুষ বড় পেয়ে বসে।

পিতৃদেব ভদ্রলোককে বললেন, আপনি ঘরে এসে বসুন।

আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভদ্রলোক বললেন, ছেলে তো বেশ বড় হয়েছে, এইবার একটা মেয়ে জুটিয়ে বিয়ে দিয়ে দাও? সব ল্যাঠা চুকে যাক।

অসভ্যের ভাষা দেখো? মেয়ে জুটিয়ে? স্বভাব যাবে কোথায়! চরকা দেখলেই তেল দিতে ইচ্ছে করে।

গা যেন জ্বলে উঠল। একটু ধাক্কা মারা উচিত! পিতা আজ অন্য নীতি শেখাচ্ছেন। একসময় বলতেন, টিট ফর ট্যাট। হঠাৎ বলে ফেললুম, সোনালি খরগোশ কেনা হল সেদিন?

ভদ্রলোক থমকে গেলেন, কী, কী খরগোশ?

যেন কিছুই জানেন না। বললুম, সেই যে হাতিবাগানে? সঙ্গে একজন সুন্দরী মহিলা! মহিলা আপনার হাত ধরে টানলেন। আপনার বয়েস হয়েছে তো। হ্যাঁচকা টানে উলটে পড়ে যাচ্ছিলেন। মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, গায়ে কিস্যু জোর নেই। আপনি তখন মাথার চারপাশে হাত ঘুরিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, মহিলার মাথার নাট বলটু সব ঢিলে। মহিলা মনে হয় আপনার স্ত্রী ছিলেন।

আমি ইচ্ছে করে বয়েস আর স্ত্রী এই দুটো শব্দের ওপর জোর দিলুম।

ধূর্তের চোখে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি? তুমি আমাকে হাতিবাগানে দেখেছ? সঙ্গে সুন্দরী মহিলা? হাসালে বাবা! আমার কি আর সে বয়েস আছে? কাকে দেখতে কাকে দেখেছ? হাতিবাগানে অনেক দাদু-নাতনি দেখা যায়!

মাতামহ শব্দ করে হাসলেন। ছোট্ট একটি কথা বললেন, স্বভাব না যায় মলে, বুঝলে, ইল্লত না। যায় ধুলে!

পিতৃদেব বললেন, নোংরা জল যত ঘোলাবেন ততই ঘুলিয়ে যাবে। আমরা যা জানি, যতটুকু জানি, তার অতিরিক্ত জানার প্রয়োজন নেই।

আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কাকিমাকে ডাকো।

কাকিমা বললেন, এই তিন কাপ চা বাইরের ঘরে নিয়ে যাও। খাওয়া হয়ে গেলে ভাগিয়ে দাও। ভাগনে যখন নেই, ভাগনেবউও তখন নেই। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঘাড়ধাক্কা। ওসব মানুষের আমি পরোয়া করি না। যখন ও বেঁচে ছিল তখন অনেক মিথ্যে বলেছি, অশান্তির ভয়ে। বুড়োর ভাগ্য ভাল যে ভাগনের হাতে খুন হয়নি।

কাকিমা হঠাৎ কীরকম বদলে গেছেন! সেই মৃদু ভীরু স্বভাব আর নেই। তিন কাপ চা ট্রে-র ওপর তুলে লগবগ লগবগ করতে করতে বাইরের ঘরে এলুম। পিতা স্বহস্তে কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, নিন, চা খান।

আমি বললুম, কাকিমা দেখা করতে রাজি হচ্ছেন না।

মাতামহ বললেন? হরিশঙ্কর, আমি কিছু বলতে পারি? তোমার অনুমতি ছাড়া কিছু বলব না।

কী আর বলবেন, ব্যাপার খুব জটিল।

এর মানে কী জানো, সেই পুরনো প্রবাদ, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস…

ব্যস, ব্যস, আর না, আর এগোবেন না।

মাতামহ অন্য পথে ঘুরে গেলেন। ভদ্রলোককে প্রশ্ন করলেন, তুমি কীরকম মামাশ্বশুর হে, ভাগনেবউ দেখাই করতে চাইছে না!

আপনারা ওর মাথাটা খেয়ে দিয়েছেন। স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্ন। জানে না, রক্ষিতার বেশি সম্মান ও এখানে পাবে না।

কী বললে?

মাতামহ আসন ছেড়ে ছিটকে উঠলেন। চোখমুখ জবাফুলের মতো লাল। ছ’ফুট লম্বা মানুষ খাড়া দাঁড়িয়ে আছেন চাবুকের মতো। যতই শরীর অসুস্থ হোক, যৌবনের ব্যায়াম আর কুস্তির চিহ্ন শরীরে এখনও লেগে আছে। হুংকার ছাড়লেন আর একবার, কী বললে তুমি?

পিতৃদেব উঠে দাঁড়িয়েছেন। মাতামহকে আগলাতে চান। ভদ্রলোক মিনমিনে গলায় বললেন, মারবেন নাকি?

মাতামহ বললেন, তোমার মতো ছুঁচোর গায়ে আমার হাত দিতে ঘেন্না করছে। স্রেফ দু’আঙুলে ঘাড়টি ধরব, আর বেড়ালছানার মতো তুলে বাইরের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসব।

মাতামহ সত্যিই এগোচ্ছিলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বুকের কাছে দাঁড়ালুম। জানি আমাকে ঠেলে এগোতে পারবেন না। শক্তি দিয়ে আটকাতে পারব না। আমার সে ক্ষমতা নেই। স্নেহের দাবিতে এই সাধক মানুষটিকে হয়তো ঠেকানো যাবে। বিশ্রী একটা পরিণতিকে কোনওক্রমে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

ইন্দ্রিয়সেবী মদ্যপ মানুষটি ভয় পেলেও অর্থের অহংকারে যুঝে যাচ্ছেন। কাঁপাকাঁপা হাতে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমাকে তা হলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে!

মাতামহ বললেন, তোমার আইনের মুখে আমি প্রস্রাব করি।

পেচ্ছাপই বলতেন। এত ক্রোধেও পিতার কথা ভোলেননি, শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করলেন। চাবির থোলোর শব্দে দরজার দিকে তাকালাম। কাকিমা ঘরে এলেন। এমন দৃপ্ত ভঙ্গি আগে কখনও দেখিনি। ঘরে ঢুকেই বললেন, আপনার আইন আমাদের কাঁচকলা করবে। আপনার স্বভাবচরিত্রের কথা একবার বলব এঁদের সামনে? আশ্রয় দিয়ে, টাকার লোভ দেখিয়ে কী করেছিলেন? বলব সব কথা এক এক করে! চলুন থানায়, এখুনি চলুন, আমি জানি, নিজের সুবিধের জন্যে আপনিই ভাগনেকে খুন করিয়েছেন। টাকার জোরে মানুষ সব করতে পারে। চলুন থানায়।

কাকিমা কোমরে আঁচল জড়িয়ে রণরঙ্গিণী মূর্তিতে সামনের দিকে এগোতে লাগলেন। ভদ্রলোক সিগারেট টানতে ভুলে গেছেন। মিউ মিউ করছেন, এ তুমি কী বলছ? ভাত ছড়ালে কাকের অভাব? এ তুমি কী বলছ?

সদরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। দরজা বন্ধ করার বোদা শব্দ। সামনের সিঁড়িতে জুতোর আওয়াজ।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন