১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম লিখিতেছে বৃদ্ধ মহাকাল
বিশ্বপত্রে জীবের ক্ষণিক ইতিহাস

শেষ বাস চলে গেছে। অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, হাঁটতে পারবে পিন্টু?

খুব পারব, কাকাবাবু।

সবে সাবালক হয়েছি, ধরা তো আমার কাছে এখন সরা বিশেষ। পারলে বিশ্বটাকে অ্যাটলাসের মতো বুকে চেপে ধরে, তার ঘোরাটাও বন্ধ করে দিতে পারি।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে পা চালাও। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাব। হরিদা ভীষণ ছটফট করছেন। আমি দেখতে পাচ্ছি, তিনি একবার করে ঘরে ঢুকছেন, একবার করে বারান্দায় বেরিয়ে আসছেন।

প্রায়-নির্জন রাস্তায় দু’জনে হনহন করে হাঁটতে লাগলুম। কাকা ভাইপোতে যেন ওয়াকিং : কম্পিটিশন হচ্ছে। আমি হাঁটছি সামান্য সামনে ঝুঁকে, কাকাবাবু হাঁটছেন খাড়া সোজা হয়ে, অনেকটা নেচে নেচে। দম ফুরিয়ে যাবে বলে আমরা কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলছি না। সামনে পড়ে আছে। ট্রামলাইন। লকলক করে চলে গেছে দূর থেকে দূরে। অনেকটা মানুষের লাভের মতো, মানুষের আকাঙ্ক্ষার মতো।

রাস্তা ক্রমশই পেছিয়ে পড়ছে। একটু আগে কারা বোধহয় শ্মশানের দিকে মৃতদেহ নিয়ে গেছে। কালো পিচের রাস্তায় সাদা সাদা খই ছড়িয়ে আছে। বাতাসে উড়ে উড়ে যাচ্ছে এপাশ থেকে ওপাশে। চলে-যাওয়া মানুষের ফেলে-যাওয়া অসংখ্য দিনের মতো। ওড়া খই দেখে আবার সেই মর্গের কথা মনে পড়ল। সাধুবাবু এক একটা ট্রে টানছেন, এক একটি মৃতদেহ বেরিয়ে পড়ছে। বিভিন্ন বয়েস, বিভিন্ন আকৃতি। মুখে লেগে থাকা বিভিন্ন প্রকারের মৃত্যুযন্ত্রণার চিহ্ন। কেউ মরেছেন আতঙ্ক নিয়ে, কেউ গেছেন বিষণ্ণতা নিয়ে, কেউ যেন হাসিমুখে মায়ের কোলে উঠে গেছেন। আমি ঠিকই দেখেছি। ও মৃতদেহ প্রফুল্লকাকা ছাড়া আর কারুর নয়। আর কারুর হলে কাকিমার দুঃখের ষোলোকলা পূর্ণ হবে কী করে! সেই মারনেওলা ভগবান বসে আছেন কোন ওপরে। অসংখ্য তারার চোখে সৃষ্টিকে দেখছেন, ঝুলিয়ে দিচ্ছেন ফরমান, একে মারো, ওকে আধমরা করে রাখো। একে হাসাও ওকে কাঁদাও।

চলতে চলতে কী করতে চাই, পরিকল্পনা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। অভিশপ্ত বাড়ি। কোনও সন্দেহই নেই। যে আসে সেই ভোগে। একটানা-একটা কিছু তাকে দিতেই হবে। হয় নিজেকে, না হয় নিজের কোনও আপনজনকে। অদৃশ্য মহাকাল সিংহাসনে বসে আছেন। রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম লিখিতেছে বৃদ্ধ মহাকাল বিশ্বপত্রে জীবের ক্ষণিক ইতিহাস। হত্যা অরণ্যের মাঝে, হত্যা লোকালয়ে, হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে, কীটের গহ্বরে, অগাধ সাগরজলে, নির্মল আকাশে, হত্যা জীবিকার তরে, হত্যা খেলাচ্ছলে, হত্যা অকারণে, হত্যা অনিচ্ছার বশে, চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তাড়নে, ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণপণে, ব্যাঘ্রের আক্রমণে, মৃগসম মুহূর্ত দাঁড়াতে নাহি পারে। মহাকালী কালস্বরূপিণী, রয়েছেন দাঁড়াইয়া তৃতীক্ষ লোলজিহ্বা মেলি, বিশ্বের চৌদিক বেয়ে চির রক্তধারা, ফেটে পড়িতেছে, নিষ্পেষিত দ্রাক্ষা হতে রসের মতন, অনন্ত খৰ্পরে তাঁর। এই মহাকালকে ফাঁকি দিতে হবে। প্লটের যেমন কাউন্টার-প্লট। এসপিয়নেজের যেমন কাউন্টার-এসপিয়নেজ। কাকিমাকে কিছুই। বলা চলবে না। ইচ্ছে করেই বলব না। একজন মানুষ যদি না ফেরেন, তা হলে তার জন্যে চোদ্দো বছর অপেক্ষার বিধান আছে শাস্ত্রে। যা হবার হবে তার পর। চোদ্দো বছর দীর্ঘ সময়। এই সময়টুকু কাকিমা অপেক্ষায় অপেক্ষায় কাটিয়ে দিন। বৈধব্য স্পর্শ করবে না। একটা উদ্বেগ থাকবে, ক্রমশই শূন্যতা সহনীয় হয়ে উঠবে। শোক আর কাবু করতে পারবে না। ভরণপোষণ? একজন মানুষের দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না! খুব পারব। পিতাপুত্রের রোজগারে হেসেখেলে চলে যাবে।

আমি লক্ষ করিনি। অক্ষয় কাকাবাবুর নজরে পড়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো নেমে এসেছে। নীচে। রাতের দিকে পৃথিবীটা কেমন যেন ধোঁয়াধোয়া হয়ে ওঠে। মিলটনের নরকের মতো। সেই আলোকিত ধোঁয়ার বৃত্তে, দু’পাশে দু’হাত ছড়িয়ে একজন মানুষ ভূমিকম্পের জমিতে গোল হয়ে ঘুরছেন। মাঝে মাঝে উলটে পড়ে যাবার মতো হচ্ছে।

কাকাবাবু এগিয়ে গেলেন। দোসর আমি পেছনে। কাছে গিয়ে শুনতে পেলুম, লোকটি অস্পষ্ট জড়ানো গলায় বলছেন, শালা কোন দিকে, উত্তরে, দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে? বল, শালা কোন দিকে?

কাকাবাবু লোকটিকে ধরে ফেললেন। চড়া গলায় বললেন, কী কোন দিকে?

এই যে বাওয়া বিবেক, আমার বাড়িটা কোন দিকে? আমার সেই সাতমহলা মার্বেল প্যালেস।

কাকাবাবু পশ্চিম দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, এই দিকে।

লোকটি মেয়েলি গলায় বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ব্যাটা হনুমান।

ডাইনে বাঁয়ে, ফাঁক ফাঁক পা ফেলতে ফেলতে লোকটি কঁচি সিগারেটের মতো অন্ধকারে চলতে লাগলেন। অনিশ্চিত যাত্রা। জড়ানো গলায় টপ্পার সুরে গান ধরেছেন, বিধুমুখী, তোমায় সাজাব যতনে, মাইরি বলছি, সাজাব যতনে।

উনি কোথায় চললেন কাকাবাবু?

থানার দিকে। মুখটা সেইদিকেই ঘুরিয়ে দিলুম। তবু প্রাণে বাঁচুক। এরপর তো গুন্ডার হাতে পড়বে। নয়তো মাতাল ড্রাইভারের চাকার তলায়। লোকটার হাতে গোটা তিনেক আংটি রয়েছে। খুব টেনেছে, বুঝলে।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

রাত বড় মজার সময়, পিন্টু। দিনের বাঁধন আলগা হয়ে পড়ে। নাও নাও, পা চালাও! কুইক মার্চ। তোমার তো এসে গেল, আমাকে এখনও কত দূর যেতে হবে জানো! বালির ব্রিজটা কী হয়ে আছে। একবার চিন্তা করো, রাতের আতঙ্ক। পারবে তুমি এখন ওই ব্রিজের ওপর দিয়ে একা একা যেতে?

আজ্ঞে না।

কী তুমি পুরুষমানুষ হয়েছ? ভয়কে জয় করো। তা না হলে জীবনের কাছ থেকে কিছুই পাবে না। সে কী দৃশ্য, ভাবতে পারো! বহু নীচে গঙ্গা বয়ে চলেছে। চারপাশ অন্ধকার। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। রেল কোয়ার্টারের বাড়ি। একের পর এক ব্রিজের আর্চ চলে গেছে এপার থেকে ওপারে। সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে পড়ে আছে একজোড়া রেললাইন। পারবে না তুমি?

আজ্ঞে না। আমি ভীষণ ভিতু। এমনিই আমি রাতকে ভীষণ ভয় পাই, তার ওপর আছে ভূতের ভয়, বদমাইশ লোকের ভয়, এমনকী ভগবানকেও আমি ভয় পাই। জ্যোতির্ময় মূর্তি ধরে সামনে এসে তিনি যদি দাঁড়ান আমার দাতে দাঁত লেগে যাবে।

নাঃ, তোমার যে কী হবে!

আপনি তো আমার হাত দেখেছেন। অনেক কথাই বলেছেন, অনেক কথাই চেপে গেছেন।

চেপে গেছি, কী করে বুঝলে?

আমি জানি। এমন কিছু বলার আছে, যা বাবার সামনে বলা যায় না।

ধরেছ ঠিক। তোমার হাতটা বড় অদ্ভুত। এক দিকে প্রচণ্ড ভোগী, অন্য দিকে সাংঘাতিক ত্যাগী। একই সঙ্গে জ্ঞানী, আবার নির্বোধ। একই আধারে বসে আছে শিশু আর পণ্ডিত। কখনও জ্ঞানীর মতো কথা বলবে, কখনও নির্বোধের মতো। একই সঙ্গে লম্পট ও সন্ন্যাসী। অনেকটা চন্দ্রের মতো। পনেরো দিন অন্ধকারে, পনেরো দিন আলোয়!

বাবা, এ তো দেখছি সাংঘাতিক হাত। বিপজ্জনক চরিত্র।

তোমার জীবন সম্পর্কে আমার নিজেরই ভীষণ কৌতূহল। দূর থেকে তোমাকে দেখে যাব। আমি আছি। প্রায় পঁচানব্বই বছর থাকব। তুমিও থাকবে, তোমার আয়ু নেহাত কম নয়। জোর করে কিছু করতে যেয়ো না। দৈবশক্তির ওপর নিজেকে ছেড়ে দাও। দেখো না কী হয়।

সেটা কি ঠিক হবে?

আরে সেইটাই তো মজা! এই সন্ন্যাসী, এই প্রেমিক। কখনও গুহায়, কখনও প্রমোদকাননে। কখনও বৃদ্ধ, কখনও কৃষ্ণ। একটা কথা আমি স্ট্যাম্প পেপারে লিখে দিতে পারি, মেয়েরা তোমাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে। সব বয়েসের মেয়েরা।

বাঁচার উপায়?

মৃত্যু।

রাত কাঁপিয়ে রাস্তা কাঁপিয়ে অক্ষয় কাকাবাবু হেসে উঠলেন। পথের ধারের একটা দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে এক বৃদ্ধা আকুল গলায় বললেন, কে যায়, জীবন নাকি?

অনেকটা ভেতর থেকে পুরুষালি গলায় ধমক ভেসে এল, আঃ, চুপ করে শুয়ে থাকো। ঘুমোতে পারছ না?

বৃদ্ধা টেনে টেনে বললেন, আঃ, মধুসূদন!

অন্ধকারে ভাল দেখা যাচ্ছে না। বারান্দায় সারি সারি অর্কিডের টব ঝুলছে। সাদামতো কী একটা রেলিং-এর পাশে জবুথবু হয়ে রয়েছে। অক্ষয় কাকাবাবু তাড়া লাগালেন, পা চালাও, পা চালাও।

মোড়ের মাথায় বেশ বড়সড় একটা পানবিড়ির দোকান রাতকে মাত করে রেখেছে। বিশাল আয়নায় আলো মুখ দেখছে। পেতলের পান-সিংহাসন ঝকঝক করছে। কোলে কুলো নিয়ে পাশাপাশি তিনটি লোক দুলে দুলে বিড়ি বাঁধছে। একটা হাঙড়ায় রেডিয়োয় দূরের কোনও কেন্দ্র বাজছে। শব্দ মাঝে মাঝে ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। থেকে থেকে চোঁচা, কেঁকা আওয়াজ হচ্ছে। দোকানের সামনের বেঞ্চে গুন্ডা-গুন্ডা চেহারার দু’জন লোক বসে আছে। মনে হয়, সাদা পোশাকের পুলিশ। পাশেই অন্ধকারমতো একটা বাড়ির দোরগোড়ায় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে।

আরও কিছু দূর এসে একজন বৃদ্ধ পথিককে পাওয়া গেল। সামনে শরীর ভেঙে লাঠি ঠুকঠুক করে টুকটুক করে চলেছেন। হাঁটার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, গন্তব্য পৃথিবীর শেষ প্রান্ত। রাত চলেছে, মানুষ চলেছে। আমাদের দেখে বৃদ্ধ বললেন, বাবুমশায়, একটা বিড়ি হবে?

কাকাবাবু বললেন, না।

নস্য?

না।

এক আনা পয়সা?

পকেট থেকে একটা আনি বের করে বৃদ্ধের হাতে ধরিয়ে দিলুম। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, যাবে কোথায়?

বৃদ্ধ বললেন, দেখি, কোথায় যাওয়া যায়।

বৃদ্ধ যেন ছদ্মবেশী ভগবান। পৃথিবীর হালচাল দেখতে বেরিয়েছেন।

বাঁ পাশের অন্ধকার একটা গলিতে, গোটা তিনেক বিড়ির আগুন জ্বলছে আর নিবছে। অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, পা চালাও, পা চালাও।

উলঙ্গ এক পাগলি আঁস্তাকুড়ে ময়লা ঘাঁটছে। কিছু দূরে একটা কুকুর প্রতিবাদে গড়গড় করছে। উত্তর আকাশে পাঞ্জা মাপের একটা তারা ধকধক করছে।

আমাদের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ হলেও, ভেতরে আলোর খেলা চলেছে। শুধু পিতা নয়, সকলেই মনে হয় আমাদের অপেক্ষায় জেগে বসে আছেন। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিলেন কাকিমা। মাথায় ঘোমটা ছিল না। সন্ধের দিকে তেল দিয়ে চুল বেঁধেছেন। আলো পড়ে খোঁপা চকচক করছে। কপালে সিঁদুরের টিপের অরুণোদয়। কাকাবাবুকে দেখে তাড়াতাড়ি মাথার ঘোমটা টানলেন। একপাশে সরে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, এত দেরি হল?

আমার প্রথম প্রশ্নই হল, কাকাবাবু আসেননি?

কাকিমা বললেন, দাঁড়াও, কোথাও গেলে, অত সহজে কি আসবেন? সব শেষ করে, অরুচি ধরিয়ে আসবেন।

সিঁড়ির মাথা থেকে পিতার গলা ভেসে এল, কী? ফিরেছ?

আমরা তিনজনে একসঙ্গে উত্তর দিলুম, আজ্ঞে হ্যাঁ।

অক্ষয় কাকাবাবু ওপরে উঠতে লাগলেন।

কাকিমা আমার হাত টেনে ধরে বললেন, তোমরা চলে যাবার পর খুব বিপদ হয়েছে।

বুকটা ধক করে উঠল, কী বিপদ?

মুকু পড়ে গেছে।

কোথায়?

নীচের সিঁড়িতে। কপাল ঘেঁতো হয়ে গেছে।

সেকী?

কাকিমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। যেন চাঁদের কপালে সূর্য উঠেছে।

ওপরে উঠে বোঝা গেল পিতৃদেব এতক্ষণ অশান্ত পায়ে পায়চারি করছিলেন। কেমন যেন উদভ্রান্তের মতো চেহারা। সারাঘরে একটা আয়োডিন-আয়োডিন, বেনজিন-বেনজিন গন্ধ বেরোচ্ছে। মুকু আমাদের বিছানাতেই চিত হয়ে শুয়ে আছে। কপালে একটা ব্যান্ডেজ।

পিতা ফিসফিস করে অক্ষয় কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী? দেখলে?

অক্ষয় কাকাবাবু চাপা গলায় বললেন, না।

থ্যাঙ্ক গড। কী হল কী? এ তো দেখছি বিপদের ওপর বিপদ।

আর বোলো না। খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। একে মেয়েছেলে। কপালটা না দাগরাজি হয়ে যায়। বিয়ে দিতে হবে তো!

অনেকটা গেছে!

ভাগ্য ভাল। স্টিচ পড়েনি। ডাক্তারবাবু বলে গেলেন, তেমন কোনও ভয় নেই।

হরিদা, আমি তা হলে চলি।

পাগল নাকি! এই রাতে তুমি যাবে কোথায়! তুমি আজ এইখানে থাকবে। কাল সকালে আমার সঙ্গে অফিস যাবে।

আমি থেকে যেতে পারি, কিন্তু আপনাদের যদি কোনও অসুবিধে হয়।

আমাদের অসুবিধে। তুমি হাসালে অক্ষয়।

কাকিমা অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, বললেন, আমি আপনার জন্যে খাবার তৈরি করেছি।

পিতা বললেন, তুমি এত বড় একটা খবর আনলে, এইসব ছোটখাটো দুর্ঘটনা না থাকলে, আজ তো আনন্দের দিন।

কী যে আনন্দের দিন সে তো আমি জানি। যে-দুঃসংবাদ আমি চেপে রেখেছি, তা যদি কোনওরকমে একবার প্রকাশ পায়, এই বাড়ি কেঁপে যাবে। কী যে হবে আমার জানা নেই।

কাকিমা বললেন, আপনারা তৈরি হয়ে নিন, খাবার জোগাড় করি। এরপর খেলে শরীর খারাপ হবে।

পিতা বললেন, আমার জন্যে খুব সামান্য। অনেক বেলায় খেয়েছি। এবেলা না খেলেই ভাল হয়।

কাকিমা বললেন, মশারিটা ফেলে দিই। মেয়েটা ঘুমোচ্ছ। ওকে আর না জাগানোই ভাল। এখানেই ঘুমোক। আপনাদের আমি আলাদা বিছানা করে দিই।

হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভাল। বিনয়দাকে আজ আর নতুন কোনও চিন্তায় না ফেলাই ভাল। সন্ধের থেকে ভদ্রলোক আরামে ঘুমোচ্ছেন। ঘুমই ওনার ওষুধ।

কাকিমা আমার পিঠে টোকা মেরে আড়ালে ডাকলেন।

তোমার কী হয়েছে গো!

কই কিছুই তো হয়নি।

তা হলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

এতটা পথ হেঁটে এলুম না! বাসট্রাম সব বন্ধ হয়ে গেছে না!

তুমি হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় ছেড়ে নাও।

এই তো নিচ্ছি।

অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, আমি চান করব।

এত রাতে তুমি চান করবে অক্ষয়!

আপনি তো জানেন, সারাদিন আমি বারেবারে চান করি। আমার গরম একটু বেশি।

যাও, তা হলে ঝট করে সেরে নাও।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সারাবাড়ি গাওয়া ঘিয়ের গন্ধে আমোদিত হয়ে উঠল। গভীর রাতে এমন ভোজনের আয়োজন একমাত্র এই ভুতুড়ে বাড়িতেই সম্ভব। এ বাড়ির প্রতিটি ইট ইতিহাসের সাক্ষী। কত ঘটনাই দেখেছে! আরও কত ঘটনা দেখবে।

রান্নাঘরে মধুর এক নাটক চলেছে। কাকিমার বাধা শোনেননি পিতা। বসে গেছেন লুচি বেলতে। এক হাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে, দু’হাত চাই। এসব কাজে তিনি সিদ্ধহস্ত। রাতের আকাশ দেখে মনে হচ্ছে, একটু পরেই পাখি ডেকে উঠবে।

হলঘরে পরপর তিনটে বিছানা পড়েছে। অক্ষয় কাকাবাবু চিত হয়ে বুকের ওপর হাত জড়ো করে শুয়েছেন। পিতাপুত্রে জেগে শুয়ে আছি। সহজে কি ঘুম আসে!

পিতা বললেন, একেই বলে সাধকের ঘুম। শুল আর ঘুমোল। তোমার কাকিমার আজ খুব ধকল গেল। ও ঘরে মুকুর মাথার কাছে হয়তো ঠায় জেগে বসে আছে। বিছানা বেশ বড় আছে, দু’জনের বিছানা। তুমি গিয়ে বলে এসো, পাশে শুয়ে পড়তে। না বললে হয়তো ওই মাটিতেই পড়ে থাকবে। শেষরাতে মশা বাড়ে। ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। মায়ের জাত, ওদের কথাও একটু ভাববে। স্বার্থপর হলে চলে না।

মুকুর মাথার কাছে একটা চেয়ারে কাকিমা বসে আছেন। মাথাটা পাশে হেলে পড়েছে। হাতদুটো দু’পাশে এলিয়ে আছে। সারাঘরে বিনবিন করছে মশা। এত ক্লান্তি, মশকদংশনেও সাড় নেই। এত অসহায়! প্রাণটা কেমন যেন করে ওঠে। এ দেশের মহিলাদের জীবনের যেন কোনও ছিরিছাদ নেই। ভাগ্যনির্ভর। হাসালে হাসি, কাদালে কান্না।

কাকিমার গায়ে হাত রাখতেই চমকে উঠলেন। ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসলেন। চোখেমুখে ঘুম জড়িয়ে আছে।

তুমি ঘুমোওনি পিন্টু?

আর ঘুমিয়ে কী হবে? একটু পরেই ভোর। বাবা আপনাকে মুকুর পাশে শুতে বললেন।

ইস ছি ছি, উনি আমাকে এই অবস্থায় দেখে গেলেন!

উনি এ ঘরে আসেননি। আমাকে পাঠালেন। নিন শুয়ে পড়ুন। মশা ঘেঁকে ধরেছে।

ছি ছি, গুরুজনদের বিছানায় শোয়া যায়।

খুব যায়। গুরুজন অনুমতি দিলে সব করা যায়।

আমি বেশ আছি গো। এসব আমার অভ্যাস আছে। কত রাতে তোমার কাকা ঘাড় ধরে ঘরের। বাইরে বের করে দিয়ে, দরজা দিয়ে দিয়েছে। দরজায় পিঠ রেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছি। ভোরবেলা দরজা খুলতেই উলটে পড়ে গেছি। কত দুঃখের রাত পার করেছি পিন্টু, এ তো সুখের রাত!

মুকু কেমন একটা শব্দ করল। কাকিমা মশারিতে মাথা ঠেকিয়ে দেখলেন। মুকু আর কোনও শব্দ করল না। স্থির হয়ে গেল।

আচ্ছা কাকিমা, কাকাবাবু যদি হঠাৎ আপনাকে ছেড়ে চলে যান, আপনার খুব দুঃখ হবে?

ছেড়ে যাবে কেন? বিয়ে করা বউকে কেউ ছাড়তে পারে! পুরুষমানুষ একটু এদিক-সেদিক করে, কিন্তু শেষে সেই বউ। বউ ছাড়া সেবা পাবে কোথায়? ভালবাসবে কে? ও চলে গেলে আমাকে তো গলায় দড়ি দিতে হবে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমি, কে দেখবে আমাকে! তোমার কাকার সব ভাল, কেবল একটু গোঁয়ার। পেটে দু’কলম থাকলে অমন স্বভাব হত কি! হত না। তা আমারই বা কী ছিল, যে শিক্ষিত ছেলে বিয়ে করবে! ও নিয়ে দুঃখু করলে চলে! ভাগ্যকে মেনে নিতে হয়।

নিন, আপনি শুয়ে পড়ুন। সারাদিন অনেক খেটেছেন। আপনাকে শোয়াতে না পারলে, বাবা আমাকে বকবেন।

আমার কেমন লাগছে পিন্টু!

ওসব লাগালাগি পরে হবে। আগে উঠুন তো।

হাত ধরে টেনে তুলে দিলুম। কাকিমা উঠে দাঁড়ালেন। শুধু শরীর নয়, বেশবাসেও ঘুম লেগেছে। কাকিমা বললেন, তোকে আমার এত ভাল লাগে কেন বল তো! আর জন্মে তুই আমার কেউ ছিলিস, এ জন্মে আবার ফিরে পেয়েছি।

হাত দিয়ে আমার মাথার চুল সরিয়ে দিলেন। মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, বউ হলে পর করে দিবি না তো!

আমি বিয়েই করব না।

যে-ফাঁদে পড়েছিস, বিয়ে না করে পারবি! মেয়েটা ভারী সুন্দর রে, তেমনি স্বভাব। হবে না, কত বড় ঘরের মেয়ে। বটঠাকুরকে বলব, সামনের মাঘেই লাগিয়ে দিন।

নিন তো, মশারিতে ঢুকুন।

আমার সোনা ছেলে।

কাকিমা গাল ধরে নেড়ে দিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে মশারিতে ঢুকে গেলেন।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ যাত্রা শুরু
২. ১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
৩. ১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
৪. ১.০৪ Nothing begins and nothing ends
৫. ১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
৬. ১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
৭. ১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
৮. ১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
৯. ১.০৯ Dark idolatry of self
১০. ১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
১১. ১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
১২. ১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
১৩. ১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
১৪. ১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
১৫. ১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
১৬. ১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
১৭. ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
১৮. ১.১৮ My good blade carves the casques of men
১৯. ১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট
২০. ১.২০ যেমন কর্ম তেমন ফল, মশা মারতে গালে চড়
২১. ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়
২২. ১.২২ যে হও সে হও প্রভু
২৩. ১.২৩ গোদা রোটি খাও হরিকে গুণ গাও
২৪. ১.২৪ তুমি নাহি দিলে দেখা
২৫. ১.২৫ লে হুঁ মকতব-এ গম-এ দিল-মে সবক হুনূজ্‌
২৬. ১.২৬ Death dances like a fire-fly
২৭. ১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
২৮. ১.২৮ তুই নেই বলে ওরে উন্মাদ
২৯. ১.২৯ আমি দেহ বেচে ভবের হাটে
৩০. ১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
৩১. ১.৩১ জানি না কে বা, এসেছি কোথায়
৩২. ১.৩২ ওই দেখা যায় বাড়ি আমার
৩৩. ১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
৩৪. ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন
৩৫. ১.৩৫ ছাঁচিপান দিয়ে ঠোঁটেরে রাঙালে
৩৬. ১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
৩৭. ১.৩৭ লাখোঁ সুনন্দার সপ্‌নোভিতে
৩৮. ১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
৩৯. ১.৩৯ রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম
৪০. ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৪১. ১.৪১ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
৪২. ১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
৪৩. ১.৪৩ নিরাসক্ত ভালবাসা আপন দাক্ষিণ্য হতে
৪৪. ১.৪৪ খেলার খেয়াল বশে কাগজের তরী
৪৫. ১.৪৫ Lead us not into temptation
৪৬. ১.৪৬ The hour has come
৪৭. ১.৪৭ তিনটে কাছি কাছাকাছি যুক্ত
৪৮. ১.৪৮ I may load and unload
৪৯. ১.৪৯ সামনে যখন যাবি ওরে
৫০. ১.৫০ The road of excess
৫১. ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়
৫২. ১.৫২ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
৫৩. ১.৫৩ দিয়েছিলে জ্যোৎস্না তুমি
৫৪. ১.৫৪ About, about, in reel and rout
৫৫. ১.৫৫ হেসে নাও এ দুদিন বই তো নয়
৫৬. ১.৫৬ সুখের কথা বোলো না আর
৫৭. ১.৫৭ আব ইয়ে সমঝ্‌মে জফরকি আয়া
৫৮. ১.৫৮ In the great crisis of life
৫৯. ১.৫৯ মনে করি এইখানে শেষ
৬০. ১.৬০ There is no path in the sky
৬১. ১.৬১ One life, one death, one heaven
৬২. ১.৬২ I shall go to her
৬৩. ১.৬৩ I could give all to time
৬৪. ১.৬৪ ফলপাকা বেলী ততী
৬৫. ১.৬৫ সামনে যখন যাবি ওরে
৬৬. ১.৬৬ নিত নাহানসে হরি মিলে তো
৬৭. ১.৬৭ হে অন্তরযামী ত্রাহি
৬৮. ১.৬৮ যে সুরে বাজাই বেসুর লাগে
৬৯. ১.৬৯ সমুখ দিয়ে স্বপনসম
৭০. ১.৭০ Tell me in what part of the wood
৭১. ১.৭১ I am no prophet
৭২. ১.৭২ যে কথা ফোটে না গানে
৭৩. ১.৭৩ দুয়ার খুলে থাকি বসে
৭৪. ২.০১ Does the road wind up-hill all the way?
৭৫. ২.০২ Good night? ah! no, the hour is ill
৭৬. ২.০৩ Love means never having to say you are sorry
৭৭. ২.০৪ What if the Universe wears a mask?
৭৮. ২.০৫ Happiness is beneficial for the body
৭৯. ২.০৬ একদিন কুম্ভকার-গৃহ-পার্শ্ব দিয়া
৮০. ২.০৭ প্রেমের হাতে ধরা দেব
৮১. ২.০৮ রক্ষা করো হে
৮২. ২.০৯ কি সুন্দর–কি মহান–উদ্বেগে দাপটে
৮৩. ২.১০ I do none of the things I promised I would
৮৪. ২.১১ As certain as stars at night.
৮৫. ২.১২ মা গো অত আদর
৮৬. ২.১৩ ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলাম
৮৭. ২.১৪ The man that runs away
৮৮. ২.১৫ There are only three things
৮৯. ২.১৬ We’re always too much out or too much in
৯০. ২.১৭ As face reflects face in water
৯১. ২.১৮ If one calls you a donkey
৯২. ২.১৯ Come let us ask life
৯৩. ২.২০ One learns to know oneself best
৯৪. ২.২১ সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
৯৫. ২.২২ ভীষণ তৃষ্ণার্ত আমি
৯৬. ২.২৩ If your only tool is a hammer
৯৭. ২.২৪ Who can go out without using the door
৯৮. ২.২৫ Life is like an Onion
৯৯. ২.২৬ অন্তরে লভেছি সত্য, ভ্রমণের ফলে
১০০. ২.২৭ The man that runs away
১০১. ২.২৮ Like a sword that cuts
১০২. ২.২৯ Still nursing the unconquerable hope
১০৩. ২.৩০ What a great happiness not to be me
১০৪. ২.৩১ Nothing at all but three things
১০৫. ২.৩২ You stand upon the threshold
১০৬. ২.৩৩ যেন রে তোর হৃদয় জানে
১০৭. ২.৩৪ The people that walked in darkness
১০৮. ২.৩৫ জীব আজ সমরে
১০৯. ২.৩৬ জন্ম-জরার ঝরাধানে ফোটে নয়ন-চারা
১১০. ২.৩৭ Is man one of God’s blunders
১১১. ২.৩৮ God, like a gardener
১১২. ২.৩৯ He that looks not before
১১৩. ২.৪০ When a man is wrapped up in
১১৪. ২.৪১ If you ever need a helping hand
১১৫. ২.৪২ To see a world in a grain of sand
১১৬. ২.৪৩ Every man is a volume
১১৭. ২.৪৪ There is an Eye that never sleeps
১১৮. ২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি
১১৯. ২.৪৬ Keep your fears to yourself
১২০. ২.৪৭ An animal with some instincts of a God
১২১. ২.৪৮ Every man is the architect
১২২. ২.৪৯ The time, which steals our years away
১২৩. ২.৫০ The flowers fall for all our yearning
১২৪. ২.৫১ Thirty spokes will converge

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন