পৌলোমী সেনগুপ্ত
মাত্র দু’বছর আগের কথা। গোগোলের বাবা-মা ঠিক করে ফেললেন, সামারের ছুটিতে দার্জিলিং যাওয়া হবে। ঠিক করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু, টানা দার্জিলিং যাওয়ার বদলে, শিলিগুড়িতে তিন-চারদিন থাকার কথা হল। শিলিগুড়িতে গোগোলের ন-মামা থাকেন। সেখানে ন-মামিমা আছেন আর দাদা-দিদিরাও আছে। ন-মামা অনেকবারই যেতে বলেছেন। কখনও যাওয়া হয়নি। এবারে সেটা ঠিক করা হল।
সামারের ছুটিতে দার্জিলিং মেলে জায়গা পাওয়া আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া প্রায় এক কথা। বাবার কাজ অনেক। বেশিদিন অপেক্ষা করারও উপায় নেই। তাই প্লেনে বাগডোগরা যাওয়া ঠিক হল। সেখান থেকে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনস-এর গাড়িতে শিলিগুড়ি সিটি অফিসে পৌঁছুতে পারলে, ন-মামার কলেজপাড়ার বাড়িতে রিকশায় যেতে দশ মিনিটের ব্যাপার।
প্লেনের টিকিট আর আসন পাওয়া গেল তিন দিনের মধ্যেই। গোগোলের এটাই প্লেনে প্রথম চড়া নয়। আগেও প্লেনে চড়ে গৌহাটি গিয়ে, সেখান থেকে গাড়িতে শিলং গিয়েছে। অতএব প্রথম প্লেনে চড়ার উত্তেজনা ছিল না।
ফকার ফ্রেন্ডশিপ প্লেনে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই দমদম থেকে বাগডোগরা। ন-মামাকে চিঠি লিখে খবর দেওয়া ছিল। কলকাতার বাড়ি থেকে সকালবেলা বেরিয়ে দুপুরের খাবার আগেই গোগোল বাবা-মায়ের সঙ্গে ন-মামার বাড়ি পৌঁছে গেল। বড় ছোট, সকলের মধ্যেই একটা আনন্দের হই-চই পড়ে গেল।
সেই দিনটা খেয়ে-দেয়ে, মহানন্দা নদীর সেতুর ধারে বেড়িয়েই কাটল। সন্ধেবেলা বাবার সঙ্গে কথা বলে, ন-মামা জলদাপাড়া স্যাংচুয়ারির কেয়ারটেকার অফিসারকে টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, ঘর পাওয়া যাবে কি না। প্রথমে জানা গেল, এত তাড়াতাড়ির নোটিসে ঘর পাওয়া সম্ভব নয়। তারপরে ভদ্রলোকের কী মর্জি হল, তিনি একটি ঘর এক রাত্রির জন্য দিতে পারবেন বলে জানালেন।
জলদাপাড়ায় হাতির পিঠে চেপে, জঙ্গলে ঘুরে, গন্ডার, হরিণ, এমনকী বাঘের দেখাও নাকি পাওয়া যেতে পারে। গোগোল ব্যাপারটা ভেবে এতই উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে, রাত্রে তার চোখে ঘুমই আসতে চাইল না। যদি বা ঘুম এল, সারারাত্রি প্রায় হাতির পিঠে চাপার স্বপ্ন দেখেই কেটে গেল। আর কত গন্ডার-হরিণ যে দেখল, তার কোনও হিসাবই নেই।
বাবা যে শিলিগুড়িতে ন-মামার বাড়িতে কয়েকটা দিন কাটিয়ে, দার্জিলিং যাবার কথা ভেবেছিলেন, তার আসল কারণ জলদাপাড়ায় যাওয়া। পরের দিন সকালে বাবা-মা’র সঙ্গে গোগোল, বুড়োদা আর মিনুদিও চলল। ন-মামা আর মামিমা গেলেন না। তবে ন-মামা গোগোলদের জলদাপাড়ার বাসে তুলে দিয়ে গেলেন।
যথেষ্ট সকালে বেরোলেও, দুপুর হয়ে গেল জলদাপাড়ায় পৌঁছুতে। কিছু খাবার আর জল সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। জলদাপাড়ায় পৌঁছুতেই সব সাবাড়। আসবার পথে অনেক চা-বাগান চোখে পড়ল। বাঁ দিকে ভুটানের পাহাড় আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু জলদাপাড়ায় পৌঁছে, গোগোলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিল আশেপাশে ঘন বন-জঙ্গল দেখতে পাবে। তার বদলে চারদিকে মিলিটারি ক্যাম্প। ঘন ঘন ট্রাক আর জিপের যাতায়াত। কয়েক সেকেন্ড অন্তর-অন্তর কেবলই বন্দুকের গুলির আওয়াজ। আর, মাথার ওপর দিয়ে প্রায় অনবরতই উড়ে চলেছে হেলিকপটার, নয়তো ছোট ছোট এরোপ্লেন।
বুড়োদা আগেও জলদাপাড়ায় এসেছে। সে বলল, “গুলির আওয়াজ হচ্ছে চাঁদমারিতে, যেখানে রাইফেলধারী সৈন্যরা তাদের হাতের টিপ করে। আর কাছেই হাঁসিমারা বলে একটা জায়গায় এয়ারফোর্সের এয়ারবেস রয়েছে। হেলিকপটার আর প্লেনগুলো সেখান থেকেই উড়ছে।”
গোগোলরা ফরেস্টের অফিস থেকে যখন বাংলোয় গেল, তখনও মিলিটারি দোতলা কোয়াটার্সের সারির পাশ দিয়েই যেতে হল। তার মানে, জলদাপাড়া এখন একটা পুরোপুরি সামরিক আর বিমানঘাঁটি। তবু যা হোক, অফিসের সামনে গোটা কয়েক হাতি বাঁধা ছিল। তাই দেখেই গোগোলের যা আনন্দ। কিন্তু সে আনন্দও নষ্ট হয়ে যেতে বসল, যখন শোনা গেল, এখন বাংলোতে খাবার কোনও ব্যবস্থা নেই। অথচ খিদে পেয়েছে প্রচণ্ড। পথ চলার জন্য খাবার কিছু সঙ্গে নেওয়া যায়। তা বলে দুপুরের খাবার কেউ বয়ে বেড়ায় না।
শেষ পর্যন্ত বাবা বাংলোর কেয়ারটেকারকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করালেন। তাঁর হাতে টাকা দিয়ে বললেন, “এ বেলাটা কোনও রকমে ডাল-ভাত করে চালিয়ে দাও। ও-বেলা মাংস মাছ মুরগি যা জোগাড় করতে পারবে, তাই খাওয়া যাবে।”
বাংলোর দোতলায় একটা বড় ঘরই গোগোলদের দেওয়া হল। দুটো খাট ছিল। কেয়ারটেকার জানিয়ে দিলেন, রাত্রে আরও কিছু বিছানা আর একটা মশারি দিতে পারবেন। মাথার ওপরে পাখা আছে। গরমের একটা রাত কোনও রকমে কেটে যাবে।
রাতটা কেটে গেল ঠিকই। ভোরের অন্ধকার থাকতেই কেয়ারটেকার গোগোলদের দরজায় ঠকঠক করে ঘুম ভাঙিয়ে চা আর বিস্কুট দিয়ে গেলেন। জানিয়ে গেলেন, “হাতি তৈরি। যত ভোরের দিকে রওনা হওয়া যাবে, ততই ভাল।”
এ খবর শোনার পরে আর চা-বিস্কুটে কারওরই মনোযোগ থাকতে পারে না। অন্তত গোগোলের তো না-ই। পনেরো মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে সব বেরিয়ে পড়ল। বাংলোর পিছনেই দুটো হাতি দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের পিঠে মাহুত। তা ছাড়াও দু’জন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। মাহুত কী বলল, কী করল, কে জানে, হাতি দুটো বসে পড়ল। আর বাকি লোক দুটো, হাতির গায়ে মই লাগিয়ে দিয়ে গোগোলদের উঠতে সাহায্য করল। চটের গদি মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। মাহুত বলে দিল, সবাই যেন শক্ত হাতে দড়ি ধরে রাখে।
বাবা-মা উঠলেন একটা হাতির পিঠে। বুড়োদা আর মিনুদির সঙ্গে গোগোল আর একটা হাতির পিঠে। হাতি যখন উঠে দাঁড়াল, গোগোলের মনে হল, একটা পাহাড় যেন ওকে পিঠে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দুলে দুলে চলল। ভীষণ মজায় ওর হাসি পেতে লাগল, আবার ভয়ও করতে লাগল। হাতির পিঠে দোলা খেয়ে ওরা সবাই হাসছিল। বাবা-মাও হাসছিলেন। তার মধ্যেই বাবা চিৎকার করে সাবধান করে দিলেন, “সবাই শক্ত করে হাওদার দড়ি ধরে থেকো।”
গোগোল খুশি হল, এদিকে মিলিটারি ক্যাম্প নেই। গাছপালায় পাখিরা ডাকছে। এখনও সূর্য ওঠেনি। তারপরে হাতি দুটো যখন একটা নদীতে নামল, তখন গোগোলের মনে আনন্দ আর ভয়ে একটা শিহরন খেলে গেল। ও জিজ্ঞেস করল, “বুড়োদা, এটা কী নদী?”
বুড়োদা বলল, “এটা জলঢাকা নদী। নদীর ওপারে তাকিয়ে দেখ, ওটাই আসলে জলদাপাড়া ফরেস্ট।”
গোগোল বিশাল চওড়া নদীর ওপারে তাকিয়ে দেখল, নিবিড় সবুজ বন। আর হাতি দুটো কখনও জলের ওপর দিয়ে, কখনও পাথর-ছড়ানো চরের ওপর দিয়ে সাবধানে পা ফেলে ফেলে চলল। এক সময়ে গভীর জলের মধ্যে, হাতি দুটো সাঁতার কেটে পার হতে লাগল। গোগোলদের পায়ে জল লেগে গেল। ভয় পেয়ে ও জিজ্ঞেস করল, “বুড়োদা, হাতি জলে ডুবে যাবে না তো?”
বুড়োদা বলল, “দূর বোকা, হাতি আবার জলে ডোবে নাকি। মনে কর, আমরা এখন নৌকোয় করে নদী পার হচ্ছি।”
গভীর জলে হাতির পিঠে, ব্যাপারটা প্রায় সেই রকমই। ঠিক যেন একটা নৌকো দুলে দুলে, জল কেটে চলেছে, আর স্রোতের সঙ্গে লড়ছে, যাতে টানে ভেসে না যায়।
এ পর্যন্ত খুবই ভাল কাটল। কিন্তু গোগোলদের কপাল খারাপ। নদী পার হয়ে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে অনেকটা বেলা অবধি ঘুরেও কোনও জন্তু-জানোয়ার দেখা গেল না। গন্ডার হরিণ আর বাঘ তো দূরের কথা, একটা খরগোশও চোখে পড়ল না। ইতিমধ্যে চাঁদমারির গুলির আওয়াজ ভেসে আসতে আরম্ভ করেছে। আকাশে হেলিকপটার উড়তে দেখা যাচ্ছে।
মাহুত বলল, “জলদাপাড়ায় এখন আর গন্ডার হরিণ বিশেষ দেখা যায় না। গুলির আওয়াজ আর হাওয়াই-জাহাজের ভয়ে ওরা সব হলং-এর জঙ্গলে চলে গেছে। সেখানে এখন অনেক বড় ফরেস্ট বাংলো হয়েছে। আজকাল সবাই ওখানেই যায়।”
গোগোল মন খারাপ করে বাংলোয় ফিরে এসে বাবাকে হলং-এর বাংলোর কথা বলল। বাবা বললেন, “হলং-এর বাংলো পেতে দেরি হয়। তা ছাড়া, নিজেদের গাড়ি না থাকলে হলং-এ যাওয়ারও অনেক অসুবিধে।”
বাবার কথা শুনে গোগোলের মনটা আরও হতাশায় ভরে গেল। বাবা কেবল বললেন, “দেখা যাক, কী করা যায়।”
তারপরে করার আর কিছুই ছিল না। সেই দিনই শিলিগুড়িতে ফিরে, রাতটা ন-মামার বাড়িতে কাটল। পরের দিন ভোরবেলা জিপে চেপে দার্জিলিং। এ যাত্রায় বুড়োদা আর মিনুদি ছিল না। দু’দিন দার্জিলিং-এ কাটিয়ে, সেখান থেকে কার্শিয়ং-এ। কার্শিয়ং-এ গিয়ে তিব্বতি লামাদের বৌদ্ধ মঠে গোগোল তো এক কাণ্ডই করে বসল। যাই হোক, সে-সব কাণ্ড-কারখানার কথা এখন আর বলে দরকার নেই।
কার্শিয়ং থেকে ফিরে আবার দার্জিলিং। ঘোড়ায় চেপে ঘুরে বেড়িয়ে, গোগোল জলদাপাড়ার দুঃখটা ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু বাবার মতলব ছিল আলাদা। তিনি দার্জিলিং-এর ট্যুরিস্ট অফিস থেকে, হলং-এর বাংলোর দুটো ঘর দু’দিনের জন্য বুক করে ফেললেন। বাবা খবর নিয়ে জেনেছিলেন, দার্জিলিং থেকে হলং-এর বাংলো বুক করার সুবিধে। বাবা গোগোলের কাঁধে হাত চেপে বললেন, “এবার হল তো?”
গোগোল খুশি হয়ে বাবাকে একটা চুমু দিয়ে দিল। তবু জিজ্ঞেস না করে পারল না, “কিন্তু বাবা হলং-এ যাবার গাড়ির কী হবে?”
বাবা বললেন, “কী আর হবে? শিলিগুড়ি থেকে দু’দিনের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে।”
তাই করা হল। সেইদিনই গোগোলরা দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি ন-মামার বাড়ি ফিরে এল। ন-মামা সব শুনে, সন্ধেবেলাতেই একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ফেললেন। পরের দিন, ভোরবেলা হলং যাত্রা। গাড়ি ভোরবেলাই এসে গেল। ড্রাইভার লোকটি বাঙালি আর বেশ ভদ্রলোক। এ যাত্রায় আবার বুড়োদা আর মিনুদি সঙ্গে।
গাড়ি প্রথমে চলল জলদাপাড়ার পথেই। তারপরে এক সময়ে আসাম যাবার রাস্তায় ঘুরে গেল। সেই পথেই পড়ল হলং-এর জঙ্গলে ঢোকবার গেট। রীতিমতো তালা-চাবি লাগানো রেলের লেবেল ক্রসিং-এর মতো লোহার ডান্ডার গেট। গেটম্যান বাবার কাছ থেকে বুকিং স্লিপ দেখে, তালা খুলে দিল।
দু’ পাশে ঘন বন। মাঝখান দিয়ে শক্ত লাল মাটি আর কাঁকরের রাস্তা। কিন্তু গাড়ি বনের মধ্যে দিয়ে চলেছে তো চলেছেই, থামবার আর নাম নেই। গোগোল বলে উঠল, “বাংলোটা কত দূরে?”
ড্রাইভার হেসে বলল, “গেট থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার।”
বুড়োদা হলং-এ কখনও আসেনি, তাই বলতে পারল না। গোগোল এবার বুঝল, কেন গাড়ি ছাড়া হলং-এ আসা যায় না। গাড়ি না থাকলে এতটা পথ হেঁটে যেতে হত। বাসে এলে, বাসও মাঝপথে বদলাতে হত। অনেক ঝামেলা। কিন্তু গভীর বনের ভিতর দিয়ে গাড়িতে যেতে গোগোলের দারুণ মজা লাগছে। এখানে মিলিটারি ক্যাম্প নেই, চাঁদমারির গুলির আর হেলিকপটারের আওয়াজ নেই। কেবল বন আর বন। তারপরেই হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা কাঠের চওড়া সাঁকো, ওপারে কাঠের সুন্দর দোতলা বাংলো।
বাংলোর চত্বরে গাড়ি দাঁড়াতেই, গোগোল দরজা খুলে নেমে পড়ল। প্রথমে বাংলোটা দেখল। জলদাপাড়ার সঙ্গে কোনও তুলনাই হয় না। বিরাট ডাইনিং রুম, বসবার ঘর আলাদা। সোফা সেট দিয়ে সাজানো। ড্রাইভার বলল, “সাঁকোর নীচে যে নদীটা আছে, সেখানে অনেক মাছ দেখা যায়।”
গোগোল অমনি বুড়োদা আর মিনুদির সঙ্গে সাঁকোর ওপর ছুটে গেল। দেখল নীচে কাচের মতো জলে অনেক আর বড় বড় মাছ খেলা করছে। গোগোল হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল। মাছগুলোর একটুও ভয় নেই।
মাছ দেখে সাঁকো পেরিয়ে ওপারে কিছুটা হেঁটে যেতেই বাঁ দিকে দেখা গেল কয়েকটা হাতি বাঁধা রয়েছে। তার মধ্যে একটা হাতি একটু দূরে, তার চারপাশে গোল করে লোহার বড় বড় ছুঁচলো গজাল পোঁতা। কেন? গোগোল বুড়োদাকে জিজ্ঞেস করল। বুড়োদা কিছুই বলতে পারল না। হাতিগুলো লম্বা ঘাস আর গাছের ডালপাতা খাচ্ছে।
কাছেই কতগুলো কাঠের উঁচু ঘর। অন্য পাশে কাঠের একটা বাংলো-বাড়ি। রেলিঙে জামা-কাপড় শুকোচ্ছে। লোকজন বিশেষ দেখা যায় না। বোধহয় মাহুতদের পরিবারের মেয়ে-বউরাই কেউ কেউ ঘরকন্নার কাজ করছিল। এই সময়ে মিনুদি বলে উঠল, “ওখানে ওটা কী দেখ।”
গোগোল ঘরগুলো ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে দেখতে পেল, একটা বাচ্চা হাতির গলায় শেকল বাঁধা। সে-ও লম্বা লম্বা ঘাস খাচ্ছে। গোগোল তৎক্ষণাৎ সেদিকে ছুটে গেল। বুড়োদা মিনুদিও গেল। বাচ্চা হাতিটা ফোঁস ফোঁস করে ওদের দিকে শুঁড় বাড়িয়ে দিল। বুড়োদা বলল, “দেখিস গোগোল, কাছে যাস নে।”
গোগোল তবু একটা হোগলার মতো লম্বা ঘাস বাচ্চা হাতিটার দিকে গড়িয়ে দিল। বাচ্চা হাতিটা ঘাসের ডগাটা শুঁড়ে জড়িয়ে টান দিতেই, গোগোল তার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। বুড়োদা ধরে ফেলল। গোগোল বেশ একটু ভয় পেয়ে গিয়েছে, আর অবাক হয়ে বলল, “আরে বাস রে, বাচ্চাটার গায়ে কী জোর।”
ঠিক এই সময়েই পিছন থেকে মোটা আর গম্ভীর গলা শোনা গেল, “তোমরা কোথা থেকে এসেছ ভাই?”
সবাই পিছন ফিরে দেখল পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের এক ভদ্রলোক। ডাক্তারি পড়ে গোগোলের তিতুদা, অনেকটা তার মতোই দেখতে। বুড়োদাই সকলের বড়, ক্লাস এইটে পড়ে। সে বলল, “আমরা শিলিগুড়ি থেকে এসেছি।”
মিনুদি তাড়াতাড়ি গোগোলকে দেখিয়ে বলল, “ও কলকাতা থেকে এসেছে।” তিতুদার মতো লোকটি, যার তিতুদার মতোই গোঁফ আছে, আর হাওয়াই শার্টের সঙ্গে সাদা ট্রাউজার পরা, পায়ে স্যান্ডেল, গোগোলের দিকে একবার দেখলেন। মুখ তুলে চারপাশে একবার দেখে নিয়ে বললেন, “তোমরা ছেলেমানুষ, এভাবে এখানে ঘুরো না। কয়েকদিন হল, একটা দাঁতাল বুনো হাতি খুব উৎপাত করছে।”
গোগোলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “উৎপাত করছে? কেন?”
ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, “বুনো হাতিটা একটু রেগে আছে।”
বুড়োদা বলে উঠল, “তার মানে পাগলা হাতি?”
ভদ্রলোক কিছু বলবার আগেই, পিছন থেকে বাবার ব্যস্ত আর উৎকণ্ঠিত ডাক শোনা গেল, “গোগোল, বুড়ো, মিনু, তোমরা শিগগির বাংলোয় ফিরে এসো।”
সকলেই পিছন ফিরে তাকাল। দেখা গেল, বাবা ড্রাইভারের সঙ্গে প্রায় ছুটে আসছেন।
কাছে এসে বাবা বললেন, “তাড়াতাড়ি বাংলোয় চলো সবাই। এখানে একটা বিরাট বুনো দাঁতাল খ্যাপা হাতি আশাপাশে ঘুড়ে বাড়াচ্ছে, লোকজনকে তাড়া করছে।” বলে সবাইকে তাড়া করে নিতে গিয়ে বাবা সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি?”
ভদ্রলোক বললেন, “আমি এই ফরেস্টেরই একজন রেঞ্জার। আমিও এদের বুনো হাতির কথাই বলছিলাম। তবে এত তাড়াহুড়ো করে ছোটবার কিছু নেই। বুনো হাতিটা লোকজনকে এমনিতে বিশেষ কিছু করছে না। চলুন, আপনাদের সঙ্গে আমিও যাচ্ছি।”
সকলের চোখে-মুখেই কেমন একটা ভয় নেমে এসেছিল। ভদ্রলোকের কথায় আবার যেন সাহস ফিরে পাওয়া গেল। ভদ্রলোক যেতে যেতে বললেন, “হাতিটা পুরুষ, আর বিরাট দেখতে, দাঁত দুটোও প্রকাণ্ড। মনে হয়, আসাম থেকে, ভুটানের পাহাড় ডিঙিয়ে এসেছে।”
ভদ্রলোককে গোগোলের এতই ভাল লেগে গেল, তাঁর কথাবার্তা বলার ধরনও এত সুন্দর, ও সবাইকে ঠেলেঠুলে, তাঁর গা ঘেঁষে চলছিল। বলে উঠল, “আচ্ছা দাদা—”
এইটুকু বলেই গোগোল থমকে গেল। কোনও ভদ্রলোককে এ রকম “দাদা” বলে ডাকা বাবা মোটেই পছন্দ করেন না। লজ্জা পেয়ে ও বাবার দিকে তাকাল। ভদ্রলোক সেটা বুঝে হেসে বললেন, “আমার নাম জয়ন্ত। তুমি আমাকে জয়ন্তদা বলতে পারো।”
বাবা গোগোলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। গোগোল মনে মনে ভরসা পেল। জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা জয়ন্তদা, আপনি কী করে জানলেন, বুনো হাতিটা ভুটানের পাহাড় ডিঙিয়ে এসেছে?”
জয়ন্তদা বললেন, ‘আমরা তো এইসব নিয়েই থাকি। সাধারণত এসব অঞ্চলে ভুটানের পাহাড় থেকেই হাতিরা জঙ্গলে নেমে আসে। তবে জঙ্গলে নেমে আসার সময় হল বর্ষাকাল।”
গোগোল জিজ্ঞেস করল, “বর্ষাকালে কেন?”
জয়ন্তদা বললেন, “বর্ষাকালে পাহাড়ের আর আসামের নদীগুলোকে বন্যা হয়। হাতিরা বন্যাকে বেশ ভয় পায়। তা ছাড়া এদিকে তখন খেতে প্রচুর ফসল থাকে, হাতিরা সেই ফসল খেতে আসে। খায়, নষ্ট করে। তখন খবর পেয়ে আমরাই বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করে ওদের গিয়ে তাড়াই।”
এই কথা বলতে বলতে সাঁকো পেরিয়ে গোগোলরা সবাই বাংলোর চত্বরে এসে পড়ল। গোগোল দেখল, মা ভয়-ব্যস্ত চোখে ওদেরই দেখছেন। বসবার ঘরের জানালা দিয়ে। সবাইকে দেখে একটু আশ্বস্ত হলেন।
জয়ন্তদা বলে উঠলেন, “ওই দ্যাখো, শ্রীমান নদীর ওপারের মাঠে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে দেখছে।”
নদী মানে, সাঁকোর নীচে দিয়ে যে ছোট জলের ধারা বয়ে গিয়েছে, বাংলোর সামনে দিয়েই তার স্রোত চলেছে। সেখানে একটা বাঁধানো ঘাট। ঘাটের ওপারে বেশ খানিকটা খোলা সবুজ মাঠ। সেই মাঠেই বিরাট বুনো হাতিটা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গোগোল ওর জীবনে এত বড় হাতি আগে কখনও দেখেনি। এত বড় দাঁতও কোনও হাতির চোখে পড়েনি। হাতিটার নীলচে কালো গায়ের কোথাও কোথাও কাদা-মাটির দাগ। কান দুটো পিছন দিকে যেন টেনে রেখেছে, আর আস্তে আস্তে শুঁড় দোলাচ্ছে। গোগোল ভয় পাওয়ার থেকে মুগ্ধই হয়ে গেল বেশি। হাতিটাকে ঠিক যেন বনের রাজার মতো দেখাচ্ছে। গম্ভীর আর শান্ত। পাগলামি খ্যাপামির কোনও চিহ্নই নেই। গোগোলের ইচ্ছে হল, ছুটে হাতিটার কাছে চলে যায়। গেলে কী হবে? হাতিটা ওকে মেরে ফেলবে? কথাটা ভেবেও জয়ন্তদাকে জিজ্ঞেস করতে পারল না।
কয়েক মিনিট পরেই হাতিটা আস্তে আস্তে বাংলোর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
জয়ন্তদা বললেন, “সবাই ঘরের মধ্যে চলো। ও হয়তো এখানেই আসবে।”
সবাই হুড়মুড় করে দৌড় দিতেই জয়ন্তদা বললেন, “এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। নদীটা পেরিয়ে ও বড়জোর ঘাটের সামনেই আসবে। বাংলোর চারপাশে এই যে দেখছ পাথরকুচি ছড়ানো, এর ওপরে হাতি কখনও পা দেবে না। পায়ের নখের ফাঁকে নরম জায়গায় বিঁধে যাবার ভয় আছে। আসলে হাতি খুবই বুদ্ধিমান জীব।”
বুড়োদা বাংলোর ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “কিন্তু বুনো যে?”
জয়ন্তদা বললেন, “বুনো হাতিরও যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। চলো, দেখি গিয়ে বসবার ঘরের জানলা দিয়ে ও এল নাকি।”
সবাই বসবার ঘরের জানালাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ল। আর সকলেই অবাক হয়ে দেখল, সত্যি বুনো হাতিটা এইটুকু সময়ের মধ্যেই নদী পেরিয়ে ঘাটের ওপর বাংলোর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পাথর-কুচি-ছড়ানো চত্বরে পা দিচ্ছে না।
গোগোলের শরীরে রীতিমতো খুশির শিহরন বইতে লাগল। এত কাছ থেকে, এমন বিরাট বুনো দাঁতাল-হাতি কোনওদিন দেখবে, ভাবতেই পারেনি। রোদ লেগে ওর দাঁত দুটো ঝকমক করছে। আর বাংলোর দিকে শুঁড় বাড়িয়ে যেন গোগোলদেরই গন্ধ শুঁকছে। গোগালের মনে হল, কেবল রাজা নয়, ওকে যেন বইয়ে-পড়া স্বর্গের ঐরাবতের মতো মহান দেখাচ্ছে।
মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে থেকে, ও বাঁ দিকে ফিরে আস্তে আস্তে চলে গেল। বাবা-মাও হাতিটাকে দেখছিলেন। এই সময়ে রসুইখানার পাচক এসে মাকে ডেকে নিয়ে গেল। গোগোল জয়ন্তদাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আপনি যে বলছিলেন, ও উৎপাত করছে, রেগে আছে? শুধু শুধু কেন এরকম করছে?”
জয়ন্তদা হেসে, একটা সোফায় বসে বললেন, “তোমরা সবাই বোসো, আমি ব্যাপারটা বলছি।”
গোগোল আগেই জয়ন্তদার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। বাবাও মুখ টিপে হেসে একটা সোফায় বসে গেলেন। জয়ন্তদা বললেন, “তোমরা আমাদের পোষা হাতিগুলো দেখেছ?”
সবাই ঘাড় ঝাঁকিয়ে জানাল, দেখেছে। জয়ন্তদা বললেন, “তার মধ্যে একটা হাতিকে লোহার ছুঁচলো গজাল পুঁতে ঘিরে বেঁধে রাখা হয়েছে, দেখেছ?”
“দেখেছি। সবাই বলল।
জয়ন্তদা হাত তুলে বললেন, “বেশ। ওটি হল মেয়ে হাতি, ওর নাম বনমালা। এখন এই বুনো হাতিটা চায়, বনমালাকে সে বিয়ে করবে। বনমালাও হাবভাবে তাই চাইছে।”
গোগোল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হাতির বিয়ে? কী করে করবে?”
জয়ন্তদা বললেন, “ওদের অবিশ্যি পুরুত ডেকে মন্ত্র পড়তে হয় না। দু’জনে একসঙ্গে মিশে, বনে চলে গেলেই ওদের বিয়ে হয়ে যায়।”
গোগোল বলল, “তবে বিয়ে হচ্ছে না কেন?”
জয়ন্তদা বললেন, “কী করে হবে বলো। তা হলে তো আমাদের বনমালাকে ওর সঙ্গে ছেড়ে দিতে হয়। তা তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না।”
“কেন?” গোগোল জিজ্ঞেস করল।
জয়ন্তদা বললেন, “বনমালাকে আমাদের এখানে মালপত্র বইবার কাজ করতে হয়। তারপরে এই যেমন তোমরা বেড়াতে এসেছ। তোমাদের পিঠে তুলে নিয়ে বনের মধ্যে বেড়িয়ে গন্ডার হরিণ দেখাতে হয়ে। ছেড়ে দিলে কী করে চলবে? ছেড়ে দিলে তো বনমালা বনেই চলে যাবে। হয়তো ভুটানের পাহাড় ডিঙিয়ে অনেক দূরে আসামের জঙ্গলেই চলে যাবে, আর কখনও ফিরে আসবে না। আমাদের অসুবিধে হয়ে যাবে।”
বুড়োদা খুশি হয়ে বলল, “ও বুঝেছি, সেইজন্যই ছুঁচলো গজাল পুঁতে বনমালাকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে, বুনো হাতিটা যাতে ওকে এসে নিয়ে যেতে না পারে।”
জয়ন্তদা বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক তাই।”
গোগোল হাসতে পারল না। জয়ন্তদা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল গোগোল, তুমি কথা বলছ না যে? তোমার কি মন খারাপ হয়ে গেল?”
গোগোল ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
জয়ন্তদা যেন একটু অবাক হয়ে হেসে বললেন, “কেন? বনমালার সঙ্গে বুনো হাতিটার বিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলে?”
গোগোল আবার ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
সবাই হেসে উঠল। গোগোল হাসতে পারল না। ব্যাপারটা ওর কাছে খুবই অন্যায় মনে হল। কারণ বুনো হাতিটা বুনো হতে পারে, কিন্তু সে এত সুন্দর দেখতে, এত বিরাট তার চেহারা, অমন সুন্দর প্রকাণ্ড যার দাঁত, তাকে বিয়ে করতে না দেওয়াটা নিশ্চয়ই অন্যায়। বিশেষ করে বনমালাও যখন তাই চায়। গোগোলের কাছে সকলের হাসি খুব নিষ্ঠুর মনে হল।
জয়ন্তদা বললেন, “গোগোল, তুমি কষ্ট পাচ্ছ বটে, কিন্তু ভেবে দ্যাখো, বুনো হাতিটার ভয়ে, তোমাদের আমরা আমাদের পোষা হাতির পিঠে চাপিয়ে, গন্ডার হরিণ দেখতে পাঠাতে পারব না। বনমালা ছাড়া যে-কোনও পোষা হাতি দেখলেই বুনোটা তাদের তাড়া করছে। বুনো হাতিটা তোমাদের আনন্দও মাটি করে দিয়েছে।”
গোগোল এদিকটা ভেবে দেখেনি। বুড়োদা, মিনুদি, এমনকী বাবাও বললেন, “সত্যি, আমাদের কপালটাই খারাপ। হলং-এ এসেও, হাতির পিঠে চেপে জন্তু-জানোয়ার দেখতে পাব না।”
গোগোলেরও যে মনটা একটু খারাপ হল না, তা নয়। বন্য গন্ডার হরিণ দেখার শখ ওরই বেশি ছিল।কিন্তু বুনো হাতিটার সেই আশ্চর্য সুন্দর আর বিরাট চেহারাটার কথা ভেবে, তার জন্যই ওর মনটা বেশি খারাপ হয়ে গেল।
পরের দিন ভোরবেলা গোগোলের ঘুম ভেঙে গেল। বুড়োদা মিনুদি এখনও ঘুমোচ্ছে। পাশের ঘরে বাবা-মায়েরও কোনও সাড়া শব্দ নেই। গোগোল খাটের মশারির ভিতর থেকে বেরিয়ে জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। ছোট হাঁটুজল নদীটির বাঁ দিকে ঝাড়ালো গাছটায় অসংখ্য পাখি ডাকছে। গোগোল জানালা থেকে সরে, আস্তে-আস্তে দরজার কাছে গিয়ে ছিটকিনি খুলে ফেলল। বাইরে বেরিয়ে নীচে নেমে, একেবারে ঘাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রসুইখানার পাচক বা চৌকিদার নিজেদের কাজে ব্যস্ত। কেউ গোগোলকে লক্ষ করল না।
গোগোল ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে, স্রোতের জলে চোখ-মুখ ধুয়ে নিল। অবাক হয়ে দেখল, ওর হাতের সামনেই মাছগুলো ঘোরাফেরা করছে। ওর খুব ইচ্ছে হল, একটা মাছকে হাত দিয়ে ধরে। ওর পা খালিই ছিল। জলে নেমে পড়ল। আর, একটা মাছ যেন ওকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওপারে নিয়ে গেল, আর চট করে হারিয়ে গেল।
গোগোল হতাশ হয়ে, ওপর দিকে তাকাল। সেই ঝাড়ালো গাছটা। ও এখন নদীর অন্য পারে। পাখি দেখবার জন্য ও উঁচু পাড়ে উঠে দাঁড়াল। মাথা তুলে গাছের দিকে দেখল। প্রথমেই ওর চোখে পড়ল একটা কালো পাখি, মাথায় হলুদ রঙের ঝুঁটি। পাখিটা একবার শিস দিয়ে ডেকেই, হঠাৎ উড়ে গেল। তারপর আরও কয়েকটা পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল। কেন? গোগোলকে দেখে ভয় পেয়েছে?
ঠিক এই সময়েই গোগোলের মনে হল, ওর মাথায় হালকা গরম দমকা বাতাস লাগল, আর মাথার চুল উড়ে কপালে পড়ল। কীসের বাতাস? ও পিছন ফিরে তাকাল। ও প্রথমে দেখতে পেল, হাতির একটা শুঁড়, ওর মাথার ওপরে। ওর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। ও ভাল করে তাকিয়ে দেখল, সেই বিশাল কালোয়-নীলে মেশানো বুনো হাতিটা ওর পিছনেই দাঁড়িয়েই আছে। তার প্রকাণ্ড বাঁদিকের দাঁতটা প্রায় ওর কাঁধের কাছে নেমে এসেছে।
গোগোল প্রথমটা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল, আর হতচকিত হয়ে ভাবল, দৌড় দেবে কি না। কিন্তু আশ্চর্য, ও দৌড় দেবার কথা ভাবতেই, হাতিটা তার শুঁড় দিয়ে, আলতো করে ওর মাথায় ছোঁয়াল। আবার সেইরকম দমকা বাতাসের মতো নিশ্বাস ফেলল। ওর চুলগুলো আবার উড়ে এলোমেলো হয়ে গেল। তারপরেই হাতিটা শুঁড় দিয়ে গোগোলের কাঁধে, পিঠে, কোমরে, এমনকী পায়েও আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেন গন্ধ শুঁকল।
গোগোলের ভয়-ছমছমানি ভাবটা কেমন কেটে গেল। ও কি এই বুনো হাতিটার শুঁড়ে একটু হাত বুলিয়ে দেবে? যেমন কলকাতার চিড়িয়াখানায় দিয়েছিল? ও মুখ তুলে হাতিটার চোখের দিকে তাকাল। চাউনিটা মোটেই রাগি দেখাচ্ছে না। কুলোর মতো কান দুটো নাড়ছে। গোগোল খুব আস্তে ওর শুঁড়ে একটি হাত বুলিয়ে দিল। অমনি বুনোটা তার শুঁড় গুটিয়ে এনে, গোগোলের ছোট নরম আঙুলগুলো শুঁকল। আঙুলের ডগাগুলো যেন লালায় ভিজে গেল। গোগোলের হাসি পেয়ে গেল।
বুনো হাতিটা হাঁ করল, তার জিভটা দেখা গেল। গোগোলের মনে হল, ও ওর প্রকাণ্ড দাঁতে হাঁ করে হাসছে। গোগোল বলেই উঠল, “তুমি হাসছ, না?”
বুনো শুঁড় তুলে গোগোলের কানের কাছে হালকা নিশ্বাস ফেলল। গোগোলের মনে হল, ও যেন বলল, “হ্যাঁ।” গোগোল আবার জিজ্ঞেস করল, “বনমালার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেয়নি বলে তোমার মন খুব খারাপ, না?”
বুনো গোগোলের নরম গালে শুঁড় ছুঁইয়ে দিল। এই সময়ে বাংলোর দিক থেকে অনেকের গলা শুনে, গোগোল সেদিকে তাকিয়ে দেখতে গেল। বুনো হাতিটা এবার গোগোলের পিঠে শুঁড় দিয়ে আস্তে ঠেলে দিল। গোগোল বাংলোর উলটো দিকে দু’ পা এগিয়ে গেল। বুনো শুঁড় তুলে যেন হাতের মতো দেখাল, আবার গোগোলের পিঠে আস্তে ঠেলে দিল। আর মাথায় আলতো করে শুঁড় দিয়ে নিশ্বাস ফেলল। তারপরে খুব ঘন ঘন শুঁড় আর কান নাড়তে লাগল।
বাংলোর দিকে তখন রীতিমতো হাঁকডাক পড়ে গিয়েছে। গোগোলের মনে হল, মা যেন চিৎকার করে ওকে ডাকছেন। কিন্তু গোগোল বুনোর সঙ্গে বনের দিকেই এগিয়ে চলল। বুনো মাঝে মাঝেই ওর পিঠে আস্তে করে ঠেলে দিতে লাগল, আর গালে গলায় মাথায় আলতো করে ছুঁয়ে দিল।
গোগোল নির্ভয়ে বুনো হাতির আগে আগে চলতে লাগল। দু-একবার ওর শুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিল। একবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমাকে ভালবাস, না?”
বুনো বেশ জোরে একটা নিশ্বাস ফেলল। বাংলোর দিকে গোলমাল তখন চরমে। কিন্তু গোগোলের কিছুই মনে হল না। একটা অন্ধ লোককে তার লাঠি ধরে যেমন কেউ রাস্তা পার করে দেয়, ও সে-ভাবেই বুনোর শুঁড় ধরে ক্রমেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। তারপরেই হঠাৎ ভয় পেয়ে থেমে চিৎকার করে উঠল, “ওটা কী?”
বুনো বিশাল হাতি তৎক্ষণাৎ আড়াল করে দাঁড়াল। আর গোগোল দেখল, একটা মস্ত গন্ডার তার বাচ্চা নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। গোগোল হাততালি দিয়ে বলে উঠল, “গন্ডার গন্ডার! মা আর বাচ্চা!”
বুনো হাতি ওর কাঁধে শুঁড় দিয়ে যেন কিছু ইশারা করল, আর আবার হাঁ করল। ঠিক যেন হাসছে। সে আবার গোগোলের পিঠে আলতো করে ঠেলে দিল। গোগোলও আবার তার শুঁড় ধরে এগিয়ে চলল। চলতে চলতে গোগোলের মাথা-সমান ঘাসবনে চলে এল। আর হঠাৎ একটা ময়ূর ডানা ঝাপটিয়ে আকাশের ওপর দিয়ে উড়ে দূরে গিয়ে নামল।
গোগোল প্রথমটায় চমকিয়ে উঠলেও, তারপরেই খুশি হয়ে চিৎকার করে উঠল, “ময়ূর ময়ূর।”
ওর কথা শেষ হতে না হতেই, হাত দশেক দূরেই এক দল হরিণ, ঠিক যেন ঢেউয়ের মতো ছুটে পালিয়ে গেল। গোগোল হাততালি দিয়ে আবার চিৎকার করে উঠল, “হরিণ, হরিণ!”
বুনো ওর হাতের ওপর শুঁড় ছুঁইয়ে আবার আলতো করে পিছন থেকে ঠেলে দিল। গোগোল আর তখন এগোবে কী! ওর আশে-পাশে থেকে এক-একটা হরিণ ছিটকে দিগবিদিক ছুটতে লাগল। ময়ূর আর বুনো মুরগি থেকে থেকেই উড়তে লাগল।
গোগোল যেন আনন্দে পাগল হয়ে গেল, আর হাততালি দিয়ে নাচতে লাগল। বুনো হাতিটা তার বিশাল শরীর দুলিয়ে, শুঁড় আর কান দুটো খুব নাড়তে লাগল। যেন সে-ও বেশ খুশি!
আরও খানিকটা এগিয়ে, একটা মোটা গাছের গুঁড়ির কাছে একটা ছোট বাঘের মতো জানোয়ার দেখে গোগোল ভয় পেয়ে থমকে গেল। হাত বাড়িয়ে বুনোর শুঁড় ধরে বলল, “বাঘ বাঘ!”
গোগোল জানে না, আসলে ওটা বাঘ নয়, একটা চিতা বিড়াল। এই অঞ্চলের বনে প্রায়ই এদের দেখা যায়। চিতা বিড়ালটা বিশাল হাতি দেখেই, ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে গরগর করে উঠল। বুনো গোগোলের হাত থেকে শুঁড়টা ছাড়িয়ে নিয়ে দু’ পা এগিয়ে যেতেই চিতা বিড়ালটা এক লাফ দিয়ে চোঁ চাঁ দৌড় দিল।
গোগোল হাততালি দিয়ে নেচে উঠল। বুনো শুঁড় তুলে হাঁ করল। ঠিক যেন হাসছে! ঠিক এ সময়েই কাছাকাছি থেকে লোকজনের গলার স্বর শোনা গেল। গোগোল স্পষ্ট বাবার ডাক শুনতে পেল, “গোগোল গোগোল! তুমি কোথায়?”
গোগোল চিৎকার করে জবাব দিল, “আমি এখানে।”
তারপরেই প্রায় একশো হাত দূরে, একদল লোককে দেখা গেল। তাদের মধ্যে বাবা আর জয়ন্তদা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বুনো হাতি এই প্রথম অদ্ভুত স্বরে ডেকে উঠল, আর তার কান দুটো মাথার পিছন দিকে লেপটে গেল। গোগোল স্পষ্ট দেখল, তার চোখের চাউনিতে রাগ ফুটে উঠেছে। সে শুঁড় দিয়ে গোগোলর কাঁধে আলতো করে ছোঁয়াল।
গোগোল জিজ্ঞেস করল, “তোমার রাগ হচ্ছে?”
বুনো গোগোলকে আড়াল করে, একশো হাত দূরে দলটার মুখোমুখি দাঁড়াল। বাবা চিৎকার করে বললেন, “গোগোল, ও পাগলা হাতি, তোমাকে মেরে ফেলবে।”
গোগোল বলল, “না, ও আমার বন্ধু হয়ে গেছে।”
বুনো কী বুঝল, কে জানে। সে হঠাৎ দলটার দিকে দৌড়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দলটার সঙ্গে বাবা আর জয়ন্তদাও পিছন ফিরে দৌড় দিলেন। কিন্তু চলে গেলেন না। জয়ন্তদা চিৎকার করে বললেন, “গোগোল, তুমি ওকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাংলোয় ফিরে এসো।”
গোগোল বলল, “আপনারা চলে যান।”
গোগোলের কথা শুনে, বাবা, জয়ন্তদা সবাইকে নিয়ে আড়ালে চলে গেলেন। গোগোল বুনোর কাছে এগিয়ে এল। বুনো ওর গায়ে মুখে শুঁড় ছুঁইয়ে শুঁকল, কিন্তু তার রাগভাবটা এখনও আছে। গোগোল বলল, “এবার ফিরে চলো, আমার মা কাঁদছে।”
বুনো শুঁড় দিয়ে, গোগোলের কানে একটা হাওয়া লাগিয়ে দিল। গোগোলের মনে হল, ও যেন বলছে, “খুব সাবধান। ওদের বিশ্বাস নেই।”
গোগোল বলল, “আমি আছি, তোমার কোনও ভয় নেই।” বলে বুনোর শুঁড় ধরে এগিয়ে চলল।
বুনো হাতি প্রথমে যেন একটু আপত্তি করল, তারপর গোগোলের পিছনে পিছনে এগিয়ে গেল। গোগোল বাংলোর পথ চেনে না। বুনোই তাকে টেনে, আস্তে করে ঠেলে, বাংলোর হাতায় এনে ফেলল। কিন্তু সে আর এগোল না। দূরে বিরাট ভিড় দাঁড়িয়ে ছিল।
গোগোল বুনোর দিকে তাকাল। তার চোখে এখন রাগ নেই, বরং গোগোলের মনে হল, তার চাউনিতে কষ্ট। গোগোল তার শুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিল। সে শুঁড় তুলে গোগোলের মাথায় তেমনি দমকা নিশ্বাস ছাড়ল। গোগোলের চুল এলোমেলো হয়ে গেল। বুনো গোগোলের কাঁধে গলায় গালে শুঁড় ঠেকাল, ঠিক যেন আলতো করে আদর করার মতো। তারপরে আস্তে আস্তে পিছন ফিরে চলে গেল।
গোগোলের মনটা কেমন টনটন করে উঠল। ও সেই বিশাল সুন্দর হাতিটিকে যতক্ষণ দেখা গেল, দেখল। তারপরে সে বনের মধ্যে হারিয়ে গেল।
এ সময়েই ভিড়টা দৌড়ে এল। প্রথমেই মা গোগোলকে বুকে চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, বললেন, ‘ওরে গোগোল, তোর জন্য ভয়েই আমি একদিন মরে যাব।”
কিন্তু মায়ের কান্নার মধ্যেও সকলেই আনন্দে হাসতে লাগল। গোগোল মায়ের সঙ্গে বাংলোর বসবার ঘরে এল।
জয়ন্তদা বন্দুকটা দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে বললেন, “এবার বলো তো গোগোল, ওই ভয়ংকর বুনো দাঁতাল হাতিটা তোমাকে কী বলল?”
গোগোল বলল, “কী আবার? ও নিজে এসে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করল, আর বেড়াতে নিয়ে গেল।”
জয়ন্তদা অবাক চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, এখন থেকে বুনো হাতিদের সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে।”
বাবা কিছুই বললেন না। তিনি এমনভাবে গোগোলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না, গোগোল ফিরে এসেছে।
১৩৮৪
অলংকরণ, সুধীর মৈত্র
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন