পৌলোমী সেনগুপ্ত
সেদিন ওঁদের বাড়ি যেতেই এক তুলকালাম কাণ্ডের মধ্যে পড়লাম! এমন হুলস্থূল বাধিয়েছেন হর্ষবর্ধন!
পাহাড়-প্রমাণ দাদা মূষিকের ন্যায় ভায়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এই মারেন কি সেই মারেন।
আমি গিরি আর গোবর্ধনের মাঝখানে গিয়ে পড়লাম—দাঁড়ান দাঁড়ান, করছেন কী? আপনার চাপে চ্যাপটা হয়ে যাবে যে ভাইটা!
চ্যাপটা! ওকে আস্ত রাখব আমি? ওরই একদিন কি আমারই একদিন! খতম করব ওকে—ওর ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিয়ে যদি আমার ফাঁসি যেতে হয় সেও ভি আচ্ছা! কিন্তু ওকে আমি ছাড়ছি না!
ভুঁড়ি যে ফাঁসাবেন, ভুঁড়ি কোথায় ওর! আমি বাধা দিয়ে বলি—আপনার মতন ওর ভুঁড়ি গজিয়ে দিন আগে তারপর তো? তবে না ফাঁসাবার মজা!
নাঃ! আর নয়! তদ্দিন আমার সবুর সইবে না। ওকে ছাড়ব এবার জন্মের মতোই—আজই আমাদের কাটান ছেড়ান!
অ্যাঁ, কী বললেন! গোবরচন্দরকে ছাড়বেন বলছেন? শুনেই আমি চমকাই।
হ্যাঁ হ্যাঁ। জন্মের মতোই ছাড়ব ওকে বলছি তো! না হলে আমার শান্তি নেই।
বললাম। কী বলছেন মশাই! ও কথা কি বলতে আছে? আপনি কি গোরু যে গোবর ছাড়বেন?
গোরু কেন, গোরুর অধম। আমি মোষ। মোষেরও অধম, আমি উট। উট না হলে এমন উটকো ভাই জোটে আমার! আপনি এসে বাগড়া না দিলে এতক্ষণ ওর এসপার ওসপার হয়ে যেত। আপনি এসেও কিছু বাঁচাতে পারবেন না। আমি ওকে ত্যাজ্যপুত্তুর করে দিলাম। আমার বিষয় আশয় কিছু ওকে দেব না।
কে চাইছে! মাঝখান থেকে গোবরা গোঙায়: চাইছে কে তোমার বিষয় আশয়? আমি কি সেই আশায় বসে আছি?
না চাস নাই চাস ত্যাজ্যপুত্তুর হয়ে গেলি— ব্যাস!
বয়েই গেল আমার!
ছি ছি ছি! আপনি বলছেন কী! অমন কথা কি কইতে আছে? ভাই কি ছেলে যে তাকে ত্যাজ্যপুত্তুর করবেন? এমন অশাস্ত্রীয় কথা মুখে আনে কখনও?
অশাস্তর কোনখানে? রামায়ণ কি আমাদের শাস্তর নয়। রামচন্দ্র কি লক্ষ্মণকে বর্জন করেননি? আমিও আমার দুর্লক্ষণটিকে বর্জন করলাম। বলে তিনি হাঁফ ছেড়ে চৌকির ওপর বসলেন।
এত রাগ কীসের জন্যে? বলি, হয়েছেটা কী? আমি শুধাই।
কাল রাত্তিরে এই ঘর থেকে আমার যথাসর্বস্ব চুরি গেছে। আর এই ঘরে ও ঘুমোচ্ছিল!…রাগে গর গর করতে করতে তাঁর গর্জন।
ঘুমোলে তো মানুষ মড়া! তখন কি কারও কোনও হুঁস থাকে নাকি? গোবরা ভায়ার দোষটা কোথায় দেখছিনে তো৷
ও বলছে ও তখন জেগে। চোরটা ঢুকতেই ওর ঘুম ভেঙে গেছল। চোখ পিট পিট করে দেখেছে সব আগাগোড়া। তবু তাকে পাকড়ায়নি, কোনও বাধা দেয়নি…
তাই নাকি? তা, যথাসর্বস্বটা গেল কী আপনার?
ডজন খানেক ল্যাংড়া আম এনে রেখেছিলাম। ওই ফ্রিজেই ছিল, আধসেরটাক রাবড়িও ছিল সেইসঙ্গে। আজ সকালে উঠে সেগুলির সদগতি করব রাবড়ি দিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে খাব আমগুলো…রাতারাতি সব ফাঁক!
সকালে উঠে দেখি কিনা সব বিলকুল লোপাট!
আর টাকাকড়ি কী গেল?
টাকাকড়ি কিছু যায়নি। টেবিলের ওপর আমার শখের ডটপেনটা ছিল, সেটা উধাও।
এই আপনার যথাসর্বস্ব? শুনে বলতে কী আমার হাসি পায়।
নয়? কী বলছেন! রাবড়ি দিয়ে যদি ল্যাংড়া আম কখনও খেয়ে থাকেন তো বুঝবেন জীবনের সর্বস্বই তাই। আর ডটপেনটা, আমার বুক পকেটে শোভা পায়, ওটাও কিছু অযথা নয়।
যান যান, বাথরুমে যান। চানটান করে ঠান্ডা হোন গে।
হর্ষবর্ধনকে ভাগিয়ে দিয়ে আমি গোবর্ধনকে নিয়ে পড়লাম—
কী গোবরাভায়া? চোর যখন ঘরে তোমার ঢুকেছে তুমি নাকি তখন জেগে ছিলে? সত্যি?
চোর কোথায়! পাড়ার ছেলে তো? আমার চেনা ছেলে। যখন এল রাত তখন তিনটে।
রাত তিনটে! অবাক কাণ্ড তো। মানে চোরের বেলায় হয়তো বিস্ময়কর কিছু নয়। কিন্তু কোনও পাড়ার ছেলের অমন অসময়ে আসাটা…
সব সময়ই তো আসে ওরা। সময়-অসময় বলে কিছু নেই ওদের। আমার কাছে আসে। এই ঘরেই আসে…
কিছু বললে না তুমি তাকে?
কী বলব? ও-ই তো বলবে! ও কিছু বলল না, আমিও কোনও রা কাড়লাম না! কারও গায়ে পড়ে কথা বলতে যাব কেন? চোখ পিট পিট করে দেখতে লাগলাম কী করে?
চোখ পিট পিট করে?
হ্যাঁ। চোখাচোখি হয়ে গেলে যদি সে লজ্জায় পড়ে যায়? চক্ষুলজ্জা বলে একটা জিনিস নেই! আমিও তাই প্রায় চোখ বুজে ছিলাম। দেখছিলাম, কী করে?
কী করে মানে? অমন সময়ে চুরি করতে এসেছে তা বুঝতে পারনি? চোখ পিট পিট করে দেখছিলে কী করে সে? ঘটিটা নেয় কি বাটিটা নেয়? দেখছিলে?
হ্যাঁ, দেখছিলাম যে কী করে ছেলেটা?
কী করল দেখলে?
দেখলাম গুটি গুটি ঢুকেই না, কোনওদিকে না তাকিয়ে সে প্রথমেই ফ্রিজটা খুলল। খুলে তার ভেতরে যা খাবারদাবার ছিল বার করল সব। কেক পুডিং সন্দেশ আইসক্রিম—যা ছিল। তারপরে রাবড়ি আর ল্যাংড়া আমগুলো নিয়ে বসল। রাবড়ি আর আম দিয়ে চেটে পুটে খেয়ে শেষ করল সব। আঁটিগুলো খায়নি, নিয়েও যায়নি। ফ্রিজের মধ্যে রেখে দিয়ে গেছে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে। ভাঁড়টাও রেখেছে সযত্নে।
তা, এত কাণ্ড সে করল। তুমি চেয়ে চেয়ে দেখলে সব? নাকি, চোখ বুজে বুজেই দেখেছ। তাকে বাধা দিলে না একদম?
বাধা দেব কেন? খাবার জিনিস খেয়েছে তো। ছেলেদেরই খাবার। ওই আইসক্রিম, চকোলেট, কেক, পুডিং ছেলেরাই খায়—বাধা কীসের!
শুধু তাই? তোমার দাদার আমগুলো…
হ্যাঁ, তাও সব সাবড়ে গেছে। পাড়ার ছেলেরা কি আম খেতে পায় নাকি? ল্যাংড়া আম চোখেই দেখতে পায় না। ওদের বাড়ি সাত দিনে একদিন মাছ আসে আমি জানি। তাও আবার চুনো মাছ আর কুচো চিংড়ি—সেই রোববার! খেতেই পায় না বেচারারা।
আহা! ওর সঙ্গে আমারও সহানুভূতি জানাই!
আহা বলছেন, আহারের বাহারটা যদি দেখতেন ওর! আমি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো পিট পিট চোখে চেয়ে ছিলাম, চোখের পলকে ফ্রিজ ফাঁক! গোগ্রাসে শেষ করে দিল সব। কত দিন যেন কিছু খায়নি বেচারা!
চক্ষের পলকে ফ্রিজ ফাঁক?
সত্যি পেট ভরে খেতে পায় না বেচারারা। আমার তো ইচ্ছে করে পাড়ার ছেলেদের ধরে ধরে বেশ করে খাওয়াই, কিন্তু পেরে উঠি না, পাছে ওদের মা-বাবারা রাগ করে, পাড়ার লোকেরা কিছু মনে ভাবে—তাই। তা ওরা যদি একেকজন এমনি করে এসে রাত বিরেতে আমাদের ফ্রিজ ফাঁক করে দিয়ে যায়, মন্দ কী? আমি ভাবি, অনেক মেহনত বেঁচে যায় আমাদের।
তবু ভাল যে খেয়েদেয়েই সরেছে, আর কিছু সরায়নি—ভাগ্যি বলতে হয়। টেবিলের ওপর তো তোমার দাদার হাতঘড়ি, দামি পেনটাও ছিল তো— নেয়নি।
নেয় কখনও? ছেলেরা কখনও আজে বাজে জিনিস ছোঁয় না। তারা কি চোর ছ্যাঁচোড় যে…? ডটপেনটা চকচকে ছিল, নেহাত ওর চোখে ধরেছে নিয়ে গেছে। দু’দিন বাদেই ফেলে দেবে।
তা হলেও আমি বলব, ঘরের মধ্যে তাকে পাকড়ানো তোমার উচিত ছিল ভায়া। আর কিছু না, চুরি করাটা যে খারাপ, ভারী দোষের এই কথাটা— বলবার জন্যেই বলে কয়ে তার পরে ছেড়ে দিতে পারতে তাকে। ধরলে না কেন?
ধরতে পারলে তো! পলটুকে ছুটে ধরতে পারে কেউ? এই তল্লাটের দৌড়ের চ্যাম্পিয়ন সে। পাড়ার পলটনের ক্যাপটেন পলটু। দৌড়ে তাকে ধরার কারও সাধ্য নেই—দেখেছি ওর দৌড়, জানি তো, ওর পেছনে ছুটতে যাওয়া নাহক। চুপ করে শুয়ে রইলাম তাই।
বেশ করেছ। বলে আমি বাড়ির ভেতরে যাই। দেখি যে হর্ষবর্ধন গিন্নির কাছে গিয়ে রান্নাঘরে বসে গরম পরোটার সঙ্গে চা বসাচ্ছেন।
আমিও তার ভাগ বসাতে বসি। পরোটা চিবুতে চিবুতে বলি—জানলাম যা, গোবরের কোনও দোষ ছিল না। জেগে থাকলে কী হবে, সাড়া দিলেই ছোঁড়াটা ভেঙ্গে পড়ত। পলটু ওর নাম, পাড়ার স্পোরটসের চ্যাম্পিয়ন, দৌড়ে তাকে ধরতে পারা গোবরার কম্মো না। তাই সব দেখে শুনেও সে চুপটি করে পড়েছিল, নাহক ছুটতে যায়নি।
পলটু না পটলা—ছোঁড়াটাকে আমি চিনি। জানালেন হর্ষবর্ধন—টিং টিঙে একটা ছেলে। ফিঙের মতন দেখতে। সেই রোগা পটকা ছেলেকে ধরে পটকে ফেলতে না পারাটা অন্যায়। কেন, গোবরা কি দৌড়ের চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না? আমি কি তাকে মানা করেছি কখনও? হতে কী হচ্ছে? কেন পারছে না হতে?
পারবে কী করে? আপনি পারাবেন তবেই না হবে? আপনি অভিভাবক না? আপনি ওকে কলকাতার কোনও চ্যাম্পিয়ন দৌড়বাজের কাছে কোচিং-এ দিন! ক’দিনের মধ্যেই দেখবেন ও একটা দৌড়বীর হয়ে উঠেছে—দেখতে না দেখতেই। তখন কেউ আর ওকে কলা দেখিয়ে আম খেয়ে পালাতে পারবে না।
তাই হল। কলকাতার এক নামজাদা ব্যায়ামবীরের হাতে গছিয়ে দেওয়া হল গোবরাকে।
তিনি রোজ সকালে মোটরে এসে গোবরাকে নিয়ে গড়ের মাঠে চলে যান। দৌড়ের যত কায়দা কসরৎ শেখান। ময়দানে মোটরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ায় গোবরা।
তারপর ফের একদিন! সেই পলটুই এসেছে আবার। রাত বিরেতে নয়, দিন দুপুরেই এবারটা।
এসেই আবদার—গোবরাদা, খিদে পেয়েছে বেজায়। কিছু খেতে দাও।
জামা ঝুলছে আমার ওই! দ্যাখো কী আছে বাঁ পকেটে। নিয়ে কিনে টিনে খাওগে—যা তোমার খুশি।
পরের পকেটে হাত দিতে আছে? ছিঃ! আমি কি পকেটমার?
তা হলে কোথায় কী আছে খুঁজে পেতে দ্যাখো।
কোথায় আছে জানি আমি। ওই ফ্রিজের মধ্যেই…বলতে বলতেই সে ফ্রিজটা খোলে। খুলেই খেতে লেগে যায়।
আস্তে আস্তে খাও। ব্যস্ত হবার কী আছে? দাদা এখন কারখানায়। বউদি ঘুমুচ্ছেন এই দুপুরবেলা। ভয়ের কিছু নেই। হাঁসফাঁস খেতে গিয়ে, সেই কার মতন যেন, গলায় যদি তোমার আটকে যায়— তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়তে পারব না এখন।
খাওয়া-দাওয়া পরিপাটি হবার পর পলটু বলে— এবার তা হলে যাই গোবরাদা।
দাঁড়াও, তোমাকে কিছু বলতে চাই। কিছু শিক্ষা দেব তোমায়।
কী শিক্ষা দেবেন? শিক্ষার কথায় সে রুখে দাঁড়ায়।
চুরি করা বড় দোষ—করিয়ো না বৃথা রোষ— এসব কি পড়োনি তোমার পাঠ্য পুস্তকে? সেই কথাটা তোমাকে বুঝিয়ে বলবার আমার বাসনা।
চুরি করলাম কোথায়? আপনার অনুমতি নিয়ে খেলাম তো।
এখন খেলে। এবার খেলে। কিন্তু বছরখানেক আগে রাত তিনটের সময়… সেই আমগুলো রাবড়ি দিয়ে… আমি কি দেখিনি নাকি? আমার মনে নেই, আমি ভুলে গেছি? সেটা তো চুরি করাই হয়েছিল, হয়নি কি? সেই কথাটাই ভাল করে তোমার মগজে ঢুকিয়ে দিতে চাই আমি। এমনি হয়তো ঢুকবে না, যা নিরেট মাথা তোমার, গাঁট্টা মেরে ঢোকাতে হবে। যেমন হাতুড়ি মেরে পেরেক ঢোকায় তেমনি করে।
আমায় গাঁট্টা মারবেন আপনি? ধরুন দেখি আমায়…গোবরা উঠে বসতে না বসতেই পলটু হাওয়া!
পলটুর পিছু পিছু গোবরাও ছুটেছে। সদর রাস্তা ধরে সবার চোখের ওপর সে এক দারুণ পাল্লা।
দেখতে না দেখতে উভয়েই অদৃশ্য। ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে দু’জনেই উধাও!
খানিক বাদে পলটু ফিরে এল হাঁফাতে হাঁফাতে। একলাই।
গোবরা গেল কোথায়? আমরা শুধোলাম।
কে জানে! যা ছুটছে না। দেখলে মাথা ঘুরে যায়!
পাকড়ায়নি তোমাকে?
কোথায়! আমাকে ধরে ফেলেছিল তো। কিন্তু ধরল না। পাশাপাশি ছুটতে লাগল আমার। খানিকক্ষণ। তারপর ছুটে বেরিয়ে গেল বুলেটের মতোই।
পাকড়াল না?
পাকড়াতে পারল না বোধহয়। থামতে পারল না। থামাতে পারল না—ওই রামছুট। মিলখা সিংকে টেক্কা মারে এমনি দৌড় না!
কে জানে! এতক্ষণ বারাসাত-বসিরহাট ছাড়িয়ে বাংলা মুলুকে গিয়ে পড়েছে বোধহয়।
তা কি পারে? কাস্টমসের ফাঁড়িতে পাকড়াবে— আমাদের পুলিশ কিংবা ওদের পুলিশ, চেক না করে ছাড়বে না।
পারলে তো চেক করবে। যা দৌড়বাজ হয়েছে না! আমি তো অবাক।
হর্ষবর্ধনও হতবাক। দেখুন তো, কী সর্বনাশ হল আমার। আপনার কথায় ব্যায়ামবীর বানাতে গিয়ে কী বিড়ম্বনায় পড়লাম।
আমি আর কী সান্ত্বনা দেব তার! বললাম, দেখুন, কী হয়। থানায় গিয়ে জানাই এখন।
লালবাজারে গেলাম দু’জনাই।
অফিসারকে গিয়ে বলতেই তিনি কনট্রোলে গিয়ে দিগ্বিদিকে বেতারে খবর নিতে লাগলেন।
হ্যাঁ, একজন যুবক চেকপোস্ট পার হয়ে গেল এইমাত্র। তাকে থামানো যায়নি। ঢাকার দিকে ছুটছে বোধহয়।
ঢাকার দিকে খবর নেওয়া হল। ঢাকা পার হয়ে গেছে…চাটগাঁর দিকে চলেছে এতক্ষণে।
আমরা বসেই রইলাম থানায়, আহার নিদ্রা নেই। আমি খাবারের জন্য হাঁ, কিন্তু খাওয়াবে কে এখানে! আর উনি গোবরার খবরের জন্য গোমড়া মুখে সামনে বসে।
টেলেক্সে খবর আসতে লাগল ক্ষণে ক্ষণে…
বারমা মুলুকে গিয়ে পড়েছে গোবরা…রেঙ্গুন টেঙ্গুন পার হয়ে গেল। কিছুতেই থামছে না, থামানো যাচ্ছে না, থামতে পারছে না হয়তো সে। খবর আসতে থাকে।
বর্মা পেরিয়ে সিঙ্গাপুরের দিকেই এখন!
ছুটতে ছুটতেই পড়ে মরবে না তো? শিঙে ফুঁকে বসবে না তো কখন। আমার ভয় হয়।
দিন তিনেকের পর দক্ষিণ উত্তর ভিয়েতনাম বিলকুল পার। আনাম কাম্বোজ পেরিয়ে চিনের সীমান্তে।
কী সর্বনাশ!
দু’জন বিদেশি সাংবাদিক স্কুটার নিয়ে ছুটছেন ওর পাশাপাশি—খবর জানবার খাতিরে…
সে বলেছে, আমি থামব না, থামতে পারব না। আমি পৃথিবী চককর দিতে চলেছি। পৃথিবীটাকে এক চক্কর দেখে নিতে চাই…ছুটতে ছুটতেই বলে গেছে সে।
দৌড়ের চক্করে দৌড়বাজির কী চক্রান্তে পড়ল বেচারা! ব্যায়ামবীর হওয়ার কী বিড়ম্বনা!
এর হেতু কি অধম এই চকরবরতি দায়ী? অনুতাপ হতে থাকে আমার।
এতক্ষণে দুনিয়া জুড়ে সব খবর কাগজে নাম ছাপা হচ্ছে, ছবি ছাপা হচ্ছে, আপনার গর্বের কথা হর্ষবর্ধনবাবু! পৃথিবী পরিক্রমায় বেরিয়েছে সে। দৌড়ের পরাক্রম না দেখিয়ে ছাড়বে না। আমি ওঁকে অভিনন্দনের সুরে সান্ত্বনা দিতে যাই।
আমার সান্ত্বনায় উনি ভ্যাক করে কেঁদে ফেলেন।
আমার ভাইটাকে হারালাম। জন্মের মতোই। কী সর্বনাশ যে হল আমার!…
আপনি ওকে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন একদিন। ও-ই এখন আপনাকে ত্যাগ করে গেল! কোথায় গেল…কোথায় যাচ্ছে কে জানে।
হর্ষবর্ধন গুম হয়ে শোনেন, তাঁর এ গুমোট বুঝি এ জীবনে কাটবার নয়।
কিন্তু তার আমাকে ছেড়ে যাবার কথা ছিল না…। তিনি গুমরে ওঠেন হঠাৎ… রামায়ণে এমন তো লেখেনি। লক্ষ্মণ কি রামকে ছেড়ে গেছে কক্ষনো? আমার দুর্লক্ষণ আমায় ছেড়ে চলে গেল…ভেউ ভেউ ভেউ!
হাউমাউ করে কাঁদেন তিনি।
এদিকে খবর আসতে থাকে টেলেক্সে—
ইন্ডিয়ান স্পোর্টসম্যান গাবারডান, ব্রাদার অব মিস্টার হাবারডান হ্যাজ রিচড সাংহাই!
খবরটা শুনেই তিনি মূৰ্ছিত।
সাংহাই! কী সাংহাতিক!
১৩৮০
অলংকরণ: অলোক ধর
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন