পৌলোমী সেনগুপ্ত
এক বুড়ো এক বুড়ি। দু’জনে গলায় গলায় ভাব। আবার দু’জনে যখন ঝগড়া হয়, তখন তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। গাঁয়ের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা বাড়িতে ওরা থাকে। পাড়ার কারও সঙ্গে মেশে না, কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। মাস গেলে বুড়ো পেনশন পায়, তাইতেই ওদের চলে যায়।
একদিন বিকেলবেলা বারান্দায় একা একা বসেছিল বুড়ো, হঠাৎ খুব আলুর চপ খেতে ইচ্ছে হল। বুড়িকে ডাকল, “হ্যাঁ গো, শুনছ?”
“কী হল?” বুড়ি তখন ঘরের ভেতর বসে পান থেঁতো করছিল। দাঁত তো নেই, থেঁতো না করে খাওয়া যায় না।
“একটু শুনে যাও না গো?”
“আ মরণ, কী হয়েছে বলবে তো! আমি এখন উঠতে পারব না।”
“অনেকদিন আলুর চপ খাইনি, বড় খেতে ইচ্ছে করছে। বানাও না কয়েকটা, দু’জনে বসে গল্প করতে করতে খাই।”
“ও মা, দুপুরেই তো আজ পেঁয়াজ-বড়া খাওয়ালাম, ভুলে গেলে! সারাদিন অত খাই খাই আমার ভাল লাগে না। এখন আমি কিচ্ছু করতে পারব না।”
“আহা, রাগ করো কেন! চপ বানালে আমি তো আর একা খাব না, তুমিও তো খাবে।”
বুড়ি মুখঝামটা দিল, “আমার দরকার নেই খাওয়ার। তুমি বাজার থেকে কিনে এনে খাও।”
“বাজারের চপ আর বাড়ির চপ এক হল! বাজারে তো বাসি-তেবাসি, কত মাছিটাছি বসে থাকে সেখানে। তা ছাড়া বাড়ির চপের স্বাদই আলাদা।”
বুড়ি খিটখিট করে উঠল, “কী পেয়েছ তুমি, যখন যা হুকুম করবে, তাই করতে হবে? আমি পারব না। খেতে হয় তুমিই বানিয়ে খাও গে যাও।”
বুড়োর মাথাটা একটু একটু করে গরম হয়ে উঠতে শুরু করল, “আমি বানিয়ে খাব, বাহ, বেশ বললে যা হোক। ঘরের গিন্নি বসে বসে পান চিবোবে, আর কর্তা হাতা-খুন্তি নেড়ে চপ ভাজবে। তোমার লজ্জা করে না এ-সব বলতে?”
বুড়িও কথায় কম যায় না, “কেন, লজ্জা করবে কেন! কর্তা হয়েছ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছ নাকি! সারাদিন বাড়িতে বসে বকবক করতে পারো, আর হেঁসেলে যেতে পারো না?”
“কী? আমি বকবক করি, আর তুমি বকবক করো না?” বুড়ো লাঠি ঠুকে ঠুকে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।
বুড়ি থেঁতো পান মুখে পুরল। হাম হাম করে চিবোতে লাগল। যেন গ্রাহ্যই নেই।
“তার মানে তুমি চপ বানাবে না?” বুড়ির ভাবভঙ্গি দেখে রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল বুড়োর। কটমট করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বিড়বিড় করে বলল, “ঠিক আছে, বানিয়ো না। তোমার হাতের রান্না আর আমি কোনওদিন খাব না। এ-বাড়িতেই আর আমি থাকব না। আমি চললাম।”
বুড়ি পান চিবোতে-চিবোতেই বলল, “যাবে কোথায় শুনি? তোমাকে আমি চিনি না নাকি, আবার যখন খাওয়ার সময় হবে, গুটি গুটি তো এখানেই আসতে হবে। যাও যাও যেখানে যাবে যাও!”
এ-কথা শুনে বুড়ো আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না, দুপদাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। বেরিয়ে বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে একেবারে রাস্তায়।
বিকেলবেলা রোদের তেজ ছিল না। ফুরফুর করে বাতাস বইছে। দুটো-একটা পাখি এ-গাছ থেকে ও-গাছে উড়ে গিয়ে বসছে। রাস্তার উলটো দিকে মাঠমতো। দু’-একটা গোরু ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছে। এই মাঠের ভিতর দিয়ে হেঁটে নদীর দিকে যাওয়া যায়। জায়গাটা খুব নির্জন। বুড়ো ভাবল, নদীর দিকটা ভাল। ওদিকেই যাওয়া যাক।
লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটতে লাগল বুড়ো। রাগে-দুঃখে মনের ভেতরটা কেমন যেন গুমরে গুমরে উঠতে লাগল। কী হবে আর বেঁচে থেকে। বাড়ির গিন্নিই যদি তার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করে, কী লাভ তা হলে বেঁচে থাকার! না, বাড়িতে আর ফিরে যাওয়া যায় না, জীবন থাকতে আর ওখানে ফিরবে না সে।
পাশাপাশি দুটো হিজলগাছ, সরসর করে একটা কাঠবেড়ালি একটা গাছ থেকে নেমে আর-একটা গাছে উঠে পড়ল। বুড়োর মনে হল, কী সুন্দর নিশ্চিন্তে বেঁচে আছে কাঠবেড়ালিটা। বউয়ের মুখঝামটা শুনতে হয় না। যখন যা খুশি করতে পারে। যখন যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে। “হে ভগবান, আগামী জন্মে যেন কাঠবেড়ালি হই। আর যেন বুড়ির মুখ দেখতে না হয় আমায়।”
অথচ সারাটা জীবন বুড়ির জন্য কতকিছু না করেছে ও। শাড়ি, গয়না কিনে দেওয়া থেকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাওয়া, সার্কাস দেখাতে নিয়ে যাওয়া, যখন যা চেয়েছে কোন জিনিসটা এনে দেয়নি বুড়িকে! আর আজ প্রতিদানে কিনা এই ব্যবহার! নাহ্, আত্মহত্যা করাই ভাল। এ-সংসারের এত গঞ্জনা-লাঞ্ছনা সহ্য করার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল।
কেমন যেন কান্না পেতে শুরু করে বুড়োর। কান্নার আবেগে শরীরটা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। নাহ্, একটু বসাই যাক। আরও খানিকটা এগিয়ে একটা ঝাপড়ানো আমগাছ। বুড়ো আমগাছটার নীচে এসে বসে পড়ল। বসে হাঁ করে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। বুড়িকে শায়েস্তা করতে হলে আত্মহত্যা ছাড়া আর পথ নেই। কিন্তু কীভাবে আত্মহত্যা করা যায়। গলায় দড়ি দিলে মন্দ হয় না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভাবল, দড়ি কোথায় পাব? দড়ি আনতে হলে তো বাজারে যেতে হবে। পয়সাকড়ি কিছুই সঙ্গে নিয়ে বেরোয়নি। বিনে পয়সায় দড়ি চাইলে দেবে কেন দোকানদার। তা ছাড়া হঠাৎ দড়ি আনতে গেলে তো সন্দেহও করতে পারে! নাহ্, গলায় দড়িটড়ি দেওয়া হল না এ-যাত্রা! অন্য কিছু ভাবতে হবে।
বুড়ো ছলছল চোখে ভাবতে লাগল, লোকে আর কী-কী ভাবে আত্মহত্যা করে! বিষ খায়! জিভের ডগায় একটু বিষ ছোঁয়ায়, তারপর মরে যায়! ব্যাপারটা খারাপ না। এই গাছতলায় বিষ খেয়ে যদি সে মরে পড়ে থাকে তো খুব ভাল হয়। মনে মনে খুব উৎসাহ পায় বুড়ো। কিন্তু একটু পরেই মনটা কেমন আবার দমে আসে, বিষ কোথায়! বিষ থাকলে তো খাওয়া। বিষ আনতে গেলেও তো বাজারে যেতে হবে। আবার সেই ঝামেলা।
নাহ্, বিষ খাওয়াও হবে না। বরং রেললাইনে মাথা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রেললাইন মানেই তো সেই স্টেশন। ওরে বাবা, সে কি এখানে নাকি! হেঁটে গেলে পাক্কা তিন মাইলের পথ। অবশ্য মাইলখানেক হাঁটলে বাস রাস্তা পাওয়া যায়, সেখানে গিয়ে বাসে চড়েও যাওয়া যায়। কিন্তু সেখানেও তো সেই একই প্রশ্ন, বাসে উঠলেই তো পয়সা চাইবে। তা ছাড়া চেনাশোনা কারও সঙ্গে দেখা হলেই তো জিজ্ঞেস করবে, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি?
না বাবা, রেলেও গলা দেওয়া যাবে না। তা হলে! বুড়ো ছলছল চোখে ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে একসময় মনে হল, এতক্ষণ ছাই বোকার মতো কীসব ভাবছি! জলে ডুবে মরাই তো সবচেয়ে সোজা রাস্তা। নদীতে গিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তেজনায় আবার উঠে দাঁড়ায় বুড়ো। নদীর দিকেই তা হলে যাওয়া যাক। সেখানে গিয়ে সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপর খাবি খেতে খেতে নদীর মধ্যে ডুবে যাবে। তারপর তার মৃতদেহ জলে ভাসতে ভাসতে কোথাও না কোথাও চলে যাবে, কেউ টের পাবে না, বুড়িও টের পাবে না। কী মজা! বুড়ো হাততালি দিয়ে উঠে আবার হাঁটতে শুরু করে নাক বরাবর নদীর দিকে। কিন্তু এখান দিয়ে কোনও রাস্তা নেই। উঁচু-নিচু এবড়ো-খেবড়ো, কোথাও জঙ্গল, কোথাও আবার ইট-পাথর ছড়ানো।
তা হোক, কিচ্ছু পরোয়া করে না বুড়ো। যত বাধাই আসুক, সবকিছু অবহেলা করে হাঁটতে থাকে। আর হাঁটতে হাঁটতে একসময় নদীর ধারেই চলে আসে।
তখন অল্প অল্প করে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। নদীর ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি গাছগাছালির দিকে ছুটে চলেছে। মাঝনদী দিয়ে একটা নৌকো বয়ে চলেছে দেখতে পেল বুড়ো। পালতোলা। কী নিশ্চিন্তভাবে বয়ে যাচ্ছে নৌকোটা। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। চোখে পড়ল নদীর ধার ঘেঁষে একটা লিকলিকে নারকেলগাছ হেলে আছে নদীর দিকে। মাথাটা বাজ-পোড়া। বাজ-পোড়া গাছ বলেই কোনও পাখিটখির নজর নেই এদিকে।
বুড়ো গাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। নদীর জল ছলাত-ছলাত করে ছুটে চলেছে। আর-একটু পরেই তো এই স্রোতের সঙ্গে মিশে এক হয়ে যাবে সে। বুড়ি টের পাবে না, কেউ টের পাবে না। সামান্য কিছু আলুর চপ খেতে চেয়ে কী এমন দোষ করেছিল, যার জন্য আজ তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হল। এই নদীর জলেই এখন তাকে ডুবে মরতে হবে। বলে কিনা খিদে লাগলে আবার আমি ফিরে যাব। কক্ষনও না, আর কোনও দিনই যাব না, মুখই দেখব না বুড়ির।
লাঠিটা একপাশে রাখল বুড়ো, তারপর গাছ থেকে সরে এসে নদীর জল ছোঁয়ার জন্য নীচে নামল। আহ্, জলটা কী ঠান্ডা। আঁজলা ভরে চোখেমুখে জল ছিটোল। তারপর নদীর দিকে চোখ রেখে বিড়বিড় করে বলল, “আর দেরি কেন, দিই না লাফ!”
কিন্তু লাফাতে গিয়েও পারল না। হুট করে এভাবে কখনও লাফানো যায়! জলের ধারে পা ভাঁজ করে একটু বসল। চারপাশটা ততক্ষণে বেশ অন্ধকার হয়ে উঠেছে। নদীর ওপারটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠেছে। বহু দূরে দূরে দুটো-একটা করে আলো জ্বলে উঠেছে। আকাশের দিকে তাকাল, আকাশে দুটো-চারটে করে তারা ফুটতে শুরু করেছে। সব কেমন নিস্তব্ধ।
নাহ্, মরতে যখন হবেই তখন আর দেরি করে লাভ নেই। বুড়ো আবার জলের দিকে এগোল, ঝুঁকল। কিন্তু পায়ে একটা পোকা কামড়াতেই লাফাতে পারল না। আরও রাত বাড়তে শুরু করল, আকাশে আরও তারা ফুটতে শুরু করল।
বার বার তিন বার। এবার লাফ দেবেই। ঝুঁকল আবার। কিন্তু এবারও পারল না। একটা বাদুড় না কী পাখি যেন মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
বিরক্ত হয়ে আবার নারকেলগাছটার কাছে ফিরে এল বুড়ো। আর এ-সময় তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল, লাফ যদি দিতেই হয়, এভাবে হবে না। বরং নারকেলগাছটার মাথায় যদি ওঠা যায়, ওখান থেকে টুপ করে জলে পড়ে গেলেই তো হয়। লাফ দিতে হবে না, শুধু একটু হাত-পা আলগা করলেই, ব্যস। একদম জলে। তারপর…
যা ভাবা তাই কাজ। বুড়ো শক্ত করে মালকোঁচা মেরে নিয়ে গাছে ওঠার জন্য এগোল। গাছটা বেশ সরুই। শক্ত করে ধরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে একবার ডগার দিকে উঠে পড়তে পারলেই হল। আর পায় কে ওকে।
গাছ বাইতে শুরু করল বুড়ো। কিন্তু শরীরে অত জোর নেই যে, তরতর করে উঠবে। একটু একটু ওঠে, আর হাঁপাতে থাকে। হাত-পা ছড়ে যেতে থাকে। তা যাক, মরতেই যখন হবে তখন একটু কেটেকুটে গেলে কীই-বা এমন ক্ষতি!
কোনও কষ্টকেই আর গ্রাহ্য করে না বুড়ো। হেঁচড়ে-হেঁচড়ে আরও উপরে ওঠে। আরও! শেষে একেবারে গাছটার মাথার কাছেই চলে আসে।
মাথার কাছে আসতেই আবার অন্য ব্যাপার। বুকের ভেতর ঢিব-ঢিব করে উঠল বুড়োর। ওরে বাবা, গাছটা কত উঁচু রে বাবা! আগে জানলে কে উঠত এখানে! ওদিকে নদীর জলটাও যেন কত নীচে। এত ওপর থেকে পড়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে! ভীষণ ভয় ভয় লাগতে থাকে বুড়োর। প্রাণপণে গাছটার মাথার দিকটা শক্ত করে দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল। না বাবা, দরকার নেই আমার এভাবে মরার। নেমে পড়াই ভাল। কিন্তু নামবে কী করে, এখান থেকে নামা কি সোজা নাকি! “ও মা গো, কী হল গো! আমার কী হবে গো! জীবনে যদি আর কখনও আলুর চপ খেতে চেয়েছি আমি!”
বুড়ো ততক্ষণে বেশ বুঝে গেছে, গাছে ওঠা যত সহজ নামা তত সোজা নয়। নামতে গেলেই পা হড়কায়। না বাবা, বাহাদুরি দেখিয়ে লাভ নেই। আর-একটু অপেক্ষা করা যাক। নদী দিয়ে কোনও নৌকো-টৌকো গেলে চিৎকার করে বরং মাঝিদের ডেকে অবস্থাটা বোঝানো যাবে। বলা যাবে, ‘কোনও মইটই এনে আমাকে একটু দয়া করে নামিয়ে দেবে গো? বড় বিপদে পড়ে গেছি।’
মাঝিরা তো খুব ভালমানুষ হয়, নির্ঘাত ওরা নামিয়ে দেবে বুড়োকে। তারপর তেমন বুঝলে মাঝিদের সঙ্গেই নৌকোয় ভাসতে ভাসতে কোথাও-না-কোথাও চলে যাওয়া যাবে। মরতেই যে হবে, এমন কী কথা! বাড়ি না ফিরলেই তো হল। বাড়ি না ফিরলেই বুড়ি কেঁদেকেটে আর কূল পাবে না।
“না, মরব না। মরব কেন; বুড়ি কী বলল না বলল, তাতেই আমিই-বা প্রাণ বিসর্জন দেব কেন! তার চেয়ে বুড়িই মরুক না।”
কোমর থেকে ধুতির কাছাটা খুলে কোনওক্রমে গাছটাকে সে জড়িয়ে নিজেকে বেঁধে ফেলল। যাক বাবা, এবার আর পড়ে মরার ভয় রইল না। এবার একটু হাত-পা নাড়া যাক। বুকের কাছটা জ্বালা-জ্বালা করছিল। হাত বুলিয়ে নিল বুকের ওপর। তারপর আবার নদীর দিকে তাকাল। অন্ধকারে স্পষ্ট করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোনও নৌকো-টৌকো তো দূরের কথা, নীচে যে জল রয়েছে, তাও ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না। ওদিকে ডাঙার দিকে আরও অন্ধকার। আকাশে বিজবিজ করছে অনেক তারা, চাঁদ নেই। এটা কি অমাবস্যা নাকি রে বাবা! কে জানে আজ কোন তিথি!
হয়তো অমাবস্যাই। একে অমাবস্যার রাত, তাতে এই অন্ধকার। না জানি গাছের মাথায় সারাটা রাত আজ এভাবেই কাটাতে হয়। না জানি কোনও গেছো-ভূত এসে একসময় ঘাড়টা ওর মট করে ভেঙে দিয়ে যায়। ‘হে ভগবান, শেষ পর্যন্ত কি ভূতের হাতেই আমার মৃত্যু ছিল। এই লেখা ছিল আমার কপালে!’
রামনাম জপতে শুরু করে বুড়ো। জপতে জপতে কতক্ষণ যে পার হয়ে গেল, হিসেব নেই। হঠাৎ চমকে উঠল। দূরে কোথায় যেন একদঙ্গল মানুষ চেঁচাচ্ছে। একটু কান পেতে থাকে বুড়ো। সেরকমই যেন মনে হচ্ছে। তবে কি খুঁজতে বেরোল নাকি সবাই! হয়তো বুড়িরই কারসাজি এটা। ঘরে ফিরছি না দেখে বুড়িই হয়তো লোকজন লেলিয়ে দিয়েছে ওর পেছনে।
সঙ্গে সঙ্গে আবার ভীষণ রাগ হল তার। ‘না কিছুতেই ফিরব না। পায়ে ধরে সাধাসাধি করলেও ফিরব না। সামান্য কয়েকটা আলুর চপ খাওয়াতে পারে না, তার কাছে আবার ফেরা কীসের।’
লোকগুলোর চেঁচামেচি আরও এগিয়ে আসছে। যেন তার নাম ধরেই চেঁচাতে-চেঁচাতে আসছে। ওদিকে জঙ্গলের দিকে টর্চের ফোকাস দেখা গেল কয়েকবার। হয়তো তাকেই খুঁজছে। খুঁজুক। টুঁ শব্দটি করবে না সে। গাছের এই ডগা থেকে একচুলও নামবে না সে। কোনওদিনও না। দেখি না কে তাকে নামাতে পারে গাছ থেকে!
হ্যাঁ, লোকগুলো বুড়োর নাম ধরেই চেঁচাচ্ছে, “ও বুড়োকর্তা, তুমি কোথায় গেলে গো?”
বুড়ো গ্রাহ্যই করল না, চেঁচাক, মরুক চেঁচিয়ে।
লোকগুলো ততক্ষণে আরও অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। “ওহে বুড়োকর্তা, কোথায় তুমি লুকিয়ে আছ? বাড়িতে গিয়ে দ্যাখো, তোমার প্রাণের বুড়ি কত কান্নাকাটি করছে।”
কান্নাকাটি না ছাই। বুড়ো সব বোঝে। বুড়িটাই হয়তো এ-সব কথা বলার জন্য ওদের শিখিয়ে দিয়েছে। বুড়িটাকে হাড়ে হাড়ে চেনে সে।
চুপটি করে গাছের মাথায় বসে থাকে বুড়ো। লোকগুলোর কাণ্ডকারখানা দেখতে থাকে। মরুক খুঁজে। টুঁ শব্দটিও করবে না সে।
আরও খানিকটা সময় পার হয়ে যেতেই কে একজন যেন গাছের দিকে ফোকাস মারল। মেরেই লোকটা চিৎকার করে এগিয়ে এল, “ওমা, তুমি এখানে? কী সর্বনাশ, ওখানে কেউ ওঠে! টুপ করে পড়ে যাবে যে! মরার ভয় নেই দেখছি।”
বুড়ো কথা বলে না।
লোকটা চেঁচাতে শুরু করতেই আরও অনেকে ছুটে এল, “আই বাপ! ও বুড়োদাদু, তুমি ওখানে কী করছ?”
বুড়ো বলল, “যাই করি না কেন, তোদের কী?”
“আমাদের কী মানে, বাড়িতে তোমার গিন্নি কান্নাকাটি করছে আর তুমি বাপু ওখানে বসে হাওয়া খাচ্ছ!”
“বেশ করছি, আমার ইচ্ছে আমি হাওয়া খাব। তোদের কী রে?”
কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, “আমাদের কী মানে, তুমি এসে এখানে বসে থাকবে, আর আমরা চুপ করে থাকব। নামো বলছি, শিগগির নামো।”
“না, নামব না।”
“নামবে না, তার মানে তুমি চাইছ আমরা তোমাকে ঘাড় ধরে নামাই, তাই না?”
ওপাশ থেকে একজন গলার স্বর নরম করে বলল, “কেন দাদু ঝামেলা করছ? রাত অনেক হয়ে গেছে, এবার বাড়ি চলো।”
বুড়ো বলল, “বাড়ি যাব কি যাব না, সেটা আমি বুঝব। তোদের কী রে? তোরা মরতে এখানে এলি কেন?”
“তবে রে বুড়ো।” ওপাশ থেকেই আর একজন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গাছে ওঠার জন্য এগিয়ে এল।
বুড়ো বলল, “খবরদার, গাছে উঠবে না বলছি। গাছে যদি ওঠো, টুপ করে আমি জলে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করব। টেরটি পাবে তখন।”
লোকটা একটু থমকে গেল। বিশ্বাস নেই বুড়োকে। নদীতে যা স্রোত, একবার ঝাঁপিয়ে পড়লে আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
কী করা যায় তা হলে! এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। একজন বলল, “থাক না, খিদে লাগলেই নেমে আসবে।”
কথাটা মন্দ বলেনি, খিদে লাগলেই নেমে আসবে। এখন শুধু বুড়োকে নজরে নজরে রাখা।
তাই হল! সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে লাগল। কেউ বা ঘাসের ওপর বসে পড়ল, কেউ নদীর জলের ধারে গিয়ে জল নিয়ে খেলা করতে লাগল।
একজন বলল, “বুড়ো কখন নামবে, কে জানে। তাস-টাস নিয়ে এলে খেলা যেত।”
“প্রস্তাবটা মন্দ নয়। তাস-টাস খেললে সময়টা কেটে যাবে।”
তাস আনতে চলে গেল কয়েকজন।
বুড়ো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। আর ভাবছিল, এত লোক এসেছে ওকে নিয়ে যেতে, অথচ সবার আগে যার আসা উচিত ছিল, সেই নেই। মানে বুড়িই নেই। বুড়ি যে আসবে না, সে তা ভালভাবেই জানে! বুড়িকে এ-সংসারে সে ছাড়া আর কেই বা চেনে তেমন করে।
মনে মনে রাগটা আরও বাড়তে লাগল বুড়োর। না, কিছুতেই সে গাছ থেকে নামবে না। বাড়িতেও আর ফিরবে না।
কেবল তাসই না, লুডো, পাশা, ক্যারম, বাগাডুলি অনেক কিছুই এসে গেল! বড় বড় গোটা-চারেক হ্যাজাকও চলে এল। এলাহি ব্যাপার শুরু হয়ে গেল চারপাশে।
তারপর রাত যত ফুরোতে লাগল, আশপাশের গাঁ থেকেও দলে দলে লোক আসতে শুরু করল। এমন এক তুলতুলে বুড়ো নারকেলগাছের ডগায় বসে আছে, এ-দৃশ্য কে না দেখতে চায়। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমাট একটা মেলাই যেন বসে গেল নদীর পাড়ে। তাই দেখে চা-মুড়ির দোকান বসে গেল কয়েকটা। ঝুড়ি মাথায় পুতুল নিয়ে বিক্রি করতে চলে এল কেউ কেউ। ভেঁপু বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাচ্চারা ছুটোছুটি শুরু করে দিল।
ভিড় সামলাবার জন্য ব্যাজ পরে ভলানটিয়ার এসে গেল। লাঠি হাতে ভলানটিয়াররা এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। চিৎকার করে লাঠি নেড়ে ভিড় সামলাতে শুরু করল। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল চারপাশ।
তারপর একটু একটু করে বেলা বাড়তে শুরু করল, রোদের তেজ বাড়তে শুরু করল। তাই দেখে দু’-তিনটে শামিয়ানা খাটানো হয়ে গেল।
দুপুরের দিকে লাল পাগড়ি মাথায় জনাতিনেক পুলিশ এল হেলেদুলে। “কী হয়েছে শুনি? এত লোক কেন এখানে?”
“আজ্ঞে, ওই দেখুন না, বুড়োটা গাছের ডগায় বসে আছে।”
“কেন, কী হয়েছে?”
“ওকেই জিজ্ঞেস করুন কী হয়েছে?”
পুলিশরা এগিয়ে গেল গাছের কাছে, “এই বুড়ো, আর জায়গা পেলে না বাবা, শেষটা কিনা এই গাছের ডগায়?”
বুড়ো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, পুলিশ। হোক না পুলিশ, পুলিশকে সে ভয় পায় না। বলল, “আমার ইচ্ছে আমি এখানে বসে থাকব, তোমাদের কী?
“তবে রে বুড়ো, তোমাকে বসাচ্ছি।” পুলিশদের মধ্যে একজন গাছে ওঠার জন্য তৈরি হতেই চেঁচিয়ে উঠল বুড়ো, “খবরদার বলছি, গাছে উঠবে না। গাছে যদি ওঠো, এখনই আমি নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করব। আমার মৃত্যুর জন্য কিন্তু তোমরাই দায়ী হবে।”
পুলিশটা একটু থমকে গেল। একজন বলল, “ওভাবে বুড়োকে নামানো যাবে না পুলিশ-দাদা, ছেড়ে দিন।”
“তা হলে কীভাবে নামানো যাবে?”
“দেখুন না, আর-একটু বেলা যাক, খিদের চোটে আপনি-আপনিই নেমে আসবে।”
পুলিশরা আর কী করে, শান্তি-শৃঙ্খলা যাতে না ভাঙে, সেইজন্য খানিকটা দূরে একটা গাছতলায় বসে খৈনি টিপতে শুরু করল।
দুপুর গড়িয়ে যেতে শুরু করল, ধীরে ধীরে বিকেল নামতে শুরু করল। বুড়ো তেমনি অনড়। খিদে-তেষ্টাও ভুলে গেল নাকি রে বাবা!
আরও খানিকক্ষণ পর একটা গুঞ্জরন উঠল। কোত্থেকে খবর পেয়ে খবরের কাগজের লোকেরাও ক্যামেরা হাতে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। ফটাফট ছবি তুলতে শুরু করল। একে তাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিল, খাতায় নোট নিতে শুরু করল। তারপর গাছের কাছে এসে বুড়োকে জিজ্ঞেস করল, “ও বুড়ো-দাদু, কী হয়েছে তোমার? গাছে উঠে বসে আছ কেন?”
বুড়ো নীচের দিকে তাকাল, “আমার ইচ্ছে!”
“আহা, অমন ইচ্ছে কেন, তাই তো জানতে চাইছি।”
“তুমি কে হে, তোমাকে বলতে হবে!”
“ঠিক আছে, তা না হয় নাই বললে, কিন্তু কাল সন্ধ্যা থেকে তো তুমি গাছে উঠে বসে আছ, তোমার খিদে পায় না?”
“পেয়েছে তো।”
“খাবে না?”
“খাব তো।”
“তা হলে গাছ থেকে নামো, না নামলে খাবে কী করে?”
বুড়ো বলল, “চালাকি পেয়েছ, এই বলে আমাকে নামাবে, তাই না! আমি নামব না।”
রিপোর্টাররা আরও অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করল বুড়োকে। কিন্তু বুড়ো নাছোড়বান্দা। শেষটায় ওরা আর কী করে, চলে গেল।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতে শুরু করল। বুড়োর শরীরটা যেন ভেঙেচুরে আসতে লাগল। দুপুর থেকেই খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়িগুলো যেন জ্বলছিল। তার উপর ঠায় চব্বিশ ঘণ্টা এভাবে গাছের ডগায় বসে, মাথা ঝিমঝিম করছিল বুড়োর।
আর ঠিক এইসময় আবার বুড়ির কথা মনে পড়ল। বুড়িটা কি সত্যি সত্যি ঘরে বসে বুড়োর জন্য কঁদছে নাকি! বুড়িও বোধহয় চব্বিশ ঘণ্টা না খেয়েই বসে আছে। বুড়োকে যে ও একেবারে ভাল না বাসে এমনও তো নয়। রোজই তো আগে বুড়োকে ও খাওয়ায়, তারপর নিজে খায়। আজও হয়তো তাই হয়েছে। কথাটা ভাবতেই মনটা কেমন যেন নরম হয়ে এল তার।
বুড়ো নীচের দিকে তাকাল, তারপর একটা ভলানটিয়ারকে ডাকল, “ওহে, আমি নীচে নামব। আমাকে নামাতে পারবে?”
সঙ্গে সঙ্গে আরও দশজন এগিয়ে এল, “বুড়ো-দাদু নামতে চেয়েছে, বুড়ো-দাদুর খিদে পেয়েছে।”
সাড়া পড়ে গেল চারদিকে, বুড়ো নামতে চেয়েছে।
বুড়ো এবার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠল, “হাঁ করে দেখছ কী, নামাতে পারবে আমাকে?”
“তুমিই নেমে এসো না ধীরে ধীরে।”
“নামতেই যদি পারতাম, তা হলে তো কাল রাতেই ঝামেলা মিটে যেত। তোমাদের তা হলে দেখতে হত নাকি এ-সব।”
এ-সময় এক কুস্তিগির এগিয়ে এল, “দাঁড়াও আমি নামাচ্ছি। বুড়োকে আমি পিঠে করে নামিয়ে আনছি।” বলতে বলতে লোকটা তরতর করে গাছে উঠে গেল।
চারপাশে হাজার হাজার লোক হাঁ করে তাকিয়ে রইল, কী হয়, কী হয় অবস্থা।
লোকটা বুড়োকে বলল, “আমার গলা জড়িয়ে ধরে পিঠে চেপে বসো। ভয় নেই, ঠিক নামিয়ে দেব তোমাকে।”
বুড়ো তাই করল। তারপর “বোম-বোম মহাদেব” লোকটা ধীরে ধীরে বুড়োকে নিয়ে নীচে নেমে এল।
বুড়ো নীচে নামতেই ছেঁকে ধরল সবাই। ভলানটিয়াররা লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে সরিয়ে দিল সবাইকে।
বুড়োর কোনও কিছুই গ্রাহ্য নেই। নীচ থেকে লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে হাঁটা দিল বাড়িমুখো। যেন কিছুই হয়নি, যেন বেড়াতে বেরিয়েছিল, এখন বাড়ি ফিরছে।
বাড়ি ফিরেই বুড়ির সঙ্গে দেখা। একগাদা আলুর চপ ভেজে বুড়োর জন্য বসে আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে।
বুড়ো ফিক করে একটু কেবল হাসল।
চোখ মুছতে মুছতে বুড়িও একটু হাসল।
পরদিন সকালে আবার হইহই কাণ্ড। পাড়ার ছেলে-ছোকরারা এসে হইচই বাধিয়ে দিল বাড়ির সামনে। দাদুর ছবি ছাপা হয়েছে কাগজে, নাম বেরিয়েছে। বুড়ো-দাদু বিখ্যাত হয়ে গেছে।
সবাই চাঁদা তুলে মালা কিনে বুড়ো আর বুড়ির গলায় পরিয়ে দিল। তারপর একটা সংবর্ধনা সভারও আয়োজন করে বসল।
মালা গলায় বুড়ো আবার ফিক করে একটু হাসল। বুড়িও।
১৩৯৫
অলংকরণ: বিমল দাস
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন