খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু

পৌলোমী সেনগুপ্ত

খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু

ঠিক মাঝরাত্তিরে পটকার মা পটকাকে ডেকে তুলল। পটকেশ্বরের তো ঘুমোলেই বিশ্বভুবন বিস্মরণ! বাঁ কাতে ঠেললে সে ডান কাতে ফেরে, ডান কাতে ঠেললে বাঁ কাতে। গায়ে জল ছিটোলে সে লেপের তলায় সেঁধোয় আর কাতুকুতু দিলে কুকুর কুণ্ডলী হয়ে যায়। মোট কথা, পটকার সঙ্গে পেরে ওঠা অর্থাৎ পটকার ঘুমের সঙ্গে পেরে ওঠা শুধু তার মায়ের কেন, ভগবানের মায়েরও কম্মো না। কিন্তু আপাতত পটকার মায়ের প্রাণের দায়। বারোটার কাঁটা ছাড়িয়ে যায়-যায়। ন্যাড়া ঠাকুরপোর কাছে মান থাকে না। আজ এক হপ্তা ধরে ঠিক হয়ে আছে অমাবস্যার রাতে নেড়ু ওস্তাদের কাছে পটকার হাতেখড়ি। তার জন্য বলে কত হাঙ্গামা, কত পুজো! কত মানত!

বেশি চেঁচাবার তো জো নেই। মাটির দেওয়াল ভেদ করে আওয়াজ ওদিকে গেলেই হল। শেষকালে পটকার মা ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদতে থাকে। পটকার বাপের আমলে তার হাতে থাকত নাকি ঝাঁক-ঝাঁক সোনার বেঁকি চুড়ি। গলায় মটরমালা। শান্তিপুরের ডুরে শাড়ি পরে সে তখন কানা উঁচু কাঁসার থালায় করে সীতেশাল চালের ভাত মাছের মুড়ো তেল কাঁটার রগরগে ছ্যাঁচড়া, থকথকে কলাইয়ের ডাল আর আধ হাত গলদা চিংড়ির হাঁড়ি-কাবাব খেয়ে মনের সুখে ঢেকুর তুলেছে। আর আজ দ্যাখো। পরনে ত্যানা, কণ্ঠার গর্তে এক পো করে তেল ধরে। সারা দিনমান কেলেমুখো মেটে হাঁড়িতে বোকড়া-বোকড়া র‍্যাশন সেদ্দ হচ্ছে। কাঁচা সর্ষের তেল, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, আর কলমি শাকের ঝোল দিয়ে সেই ভাত ধরে দিয়েছিল বলে এই আজই তোঁ পটকা রাগ করে থাঁলা ছুঁড়ে ফেঁলে দিঁয়েছে—এঁ-এঁ।

মায়া-কান্না এই পর্যন্ত গড়াবার পর পটকা এক লাফে লেপ, তোশক, বালিশ, কম্বলের জঙ্গল থেকে বরাহ অবতারের মতো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বেরিয়ে আসে।

পটকার মা সেদিকে একবার আড়ে তাকিয়ে আবার গান ধরে, “তবে কি আমি ছিল ছিরিযুক্ত নফরচন্দ পরামানিকের ইস্তিরি, ছিরিমান পটকেশ্বরের একমাত্তর মাতাঠাকুরানি হয়ে নোকের বাড়ি বাসন মেজে খাব?”

পটকা হেঁড়ে গলায় চেঁচায়, “তুমি চুপ করবে? রাত ক’টা হল খ্যাল আছে?”

পটকার মা এবার কান্না ছেড়ে নিজমূর্তি ধরে। নীলধ্বজের রানি জনার চেয়ে সে নফরচন্দ্রের নফরানি, কীসে কম যায়!

“বলি সে খেয়াল তোর আছে রে হতভাগা? কাজে বেরোবার সময় যে বয়ে যায়! গতকাল তিন কেজির কুমড়োখানা বলি দিয়ে যে মা ছিনতাই-কালীর পুজো দিলুম, সে কি নাকে তেল দিয়ে এমনি অমাবস্যের রাতটা মাটি করার জন্যে? দোরের পাশে এখনও মাটির কলসে ডাব, আমপাতা সব শুকুচ্ছে যে রে!”

এতক্ষণে পটকার হুঁশ হয়। মা কী বলছে আর কেনই বা বলছে। হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সে ডান হাতের কড়ে আঙুলটা কানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে আচ্ছা করে ঝাঁকায়। হাত-পায়ের বিশখানা আঙুল মট-মট করে মটকায়, তারপর বম-বম করে খানিকটা গালবাদ্য করে নেয়। অর্থাৎ কিনা পটকা ঘুম ছাড়াচ্ছে। নিজের ঘুমের কাছে পটকা নিজেই জব্দ। নইলে তার কি এ-জ্ঞান নেই যে, ব্যবসাপত্তরের বেলা বয়ে যাচ্ছে! তার কি আর সাধ যায় না মায়ের পরনে শান্তিপুরের মিহি শাড়ি দেখতে? গলদা চিংড়ি হাঁড়িকাবাব খেতে? সে কি ছেলেমানুষ? কিন্তু ওই যে বললুম, নিজের ঘুমের কাছে পটকা নিজেই জব্দ।

নানারকম কায়দা কসরত করে, পটাপট কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে পটকা যখন উঠে দাঁড়ায়, তখন তার মাথার চুল একেবারে খাড়া, চোখ দুটো জ্বলছে, নাকের পাটা ফোঁস-ফোঁস করে ফুলছে। হাফ শার্টের তলায় ছত্রিশ ইঞ্চি ছাতিটাও ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার মতো উঠছে, নামছে, উঠছে, নামছে। সাক্ষাৎ-মা ছিনতাই-কালীর সেবক। বুকে একটা কিল মেরে পটকা বলল, “কই, এবার সাজ-গেঞ্জাম সব বার করো তো দেখি! সাজিয়ে দাও, দেখি কেমন বীরের মা, মহাবীরের ইস্তি। রণং দেহি, যুদ্ধং রেডি।”

মা খুশিমুখে বলল, “এই তো চাই! নফরচন্দরের ব্যাটা পটকেশ্বরের কি মাঝ রাত্তিরে বাবুয়ানি করা চলে?”

তাক্তাপোশের তলা থেকে পেটা লোহার তোরঙ্গ বেরোয়। মনের সুখে পটকার মা সাজায় পটকাকে। সে এক মহাভারত ব্যাপার। জনা প্রবীরকে সাজাচ্ছে, না চিত্রাঙ্গদা বীর বভ্রুবাহনকে! ব্যাপারটা একই। সেও রণং দেহি, এ-ও যুদ্ধং রেডি।

গায়ের সঙ্গে চামড়ার মতো সেঁটে থাকা কালো নাইলনের হাফ-পেন্টুল, তেল বুলিয়ে-বুলিয়ে মাছি-পিছলনো গা, বেল্টের সঙ্গে গোঁজা গুপ্তি: লাঠিক্কে লাঠি, ছুরিক্কে ছুরি। কোমরে জড়ানো দড়ির মই যত উঁচু হোক তরতর করে উঠে যাবে, পকেটে নাইলনের দড়ি, বাঁধো ছাঁদো, পিঠটান দাও। কালো মোজার ভাঁজে ধারালো ব্লেড, কুচ করে গলাও কাটবে, পকেটও কাটবে। পায়ে রবারের জুতো। তাতে নকল হিল, ছাপ দেখে কে ধরবে ধরো এখন। শেষমেশ বাঁ কপালের কোণে পটকার মা একটা ভুসো কালির ফোঁটা দিয়ে দিল। এমন রূপে-গুণে পুত্তুর তার। নজর না লাগে!

বর্বন রোডের মোড়ে খুড়োর সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার কথা। চারদিক নিশুত, নিঝঝুম। অত বড় হাওড়ার পুল আর উড়াল দিনের বেলায় যেগুলো লোকে-লশকরে, গাড়িতে জুড়িতে ঝমঝম করে, তারা যেন অমাবস্যের তারার আলোয় অজগর সাপের ভূতের মতো শুয়ে আছে। গিলে খাবে নাকি রে বাবা? চলতে-চলতে পটকার গা ছমছম, মাথা চনচন। আসলে পটকার এতদিন যা কিছু কেরামতি, ওই দিনের বেলাতেই। বাসে-ট্রামে, কি ট্রেনের ভিড়ে। বা আজকাল কি লোকে পকেটে কিছু রাখছে? মেয়েগুলো ঘুরছে দ্যাখো ন্যাড়া বোঁচা। কানে একটা ঝুমকো দুল দিবি, গলায় চিকমিকে হার দিবি, হাতে বেশ মোটা বালা, তবে তো মানাবে? তা না দ্যাখো ধিঙ্গি সব খালি গলা খালি কানে ঘুরছে। যদি-বা পরছে পেতল, দস্তা, কাঠ, গালা, মাটি, কী নয়? ম্যা গো! কাজে-কাজেই পটকাকে বাধ্য হয়ে রাতের কারবারে নাড়া বাঁধতে হয়। ন্যাড়াখুডোর কাছে।

বর্বন রোডের বাড়িগুলোর গায়ে ভুতুড়ে গন্ধ। জনমনিষ্যি যেন কোনও কালে বাস করেনি। সেই বাড়ির ছায়ায় ছায়ায়ই এগোতে হয় পটকেশ্বরকে, যেন সে আর মানুষ নেই। জায়গায়-জায়গায় আলো জ্বেলে-জ্বেলে রাতকে দিন করে রেখেছে ব্যাটারা। অথচ তা সত্ত্বেও চারদিক কী ছমছমে। কিন্তু কোথায় খুড়ো? এদিক-ওদিক হাতড়ে খুড়োকে খুঁজতে থাকে পটকা। কে জানে হয়তো খুড়োও তারই মতো ছায়ায়-ছায়ায়। হয়তো-বা এও এক পরীক্ষে। আঁধার কোণে ভূত পেরেত আর কুটুম এড়িয়ে খুড়োকে খুঁজে পেলেই হয়তো গোটাগুটি রেতো কারবারের পারমিটখানা খুড়ো তুলে দেবে পটকেশ্বরের হাতে।

কোথায় খুড়ো? অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে-করে পাশের একটা সরু গলি দিয়ে পটকা শুট করে বড়বাজারের দিকটায় কেটে পড়ল। খুড়োর খবর, বড়বাজারের কোনও বাড়ির তিনতলায় আজ বিস্তর চোরাই সোনা আসবে। পাহারা দিতে কেউ নেই, একটা বোবা-কালা লোক ছাড়া। দুটো ঘরের মাঝে সরু প্যাসেজ। সেই প্যাসেজের একপাশে ডাঁই করা পুরনো প্যাকিং বাক্স, চটের বোরা। তারই মধ্যে লুকনো আছে গাদা-গাদা সোনা। আজ বাদে কালই আবার পাচার হয়ে যাবে। খুড়ো যদি না আসে? এমন মওকা বৃথা যেতে দেবে না পটকা। যেটুকু নিশেন আছে তাতে করেই গন্ধে-গন্ধে ঠিক সে পৌঁছে যাবে। কিন্তু নিশেন মতো গলিতে পৌঁছে নাক উঁচু করে সোনার গন্ধ শুঁকতে গিয়ে পটকা দিশে পেল না। সোনার গন্ধ হবে বেশ চকোসা-চকোসা। সে-গন্ধ নুকনো ছুপনো থাকবে না পটকার মতো তিন পুরুষের মহৎ শিল্পী বংশের ওয়ারিশানের কাছে। কোথায় সোনা? এ তো গুচ্ছের আরশুলোর পাখা, বেড়ালের লোম আর ইঁদুরের নাদির বিটকেল গন্ধ। তবে কি খুড়ো তাকে ভাঁওতা দিল? বাপের অদ্দিনের স্যাঙাৎ এমনি তঞ্চকের কাজ করবে? খুড়িতে আর পটকার মায়েতে যে সেই ছোটকাল থেকে ‘ভুসোকালি’ পাতানো আছে! সে-সময়ে পটকাদের ফ্যামিলির খুব রবরবা। ফোঁস করে নিশ্বেস পড়ে গেল পটকার। সেই খুড়ো কি শেষপর্যন্ত? কথাই তো ছিল সোনা পেলে তিন ভাগ নেবে খুড়ো এক ভাগ পটকা। কেননা খুড়ো খবর এনেছে। তা তাই তা-ই সই। পটকার এখন বয়সকাল। কত রোজগার করবে। ওদিকে খুড়োর দিন তো ফুরিয়ে এল। দাঁত পড়ে গালে গর্ত, চোখ কোটরে। যদিও সেই চোখেই এখনও শ্যেনের ঠাহর। সেই দাঁতে এখনও নেকড়ের ধার। ওই দাঁত দিয়ে খুড়ো নাইলনের দড়ি ইস্তক কেটে বেরিয়ে যেতে পারে। ও-সব হল গিয়ে সেকালের তাকত।

নাঃ, এখনও খুড়োর দেখা নেই। এই পেরথম দিনটাতেই শুভ কাজে খুঁত থেকে গেল? বিদ্যে-দিগ্‌গজ পণ্ডিতে হাতেখড়ি না করালে কি আর ঠিকঠাক পণ্ডিত হওয়ার জো আছে? মহাত্মা গান্ধী রোড সুনসান। একবারটি গলা বাড়িয়ে দেখে নিল পটকা। অর্ধেক আলো ইলেকট্রিক কোম্পানির দয়ায় জ্বলছে না। পটকা ঘোরাফেরা করছে যেন ছায়ারও ছায়া। সড়াত সাঁত। নিজের ওস্তাদিতে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। নেড়ি কুকুরগুলো একবার ঘেউ-ঘেউ করে ডুকরে উঠেছিল, কিন্তু পটকার একটা বিশেষ শিস জানা আছে। সাপুড়ের যেমন সাপের মন্তর, নিশিটুকুমেরও তেমনই-তেমনই এই শিস। ঠাকুর্দা বাপকে, বাপ ছেলেকে, ছেলে নাতিকে শিখিয়ে যায়। শিখিয়ে-শিখিয়ে এমন হয়েছে যে, নাতির ছেলের বেলায় আর শেখাতে হয় না। বোল ফোটবার আগেই মুখে শিস ফোটে। যাই হোক, কুকুরদের শান্ত-দান্ত করে ছায়ায়-ছায়ায় পটকা এগোতে লাগল। খুড়োর নিশেন যদি ভুলও হয়, সোনার গলি সে শুঁকে-শুঁকে খুঁজে বার করবেই। ভালই হবে তখন আর ভাগাভাগি হবে না। সবটাই পটকার একার।

এমন সময় দূর থেকে একটা ছুন ছুন ছুন ছুন করে মিষ্টি শব্দ ভেসে আসতে শুনে নিজের জায়গায় স্থির হয়ে গেল পটকা। ক্রমেই এগিয়ে আসছে শব্দটা। মেয়েদের ঘুন্টি-দেওয়া নূপুরের শব্দ। নতুন বিয়ে হওয়া বর-কনে আসছে একজোড়া। বর পরেছে চাপা সিল্কের পাজামা। তার ওপর জরিদার আচকান, মাথায় পাগ। বউ পরেছে ঝকমকে কালো শাড়ি। হাতে সোনালি হ্যান্ডেলওলা ভ্যানিটি ব্যাগ। আর কী গয়না! কী গয়না!

বউয়ের কান থেকে ঝুলছে কানবালা, গলায় লম্বা সীতেহার, কোমর পেঁচিয়ে রয়েছে চন্দ্রহার, হাতভর্তি ঝমর ঝমর চুড়িবালা। বরটার দু’ হাতেও বোধহয় আটখানা আংটি। গলায় লম্বা সোনার মফচেন। দূর থেকে দেখেই ঠিক চিনেছে পটকা। এ-সব নিখাদ গিনিগোল। কোনও ভুল নেই। বর-বউ দুটোর কি মাথাখারাপ? এমনি ভর রাত্তিরে তাল-তাল সোনা পরে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে? অবশ্য বলাও যায় না, এক-একটা রামবোকা আদুরে বউ আছে বটে, গুচ্ছের খানিক গয়না না হলে বিয়ে বাড়ি যাবে না। এরকম বউয়ের দুর্দশা ট্রেনে দেখেছে পটকা। মাঝ রাস্তাতেই খেল খতম। একখানা ভোজালি কি পাইপগান ঠেকিয়ে এক কামরা লোকের চোখের সামনে থেকে পটাপট সব খুলে খুলে নিয়ে ট্রেনের ইস্পিড কমতেই এক লাফে সব উধাও। এ তো হামেশা হচ্ছে! পটকারা খেতে পাবে না, জাতব্যবসা লাটে উঠবে, আর তোমরা সোনাদানায় গা মুড়ে নেমন্তন্ন খেয়ে বেড়াবে, সেটি হচ্ছে না।

চটপট পটকা রেডি হয়ে যায়। রাস্তার এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো পর্যন্ত আড়াআড়ি সে দড়িটা খাটিয়ে ফেলে। ব্যস, যুদ্ধং রেডি। গল্প করতে-করতে আসছে তো! খেয়াল করবে না। দড়িতে ধাক্কা খেয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়বে। আর তখনই শুরু হবে পটকার খেল। কান, কোমর আর গলার জিনিসগুলো একটানেই খুলে নেবে। তারপর ছোরা দেখিয়ে বাকিগুলো খুলিয়ে নিতে হবে—এই আর কী! রুটিন কাজ! এর জন্য হাতেখড়ি-টড়ির দরকার হয় না।

ও কী! বর বউ দুটো গল্প করতে করতে দিব্যি দড়ি পার হয়ে গেল যে! পটকা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পড়িমরি করে পেছন পেছন ছুটে, হাতে গুপ্তি বাগিয়ে পেছন থেকে লোকটার পিঠে ভোজালি ঠেকিয়ে সে কর্কশ গলায় বলল, “বেশি চালাকি করবে না, ওপরে হাত তোলো।” ও মা কোথায় কী! দেখে, লোকটা সামনে থেকে পেছনে চলে গেছে আর মেয়েটা যেন কিছুই হয়নি এমনি করে এগিয়ে চলেছে। মেয়েটা পালায় দেখে পটকা সাঁই-সাঁই করে এবার তার দিকে ছোটে, ক্যাঁক করে ধরবে একেবারে। ও মা! কোথায় মেয়ে। তার দু’ হাতের মধ্যেটা ফাঁকা। কোথা থেকে খিলখিল করে কেমন একটা বিশ্রী হাসি ভেসে আসছে। পেছনে ফিরতেই পটকার বুক হিম হয়ে গেল। মেয়েটা শূন্যে শুয়ে আছে। সেই কালো বেনারসি, চিকমিক করছে গয়না সারা গায়ে। শুয়ে-শুয়ে ভাসছে আর খিলখিল করে রক্ত-জল-করা হাসি হাসছে।

এতক্ষণ পটকা সব সহ্য করে যাচ্ছিল, কিন্তু এইবার সে আর পারল না। যতই মা ছিনতাই-কালীর সেবক হোক, সে মানুষ বই তো নয়! ভূ-ভূ করতে-করতে পটকা দৌড় দেয় আর তার পেছনে সেই পেতনি ধেয়ে আসে, লোকটাও আসছে সমানে, একটা চকমকে মুণ্ডিওলা লাঠি না কী আবার পটকার দিকে তাক করে ধরেছে। নিজের খাটানো দড়িতে পা জড়িয়ে নিজেই চিতপটাং হয়ে যায় পটকা। তারপর অজ্ঞান।

জ্ঞান ফিরতে পটকা জীবনে এই প্রথম শ্বশুরবাড়ি দেখল। ওপরে ফোকরওলা, সামনে গরাদ-দেওয়া বিচ্ছিরি বদখত একখানা ঘর, তাতে অমন দশ-এগারোজন ষণ্ডা, পুঁচকে, মোটকা, বাঁটকুল, সিড়িঙ্গে, হোঁতকা সব ডোরা-ডোরা জামা পরে শুয়ে-বসে রয়েছে। পটকা চোখ পিট পিট করতেই একজন মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কালিঝুলিগুলো হাত দিয়ে মুছতে লাগল।

“এ কী! এ যে আমাদের নেড়ু ওস্তাদের ভাইপো। একেবারে আনপড় কারিগর তো নয়? কী বাপ! নফর চন্দরের নাম ডোবালি যে! নিজের দড়িতে নিজেই পটকান! ছ্যা ছ্যা ছা!” পটকার কালিঝুলি মুখের মধ্যে চোখের ঢেলা বেরিয়ে রয়েছে। সে বলল, “ভূ-ভূ।” সঙ্গে-সঙ্গে শ্বশুরঘর অট্টহাসিতে ভরে গেল। হো হো, হা হা, হো হো, হা হা।

কে যেন বললে, “তুই ভূত। একেবারে গো-ভূতের ছানা।”

আর-একজন বললে, “রগড়টা তুমিই ওকে সমঝিয়ে দাও না ভাই ভজনলাল।”

তরমুজের মতো গালওলা এক ব্যক্তি বলল, “আরে বুদ্ধু, জাদুগরনে তুঝে ভেড়ুয়া বনায়া রে! তুকে ভেলকি দেখাল তো সাথ-সাথ তু ভি দৌড় করলি! ক্যা শরম কি বাত রে!”

ছোট-বাজার থানার ভেতরে তখন ও-সির ঘরে টেবিলের ওপর রাবড়ি, জিলাবি, লাড্ডু, সামোসা সব রেডি। ওসি বলছেন, “আরে গুপ্তা সাব, ভেলকি যা দেখিয়েছেন এ-থানায় জবর তামাশা হল। হাসি-খুশির মওকা তো আমাদের কমই মিলে। তা আমাদের ভেলকিটা টুক এক্সপ্লেন করে দিন। চোট্টা পাকড়ে দিলেন, মিঠা মুখ ভি একটু করতেই হবে!”

জাদুকর ইন্দ্রগুপ্ত বললেন, “আমরা তো সোজা বিয়েবাড়ি থেকে আসছি মিশ্রজি। মাফ করুন এবারের মতন।”

“চায় তো পিবেন জরুর। পিতে পিতে তামাশাটা খুলিয়ে বলুন।”

ইন্দ্রগুপ্ত হেসে বললেন, “আসলে কদমতলায় আমাদের একটা ছোটখাটো শো ছিল। বন্ধুর বাড়ি। বন্ধুর বউভাতের নেমন্তন্নেই গিয়েছিলাম। বন্ধু বলেছিল, হঠাৎ একটা ভেলকি দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে। কিন্তু ম্যাজিশিয়ান হিসেবে নয়, সাধারণ অতিথি হিসেবেই দেখাতে হবে। স্টেজ থাকবে না। কোনও ব্যবস্থা থাকবে না। কাজে-কাজেই আমরা একটু রেডি হয়েই গিয়েছিলাম। ড্রাইভার ছাড়া কেউ সঙ্গে ছিলও না। ম্যাজিকের যা কিছু সরঞ্জাম পোশাকের পকেটে আর হাতের কায়দায়।”

জাদুকরের স্ত্রী জ্যোৎস্না এইখানে ফিকফিক করে হাসতে লাগল।

ইন্দ্রগুপ্ত বললেন, “ম্যাজিক ওখানে খুব জমে গেল। কেউ ছাড়তে চায় না। তারপর সাড়ে বারোটা নাগাদ যদি-বা ছাড়া পেলাম, হাওড়া ব্রিজ পার হতে না হতেই গাড়ি ব্রেক-ডাউন। ড্রাইভারকে বললুম, “বাবা তুমি গ্যারাজ-ট্যারাজ দ্যাখো, আমরা হাঁটতে-হাঁটতে চলে যাচ্ছি।” যাব তো সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। রাত্তিরবেলা, ট্রাফিক নেই, কিছু নেই। দিব্যি পৌঁছে যাব। গায়ে গয়না রয়েছে বিস্তর, তাই চোখ-কান খোলা রেখে হাঁটছি, হঠাৎ দেখি একটা ছায়া সড়াত করে সরে গেল। ছোকরা একপাশে সরে গেল। ঠাওর করে দেখি একগাছি দড়ি রাস্তার এপার-ওপার বাঁধা। ছোকরা একপাশে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গুঁড়ি মেরে বসে রয়েছে। আরে বাবা, এ-সব দড়ি-ফড়ি নিয়ে কারবার তো আমাদেরও। কাজেই কাছে পৌঁছতেই কুক। আর বাকিটুকু তো স্রেফ ফুট ওয়ার্ক।

‘আপনাদেরও তা হলে আমাদের লাইনের বহুত কুছু শিখতে হয়, বলুন।”

“তা তো হয়ই। হাত-সাফাই, পা-সাফাই,” হাসতে-হাসতে বললেন ইন্দ্রগুপ্ত।

“তারপর?”

“তারপর তো সব সোজা। যেই ছোকরা জ্যোৎস্নার পেছনে ছুটেছে, আমি দড়িটা গিঁট দিয়ে বেঁধে আস্তে-আস্তে এগিয়েছি। আর পকেট থেকে আমার ম্যাজিকের বেলুন-পুতুল গ্যাস দিয়ে ফুলিয়ে কালো সুতো দিয়ে নাচাচ্ছি। ওই খেলা দেখিয়েই তো বিয়েবাড়ির আসর জমিয়ে এসেছি। ভেনট্রিলোকুইজম জানেন তো? সেই কায়দায় মেয়ে গলায় খিলখিল করে হাসতেই ছোকরা মুখ ফিরিয়েছে, জ্যোৎস্না ঢুকেছে গলির ভেতরে। ওর ফুট ওয়ার্কও তো নেহাত ফ্যালনা নয়। শূন্যে ওই দৃশ্য দেখে আর হাসি শুনেই ছোকরার হয়ে গেছে। তার পর নিজের দড়িতে নিজেই কুপোকাত!”

জ্যোৎস্না বলল, “আর-এক ওস্তাদকেও পাকড়াও করেছেন শুনলাম! এরা সব বলছিল।”

মিশ্রজি বললেন, “ওই তো, মক্কেল আসছেন। আপনার গাড়ির বুটে মেলা চাঁদির বাঁট নিয়ে বসে ছিল। সোচছিল কি ছোটা বাজার এরিয়া এমনি করেই পার হয়ে যাবেন।”

শ্রীল শ্রীযুক্ত ন্যাড়াচন্দরকে এই সময়ে ধাক্কা দিতে-দিতে এনে ফেলল কনস্টেবলরা। শ্রীঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ন্যাড়া এ-মহলে চেনা মুখ। সে হাজতে নিক্ষিপ্ত হতেই চারদিক থেকে সংবর্ধনার কলরব উঠতে থাকে। প্রশ্নোত্তরের আকারে। একজন প্রশ্ন করছে। সবাই উত্তর দিচ্ছে।

“সসুরাল কিসকা?”

“নেড়ু ওস্তাদকা।”

“উও কিধর?”

“অভভি আতা।”

“আতা কিঁউ?”

“দহেজ লেনে।”

“কোঁতকা খায়া?”

“কোই বাত নহি।”

এর পর সমস্বরে সবাই চেঁচাতে থাকে:

নেড়ুবাবা পার করে গা।

বোম বোম নেড়ু বোম।

নেড়ু ওস্তাদ

জিন্দাবাদ।।

এত অভ্যর্থনাতেও কেন কে জানে অন্যান্যবারের মতো নেড়ুর মুখে হাসি ফোটে না। সে আড়চোখে ভাইপোকে নজর করে। তারপর কেমন ভ্যাবাচাকা কাঁচুমাচু মুখে ভাইপোর দিকে পেছন ফিরে বসে থাকে। কে জানে কী হয়েছে খুড়ো-ভাইপোর মধ্যে?

১৪০১

অলংকরণ: সুব্রত চৌধুরী

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন