চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী

পৌলোমী সেনগুপ্ত

চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী

সকাল থেকে আকাশ থমথমে মেঘলা, বিকেল হতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দেখে মজিলপুরের বিখ্যাত ‘চার বুড়োর আড্ডা’-র তিন বুড়ো হরিহর, গদাধর আর মুকুন্দ ছটফটিয়ে উঠল, “সেরেছে! বুনোটা আসতে পারলে হয়!”

মুকুন্দ এরই মধ্যেই তাসের প্যাকেটটা বার করে অকারণ ভাঁজছিল, হঠাৎ জোর গলায় বলে উঠল, “না, না, আসবে ঠিকই! আড্ডায় আসেনি, এমন কোনওদিন হয়েছে?”

হরিহর বলল, “হয়নি! সেটা আজন্মকাল গায়ে গায়ে থাকার জন্যে! চারজনেই দু’মিনিটের রাস্তায়। বুনোটার যে বুড়ো বয়সে মতিভ্রম ঘটল। এই শেষ বয়েসে কিনা শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি পেয়ে, সাতপুরুষের বাড়িঘর ছেড়ে ঠেলে গিয়ে সেখান সামলাতে গেল। এখান থেকে ক’মাইল রে গদা?”

“এখন তো আর মাইল বলে না রে। কিলোমিটার-ফিটার কী যেন বলে।”

“থাম তো! এখন কী বলে তা নিয়ে তোর কী দরকার? তোর যা জানা তাই বল।”

“তা সেটা কত আর? আধমাইলটাক। বুনোর কাছে তো নস্যি। তবে কাল যেন বলছিল, ক’দিন থেকে হাঁটুটা বড় জ্বালাচ্ছে। ব্যথা, যন্তন্না।”

“তাই যখন, তখন একটু সময় থাকতে বেরিয়ে পড়লেই হত! সকাল থেকেই তো আকাশের অবস্থা দেখছিস! কী এত রাজকার্য তোর!”

এমনভাবে বলে, যেন সামনেই রয়েছে ‘বুদ্ধু’ বনমালী!

গদাধর বলল, “তা বুনোর তো নিজের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাস করতে যাওয়ার মন ছিল না। বউ ছেলেমেয়েকে বলেছিল, ‘তোমরা গিয়ে থাকো গে, আমি এখানে বেশ থাকব। দূর তো বেশি না, দুপুরের দিকে গিয়ে না হয় ভাতটা খেয়ে আসব। রাতে তো খাদ্য খই-দুধ, সে এখানে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। দক্ষর মা রয়েছে। চারদিকে এত বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শি!’ তো বউ ছেলেরা রাজি হল? বলল, ‘পাগলের মতো কথা বোলো না!”

“ওই সম্পত্তিটা পাওয়াই কাল হল।”

“আহা! এদিকে ছেলেমেয়ে তো আহ্লাদে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নেচেছিল! তাদের তো হাল ফিরে গেল। বুনোর শাশুড়িবুড়ির তো কম ঐশ্বর্য ছিল না! জমিজমা, বাগান, মাছের পুকুর, গোয়ালে গোয়ালভরা গোরু, উঠোনে গোলাভরা ধান! তায় আবার সে-বাড়ির কাছাকাছি সিনেমা হল।”

মুকুন্দ তাসটা জোরে জোরে ভাঁজ করতে করতে বেজার মুখে বলে, “বুনোর আর ওর কোনটা কাজে লাগবে? পেটরোগা মানুষ! রাতে তো খায় এক ছটাক দুধে একটু খই ভিজিয়ে, আর দিনে একটু শিঙিমাছের ঝোল আর গলা-গলা ভাত।”

“সে কথা কে বুঝছে? বয়েস হলেই পরাধীন। একদা ওই বুনো যখন রেল আপিসে কাজ করত? ছুটিছাটায় বাড়ি এলে গুষ্টিসুন্ধু সবাই থরহরিকম্প।”

মুকুন্দ বলল, “এখন সকলেরই এক অবস্থা।”

গদাই বলে ওঠে, “তুই আর বলিসনে। তোর না আছে বউ-ছেলে, না আছে সংসার। পিসিমার যাওয়া পর্যন্ত তো মুক্ত পুরুষ। তা পিসিই কি কম দিন গেছে? পিসির মেয়েটাই গিন্নি হয়ে উঠল।”

কথাটা ঠিক। মুকুন্দ ঝাড়া হাত-পা। কোনও একসময় সে-ও চাকরি-বাকরি করত, তবে মজিলপুর থেকে কলকাতায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি এমন কিছু ব্যাপার ছিল না! তা যাকগে, সে-সব গত কথা!

মুকুন্দ বরাবরই রীতিমতো স্বাধীন! পিসি থাকতেও! পিসি ছিল ভালমানুষের রাজা! তো পিসির মেয়েটার সঙ্গে মুকুন্দ পাড়াতেই তার এক জ্ঞাতিভাইয়ের ভাইপোর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। সেখানেই দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে আসে। আর সারাদিনের চা, জলখাবার, আড্ডায় মুড়ি-তেলেভাজা, রাত্তিরে দু’খানা রুটি আর এক থাবা তরকারি পিসির মেয়ে বা ভাই-বউ নিজে এসে এসে সাপ্লাই করে যায়।

হরিহর আর গদাধরের অবশ্য মস্ত একখানা করে সংসার। ছেলে, বউ, নাতি-নাতনি, গিন্নি! তা তাতে তার নিয়মিত সময় আড্ডায় হাজরে দেওয়ায় কোনও বিঘ্ন ঘটে না।

বড় সুখেই কাটায় এই চার বুড়ো!

আজন্মের বন্ধু!

ছেলেবেলায় ইস্কুল পালিয়ে পরের বাগানের ফলপাকুড় চুরি করতে, আরও একটু বড় হলে পরের পুকুরের মাছ ধরতে, একেবারে একাত্মা। পাড়ার লোক বলত, “দু’জোড়া মানিকজোড়!”

এখন ক্ষমতা গেছে। তবু সারাটা দিন খেয়ে, শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে কাটিয়ে, ছটফট করতে থাকে এই সন্ধেবেলার তাসের আড়ার জন্য! যেই চারজনে এক হল, যেন কী এক পরম পাওয়া পেল!

তা বনমালী অন্য পাড়ায় চলে গিয়েই যে আড্ডায় ঘাটতি ঘটেছে তা নয়। পৃথিবী উলটে গেলেও— ঠিকই যথাসময়ে এসে হাজির হয়।

আজই একটু যেন দেরি হচ্ছে!

কাজেই বাকি তিনজনে বলে চলেছে, “চিরদিনের হাড়-মুখ্য ! আকাশটা তো দেখছিস সকাল থেকে? দু’ঘণ্টা আগে বেরোলেই কী হত?”

এদিকে বৃষ্টিটা যেন একটু জোরেই এসে গেল।

নাঃ। মাটি করেছে!

তিন বুড়োই ফরাসপাতা ফৌজি ছেড়ে বাইরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। উদ্বিগ্ন মুখ। উৎকণ্ঠ দৃষ্টি।

হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল হরিহর, “ওই তো, ওই তো আসছে! হুঁ বাবা। বলেছি না, পৃথিবী উলটে গেলেও, আসা রদ হবে না!”

কিন্তু কী আশ্চর্য!

ছাতা মাথায় নেই কেন?

খালি মাথায় ভিজতে ভিজতে আসছে!

মুকুন্দ তাড়াতাড়ি নিজের ছাতাটা নিয়ে, নিজের মাথায় দিয়েই এগিয়ে গেল।

সেকেলে ঢাউস মার্কা ছাতা! দু’জনের মাথা অনায়াসেই ঢাকা পড়তে পারে!

একজন আসছে।

অপরজন যাচ্ছে।

মাঝখানেই দেখা!

ভিজে চুপচুপে বনমালী বলে ওঠে, “আঃ, তুই আবার কেন কষ্ট করে? যা ভেজবার, তা তো ভিজেইছি!”

“তা হোক। চোখে দেখে স্থির হয়ে থাকা যায়; কিন্তু ছাতা নিয়ে বেরোসনি কী বলে?”

বনমালী কেমন একরকম বোকাটে হাসি হেসে বলে, “বেরিয়েছিলাম! নাতনি তার শৌখিন ছাতাখানা দিল হাতে। হঠাৎ সেই হালকা ছাতাখানা ঝোড়ো হাওয়ায় হাত ফসকে উড়ে গিয়ে ঘোষের পুকুরে গিয়ে পড়ল! ঢের চেষ্টা করলাম, হল না।”

বলতে বলতে এসে পড়ে।

বাকি দু’জন হইহই করে ওঠে, “এসে গেছে। এসে গেছে।”

মুকুন্দ বলে, “আহা, এখন ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে, গা-মাথা মুছে আমার শুকনো কিছু জামা-কাপড় পরে তবে গুছিয়ে বোস!”

বনমালী তাড়াতাড়ি বলে, “না, না! বেশ আছি। গায়ে গায়ে শুকিয়ে যাবে।”

“গায়ে গায়ে শুকিয়ে যাবে? বলিস কী? ভিজে টুসটুস করছিস! কেন, আপত্তিটা কীসের?”

বনমালী আবারও তেমনই বোকাটে হাসি হেসে (এটা ওর মুদ্রাদোষ) বলে, “কে আবার তোর জামাকাপড় ফেরত দিতে আসবে?”

“কেন? তুইই আসবি। কাল কি আর এত বিষ্টি পড়বে? তোরটা কাচিয়ে শুকিয়ে রাখব, আমারটা দিয়ে যাবি, তোরটা নিয়ে যাবি। প্রবলেমটা কোথায়?”

“তাই বলছিস? আসলে কী জানিস, আচ্ছা দিচ্ছিস দে, নাতনির ছাতাটা গেল।”

বনমালী একখানা গামছা আর মুকুন্দর একখানা শুকনো ধুতি-গেঞ্জি আর হাফ পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে পাশের দালানটায় চলে গেল!

গদাধর আর হরিহর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, “যাক বাবা, শেষপর্যন্ত এল তা হলে!…দ্যাখো কাণ্ড! এখন বিষ্টিটা ছেড়ে গেল!”

যাক! এখন যেখানে যাই হোক অন্তত ঘণ্টাতিনেকের মতো তো নিশ্চিন্তি!

পৃথিবীতে তখন থাকবে শুধু এই একখানা ফরাসপাতা মস্ত ফৌজি চারটে গোল্লা-গোল্লা তাকিয়া, চারটো বুড়ো আর একজোড়া তাস!

বনমালী মুকুন্দর জামা-কাপড়ে সজ্জিত হয়ে চলে এসে গুছিয়ে বসতেই, গদাধর বলে ওঠে, “যাক বাবা, শেষ পর্যন্ত এলি! ভাবনা ধরেছিল, বুঝিবা আজকের আড্ডাটা ফসকে গেল।”

“আজকেরটা ফসকাবে মানে?”

বনমালী তার রুপোর নস্যির কৌটো থেকে একটিপ নস্যি নিয়ে নাকে গুঁজতে গিয়ে বলে, “এ হে হে ভিজে গেছে—যাগগে। ভিজেই সই।”

হরিহর বলে উঠল, “নস্যির কৌটো তো তোর ট্যাঁকে গোঁজা থাকে। সেখান থেকে কৌটোর ভেতরের নস্যি ভিজল কী করে?”

বনমালী ভিজে নস্যির হাতটা তাকিয়ায় মুছে হেসে বলে, “ওই তো খুড়োর কলে পড়ে গিয়েই তো…যাকগে, তাস সাজা! আজ না এসে থাকতে পারা যেত? কাল মুকুন্দ, আর তোর কাছে হেরে মরেছি না?..শেষ পিটে হঠাৎ রঙের টেক্কা তুরুপ মেরে ছক্কা দিয়ে বসলি! আজ তার শোধ নিতে হবে না?”

“আজও তা হলে একই পার্টনার?”

“নিশ্চয়! অ্যাই মুকুন্দ, ওখানে করছিস কী?”

“কিছু না! তোর ভিজে জামা-কাপড়গুলো ঠেলে

রাখছি! কী হল? তাস দেওয়া হয়েছে?”

“কখন!”

“রংটা কী হল?”

“চিড়িতন। চিড়িতনের সাহেব!”

“সেরেছে! চিড়িতন। ওটা আমার চিরকেলে অপয়া! যাক দেখি কী হাত তাস?”

এই চার-চারটে আশি বছরের বুড়ো কী এমন খানদানি খেলা নিয়ে মশগুল থাকে!

এমন কিছুই না! সেই আদি-অন্তকালের ‘গাবু’ খেলা! ছেলেবেলায় গরমের ছুটির দুপুরে পিসিমা, জেঠিমা, পাড়ার কাকিমাদের যে নিত্য তাসের আড্ডা বসত, সেইখানে কাছ ঘেঁষে বসে থেকে, আর মনপ্রাণ চোখ সব দিয়ে দেখে দেখে যা শিখেছিল তাই চালিয়ে আসছে চিরকাল!

সেই সাবেকি—দু’কুড়ি সাতের খেলা! এতে এখনকার খেলার মতো একসঙ্গে দু’জোড়া তাস লাগে না, পয়সা নিয়ে বাজি ধরাধরি নেই, হারজিতের মধ্যে, অপর পক্ষের পিট-এর ওপর টেক্কা মেরে, কিংবা তুরুপ মেরে বেশি পিট বাগিয়ে দিতে যাওয়া।

“আর হারা মানে?”

“ছক্কা-পাঞ্জা খাওয়া!”

এখনকার ছেলেমেয়েরা এই জোলো-জোলো খেলা দেখে আর তারই জন্য বুড়ো চারটের হানফানানি দেখে হাসে!

তা তাতে বয়েই গেল!

কে ওদের কথার ধার ধারে?

এরা নিজেদের আনন্দেই মশগুল!

কিন্তু ‘কালকের শোধ নেব’ বলে যতই তড়পাক, বনমালীর যেন আজ কেমন অন্যমনস্ক-অন্যমনস্ক ভাব!… বেশ দু’-একবারে ভুলই করে বসল। তার পার্টনার মুকুন্দর কারসাজি আর বাহাদুবিতে অবশ্য সামলে গেল।

শেষপর্যন্ত অবশ্য জিতেই গেল বনমালীরা!

যাক বাবা! বাঁচা গেল!

তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বনমালী। চৌকি থেকে নেমে পড়ে বলে, “হেরো হয়ে মরতে হল না! আচ্ছা—”

মুকুন্দ হাঁ-হাঁ করে ওঠে, “আরে, আরে চলে যাচ্ছিস যে? বিষ্টি ছেড়ে গেছে। এক্ষুনি চা, মুড়ি, ফুলুরি চলে আসবে—”

“তোৱা খাস।”

“কেন, তোর কী এত তাড়া? গিন্নি গঞ্জনা দেবে?”

শুনে বনমালী জোর পায়ে হাঁটা দিতে দিতে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বাঁধানো দাঁতে ঝিলিক মেরে হেসে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা নেড়ে বলে যায়, “সে গুড়ে বালি।”

“আরে, আরে, এই বুনো! তোর নস্যির কৌটোটা যে পড়ে রইল!”

তা সে-কথা আর বনমালীর কান পর্যন্ত পৌঁছল না বোধ হয়, ফিরে তাকাল না! হঠাৎ যেন অন্ধকারে মিশে গেল।

এরা তিনজন—হরিহর, গদাধর আর মুকুন্দ কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে বলাবলি করে, “বুনোটার আজ যেন কেমন বেভাব, দেখলি না?”

“তাই মনে হল। বাড়িতে বকাবকি হয়েছে বোধ হয়।”

“বাড়ির বকাবকিকে ও ভারী কেয়ার করে! শরীরটাই বোধ হয় জুতসই নেই!”

“হতে পারে। তা আমরাও তা হলে এবার চলেই যাই।”

মুকুন্দ হাঁ হাঁ করে ওঠে, “কেন? তোদের এত কী তাড়া পড়ল? এই তো সবে আটটা কুড়ি! তোদের তো আর মাঠ ভেঙে এক মাইল পথ হাঁটতে হবে না। মুড়িটা এসে পড়বে হয়তো এখনই…”

“মুড়ি? বলছিস? তা হলে বসেই যাই আর একটু?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ ! ততক্ষণ না-হয় ‘গোলাম চোর’ খেলাই চালিয়ে যাওয়া যাবে ছেলেবেলার মতো।”

বলে হা-হা করে হেসে ওঠে!

অতএব আবার দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে চৌকিতে বসা! তাসের গোছা নিয়ে নাড়াচাড়া।

একটু পরেই দরজায় ধাক্কা পড়ল, যেন জোর তলবে দুমদাম।

ওই এসে গেল মুড়ি-ফুলুরি! এত ধাক্কাচ্ছে কেন?

মুকুন্দ নেমে পড়ে এসে দরজাটা খুলেই প্রায় পাথর হয়ে গেল।

মুড়ি-বেগুনির বদলে এ আবার কী?

সামনে গোটাআষ্টেক ছোকরা। একজন একটা জ্বলন্ত হ্যারিকেন নিয়ে হাতে দোল খাওয়াচ্ছে!

“তোমরা কে বাবা?”

“আমাদের চিনতে পারছেন না?”

“না তো—ঠিক—”

“তা চিনবেন না। আমরা ও-পাড়ার। সিনেমা হল্‌-এর পাশে থাকি আমরা। তো দাদুরা কি এখনও তাস পেটাচ্ছেন নাকি? অ্যাঁ? আচ্ছা লোক তো! চারজনের আড্ডার একজন যে আজ এল না, তার জন্যে প্রাণে একটু ধড়ফড়ানি আসেনি?”

“এল না মানে? বনমালীর কথা বলছ তো?”

তিনজনেই উঠে এসে মারমুখী হয়ে বলে ওঠে, “এই তো তাস খেলা সেরে একটু আগে চলে গেল!”

“কী? কী বলছেন দাদুরা? একটু আগে তাস খেলে উঠে গেলেন বনমালী বাঁড়ুজ্জে। হ্যা হ্যা হ্যা!… দাদুরা কি সন্ধেবেলাই আফিমের মৌতাতে ঝিমোন?… লোকটা তো সেই কোন বিকেলবেলা ঘোষের পুকুরে ডুবে মরে, এখন পেট ফুলে বাড়ির উঠোনে শুয়ে! ওঁর স্ত্রী কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, আপনারা নাকি ওঁর চিরকালের প্রাণের বন্ধু, তাই একবার শেষ দেখা দেখতে—”

হরিহর, গদাধর আর মুকুন্দ তিনজনের কেউই ব্রাহ্মণ নয়, হলে চিৎকার করে পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দিয়ে বসত। তবে শুধু চিৎকার করতে তো পৈতে লাগে না!

তিনজনে একসঙ্গে গর্জন করে ওঠে, “কী? আমরা অফিমের ঝোঁকে? অসভ্য, বেয়াদপ ইয়ার ছোকরারা! নিজেরা নেশার ঝেঁকে এসে যা মুখে আসছে বলে চলেছ?… ইয়ার্কি মারবার আর বিষয় পাওনি? একটা জলজ্যান্ত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, তাকে মেরে পেট ফুলিয়ে উঠোনে শুইয়ে রেখে, ছি ছি। নরকেও ঠাঁই হবে না তোমাদের!”

“ওঃ, বটে নাকি?”

আটজনের সমস্বর প্রতিবাদ!

“তা হলে এই চললুম! নেহাত আপনাদের খবরটা দিতে বললেন নবগোপালের ঠাকুমা, তাই আসা!… শেষ দেখা দেখতে ইচ্ছে হয় তো যান চটপট ! নইলে পুলিশে এক্ষুনি লাশ তুলে নিয়ে গিয়ে মর্গে চালান দিয়ে দেবে। অপঘাত মিত্যু বলে কথা?”

নবগোপাল বনমালীর নাতি।

তিন বন্ধু হকচকিয়ে বলে, “ব্যাপারটা কী বল তো?”

“কী আবার? বদমাশ ছেলেদের বদমায়েশি। মজা করার এক নতুন ফন্দি।… আমরা ভয় পেয়ে ছুটতে ছুটতে যাব, আর ওরা তখন দাঁত বার করে হাসবে!”

“তা হোক। তবু একবার যাওয়া যাক!”

এখন তিনজনের তিন মত।

“গিয়ে কী হবে? ওদের মজা করার হাসি দেখতে?”।

“কিন্তু এত সব বলল। যদি সত্যি মর্গে চালান দিয়ে বসে! তা হলে শেষ দেখাটা—”

“যদি মর্গে চালান দিয়ে বসে? জলজ্যান্ত লোকটাকে! বলি নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করব, না এই ফক্কড়দের কথা বিশ্বাস করব?”

“সেও তো কথা! নস্যির কৌটোটা তো এই চোখের সামনেই পড়ে থেকে চকচক করছে! খাঁটি রুপোর জিনিস! অফিসে রিটায়ার করার সময় ফেয়ারওয়েলে দিয়েছিল!”

কিন্তু নিজের চোখকে যে অবিশ্বাস করতে বাধ্য হতে হয়। অথবা অলৌকিক কোনও ভৌতিক কাণ্ডকে বিশ্বাস করতে হয়!

অথচ—ততক্ষণে পাড়ার লোকেরা মুকুন্দর দরজায় এসে ভেঙে পড়েছে।

“বামুনজ্যাঠার খবর শুনলেন?”

“বামুনদাদুর খবর শুনলেন?”

“নবুর ঠাকুর্দার খবর শুনলেন?”

“কী কাণ্ড! কী কাণ্ড! হায়! হায়।”

“শুনলাম, বাড়ির লোকের কথা না শুনে, ‘বিষ্টি আসছে’ বলে, বেলা তিনটের সময় আপনাদের এই আড্ডায় আসছিলেন!… হঠাৎ যে কী করতে পুকুরধারে গেলেন!”…

এই তিন বুড়ো, বিশেষ করে মুকুন্দ, গলার শির ফুলিয়ে, হাউমাউ করে চেঁচিয়ে বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু আসল ব্যাপারটা তো…”

তা কে শোনে কার কথা?

যে মানুষটাকে বেলা পাঁচটায় পুকুর থেকে টেনে তোলা হয়েছে এবং এখনও জল খেয়ে পেট জয়ঢাক করে বাড়ির উঠোনে পড়ে আছে, সে লোক সন্ধে সাড়ে ছ’টায় এঁদের সঙ্গে তাস খেলে গেছে, এ-কথা কে বিশ্বাস করবে?

সমবেতর রায় আসলে, ‘আসছে-আসছে’ করে ভাবতে-ভাবতে, ‘এল না’ দেখে বুড়োরা বাদলা হাওয়ার আমেজে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর সেই ঘোরের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছে, “এসেছিল—খেলে গেছে।”

“বেশ, তাই যদি হয় তো নস্যির কৌটোটা?”

“ও কিছু না। হয়তো কালকেই ফেলে গিয়েছিল, তাকিয়ার তলায় পড়ে ছিল।”

“বটে! তাকিয়ার তলায়? তাকিয়া রোজ ঝেড়েঝুড়ে তোলা হয় না ?…ঠিক আছে, তাই-ই যদি হয়, ওই ভিজে জামাকাপড়গুলো ? যেগুলো দালানের কোণে পড়ে রয়েছে?”

দু’-একজন বাড়ির মধ্যে ঢুকে এসে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে মুকুন্দকে বলল, “ও-সব বোধ হয় দাদু, আপনারই। সকালে চানের সময় ছেড়েছিলেন বাদলা দেখে আপনার কাজের লোক বোধ হয় কাচেনি। ভেবেছে শুকোবে না তো। কেচে আর লাভ কী? কাল কাচলেই হবে!”

মুকুন্দ রেগেমেগে সেই ভিজে সপসপে ধুতিখানা কুড়িয়ে নিয়ে এসে বলে ওঠে, “এই ধুতি আমার? এই ঝুলপাড় বাবুধাক্কা দেওয়া ধুতি? জন্মে এরকম শৌখিন ধুতি পরি আমি? দেখেছে কেউ? কেউই পরতাম না। তো ইদানীং বুনোর নক্কামার্কা নাতিটা শখ করে দাদুকে পয়লা বোশেখে, পুজোর সময় ওই রকম বাহারি ধুতি কিনে এনে উপহার দেয়, তাই।’

কিন্তু এতেও কারও তেমন মন বদলাল বলে মনে হল না।

কোন বুড়ো কী পাড় ধুতি পরে, সে আবার কে কবে তাকিয়ে দেখেছে?

অকাট্য আর প্রত্যক্ষ সত্য তো সেই জলে ডুবে মরা পেটফোলা লাশটা। যা নাকি সব্বাই স্পষ্ট চোখে দেখে এসেছে।

হঠাৎ পাড়ার ঠানদি গঙ্গাবুড়ি বলে ওঠে, “ওরে, শুনেছি, এমন হয়! হঠাৎ ঘটলে—সদ্য মড়াটা, আপনজনদের একটু দেখা দিতে যায়।”

তা ‘একটু দেখা দিতে’ যেতে পারে। হয়তো ছায়া ছায়া শরীর নিয়ে। কিন্তু তিন ঘণ্টা ধরে তাস পিটে যায়?… “এই মারলাম টেক্কা! এই দিলাম তুরুপ!” বলে হুঙ্কার ছেড়ে যায়? কার মড়া তুলে কার নাম করেছে।

মুকুন্দ বনমালীর সেই ছেড়ে রেখে যাওয়া ভিজে জামা-কাপড়গুলো গামছায় জড়িয়ে পুঁটুলি বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে হনহন করে এগোতে থাকে বনমালীর শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে!

এত জোরে হাঁটা অভ্যেস এখন আর নেই। কিন্তু রাগে, দুঃখে, অপমানে আর বিভ্রান্তিতে গায়ে পাগলা হাতির বল!

হরিহরের হাতে লণ্ঠন, সে হাঁক ছাড়ে, “এই মুকুন্দ। অত ছুটছিস কেন? আমি তাল দিতে পারছি না।”

তো তারপর?

বনমালীর শ্বশুরবাড়ির উঠোনে তো সেই দৃশ্যই!

“কার না কার মড়া’ বলার উপায় কোথা? নাকের ওপরকার ওই মস্ত আঁচিলটি? এই মজিলপুর গ্রামে আশপাশে আর কারও ছিল অমন?

আর ভিজে ধুতিখানা দেখেই তো বনমালীর গিন্নি ডুকরে উঠল, “ওগো, হ্যাঁগো! এই কাপড়টা পরেই বেরিয়েছিল গো!… ওমা—এখন পরনে কী? ছি ছি। এই সরু নরুনপাড় চটের মতন মোটা খেঁটে ধুতি সাতজন্মে পরেছেন তিনি কখনও? ওগো সেই যে বলে ‘মরা’ মানে নতুন কাপড় পরা। এ তাই না কি?… হায়। হায়। যাকগে গিয়ে এইরকম কাপড় পরতে হবে তোমায়?”

নিজের ধুতিখানা সম্পর্কে এমন তাচ্ছিল্য শুনে বিরক্ত হয়ে সরে এল মুকুন্দ।

এই সময় পুলিশের লোক এল।

বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন, “কখন দেখা গিয়েছিল পুকুরে ভাসতে?”

“আজ্ঞে, বেলা পাঁচটা নাগাদ।”

“কে প্রথম দেখেছিল?”

“আজ্ঞে, এই যে এই রাখাল ছেলেটা। ওর একটা বাছুর হারিয়ে যাওয়ায় খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে চোখে পড়ে জলের মধ্যে কী দাপাদাপি করছে।… ভাবল বোধ হয় বাছুরটাই জল খেতে গিয়ে হড়কে পড়ে মরেছে। তা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার একটা ঠ্যাং হাতে পেয়েছে বলে বিস্তর টানাটানি করল বেচারা, কিন্তু এই রোগাপটকা বছরদশেকের ছেলের সাধ্য কী বনমালীর ওই লাশ টেনে তোলার?…তা ছাড়া দেখল যেটাকে বাছুরে ঠ্যাং ভেবেছিল, সেটা হচ্ছে বনমালীর পাঞ্জাবি পরা একখানা হাত! তারপর আর কী? চেঁচামেচি করে পাড়াসুদ্ধ লোক জড়ো করে—”

“মাছধরা জেলেরা এসে টেনে তুলল।”

“দেখল, লোকটার অন্য হাতে একটা ফুলকাটা ছাতার বাঁট ধরা। ছাতার কাপড়টা জলে সুপসুপে ছেঁড়াখোঁড়া।”

“তার মানে টানাটানি করেছিল বুড়ো বিস্তর নাতনির ছাতাটা বাঁচাতে।”

তারপর?

তারপর আবার কী? পুলিশ লাশটাকে মর্গে নিয়ে চলে গেল। যতই যা হোক, অপঘাতের মড়াকে মর্গে নিয়ে যেতেই হবে! ফিরে ফিরে দেখে হিসেব করে বুঝতে হবে, সত্যিই নিজে অসাবধানে ডুবে গেছে; না কেউ শত্রুতা করে জলে ঠেলে দিয়ে চুবিয়ে মেরেছে।

অনেক রাত্রে ফিরে এল তিন বুড়ো।

হরিহর আর গদাধর বলল, ‘আজ রাত্তিরে আর তোর একা বাড়িতে শুয়ে কাজ নেই মুকুন্দ, আমরা দু’জনা থাকি!’

“থাকবি, তা থাক!”

হাতের হ্যারিকেনটার পলতে বাড়িয়ে দিয়ে, দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকে এল মুকুন্দ। পিছু পিছু ওরা দু’জনও।

ঘরের দরজার শেকলটা খুলল!

আর খুলেই তিন-তিনটে আড়ে-দৈর্ঘ্যে প্রকাণ্ড লোক “আঁ—আঁ—আঁ” করে চেঁচিয়ে উঠে সপাটে মাটিতে!

জ্ঞান হারাবার আগে দেখতে পেয়েছিল চৌকির ওপর নিজের তাকিয়া ঠেস দিয়ে বনমালী তাস ভাঁজছে। এদের দেখেই খিখি করে হেসে উঠে ফ্যাসফেসে গলায় বলে উঠেছিল, “দুঃখু করিস না, আড্ডা ভাঙবে না। আসব রোজ।”

১৪০৩

অলংকরণ: দেবাশিস দেব।

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন