পৌলোমী সেনগুপ্ত
ছোটবেলায় আমার বিশ্বাস ছিল না যে ভূত বলে কিছু আছে। বইতে ভূতের গল্প পড়েছি, দিদিমার কাছে কত রাত ভূতের গল্প শুনেছি। কিন্তু সে-গল্প পড়ে বা শুনে কখনও মনে ভয় পাইনি।
দিদিমাকে বলতুম—দিদিমা, একটা ভূতের গল্প বলো না—
দিদিমা বুড়ো মানুষ, সন্ধে হতে-না-হতেই ঘুমে তার চোখ দুলে আসত। তবু আমি বার বার গল্প শুনতে চাইতুম। বিশেষ করে ভূতের গল্প।
দিদিমা বিরক্ত হত।
বলত—না, রাত্তিরে ভূতের গল্প শুনতে নেই, ভূতে ঘাড় মটকাবে, তুই ঘুমো এখন, ঘুমিয়ে পড়—
কিন্তু তবু আমি ছাড়তুম না। ভূতের গল্প আমার শোনা চাই। ভূতের গল্প শুনে আমি ভয় পেতুম না বটে কিন্তু শুনতে বড় ভাল লাগত। গল্পের ভূতের হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমার কল্পনা অনেক দূরে গিয়ে পৌঁছুত। এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে যেখানে লেখা-পড়া নেই, পরীক্ষায় পাশ করার ভয় নেই, বাবা-মা-মাস্টারমশাই-এর চোখ রাঙানি নেই, শুধু আছে একটা ভাঙা পোড়োবাড়ি আর তার ভেতরে কয়েকটা ভূত আর পেত্নী। এই ভূত-পেত্নীদের জগতের স্বপ্ন দেখতেই আমার ভাল লাগত।
তারপর একটু যখন বড় হলুম তখন ভূত-পেত্নীর জগত থেকে একেবারে বাস্তব জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এ বাস্তব জগতে মাস্টারমশাইয়ের বেত খেতে হয়, পড়া না-পারলে কানমলা খেতে হয়। আর তারপরে পরীক্ষায় ফেল করার দুঃখ-লজ্জা তো আছেই।
এখন যেমন পরীক্ষায় ফেল করলে লজ্জা হয় না তখন কিন্তু তা ছিল না। যেবার পরীক্ষায় ফেল করেছিলুম বাবা সমস্ত দিন আমাকে একটা ঘরের মধ্যে তালা-চাবি বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলেন। ভাত তো দূরের কথা, এক ফোঁটা জল পর্যন্ত খেতে পাইনি।
সন্ধেবেলা বাবা দরজা খুলে দিতেন। বলতেন— এবার ভাল করে লেখাপড়া করবি তো?
বলতুম—হ্যাঁ করব—
পরীক্ষায় আর ফেল করবি না তো?
বলতুম—না—
তবে নিজের হাতে দু’কান মোল—
আমি নিজের হাতে কান মলতুম। বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব এই প্রতিজ্ঞাও করতুম। তবু সব বছরে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারতুম না। কতবার যে আমি জীবনে ফেল করেছি তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আমার ক্লাসের ছেলেরা আমার নাম দিয়েছিল ফেলু-মাস্টার, মানে ফেল-মাস্টার।
কিন্তু আমার বড়দা ছিল যাকে বলে সত্যিকারের ভাল ছেলে। প্রত্যেকবার বড়দা এগজামিনে ফাস্ট হত। কতবার যে মেডেল পেয়েছে, প্রাইজ পেয়েছে বড়দা তার গোনাগুনতি নেই। বাবা-মা সেই মেডেলগুলো আর প্রাইজের বইগুলো একটা কাচের আলমারিতে সাজিয়ে রেখেছিল। আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশী কেউ এলেই সেগুলো সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখানো হত।
তারা বড়দার ক্ষমতা দেখে তারিফ করত আর বড়দা’র সম্মানে আমার বাবা-মা’র বুক গর্বে দশ হাত হয়ে যেত!
তারপর আমার দিকে দেখিয়ে বলত—আর এটি? এটি লেখা-পড়ায় কেমন?
বাবা বলতেন—এই এর কথা বলছেন? এর। কিস্যু হবে না, এর মাথায় গোবর পোরা—
লজ্জায়-ধিক্কারে আমার মাথা হেঁট হয়ে আসত। কিন্তু আমি কী করব? আমার মাথায় যে গোবর পোরা তার জন্যে কি আমি দায়ী?
তা আমার কথা থাক। আমি বড়দার কথাই বলি। বড়দাকে নিয়েই আমার এই কাহিনী। বড়দাই ছিল বাবা-মা’র ভরসা, বড়দাই ছিল বাবা-মা’র একমাত্রনির্ভর-স্থল। বড়দার মতো ছেলে যাদের তাদের আর ভাবনা কী?
বড়দা যখন কলকাতার কলেজ থেকে গরমের ছুটির সময় বাড়িতে আসত তখন তার জন্যে বাবা স্পেশাল খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। সেদিন ঝি-চাকর কেউ বাজারে গেলে চলবে না। বাবা নিজে বাজারে যাবেন।
কেউ যদি জিজ্ঞেস করত—এ কি মিত্তিরমশাই, আপনি যে বাজারে?
বাবা বলতেন—আজ যে নীলু আসছে, গরমের ছুটি হয়েছে তো—
সেদিন বাবা বড়দার জন্যে বেছে বেছে সেরা মাছ কিনবেন, সেরা আম, সেরা পটল, সেরা সব জিনিস। সকাল থেকেই বাড়িতে একেবারে রান্নার ধুম পড়ে যেত। বড়দা খেতে ভালবাসত বলে মা ভাল ভাল রান্না করত। বড়দা এলেই বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। আমরা দুটি মাত্র ভাই। তার মধ্যে একজন বাপ-মায়ের আদরের দুলাল, আর, আর-একজনের জন্যে একেবারে শূন্য। আমার ভাগে সত্যিই একেবারে শূন্য।
তা তার জন্যে কারওর দোষ নেই। কারণ আমার মাথায় যে গোবর পোরা।
বড়দা খেতে বসলেই মা সামনে বসত, মাথার ওপর পাখাটা জোরে খুলে দেওয়া হত।
বলত—ভাত ফেলে রাখলি কেন, ও-ভাত কটা খেয়ে নে—
বড়দা বলত—না মা, বিলুকে দাও, ওকে তোমরা মোটে দেখছ না, ওকে তো তোমরা কেউ খেতে বলছ না। আমি আর খেতে পারব না, আমার পেট ভরে গেছে—
বাবাও সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যেন তিনি নিজে দাঁড়িয়ে না থাকলে বড়দার অযত্ন হবে।
বাবা বলতেন—সে কী, ইলিশ মাছ আরও দুটো দাও ওকে—
বড়দা বলত—বা রে, আমার কি রবারের পেট, আমি তো চারটে ইলিশ মাছের পিস খেয়েছি, আর খেলে বমি হয়ে যাবে—
—না বমি হবে না। কলেজের হোস্টেলে তোদের যা হাল, আধ পেটা খেয়ে খেয়ে তোদের পেটের নাড়ি শুকিয়ে গিয়েছে। আরও দুটো খেতে হবে, আমি নিজে গিয়ে তোমার জন্যে বাজার করে নিয়ে এসেছি, একেবারে আসল গঙ্গার ইলিশ। খাও। তারপর ল্যাংড়া আম এনেছি, তাও দাও দুটো—
বড়দাকে এইরকম করে খাইয়ে খাইয়ে যেন বাবা-মা’র তৃপ্তি হত না। আর শুধু কি খাওয়া? বড়দা যখন ঘুমোবে তখন কেউ শব্দ করতে পারবে না। বড়দা যখন পড়বে তখন কেউ কাছে যেতে পারবে না, বড়দার যদি একদিন একটু সর্দি-কাশি হয় তো তার জন্যে শহরের সবচেয়ে বড় ডাক্তার দেখতে আসবে। বড়দার পরীক্ষার আগে মা, মা কালীর কাছে জোড়া-পাঁঠা মানত করবে। আর বড়দাও তেমনি ছেলে। কখনও কি পরীক্ষায় সেকেন্ড হতে নেই রে! বরাবর কি ফার্স্টই হতে হয়! অথচ একই বাড়িতে আমরা একই বাবা-মায়ের দুই ছেলে।
আমি মনে মনে ভগবানকে অভিশাপ দিতুম ভগবান কেন এত একচোখো। দিতে হলে একজনকে কি এমন উজাড় করেই দিতে হয়?
তা তারপরে দাদা বি-এস-সি পাশ করলে অনার্স নিয়ে। একেবারে ফাস্ট।
সেদিন আমাদের বাড়িতে একেবারে লোকে লোকারণ্য। যেদিন পরীক্ষার ফলটা বেরোল সেদিন বড়দার ছবি ছাপা হল খবরের কাগজের পাতায়। বড়দার ছোট্ট জীবনী বেরোল। বাবার নামও তার সঙ্গে উল্লেখ করা হল। শহরের গণ্যমান্য সমস্ত লোককে বাড়িতে নেমন্তন্ন করা হল। লুচি, পোলাও, মাছ, মাংস, চপ, কাটলেট, সন্দেশ, রসগোল্লা, রাজভোগ, চাটনি কিছুরই আর কমতি ছিল না। সবাই খেয়ে ধন্য ধন্য করতে লাগল বড়দাকে।
বড়দার বড় লজ্জা করতে লাগল কিন্তু গোড়া থেকেই।
বলতে লাগল—এ আর এমন কী করেছি, প্রত্যেক বছরই তো কেউ-না-কেউ একজন ফার্স্ট হয়ই, এবার যেমন আমি ফার্স্ট হয়েছি, আসছে বছরেও আর-একজন হবে—
ভদ্রলোকরা বলত—আসছে বছরে যারা ফার্স্ট হবে তাদের বাবা-মায়েরও এমনি আনন্দ হবে। আনন্দ করাটা কি দোষের?
বড়দা কিন্তু তাতেও খুশি হত না।
বলত—তার চেয়ে আপনারা আশীর্বাদ করুন যেন জীবনের শেষ পরীক্ষাতেও ফার্স্ট হতে পারি, সেই ফার্স্ট হওয়াটাই চরম ফার্স্ট হওয়া—
কিন্তু আশ্চর্য প্রতিভা বড়দার। এম এস সি দিলে কেমিস্ট্রিতে। তাতেও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।
বাবার আর মা’র আনন্দ তখন দেখে কে।
কিন্তু শুধু পাশ করলেই হবে না। ভাল করে পাশই করো আর ফেলই করো, আসল কথাটা তো বড় চাকরি করে বেশি টাকা মাইনে পাওয়া? তুমি এম এ পাশই করো আর রাস্তার বখাটে ছেলেই হও, কত টাকা তুমি মাসে উপায় করো সেইটে দিয়েই বিচার করব তুমি জীবনের পরীক্ষায় পাশ না ফেল!
তা ঠিক এই সময়েই যুদ্ধ রাধল। এমনভাবে যুদ্ধ বেধে যে সব কিছু ওলোট-পালট বাধিয়ে দেবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। যুদ্ধ বেধে গেল ইংরেজ আর জার্মানদের মধ্যে। সে এক মহা যুদ্ধ। বলতে গেলে সমস্ত পৃথিবীই জড়িয়ে পড়ল সে-যুদ্ধতে।
হঠাৎ বড়দার চিঠি এল কলকাতা থেকে। বড়দা লিখেছে যে সে যুদ্ধে চাকরি পেয়েছে। প্রথমে দু’হাজার টাকা মাইনে। তারপরে চাকরিতে ভাল কাজ দেখাতে পারলে পরে মাইনে আরও বাড়বে। এমনকী পাঁচ হাজার ছ’ হাজার টাকাও হতে পারে।
চিঠি পড়ে তো মা কেঁদে উঠল। বাবার মাথায় বজ্রাঘাত। শহরের গণ্যমান্য লোক যারা খবরটা শুনল সবাই এল।
তারা বললে—মিত্তিরমশাই, এরই জন্য আপনি এত ভাবছেন? জানেন এই চাকরি পাবার জন্যে লক্ষ লক্ষ ছেলে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে। আর আপনার ছেলে সেই চাকরি পেয়েছে বলে আপনি ভয় পাচ্ছেন?
বাবা বললেন—না, তা নয়, যুদ্ধ বলে কথা, যদি কোনও বিপদ-আপদ হয় তাই ভাবছি। যুদ্ধ মানেই তো মারামারি, অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মারামারি। কে কাদের কত লোক মারতে পারল তারই প্রতিযোগিতা—
ভদ্রলোকরা বললে—তাদের মধ্যে কি সবাই মারা পড়ে? বরং মারা পড়ে তারা যারা আমাদের মতো লোক যুদ্ধে যায় না। বোমা তো আমাদের মাথাতেই পড়ে। নিরীহ লোকরাই যুদ্ধে বেশি মারা যায়। কারণ তাদের হাতে বন্দুক থাকে না রাইফেল থাকে না, কিছু না। তাদের বিপদই তো সবচেয়ে বেশি—
আর একজন বললে—আর তা ছাড়া যুদ্ধ তো চিরকাল থাকবে না, বড়জোর এক বছর কি দু’বছর, তারপরে তো গভর্নমেন্ট আপনার ছেলেকে মোটা টাকার চাকরি দেবে, সেদিকটাও তো ভেবে দেখবেন আপনি—
যুদ্ধে যাবার আগে বড়দা একবার বাড়িতে এল। মা’কে বাবাকে সব বুঝিয়ে বললে। বললে যে যুদ্ধ বেশিদিন চলবে না। যেই যুদ্ধটা থেমে যাবে সঙ্গে সঙ্গে মস্ত বড় চাকরি দেবে। এখন সরাসরি লেফটেন্যান্ট করে নিচ্ছে বড়দাকে, দু’দিন বাদেই ক্যাপ্টেন হবে, তারপরে মেজর, আর তারপরে কর্নেল।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন—তা তোমাকে কি জার্মানদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে নাকি?
বড়দা আশ্বাস দিয়ে বললে—আমি যুদ্ধ করব না, যারা যুদ্ধ করবে আমি তাদের পেছনে পেছনে থাকব। ইঞ্জিনিয়ারিং স্টোর্স-এর ইনচার্জ হব আমি।
বড়দা সরাসরি যুদ্ধে যাবে না শুনে বাবা-মা একটু আশ্বস্ত হল। আবার দু’হাজার টাকা মাইনে হবে শুনে খুব আনন্দও হল। বড়দা যাবার আগের দিন মা কালীমন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে এসে বড়দার কপালে পুজোর সিঁদুরের টিপ ছুঁইয়ে দিলে। আর মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল। কী প্রার্থনা করতে লাগল তা মা-ই জানে। হয়তো প্রত্যেক মা ছেলের ভালর জন্যে যে প্রার্থনা করে সেই একই প্রার্থনা কবলে। আমি তা জানতে পারলুম না।
বড়দা যুদ্ধে গিয়ে বাড়িতে প্রত্যেক সপ্তাহেই চিঠি পাঠাত। বেশ ভাল আছে বড়দা, খুব আরামে আছে। কোনও কষ্ট হচ্ছে না। চিঠিটা পড়ে বাবা-মা খুশি হত।
আর প্রত্যেক মাসে বাবার নামে বড়দার মাইনের টাকাটা চলে আসত। একেবারে পুরো দু’ হাজার টাকা। বাবা সে-টাকাটা বড়দার নামে ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা রেখে দিয়ে আসতেন। আর পাড়ার প্রত্যেকটা লোককে জানিয়ে আসতেন ছেলের চিঠি আসার কথা। যারা বেশি আগ্রহী তারা আবার চিঠিটা পড়ত। পড়াত। অন্য লোকদের শোনাত।
কখনও চিঠি আসত ফ্রান্স থেকে, কখনও বা আবার লন্ডন। আন্দাজে বুঝে নিতে হত কোথায় বড়দা আছে। কারণ মিলিটারিতে ঠিকানা দেওয়া বারণ।
বাবাও চিঠির উত্তর দিতেন—আমরা সবাই ভাল আছি, তুমি নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেবে, আর যদি কিছুদিনের ছুটি পাও তো একবার বাড়িতে আসিবে। তোমার মা তোমাকে দেখিবার জন্য বড়ই ব্যাকুল।…
এইরকম চিঠি কিছুদিন ধরে চলল। বাবা প্রত্যেকদিন খবরের কাগজ খুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। কাদের জয় হচ্ছে আর কারা হারছে এ নিয়ে গবেষণা করেন, মা’র সঙ্গে, পাড়ার লোকের সঙ্গে আলোচনা করেন। শহরের সবাই যখন চাইছে জার্মানি যুদ্ধে জিতুক, বাবা-মা তখন চাইছে ইংরেজ জিতুক। কারণ ছেলের চাকরি ইংরেজদের দলে।
আর শুধু খবরের কাগজ নয়, রেডিয়ো শোনাও তখন প্রায় বাতিকে দাঁড়িয়ে গেছে। যখন জার্মানদের জেতার খবর আসত তখন আমাদের খারাপ লাগত, আর ইংরেজদের জেতার খবর আসত তখন আমরা খুশি হতুম।
একদিন চিঠি এল বড়দা ক্যাপ্টেন হয়েছে। মাইনে আরও এক হাজার টাকা বেড়েছে।
এক-একবার বড়দার চাকরিতে উন্নতি হয় আর মা, মা-কালীর মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে আসে। যেন ছেলের আরও উন্নতি হয় মা, ছেলে যেন আমাদের মুখোজ্জ্বল করে মা, ছেলে যেন সুস্থ শরীরে বাড়িতে ফিরে আসে!
তা মা-কালী মা’র সে প্রার্থনা শুনল কি না কে জানে। আমরা শুধু পুজোর প্রসাদ খেলুম।
এরপরে হঠাৎ খবর আসতে লাগল জার্মানি হারছে। ইটালি হারছে। জাপান হারছে। আমেরিকা ইংরেজদের দলে ভিড়ে পড়েছে।
বাবা তো আনন্দে একেবারে লাফাতে লাগলেন। ইংরেজদের জয় যেন তাঁর নিজের ছেলের জয়।
তখন জিনিসপত্রের দাম দিন দিন বাড়ছে, দেশে বোমা পড়ছে, কলকাতা শহর থেকে লোকে ভয়ে পালাচ্ছে। কত সব দুর্যোগ গেল সে ক’বছর। কিন্তু বড়দা’র দৌলতে আমাদের সংসারে তখন কোনও অভাব অভিযোগ নেই, বড়দার মাইনের অজস্র টাকা ব্যাঙ্কে জমে গেছে।
সেই যুদ্ধের শেষের দিকে যখন ইংরেজদের জয়-জয়কার, তখন একদিন বড়দার একখানা চিঠি এল। তাতে বড়দা লিখেছে—আমি পনেরো দিনের ছুটিতে দেশে যাচ্ছি। আসছে মাসের দশই সন্ধের ট্রেনে আমি বাড়িতে পৌছুব। স্টেশন থেকে আমাদের মিলিটারি গাড়িতে সোজা বাড়ি পৌছুব, ট্রেন যদি ঠিক সময়ে পৌঁছয় তো রাত ন’টার মধ্যেই আমি পৌঁছুব—
চিঠিটা পড়ে খানিকক্ষণ কারও মুখেই কোনও কথা বেরোল না। আনন্দে মানুষ অনেক সময় বোধহয় বাবাও হয়ে যায়। আমার বাবা-মা’র অবস্থাও বোধহয় সেইরকম হয়ে গিয়েছিল।
যখন অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল তখন বাবা বললেন—আজ হল সাতুই, আর নীলু আসবে দশুই—আর তিন দিন বাকি—
তিনটে দিন। তিনটে দিন যেন তখন আমাদের কল্পনায় তিন বছর মনে হল। সেই তিনটে দিন যেন আর কাটতে চায় না। বড়দা আসবে! বড়দা এত বছর পরে বাড়ি আসবে। এ যেন হাতে চাদ পাওয়ার মতো ঘটনা। নীলু এলে বাবা যে কী করবেন তারই প্ল্যান করতে লাগলেন। নীলু যা যা খেতে ভালবাসে সেইসব জিনিসের তালিকা তৈরি হল।
তপসে মাছ ভাজা। তপসে মাছ ভাজা খেতে নীলু বড় ভালবাসত।
আর কী খেতে ভালবাসত গো?
মা বললে—ল্যাংড়া আম—
বাবা বললেন—ল্যাংড়া আম এখন কোথায় পাব?
মা বললে—সরভাজা, সরপুরিয়া—
কিন্তু সে-সব এখন কোথায় পাব?
ল্যাংড়া আম তখন বাজারে পাওয়া যায় না। আমের সময় চলে গিয়েছে। কিন্তু চেষ্টা করলে কী না পাওয়া যায়। এখনও তিন দিন সময় আছে! এই তিন দিনের মধ্যে কলকাতায় চলে গেলে সবই পাওয়া যাবে। কলকাতা শহরে পয়সা ফেললে কী না পাওয়া যায়? চেষ্টা করলে সেখানে ঘোড়ার দুধও পাওয়া যায়।
তা বাবা আর দেরি করলেন না। ন’ তারিখে সকালবেলার ট্রেনেই কলকাতায় চলে গেলেন। সেখানে এক দিনে সব কেনাকাটা করে দশ তারিখে সকালবেলাই এসে পৌঁছলেন। ল্যাংড়া আম, তপসে মাছ, সরপুরিয়া, সরভাজা। আর তার সঙ্গে কিসমিস, পেস্তা, বাদাম, আঙুর, আপেল, কমলালেবু। সবগুলোই দামি জিনিস।
সকাল থেকেই রান্নার আয়োজন চলল। পাড়ার যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই বলেন—জানেন চাটুজ্জেমশাই, আমার নীলু আসছে আজ রাত্তিরে—
—নীলু আসছে?
—হ্যাঁ, এখন সে কর্নেল। কর্নেল নীলরতন মিত্র। আমার ছেলে কর্নেল হয়েছে। জানেন তো?
চাটুজ্জেমশাই, গাঙ্গুলিমশাই, বোসমশাই সবাইকেই বাবা খবরটা দিলেন। আমিও খবর দিলুম আমার সব বন্ধুদের। সবাইকেই বললুম—আমার বড়দা আসছে ছুটিতে, এখন কর্নেল হয়েছে—
নিজেদের ঐশ্বর্যের কথা যদি লোককে জানাতেই না পারলুম তো কীসের আনন্দ। আসলে পাড়ার লোকরা কিন্তু খবরটা শুনে খুব খুশিই হল। আমার বাবা ছিলেন সকলের প্রিয়। মিত্তিরমশাই-এর কিছু ভাল হলে সবারই আনন্দ হত।
মা তো সেদিন সকাল থেকেই ব্যস্ত। বড়দা কোন ঘরে শোবে, কী খাবে, কীরকম দেখতে হয়েছে তাকে এইসব কথাই হতে লাগল বাবা-মা’র মধ্যে! শুধু তো সাধারণ ছেলে নয় নীলু, কর্নেল ছেলে। সুতরাং তার খাতিরই আলাদা। খোকা এলে তাকে সকলের বাড়িতে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। চাটুজ্জেমশাই-এর বাড়িতে আগে যেতে হবে। বাবা। বলবেন—চাটুজ্জেমশাইকে প্রণাম করো, জ্যাঠামশাই-এর আশীর্বাদেই তুমি এত বড় হয়েছ—
চাটুজ্জেমশাই জিজ্ঞেস করবেন—বেশ বেশ খুব ভাল, ভাল থাকো বাবা, আরও বড় হও, আশীর্বাদ করছি তুমি রাজা হও, আমাদের দেশের মুখোজ্জ্বল করো—
তারপর নিয়ে যাবেন মুখুজ্জেমশাই-এর বাড়িতে। এমনি করে সব বাড়িতে গিয়ে বড়দাকে দিয়ে সকলের পায়ের ধুলো নেওয়াবেন।
কত পরিকল্পনা বাবার। মা রান্না করছিল আর বাবা তাঁর এইসব পরিকল্পনার কথা আলোচনা করছিলেন।
একবার বললেন—মাংসতে যেন ঝাল দিয়ো না বেশি বুঝলে, নীলু আবার ঝাল খেতে পারে না—
মা বললে—সে তোমাকে বলতে হবেনা, সে আমি জানি—
—আর দ্যাখো একটা ভুল হয়ে গেল।
—কী?
বাবা বললেন—খোকা যে আনারস খেতে ভালবাসে—আনারসের কথা তো একেবারেই মনে ছিল না।
বলে আবার বাজারে ছুটলেন। এইরকম এক-একটা জিনিসের কথা মনে পড়ে আর সেইটে আনতে ছোটেন। সারাদিন কেবল এই-ই চলল। বাবারও বিশ্রাম নেই, মা’রও বিশ্রাম নেই। যখন সব কাজ শেষ হল তখন ঘড়িতে সন্ধে সাতটা।
বাবা ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলেন—এইবার বোধহয় কলকাতায় এসে পৌঁছেছে—
তারপর ঘড়িতে আটটা বাজল। বাবা বললেন—এতক্ষণে বোধহয় রানাঘাট পৌঁছেছে, আর এক ঘণ্টার রাস্তা।
রানাঘাট থেকে বাজিতপুরে পৌঁছতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। পিচের রাস্তা। জিপ গাড়িতে করে আসবে লিখেছে একেবারে হু হু করে এসে পৌঁছুবে। রান্নাবান্না সব তৈরি। মুখুজ্জেমশাই, চাটুজ্জেমশাই, গাঙ্গুলিমশাই, সব বাবার বন্ধুরাও বাড়িতে এলেন। নীলুকে দেখবেন। নীলুকে আশীর্বাদ করবেন। সবাই ঘড়ি দেখছেন।
আটটা বাজল ঘড়িতে। ন’টা। এইবার আসার সময় হল। বাবা সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মিলিটারি গাড়ি হু হু করে চলে আসবে। এ তো ট্যাক্সি নয়, বাসও নয় যে থেমে থেমে আসবে। মিলিটারি গাড়িকে থামাবে এমন ক্ষমতা পুলিশেরও নেই। আর গাড়িতে যে আসছে সে-ও যে সে লোক নয়, কর্নেল। একেবারে মাথা! সকলের হেড।
কিন্তু কোথায় কী? চারদিকে অন্ধকার। ঝাঁ-ঝাঁ অন্ধকার। কোথাও কিছু দেখা যায় না।
চাটুজ্জেমশাই বললেন—অত ভাবছেন কেন মিত্তিরমশাই, ট্রেন হয়তো কলকাতায় দেরি করে পোঁছেছে—
তা হবে। বাবা ভাবলেন, তা হবে। রেলের তো ব্যাপার সব। আজকাল যুদ্ধের সময় সব কাজ কি আর ঠিকমতো চলছে। হয়তো ট্রেনই দেরি করে আসছে!
শেষকালে রাত দশটাও বাজল। চাটুজ্জেমশাই, মুখুজ্জেমশাই, গাঙ্গুলিমশাই একে একে সবাই চলে গেলেন। আজ থাক। হয়তো মাঝ রাত্রে এসে পৌঁছবে ছেলে। কাল সকালবেলাই আবার না-হয় আসব। তখন দেখে যাব নীলুকে। আশীর্বাদ করে যাব তাকে।
মা বললে—আরও কিছুক্ষণ দেখা যাক—এখনও আসবার সময় আছে, সে না এলে খাব না—
বাবা বললেন—তা হলে বিলুকে খেতে দাও, ওর ঘুম পাচ্ছে, ও খেয়ে নিয়ে ঘুমোতে যাক, নীলু এলে ওকে ডেকে তুলবোখন—
আমি বললুম—না, আমার ঘুম পাচ্ছে না, আমি এখন খাব না, বড়দা এলে তখন একসঙ্গে খাব—
তখন এগারোটা বাজল ঘড়িতে। সারা পাড়াটা নিঝুম হয়ে এল। আমরা তিনজন, আমি বাবা আর মা, তিনজনেই বড়দার আশায় জেগে বসে রইলুম। কোথায় হঠাৎ কিছু শব্দ হয় আর আমরা আনন্দে চমকে উঠি। ভাবি ওই বুঝি বড়দা এল।
কিন্তু না, একটা বেড়াল ছাদ থেকে ভাঁড়ার-ঘরের টিনের চালের ওপর লাফিয়ে পড়েছিল, ওটা তারই শব্দ।
কিন্তু আর কতক্ষণ বসে থাকব। বাবার মুখটা ক্রমেই গম্ভীর হয়ে আসছে। মা’র চোখ দুটো ছল ছল করতে শুরু করেছে।
বাবা মা’কে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন—তুমি অত ভাবছ কেন, নীলু আসবে ঠিক, তুমি ভেবো না। মিলিটারি না? হুট করে আসব বললেই কি আর আসতে পারে? কাজকর্ম সব অন্য লোকদের বুঝিয়ে তবে তো আসবে! আর এখনই তো তার ঘাড়ে বেশি দায়িত্ব। এখন তো জাপানিরা যুদ্ধে হেরে গেছে। তোমার ছেলে কি সোজা ছেলে ভেবেছ? ব্রিটিশ রাজত্বটাই তো এখন নীলুর ওপর নির্ভর করছে, বলতে গেলে সে-ই তো সব একলা চালাচ্ছে—
বলতে বলতে হঠাৎ কী একটা যেন শব্দ হল।
আমরা আবার চমকে উঠলাম। ভাবলাম আবার হয়তো আর একটা বেড়াল লাফিয়ে পড়েছে ভাঁড়ার-ঘরের টিনের চালের ওপর!
কিন্তু না, হঠাৎ দেখি বড়দা।
—খোকা, তুই এলি? কী করে এলি? আমরা তো কই গাড়ির শব্দ পেলুম না।
বড়দা হো হো করে ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল।
হাসি থামিয়ে বললে—আমি তো খিড়কির পাঁচিল লাফিয়ে ঢুকেছি—
—কেন রে? সদর-দরজা তো খুলে রেখেছিলুম, খিড়কির পাঁচিল ডিঙিয়ে এলি কেন?
বড়দা বললে—তোমাদের চমকে দেবার জন্যে! যুদ্ধে গিয়ে আমাদের এরকম কত বাড়ির পাঁচিল ডিঙোতে হয়েছে, এসব অভ্যেস হয়ে গেছে আমার—
—কিন্তু গাড়ির শব্দ শুনতে পেলুম না তো কই?
বড়দা বললে—গাড়িটা মোড়ের মাথায় ছেড়ে দিলুম। ওকে আবার এক্ষুনি কলকাতায় ফিরতে হবে, সেখানে অনেক জরুরি কাজ আছে আমাদের, আমি এটুকু হেঁটেই এলুম।
বাবা উঠলেন। বললেন—থাক থাক, এখন আর কথা নয়, তুমি জামাকাপড় বদলে নাও, চান করবার গরম জল তৈরি, তারপর খেতে খেতে গল্প করা যাবে—
মা’র দিকে চেয়ে বললেন—দাও আমাদের সকলকে খেতে দাও—
আমি বড়দার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছিলুম। কী চমৎকার দেখতে হয়েছে বড়দাকে। ফরসা রং ছিল গায়ের, এখন তামাটে হয়ে গেছে। কিন্তু কী মজবুত শরীর, কী স্বাস্থ্য। মাথার চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা। গায়ে খাকি পোশাক। বুকে কতগুলো মেডেল, দু’কাঁধে কতগুলো স্টার। বড়দাকে দেখে আমার খুব গর্ব হচ্ছিল। আমারই তো বড়দা। আপন মায়ের পেটের বড়ভাই।
বড়দা আমার দিকে চেয়ে হঠাৎ বললে—কী রে বিলু, তুই কত বড় হয়েছিস? লেখা-পড়া করছিস তো মন দিয়ে? খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করবি, আর ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করবি, শরীরটাকে ফিট রাখবি। এরকম রোগা কেন তুই?
বলে আমার বুকে একটা ঘুসি মারলে।
মা বললে—নাও, অনেক রাত হয়ে গেল, তুই চান করে নে, খেতে খেতে গল্প করবি, এখন ওঠ—উঠে পড়—
বড়দা বাথরুমে গিয়ে চান করতে ঢুকল। ততক্ষণে মা আমাদের সকলের খাবার দিয়ে দিয়েছে। আমরা সবাই একসঙ্গে বসে বসে খেতে লাগলুম। বড়দা কত গল্প করতে লাগল। কোথায় প্যারিস, কোথায় লন্ডন, কোথায় ইতালি, আফ্রিকা। সব জায়গায় কী কী ঘটেছে, সেখানে গিয়ে কী কী দেখেছে তার গল্প বলতে লাগল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কখন কবে কী বিপদের মধ্যে পড়েছে, কী করে হাজার হাজার জার্মানকে মেরেছে তারই গল্প। কী করে বর্মা মালয় সিঙ্গাপুর দখল করেছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব বলতে লাগল।
মা বললে—ওরে, গল্প এখন থাক, আগে খেয়ে নে, কাল সকালে উঠে যত খুশি গল্প করিস, শুনব। ওদিকে রাত বারোটা বেজে গেছে তা জানিস?
কিন্তু বড়দা কি আর থামে? এত বছর পরে বাড়িতে এসেছে, এত বছর পর ছুটি পেয়েছে। যত গল্প মনে জমে ছিল সব বলতে লাগল।
শেষকালে যখন রাত একটা তখন বাবা বললেন—না না, আর নয় খোকা, তুমি শুয়ে পড়ো গিয়ে, তোমার ঘরে বিছানা করা আছে, সারাদিন খাটুনি গেছে, এখন ঘুমোও গে যাও—
বড়দা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর মা নিজেও খেয়ে নিলে। আমিও বাবার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি আর আমার জ্ঞান নেই—
হঠাৎ সদর দরজার কড়া নাড়ার শব্দে আমরা সবাই ধড়মড় করে জেগে উঠেছি।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন—কে?
—টেলিগ্রাম!
মা’ও অবাক হয়ে গেছে। মা’ও শুনতে পেয়েছে শব্দটা! বাবা মা আমি তিনজনেই জেগে উঠে সদর দরজায় গিয়ে হাজির হয়েছি। রাত তখন বোধহয় তিনটে। সেই অত রাত্রেই কার টেলিগ্রাম? নিশ্চয়ই খোকার! হয়তো খোকার ছুটি বাতিল হয়ে গিয়েছে। হয়তো ওপরওয়ালা সাহেব খোকাকে জরুরি তলব দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে। হয়তো যুদ্ধের কোনও জায়গায় জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বাবার হাত কাঁপছিল। বাবা টেলিগ্রামের রসিদে সই করে খামটা নিয়ে খুলে ফেললেন।
না, এ তো বাবার নামেই টেলিগ্রাম। এসেছে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম থেকে। তাতে লেখা আছে—আপনার ছেলে কর্নেল মিত্র বর্মার রণক্ষেত্রে ব্রিটিশ-সাম্রাজ্য রক্ষার জন্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছে—
মা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করলে—কীসের টেলিগ্রাম গো, কে পাঠিয়েছে—
বাবার গলা দিয়ে আর্তনাদের মতো যেন একটা আওয়াজ বেরোল—ওগো, খোকা নেই—
—নেই মানে? নেই মানে কী? কী বলছ তুমি?
—কিন্তু খোকা যে ও-ঘরে ঘুমোচ্ছে।
বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে এসে বড়দার শোবার ঘরে ঢুকলেন। তাঁর সঙ্গে মা-ও এল, আমিও এলুম।
কিন্তু কোথায় বড়দা? ঘরটা যে ফাঁকা, বড়দা যে আমাদের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললে, আমরা যে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলুম। তারপরে যে বড়দা ঘরে শুতে গেল। তা হলে কোথায় গেল সে? তা হলে রাত্রে কে এসেছিল? কার সঙ্গে এত কথা বললুম? সবই কি ভৌতিক কাণ্ড?
বাবা আর মা তখন সেখানেই অজ্ঞান অবস্থায় মূৰ্ছা গেল।
এ সেই কতকাল আগেকার ঘটনা। তারপরে কত মাস কেটে গেছে, কত বছর কেটে গেছে। কত বইতে ভূতের গল্প পড়েছি, কত ভূতের গল্পও বন্ধুর মুখে শুনেছি। কখনও তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু আমার নিজের জীবনের ছোটবেলাকার এই ঘটনাটার রহস্য আজও ভেদ করতে পারিনি, এখনও বুদ্ধি যুক্তি-বিজ্ঞান দিয়ে এই অলৌকিক ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা করতে পারিনি।
১৩৮১
অলংকরণ: মদন সরকার
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন