পৌলোমী সেনগুপ্ত
গরমের ছুটিতে প্রতি বছরই মামার বাড়ি চলে আসে মুনা। মামার বাড়ি মানেই অপার এক আনন্দের উৎস। মামারা তার অদ্ভুত। কানুমামার সারাদিন ধরে শুধু ওষুধ খাওয়ার নেশা। অফিস ছাড়া যতক্ষণ বাড়ি আছেন হয় ট্যাবলেট, নয় কোনও ক্যাপসুল, নয়তো সিরাপ চলছেই। পাছে সন্ধেবেলা মাথা ধরে, সেজন্য সকালে উঠেই দুটো ট্যাবলেট খেয়ে নিলেন। গত সপ্তাহে দুটো হাঁচি হয়েছিল, তার জন্য দিনে তিনবার সিরাপ। অফিসে টিফিনে ফিশফ্রাই কাটলেট সাঁটাবেন, পকেটে তাই মুঠো মুঠো অম্বলের বড়ি। ভানুমামার নেশা ‘পারফিউম’। কবজিতে রজনীগন্ধা, বগলে জুঁই, ঘাড়ে ফরাসি বুনো ফুল, পিঠে ওডিকোলন, বুকে গোলাপ। ঘুরছেন, ফিরছেন, লোককে গন্ধ শোঁকাচ্ছেন। আর বেণুমামার নেশা হল মিষ্টি। ঘুম থেকে উঠে জিলিপি, অফিস বেরনোর আগে চমচম, টিফিনে শোনপাপড়ি, ফেরার সময়ে কমলাভোগ, সন্ধেবেলা রসমালাই, রাত্রে কেশর দেওয়া রাবড়ি। এর সঙ্গে ছুটির দিনে বোঁদে, মিহিদানা আছে, আর আছে বোম্বাই সাইজের ল্যাংচা। যাকে কিনা আদর করে বেণুমামা বলেন, ‘ল্যাংচেশ্বর’। বছরের মধ্যে একশো বিরাশি দিন অবশ্য পেটের গণ্ডগোলে ভোগেন বেণুমামা।
কানুমামা, ভানুমামা, বেণুমামা ছাড়া আরও দুই মামা আছেন মুনার। টুটানমামা আর কুনালমামা। টুটানমামার বাড়ি বোড়ালে, তবে মাঝেমধ্যেই লেক প্লেসে অবস্থান করেন। হ্যা হ্যা করে হাসতে পারেন। গলা ফাটিয়ে গান করেন। বিদঘুটে সব গল্প বানাতে পারেন মুনাদের পেছনে সারাক্ষণই লেগে আছেন তিনি। ঢাকুরিয়ার কুনালমামা হলেন আর-এক মজার খনি। মজা করে করেই কত কী যে নতুন নতুন গল্প শোনাতে পারেন। গালভরতি দাড়ি, চুল সদাই উসকোখুসকো। কুনালমামার কাঁধের আধছেঁড়া ঝোলাটিতে যত হাসি, তত জ্ঞান। কুনালমামার সঙ্গে বেণুমামার মিষ্টি খাওয়ার জোর প্রতিযোগিতা লাগে মাঝে মাঝে।
তবে এই মজাদার মামাদের জন্যই যে মুনার মামার বাড়ি চলে আসা, তা নয়। গরমের ছুটিতে সব মাসতুতো, মামাতো ভাইবোন একজোট হয়, এটাই বড় আকর্ষণ। সাঁতরাগাছির সুমিমাসির বাড়ি থেকে আসে খুকু আর পুপসি, রাসেল স্ট্রিটের দীপালিমাসির বাড়ি থেকে তিতলি। এ ছাড়া কানুমামা আর বেণুমামার দুই মেয়ে কঙ্কা, টুকটুকি তো আছেই। জুলিমাসির ছেলে মুন্তুকুলি আর গোপালমামার ছেলে বুম্বাও আগে আগে আসত, ইদানীং তাদের খুব বড় বড় হাবভাব হয়েছে, ভাইবোনেদের সঙ্গে আড্ডা মারাটাকে তারা শিশুসুলভ কাজ বলে মনে করে।
এতে অবশ্য মুনাদের কিছু যায় আসে না। সাত ভাইবোনে মিলেই লেক প্লেসের বাড়িটাকে পুরো ভুশণ্ডির মাঠ বানিয়ে দেয়। ছুটছে, নাচছে, লাফাচ্ছে, গাইছে, চুলোচুলি করছে , চিলচিৎকার জুড়ছে। মুনার দিদার একেবারে ত্রাহি ত্রাহি দশা। কিন্তু কিচ্ছু বলার উপায় নেই। মুনার দাদুর কড়া হুকুম, গোটা বাড়ি যদি চুরমার হয়ে যায়, তা হলেও ওদের কোনও কথা বলা চলবে না। গরমের ছুটিতে সপ্তরথী পুরোপুরি স্বাধীন।
সেদিন হঠাৎ ধুন্ধুমার লেগে গেল বাড়িতে। সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল, বিকেল হতেই মুষলধারে নামল। বিকেলে যে দঙ্গল বেঁধে লেকে চরকি মারতে যাবে, তার উপায় নেই। সুতরাং ঝগড়া ছাড়া আর কাজ কী!
তা ঝগড়াটা লাগল কী নিয়ে? না, কোন গোয়েন্দা বড়?
মুনা এবার ক্লাস টেনে উঠেছে, সে-ই এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ, গম্ভীর মুখে সে বলল, “গোয়েন্দা হল গিয়ে ব্যোমকেশ। ওর মতো করে মানুষচরিত্র আর কেউ বুঝতে পারে না।”
খুকু মুনারই সমবয়সি প্রায়। মুনা যা বলবে খুকু তার উলটোটাই বলবে, এই রীতিই চলে আসছে ছেলেবেলা থেকে। খুকু বলল, “ছোঃ, গোয়েন্দা বলে যদি কেউ থাকে সে হল কিরীটি রায়। সে তোর ব্যোমকেশকেও এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচে আসবে। কী বলিস রে, তিতলি?”
তিতলির ক্লাস সেভেন। সে সদ্য ‘মিল অ্যান্ড বুন’ পড়া শুরু করেছে, নায়ক-নায়িকার দুঃখে সে কোনও বইই গোটাটা শেষ করতে পারে না, মাঝপথ থেকেই ফোঁস ফোঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আর হাপুস নয়নে কাঁদে। ছলছল চোখে সে বলল, “আমার গোয়েন্দাদের ভাল লাগে না খুকুদি। ওরা ভীষণ রাগী আর কাঠখোট্টা হয়।”
পুপসির ক্লাস এইট। সে ইদানীং ক্যারাটে ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, নিয়ম করে প্রতিদিন ডাম্বেল ভাঁজে। তিতলির মাথায় চটাস করে একটা চাঁটি মেরে বলল, “বেহালায় থেকে থেকে তোর মনটাও কেমন বেহালা বেহালা হয়ে গেছে। সারাক্ষণ পুঁই পুঁই বাজে।”
তিতলি ঝামরে উঠল, ‘অ্যাই, তুই আমার চুল নষ্ট করে দিলি কেন?”
“উঁউঁহ, চুল নষ্ট! দেব একদিন ঘুমের সময়ে চুলে কাঁচি চালিয়ে, ঘুম থেকে উঠে দেখবি পুরো কদমছাঁট হয়ে গেছিস। তখন বেহালা ছেড়ে কদমতলায় গিয়ে থাকতে হবে।” “ভাল হবে না বলছি পুপসিদিদি।”
“কী করবি তুই, অ্যাঁ? কী করবি?” বলতে বলতে টি-শার্টের হাতা গোটাল পুপসি, “গুলি দেখেছিস আমার? দেব এমন এক রদ্দা…”
“আহ পুপসি, বিহেভ ইয়োরসেলফ।” মুনা ধমক লাগাল, “কাজের কথায় আয়। কে বড়? ব্যোমকেশ, না কিরীটি?”
“দুটোই ঢ্যাঁড়শ। শরীরচর্চা করে না, ওরা আবার গোয়েন্দা কী রে?” পুপসি হাত-পা ছুড়ে একটু কুংফু প্র্যাকটিস করে নিল, “গোয়েন্দা হল গিয়ে ফেলুদা। রিয়েল টাফ ম্যান। যেমন বুদ্ধি, তেমন নার্ভ, তেমনই তাগত। ব্যোমকেশ আর কিরীটি দু’জনকে দু’হাতে ধরে পুকুরে চোবাতে পারে।”
কঙ্কা আর টুকটুকি, একজন ক্লাস টু, আর-একজন ক্লাস থ্রি। জগৎসংসারের কোনও বিষয়েই মতামত দিতে তারা দ্বিধা করে না। দু’জনে কোরাসে চেঁচিয়ে উঠল, “কেন, আমাদের টিনটিন কী দোষ করল? চাঁদে, সমুদ্রের নীচে, কোথায় না যেতে পারে টিনটিন? আমরা বলছি টিনটিনই বড়। হ্যাঁ, টিনটিনই বড়।”
এর পরে আর ঝগড়া না লেগে উপায় থাকে?
পাঁচ-সাত মিনিট খণ্ডযুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর দলের একমাত্র পুরুষসদস্য গুলুরাম হাল ধরতে বাধ্য হল। সে-ও এখন আর ছোটটি নেই, একা একা স্কুলে যায়-আসে, দীপালিমাসি বাড়িতে না থাকলে নিজে হাতে কফি তৈরি করতে পারে, হঠাৎই অনেকটা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে, তাকে তার দিদি, বোনেরা এখন বেশ সমীহই করে। আজকাল গুলুরাম টেনিসও খেলতে যায়। দু’হাতে ওভারহেড ম্যাশ করার ভঙ্গিতে সে থামাল সবাইকে, “দ্যাখো, এভাবে তো মীমাংসা হবে না। তবে তোমরা যদি মানো, আমি একটা সলিউশনের রাস্তা দিতে পারি।”
সকলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “কী? কী-ই?”
“প্ল্যানচেট। আমরা সবাই মিলে প্ল্যানচেটে কোনও নামকরা লোককে ডাকি, তিনিই আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেবেন।”
“প্ল্যানচেট মানে ভূত ডাকা!” খুকু অবিশ্বাসী চোখে তাকাল, “ভূত কি আমাদের সাঁতরাগাছির মশা যে, ডাকলেই চলে আসবে?”
“ডাকতে জানলে ঠিকই আসবে।” গুলুরাম তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে নাবালিকা দিদি, বোনদের দেখল, “আমি প্ল্যানচেটের প্রসেস জানি। মা শিখিয়ে দিয়েছেন। ঘরের আলো নিভিয়ে দাও, দরজা-জানলা বন্ধ করো, তারপর একটা তেপায়া টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে যাও। টেবিলে আঙুল ছুঁইয়ে একমনে যাকে ডাকতে চাও তার ধ্যান করতে থাকো। দেখি সে কেমন না এসে পারে! মা তো সেদিন পাবলো পিকাসোকে ডেকেছিলেন। আধঘণ্টা ধরে এসে পিকাসো সাহেব মাকে পেন্টিং শিখিয়ে গেলেন।”
এর পরে আর কথা চলে না। দীপালিমাসির আঁকার জগতে খুব নামডাক, তাঁর উদাহরণ ভাইঝি-বোনঝিদের কাছে বেদবাক্য।
তিন মিনিটের মধ্যে সাজসরঞ্জাম প্রস্তুত। রান্নাঘর থেকে দিদার মিকসি রাবার তেপায়া টেবিল এসে গেছে। দাদুর ঘর থেকে লোডশেডিংয়ের জন্য কিনে রাখা ইয়া ইয়া মোমবাতি। দিদা হাঁ হাঁ করে পেছন পেছন ছুটে এসেছিলেন, তাঁর মুখের ওপর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আর বৃষ্টির জন্য জানলা তো বন্ধ ছিলই।
মোমবাতি জ্বলার পর আবার একপ্রস্থ লড়াই শুরু হওয়ার উপক্রম। কাকে ডাকা হবে তাই নিয়ে। এবারও গুলুরামই সমস্যার সমাধান করে দিল। বলল, “দ্যাখো, যে লাইনের ব্যাপার, সেই লাইনেরই কাউকে ডাকা ভাল। আমার মনে হয় এ-ব্যাপারে শার্লক হোমসই যোগ্যতম লোক।”
প্রস্তাবটা সকলেরই মনঃপূত হয়েছে। শার্লক হোমসের মতো গোয়েন্দা যাকে সেরার শিরোপা দেবে, তাকে মেনে নিতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কঙ্কা, টুকটুকি অবশ্য শার্লক হোমসের নাম শোনেনি, দিদিদের একমত হওয়া দেখে তারাও অগত্যা ভুরু কুঁচকে রাজি হয়ে গেল।
সপ্তরথী টেবিল ঘিরে ধ্যানস্থ। টেবিলে আঙুল ছুঁইয়ে। এক মিনিট যায়, পাঁচ মিনিট যায়, দশ মিনিট যায়, কারও আসার লক্ষণ নেই।
হাল ছেড়ে দিয়ে সকলে যখন গুলুরামের মুণ্ডপাত করতে যাচ্ছে, হঠাৎ একটা মৃদু শব্দ শোনা গেল। দরজার বাইরে থেকে। ক্যাঁচ করে একটু যেন ফাঁক হল দরজাটা। মোমবাতির শিখাও কেঁপে উঠল যেন।
গুলরাম কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে উঠল, “এসে গেছে! এসে গেছে!”
দুম করে সকলেই বেশ নার্ভাস হয়ে গেছে। পুপসি ধরা ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে?”
গুলুরাম বলল, “শার্লক হোমস, আবার কে…”
তিতলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, “আমরা এখন কী করব?”
“চোখ বুজে শার্লক হোমসকে প্রশ্ন করব।”
কঙ্কা, টুকটুকি গা ঘেঁষে বসেছে খুকুদিদি মুনাদিদির। ভয়ে ভয়ে তারা বলল, “আমরা কিন্তু প্রশ্ন করতে পারব না। ভূত আমাদের ভাল লাগে না।’
“তোরা কেন করবি? আমি করছি?” খুকু গলা ঝেড়ে নিল, “আ-আ-আপনি কি এসেছেন?”
একটা ভাঙা ভাঙা কর্কশ গলা শোনা গেল, “এসেছি।”
মুনা প্রশ্ন করল, “আপনি কি শার্লক হোমস?”
গলাটা যেন হেসে উঠল, “তাতে কি সন্দেহ আছে?”
খুকুর গলায় তবু অবিশ্বাস, “আপনি তো সাহেবমানুষ, এত ভাল বাংলা জানলেন কী করে?”
গলাটার হাসির দমক বেড়ে গেল, “ভূতেদের ভাষা শিখতে হয় না খুকু। ভূত হলেই সব ভাষা জানা যায়। তুমি চাইনিজ শুনতে চাও? ইডিশ বলব? সোয়াহিলি? সাঁওতালি শুনবে, না সংস্কৃত?”
সকলে নিথর।
মুনা নীরবতা ভেঙেছে খানিক পরে, “না, না, ভাষা শুনে কাজ নেই। আপনিই শার্লক হোমস তা মেনে নিলাম আমরা।”
খুকু বলল, “আপনি তো সর্বজ্ঞ,আমাদের একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো।”
বলো কী প্রশ্ন?”
“কে বড় গোয়েন্দা? কিরীটি রায়? বোমকেশ? ফেলুদা? টিনটিন? কে?”
“এদের কেউই নয়।” গলাটা কেমন গম্ভীব শোনাল এবার। চুপ করে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর বলল, “গোয়েন্দাই বলো, কি সত্যদ্রষ্টাই বলো, সে দেখেছিলাম বটে একজনকেই, তার কাছে সবাই নস্যি। আমিও!”
“কে সে?”
“ঘনাদা। ঘনশ্যাম দাস দ্য গ্রেট। বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনে থাকত।” গলাটা চুক চুক করে শব্দ করল, “গত সপ্তাহে দেখে এলাম মেসবাড়িটা ভেঙে মাল্টিস্টোরেড হচ্ছে। দেখে এত দুঃখ হল আমার। ঘনাদার স্মৃতিচিহ্নের কী দশা!”
উত্তরটা শুনে কেউই খুশি হয়নি, পুপসি খানিকটা তেড়িয়া ভঙ্গিতে বলল, “মুখে একটা কিছু বলে দিলে তো হবে না, আপনাকে তা প্রমাণ করতে হবে। তা ছাড়া ঘনাদা তো ঠিক গোয়েন্দাও নয়, খালি গুল ঝাড়ে…”
“ইইইহ, ও-কথা বোলো না।” গলাটা যেন প্রায় শিউরে উঠেছে, “পুরাকালে জন্মালে ঘনাদাকে সবাই মুনি-ঋষি বলত। বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্রের সঙ্গে একসঙ্গে নাম করত। নেহাত এই কলিযুগে এসেছিলেন…আমার এখন হাত-পা নেই বলে তাঁকে প্রণাম জানাতে পারছি না। জানো, তিনি একবার কীভাবে আমার একটা কেসের সমাধান করে দিয়েছিলেন?”
এতক্ষণে কঙ্কার গলা চিঁ-চিঁ করে উঠল, “না-বললে কী করে জানব?”
“তা হলে তাড়াতাড়ি বলেই দিই গল্পটা। আমাকে আবার এর পর চিকমাগালুরে একটা প্ল্যানচেট অ্যাটেন্ড করতে যেতে হবে। ওরা তিন দিন আগে থেকে আমাকে বুক করে রেখেছে।”
টুকটুকি হবথর স্বরে বলল, “বলুন তবে।”
“তা শোনো। হয়েছে কী, সেবার লন্ডনে একটা বিচ্ছিরি কেসে ফেঁসে গেলাম। এক ভারতীয়র কেস। নাম তাঁর দীননাথ মজুমদার। ভদ্রলোক একদিন আমার কাছে কাঁপতে কাঁপতে এসে হাজির। তাঁর বাড়িতে নাকি একটা বিচিত্র কাণ্ড ঘটেছে।”
“কীরকম? কীরকম?” গুলুরাম প্রশ্ন ছুড়ল।
“দাড়াও, তার আগে দীননাথ সম্পর্কে কিছু বলে নেই। দীননাথ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিরিশ বছর ধরে লন্ডনে তাঁর বাস। বউ, ছেলে, নাতি-নাতনি নিয়ে লন্ডনের সাউদালে একটা তিনতলা বাড়িতে থাকতেন তিনি। একতলা, দোতলায় দুই ছেলে, দুই বউমা, নাতি-নাতনি, আর তিনতলায় তিনি আর তাঁর স্ত্রী। বাড়িতে দু’জন কাজের লোকও ছিল। এক বয়স্ক ভারতীয় বিধবা, আর একটা তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে। সে-ও ভারতীয়! রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত-টাত মেজে দোতলায় নেমে আসতেন দীননাথ আর তাঁর স্ত্রী। উঠতেন সেই রাতে। শুধু শোওয়ার জন্য। তা হয়েছে কী, একদিন ওইরকম রাত্রিবেলা শুতে গিয়ে দেখেন তাঁদের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।”
পুপসি প্রশ্ন করে উঠল, “ঘরে চোর ঢুকে বসে ছিল বুঝি?”
“তা হলে আর রহস্য কোথায়?” হোমসসাহেব হাসছে খনখন, “দীননাথ ছেলেদের ডাকলেন। তারাও প্রথমে তোমার মতোই ভেবেছিল। খুব হুঙ্কার-ফুঙ্কার ছাড়ল বাইরে থেকে। কিচ্ছু হল না। দরজা যে বন্ধ, সেই বন্ধ। ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। তারপর দুই ভাই মরিয়া হয়ে দরজা টেনে একটু ফাঁক করলেন , দীননাথের স্ত্রী একটা খুন্তি গলিয়ে দরজার খিল খুললেন।”
তিতলি বহুক্ষণ পর খিলখিল হেসে উঠেছে, “লন্ডনের দরজায় খিল! আমি তো লন্ডনের অনেক গল্প পড়েছি, কোথাও তো খিলের কথা শুনিনি!”
“তুমি ঠিকই বলেছ। খিল থাকার কথা নয়। কিন্তু ছিল। কারণ দীননাথ পুরো দেশীয় কায়দায় বাড়িটা বানিয়েছিলেন। একদম তাঁর ডিহিভুরশুটের বাড়িটার মতো।” হোমস একটু ভুতুড়ে দম নিয়ে কথা শুরু করল আবার, “তা দরজা তো খোলা হল। খুলেই সবার চক্ষু চড়কগাছ। জানলাগুলো সব ভেতর থেকে বন্ধ, বাথরুমের দরজাও ঘরের দিক থেকে ছিটকিনি টানা, কোথাও কোনও ফাঁকটি নেই। দরজাটা তা হলে বন্ধ করল কে? খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ। আলমারি, খাটের তলা, সে-আমলের প্রকাণ্ড সিন্দুক সব তন্নতন্ন করে দেখা হল। উৎসাহের চোটে ড্রয়ার, সুটকেস, টিনের তরঙ্গ খুলে দেখাও বাদ রইল না। হা হতোস্মি। একটা মাছির পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া গেল না। ভারী চিন্তিত হয়ে রাতটা কাটিয়ে দিল বাড়ির সবাই। দীননাথ তো বিছানাতেই বসে রইলেন সারারাত।
“পরের দিন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেদিন দরজা খোলার পরে দীননাথের বড়ছেলের বউ একটা জিনিস দেখাল দীননাথকে। একটা মা-কালীর পট। ঘটনাটা ঘটার ঠিক আগের দিনই পটটা কিনেছিলেন দীননাথ। কোনও এক অ্যান্টিক ডিলারের কাছ থেকে।
“পটটা খুবই সাধারণ। তোমরা যাকে কালীঘাটের পট বলো, অনেকটা সেই ধরনের। বর্ধমানের মহারাজার কোনও ভাইপোর বাড়িতে ছিল পটটা। কীভাবে যেন তার বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যায়। পাঁচ-সাত হাত ঘুরে আসে লন্ডনের ওই দোকানে।
“দীননাথের বড়বউমা বলল, ‘ওই পটটারই বোধ হয় কোনও অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তোমাদের মা-কালী নাকি খুব জাগ্রত দেবী, তিনিই নাকি লীলা দেখাচ্ছেন!’ দীননাথের স্ত্রীও বড়বউমার কথায় সায় দিলেন, হ্যাঁ, মা কালীই ভেতর থেকে বন্ধ করছেন দরজা।”
পুপসি তুরন্ত প্রতিবাদ করল, “যাহ, তাই হয় নাকি! মা-কালীর আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, লন্ডনে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবেন!”
“দীননাথবাবুও নাকি তাই বলেছিলেন। বলেছিলেন, পুলিশে খবর দেওয়ার কথা। তা বাড়ির লোক কি সে-কথা শোনে? এক-দু’দিনের মধ্যে তারাই ঘুরে ঘুরে লন্ডনের ভারতীয় মহলে মা-কালীর মহিমা প্রচার করে এল। তারপর শুরু হয়ে গেল এলাহি কাণ্ড। হোম, যজ্ঞ, কীর্তন, পূজাপাঠ কী নয়! দলে দলে লোক দীননাথের বাড়িতে আসছে তো আসছেই। দীননাথ একদম ভিড়ভাট্টা পছন্দ করেন না , কিন্তু তাঁর আর তখন উপায় নেই। অগত্যা লোকজনের ঠেলা সামলাতে ভোর হতেই ব্যবসার কাজে বেরিয়ে পড়েন, ফেরেন সেই মধ্যরাত্রে। কিন্তু মজার ব্যাপার, ওই ঘরে যখন ওইসব পুজোটুজো হচ্ছে, তখন কিন্তু আর দরজা বন্ধ হয় না। মা-কালীকে শত ডাকা সত্ত্বেও না।
“অলৌকিক কিছু না দেখলে কি আর লোকের ভাল লাগে! ধীরে ধীরে উৎসাহী লোকেদের ভিড় কমতে লাগল। যারা অতি-বিশ্বাসী তারা বলল, ‘মা-কালী বোধ হয় একা থাকতে চান।’ যারা স্রেফ কৌতূহলের বশে দেখতে এসেছিল, তারা ঠোঁট বেঁকিয়ে চলে গেল। দু-চারজন ঠারেঠোরে এ-কথাও বলতে ছাড়ল না যে , দীননাথবাবুই এ-সব গালগল্প প্রচার করেছেন। নিজে বিখ্যাত হওয়ার জন্য।
“এক সময়ে লোক আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। ও যিশু, সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই পুরনো খেল। আবার সেই দীননাথরা নীচে নামলেই ওপরের ঘরের দরজা বন্ধ।
“দীননাথের তখন ঘটনাটা অনেকখানি সয়ে এসেছে। তিনি আর লোক-জানাজানি হতে দিলেন না। পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখলেন পটটাকে। কী কাণ্ড! অমনি পাশের ঘরটা বন্ধ হতে শুরু করেছে। বাড়ির লোকজন দীননাথকে বলল, ‘এবার মানবে তো এ-সব মা-কালীরই কাজ।’ দীননাথ হেঁ-হেঁ করে তাদের কথায় মাথা নাড়লেন বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ে শুকিয়ে আমসি। কারণ তাঁর মন বলছে এ কোনও দুষ্ট লোকের কাজ। সেই রহস্য সমাধানের জন্যই তিনি ছুটে এলেন আমার কাছে। বাড়ির লোকরা অসন্তুষ্ট হবে বলে পুলিশকেও জানালেন না।
“তা আমি তো গেলাম। ওয়াটসনকে সঙ্গে নিয়ে। জানো তো, তখন আমার যশ বেশ ভালই।
প্রোফেসর মরিয়ারটির সঙ্গে লড়াই জিতেছি, বাস্কারভিলের কুকুরগুলোর কেসটা সলভ করেছি, সেই বিখ্যাত নাচিয়ে মূর্তিগুলোরও রহস্য সমাধান করেছি। মনে মনে তখন খুব অহঙ্কার। ভাবলাম এতসব জটিল কেস করেছি, আর এই সামান্য দরজা বন্ধ হওয়ার রহস্য ভেদ করতে পারব না?
‘কিন্তু এই কেসটাতেই আমি কেমন যেন ‘বুরবক’ বনে গেলাম। সব্বাইকে জেরা করলাম। একসঙ্গে। আলাদা আলাদা। ঘরটাও দেখলাম। সামান্যতম ‘ক্লু’ খুঁজে পেলাম না। উলটে একদিন আমি যখন দোতলায় লোকজনের এজাহার নিচ্ছি, তখনই তিনতলায় ঘর বন্ধ হয়ে গেল। লজ্জায় আমার মরে যাওয়ার জোগাড়।
“মনের দুঃখে ভাবলাম গোয়েন্দাগিরি ছেড়েই দেব। কাগজ দেখে দেখে কয়েকটা স্কুলে মাস্টারির আবেদনপত্র পাঠাতে শুরু করেছি, তখনই ওয়াটসন আমাকে পরামর্শটা দিল। আমার মনমরা ভাব দেখে বলল, ‘হোমস, এটা যখন ভারতীয়দের কেস, তুমি কোনও ভারতীয় গোয়েন্দার সঙ্গে আলোচনা করে দ্যাখো না কেন! ওরা যদি তোমাকে ভাল কোনও টিপস দিতে পারে?’
“ওয়াটসনের বুদ্ধির ওপর আমার কোনওদিনই তেমন ভরসা ছিল না। ওয়াটসনের কথা আঁতে লাগলেও সেদিন কিন্তু মনে মনে তারিফ না করেও পারলাম না। ওভাবে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী!
“খানিকটা দোনোমনো করে, খানিকটা কডলিভার অয়েল খাওয়া মুখে পাড়ি জমালাম কলকাতায়। তোমাদের ব্যোমকেশ, কিরীটি, ফেলু সবার বাড়ি গেছি, কেউ পরামর্শ দিতে রাজি নয়। সবারই এক রা, এখন খুব কেসের চাপ,লন্ডন যেতে পারব না। কত করে বললাম, আমি সব ছবির মতো বলে যাচ্ছি তোমাদের, সেই শুনে কিছু টিপস দাও। তো তাদের সেই এক কথা। ‘উঁহু, নিজেরা না দেখে আমরা টিপস দিই না।’
“সেই সময়েই প্রথম ঘনাদার নাম শুনলাম। ব্যোমকেশের মুখে। তার বিচিত্র কীর্তিকাহিনী, অগাধ জ্ঞান, তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টির কথা শুনে খানিকটা আশা জাগল মনে। খুঁজে খুঁজে চলেই গেলাম বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের টঙের ঘরে।
“ভাগ্য ভাল, ঘনাদা সেদিন একাই ঘরে ছিল। তবে সত্যি বলতে কী, তার চেহারা দেখে আমি একটু হতাশই হয়েছিলাম। ঘরদোর দেখেও। একটা তক্তপোশে আধশোওয়া হয়ে বসে আছে ঘনাদা। পরনে একটা লুঙ্গি আর পিরান। স্বাস্থ্যও যেন কেমন। বুড়োটে। গায়ে একটা সুতির র্যাপারও বোধ হয় জড়ানো ছিল।
“টেবিলে একটা ফাটা রেডিও ছিল ঘনাদার। আমি যখন যাই, মন দিয়ে কী একটা বাংলা গান শুনছিল ঘনাদা। আমাকে দেখে তার ভুরুটিও কাঁপল না।
“অমায়িক হেসে বলল, ‘এসো হোমস। তুমি নাকি বাড়ি বদলাচ্ছ?’
“আমি তো হাঁ। আমিই যে হোমস ঘনাদা জানল কী করে? আর বাড়ি বদলানোর কথা? সে তো আমি ওয়াটসন ছাড়া কারও সঙ্গে আলোচনা করিনি! তবে কি ঘনাদা অন্তর্যামী!
“ঘনাদা ভাবনাটাও টের পেয়ে গেল। বলল, ‘ভাবছ, আমি তোমার এত কথা জানলাম কী করে, তাই তো? এ কিছুই না। এ হল ‘সিম্পল ম্যাটার অব ইন্ডিয়ান যোগ’। মানুষের চিন্তাভাবনাগুলো বাতাসে তরঙ্গের মতো ভাসে, সেগুলো আমি যোগবলে সংগ্রহ করে রাখি। অমন হাঁ করে দেখছ কী? মুখ বন্ধ রাখো। আমার মেসের মশারা যে তোমার মুখে সেঁধিয়ে যাবে।’
“আমার বেশ মনে আছে তখন তোমাদের শীতকাল। ঠান্ডাও ছিল মোটামুটি, তবু তার মধ্যেই আমি ঘামতে শুরু করেছি। মনে মনে পুলকও জাগছে একটু। এ কোন মহাপুরুষের সামনে এসে পড়েছি আমি।
“ঘনাদা বলল, ‘বলো, তোমার সমস্যাটা শোনা যাক।’
“আমি তোতলাতে তোতলাতে সবিস্তারে গোটা ঘটনাটাই বললাম ঘনাদাকে।
“ঘনাদা চোখ বুজে শুনল। তারপর নাকে এক টিপ নস্যি গুঁজে ঝাড়া পনেরো মিনিট ভাবল কী যেন। হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছে, ‘দারিৎসু। টাইসেরিয়াস।’
“আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানে?’
‘“মানে পরে হবে। আগে তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও। যে দোকান থেকে পটটা কেনা হয়েছিল, সেটা তুমি ভিজিট করেছিলে?’
‘“আজ্ঞে হ্যাঁ ঘনাদা।’
‘“দোকানটা কি কোনও গ্রিকের?’
‘“হ্যাঁঅ্যা! আপনি কী করে জানলেন?’
‘“প্ৰশ্ন নয়, উত্তর দাও। দীননাথের বাড়িতে যে বাচ্চা ছেলেটি কাজ করে, সে কত দিন আগে দীননাথের বাড়িতে বহাল হয়েছে?’
‘“আজ্ঞে, ঘটনাটা শুরু হওয়ার মাসখানেক আগে।’
‘“যেদিন পটটা কেনা হয়, সেদিন দীননাথের সঙ্গে বাচ্চাটাও দোকানে গিয়েছিল?’
“আমি ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে আছি। কোনওক্রমে ঘাড় নাড়তে পারছি শুধু।
‘“যা ভেবেছি তাই। দারিৎসু। টাইসেরিয়াস। বুঝলে কিছু?’
“হাত কচলাতে কচলাতে বললাম, ‘আপনি না বললে বুঝি তার সাধ্য কী!’
“ঘনাদার বুড়োটে চেহারা পলকে টান টান। স্বর গমগম করছে, ‘আরে মূর্খ, টাইসেরিয়াস হল এক জবরদস্ত ডাকাতের নাম। শুনেই বুঝতে পারছ, নামটা গ্রিক? ওই লোকটাই লন্ডনে অ্যান্টিকের দোকান ফেঁদেছে।’
“মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘আর দারিৎসু কে?’
“ঘনাদা আমার টুপিটা খুলে আদর করে চুল ঘেঁটে দিল, ‘দুর বোকা, দারিৎসু লোক হতে যাবে কেন? দারিৎসু হল একটা জটিল সুতোর ফাঁসের নাম। আমিই ফাঁসটা তৈরি করা টাইসেরিয়াসকে শিখিয়েছিলাম। টন সুতোর ওই ফাঁস খিলের ডগায় আলতো করে লাগিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে টানলে খিল ওপর দিকে উঠতে থাকে। খিল খাপের মুখে এলে একটা ঝটকা দিতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে খাপে বসে যায় খিলটা, সুতোটাও খুলে বেরিয়ে আসে বাইরে। যেমন সহজ, তেমনই দুর্বোধ।’
“রহস্যটা যেন একটু একটু স্পষ্ট হচ্ছিল। বললাম, ‘আপনি বলতে চান বাচ্চাটাই করছে কাজটা?’
‘“অলবত। ওকে তো টাইসেরিয়াসই পাঠিয়েছে। ফাঁসটা শিখিয়ে।’
“এতে টাইসেরিয়াসের লাভ?’
“আছে। দীননাথ যে ভয় পাচ্ছে, সেটাই ঘটতে পারে যে-কোনওদিন। তিনতলাতেই দীননাথের আয়রন চেস্ট, গয়না, শেয়ারের কাগজ… ভয় তো পাওয়ারই কথা। এরকম কিছুদিন চালানোর পর সত্যিই একদিন তিনতলাটাকে সাবাড় করে দেবে টাইসেরিয়াস। ও বড় নিষ্ঠুর। জিনিসপত্র হাতানোর সময়ে দীননাথকেও মেরে ফেলবে। শুধু তাই নয়, তার কয়েকদিন আগে বাচ্চাটাও উধাও হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে। সবাই ভাববে এ-সবই হচ্ছে মা-কালীর অলৌকিক লীলা। অথবা ভৌতিক কিছু। টাইসেরিয়াসের টিকিটা ছুঁতে পারবে না কেউ। তুমি এক্ষুনি দেশে ফিরে যাও হোমস। প্রাণে বাঁচাও দীননাথকে।’
“আমি তো পুরো ভারতীয় কায়দায় প্রণাম করে ফেলেছি ঘনাদাকে, ‘আপনি আমার সম্মান রাখলেন ঘনাদা।’
“ঘনাদা একটুও খুশি নয়। বসে বসে আঙুল কামড়াচ্ছে, ‘ইস, কেন যে আমি টাইসেরিয়াসকে ফাঁস তৈরিটা শিখিয়েছিলাম!”’
এতক্ষণ ধরে গল্পটা শুনতে শুনতে বোজা চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হয়েছিল গুলুরামের। নিশ্বাস বন্ধ করে সে বলল, “সত্যিই তো, ঘনাদা কেন টাইসেরিয়াসকে শেখাল ফাঁসটা?”
শার্লক হোমসের ছায়ামূর্তি অন্ধকারে দুলছে। মোমের শিখা কাঁপছে অল্প অল্প। বোধ হয় ভৌতিক নিশ্বাস ফেলছে হোমস। গোটা দু’-তিন নিশ্বাস ফেলে বলল, “প্রশ্নটা যে আমার মনেও জাগেনি তা নয়। জেগেছিল বইকী!”
“জিজ্ঞেস করেননি?”
“করেছিলাম।”
“ঘনাদা কী বলল?”
“সে আর-এক কাহিনী। ঘনাদা টাইসেরিয়াসকে কোথায় ফাঁসটা শিখিয়েছিল শুনবে? ট্রাসি গুম্ফাযয়।”
“সেটা আবার কোথায়?”
“তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে আড়াইশো-তিনশো মাইল দূরে। ঘনাদা সেখানে গিয়েছিল চেঙ্গিস খাঁর গুপ্তধনের খোঁজে। জানো তো, চেঙ্গিস খাঁ তিব্বতে মারা গিয়েছিল? কিন্তু তার দেহ সমাধিস্থ করা হয় মঙ্গোলিয়ায়। উলানবাটোরের কাছে কোনও এক অজ্ঞাত জায়গায়। তিব্বত থেকে যখন চেঙ্গিস খাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন নাকি সঙ্গে প্রচুর হিরে-জহরতও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেইসব ধনরত্নের আজ পর্যন্ত কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। তা ঘনাদা কোথায় যেন শুনেছিল ট্রাসি গুম্ফায় ওই গুপ্তধনের কিছু তথ্য রাখা আছে। সেখানে গিয়ে টাইসেরিয়াসের সঙ্গে পরিচয়। টাইসেরিয়াস দারুণ মজার মজার গল্প বলতে পারত, ঘনাদার সঙ্গে খুব সহজেই তাই তার বন্ধুত্ব জমে গেল। গুফায় থাকতে থাকতেই ঘনাদাই একদিন গুপ্তধনের কথা বলে ফেলেছিল টাইসেরিয়াসকে। ব্যস, অমনই টাইসেরিয়াস ঘনাদার সঙ্গে একদম জোঁকের মতো সেঁটে গেল। টাইসেরিয়াসও ওই ধান্দাতেই গিয়েছিল কিনা।’
“তার সঙ্গে ফাঁসের সম্পর্ক কী?” গুলুরাম বেশ অসহিষ্ণু এবার।
“সাধে কি আর শিখিয়েছিল ঘনাদা! রোজ গুম্ফায় যায় ঘনাদা, পুথিপত্র ঘাঁটে, তাই দেখে হঠাৎ একদিন এক বৌদ্ধ লামার সন্দেহ হল। সঙ্গে সঙ্গে দু’জনকেই সে আটকে ফেলেছে একটা ঘরে। দু’দিন নিরম্বু উপবাসের পর ঘনাদা অধৈর্য হয়ে পড়ল। পাশে টাইসেরিয়াসও খিদেয় কুঁই কুঁই করছে। তখনই ঘনাদা ওই ফাঁসটা তৈরি করে। ঘরের ভেতর থেকে বাইরের খিল খোলার জন্য। শুধু তাই নয়, পাছে লামার সন্দেহ হয় সে জন্য বাইরে এসে একই ভাবে খিল তুলে ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয় ঘরটা। আর তখনই টাইসেরিয়াসও শিখে যায় ফাঁসটা। আর পরদিনই ঘনাদার ব্যাগ ঘেঁটে পুরনো পুথিপত্র থেকে ঘনাদার তৈরি করা গুপ্তধনের ম্যাপটা হাতিয়ে নিয়ে পালায় টাইসেরিয়াস। লোকটা এত ভয়ংকর যে, যে-লামা তাকে আটকেছিল, তাকেও যাওয়ার আগে খুন করে রেখে যায়।”
পুপসি উসখুস করে উঠল, “টাইসেরিয়াস গুপ্তধন পেয়েছিল?”
“তা হলে কি আর লন্ডনে গিয়ে দোকান করে? ঘনাদা তো ট্রাসি গুম্ফা ঘেঁটে শুধু আধখানা ম্যাপ তৈরি করেছিল। বাকি আধখানা ম্যাপ তো তৈরি করার কথা সেই উলানবাটোরে। অর্ধেক ম্যাপ হারিয়ে যাওয়ার পর ঘনাদার মন ভেঙে গেল। আর বাকি ম্যাপ তৈরিই করল না।”
খুকু আর চুপ থাকতে পারল না, “তা মিস্টার হোমস, লন্ডনে গিয়ে আপনি টাইসেরিয়াসকে ধরতে পেরেছিলেন?”
“টাইসেরিয়াস কি কম ধূর্ত! যেই শুনেছে আমি কলকাতায় গেছি, অমনই সে লন্ডনের দোকান তুলে দিয়ে হাওয়া। বাচ্চা ছেলেটাকে তিনবার কান রগড়ানি দিতেই সত্যি কথাটা স্বীকার করে ফেলল। আমাকেও আর স্কুল মাস্টারিতে যেতে হল না।”
“কিন্তু ঘনাদাই বা দারিৎসু শিখল কার কাছ থেকে?” খুকুর প্রশ্নের বুঝি শেষ নেই।
“সে আর-এক লম্বা কাহিনী। সেটা বলতে গেলে আমার আজ আর চিকমাগালুরে যাওয়া হবে না। আমার লন্ডনের বিগবেনে কখন দুপুর দুটো বেজে গেছে। আর ওখানকার দুটো মানে তোমাদের এখানে সন্ধে সাড়ে সাতটা।” শার্লক হোমসের ছায়া দুলছে , “আমি এখন তা হলে চলি, অ্যাঁ?”
পুপসি তড়িঘড়ি বলে উঠল, “তা হলে আমাদের দারিৎসুর গল্পটা শোনা হবে না?”
“ইচ্ছে থাকলে নিশ্চয়ই হবে। তোমরা আমাকে বুক করে রাখো। সামনের সপ্তাহে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার পর থেকে ফ্রি আছি। যদি চাও তো সেদিনই…। প্ল্যানচেট করতে হবে না, আমি এমনই এসে যাব। শুধু ঘরের লাইটটা একটু নিভিয়ে রেখো। কী, আসব?”
তিতলি বিরস মুখে বলল, “কী দরকার! প্রত্যেক উইকে বাড়িতে ভূত এলে বাড়ির বদনাম হয়ে যাবে।”
“তুই চুপ কর তো!” অন্ধকারেই পুপসি চাঁটি মারল তিতলিকে, “না, না, মিস্টার হোমস, আপনি আসুন। আমাদের সন্ধেটা ভালই কাটবে।”
ঝুপ করে মোমবাতি নিভে গেল। একটু ফাঁক হয়ে থাকা দরজা বন্ধ হয়ে গেল ক্যাঁচ করে।
কঙ্কা, টুকটুকি সজোরে চেপে আছে দিদির হাত। সপ্তরথী নির্বাক, নিস্পন্দ। সাহস করে যেন শ্বাসও নিতে পারছে না কেউ।
দড়াম করে খুলে গেল বন্ধ দরজা। পুরোপুরি। আলো জ্বলে উঠেছে ঘরে।
আলোকিত ঘরে দু’ হাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে আছেন টুটামামা। দাঁত বের করে হাসছেন। টুটানমামার আপাদমস্তক কালো বর্ষাতিতে মোড়া।
“কী রে, তোরা সব এমন ভেবলু মুখে ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস কেন?”
“জানো তো, এক্ষুনি না…,” কঙ্কা, টুকটুকি শার্লক হোমসের কথা বলতে যাচ্ছিল, মুনা তাদের মুখ চেপে ধরেছে। সন্দিগ্ধ চোখে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কতক্ষণ এসেছ?”
“এই তো ঢুকছি।” টুটানমামার হাসি আরও রহস্যময়। চোখ নাচছে, “কেন বল তো?”
সাত ভাই-বোন নিমেযে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে নিল। বুঝি-বা কিছু ইশারাও হয়ে গেল নিজেদের মধ্যে।
থাক, শার্লক হোমস তো বলেইছে, আবার বৃহস্পতিবার আসবে। তখনই বোঝা যাবে রহস্যটা।
১৪০৩
অলংকরণ: দেবাশিস দেব
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন