পৌলোমী সেনগুপ্ত
আমার বন্ধু নিত্যপ্রিয় কলকাতায় এলে আমার সঙ্গে দেখা করে যেত। সবসময় পারত না, কিন্তু সময় পেলে ঠিকই আসত। নিত্য আমার কলেজের বন্ধু, আমরা দু’-চার জন খুবই গলায় গলায় ছিলাম। ওর বাড়ি সালানপুর। জায়গাটা কলকাতার খুব কাছে নয়—আবার এমন একটা দূর নয় যে, যাওয়াই যায় না। কলেজে পড়ার সময় নিত্য হোস্টেলে থাকত। তখন থেকেই সে কতবার আমাদের বলেছে তাদের সালানপুরের বাড়িতে যেতে। লোভ দেখিয়েছে অনেক, পুকুরে মাছ ধরার, পাখি শিকার করার, এখানে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যাবার—তবু আমাদের যাওয়া হয়নি। মাছ ধরার কিংবা পাখি শিকার করার আমরা কিছু জানি না, বেড়াতে যাবার ইচ্ছে থাকলেও আলসেমি করে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
গতবার শীতের মুখে নিত্যপ্রিয়র বাবা মারা গেলেন। চিঠি লিখেছিল নিত্য। শ্রাদ্ধের ছাপানো চিঠিও পেয়েছিলাম। যাব যাব করেও শেষপর্যন্ত যেতে পারিনি আমার মায়ের অসুখের জন্যে। হঠাৎ একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিল মায়ের।
মা ভাল হয়ে যাবার পর নিত্যর চিঠি পেলাম। মায়ের খবর জানতে চেয়েছে। আমার নিজেরই খারাপ লাগছিল। এতদিন হয়ে গেল—বেশ কয়েকটা বছর—নিত্যর বাড়ি যাওয়া হল না। তার বাবার কাজের সময় অন্তত যাওয়া উচিত ছিল। তাও হল না।
আমাদের আর এক বন্ধু বিভূতিকে বললাম, “যাবি? নিত্যর কাছে এবার যাওয়া উচিত, এই সময়টায় অন্তত। দিন তিন-চার ঘুরে আসি।”
বিভূতি রাজি। সে স্কুলে মাস্টারি নিয়েছে। পরীক্ষা-টরিক্ষা শেষ, ক্লাস প্রমোশনও হয়ে গেছে। হাতে তার কোনও কাজ নেই।
বড়দিন পেরিয়ে গিয়ে নতুন বছর পড়ছিল তখন। শীত পড়েছিল ভালই। এসময় দিনকয়েকের জন্যে বাইরে থেকে বেড়িয়ে আসতে ভালই লাগে মানুষের।
সালানপুর জায়গাটা আসানসোল থেকে মাত্র দু’-তিনটে স্টেশন, মধুপুরের লাইনে। প্যাসেঞ্জার গাড়িতে না চাপলে মেরেকেটে ঘণ্টা ছয়-সাতের ব্যাপার।
বিভূতি আর আমি সত্যি-সত্যি ট্রেনে চেপে বসলাম বছরের একেবারে শেষ দিনটিতে।
চিঠি লেখা ছিল। সালানপুরে গাড়ি পৌঁছতেই দেখি নিত্যপ্রিয় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে।
প্লাটফর্মে পা ছোঁয়াতেই নিত্যপ্রিয় ছুটে এল। “শেষপর্যন্ত এলি তা হলে? আয়।”
নিত্যপ্রিয়কে কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছিল। অশৌচ, শ্রাদ্ধ, নিয়মভঙ্গ সবই কেটে গেছে যদিও, তবুও তার জের যেন এখনও মিলিয়ে যায়নি ওর শরীর থেকে। সামান্য রোগা রোগা, শুকনো দেখাচ্ছিল। মাথায় এখনও চুল গজায়নি তেমন, ছোটছোট খোঁচা খোঁচা হয়ে রয়েছে। মুখটা বেশ ফ্যাকাসে।
বিভূতি নিত্যর পিঠে হাত রেখে বলল, “তোর অবস্থা আমার আগেই হয়ে গিয়েছে। কেমন আছিস এখন?”
“আছি এক রকম। আমরা সামলে নিয়েছি খানিক। মা এখনও ঠিক সামলে উঠতে পারেনি। মাকে নিয়েই যা মুশকিল।…নে, চল।”
নিত্যপ্রিয়র মুখে আগে শুনেছি অনেক, ধারণা করতে পারিনি। জায়গাটা সত্যি চমৎকার। যেদিকে তাকাও আকাশ যেন ঢলে পড়েছে। যেমন ফাঁকা, কত গাছপালা, শালুক পাতায় ভরে আছে পুকুর, শ্যাওলা রয়েছে, কিন্তু ঘোলাটে জল কোথাও নেই বড়। হা হা করছে মাছ, সবজির খেত, ঘাসের ওপর জমে থাকা রাতের হিম এখনও শুকিয়ে ওঠেনি। রোদ টলটল করছে। বাতাসের গন্ধটাই আলাদা।
নিত্যদের বাড়ি এসে আরও অবাক হয়ে গেলাম। চারদিকে উঁচু পাঁচিল, বাড়িটাও এক বিচিত্র ছাঁদের, দুর্গ-দুর্গ দেখতে লাগে, জলে জলে শ্যাওলা জমে গেছে বাইরের দেওয়ালে, জানলাগুলো ছোট ছোট, কার্নিশে লোহার শিক পোঁতা। বাড়ির পেছন দিকে বাগান। ফলের গাছ অনেক রকম। বাগানের অন্যপাশে লোহা-লক্কড়ের স্তূপ, মায় একটা ভাঙা বাড়ি।
দোতলার কোনার ঘরে আমাদের জায়গা করে রাখা হয়েছে। খাট-বিছানা সাজানো।
এই বাড়িটা নিত্যদের দু’পুরুষের। তার ঠাকুরদা শুরু করেছিলেন; বাবা শেষ করেছেন। নিত্যকে কিছু করতে হবে না। জমি-জায়গা দেখাশোনা করে আর কোলিয়ারির ঠিকাদারি করে দু’ পুরুষে অবস্থা বেশ সচ্ছলই করে গেছেন নিত্যর পূর্বপুরুষরা। নিত্যও ঠিকেদারি কাজ নিয়ে আছে। একসময়ে এদিকে ডাকাতির খুব উপদ্রব ছিল। কাজেই বাড়িটাকে ওইরকম দুর্গের মতন চেহারা করে গড়ে তুলতে হয়েছে। বন্দুক-টন্দুকও আছে বাড়িতে।
খাওয়া-দাওয়া গল্পগুজব করে দুপুরটা কাটল। বিকেলে বেরোলাম বেড়াতে। ভালই লাগছিল। তবে শীতটা বড় বেশি। আমাদের মতন কলকাতার শহুরে বাবুদের গায়ের চামড়ায় এ-শীত সহ্য হয় না। উত্তুরে বাতাস দিতে লাগল কনকনে, ঝপ করে আকাশ থেকে অন্ধকারটাও খসে পড়ল। আর বেড়ানো হল না। বাড়ি ফিরলাম।
বাড়ি ফিরে চা, মুড়ি, আলুর ঝাল-ঝাল বড়া, বেগুনি খেতে খেতে হাজার রকম গল্প। একটা ছোট পেট্রোম্যাক্স বাতি জ্বালিয়েছিল নিত্য; সেটা জ্বলতেই লাগল। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার।
গল্পে গল্পে রাত হয়ে গেল খানিকটা। নিত্যর ছোটভাই বার কয়েক তাগাদা দিল। আমরা খেতে চললাম অন্য ঘরে।
নিত্য তার শোবার ব্যবস্থা আমাদের সঙ্গেই করেছিল। কারণ আর কিছু নয়, আড্ডা আর গল্প। সর্বক্ষণ সে আমাদের আঁকড়ে থাকতে চায়।
খেয়ে এসে আবার আমরা বসলাম। এবারে আর পেট্রোম্যাক্স নয়, লণ্ঠন জ্বলতে লাগল ঘরে।
তিন বন্ধু সিগারেট ধরিয়ে শুয়ে বসে গল্প করছি। করতে করতে নিত্যর বাবার কথা উঠল। তার বাবার মৃত্যু থেকে কথাটা গড়িয়ে গড়িয়ে আত্মা, পরলোক, পুনর্জন্ম, জাতিস্মর এইসব প্রসঙ্গ থেকে একেবারে ভূতের প্রসঙ্গে চলে গেল।
আমি বরাবরই একটু ভিতু গোছের লোক। ভূত মানি আর না-মানি গা-ছমছমে গল্প শুনলে অস্বস্তি হয়। তার ওপর ওই নতুন জায়গা। ঘরের মধ্যে তাকালে ছাদটাও ভাল করে চোখে পড়ে না—এত উঁচু ছাদ, আর এমনই মিটমিটে আলো। তিন-চারটে কুলঙ্গিতে যেন অন্ধকারের তাল জমে আছে। দেওয়াল-তাক গোটা দুই, দেখতে চোরা-দরজার মতন।
বিভূতি স্কুলের সায়েন্স টিচার। ফিজিক্স আর অঙ্ক পড়ায়। নিজেকে সে কী ভাবে জানি না; তবে আমার মতন ভিতু নয়। ভূতটুত মানে না। ভূতের গল্পে তার রুচি থাকলেও ভূতে নেই। বিভূতি ইয়ার্কি ঠাট্টা করছিল। তামাশা করছিল।
রাত হয়ে যাচ্ছে। লম্বা একটা হাই তুলে বিভূতি বলল, “ভূতের ব্যাপারে আমার থিয়োরি হচ্ছে— যার ভূত ভবিষ্যৎ কোনওটাই নেই সেইটেই হচ্ছে আসল ভূত, আদি ভূত।”
আমি ঠাট্টা করে বললাম, “প্রায় তোর মতন অবস্থা তা হলে।”
বিভূতি বলল, “ঠিক বলেছিস। আমরাই যথার্থ ভূত।”
এমন সময় নিত্য হঠাৎ বলল, “তোদের একটা জিনিস দেখাব। দেখবি?”
“ভূত দেখাবি?” বিভূতি তামাশা করে বলল, “তোদের এই বাড়ির চারপাশে যত নিম, বেল, কাঁঠাল গাছ, তাতে দু’-চারটে ভূত থাকলেও থাকতে পারে।”
নিত্য বলল, “না, বাইরে নেই। ভেতরেই এক জিনিস আছে, যার ভয়ে আমি মরছি। দাঁড়া; আসছি।”
নিত্য উঠে গেল।
আমার ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। দুপুরে এক চোট ঘুমিয়েছি। তবু। বাইরে এলে বোধহয় একটু বেশি ঘুম পায়। তার ওপর বাইরে শীতের হাওয়ার শব্দ, ঘরে কনকনে ঠান্ডা, লেপের আরাম, ঝাপসা ঘর— ঘুমের আর দোষ কোথায়। নিত্য কোন জিনিস এনে দেখায়, তার জন্যে কৌতূহলও হচ্ছিল।
দুটো খাট পাশাপাশি আমাদের জন্যে পাতা। নিত্যর জন্যে একটা নেয়ারের খাট। মশারি রয়েছে, শোবার সময় টাঙিয়ে নেব।
শীতটা বাস্তবিকই এখানে বেশি। ঘরের মধ্যেও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। লেপ চাপা দিয়ে বসে আছি আমরা।
নিত্য ফিরে এল।
ফিরে এসে বিছানায় বসল। বলল, “এই জিনিসটা দেখ।”
দেখার মতো অদ্ভুত কিছু নয়। একটা পকেট ঘড়ি। মান্ধাতার আমলের।
বিভূতি হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা নিল। এ-রকম ঘড়ি আজকাল আর দেখা যায় না। ব্যবহার করে না কেউ। আগে খুব চল ছিল। চেন-বাঁধা পকেট-ঘড়ি আমিও দেখেছি আমার বড়মামা বরাবর ব্যবহার করত।
ঘড়ির উপর ঢাকনা ছিল। বুড়ো আঙুল দিয়ে আংটা টিপতেই খুলে গেল।
ঝুঁকে পড়ে আমরা দেখতে লাগলাম। ডায়ালটা ময়লা হয়ে এলেও, রোমান হরফের দাগগুলো পড়া যায়, কাঁটা দুটোও ঠিক আছে। কোন কোম্পানির ঘড়ি বোঝা গেল না, লেখাটা মুছে গেছে—দু’-একটা অক্ষরই শুধু চোখে পড়ে আবছা ভাবে।
বিভূতি বলল, “তোর বাবার ঘড়ি?”
নিত্য বলল, “না, আমার ঠাকুরদার।”
“তা এতে দেখবার কী আছে? পকেট-ঘড়ি। বাইরের ডালাটায় কারুকাজ রয়েছে। এই তো?”
আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিত্য কেমন করে যেন হাসল, মরা হাসি। বলল, “ঘড়িটা এখনও চলে। দেখবি?”
বলে ঘড়িটা নিয়ে পুরো দম দিল নিত্য। দম দিয়ে বিভূতির হাতঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়ে দিল। দশটা পঞ্চান্ন। বলল, “ঘড়িটা চলছে। কানে নিয়ে শোন।”
কানের কাছে ঘড়ি নিয়ে শুনল বিভূতি। আমারও হাতে দিল। আমিও শুনলাম। টিকটিক শব্দ হচ্ছে। সেকেলে ঘড়ি, সেকেন্ডের কাঁটা নেই—থাকলে কানে শুনতে হত না।
ঘড়িটা ফেরত নিয়ে নিত্য বিছানার ওপর রেখে দিল। বলল, “ঘণ্টা খানেক আমাদের জেগে থাকতে হবে।”
“কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
নিত্য বলল, “ঘড়িটা এখন ঠিক চলবে। বারোটা বেজে সাত মিনিটের পর আর চলবে না।”
“তার মানে?”
“দেখ না। ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা কর।”
বিভূতি বলল, “তুই বলছিস—বারোটা বেজে সাত মিনিটে ঘড়িটা বন্ধ হয়ে যাবে?”
“কাঁটায় কাঁটায়।”
“কেন?”
“তা জানি না।” বলে একটু থেমে আবার কী বলতে যাচ্ছিল, না বলে থেমে গেল।
বিভূতি বিশ্বাস করল না। আমিও না। যে ঘড়িটায় এইমাত্র দম দেওয়া হল সেই ঘড়ি কী করে ঘণ্টাখানেক পরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে? যদি এমনই হয় ঘড়িটা খারাপ, তবে সেটা বারোটা বেজে সাত মিনিটের আগেও বন্ধ হতে পারে, পরেও পারে। ঠিক বারোটা সাতে বন্ধ হবে কেন?
বিশ্বাস করার কারণ ছিল না। আমরা বিশ্বাস করলাম না। অবশ্য কৌতূহল হল।
ঘড়িটা বিছানার ওপর রেখে আমরা বসে থাকলাম। বিভূতি এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগল। নিত্য বলল, এখন সে কিছুই বলবে না, আগে আমরা দেখি সে যা বলেছে তা সত্যি কি না!
বিভূতি দু’-চারবার ঠাট্টা তামাশা করল। তারপর আমরা সময় কাটাবার জন্যে অন্য গল্প করতে লাগলাম। মন আর চোখ পড়ে রইল ঘড়ির কাঁটায়।
শীতের দিন। আগে বুঝিনি, ঘড়িতে রাত দেখার পর ঘুম যেন চোখের পাতায় চেপে বসছিল। ঘন ঘন হাই উঠছিল। কথা জড়িয়ে আসছিল ঘুমে।
এই ভাবে বারোটা বেজে এল।
আমরা চোখের পাতা রগড়ে সোজা হয়ে বসলাম। আর কিছুক্ষণ মাত্র। দেখা যাক, নিত্য আমাদের সঙ্গে তামাশা করল কি না!
বিভূতি বলল, “নিত্য, তুই যদি ধাপ্পা মেরে থাকিস, তোকে আমি বাইরে বার করে দেব।”
নিত্য জবাব দিল না কথার, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকল।
কাঁটায় কাঁটায় বারোটা। বাইরে কোনও সাড়াশব্দ নেই, এই বাড়িটাও নিঃসাড়। সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিঝুম চারদিক। আমরা তিনজন মাত্র জেগে আছি।
চোখের পাতা থেকে ঘুম যেন একটুর জন্যে সরে গেল। দেখি, নিত্য একদৃষ্টে ঘড়ির দিকে চেয়ে আছে। তার চোখেমুখে কেমন যেন উত্তেজনা। ভয়। বিভূতি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখছিল ঘড়িটা। আমার হঠাৎ কেমন গা শিউরে উঠল। ভয়ভয় করতে লাগল। যদি নিত্যর কথা সত্যি হয়, তবে?
বারোটা তিন হল। আমার বুক ধকধক করছিল। বারোটা চার। নিত্য একদৃষ্টে চেয়ে, চোখের পাতা পড়ছে না। বিভূতি ঝুঁকে পড়ল।
বারোটা পাঁচ। ঘড়ি চলছে। মিনিটের কাটাটা এত আস্তে নড়ছে কিছুই বোঝা যায় না। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
বারোটা ছয়। বিভূতি একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর নিত্যর দিকে। কোনও কথা বলল না। আমি আরও ঝুঁকে পড়লাম। বুক কাঁপছিল।
বারোটা সাত।
আমাদের তিনজনের চোখ ঘড়ির কাঁটার ওপর স্থির হয়ে আছে, নড়ছে না। তাকিয়ে আছি, তাকিয়ে আছি… সময় কাটছে তবু কাঁটা আর নড়ছে না। বিভূতি ধৈর্য হারিয়ে তার হাতঘড়ি দেখল, বারোটা নয়। তারপর পকেট ঘড়িটা তুলে নিয়ে কানের কাছে রাখল। তার মুখ কেমন থম মেরে গেল। অবাক, বিমূঢ়, ভীত। বলল, “বন্ধ হয়ে গেছে।”
নিত্য এতক্ষণ পিঠ নুইয়ে বসেছিল। পিঠ সোজা করল এবার। হাঁফ ফেলল স্বস্তির। অন্যমনস্কভাবে বলল, “এই রকমই হয়। বারোটা সাতে বন্ধ হয়ে যায়।”
আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম। বললাম, “কেন?”
নিত্য বলল, “এখন আর বলব না। কাল শুনিস।”
বিভূতি বলল, “দিনের বেলা বন্ধ হয় না? বারোটা সাতে?”
“না।”
“অসম্ভব। এ-রকম হতেই পারে না।”
“হয়।”
“আমি কাল দেখব।”
“আমি দেখেছি কতবার।”
“আমি নিজের চোখে দেখব।…কেমন করে এটা সম্ভব?”
“কী জানি কেমন করে হয়। আমিও বুঝি না।”
আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম। ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “ঘড়িটা ভুতুড়ে। ওটা সরা। আমার বিছানা থেকে সরিয়ে নে। সারা রাত আজ আর আমার ঘুম হবে না।”
পরের দিন সকাল থেকেই বিভূতি ঘড়িটা নিয়ে পড়ে থাকল। তার জেদ। সে দেখতে চায় কেন একটা ঘড়ি এই রকম বিচিত্র ব্যবহার করবে। এ তো মানুষ নয় যে, তার খেয়ালখুশি থাকবে! ঘড়ি হল যন্ত্র। যন্ত্রর কোনও খেয়ালখুশি থাকতে পারে না, যদি বা থাকে, তাকে আমরা যান্ত্রিক গোলযোগ বলি; যান্ত্রিক কারণ ছাড়া তা হতে পারে না।
সকালের দিকে বিভূতি ঘড়িটা চেয়ে নিয়ে আবার একটু দম দিল, নাড়াচাড়া করল, সময় মিলিয়ে দিল। ভুতুড়ে ঘড়িটা চলতে লাগল আবার।
নিত্য আমাদের নিয়ে কাছাকাছি বেড়াতে বেরুল। হাঁটাহাঁটি করলাম খানিক। স্টেশনের সামনে একটা মেঠো চায়ের দোকানে বসে চা খেলাম। রোদ, ধুলো, শীতের বাতাস খেয়ে বাড়ি ফিরলাম বেলা করে। যাই করি না কেন, মাথার মধ্যে ঘড়ি। ঘড়ি ছাড়া চিন্তা নেই। নিত্যকে কিন্তু মনমরা দেখাচ্ছিল।
খুবই আশ্চর্যের কথা, দিনের বেলায় ঘড়িটা ঠিকই চলছিল। কে বলবে অত পুরনো এক পকেট ঘড়ি এইভাবে চলতে পারে। বেলা বারোটা পেরিয়ে গেল। আমি আর বিভূতি ভেবেছিলাম— ঘড়িটা থেমে গেলেও যেতে পারে। থামল না। বারোটার কাঁটা ছাড়িয়ে ছোট কাঁটাটা একটায় পৌঁছল, তারপর দুটোয়। বিভূতি রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। নানা রকম যুক্তি বার করতে লাগল, আঙ্কিক যুক্তি। কাগজ কলম নিয়ে অঙ্ক কষতে বসল খেপার মতন। শেষে বিরক্ত হয়ে বলল, “ধ্যুত, এ আমার মাথায় ঢুকছে না। তবে আজ আর-একবার রাত্রে দেখব সত্যি ঘড়িটা বারোটা সাতে বন্ধ হয় কি না!”
আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না, ঘড়িটা ভুতুড়ে। যথা সময়ে ওটা আবার বন্ধ হবে।
বিভূতি তবু জেদ ধরে থাকল। নিত্য আপত্তি করল। কী হবে আর ঘড়ি দেখে? বিভূতি শুনল না। তার বড় জেদ।
রাত্রে আবার আমরা তিনজন ঘড়ি নিয়ে বসলাম।
আমার মোটেই ভাল লাগছিল না। নিত্যকে বললাম, “ঘড়িটা তোরা তো ব্যবহার করিস না?”
“না।”
“এতকাল ওটা ঠিক আছে কেমন করে?”
“তাও জানি না। বাবা দু’-চারবার ঘড়িটা কলকাতায় নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন।”
“তখনও কি এই রকম ভাবে বন্ধ হত?”
“হত। বাবার নজরেই ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে। বাবাও বিশ্বাস করেননি, কলকাতায় নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছেন। দোকানের লোকরাও কিছু বলতে পারেনি।”
“আশ্চর্য!”
“ঘড়িটা বাবার ঘরে থাকত। ড্রয়ারের মধ্যে। বাড়ির কারও আপদ-বিপদ ঘটলে দম দিতেন।”
“কেন, আপদ-বিপদ ঘটলে কেন?”
“সে একটা ব্যাপার আছে।” শুকনো মুখে নিত্য বলল।
“তুইও দমটম দিস?”
“না।”
“কেন?”
“কী হবে দম দিয়ে?”
আমি নিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওকে কেমন অন্যমনস্ক, গম্ভীর, মনমরা দেখাচ্ছিল।
কথায় কথায় রাত বাড়ল। এগারোটা বাজল। দেখতে দেখতে সাড়ে এগারো। তারপর ঘড়ির ছোট কাঁটা বারোটার দিকে এগুতে লাগল।
আমি বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম ঘড়িটা ঠিক সময়ে থেমে যাবে। বিভূতির সন্দেহ যায়নি।
ঠিক যখন বারোটা তখন নিত্য কেমন চঞ্চল-বিহ্বল হয়ে বিভূতির হাত ধরে ফেলল। তারপর থর থর করে কাঁপতে লাগল। আমরা হতভম্ব।
বিভূতি বলল, “কীরে, তোর হল কী?”
নিত্যর দু’চোখে জল। ঠোঁট ফুলে উঠেছে। কেঁদে ফেলল নিত্য।
ঘড়ির দিকে একবার তাকালাম আমি। পলকের জন্যে। বারোটা বেজে দু’মিনিট।
বিভূতি আবার বলল, “তুই অমন করছিস কেন? কী হয়েছে তোর?”
নিত্য কান্না জড়ানো অস্পষ্ট গলায় বলল, “বাবা মারা যাবার দিন ঘড়িটা বারোটা সাতের পরও চলছিল। আমি দেখেছি।”
“তার মানে?”
“ঘড়িটা আমাদের সংসারের অমঙ্গলের কথা, মৃত্যুর কথা বলে দেয়। আমার কাকা, আমার মেজভাই, বাবা—এই তিনজনের মৃত্যুর দিনই ঘড়িটা চলেছে, বাবা চালিয়েছিলেন। আর কোনওদিন কখনও চলেনি। আমার আজকাল আর ঘড়িটা দেখতে ইচ্ছে করে না। ভয় হয়।…আজ দুপুর থেকে মায়ের শরীর খারাপ…।”
নিত্য কাঁদতে কাঁদতে ঘড়ির দিকে তাকাল।
বিভূতি কেমন যেন চমকে গিয়ে ঘড়িটা তুলে নিল। নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ডালাটা বন্ধ করে দিল।
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। নিত্যর মুখ সাদা।
ঘড়ির কাঁটাটা বারোটা সাতে থামার জন্যে আমরা ভগবানের পায়ে মাথা খুঁড়ছিলাম। বিভূতির হাত কাঁপছিল। আমার বুক ধকধক করছিল। আর নিত্য কাঠ হয়ে বসে ছিল।
বারোটা সাতের দিকে ঘড়ির কাঁটাটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিল। ডালার তলায় কী হচ্ছে, তা দেখার সাহস আমাদের হচ্ছিল না।
১৩৮৪
অলংকরণ: মদন সরকার
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন