জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু

পৌলোমী সেনগুপ্ত

গোগোলের আপন মামা ছাড়াও, আরও কয়েকজন মামা আছেন। তাঁরা সকলেই মায়ের নানারকম সম্পর্কের দাদা বা ভাই। মায়ের নিজের সহোদর দাদা বা ভাই, সকলেই থাকেন কলকাতা থেকে বেশ দূরে। ছোটমামা তো কিছুকাল আগেও লখনৌতে ছিলেন। সম্প্রতি শিলিগুড়িতে বদলি হয়ে এসেছেন।

মায়ের এক পিসতুতো ভাই থাকেন রানাঘাট। নাম হেরম্বকুমার চক্রবর্তী। মা তাঁকে হারুদা বলে ডাকেন। গোগোল বলে হারুমামা। হারুমামার বাড়ি রানাঘাটে। তিনি চাকরিও করেন রানাঘাটে খাদি গ্রামোদ্যোগ ভবনে। মাঝে-মধ্যে কলকাতায় এলে, গোগোলদের বাড়িতে আসেন। মানুষটি সাদাসিধে। মুখে হাসি লেগে থাকে, কিন্তু কথা বলেন কম। রোগা বলা চলে না, তবে বেশ লম্বা। ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া তাঁকে আর কোনও বেশেই দেখা যায় না। সত্যি বলতে কী গোগোলের মনে হয়েছে, ওর আপন বা অন্য সম্পর্কের মামাদের মধ্যে হারুমামা বোধহয় সব থেকে গরিব। তিনি নিজেও বলেন, “গোগোল, আমি তোমার গরিব মামা। তোমার মা বাবাকে এত করে বলি, একবার রানাঘাটে আমাদের বাড়ি আসতে। কিছুতেই নাকি ওদের সময় হয় না। তুমিই একবার বাবা-মাকে জোর করে নিয়ে চলো।’

হারুমামা গরিব বলে বাবা-মা যেতে চান না, তা ঠিক নয়। তবে তিনি যতবার এসেছেন, প্রত্যেকবারই মা আর বাবাকে রানাঘাটে যাবার কথা বলেছেন। মা-বাবা বলেন, যাব। কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। অথচ, কলকাতা থেকে রানাঘাট কত কাছে। হারুমামার মুখে গোগোল শুনেছে, তাঁদের বাড়ির কাছেই চুর্নি নদী। আসলে তাঁদের বাড়ি চুর্নি নদীর ওপারে। কালীনারায়ণপুরে। রানাঘাট বললে লোকে সহজে বুঝতে পারে বলে, রানাঘাটের নাম করেন। রানাঘাটের ওপারে চুর্নি নদীর ধারেই তাঁদের বাড়ি। কালীনারায়ণপুর গ্রাম হলেও, সেখানে হাটবাজার গঞ্জ আছে। গ্রামটাও নাকি খুব বড় আর অনেককালের প্রাচীন। বাড়িতে আছেন মামিমা, আর গোগোলের থেকে দু’ বছরের বড় এক মামাতো দাদা। গোলোথেকে বছর পাঁচেকের ছোট একটি বোন। সেই দাদা আর বোন, জীবনে মাত্র দু’বার নাকি কলকাতায় এসেছে। একবার চিড়িয়াখানা দেখতে। আর একবার জাদুঘর আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। হারুমামা হেসে বেশ সহজভাবেই বলেন, ‘আমার সময় হয় না। তা ছাড়া কলকাতায় বেড়াতে আসতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। আমি গরিব মানুষ, বেড়াবার টাকা কোথায় পাব।”

গোগোলের খুব ইচ্ছে, কালীনারায়ণপুরে হারুমামার বাড়ি বেড়াতে যায়। মা-বাবাকেও অনেকবার বলেছে। মা-বাবা খালি বলেন, “হ্যাঁ, যাব। দু’-একটা দিন হাতে নিয়ে যেতে হবে তো। ফাঁক পেলেই একবার ঘুরে আসব।”

হারুমামা এমনিতে কম কথা বলেন। কিন্তু গোগোলের সঙ্গে অনেক কথা বলেন। গোগোলের চেষ্টায়, কাশ্মীরের সেই ব্যাঙ্ক-ডাকাতরা ধরা পড়ার পর থেকেই, তিনি ওকে আদর করে “খুদে গোয়েন্দা” বলে ডাকেন। তারপরে যত ঘটনা ঘটেছে সবই তিনি গোগোলের মুখ থেকে শুনছেন। আবার তিনিও গোগোলকে অনেক গল্প শুনিয়েছেন। সবই অনেককালের আগের ডাকাতদের গল্প। বলতে-বলতে আবার, হেসে মজা করে বলেন, “সেই সব ডাকাতদের আমলে তুমি যদি থাকতে, তা হলে কী ঘটত, আমি তাই ভাবি।”

রানা ডাকাতের গল্প গোগোল হারুমামার কাছ থেকেই প্রথম শুনেছে। রানা ডাকাতের নাম থেকেই নাকি জায়গাটার নাম রানাঘাট হয়ে গেছে। হারুমামা অবশ্য সেটা নিশ্চয় করে বলতে পারেন না। তবে রানাঘাটের লোকে তা-ই বলে। গল্পটাও খুব দারুণ। রানা ডাকাত নাকি আদপে মানুষ খুন করত না। সে টাকা-পয়সা-সোনা-দানা যা চাইত, তা পেলেই চলে যেত। নেহাত কেউ কথা না শুনলে, দু’-চার ঘা লাগিয়ে দিত।

সব থেকে আশ্চর্য রানার ডাকাত হওয়ার গল্প। যা শুনে, গোগোল মনে-মনে রানাকে ভালবেসে ফেলেছে। আসলে রানাঘাটের নাম নাকি ছিল ব্ৰহ্মডাঙা। কতকাল আগের কথা, হারুমামা ঠিক বলতে পারেন না। তাঁর ধারণা দু’শো বছর আগের ঘটনা। রানা ছিল ব্রহ্মডাঙার এক গরিব ব্রাহ্মণের ছেলে। তার ছিল এক ছোটবোন। সেকালে মেয়েদের ন’-দশ বছরের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যেত। বোনকে সে খুব ভালবাসত। কিন্তু তারা এত গরিব ছিল, কিছুতেই বোনের বিয়ে দিতোরছিল না। সেকালের সমাজও ছিল খুব নিষ্ঠুর। গরিব হলেও, তারা মানতে চাইত না। তাদের এক কথা, যেমন করে হোক মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে।

রানার বোনের বয়স দশ পেরোতেই গাঁয়ের লোকেরা যা-তা বলতে আরম্ভ করেছিল। শেষ পর্যন্ত ঘটিবাটি বিক্রি করে, আর রানার মায়ের যেটুকু সোনা ছিল, তা দিয়েই বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। হলে কী হবে। সোনার গহনা যা দেবার কথা ছিল, তার থেকে একটু কম হয়ে গেছল। তা দেখেই, বরের বাবা বরকে বিয়ের পিঁড়ি থেকে তুলে নিয়ে চলে যায়। ওদিকে রানার বোন তখন কনে সেজে বসে আছে। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। ঘটনাটা খুবই অপমানকর আর লজ্জার। রানার বোন ভোররাত্রে, বাড়ির পিছনে পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করে। তারপর থেকেই রানা বাড়ি থেকে চলে যায়। কোথায় যায়, কেউ জানত না। তার বোনের শোকে বাবা-মা-ও বেশিদিন বাঁচেননি।

এই ঘটনার বেশ কিছুকাল পরে রানা ডাকাতের আবির্ভাব। তার নাম শুনলেই বড়লোকদের বুক কেঁপে উঠত। কিন্তু সে ডাকাতি করার জন্যই ডাকাত হয়নি। সে চারদিকে খবর রাখত, কোথায় কোন গরিব লোক টাকার অভাবে তার মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না। খবর পেলেই, সে তার দলবল নিয়ে, চুর্নি নদীতে নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। কোনও ধনী যাত্রীর নৌকো পেলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সোনা-দানা টাকা-পয়সা যা পেত, লুঠ করে নিয়ে, সেই গরিব মেয়ের বাবা-মাকে দিয়ে আসত। গরিবের মেয়ের বিয়ে হয়ে যেত নির্বিঘ্নে। আসলে, সে চাইত, কোনও গরিবের মেয়েই যেন তার বোনের মতো অভাবে আর অপমানে, জলে ডুবে না মরে।

হারুমামার কাছ থেকে রানা ডাকাতের গল্প শোনার পরে, গোগোল চুর্নি নদী আর রানাঘাট দেখার জন্য মনে-মনে খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। এমন কিছু দূরেও নয়। শেয়ালদা থেকে ট্রেনে যেতে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। গোগোলের ইস্কুলে শনি রবিবারে ছুটি থাকে। ও প্রায়ই মাকে বলত, “চলো মা, হারুমামার বাড়িতে এ-সপ্তাহে বেড়িয়ে আসি।”

মা বলতেন, “কী করে যাব। তোমার বাবার তো শনিবারে ছুটি নেই। হারুদার বাড়ি গেলে দু’-একটা দিন থাকতেই হবে, নইলে ছাড়বেন না। সেরকম সুযোগ এলেই যাব।”

গোগোল মনে-মনে যতই অস্থির হোক, দু’-তিন দিনের ছুটির সুযোগ আর আসে না। ওর এলেও বাবার আসে না। বাবা মা’কে বলেন, “তুমিই গোগোলকে নিয়ে ঘুরে এসো। আমি তোমাদের শেয়ালদার ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব।”

মা বাবাকে বলেন, “তুমিই তো বলো, সেই কবে চুর্নি নদী দেখেছ, আবার দেখতে ইচ্ছে করে। যাবই যখন এক সঙ্গে যাব। তুমি অফিস থেকে দু’দিন ছুটি নেবার ব্যবস্থা করো। বাবা আর ছেলে, দু’জনেরই চুর্নি নদী দেখার সাধ মিটবে।”

বাবা হেসে বলেন, “গোগোল তো কেবল চুর্নি নদী দেখতে চায় না। ও চায় রানা ডাকাতের দেশ আর তার চুর্নি নদী দেখতে। তবে নদীটা সত্যি সুন্দর আর নামটাও। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দেখা যাক, কবে নাগাদ অফিস থেকে ছুটি নিতে পারি।”

গোগোল ভাবে, গ্রীষ্মের আর পরীক্ষার পরে শীতের লম্বা ছুটি, বাবা ঠিকই ছুটি নিতে পারেন। আর সামান্য দু-তিন দিনের ছুটি নিতেই যত অসুবিধে। অবশ্য প্রত্যেক বছরেই যে বাবা গ্রীষ্মে শীতে লম্বা ছুটি নিতে পারেন, তা নয়। গোগোল এও জানে, অফিসের কাজের চাপে, বাবার পক্ষে দু’-তিন দিনের ছুটি নেওয়াও অনেক সময় মুশকিল হয়ে যায়।

হঠাৎ ম্যাজিকের মতো ঘটনা ঘটে গেল। বাবা এক বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিস থেকে ফিরে জানালেন, বিশেষ একটা কারণে, তিনি শুক্র শনি ছুটি পেয়ে গেছেন। তার মানে শুক্র শনি রবি, তিন দিন টানা ছুটি। বাবা নিজেই বললেন, এই ছুটিতেই হারুমামার বাড়ি বেড়িয়ে আসবেন। গোগোলকে শুক্রবার ছুটি নিতে হবে। শনি-রবিবার তো এমনিতেই ছুটি। ভাগ্যিস, গোগোলের এ সময়ে উইকলি পরীক্ষা ছিল না। বেড়িয়ে এসে, সোমবার দিন ইস্কুলে একটা অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দিলেই হবে। যদিও গোগোল এরকম হঠাৎ-ছুটি কখনও নেয় না। কিন্তু হারুমামার বাড়ি যাবার উপলক্ষে একটা দিনের জন্য বাবা মা দু’জনেই রাজি হয়ে গেলেন।

শুক্রবার দিন সকালবেলা জলখাবার খেয়েই, বাবা মার সঙ্গে গোগোল বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে একটা মাত্র সুটকেসে কয়েক দিনের জামাকাপড়, তোয়ালে, দাঁত মাজার পেস্ট, ব্রাশ, বাবার দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম নেওয়া হয়েছিল। হতে পারে জায়গাটা কলকাতা থেকে মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল দূরে। তবু গোগোল মনে-মনে খুব খুশি আর উত্তেজিত। হারুমামাকে কোনও খবর দেওয়া ছিল না। একরকম ভালই। মামা মামি সবাইকে বেশ চমকে দেওয়া যাবে। হারুমামা নিশ্চয়ই অফিসে থাকবেন। বাড়ি এসে গোগোলদের দেখে থ হয়ে যাবেন। গোগোল মনে-মনে একচোট হেসে নিল।

ট্যাক্সিতে করে শেয়ালদায় পৌঁছে আগেই টিকেট কাউন্টারে লাইন দিতে হল। গোগোল বাবার পাশে পাশে। মা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাউন্টারে পৌঁছে বাবা যখন কালীনারায়ণপুরের টিকেট চাইলেন, গোগোল তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “কালীনারায়ণপুর কেন? আমরা তো রানাঘাটে যাব। সেখান থেকে চুর্নি নদীতে নৌকোয় করে কালীনারায়ণপুর যাব।”

বাবা হেসে বললেন, “নদীর ওপারে কালীনারায়ণপুর স্টেশন আছে। আমরা সেই স্টেশনে নেমে হারুমামার বাড়ি যাব।”

গোগোল একটু বোকা বনে গেল। হারুমামার কথা থেকে ও বুঝতেই পারেনি, কালীনারায়ণপুরে কোনও স্টেশন আছে। ধারণা করেছিল, রানাঘাটে নেমে, নৌকো ছাড়া কালীনারায়ণপুরে যাওয়া যায় না। মনটা একটু খারাপও হয়ে গেল। ভেবেছিল ট্রেন থেকে নেমেই নৌকোয় চাপতে পারবে। তবে হারুমামা নিশ্চয়ই নৌকোয় চাপাবেন।

টিকিট কেটেই দৌড়োতে হল। ট্রেন ছাড়তে মাত্র দু’-তিন মিনিট বাকি ছিল। কিন্তু ট্রেনে এত ভিড়, ব্যারাকপুরের আগে বসবার জায়গা পাওয়া গেল না। তাও মা আর গোগোলের জায়গা হল। বাবা বসতে পেলেন নৈহাটিতে পৌঁছে। বাবার কাছেই জানা গেল, নৈহাটি জংশন স্টেশন। এখান থেকে ট্রেন বদলে গঙ্গার ওপর জুবিলি ব্রিজ পেরিয়ে, ব্যান্ডেল যাওয়া যায়। রানাঘাটও নাকি জংশন স্টেশন। ওখানে প্রধান লাইন চলে গেছে বহরমপুর। শান্তিপুরের শাখা লাইন। আর বনগাঁয়ে যাবার লাইনও আছে।

কল্যাণীর পর থেকেই, দু’ধারের ছবি অন্যরকম। সবুজ খেত আর মাঠ এবং গ্রাম। রানাঘাটে পৌঁছে দেখা গেল, বেশ বড় স্টেশন আর জমজমাট। গোগোল হেসে বলল, “মা হারুমামা এখন এখানেই কাজ করেন। অথচ জানতে পারছেন না, আমরা এখান দিয়ে যাচ্ছি।”

মা হেসে বললেন, “তাইতে বুঝি তোর খুব মজা লাগছে?”

গোগোল বলল, “সত্যি মজা লাগছে। ইচ্ছে করছে, এখানে নেমেই হারুমামার অফিসে চলে যাই।”

মা বললেন, “তা যাবে বই কী। চুপ করে বোস।”

রানাঘাটে গাড়ি একটু বেশিক্ষণ দাঁড়াল। তারপরে গাড়ি ছেড়ে কিছুটা এগোতেই বাবা বললেন, “গোগোল, নজর রেখো এবার চুর্নি নদী দেখা যাবে।”

বাবার কথা শেষ হতেই গোগোল জানালা গিয়ে চুর্নি নদী দেখতে পেল। এত সুন্দর ছোট নদী ও কখনও দেখেনি। নদীটা অনেক নীচে। রেললাইন আর ব্রিজটা যেন হঠাৎ অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। কিন্তু জলটা আশ্চর্য পরিষ্কার। ঠিক কাচের মতো। আর জলের নীচে যেন কী সব দেখা যাচ্ছে। দেখতে-দেখতেই ট্রেন নদী পেরিয়ে গেল। গোগোল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, নদীর জলের নীচে কী সব যেন দেখা যাচ্ছিল।”

বাবা বললেন, “ওগুলো জলের নীচে নানারকম জলজ ঘাস, গুল্ম আর লতাপাতা। চুর্নি নদীর এটাই সৌন্দর্য, জলের নীচে কাচের মতো সবই প্রায় স্পষ্ট দেখা যায়। এখন বসন্তকাল। বর্ষাকালে যখন জল ঘোলা হয়ে যায়, তখন আর দেখা যায় না।”

গোগোলের চোখের সামনে নদীটাই ভাসতে লাগল। জলের নীচে পর্যন্ত দেখা যায়, এরকম নদীর কথা ও ভাবতেই পারে না। ওই সব ঘাস-গুল্ম-লতাপাতার মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক সাপ আছে। ভাবতেই ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ও জিজ্ঞেস করল, “বাবা, ওই নদীতে কেউ সাঁতার কাটে?”

বাবা বললেন, “কেন কাটবে না? অবশ্য তুমি যেরকম সাঁতার শিখেছ, চুর্নিতে সাঁতার কাটতে পারবে না। জলে খুব স্রোতের টান।”

“কিন্তু যারা সাঁতার কাটে, জলের ঘাস আর ‘গুল্মেֹ’ তাদের পা আটকে যায় না?”

“আটকাবে কেন? জলের নীচে ডুব দিলে আলাদা কথা। আর যারা ডুব দেয়, তারা আটকে গেলেও, ঠিক ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে পারে।”

“কিন্তু ওই সব ঘাস-গুল্মের মধ্যে নিশ্চয়ই সাপ আছে?”

“তাও থাকতে পারে। তবে জলের ও-সব সাপ বিষাক্ত নয়। জলঢোঁড়া বা হেলে জাতীয় সাপ থাকতে পারে।”

বাবার কথা শেষ হতে-না-হতেই কালীনারায়ণপুর স্টেশন এসে গেল। বাবা এক হাতে সুটকেস, আর অন্য হাতে গোগোলের হাত ধরে নামলেন৷ পিছনে মা। ট্রেনটা এক মিনিটও দাঁড়াল না। ছেড়ে চলে গেল। গোগোল দেখল, মস্ত লম্বা একটা মাত্র প্ল্যাটফরম। মাঝখানে একটা টিনের শেড। এরকম এক প্ল্যাটফরমওয়ালা স্টেশন গোগোল কখনও দেখেনি। প্ল্যাটফরম থেকে নীচে সিঁড়ি নেমে গেছে। স্টেশনটা সেখানেই। টিকেট-কালেকটরও নীচেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবা টিকেট দিয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, “এখন তবু একটা প্ল্যাটফরম হয়েছে। আগে তাও ছিল না। স্টিম-ইঞ্জিনে টানা ট্রেনের দু’ধাপ পাদানি বেয়ে লাফিয়ে নামতে হত।”

স্টেশনের কাছে বেশ ভিড়। আশেপাশে অনেক দোকানপাট অথচ মোটেই শহরের মতো দেখতে নয়, গোগোল জিজ্ঞেস করল, “আমরা যাব কী করে?”

বাবা বললেন, “হেঁটেই যাব। আমাদের তো আবার সেই চুর্নি নদীর ধারেই যেতে হবে। বেশি দূরে নয়। আর এখানে তুমি কোনও গাড়িঘোড়ার আশা করতে পারো না। তবে, হারুদাদার বাড়ি যাবার রাস্তাটা আমার ঠিক মনে নেই।”

মা বললেন, “আমার আছে।” বলে মা আগে-আগে চলতে লাগলেন। গোগোল বাবার সঙ্গে মায়ের পিছনে-পিছনে চলতে লাগল। কাঁচা বাড়ি, কোঠাবাড়ি, পুকুর, বাগান, আঁকাবাঁকা রাস্তার দু’পাশে। নতুন বাড়ি প্রায় একটাও চোখে পড়ল না। কোঠাবাড়িগুলো সেকেলে আর পুরনো। একটা মন্দিরও দেখা গেল। গোগোলরা চলেছে পাড়ার ভিতর দিয়ে। অনেকেই ওদের তাকিয়ে দেখছে।

প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পরে, মা একটা পাঁচিল-ঘেরা খোলা দরজার সামনে দাঁড়ালেন। ভিতরে দেখা যাচ্ছে, একটা পুরনো একতলা বাড়ি। ইটে নোনা ধরেছে, জায়গায়-জায়গায় শ্যাওলা জমেছে। দরজা-জানালার আলকাতরার রংও উঠে গেছে। একতলা বাড়িটার একধারে, বাঁধানো রকের শেষে একটা মাটির দেওয়াল খড়ের চালাঘরও দেখা যাচ্ছে। সামনের উঠোনে একটা কুকুর শুয়ে ছিল। আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কুকুরটা হঠাৎ গোগোলদের দেখতে পেয়ে, দাঁড়িয়ে উঠে, ঘেউঘেউ চিৎকার জুড়ে দিল।

বাবা বললেন, “দেখে তো মনে হচ্ছে, হারুদাদের সেই বাড়িটাই। কেউ নেই নাকি?”

বাবার কথা শেষ হতে হতেই, চালাঘরের পাশ থেকে একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। বয়স বোধহয় মার মতো হবে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে বেরিয়ে এলেন। গোগোলদের দেখে অবাক চোখে ভুরু কুঁচকে তাকালেন, আর মাথার ঘোমটা একটু টেনে দিলেন। গোগোল মা-বাবার মুখের দিকে দেখল। নিশ্চয় কোনও অচেনা বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু মা ঠোঁট টিপে হাসছেন কেন?

চালাঘরের ছাদ থেকে উঠোনে বেরিয়ে আসা মহিলা হঠাৎ যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। দরজার দিকে ছুটে আসতে-আসতে বললেন, “নীতিঠাকুরঝি না? আশ্চর্য, আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”

মা বললেন, “তাই তো মনে হচ্ছে চারুবউদি। তুমি আমাদের চিনতেই পারছ না। আমি কিন্তু তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছি।”

চারুবউদি যাঁকে বলা হল, তিনি দরজার বাইরে ছুটে এসে মায়ের হাত ধরলেন। “ইশ! না চিনলে আমি কী করে তোমার নাম বললাম? এসো, ভেতরে এসো।” বলে মাকে টেনে নিতে নিতে বাবাকে বললেন, “আসুন, ভেতরে আসুন নন্দাইমশাই।”

তারপরেই যেন তিনি গোগোলকে দেখতে পেলেন। অমনি গোগোলের একটি হাত চেপে ধরে একেবারে গায়ের কাছে টেনে নিলেন, বললেন, “এই নাকি আমাদের সেই গোগোল? বাহ্‌ কী সুন্দর ছেলে তোমার নীতিঠাকুরঝি।”

গোগোল খুবই লজ্জা পেয়ে গেল। মা বললেন, “সুন্দর না আর কিছু। খালি দুষ্টুমি করে, আর আমাদের জ্বালিয়ে মারে।”

এ-সব কথার মধ্যেই গোগোলরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কুকুরটাও ঘেউ-ঘেউ বন্ধ করেছে। মায়ের চারুবউদি বললেন, “না না, বেশ সুন্দর ছেলে হয়েছে। ওর মামার মুখে আমি অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু ওকে আমি এই প্রথম দেখলাম।”

মা বললেন, “গোগোল, ইনি হচ্ছেন তোমার মামিমা। হারুমামার বউ। প্রণাম করো।”

গোগোল নিচু হয়ে প্রণাম করতে গেল। মামিমা মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে, গোগোলকে জোর করে টেনে তুলে বললেন, “না বাবা, পেন্নাম-টেন্নাম করতে হবে না, এমনিতেই আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি। এসো, ঘরে এসো।”

মামিমা রকে উঠে, সবাইকে নিয়ে দালানে ঢুকলেন। লম্বা দালান। দালানের ধারে-ধারে ঘর। মামিমা গোগোলের হাত ছেড়ে দিয়ে, এদিক-ওদিক ছুটে কয়েকটা সুতোয় বোনা আসন জোগাড় করে পাতলেন। বললেন, “কিন্তু নীতিঠাকুরঝি তোমার দাদা তো তোমাদের আসার কথা আমাকে কিছু বলেনি?”

মা বললেন, “কী করে বলবে? হারুদাকে আমরা কিছু বলিনি, কোনও চিঠিও দিইনি। গোগোলের তাড়ায় হঠাৎ না জানিয়েই চলে এলাম।”

চারুমামিমা খুশিতে ডগমগ হয়ে, গোগোলের গাল টিপে দিয়ে বললেন, “সত্যি! গোগোলের তাড়ায় এসেছ? খুব ভাল হয়েছে। তোমরা বোসো। আমি আগে একটু চা করি।” বলে বাবার দিকে ফিরলেন, বললেন, “ও নন্দাইমশাই, সুটকেসটা হাত থেকে নামান। কেউ চুরি করবে না।”

বাবা লজ্জা পেয়ে হেসে, দেওয়াল ঘেঁষে সুটকেস রাখলেন। বললেন, “আমি ভাবছি, চারুবউদি বোধহয় আমাকে দেখতেই পাচ্ছেন না।”

চারুমামিমা বললেন, “দরজাতেই তো আপনাকে ডাকলাম। দোষ দিচ্ছেন কেন? বসুন। চা করে নিয়ে আসি। আর গোগোলকে আগে কিছু খেতে দিই।”

গোগোল বলল, “না না, আমি এখন কিছু খাব না। আমি নদী দেখতে যাব।”

ওর কথা শুনে সবাই হেসে উঠলেন। বাবা বললেন, “একটু অপেক্ষা করো, আমিই তোমাকে নিয়ে যাব।”

ইতিমধ্যেই মা আর মামিমার কথা থেকে জানা গেল, হারুমামা কাজে গেছেন। ছেলেমেয়েরা সবাই ইস্কুলে। একমাত্র ঠিকে ঝি-ও চলে গেছে। মামিমার সঙ্গেও মা’ও দালানের বাইরে চলে গেলেন। গোগোল বাবার সঙ্গে দালান আর ঘরগুলোর ভেতরে ঢুকে দেখতে লাগল। দেখার মতো তেমন কিছু নেই। দেওয়ালে টাঙানো পুরোনো ফোটো, নানারকমের ক্যালেন্ডার। সেকালের উঁচু ধরনের খাট, আর বিছানা। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে বাগান আর পাঁচিল দেখা যাচ্ছে। দু’-তিন রকমের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। বাবা বললেন, “গোগোল, এখন এরকম দেখছ। এক সময় হারুমামাদের অবস্থা বেশ ভাল ছিল। অনেক জমি পুকুর ছিল। জমির ধান, পুকুরের মাছ, গোরুর দুধ কোনও কিছুর অভাব ছিল না।”

গোগোল জানতে চাইল, এখন কেন এরকম অবস্থা হল। বাবা বললেন, “সে অনেক কথা। হারুমামার অন্যান্য ভাই দাদারা আলাদা হয়ে চলে গেছেন। অভাবে জমিজমা বিক্রি হয়ে গেছে। সে-সব তুমি এখন বুঝবে না। কেবল জেনে রাখো, মানুষের জীবন চিরকাল একরকম থাকে না।”

এ-সব কথাবার্তার মধ্যেই, চারুমামিমা সবাইকে মুড়ি মুড়কি আর মণ্ডা ভরা থালায় খেতে দিলেন।

মা নিজের হাতে চা করে নিয়ে এলেন। চারুমামিমা হঠাৎ বাড়ির বাইরে কোথায় চলে গেলেন। আর ফিরে এলেন একটু পরেই।

কলকাতায় সাধারণত মুড়ি-মুড়কি মণ্ডা খাওয়া হয় না। গোগোলের সত্যি খিদেও পেয়েছিল। খাওয়া হয়ে যেতেই বাবাকে বলল, “চলো বাবা, নদীর ধারে চলো।”

বাবা, মা আর মামিমাকে বলে, গোগোলকে নিয়ে চললেন। চালাঘরের পাশ দিয়েই রকের শেষে একটা খোলা দরজা। সেই দরজা দিয়ে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে গোগোল দেখল, চারপাশে গাছপালা, আর ঘন ছায়া। দূরে-দূরে কয়েকটা বাড়ি। খানিকটা যেতেই দেখা গেল চুর্নি নদী। নদীর ধারে এসে গোগোলের দু’চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। ওপারে একটা বাঁধানো ঘাটে অনেকে স্নান করছে। এপারে ঘাট নেই, কিন্তু মাটির ধাপের সিঁড়ি নেমে গেছে। এপারেও অনেকে স্নান করছে। ওপারে চেহারাটা অন্যরকম। অনেক বেশি বড়-বড় বাড়ি, পাকা রাস্তায় সাইকেল-রিকশা চলেছে। সব থেকে যেটা অবাক করল, তা হচ্ছে, গোগোলের থেকেও ছোট ছেলেমেয়েরা দিব্যি সাঁতার কাটছে। স্রোতের টানের সঙ্গে তারা রীতিমতো লড়াই করছে।

নদীটা এতই ছোট, ওপারের সব লোককে স্পষ্ট দেখা তো যাচ্ছেই,— এমন কী তাদের কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। গোগোল আরও খানিকটা নীচে নেমে জলের দিকে দেখল। জলের নীচে সবুজ ঘাস-গুল্ম-লতা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্রোতের টানে সব একদিকে ঢলে পড়েছে আর সাপের মতোই কিলবিল করছে। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের একটুও ভয় নেই।

গোগোল কতক্ষণ এরকম দেখছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ কাঁধে কার হাতের চাপ পড়তেই ফিরে তাকিয়ে দেখল, হারুমামা। হারুমামা গোগোলকে একেবারে দু’হাতে তুলে ধরলেন, বললেন, “আমার খুদে গোয়েন্দা ভাগনেটি সত্যিই এসে পড়েছে!”

গোগোলের অস্বস্তি হল। মাটিতে নেমে বলল, “আপনি তো ওপারে অফিসে ছিলেন। এখন কী করে এলেন? বিকেলে আসবার কথা তো।”

হারুমামা বললেন, “তোমার মামিমা পাড়ার একটি ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিলেন। আমি অমনি একটা রিকশা চেপে খেয়াঘাটে এলাম। নৌকোয় এপারে এসেই দৌড়ে তোমাদের কাছে।”

বাবাও কাছে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন। হারুমামা বললেন, “তুমি যে-ভাবে সব দেখছ, তোমাকে নিয়ে আমি নদীতে চান করব। তবে আজ নয়, কাল সকালে। তোমার ভাইবোনদের নিয়ে। এখন চলো বাড়ি যাই।”

বেলা গড়িয়ে বিকেল না হতেই, ইস্কুল থেকে আগে বাড়ি ফিরল মামাতো বোন চিনি। গোগোলের থেকে বছর খানেকের ছোট। চিনি খেতে মিষ্টি আর বোন চিনি দেখতে সত্যি মিষ্টি। ওর আধঘণ্টা বাদেই এল মামাতো দাদা তিনু। গোগোলের থেকে বছর দুয়েকের বড়। দেখতে-দেখতেই তিনজনের মধ্যে খুব ভাব জমে উঠল। তিনু তো ইস্কুল থেকে এসে, একটু পরেই গোগোলকে নিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করল। চারুমামিমা তাড়াতাড়ি তিনুদাকে ভাত খাইয়ে দিলেন। চিনিও খেয়ে নিল। তারপরে তিনজনে নদীর দিকে গেল।

যাবার আগে হারুমামা সাবধান করে বলে দিলেন, “তিনু জলের ধারে যাসনি, আর বেশি দূরেও নয়।”

তিনু বলল, “আমরা বাড়ির কাছেপিঠেই থাকব।”

তিনুর খুব ইচ্ছে ছিল না, চিনি ওদের সঙ্গে আসুক। গোগোল বলল, “চিনি তা হলে একলা পড়ে যাবে। ও আমাদের সঙ্গে থাকুক।”

তিনজনেই নদীর ধারে আশেপাশে বেড়াতে লাগল। বেড়াতে বেড়াতে চারদিকে-পাঁচিল-ভাঙা একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে পড়ল। আশেপাশে বাড়ি নেই। নদীর ওপারটাও ফাঁকা জঙ্গল আর পোড়া জমি। গোগোল এগিয়ে যেতেই, তিনুদা ওর হাত টেনে ধরে বলল, “আর যেয়ো না গোগোল। ও-বাড়িটা ভূতের বাড়ি৷”

ভূতের বাড়ি! গোগোল অবাক চোখে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল। ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে বাড়িটার অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। দরজা-জানালাগুলো ভাঙাচোরা হলেও, সবই বন্ধ। ভাঙাচোরা ফাঁক দিয়ে কেবল ভিতরের অন্ধকার দেখা যায়। কয়েক জায়গায় ইটের দেওয়ালে বড় বড় ফাটল। বাড়িটার এক পাশে একটা বাঁশঝাড়। আরও কয়েকটা ঝাড়ালো গাছের ছায়ায় নিঝুম বাড়িটা দেখলে, সত্যি কেমন গা ছমছম করে। কিন্তু গোগোল কখনও ভূতের বাড়ি দেখেনি, ভূতও দেখেনি।

চিনি বলল, “এটা জোনাকি-ভূতের বাড়ি। এখানে আমরা একদম আসিনে। চলো, তাড়াতাড়ি চলে যাই।”

তিনুদাও বলল, “হ্যাঁ, গাঁয়ের কেউ এদিকটায় আসে না। চলো, চলে যাই।”

গোগোল ওদের সঙ্গে ফিরে চলল। জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু জোনাকি-ভূতের বাড়ি মানে কী?”

তিনুদা বলল, “সন্ধের পর অন্ধকার হলেই বাড়িটার দরজা-জানালার ফাঁকে-ফাঁকে টিপ-টিপ করে জোনাকি জ্বলতে দেখা যায়। আমাদের বাড়ি থেকেও দেখা যায়।”

গোগোল জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু জোনাকি আবার ভূত হয় কেমন করে?”

চিনি বলল, “ভূতের কথা কি কেউ বলতে পারে? তারা জোনাকি হতে পারে, মৌমাছি প্রজাপতি গোরু ছাগল সবই সাজতে পারে। আবার মানুষও হয়ে যেতে পারে।”

তিনুদা বলল, “বছর খানেক আগে ও বাড়ির পোড়োয় একটা লোককে ঘাড় ভেঙে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। রানাঘাট থেকে পুলিশ এসেছিল। বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিল। কিছুই দেখতে পায়নি। লোকটাকে কে কী ভাবে মারল, পুলিশও ধরতে পারেনি। অনেকদিন নজরও রেখেছিল, কিন্তু কিছুই জানতে পারেনি। কেবল একটা ডাইনির মতো বুড়ি আছে, ওই বাড়িটার থেকে একটু দূরে একটা চালাঘরে থাকে। সে-ই একমাত্র বাড়িটার পাঁচিলের গায়ে ঘুঁটে দেয়। সে আমাদের বাড়িতেও ঘুঁটে দিতে আসে। তার কাছে শুনেছি, অনেক রাত্রে, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন বাড়িটার ভেতর থেকে নাকিসুরে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। আর দড়াম-দড়াম করে দরজা-জানালার শব্দ হয়।”

চিনি বলল, “আমি কখনও ঘুঁটেউলি বুড়িটার সামনে যাইনে। আমার মনে হয়, ওই বুড়িটাই আসলে ভূত।”

তিনুদা শুধরে দিল, “মেয়েমানুষ কখনও ভূত হতে পারে না। পেতনি হয়। হয়তো শাকচুন্নি।”

চিনি বলল, “ভূতেরা অনেকরকম বেশ ধরতে পারে। জোনাকি-ভূত, দিনের বেলা বুড়ির বেশে ঘুঁটে দেয়। মা তো সেইজন্য ওকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেয় না। বাইরে থেকেই ঘুঁটে নেয়।”

গোগোল জিজ্ঞেস করল, “মামিমা সব জেনেও বুড়িটার কাছ থেকে ঘুঁটে নেন কেন?”

তিনুদা বলল, “না নিলে যদি আমাদের ওপর ওর খারাপ নজর পড়ে, সেইজন্য।”

গোগোলের খুবই অদ্ভুত লাগল। বাড়ি ফিরেও হারুমামাকে জিজ্ঞেস করল। হারুমামাও বললেন, “বাড়িটা ভাল নয়। বহুকাল খালি পড়ে আছে। আমরা শুনেছি, ও-বাড়িতে অনেককাল আগে একটি বউ নাকি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। যাদের বাড়ি, তারা সব কলকাতায় থাকে। এখানে আসে না। তবে একটা লোককে মরা অবস্থায় ও-বাড়ির পোড়ায় পাওয়া গেছল বছর খানেক আগে। পুলিশ তার কোনও কুলকিনারা করতে পারেনি। আজকাল সবাই বলে জোনাকি-ভূতের বাড়ি। ওটা কিছু নয়। খালি বাড়ি, ঘরগুলো নিশ্চয়ই স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডা। জোনাকিরা রাত্রে উড়তে পারে। ভূতের বাড়ি ঠিক জানিনে। তবে ওরকম পোড়ো খালি বাড়ি দেখলেই কেমন খারাপ লাগে। বিশেষ করে বছর খানেক আগে একটা মরা লোককে পোড়োয় পড়ে থাকতে দেখে, কেউ আর ওদিকে যায় না।”

গোগোল জিজ্ঞেস করল, “আর ওই ঘুঁটেউলি বুড়িটা?”

হারুমামা বললেন, “বুড়িটার সত্যি সাহস আছে। কবে কোথা থেকে যে বুড়িটা এসে ওই বাড়ির কাছেই একটা চালা করে আছে, খেয়ালই করিনি। সারাদিন গোবর কুড়োয়, আর ওই বাড়ির পাঁচিলেই ঘুঁটে দেয়। সে নাকি বাড়িটার ভেতর থেকে অনেক রকম শব্দ শুনতে পায়। আমরা অবশ্য কিছুই শুনতে পাইনে।”

গোগোল এরকম বাড়ি কখনও দেখেনি। ভূতের গল্প পড়েছে। কিন্তু ভূত কেমন তা ভাবতেই পারে না। তিনুদা অবশ্য বলেছে, ভূত আসলে কঙ্কালের মতোই দেখতে। কেবল তার চোখ দুটো জ্বলে। জোনাকিগুলো আসলে হয়তো সেই জলন্ত চোখেরই ছিটেফোঁটা। কারণ, ভাঙা দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে তো আর পুরো চোখ দুটো দেখা যেতে পারে না।

গোগোলের সেই জোনাকি দেখবার খুবই ইচ্ছে হল। রাত্রে, খাবার আগে, তিনুদা আর চিনির সঙ্গে ও ছাদে উঠল। অন্ধকারে বাড়িটা ঠিক দেখা যায় না। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকবার পরে দূরে বাড়িটা অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখা গেল, আর হঠাৎ জোনাকি জ্বলে উঠতে দেখা গেল। দরজা-জানালার ফাঁকে-ফাঁকে, টিপটিপ জোনাকি জ্বলছে। আবার কখনও উড়ে-যাওয়ার মতো লম্বা সরু ঝিলিকও দেখা যাচ্ছে। অথচ, আশেপাশে আরও জোনাকি দেখা যাচ্ছে। সেগুলো গাছের ঝোপেঝাড়ে, নয়তো নীচের দিকে, ঘাসের কাছে।

গোগোলের মনে-মনে ভীষণ কৌতূহল হল। সত্যি কি ভূতের জ্বলন্ত চোখের স্ফুলিঙ্গ জোনাকির মতো দেখা যাচ্ছে? খুব ইচ্ছে হল, কাছে দিয়ে দেখে আসে। কিন্তু সেটা যে অসম্ভব, তাও জানে।

পরের দিন তিনুদা, চিনি ইস্কুলে তো গেলই না, হারুমামাও অফিসে গেলেন না। বাড়িতে রীতিমতো উৎসব লেগে গেল। নিজেকে গরিব বললেও, হারুমামাদের একটা পুকুর আছে। সেখান থেকে মাছ ধরা হল। তারপর সবাই মিলে চুর্নিতে চান করতে যাওয়া হল। তিনুদা আর চিনি দিব্যি সাঁতার কাটল। বাবাও কয়েকবার এপার-ওপার করলেন। গোগোলকে হারুমামা নিজেই ধরে-ধরে সাঁতার কাটালেন। স্রোতের খুব টান। তা ছাড়া জলের নীচে লম্বা ঘাস আর গুল্ম দেখে ওর একটু ভয়ও হল। অথচ তিনুদা ডুব দিয়ে জলের নীচের ঘাস-গুল্ম ছিঁড়ে নিয়ে এল। তিনুদার দুঃসাহসে গোগোল অবাক হয়ে গেল।

বেলা এগারোটার মধ্যেই স্নান আর সাঁতার কাটা শেষ। সকাল আটটায় এক প্রস্থ জলখাবার খাওয়া হয়ে গেছল। চুর্নি থেকে ফেরার পরে চারুমামিমা আবার অনেকটা সন্দেশ খেতে দিলেন। গোগোলের তখন তেমন খিদে পায়নি। মামিমা বললেন, “আজ রান্না হতে দেরি হবে। এখন একটু সন্দেশ খেয়ে নাও।”

তিনুদা আর চিনিকেও দিলেন। তারপরে মা বাবা হারুমামা দালানে বসে গল্প জুড়ে দিলেন। কাছেই মামিমা বঁটি পেতে মাছ কুটতে বসে গেছেন। গোগোল বেরিয়ে পড়ল তিনুদা আর চিনির সঙ্গে। এদিকে-ওদিকে খানিকটা ঘুরে গোগোল নিজে থেকেই জোনাকি-ভূতের বাড়ির দিকে পা বাড়াল। খানিকটা যাবার পরেই তিনুদা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, “গোগোল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?”

গোগোল বলল, “চলো না, একটু কাছে গিয়ে দেখে আসি।”

চিনি আঁতকে উঠে বলল, “না না গোগোলদা, ও বাড়ির কাছে যেয়ো না। তোমার কি একটু ভয় নেই?”

গোগোলের একটু ভয় যে নেই, তা নয়। কিন্তু ওর কৌতূহলটা তার চেয়ে বেশি। ও বলল, “বাড়িটার কাছে যাব না। আমরা নদীর ধার দিয়ে নেমে, বাড়িটার ওপাশে যাব। ওদিকটা দেখে চলে আসব।”

তিনুদা ঠিক করতে পারল না, কী করবে। চিনি চোখ বড় করে বলল, “ওদিকটায় তো সেই ডাইনি বুড়িটা আছে।”

চোখ বড় করে বলল, “ওদিকটায় তো সেই ডাইনি বুড়িটা আছে।”

গোগোল বলল, “ডাইনি বুড়ি বলছ কেন? ও তো ঘুঁটেউলি। তোমাদের বাড়ির দরজায়ও আসে। ও আমাদের কী করবে?”

তিনুদা চিনির দিকে তাকাল। চিনিও তাকাল। ওর চোখে ভয়। তিনুদা বলল, “নদীর ধার দিয়ে গেলে বাড়িটা দূরে থাকবে। তেমন দেখাই যাবে না। যাবি চিনি?”

চিনি তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে বলল, “না বাবা আমি যাব না।”

গোগোল বলল, “তিনুদা, তুমি আর আমি যাই চলো।”

তিনুর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সাহস পাচ্ছে না। অথচ গোগোলের কাছে হার মানতেও লজ্জা করছে। চিনি বলল, “যেয়ো না দাদা। আমি বাড়ি গিয়ে এখুনি বাবাকে বলে দেব।”

গোগোল বলল, “আমরা তো বাড়ির মধ্যে ঢুকব না। নদীর এপাশ থেকে ওপরে উঠে, ওদিকটা দেখেই আবার চলে আসব।”

তিনুদা যেন একটু সাহস পেয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমরা তো বাড়ির মধ্যে ঢুকব না।”

গোগোল নদীর দিকে পা বাড়িয়ে ডাকল, “এসো তিনুদা। চিনিও এসো।”

তিনু গোগোলের সঙ্গে এগিয়ে গেল। চিনি চিৎকার করে বলল, “যেয়ো না বলছি।”

গোগোল তবু নদীর ধারে এগিয়ে গেল। তিনুও পিছনে-পিছনে চলল। চিনি বাড়ির দিকে দৌড় দিল। গোগোল আর তিনু নদীর ধারে এসে পড়ল। উঁচু ঢালু পাড়ে হাঁটু ডুবে যাওয়া জঙ্গল। কয়েকটা বড়-বড় গাছও আছে। ওপারটাও জঙ্গল আর পোড়ো। এপারে ওপারে, এদিকে কোনও লোকজন নেই। স্নানের ঘাট নেই। কেউ স্নানও করছে না। কিন্তু গোগোলের চোখে পড়ল, ওদের হাঁটু-ডোবা জঙ্গলের মধ্যে, পায়ে হাঁটা রাস্তার সরু দাগ রয়েছে। ও বলল, “দেখছ তিনুদা, এখানে পায়ে চলার দাগ আছে। তা হলে এদিক দিয়ে মানুষ যায়।”

তিনু বলল, “বোধহয় এখান দিয়েই বুড়িটা যাতায়াত করে।”

গোগোল ভাবল, একটা বুড়ি কতবার যাতায়াত করে? তার জন্য এরকম সরু রাস্তার দাগ পড়ে? কিন্তু চারদিকটা সত্যি ভারী নিঝুম। কিন্তু বলল, “চলে এসো গোগোল। আর যাবার দরকার নেই।”

গোগোল বলল, “এখানে ভয় কীসের? চলো না, আরও একটু এগিয়ে গিয়ে আমরা ওপরে উঠব।”

তিনুদা কিছু বলতে পারল না। গোগোলের পিছনে-পিছনে চলল। খানিকটা গিয়ে গোগোল দাঁড়িয়ে পড়ল। আশ্চর্য, এখানে নদীর ধারটা কেমন চ্যাটাং-মতো। আর এখানে-সেখানে কয়েকটা সরু গভীর গর্ত। এমনকী পায়ের ছাপও অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর সেই পায়ের ছাপ ওপরে জঙ্গলের দিকে উঠে মিলিয়ে গেছে। তিনুদা বলল, “কী দেখছ, গোগোল?”

গোগোল বলল, “এখানে দ্যাখো তিনুদা, মানুষের পায়ের ছাপের মতো দাগ রয়েছে। আর এই গর্তগুলো কীসের?”

তিনু দেখে অবাক হয়ে গেল। একবার ওপারের জঙ্গল আর পোড়োর দিকে মুখ তুলে দেখল। বলল, “আশ্চর্য তো! দেখেই মনে হচ্ছে, এখানে নৌকো আসে। গর্তগুলো দেখে মনে হচ্ছে, নৌকো বাঁধবার জন্য এখানে বাঁশের লগি পোঁতা হয়।”

গোগোল হেসে বলল, “আর তোমরা বলো, এদিকে কেউ আসে না। না এলে এ-সব দাগ থাকবে কেন?”

তিনুদা তো খুবই অবাক হয়ে গেল। আর ভাবনায়ও পড়ে গেল। বলল, “তা হলে কি জেলেরা এখানে মাছ ধরতে আসে? কিন্তু সবাই বলে, এদিকে কেউ আসে না।”

গোগোল বলল, “কেউ দেখতে পায় না বলেই জানতে পারে না। এখন দেখতে পাচ্ছ তো, এদিকে লোক আসে। চলো, আরও খানিকটা এগিয়ে আমরা বাঁ দিকে ওপরে উঠব। এখান দিয়ে সোজাসুজি উঠলে, একেবারে বাড়িটার সামনে পড়ে যাব।”

তিনুদা বলল, “তার দরকার নেই। এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে ওঠাই ভাল। তবে বুড়িটার জন্যই আমার ভয় লাগছে।”

গোগোল হাঁটতে-হাঁটতে বলল, “তোমরা বলো বুড়িটা ডাইনি। আসলে তো ঘুঁটেউলি। তোমাদের ও ঘুঁটে দেয়।”

তিনুদা বলল, “তা দেয়। তবু বুড়িটাকে দেখলেই কেমন ভয় লাগে।”

দু’জনেই বেশ খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে উঁচুতে তাকাল। বাড়িটার এক পাশের মাথা দেখা যাচ্ছে। গোগোল এবার উপরে উঠতে লাগল। এদিকটায় জঙ্গল আর মাটিতে কোনওরকম পায়ের ছাপ নেই। দু’জনেই ওপরে উঠে এল। কোথাও কেউ নেই। বাড়িটার পাঁচিল এদিকেও ভাঙাচোরা। একটা দরজাও আছে। দরজাটার সামনে একগুচ্ছ জঙ্গল। তিনু গোগোলের হাত টেনে ধরে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ওই যে দেখছ চালাঘরটা, ওটাতেই সেই বুড়ি থাকে। রেললাইনের ওপর থেকে চালাটা দেখা যায়। কিন্তু বুড়িটা দেখছি এদিকে কোথাও নেই।”

গোগোল মুখ ফিরিয়ে দেখল, বেশ খানিকটা দূরে উঁচু রেললাইন। ওই লাইনটাই রানাঘাট থেকে চুর্নি নদীর ওপর দিয়ে এসেছে। ও আবার বাড়িটার দিকে তাকাল। ওদের কাছ থেকে বাড়িটা প্রায় কুড়ি হাত দূরে। এদিকেও দরজা জানালা সব বন্ধ। তবে দু’-একটা জানালার পাল্লা ভেঙে পড়েছে। একটা দরজার একটা পাল্লা খোলা। গোগোল ভাঙা পাঁচিলের দিকে এগিয়ে গেল। তিনু বলল, “কোথায় যাচ্ছ?”

গোগোল বলল, “একটু কাছে থেকে দেখে আসি।”

কিন্তু তিনুদা দাঁড়িয়েই রইল। বলল, “দুপুরবেলাও ভূতেরা বেরোয়।”

গোগোল ভেবে অবাক হল, তার থেকে দু’বছরের বড় হয়েও, তিনুদা চিনুর মতো কথা বলছে। রাতের জোনাকি-ভূত দিনের বেলা দেখা যাবে কেমন করে? অবশ্য সত্যিই যদি ভূত থাকে। গোগোল কখনও ভূত দেখেনি। গল্পের বইয়ে পড়েছে। তবে সেগুলো যে ভূত, তা মোটেই প্রমাণ হয়নি। ও বলল, “তবে তুমি দাঁড়াও, আমি একটু কাছে থেকে দেখে আসছি।”

তিনুদা দাঁড়িয়েই রইল। গোগোল মানুষ পেরুবার মতো হাঁ-করা ভাঙা পাঁচিলের কাছে এগিয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখল, সেখানে মানুষের পায়ের ছাপ রয়েছে। অথচ বাড়িতে ঢোকবার দরজার কাছে ঘন জঙ্গল। ও তিনুদার দিকে ফিরে বলল, “তিনুদা, দেখবে এসো, এখানে মানুষের পায়ের ছাপ রয়েছে।”

তিনুদার অবস্থা খারাপ। সে আশেপাশে ভয়ের চোখে দেখতে-দেখতে বলল, “থাকুক। তুমি চলে এসো।”

কিন্তু গোগোলের কৌতূহল তখন বেড়ে গেছে। বলল, “তুমি দাঁড়াও, আমি একটু ভেতরের উঠোনটা দেখে আসি।”

তিনু আর কিছু বলবার আগেই, গোগোল পাঁচিলের হাঁ-করা ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কেউ কোথাও নেই, ফাঁকা আর নিঝুম। উঠোনের চারপাশে শুকনো একরকমের কাটিঘাস গজিয়েছে। তার মাঝে-মাঝে এলোমেলো পায়ের ছাপও রয়েছে। ভূতের কি পায়ের ছাপ পড়ে? গোগোল বাড়িতে ঢোকবার এক পাল্লা খোলা দরজাটার দিকে তাকাল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। রকে উঠে, দরজার কাছে গিয়ে ভিতরে উঁকি দিল। অন্ধকার। আর একটা ভ্যাপসা গন্ধ। কিন্তু অন্যরকমের গন্ধও যেন পাওয়া যাচ্ছে। কীসের গন্ধ? মনে করার চেষ্টা করতেই, ওর খেয়াল হল, গন্ধটা সিগারেটের ধোঁয়ার। আশ্চর্য! এখানে সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ আসছে কোথা থেকে? ও তিনুদাকে বলবার জন্য মুখ ফেরাল। তাকে দেখা গেল না।

গোগোল কয়েক সেকেন্ড ভাবল। তারপর ভিতরে ঢুকে পড়ল। সামনেই একটা ঘর। আবছা অন্ধকার। একতলা হলেও বেশ বড় বাড়ি। ঘরটার দু’পাশে কয়েকটা ঘরের দরজা। সবই যেন বন্ধ। মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ। তার মধ্যে মানুষের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। তা হলে কি ভিতরে কোনও মানুষ আছে? সিগারেটের গন্ধটাই বা কোন দিক থেকে আসছে?

গোগোল আশেপাশে তাকিয়ে, ডান দিকে এগিয়ে গেল। একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ধ দরজা। হাত দিয়ে একটু ঠেলা দিতেই, দরজাটা খুলে গেল। ভেবেছিল, নিশ্চয়ই ঘরটা অন্ধকার হবে। কিন্তু জানালার কাঠের জাফরি এত ভাঙা-চোরা, অনেক ফাঁক রয়েছে। সেই ফাঁক দিয়ে ঘরে একটু আলো এসেছে। কিন্তু গোটা ঘরটা ভরতি ওগুলো কী? মনে হচ্ছে পলিথিন দিয়ে ঢাকা।

ভূতের বাড়িতে এ-সব কী? গোগোল এগিয়ে গেল। পলিথিন ধরে টান দিতেই, একটু শব্দ হল। আর দেখল, নতুন কাপড়ের বড়-বড় বান্ডিল। ভূতের বাড়িতে নতুন কাপড়ের বান্ডিল কেন? গোগোল সরে গিয়ে আর-এক দিকের পলিথিনের ঢাকনা তুলল। দেখল চটের বড়-বড় বস্তা ঠাসা কী সব রয়েছে। ভাল করে দেখেই বুঝল, সব চিনির বস্তা। পিঁপড়েও রয়েছে। আশ্চর্য! ভূত কি এত চিনি খায় নাকি?

এবার পাশের আর একটা ঘরের দিকে ওর নজর পড়ল। দরজাটা খোলা। হালকা আলোও আছে। গোগোল সেই ঘরে ঢুকল। দেখল একটা জানালার পাল্লা বা গরাদ অর্ধেক নেই। সেখানে পলিথিনের ঢাকা দেওয়া কিছু নেই, কেবল ঘর ভরতি, মুখ-আঁটা বড় বড় টিন। গন্ধেই টের পাওয়া যাচ্ছে, সবগুলোই সরষের তেলের টিন। ভূতে কি তেলও খায়?

ঠিক এই সময়েই সামান্য শব্দে গোগোল মুখ ফিরিয়ে দেখল, দুটো ঘরের মাঝখানের দরজায় একটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। পায়জামার ওপরে গেঞ্জি গায়ে, ষণ্ডা-মতো লোকটার মুখ শক্ত। অবাক চোখ দুটো যেন ধক-ধক করে জ্বলছে। তার ডান হাতের আঙুলের ফাঁকেও সিগারেট জ্বলছে। মোটা গলায় চাপা গর্জনের স্বরে বলল, “এই ছুঁচো, তুই কোথা থেকে এখানে ঢুকলি রে? কে তুই?”

ভূতের বদলে ষণ্ডামার্কা মানুষ। চিনি বলেছিল, ভূতেরা অনেক রকম বেশ ধরতে পারে। এও কি তাই নাকি? গোগোল কোনও জবাবই দিতে পারল না। লোকটার মুখ আরও শক্ত আর ভয়ংকর হয়ে উঠল। বলল, “জানিস এটা ভূতের বাড়ি? ঢুকলে আর বেরোনো যায় না? মরবার পাখনা গজিয়েছে?”

গোগোলের বুকের মধ্যে তখন ঢিপ-ঢিপ করছে। তবু ভয়ে ভয়ে সত্যি কথাটাই বলল, “আমি ভূত দেখতে এসেছিলাম।”

“ভূত দেখতে?” লোকটা খ্যাঁক করে উঠল, “দেখাচ্ছি ভূত। ঘাড় মটকে এখুনি তোর ভূতের মজা দেখাচ্ছি।”

তার কথা শেষ হবার আগেই পিছন থেকে আর একটা লোক এসে পড়ল। বলল, “কে রে জিতু?”

গোগোল দেখল, সেই লোকটাও বেশ ষণ্ডা-মতো। জিতু নামে লোকটা বলল, “কে জানে কে! এ এলাকার কেউ নয়, ছুঁচোটা কেমন করে ঢুকে পড়েছে।”

পিছনের লোকটা আর-একটু এগিয়ে এল। বলল, “তা হলে তো ছাড়াছাড়ি নেই। শিগগির ধরে ঘাড়টা মটকে দে, তারপরে নদীর জলে ফেলে দিয়ে আয়।”

গোগোল ভয় পেলেও ঝট করে পাল্লা-খোলা, গরাদ বিহীন জানালাটা দেখে নিল। ইতিমধ্যে জিতু নামের লোকটা ঘরের মধ্যে পা বাড়িয়েছে। গোগোল তেলের টিনের ওপর লাফ দিয়ে উঠল। জিতু চিৎকার করে উঠল, “আরে এ ছুঁচো নয়, সাপ দেখছি। পালাচ্ছে।” বলে সে-ও তেলের টিনের ওপর উঠতে গেল। কিন্তু পা হড়কে পড়ে গেল।

গোগোল গরাদ-ভাঙা পাল্লা-খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে নীচে পড়ল। পায়ের একটা স্যান্ডেল খুলে ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু ওর তখন সেদিকে নজর নেই। শুকনো কাটিঘাসের ওপর দিয়েই পাঁচিলের দিকে ছুটল। পিছনেও ধুপ করে শব্দ হল, আর চিৎকার শোনা গেল, “জিতু, তুই একটা আস্ত মোষ। শিগগির আয়, পুঁচকে শয়তানটা পালাচ্ছে।”

গোগোল পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ে, একবার পিছন ফিরে দেখল। দু’জনেই ছুটে আসছে। কিন্তু তিনু নেই। বরং ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটা শননুড়ি-চুল বিটকেল বুড়ি। সে হাঁইমাঁই শব্দ করে গোগোলের দিকে তেড়ে এল।

গোগোল দেখল, নদীর পাড়ের দিকে যাবার উপায় নেই। ও সোজা রেললাইনের দিকে দৌড় লাগল। পিছন ফিরে আর একবার দেখল। লোক দুটোই বেশ পিছনে। কিন্তু ছুটে আসছে। গোগোলের মাথার ঠিক নেই। ওরা হাতে পেলেই ঘাড় মটকে নদীর জলে ফেলে দেবে। ও রেললাইনের দিকে গিয়ে একটু দমে গেল। রেললাইন বেশ উঁচুতে। ওপরে একটা লোকও দেখা যাচ্ছে না। অথচ ওপরে না উঠেও উপায় নেই। ও মরণপণ হয়ে ওপরে উঠতে লাগল। পিছনে তখন লোক দুটোর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তার সঙ্গে কারওর গলা, “ওকে ধরতেই হবে। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

গোগোল রেললাইনের ওপরে উঠে, দিক ঠিক করতে পারল না। রেললাইনের ডান দিক ধরে দক্ষিণে ছুটতে লাগল। খেয়ালই নেই, ওদিকে রয়েছে চুর্নির ব্রিজ। দৌড়তে দৌড়তে ব্রিজের সামনে এসে থমকে গেল। নীচের দিকে তাকিয়ে ওর মাথাটা ঘুরেই গেল। পিছন থেকে শোনা গেল, “এবার কোথায় যাবে চাঁদ? নীচে পড়েই মরবে।”

গোগোল ভাবল, নীচে পড়ে যাই হোক, ও ব্রিজের ওপর দিয়েই যাবে। ভেবেই, রেলের স্লিপারের ওপর এক পা করে এগোতে লাগল। পিছনে চিৎকার শোনা গেল “ছেলেটা নির্ঘাত মরবে।”

গোগোলের তখন পিছন ফিরে দেখবার সময় নেই। তখন পিছনে আরও অনেক লোকের গলার স্বর ভেসে আসতে শোনা গেল, “রেল আসছে, রেল আসছে।”

গোগোল থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে তাকিয়ে দেখল, সত্যি একটা ট্রেন দূরে দেখা যাচ্ছে। কোনওরকমে একবার সাহস করে নীচে তাকাল। অনেক নীচে চুর্নি নদী। ও একবার পিছন ফিরে দেখল। ব্রিজের ওপারে অনেক লোক জমে গেছে। কিন্তু তার মধ্যে সেই ষণ্ডা দুটো আছে কি না বুঝতে পারল না। ও সামনে ফিরে, দু’হাত তুলে নাড়তে লাগল। কিন্তু ট্রেনটা এগিয়েই আসতে লাগল।

কী করবে গোগোল? এত উঁচু থেকে চুর্নিতে পড়লে, ডুবেই মরে যাবে। পাশে কোনও রেলিং পর্যন্ত নেই। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যেতেই, ও গায়ের জামা খুলে উঁচুতে হাত তুলে ওড়াতে লাগল। ট্রেনটা তখন ব্রিজের প্রায় কাছে। কিন্তু নানারকম শব্দে ব্রেক কষে, গাড়িটা ব্রিজের খানিকটা এসে থেমে গেল। গোগোল সাবধানে একটা-একটা করে স্লিপার পার হতে লাগল। ইলেকট্রিক ট্রেনের সামনে আসতেই, অনেক যাত্রীর হইচই শোনা গেল। সামনের ইঞ্জিনের লোকটা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, “মরবে নাকি? শিগগির সামনের ডান্ডা ধরে, ওপরের থাকটার ওপর উঠে বসে পড়ো।”

গোগোলের তা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। ও সামনেই দেখল, ইঞ্জিনের সামনে দু’ দিকে দুটো রড রয়েছে। বাফারও আছে। কিন্তু ডান্ডা ধরে বসবার মতো চওড়া জায়গাই আছে। ও সেখানে উঠে ডান্ডা ধরে বসে পড়ল। হাত-পা ঠক-ঠক করে কাঁপছে। ইঞ্জিনম্যান জানালা দিয়ে দেখে, ভোঁ বাজিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। খুব আস্তে আস্তেই ব্রিজটা পেরিয়ে গাড়ি আবার দাঁড়াল। সেখানে তখন লোকে ভিড়ে তিল-ধারণের জায়গা নেই।

ইঞ্জিনম্যান নেমে এসে, গোগোলকে দু’হাতে ধরে নামাল। চোখে-মুখে রাগ আর উত্তেজনা। পারলে যেন দু’ঘা লাগিয়েই দেয়, এমনি কড়া ধমক দিয়ে বলল, “চলো, তোমাকে আমি এক্ষুনি পুলিশে দেব। কেন তুমি ব্রিজের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলে?”

গোগোল কোনও জবাব দিতে পারল না। ওর চোখে জল এসে পড়ল। এর মধ্যেই হারুমামা, বাবা আর তিনুদা এসে হাজির। গোগোল হারুমামাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, “হারুমামা, জোনাকি-ভূতের বাড়িতে দুটো ডাকাত ছিল। তাদের তাড়া খেয়ে আমি ব্রিজের ওপরে উঠে পড়েছিলাম।”

আশেপাশের অনেকেই ভয়ে আর বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল, “জোনাকি-ভূতের বাড়ি ঢুকেছিল? সর্বনাশ। তা হলে নিশ্চয়ই ভূতে তাড়া করেছিল।”

গোগোল বলল, “ভূত না, ডাকাত। সেখানে অনেক কাপড় চিনি আর সরষের তেল ডাঁই করা রয়েছে।”

গোগোলের কথা শুনে সবাই হতবাক। ট্রেনের ইঞ্জিনম্যান বলল, “আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। সামনে সিগন্যাল দেওয়া রয়েছে। আপনারা এ-ছেলের নাম-ধাম টুকে রাখবেন। আমাকে রিপোর্ট করতে হবে।” বলেই সে লাফিয়ে ট্রেনের সামনের দরজা দিয়ে উঠে পড়ল। কয়েকবার ভোঁ দিয়ে, গাড়ি চালিয়ে দিল।

এদিকে সবাই তখন নানারকম কথাবার্তা বলছে। কোথা থেকে একজন সেপাইও চলে এল। সে বলল, “সবাই চলুন তো, জোনাকি-ভূতের বাড়িটা দেখি গিয়ে।”

হারুমামাকে সবাই চেনে৷ তিনি বলল, “আপনারা যান। এ-ছেলেটি আমার ভাগনে। কী হল না হল, সব দেখে আমাদের বাড়িতে আসবেন।”

দেখা গেল, হারুমামার কথা কেউ অগ্রাহ্য করল না। সেপাইয়ের সঙ্গে সবাই ছুটল। আর, হারুমামা গোগোলের হাত ধরে বাড়ির দিকে চললেন। সঙ্গে বাবা আর তিনুদা।

ঘণ্টা খানেক পরেই হারুমামার বাড়িতে রানাঘাট থানার ওসি, অন্য একজন বড় অফিসার আর বেশ কয়েকজন সেপাই এসে হাজির। পিছনে বিশাল একদল লোক। অফিসার বললেন, “হারুবাবু, আপনার ভাগনেটি কোথায়?”

গোগোল ঘর থেকে বেরিয়ে এল। অফিসার এসে গোগোলের হাত ধরে হেসে বললেন, “তুমি এইটুকু ছেলে, সাংঘাতিক কাজ করেছ। জোনাকি-ভূতের বাড়িটা আসলে বাংলাদেশে চোরাই মাল পাঠাবার একটা গুদাম। চোরাই চালানদাররা বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি সাজিয়ে রেখেছে।”

সবাই তখন গোগোলকে দেখার জন্য ব্যস্ত। সবাই চিৎকার করছে, “আমরা গোগোলকে দেখব, গোগোলকে দেখব।”

অফিসার নিজেই গোগোলকে কাঁধের ওপর তুলে ধরলেন, “দেখুন। ভূত দেখতে গিয়ে ও কী বিরাট চুরির ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছে।”

হারুমামা তো রীতিমতো লাফালাফি করতে লাগলেন। হাসছেন আর বলছেন, “হ্যাঁ, ও হল খুদে গোয়েন্দা গোগোল।”

কিন্তু গোগোল দেখল মা আর মামিমা রকে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। কিন্তু চিনি আর তিনুদাও হারুমামার সঙ্গে নাচছে আর হাসছে।

থানার ও সি বললেন, “প্রায় তিন লাখ টাকার মাল ধরা পড়েছে। আমরাও জানলাম, বাড়িটা আসলে ভূতের বাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছিল।”

হারুমামা জিজ্ঞেস করলেন, “জোনাকির মতো টিপটিপ করে কী জ্বলত?”

ও সি হেসে বললেন, “পেনসিল চর্ট। বেশি আলো জ্বাললে সব দেখা যাবে। ওখান থেকে নৌকোয় করে রানাঘাটে মাল নিয়ে ওরা মাজদিয়ার ওদিকে বর্ডারে মাল পাচার করত। একটা পাজি বুড়ি সব সময় ওখানে পাহারা দিত, কিন্তু গোগোলকে সে ঢুকতে দেখেনি। তাকেও আমরা ধরেছি।”

সবাই এগিয়ে এসে গোগোলকে একবারটি ছুঁতে চাইল। অফিসার গোগোলকে রকের কাছে, মায়ের সামনে নামিয়ে দিলেন। ওর গাল টিপে আদর করে বললেন, “সত্যি, সাহসী ছেলে। তবে বড় দুঃসাহস। ব্রিজের ওপর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। তবু বলব, শাবাশ গোগোল। শাবাশ।”

হারুমামা এসে গোগোলকে একেবারে বুকে জড়িয়ে কোলের ওপর তুলে নিলেন।

পুলিশ অফিসাররা বসলেন দালানের মধ্যে। তাঁদের খুব চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। বাইরে তখনও বিস্তর লোক গোগোলকে দেখবার জন্য অপেক্ষা করছে।

১৩৮৭

অলংকরণ: সুনীল শীল

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন