পৌলোমী সেনগুপ্ত
গুপি আমার সেজ মামার ছেলে, আমার সঙ্গে বেজায় ভাব। গত বছর পুজোর সময়টা আমরা কালীঘাটে বড়মামার বাড়িতে কাটিয়েছিলাম। কলকাতা শহর তৈরি হবার অনেক আগে ও-সব পাড়ার পত্তন হয়েছিল। ভাঙা সব মন্দির, টিপি ঢিপি ইট, তার মধ্যে মানুষ থাকে। বড়মামার বাড়িটাও বেজায় পুরনো, আমার অতি বৃদ্ধ বুড়ো দাদামশাইয়ের বাপের ঠাকুরদার বাবা নাকি বানিয়েছিলেন। সেই ইস্তক আমার মামার বাড়ির লোকেরা ওখানে বাস করে আসছে। অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটে ওখানে, তুকতাক, যাদুমন্ত্র, ভূতপ্রেত সাধুসন্ন্যাসী। সবাই সে-সব কথা বিশ্বাস করে। বড়মামারাও। বিশেষ করে বড়মামার ছেলে রামকানাইদা।
সে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে কোথায় কোন কারখানায় কাজ শেখে আর পাড়া চষে বেড়ায়। বাড়ির লোকে খাবার সময় ছাড়া তার টিকির ডগাটি দেখতে পায় না। কিন্তু আমরা যে-দিন গেলাম রামকানাইদা বাড়ি থেকে বেরোল না। একটু খুশি না হয়ে পারলাম না। বিকেলে জলখাবারের পর আমাদের সঙ্গে শোবার ঘরে এসে বলল, “দেখি মনিব্যাগ।”
গুপি চটে গেল। “মনিব্যাগ আবার কী? আমরা না ছোটভাই, কোথায় তুমি আমাদের কিছু দেবে, না মনিব্যাগ চাইছ?” রামকানাইদা কাষ্ঠ হাসল। “ট্যাঁক গড়ের মাঠ, চাইব না তো কী? পুজোর খরচা আছে না। তোরা তো দিব্যি এখানে আমার বাবার হোটেলে দু’বেলা ভাত মারবি। আবার বিকেলে তোদের জন্য লুচি হালুয়া হল! নে, নে, বের কর।” গুপি বলল, “সেটি হচ্ছে না, বাপু, মনিব্যাগ বড়জ্যাঠার কাছে রেখেছি। আমাদের কেনাকাটা আছে, কালীঘাট থেকে মেলা জিনিস কিনে নিয়ে যেতে হবে।” রামকানাইদা বলল, “আচ্ছা দশটা টাকা দে তো।” গুপি বলল, “উহু।”
রামকানাইদার মুখটা কালো হয়ে গেল। “আচ্ছা, দেখা যাবে।” এই বলে সে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল। টাকাটা অবশ্য গুপির জামার ভিতরের গোপন পকেটেই ছিল। সে কথা সে বলতে যাবে কেন? দু’-তিন দিন গেল। রামকানাইদার দেখা নেই। টাকাটা খরচ করে ফেলতে পারলে বাঁচি। দশটি টাকা। গুপির পাঁচ, আমার পাঁচ। ভেবেছিলাম দু’দিন সিনেমা দেখব, একটা পুজোবার্ষিকী কিনব, আর গুপি বলছিল একটা লটারির টিকিট কিনে যদি এক লাখ টাকা পাওয়া যায়, একেক জনের ভাগে হবে পঞ্চাশ হাজার। তাই বা মন্দ কী! এখন মনে হচ্ছিল টাকাটা ঝেড়ে ফেলতে পারলেই বাঁচা যায়।
আলিপুরের দিক থেকে এলে চেতলার পুল পার হয়েই বাঁ হাতে একটা সরু গলিকে বুড়িগঙ্গার ধার দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যেতে দেখা যায়। তাতে ঘেঁষাঘেঁষি দু’-সারি অতি পুরনো বাড়ি কোনওরকমে পরস্পরকে ঠেকো দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খালের দিকে থেকে থেকে খানিকটা ফাঁকা জায়গাও আছে, সেখানকার ইটের গাদা দোতলার সমান উঁচু, মোষগাড়ি, মোষ, কাদা। কিন্তু কোনওরকমে ইটের গাদা পার হয়ে একবার খালের ধারে পৌঁছতে পারলেই, ব্যস আর ভাবনা নেই। চুপচাপ, নিরিবিলি, বড়দের সাধ্য নেই যে দেখতে পায়।
সেই রকম একটা জায়গার ভাঙা পাথরের সিড়ির ওপর বসে পড়ে গুপি বলল, “বেশ জায়গাটা না রে? ভারী বদনাম এর।” আমি একটু অবাক হলাম। “বদনাম কেন?” “বদনাম হবে না? তাকিয়ে দেখ, ভিতগুলো মাটির নীচে বসে গেছে। এদেশে ইংরেজরা এসে জমিদারি পত্তন করার অনেক আগে ওগুলো তৈরি। এখানে হয়নি এমন দুর্ঘটনা নেই।”
ভাঙা ঘাটের কয়েক ধাপ নীচে একটা রোগা সিড়িঙ্গে ছোকরা একটা বেজায় মোটা ছাগলের গলার দড়ি নিয়ে বসেছিল। সে ফিক করে একটু হেসে বলল, “হবে না দুর্ঘটনা! তখন বড় গঙ্গার ঘাটে নৌকো থেকে নেমে, এখন যেখানে বড় পোস্টাপিস সেখান থেকে দল বেঁধে, ঘোর বেঘো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে, যাত্রীরা আসত মা-কালীর পুজো দিতে। সারতে সারতে সন্ধ্যা হয়ে যেত, রাত কাটাবার আস্তানার দরকার হত। তখন এইসব বাড়িগুলোতে সামান্য খরচে আশ্রয় পাওয়া যেত। তবে ও-রকম আশ্রয়—সে যাই হোক, এখন সেসব লোকের বংশধররা সব ভারী ভালমানুষ হয়েছেন!”
এই অবধি বলে ছেলেটা থেমে ছাগলকে বলল, “হেট, হেট, ওদিকে নয়, দাদা। ওই খ্যাঁদা ছেলেটা যেখানে বসেছে ওখানে গোখরোর বাসা।”
তাই শুনে আমি এক হাত লাফিয়ে উঠে সরে বসলাম। ভারী রাগ হল, “তুমি তো বেশ লোক হে!এতক্ষণ বসে আছি কিচ্ছু বলনি, আর যেই তোমার পেয়ারের ছাগল এদিকে এসেছে, অমনি বলছ গোখরোর বাসা! আমাকে যদি কামড়াত?”
ছেলেটা একটা খড় চিবুতে চিবুতে বলল,‘কামড়াবে কেন? তবে হ্যাঁ, ছোবল মারতে পারে। তাতেই বা কী এমন হত? হয়তো তোমার মাথা ঘুরত, হাত-পা ঝিমঝিম করত, মুখ দিয়ে ফেনা উঠত, চোখ উলটে যেত। তার বেশি কী-ই বা এমন হতে পারত? হ্যাঁ, মুখটা নীল হয়ে যেত বোধ হয়। কিন্তু তোমার বন্ধু যদি তক্ষুনি আমার হাতে দশটা টাকা গুঁজে দিত, আমি ছুটে গিয়ে ভণ্ড গোঁসাইকে ডেকে আনতাম। তিনি একটা ফু দিলেই তুমি চোখ রগড়ে উঠে বসতে। কী আর এমন ক্ষতি হত, তাই বলো?”
গুপি এতক্ষণ হাঁ করে ওর কথা শুনছিল। এবার বলল, “তা হলে ছাগলের জন্যই বা অত ভাবনা কীসের? তাকেও তো ভণ্ড গোঁসাই ফুঁ দিয়ে চাঙ্গা করে তুলতেন।”
ছেলেটা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, “তা হয় না। আমার টাকাও নেই। তা ছাড়া ওর উপর গোঁসাইয়ের রাগ আছে। নইলে উকিল না হয়ে ও ছাগলই বা হয়ে থাকবে কেন?” এই বলে সে ফোৎ ফোঁৎ করে খানিকটা কেঁদে নিল।
আমরা বেজায় আশ্চর্য হয়ে গেলাম। হাফ প্যান্টের পায়া দিয়ে নাক মুছে ছেলেটা বলল, “কামিখ্যে পাহাড়ের নাম শুনেছ? সেখানে সহজে কেউ রাত কাটাতে চায় না। কাটালে মানুষ আর মানুষ থাকে না, ছাগল হয়ে যায়। গোঁসাই হলেন গিয়ে কামিখ্যের পাণ্ডা। ইটের গাদার ওপারে ওই পোড়ো বাড়িতে ওঁর আস্তানা। পয়সাওলা লোক, পাঁঠার মস্ত ব্যবসা। আর—আর বেশি কিছু বলতে চাই না। আজকাল পাঁঠার বড় দাম।”
আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল, “তবে কী—তবে কী”—ছেলেটা চোখ কটমট করে, ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “শ্—শ্—শ্চুপ। যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ, যত কানাঘুষো সব ওঁর কানে পৌঁছয়।”
তারপর উঠে ছাগলটাকে বলল, “চল, দাদা, আর দুঃখ করে কী হবে? দশ টাকা না পেলে তো গোঁসাই তোমার রূপ বদলাবে না।” তাই শুনে ছাগলটাও মহা ব্যা—ব্যা করতে করতে আমার কান চেবানো ছেড়ে দিয়ে, উঠে পড়ল।
চলেই যেত ছোকরা, গুপি আবার ওর গেঞ্জি ধরে টেনে বলল, “ভয় কীসের? খুলেই বলো না।”
ছেলেটা ইদিক-উদিক দেখে নিয়ে নিচু গলায় বলল, “ও ছাগল নয়।” ছাগল নয়? বলে কী ছোকরা, দিব্যি আমার পকেট চেবাচ্ছে! চারটে দো-ভাগা খুর, বেঁড়ে ল্যাজ, ঝুলো কান, কেমন যেন গন্ধ, যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে! ছেলেটা বলল, “ছাগল বনে গেলে শুধু কি চেহারাটাই ছাগুলে হয় ভেবেছ? মনেও ছাগুলে ভাব ধরে। এই দাদা, ও কী হচ্ছে!” এই বলে ছাগলের দড়ি ধরে টেনে সরিয়ে নিল। বাস্তবিক ভাল করে দেখতে দেখতে ছাগলের মুখের সঙ্গে ছেলেটার একটু আদল আছে মনে হল।
“কিন্তু—কিন্তু—?”
ছেলেটা বলল, “আবার কিন্তু কী এর মধ্যে? স্রেফ কথা হল, দাদা গোঁসাইয়ের বেজায় ভক্ত। কারও বারণ শুনল না, ঠাকুমার বিছেহার, বাবার সোনার ঘড়ি, নিজের পৈতের সোনার বোতাম, সব নিয়ে গুরুর সঙ্গে কেটে পড়ল। নাকি তীর্থে যাচ্ছে। ছয় মাস পরে গোঁসাই ছাগলকে দিয়ে গেলেন, বললেন নাকি হাজার বারণ করা সত্ত্বেও দাদা কামিখ্যেতে রাত কাটাল। সকালে তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না, শুধু ওই ছাগলটি ব্যা ব্যা করতে করতে যখন ওঁদের সঙ্গে পাণ্ডুঘাট অবধি হেঁটে এল, তখন আসল ব্যাপার বুঝতে কারও বাকি রইল না।”
গুপি বলল, “ওকে আবার মানুষ করা যায় না?”
ছেলেটা বলল, “এতক্ষণ কী বলছি। দশ টাকা খরচ লাগে। সে আমি কোথায় পাব? বাবা দেবে না, বলছে ওই ছাগলই ভাল।”
“আর ঠাকুমা?” “তিনি আরও খারাপ। বলছেন সের দরে গোঁসাইয়ের কাছে বেচে দিতে। উঃ!” ছাগলটাও তাই শুনে আকাশ পানে এমনি বেজায় ব্যা—ব্যা করতে লাগল যে, শেষ পর্যন্ত গুপি পকেট থেকে দশ টাকার নোটটা বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, “যাচ্চলে!” ছেলেটা কৃতজ্ঞতায় ভেঙে পড়ল। “দাও, দাও, চাট্টি পায়ের ধুলো দাও বাপ। কাল সন্ধে নাগাদ ওই আমাদের তেরো নম্বরের বাড়িতে খোঁজ নিলে, সুখবর পাবে।” তারপর কাঁদো কাঁদো মুখ করে ছেলেটা বলল, “ভাই, গত চারশো বছরের মধ্যে আমাদের বাড়িতে একটাও ভাল কাজ হয়নি। তোমাদের দয়ায় এবার হবে।” এই বলে ছাগল টানতে টানতে বোঁ দৌড় দিল। ছাগলটাও আনন্দের চোটে ব্যা—ব্যা করতে করতে বেজায় ছুটতে লাগল।
গুপি বলল, “আহা! হাজার মন্দ লোক হোক, এদ্দিন পরে মুক্তির আশা পেয়েছে, হবে না ফুর্তি! দশ টাকা দিয়ে এর চেয়ে আর ভাল কী হতে পারত!”
সেদিন রাতে রামকানাইদার দেখা পেলাম না। পরদিন ভোরে আমরা উঠবার আগেই হয়তো কারখানায় চলে গেছিল। মোট কথা দেখা পাইনি। ওর হাত থেকে টাকাটা বাঁচাতে পেরে দু’জনেই খুব খুশি। তবু মাঝে মাঝে— যাক গে।
সন্ধ্যাবেলায় তেরো নম্বরের বাড়িতে সদর দরজায় টোকা দিতেই এক রুদ্রমূর্তি ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বললেন, “কাকে চাও হে ছোকরারা? নাদু ভাদু বাড়ি নেই, নৌকো করে তারা পাঁঠাভাতি করতে গেছে, রামকানাই রাস্কেলের সঙ্গে। এখন যাও, আমার মন মেজাজ ভাল নেই। নেদো হতভাগা কোত্থেকে দশ টাকা জুটিয়েছে, তাই দিয়ে নৌকো ভাড়া করেছে। ও কী হল?”
গুপি বলল, “যাচ্চলে।”
১৩৮০
অলংকরণ: সুবোধ দাশগুপ্ত
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন