পৌলোমী সেনগুপ্ত
এবার পতিতপাবন রুদ্র উঠলেন।
বিধানসভা একেবারে চুপ। পিছনের দিকে জন চারেক সদস্য নিদ্রা যাচ্ছিলেন। তাঁদের নাকের আওয়াজও বন্ধ হয়ে গেল।
এক একটি প্রশ্ন যেন এক একটি তির। যাঁর উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত হয়, তাকে একেবারে কাহিল করে ফেলে। উত্তর দেবার মতন আর শক্তি থাকে না। কেবল তোতলাতে থাকেন। ধরাশায়ী হতে বিলম্ব হয় না।
যে-কোনও ব্যাপার পতিতপাবনবাবুর একেবারে নখদর্পণে। কী অগাধ পাণ্ডিত্য ভাবলে অবাক হতে হয়। কোচবিহারের স্বল্পখ্যাত এক জেলায় ক’জন লোকের একটা চোখ নেই, মেদিনীপুর শহরে ক’টা নলকূপের হাতল উলটো লাগানো হয়েছে, রায়গঞ্জ সাবডিভিশনে ক’টা গোরুর অপুষ্টির জন্য শিং ওঠেনি, সব তাঁর মুখস্থ। কোনও কাগজপত্র উলটে দেখবার প্রয়োজন হয় না, মুখে মুখে ফিরিস্তি দিয়ে যান।
তাই সরকার পক্ষের সবাই পতিতপাবনবাবুকে রীতিমতো সমীহ করেন। ভাষণ দেবার সময় আড়চোখে পতিতপাবনবাবুকে লক্ষ করেন। বেফাঁস কিছু বললেই সর্বনাশ। তাঁর হাতে নিস্তার নেই।
কাজেই পতিতপাবনবাবু উঠে দাঁড়াতেই মুখ্যমন্ত্রীও একটু বিচলিত হলেন।
পতিতপাবনবাবু দাঁড়িয়ে একবার মুখ্যমন্ত্রীর দিকে দেখলেন, জরিপ করার ভঙ্গিতে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আপনার সরকার কি অবহিত আছেন, এ বছর সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা মাত্র দু’হাজার তিনশো ছাপ্পান্ন, অথচ গত বছর এই সময়ে বাঘের সংখ্যা ছিল তিন হাজার একশো তেইশ। অবশ্য বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দুশো তেরোটি বাঘ সে দেশে চলে গেছে। বাকি বাঘ মারা গেছে অনেক কারণে। শিকারিরা মেরেছে ত্রিশটা, বিষাক্ত কাঁটায় কেটে গিয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে মারা গেছে তিনশো বাইশ,পানীয় জলের অভাবে মারা গেছে কুড়ি। আত্মহত্যা করেছে গোটা ষোলো। বাঘের জন্য আপনাদের দরদের অন্ত নেই। সিংহের কাছ থেকে পশুরাজ খেতাব কেড়ে নিয়ে আপনারা বাঘকে দিয়েছেন। অবশ্য এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আমাদের অজানা নয়। ইংরাজদের মতো আপনারাও ভেদনীতি চালাচ্ছেন। সিংহ আর বাঘের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করাই আপনাদের আসল মতলব। বাঘ বাঁচাবার জন্য আপনারা কী করছেন জানাবেন কি?
মুখ্যমন্ত্রী চশমা খুলে নিয়ে চাদরে মুছলেন। এ ধরনের প্রশ্নের জন্য সময় দরকার। আগে থেকে নোটিস দিয়ে রাখতে হয়। তবু কিছু একটা বলতে না পারলে ইজ্জত থাকে না।
হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে গেল। এ প্রশ্ন আপনি পশুমন্ত্রীকে করবেন।
ভ্রূ কুঁচকে পতিতপাবনবাবু বললেন, কিন্তু আপনি তো মুখ্যমন্ত্রী। সব মন্ত্রীই আপনার তাঁবে।
তা হলেও, সুষ্ঠু কাজের জন্য বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব বিভিন্ন মন্ত্রীদের ওপর দেওয়া হয়।
সরকারের চিফ হুইপ উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, আমি প্রবলভাবে, উঃ—
চিপ হুইপ বসে পড়লেন। দু’পায়েই বাত। আজ আবার পূর্ণিমা। আগে চিনির কারবার ছিল বহুকষ্টে খদ্দেরের জিপে এসে পৌঁছেছেন। এখন মনে হচ্ছে না-আসাই উচিত ছিল।
পাশের ভদ্রলোকটি ঝুঁকে পড়ে বললেন, দাদা, রশুন খাচ্ছেন না?
বিমর্ষকণ্ঠে চিফ হুইপ উত্তর দিলেন, চেষ্টা খুব করেছি ভাই, কিন্তু পেটে রাখতে পারি না। তোমার কথামতো ভোরবেলা গায়ত্রী জপ করেই একটা রশুন মুখে পুরেছিলাম, বিকালে চাঁপদানীর মাঠে যখন বক্তৃতা দেবার জন্য মুখ খুলেছি, সেই রশুন ছিটকে সামনের এক ভদ্রলোকের মাথায় গিয়ে পড়ল। আমারও বরাত, ভদ্রলোকের মাথায় আব ছিল, তাতেই লাগল। আমার বক্তৃতার জোর জানো তো, রশুনও একটু জোরেই বেরিয়ে গিয়েছিল। অন্যসময় কিছুই হত না, কিন্তু ভদ্রলোক আমার বিপক্ষদলের লোক। সেই আঘাতেই চেঁচামেচি করে মূৰ্ছা গিয়ে বিশ্রী কাণ্ড। তাঁর দলের লোকেরা আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। কোনও রকমে উদ্ধার পেয়েছি। সেই থেকে রশুন আর খাই না।
বেশ তা হলে পশুমন্ত্রীই আমার কথার উত্তর দিন।
পশুমন্ত্রী জর্দা দিয়ে পান চিবোচ্ছিলেন। তিনি পাকা লোক। বহুবার মন্ত্রিত্ব করেছেন। সব দপ্তর ঘুরে এখানে এসে ঠেকেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
পশুমন্ত্রীর ধারে কাছে কেউ বসতে চান না। সর্বদাই তাঁর মুখে পান ভর্তি। বক্তৃতা দেবার সময়ে পানের রস ফোয়ারার মতন ছোটে। ফলে, আশপাশের সবাই যখন বেরিয়ে আসেন, মনে হয় হোলি খেলে ফিরলেন।
মাননীয় সদস্য খুব বুদ্ধিমানের মতনই প্রশ্ন করেছেন, তবে তিনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন এ ধরনের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য দপ্তর আছে, তাঁরা অনুসন্ধান করে এক সপ্তাহের মধ্যে সব কিছু জানিয়ে দেবেন। মাননীয় সদস্য অনুগ্রহ করে যেন প্রশ্নের একটি কপি অধ্যক্ষের কাছে পৌঁছে দেন।
বিধানসভা সেদিনের মতন শেষ।
পশুমন্ত্রী বিভাগীয় সচিবকে ফোন করলেন: মিস্টার সেনগুপ্ত, আপনি বাঘের এই হিসাবটা পাঁচ দিনের মধ্যে আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। অত্যন্ত জরুরি।
ঠিক আছে স্যর। প্রশ্নটা লিখে নিই। মিস্টার সেনগুপ্ত প্রশ্নটা লিখেই বেল টিপলেন। বেয়ারা আসতে বললেন, লাহিড়ি সাব।
সহকারী সচিব লাহিড়ি ওঠবার ব্যবস্থা করছিলেন। তিন দিন পরে জামাইষষ্ঠী। তাঁর সব সুদ্ধ সাত মেয়ে। সাত জামাই ভারতবর্ষের নানা দেশে ছড়ানো। আজ বিকাল থেকে সব আসতে আরম্ভ করবে। ছেলে নেই, কাজেই সব কিছুর ভার তাঁর ওপর। বিরক্ত মুখে বললেন, জ্বালালে। এই অসময়ে আবার ডাক কেন? তারপর উঠে সচিবের ঘরে ঢুকলেন।
বাঘের প্রশ্ন পেয়ে তাঁর চোখ কপালে উঠল। বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো? বাঘের এত হিসাব নিকাশ কেন? এরপর কি তাদেরও ভোট দেবার অধিকার হবে? সে-রকম কোনও আইন আসছে?
জানি না মশাই। জানেন তো, আমরা একেবারে সৈনিকদের মতন। হুকুম তামিল করাই আমাদের কাজ। দেখুন, কী করতে পারেন। আর সময়ও নেই।
লাহিড়ি প্রশ্ন নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
এরপর লাহিড়ির কামরায় সুপারিন্টেন্ডেন্ট রামতনু ধাড়ার ডাক পড়ল। রামতনুবাবু নৈহাটি থেকে যাওয়া আসা করেন। একটু দেরিতে অফিসে আসেন, কিন্তু থাকেন রাত সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। ভিড়ের জন্য তার আগে আর ট্রেনে উঠতে পারেন না। বসে বসে একলা একলা বাঘবন্দি খেলেন।
লাহিড়ির কথা শুনে চমকে উঠলেন, আবার বাঘ?
আবার বাঘ মানে? এর আগে আবার কবে তোমায় বাঘ দেখালাম?
রামতনুবাবু সামলে নিলেন: না স্যর, বলছি, চার দিনের মধ্যে এত বড় হিসাব কি করা যাবে? এ তো আর আন্দাজে দেওয়া যায় না।
আন্দাজে দেওয়া যায় না?
সেটা কি ঠিক হবে? আপনার মনে আছে, বছর দুয়েক আগে এই ধরনের একটা প্রশ্ন এসেছিল। পতিতপাবন রুদ্রেরই প্রশ্ন। পার্ক স্ট্রিটের মোড় থেকে টালিগঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত জলের পাইপ আর টেলিফোনের লাইনের জন্য ক’জায়গায় গর্ত খোঁড়া হয়েছে। আপনি বললেন, সময় নেই, আন্দাজে একটা লিখে দাও। দিলাম লিখে, দু’শো পঁয়ত্রিশ। তাই নিয়ে বিধানসভায় হুলুস্থূল কাণ্ড। রাতারাতি লোক নিয়ে আমি নিজে বের হয়েছিলাম। গুনে দেখলাম দু’শো বত্রিশটা গর্ত। বাকি তিনটে গর্ত লোক দিয়ে খুঁড়ে তবে শান্তি।
লাহিড়ি বিরক্তকণ্ঠে বললেন, যা হোক একটা কিছু করো রামতনু। আমি আর ভাবতে পারছি না। আমার বাড়িতেই সাতটা বাঘের আমদানি হচ্ছে।
বাড়িতে বাঘ? রামতনুবাবু বিস্মিত হলেন।
আরে জামাইষষ্ঠী না? সাত জামাই আসছে।
পরের দিন অফিসে এসেই রামতনুবাবু সেকশন-ইন-চার্জ অবিনাশ রায়কে তলব করলেন। খুব করিতকর্মা লোক অবিনাশ। নিজে কাজ করে না, কিন্তু পরের কাছ থেকে ঠিক কাজ আদায় করে নেয়। রামতনুবাবুর বিশেষ প্রিয়পাত্র।
শোনো অবিনাশ, বোসো। বাঘের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও।
অবিনাশ অবাক হল। বলেন কী, নৈহাটিতে বাঘ? হবে না, মিউনিসিপ্যালিটিগুলো অকর্মণ্য হয়ে উঠেছে। কিছু পরিষ্কার করবে না। চারদিকে আগাছা আর জঙ্গল বাড়ছে। জঙ্গল থাকলেই বাঘ থাকবে, এ তো জানা কথা। একটা কাজ করুন না, রেশনের আটা সিন্নির মতন মেখে বাড়ির দরজায় রেখে দিন না।
রেশনের আটা?
হ্যাঁ, যা আটা দিচ্ছে, বাঘের বাপও হজম করতে পারবে না। লিভারের দফা শেষ হয়ে যাবে।
আরে না, না, নৈহাটিতে বাঘ নয়, বিধানসভায় বাঘ।
বিধানসভায়? সে কী? চিড়িয়াখানা থেকে এতদূর এসেছে নিজেদের অবস্থা জানাতে?
দুর, সে-সব কিছু নয়। কথাটা ভালকরে শোনোই না।
রামতনুবাবু প্রশ্নটা অবিনাশের দিকে এগিয়ে দিলেন, এর একটা ব্যবস্থা করো।
অবিনাশ কাগজটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ঠিক আছে। সরেজমিনে তদারক করার জন্য কারও যাওয়া দরকার।
যা ভাল বোঝো করো। মোট কথা তিন দিনের মধ্যে আমার উত্তর চাই।
অবিনাশ সেকশনে ফিরে এল।
সেকশনের সব চেয়ে নিরীহ কেরানি অখিল সমাজদার। কোনওদিকে দেখে না। ঘাড় হেঁট করে নিজের কাজ করে যায়। তবে এক দিনের কাজ তিন দিনে করে। বুদ্ধি তেমন শাণিত নয়।
অবিনাশ তাকে ডেকে পাঠাল: তোমার শ্বশুরবাড়ি তো সন্দেশখালি, তাই না?
অখিল মাথা নিচু করে টেবিলে আঁচড় কাটতে লাগল।
সামনে জামাইষষ্ঠী। দু’দিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি ঘুরে এসো।
অখিল আশ্চর্য হল। এর আগে দরখাস্ত করেছিল, কিন্তু অবিনাশ ধমকে উঠেছে, সবাই শ্বশুরবাড়ি গেলে, আমি সেকশন চালাব কী করে?
তুমি আজ বিকালেই চলে যাও। বরং একটু সকাল সকাল অফিস থেকে উঠে পড়ো। সন্দেশখালি যাওয়াও তো খুব ঝামেলা। ট্রেন, লঞ্চ, তারপর কিছুটা হাঁটতেও হবে।
এবারও অখিল ঘাড় নাড়ল।
আর নাও, এই হিসাবটা করে আনবে।
অবিনাশ প্রশ্নটা অখিলের দিকে এগিয়ে দিল।
এতক্ষণ পরে অখিল বলল, হিসাব?
হ্যাঁ, বাঘের একটা ছোট হিসাব আছে। তোমাদের সঙ্গে বাঘের তো খুব দহরম-মহরম। প্রায় মোলাকাত হয়। অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না।
ওপরে পাখা ঘুরছে, তবুও অখিলের সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল। এই বাঘের ভয়ে অখিল শ্বশুরবাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে।
বছর খানেক আগে এক কাণ্ড হয়েছিল। বিকালে অখিল বেড়াতে বেরিয়েছিল। কিছু দূর গিয়ে পথ হারিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে যখন পথের সন্ধান পেয়েছিল, তখন সন্ধ্যা নেমেছে।
চারদিকে চাপ চাপ কুয়াশা। বাড়ির কাছে এক অর্জুনগাছের তলায় অখিলের খুড়শ্বশুর। বাসন্তী রঙের র্যাপার গায়ে জড়িয়ে।
আশ্চর্য কাণ্ড। ভদ্রলোক হাঁপানির রোগী। আর এভাবে ঠান্ডায় বসে আছেন!
কাছে গিয়ে অখিল জিজ্ঞাসা করেছিল, খুড়োমশাই, এই কুয়াশায় আপনি বাইরে কেন? আমার জন্য নাকি?
খুড়শ্বশুর উত্তর দিয়েছিলেন, হুঁম।
হাঁপানির জন্য ভাল করে কথাও বলতে পারছেন না।
অখিল আরও এগিয়ে গিয়ে বলেছিল, এই তো আমি এসে গেছি, এবার বাড়ি চলুন।
অখিলের বোধ হয় ইচ্ছা ছিল, খুড়োমশায়ের হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে আসবে, কিন্তু পারেনি। ওরে বাবা রে, খেলে রে, বলে বিদ্যুদবেগে ছুটতে আরম্ভ করেছিল।
পায়ের একটা পাম্পশু পরের দিন পাওয়া গিয়েছিল, আর কাঁটা গাছে লেগে দামি শাল ছিন্নবিচ্ছিন্ন।
অফিসে এসে অখিল গল্পটা করেছিল। সেই থেকে অবিনাশ অখিলকে ডাকে, বাঘেরও অখাদ্য।
অখিল যাবার মুখে অবিনাশ আবার ডাকল, শোনো, বাঘের হিসাবটা শুধু তুমি নিয়ে আসবে। তাদের বাঁচাবার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে তোমার কোনও খোঁজ করবার দরকার নেই। সে সম্বন্ধে মন্ত্রীমশাই যা ভাল বুঝবেন, করবেন। বুঝেছ?
কী বুঝল অখিলই জানে, কিন্তু সে ঘাড় নাড়ল।
অখিল যখন সন্দেশখালি পৌঁছল, তখন রাত আটটা।
তার শ্বশুর বেশ বড়লোক। মাছের ভেড়ি আছে, ধান জমি, মধুর ব্যবসা। গোটা ছয়েক নৌকা। নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের গভীরে চলে যান। মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। চুপি চুপি অর্জুন আর কেওড়া কাঠ কেটে নৌকা বোঝাই করেন।
অখিল শ্বশুরকে ধরল। আমি কিন্তু সরকারি কাজে এসেছি।
শ্বশুরমশাই বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছিলেন। পুরুতমশাই দক্ষিণরায়ের পাঁচালি শোনাচ্ছিলেন। পুরুতমশাইকে থামিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সরকারি কাজ মানে?
পাঞ্জাবির পকেট থেকে কাগজটা বের করে অখিল বলল, এই বাঘের হিসাবটা নিয়ে যেতে হবে। মন্ত্রীমশাই চেয়েছেন।
তাক থেকে চশমা পেড়ে নিয়ে চোখে দিয়ে শ্বশুরমশাই কাগজটা পড়লেন, তারপর বললেন, কঠিন হিসাব। তুমি কাগজটা রমজান আলিকে দিয়ে দাও। কাল ভোরে ওর দল সুন্দরবনের মধ্যে যাচ্ছে, একটা হিসাব নিয়ে আসবে। তবে সুন্দরবন তো আর একটুখানি এলাকা নয়, বিরাট জায়গা। বাঘ সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। গড়পড়তা একটা হিসাব নিয়ে আসতে পারবে।
অখিল মাথা নাড়ল: না, আমাকেও রমজান আলির সঙ্গে যেতে হবে। অন্য কারও ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করলে চলবে না। সেকশন-ইন-চার্জের হুকুম, নিজে সব কিছু দেখে আসতে হবে।
শ্বশুরমশাই অবাক। সে কী? বাঘেদের মধ্যে জামাইষষ্ঠীর রেওয়াজ আছে বলে জানা নেই। তোমাকে জামাই বলে খাতির করবে তাও মনে হয় না। তার ওপর সুন্দরবনে তুলো আর সূর্যমুখীর চাষের জন্য অনেকটা জঙ্গল সাফ করাতে বাঘগুলো তেতে আছে। মানুষ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অখিল নাছোড়বান্দা। কাজ ধীরে সুস্থে করে বটে, কিন্তু কাজে ফাঁকি দেয় না।
শ্বশুরমশাই অগত্যা সব ব্যবস্থা করে দিলেন।
নৌকার মাঝখানে অখিল। দু’পাশে দু’জন বন্দুক হাতে। চারপাশ ঘিরে অন্য লোক। তাদের হাতে লাঠি, শড়কি, বল্লম।
নৌকায় অন্য লোকেরা বলল, আপনার মন্ত্রীমশাইকে জিজ্ঞাসা করবেন, মানুষকে ছেড়ে বাঘের এত খোঁজ কেন? আমাদের সুখদুঃখের খোঁজও একটু দেবেন কত্তা। খাদ্য পাই না, পরনের কাপড় নেই—
হাত নেড়ে অখিল তাদের থামিয়ে দিল: আরে এসব খোঁজ মন্ত্রীরা নেবেন কেন? বিরোধী দলের সদস্যরা জানতে চান। আমরা আর কী করব!
নৌকা যখন ঘাটে বাঁধা হল, তখন দুপুর।
দু’জন মাঝিমাল্লা ছাড়া সবাই নেমে গেল।
রমজান আলি বলল, রসুন জামাইবাবু, আমরা মধু নিয়ে বিকালের আগেই ফিরব। মধু আনব, সেই সঙ্গে বাঘের হিসাব।
সবাই জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বেশ কড়া রোদ। অখিল ছইয়ের তলায় আশ্রয় নিল।
পাটাতনের ওপর মাঝিরা রান্না শুরু করল। তারপর রোদের তেজ কমতে, অখিল বাইরে এসে বসল। হরিণ, শেয়াল, নানা রঙের পাখি জল খেয়ে যাচ্ছে। নৌকা থেকে একটু দূরে। একটু আগে মাঝি আর মাল্লারাও নেমে গেছে। যাবার সময় বলে গেছে, শুকনো গাছের ডাল ভেঙে এখনই আসছি জামাইবাবু।
নৌকায় অখিল একেবারে একলা। হঠাৎ দেখল হরিণ আর অন্য জন্তুরা তিরবেগে বনের মধ্যে পালিয়ে গেল।
কী হল? এমন ভয় পেল কেন?
এদিকে মুখ ঘুরিয়েই অখিল কাঠ হয়ে গেল। ওপাশের চড়া থেকে লাফিয়ে জলে পড়ে একটা বাঘ সাঁতরে এপারে আসছে। শুধু তার মুখটা দেখা যাচ্ছে। বিরাট হাঁড়ির মতন মুখ। জ্বল জ্বল করে দুটো চোখ জ্বলছে। নৌকা লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে। হয়তো সাঁতরে এপারে আসাই তার উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু নৌকার ওপর এমন তৈরি ‘ডিনার’ দেখে গতি পরিবর্তন করেছে।
নৌকা ভীষণ বেগে দুলতে লাগল। নৌকার অবশ্য দোষ নেই। অখিলের অবস্থা ম্যালেরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতন। ঠক ঠক করে তার দেহ কাঁপছে। কাজেই নৌকাও কাঁপছে।
সর্বনাশ, কী হবে! বেশ কাছে এসে পড়েছে!
আর কালবিলম্ব না করে অখিল ডাঙার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এক হাঁটু কাদা। বহুকষ্টে কাদা ভেঙে জমির ওপর উঠল।
অখিল দ্রুতপায়ে সামনের গাছের গোড়ায় এসে দাঁড়াল। ঝাঁকড়া আসশ্যাওড়া গাছ। অখিল জীবনে কোনও দিন গাছে ওঠেনি। গাছে ওঠার চেষ্টাও করেনি, কিন্তু তার যখন জ্ঞান হল, দেখল সে গাছের প্রায় মগডালে বসে আছে।
এদিকে ফিরে দেখল, বাঘ নৌকার ওপর। ঠিক যেখানে অখিল বসেছিল। সূর্যের আলো এসে বাঘের মুখে পড়েছে। সে আলোয় দেখা গেল, বাঘের মুখ খুব বিষণ্ণ। মনে যেন দারুণ অশান্তি। অখিলের দিকে কোনও নজর নেই।
নিরুপায় অখিল চুপচাপ বসে রইল।
মাঝিমাল্লাদেরও দেখা নেই। অবশ্য নৌকার আরোহী বদল হয়েছে দেখলে তারাও আর ধারে কাছে আসবে না।
কিন্তু অন্য লোকগুলোই বা ফিরছে না কেন? বাঘের হিসাব নিতে গিয়ে তারাও কি সব হিসাবের বাইরে চলে গেল!
বাঘটা উঠে দাঁড়াল। করুণদৃষ্টিতে একবার জঙ্গলের দিকে দেখল তারপর জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর উঠল না।
কম্পিত বুকে অখিল অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। না, বাঘ উঠল না।
বোঝা গেল আত্মহত্যা করেছে। অন্য লোকে বললে অখিল হয়তো বিশ্বাস করত না, কিন্তু নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবে কী করে!
বেশ অন্ধকার চারদিকে। ঝোপে ঝোপে জোনাকি জ্বলছে। সবগুলো হয়তো জোনাকি নয়, কিছু কিছু বন্য জন্তুর চোখও রয়েছে।
মাটির ওপর দ্রুত ধাবমান কতকগুলো ছায়া।
এই সময় গাছ থেকে নামা নিরাপদ নয়। একা নৌকায় থাকাও রীতিমতো বিপজ্জনক। তা ছাড়া, অখিল কীভাবে উঠেছে নিজেই জানে না, নামতে পারবে এমন ভরসা কম।
সে ডাল আঁকড়ে বসে রইল।
কিন্তু বেশিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব হল না। দলে দলে মশা এসে আক্রমণ শুরু করল। মশা নয়, ডাঁশ। যেখানে বসে, প্রায় সিকি লিটার রক্ত তুলে নেয়।
মারবার উপায় নেই। শব্দ হলেই নীচের বন্য জন্তুরা আকৃষ্ট হবে। গাছে চড়তে পারে সুন্দরবনে এমন জন্তু কমতি নেই। উঠে পড়লেই হল।
সুতরাং অখিল নিঃশব্দে, বিনা প্রতিবাদে নির্যাতন সহ্য করে গেল। মনে মনে ভাবল ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিচ্ছে।
এক সময়ে ভোর হল। গাছে গাছে পাখির ডাক।
একটু পরেই ঝোপের পাশ থেকে মাঝিমাল্লারা বেরিয়ে গাছতলায় এসে দাঁড়াল।
একজন বলল, ও জামাইবাবু, আপনি! আমরা ভেবেছি চিতাবাঘ গাছের ওপর ওত পেতে বসে আছে। তলা দিয়ে গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাই আমরা সারা রাত আর এক গাছে বসে কাটালাম।
অখিল চটে লাল। জলজ্যান্ত মানুষ আমাকে চিতাবাঘ ভাবলে কী করে?
অন্ধকারে শুধু কাঠামোটা দেখা যাচ্ছে। তার ওপর ওই ল্যাজ।
ল্যাজ? আমার ল্যাজ? মানে?
ওই দেখুন না।
অখিল চোখ ঘুরিয়ে দেখল।
তার কাছাটা খুলে ল্যাজের মতন দুলছে। গাছে ওঠবার সময় কখন খুলে গেছে।
এবার নেমে আসুন জামাইবাবু।
একটু নেমেই অখিল থেমে গেল। কিছুতেই নামতে পারছে না। পা দুটো ঠক ঠক করে কাঁপছে।
মাঝিদের মধ্যে যে ছোকরা সে চটপট করে গাছে উঠে জাপটে ধরে অখিলকে নামাল।
ভাল করে তাকে দেখেই সবাই অবাক। একজন বলল, একী গো জামাইবাবু, মনে হচ্ছে কোথা থেকে হাওয়া বদল করে এসেছ। এক রাতে শরীর এত ভাল হল কী করে?
অখিল বুঝতে পারল এ-সব ডাঁশের কারসাজি। শরীর ফুলিয়ে ডবল করে দিয়েছে।
সবাই নৌকায় গিয়ে উঠল।
মাঝিদের একজন আয়না নিয়ে অখিলের সামনে ধরল।
দুটো চোখ দেখার উপায় নেই। গাল ফুলে চোখ ঢেকে দিয়েছে। গায়ের রংও একটু লালচে। পাঞ্জাবিটা রীতিমতো টাইট।
অখিল জিজ্ঞাসা করল, আর সকলে আসছে না কেন? কাল বিকালে আসবার কথা!
কেউ বিশেষ উদ্বিগ্ন হল না। বলল, দক্ষিণরায়ের হিসাব নিয়ে ফিরবে তো। একটু দেরি হবেই। আজ এসে পড়বে।
অখিল এদিক ওদিক দেখে আবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা, বাঘ আত্মহত্যা করে?
অখিলের কথা কানে যেতেই সবাই চোখ বন্ধ করে কানে আঙুল দিল। এক সঙ্গে বলল, জয় বাবা দক্ষিণরায় অপরাধ নেবেন না। জামাইবাবু এ এলাকায় ওসব নাম করবেন না। দক্ষিণরায় বলবেন। হ্যাঁ, ওঁরা আত্মহত্যা করেন বইকী। একবার মনে আছে কাঠ কাটতে জঙ্গলে গেছি, হঠাৎ দক্ষিণরায় একটা হরিণ লক্ষ্য করে লাফ দিল, কিন্তু ধরতে পারল না। হরিণ পালাল। দক্ষিণরায়ের বাপ খেপে লাল। গরর গরর করে সে কী তর্জন। আমি গাছের ওপর বসে কাঁপছি আর সব দেখছি। ব্যস, ছেলের অভিমান। বাপ সরে যেতেই মাথা নিচু করে জলের ধারে এসে দাঁড়াল, তারপরই ঝপাং। এ জন্তুর তুলনা হয় না জামাইবাবু। বড় অভিমানী।
অখিল ভাবতে লাগল, তা হলে ওই বাঘটারও এ রকম কিছু একটা হয়ে থাকবে। অভিমানে আত্মহত্যা।
দুপুরবেলা সবাই নৌকার ওপর বসে, হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে হই হই শব্দ।
সন্দেহ নেই, বাঘ বেরিয়েছে। লোকেরা তাড়িয়ে এদিকে নিয়ে আসছে।
অখিল আর তিলমাত্র বিলম্ব না করে ছইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ডাঁশের কল্যাণে তার চেহারাটাও বেশ পুষ্ট হয়েছে। বাঘের নজর একবার তার ওপর পড়লে আর অন্য কাউকে পছন্দ হবে না।
অখিল দুর্গানাম জপ করতে লাগল।
পাটাতনের ওপর থেকে কে একজন বলল, জামাইবাবু, বেরিয়ে আসুন, ওরা সবাই ফিরছে।
আস্তে আস্তে অখিল বেরিয়ে এল।
রমজান আলির দল আসছে। মাচায় কাকে ঝুলিয়ে।
বাঘ মেরে আনছে নাকি! তাই এত দেরি।
কাছে আসতে দেখা গেল, একটা কাঠের পিড়েতে একজন অতিবৃদ্ধ বসে। চৌদোলার মতন তাকে ঝুলিয়ে আনছে।
অখিল জিজ্ঞাসা করল, লোকটি কে?
দক্ষিণরায়ের মন্দিরের পুরুতমশাই ত্রিলোচন ঠাকুর। দক্ষিণরায়ের দল ওঁর কথায় ওঠে বসে। এ এলাকা ওঁরই রাজত্ব। রমজান আলি ওঁকে নিয়ে এসেছে হিসাব দেবার জন্য। সব কিছু ওঁর নখদর্পণে।
ত্রিলোচন ঠাকুর নৌকায় উঠতেই প্রণামের হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।
রমজান আলি বলল, নিন জামাইবাবু, হিসাব নিন।
ত্রিলোচন ঠাকুর হাসলেন। তোমার হিসাব তো বাবা ঠিক নয়। তিন বছরের পুরনো হিসাব। ঠিক হিসাব লিখে নাও। মোট বাঘের সংখ্যা তিন হাজার একশো দশ। গত বছরে বরং কমই ছিল। এবার বাঘ বাড়ার আসল কারণ অনেকগুলো ডবল যমজ বাচ্ছা হয়েছে। তা ছাড়া নিজেদের মধ্যে মারামারি অনেক কমে গেছে। এ অঞ্চলেও সভা হচ্ছে। গরম গরম বক্তৃতা। দেশে ভাই ভাইয়ে খুনোখুনির কথা সব বক্তাই বলে। সবই বাঘেদের কানে আসে। তারা বুঝতে পেরেছে, নিজেদের ভিতর মারপিট নিছক ‘মানবিক’ ব্যাপার, পশুর জগতে চলে না। চলা উচিত নয়। তাই নিজেদের মধ্যে আর কামড়াকামড়ি করে না। যে দু’শো তেরোটি বাঘ বাংলাদেশে ফিরে গেছে, তারা সে দেশেরই বাঘ। গোলমালের সময় এদেশে চলে এসেছিল, গোলমাল থামতে নিজের দেশে চলে গেছে। গ্যাংগ্রিনে কেউ মারা যায়নি। বাঘের গ্যাংগ্রিন ঠিক হয় না। লিভারের অসুখে কিছু মারা গেছে, কিছু গেছে যক্ষ্মায়। কলকারখানার দূষিত ধোঁয়ায়।
কৌতূহলী অখিল জিজ্ঞাসা করে ফেলল, এরা কি আত্মহত্যা করে নিজেদের পারিবারিক কারণে?
ত্রিলোচন ঠাকুর উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। আত্মহত্যা করে বই কী। আলবত করে। কিন্তু নিজেদের ব্যাপারে নয়। আমাদের জন্য।
অখিল চমকে উঠল: আমাদের জন্য? তার মানে?
মানে অতি সরল। বিদেশি শাসক এ দেশ থেকে সরে গেল, তবু আমাদের শ্বেতপ্রীতি কমল না। সাদা রং দেখলে এখনও আমরা ভক্তিতে ডগমগ হয়ে যাই। তাই চিড়িয়াখানায় পর্যন্ত সাদা বাঘকে আলাদা সম্মান দেখানো হয়। বেশি মূল্যের দর্শনী। রাজকীয় থাকার ব্যবস্থা। এসব কি ভেবেছ বাঘেদের কানে যায় না? ছি, ছি, লজ্জায় তারা প্রাণ রাখবে কী করে!
অখিল চুপ করে রইল। এর চেয়ে নিখুঁত হিসাব সে কল্পনাও করেনি। এবার অফিসে তার উন্নতি অবধারিত।
কাগজে সব হিসাব লিখে নিয়ে কাগজটা অখিল পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিল।
ত্রিলোচন ঠাকুর যাবার সময় বললেন, দাও পাঁচটা টাকা। মন্দিরে পূজা দিতে হবে।
বিনা বাক্যব্যয়ে অখিল পাঁচ টাকা দিয়ে দিল।
ত্রিলোচন ঠাকুর চৌদোলায় চড়ে চলে গেলেন। তাঁর সাগরেদরা নিয়ে গেল।
নৌকা সন্দেশখালির দিকে ফিরল।
অখিলেব মন খুশিতে ভরপুর। এত কঠিন একটা কাজ এত সহজে সমাধা হবে ভাবতেও পারেনি। গুন গুন করে অখিল গান গাইতে শুরু করল।
ফুরফুর বাতাস বইছে। এখনও পুরো অন্ধকার নামেনি। লোকেরা পাটাতনের ওপর বসে গল্পগুজব করছে।
হঠাৎ অখিলের মনে হল কে যেন তার পাঞ্জাবি ধরে টানছে। প্রথমে মনে করল বোধ হয় নৌকার পেরেকে আটকে গেছে। কিন্তু না, টানটা বেশ জোর।
মুখ ফিরিয়ে দেখেই অখিল চিৎকার করে উঠল, বাঘ! বাঘ!
সবাই ছুটে এল। এখানে মাঝগাঙে আবার বাঘ কোথায়। তা ছাড়া জামাইবাবু দক্ষিণরায় না বলে বাঘ বলছেন কেন? বিপদ একটা নির্ঘাৎ বাধাবেন। এখনও ওঁদের এলাকা পার হইনি। কই কোথায় দক্ষিণরায়?
জলের মধ্যে।
সে কী? সবাই অবাক।
অখিল মোটেই ভুল দেখেনি। বিরাট মুখ। আগের দিন যেমন দেখেছিল। জ্বলজ্বলে দুটো চোখ।
আশ্চর্য, বাঘটা কি এতক্ষণ ডুবসাঁতার দিয়ে ছিল? কিংবা ডুব দিয়ে পাড়ে উঠে ঝোপের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে বসেছিল। তারপর নৌকার সঙ্গে সাঁতরাতে শুরু করেছে।
বাঘটা আবার ডুব দিয়েছে। তাকে কোথাও দেখা গেল না।
রমজান আলি হেসে বলল, জামাইবাবু খোয়াব দেখেছেন।
নিজের পাঞ্জাবির পকেটের দিকে চোখ পড়তেই অখিল হাঁউমাঁউ করে চেঁচিয়ে উঠল। সর্বনাশ, আমার পকেট!
পকেট নেই। বাঘ দাঁত দিয়ে চিবিয়ে কেটে নিয়েছে। সেই সঙ্গে হিসাবও উধাও।
অখিল মাথা চাপড়াতে শুরু করল। এত মেহনত সব মাটি।
নৌকা সন্দেশখালি পৌঁছাল। অখিল শ্বশুরের কাছে সব বলল।
শ্বশুর বললেন, ওই হিসাবটা নেবার জন্য তোমার সঙ্গ নিয়েছিল বোঝা গেল। যাক, হিসাবের ওপর দিয়ে গেছে। হিসাব একটা তৈরি করা যাবে। জামাই গেলে, জামাই তৈরি করা সম্ভব হত না।
অখিল আন্দাজে একটা হিসাব তৈরি করে নিল।
কলকাতায় আসবার জন্য যখন সে নৌকায় উঠছে, তখন খবরটা কানে এল। শ্বশুরই বললেন। ত্রিলোচন ঠাকুরকে দক্ষিণরায়ের দল পথেই শেষ করে দিয়েছে। গোপন হিসাব ফাঁস করে দেবার জন্য।
১৩৮০
অলংকরণ: শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন