ননীদা – মতি নন্দী

পৌলোমী সেনগুপ্ত

ক্রিকেট সিজনের শুরুতেই ক্রিকেট ক্লাব অব হাটখোলার অর্থাৎ সি সি এইচ-এর নেট পড়ে মহামেডান মাঠের ধারে, মেম্বার গ্যালারিগুলোর পিছনে। শরিকি মাঠ, ফলে ভাগের মা-র গঙ্গা না পাওয়ার মতো অবস্থা। কোনও শরিকই মাঠের যত্ন করে না। পুজোর পর মাঠের মাঝখানটায় জল ঢেলে রোলার টেনে মালিরা একখণ্ড জমিকে ক্রিকেট পিচ বলে চালাবার চেষ্টা করে বটে কিন্তু ননীদা মানতে রাজি হন না। প্রতি বছরের মতো ননীদা এবারও চিৎকার করে বলেন, “য়্যাঁ, শার্টের ইস্ত্রি করা কলারের মতো পিচ না হলে ব্যাটসম্যান স্ট্রোক দেখাবে কী করে? ক্রিকেট কি ডাংগুলি খেলা! ভদ্রলোকের খেলা ভদ্দর পিচ না হলে হয় কখনও? ধান ছড়িয়ে দে রে, দুর্যোধন! ধান ছড়িয়ে দে, যা একখানা পিচ বানিয়েছিস!”

“জল ঢালি রোলার দিয়েছি সকাল-সন্ধ্যা। তংকা বাড়াও বাবু ইডেন মতো, মো পিচ বনাই দিব।”

“হ্যাঁ,তারপর এই মাঠেই টেস্ট খেলা হবে।”

প্রতি বছর ননীদা ঝগড়া করবেন মালির সঙ্গে, প্লেয়ারদের সঙ্গেও। দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব। প্রতি বছরই দু’-চারটে নতুন ছেলে আসে। নেটে ট্রায়াল নেওয়া হয়। সিনিয়ার প্লেয়ার হিসাবে আমি এবং আরও দু’-একজন থাকি। আর ননীদা তো থাকবেনই।

আমাদের ক্লাবের তিনটি মাত্র ব্যাট। ম্যাচের দিন সেগুলির মুখ দেখা যায়। চার জোড়া প্যাড। ব্যাটিং গ্লাভস বলতে যা আছে, সেগুলো ঘামে আর ময়লায় এমন দুর্গন্ধ ছড়ায় যে উইকেটকিপাররা পর্যন্ত পিছিয়ে বসে। দুর্যোধন মালি প্র্যাকটিসের জন্য যে নেটটা বাঁশ দিয়ে খাটায় তাতে গোটাতিনেক ফুটো, যার মধ্য দিয়ে আধমনি কচ্ছপরাও অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারে। প্র্যাকটিসের জন্য একটা ব্যাট ঠিক করা আছে। ওজন ছ’-সাত পাউন্ড, হ্যান্ডেলটা মচমচ শব্দ করে, ব্লেডের আধখানা কালো সুতোর ব্যান্ডেজে দেখা যায় না, বাকিটুকুর রং তেল খেয়ে খেয়ে ঘোর বাদামি। গোটাচারেক বল প্র্যাকটিসে দেওয়া হয়। গত বছরে বা তার আগের বছরের ম্যাচে এগুলো ব্যবহৃত। এখন টিপলে ডেবে যায়, আকারে বেড়ে গেছে, সেলাইয়ের সুতোগুলো মসৃণ।

ননীদা নেটের ইন-চার্জ। নেটের পাশে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘড়ি ধরে এক একজনকে দশ মিনিট ব্যাট করতে দেন। ব্যাটসম্যান বা বোলারের নানাবিধ ত্রুটির সংশোধন করাতে অনবরত কথা বলেন। ননীদা দু’ বছর আগেও আমাদের টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। এখন উনি যে কী, সেটা বলা শক্ত। প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, ট্রেজারার, সিলেক্টর, স্কোরার, মালি, সাবস্টিটিউট ফিল্ডার প্রভৃতিকে একত্রে একটা লোকের মধ্যে ভরে দিলে যা হয়, ননীদা তাই। ওর মুখের উপর কথা বলতে পারে এমন কেউ ক্লাবে নেই। দুর্যোধনের নেড়িকুত্তাটা পর্যন্ত ওর গলার আওয়াজে লেজটাকে গুটিয়ে নেয়। ননীদাকে এল বি ডবল্যু আউট দিয়ে একবার একজন আম্পায়ার খেলা শেষে তাঁবুতে চা-খাওয়ার জন্য আর না ফিরে, হনহনিয়ে সাইট স্ক্রিনের পাশ দিয়ে হাইকোর্ট মাঠ পেরিয়ে মহামেডান তাঁবুর পাশ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছল।

বারো বছর আগে আমি আর চিতু অর্থাৎ চিত্তপ্রিয় প্রথম যখন ননীদার সামনে পরীক্ষা দেবার জন্য হাজির হই তখন উনি আমাদেরই বয়সি একটি প্যাংলা ফ্যাকাসে দামি শার্ট-প্যান্ট-বুট এবং চশমা-পরা ছেলেকে নেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বোঝাচ্ছিলেন কীভাবে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলতে হয়।

“ল্যুক। এই হচ্ছে স্টান্স। লেফট শ্যোলডার এইভাবে…ভাল কথা তুমি কি লেফট হ্যান্ডার?… গুড গুড, আমি একটা লেফট হ্যান্ডারই চাইছি। তিনজন আছে আরও একজন চাই। হ্যাঁ, তা হলে হবে রাইট শ্যোলডার। বোলার ডেলিভারি স্ট্রাইডে দ্যাখো, ভাল করে দ্যাখো, তখন ব্যাটের ব্যাক লিফট এই…তারপর কী করবে?”

“ফরোয়ার্ড খেলব।” ছেলেটি খুব উৎসাহভরে চটপট জবাব দিল। ননীদা প্রায় ৩৫ সেকেন্ড ওর মুখের দিকে ঠায় তাকিয়ে রইলেন ছবির প্রদর্শনীতে দুঁদে সমালোচকের মতো। তারপর বললেন, “গবেট কোথাকার। আমি কি বলেছি বলের ডেলিভারি হয়েছে? বল এখনও তো বোলারের হাতে। উইকেটের পেস কী, বাউন্স কী তাই জানো না, আগে থেকেই বলে দিলে ফরোয়ার্ড খেলব?”

“আপনি ফরোয়ার্ড খেলাই শেখাচ্ছেন তো, তাই ফরোয়ার্ড খেলব বললুম।” ছেলেটি ঢোঁক গিলে বলল। ননীদা এবার ১৫ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, “বলটা শর্ট পিচ কি ওভার পিচ, স্টাম্পের মধ্যে না বাইরে, কতটা সুইং বা কতটা স্পিন এ-সব না দেখেই ফরোয়ার্ড খেলবে?”

ননীদার কথায় এবং ছেলেটির ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে চিতু মুচকি হেসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের তর্জনীটি বাঁকিয়ে ঘুড়িতে টুঙ্কি দেবার মতো তিনবার নেড়ে ননীদা ডাকলেন, “কাম হিয়ার।” চিতু খুব স্মার্ট ছেলে। আজ পর্যন্ত ট্রামে-বাসে টিকিট কাটেনি। সিনেমা এবং ফুটবল মাঠে লাইনে না দাঁড়িয়েই টিকিট পায়।

চিতু কাছে আসতেই ননীদা কিছু বলার জন্য সবে ঠোঁট ফাঁক করেছেন, চিতু অমনি বলল, “আই অ্যাম এ লেফট হ্যান্ডার।”

ননীদার খোলা ঠোঁট দুটি একটা ফাস্ট ইয়র্কারকে সামাল দেবার মতো ঝটতি বন্ধ হয়ে গেল।

“অ্যান্ড অ্যান ওপেনিং ব্যাট লাইক নরি কন্ট্রাক্টর।” চিতু বুক চিতিয়ে বলল। কন্ট্রাক্টর তখন দারুণ খেলে। সবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টেস্ট সেঞ্চুরি করেছে। ননীদার ঠোঁট দুটি এবার ফুলটস লেগব্রেক দেখে ব্যাট তোলার মতো খুলতে শুরু করল এবং সপাটে পুল করল—“ব্যাট করতে জানে না।”

অবধারিত বাউন্ডারি সুতরাং রানের জন্য আর দৌড়ের দরকার কী, এই রকম ভঙ্গিতে ননীদার দৃষ্টি চশমা পরা ছাত্রটির মুখে আবার ফিরে এল। ‘‘ব্যাট যখন ওপর থেকে নামবে একদম পারপেন্ডিকুলার, স্ট্রেট নামবে। চলো দেখাচ্ছি।”

ননীদা যখন গুড লেংথ বরাবর পিচের উপর একটি বল রেখে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভের মহড়া দিয়ে দেখাচ্ছিলেন চিতু তখন দাঁতে দাঁত চেপে আমায় বলল, “ব্যাট করতে জানে না কন্ট্রাক্টর! আচ্ছা!”

নেট থেকে বেরোলেন ননীদা। তাঁবুর ফেনসিং-এর ধারে একটা জায়গার দিকে আঙুল দেখিয়ে ছাত্রটিকে বললেন, “ওখানে গিয়ে, যেমন দেখালাম, ঠিক তেমনি করে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভের শ্যাডো প্র্যাকটিস করো। দু’শো বার।” তারপরই চিতুর দিকে ফিরে বললেন, “ইয়েস কন্ট্রাক্টর, প্যাড অন।”

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে, “তোমার নাম মতি? ফাস্ট বল করো?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।” এবং চোখের নিমেষে লিন্ডওয়ালকে হুক করার জন্য প্রয়োজনীয় ফুটওয়ার্কের মতো যোগ করলাম, “মানে চেষ্টা করি।”

“দেখি কেমন চেষ্টা করো! যাও কন্ট্রাক্টরকে বল করো।”

এবার আমার উভয়-সঙ্কট। যদি চিতু খেলতে না পারে তা হলে ননীদাই ঠিক অর্থাৎ ‘‘কন্ট্রাক্টর ব্যাট করতে জানে না।” সুতরাং নরির মানসম্মান এখন আমার উপরই নির্ভর করছে আবার চিতুর হাতে বেধড়ক মার খেলে আমিই হয়তো আউট হয়ে যাব ক্লাব থেকে। মাঝামাঝি একটা পথ নিলাম। গায়ে যত জোর আছে খরচ করে বল করতে লাগলাম, উইকেটের বাইরে দিয়ে। বলের পেসটা কেমন, ননীদা সেটুকু অন্তত বুঝুন!

চিতু প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেছল। কিন্তু স্মার্ট ছেলে। ব্যাপারটা বুঝে গিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে ব্যাট চালাতে শুরু করল। যেগুলো ব্যাটে বলে হল তার বেশির ভাগই ব্যাটের কানায় লেগে শ্লিপ বা উইকেটকিপারের (যদিও নেটে কেউ ছিল না) মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে মহামেডান মাঠের কাঠের দেয়ালে ঠকাস ঠকাস শব্দ করল।

আড়চোখে ননীদার দিকে বারকয়েক তাকালাম। দেখি এক দৃষ্টে আকাশে তিনি যেন “উড়ন্ত পিরিচ” খুঁজছেন। নেটের মধ্যে কী হচ্ছে বা না হচ্ছে সে সম্পর্কে উদাসীন। ফেনসিং-এর ধারে চশমাপরা ছেলেটি সমানে টিউবওয়েলের হ্যানডেল টেপার মতো ব্যাট হাতে ওঠানামা করে যাচ্ছিল। পাম্প করা থামিয়ে এখন সে ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে। ননীদা ধীরে ধীরে আকাশবাণী ভবনের গা বেয়ে আকাশ থেকে চোখ নামালেন। অর্ধ নিমীলিত চোখে দূরে ইডেনের প্রেস বক্সের দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “ক’টা হল?”

বোলিং মার্কে ফিরে যাচ্ছিলাম বল হাতে। থমকে বললাম, “গুনিনি তো!”

ননীদা আর একটু গলা চড়িয়ে বললেন, “দু’শো হয়েছে?”

সঙ্গে সঙ্গে ফেনসিং-এর ধারে দ্রুতগতিতে টিউবওয়েল পাম্প শুরু হল। ননীদার আঙুলের তিনটি টুঙ্কিতে চিতু নেট থেকে বেরিয়ে এল।

“উই ডোন্ট প্লে ফর ফান। ক্রিকেট একটা আর্ট, এতে সাধনা লাগে। দু’রকমের ক্রিকেটার হয়। একদল ব্যাটকে কোদাল ভাবে, বাকিরা ভাবে সেতার। একদল কুলি, অন্যরা আর্টিস্ট।”

চিতুর মুখ অপমানে কালো হয়ে উঠল। আস্তে আস্তে সে নেটের পিছনে গিয়ে প্যাড খুলতে শুরু করল। ননীদা আমার দিকে তাকিয়ে চিতুকে শুনিয়েই বললেন, “উইকেট সোজা বল করবে আর লেংথে বল ফেলবে। এই দুটো কথা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো। শুধু তখনই কথা দুটো ভুলবে যখন এই সব ফোতো ব্যাটসম্যানদের বল করবে। সোজা মাথা টিপ করে বল দেবে। কাল থেকে রেগুলার আসবে।”

চিতু আর একটিও কথা বলেনি। চশমাপরা ছেলেটির সঙ্গে আলাপ হল। নির্ভেজাল ভালমানুষ। নাম অঞ্জন কর। অত্যন্ত সম্পন্ন ঘরের ছেলে বলেই মনে হল। ব্যাগ থেকে স্যান্ডউইচ বার করে আমাদের দিল। আমি নিলাম, চিতু মুখ ফিরিয়ে রইল। বললাম, “ও ভীষণ রেগে গেছে। আপনি। কিছু মনে করবেন না।”

অঞ্জন বলল, “জানি, রাগ করারই কথা। কাল ব্যাক লিফট শিখেছি—দু’শোবার ব্যাট তুলতে হয়েছে আর নামাতে হয়েছে। কাল ব্যাক ডিফেন্সিভ স্ট্রোক শিখতে হবে।”

অঞ্জন কোমরে হাত দিয়ে অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইল। স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে বললাম, “তারপর আছে ড্রাইভ, হুক, পুল, কাট।”

“তারপর স্ট্রোক শেখা?” আমি জানতে চাইলাম।

শিউরে উঠে অঞ্জন বলল, “না, না, তারও আগে ফিল্ডিং শিখতে হবে বলেছে ননীদা। দু’শো থ্রো আর দু’শো ক্যাচ লোফা—রোজ।”

“না, না, তারপর রানিং বিটুইন দ্য উইকেট। প্যাড পরে ব্যাট হাতে দু’শোবার।”

এই সময় চিতু খুব বিরক্ত স্বরে আমায় বলল, “খাওয়া হল তোর, না, সারাদিন শুধু দু’শোর গপ্পোই শুনবি। ঢের ঢের ক্লাব আছে গড়ের মাঠে।” তারপর অঞ্জনকে উদ্দেশ করে বলল, “কিসসু হবে না আপনার। এভাবে উজবুকের মতো শিখে ক্রিকেটার হওয়া যায় না, বুঝলেন?”

হতভম্ব অঞ্জনকে ফেলে রেখে চিতু আমায় টানতে টানতে রেড রোড পর্যন্ত নিয়ে এল। “ফোতো কি না দেখাব, একবার বাগে পাই।”

ক্রিকেট ক্লাব অব হাটখোলার বরাবরের প্রতিদ্বন্দ্বী রুপালি সঙ্ঘের সম্পাদকের সঙ্গে পরদিনই চিতু দেখা করল। আমি কিন্তু হাটখোলাতেই রয়ে গেলাম।

॥ দুই ॥

বারো বছর পর আজ হঠাৎ প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা আমার মনে পড়ল।

নেটের ধারে আমি, ননীদা আর ভবানী। সাত-আটটি ছেলে বোলারদের পিছনে ছড়ানো।

“হল না, হল না,” বলতে বলতে ননীদা নেটের মধ্যে ঢুকে, ছেলেটির হাত থেকে ব্যাটটা ছিনিয়েই নিলেন। “বলের লাইন হচ্ছে এই আর তোমার পা থাকছে এখানে…লাইনে পা আনো৷” ননীদা কাল্পনিক বলের লাইনে পা রেখে ব্যাট চালালেন। এবং একস্ট্রা কভারে কাল্পনিক বলটির বাউন্ডারি লাইন পার না হওয়া পর্যন্ত উঠলেন না।

“এইভাবে ড্রাইভ করবে, বলের উপর কাঁধ আর মাথা এনে।”

ননীদা বেরিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “স্ট্রেট ব্যাট, বুঝলে, আর ডিফেন্স। এই দুটো না শিখেই আজকালকার ছেলেরা ভাবে সোবারস হওয়া যায়।”

ছেলেটি মুখ ঘুরিয়ে ননীদার দিকে তাকাল একবার। কাঁধটা ঝাঁকিয়ে ব্যাট হাতে স্টান্স নিল। তিনটি ছেলে বল করছে। প্রথম বলটি লেগ স্টাম্পের অনেক বাইরে। ছেড়ে দিল। ননীদা বলে উঠলেন, “গুড।” পিচে কতকগুলো ইটের টুকরো মাটির উপরে মাথা তুলে রয়েছে। তারই একটিতে পড়ল দ্বিতীয় বলটি। সোজা ফণা তোলার মতো বলটি খাড়া হয়ে ছেলেটির কপাল ছুঁয়ে নেটের বাইরে পড়ল। ছেলেটির মুখ মুহুর্তের জন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ননীদা আক্ষেপ করলেন, “আহ্, হুক করার বল ছিল এটা।”

তৃতীয় বল পিচে পড়ার আগেই ছেলেটি লাফিয়ে বেরোল। বোধ হয় ড্রাইভ করতেই চেয়েছিল। ব্যাটটা একটু তাড়াতাড়ি চালানোয় বলটা উঠে গেল এবং রাস্তা পার হয়ে অন্তত ৭০ গজ দূরে কাস্টমস মাঠে গিয়ে পড়ল। ননীদা উত্তেজিত হয়ে বললেন—

“দ্যাখো, দ্যাখো, বলের লাইন থেকে পা কতদূরে!”

“তার আগে বলটা দেখুন।” ছেলেটি ব্যাট তুলে দেখাল এবং আবার বলল, “এতে ছ’টা রান পাওয়া যাবে। সোবারস হলে তাই করত।”

“তাই নাকি, সোবারস এইভাবে ব্যাট চালাত?”

“মনে তো হয়। এরকম পিচে বলের লাইনে এসে খেলা মানে মাথাটা ফাটানো।”

ননীদার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। ভবানী আর আমি দ্রুত চোখ মেলালাম পরস্পরে। ননীদা হঠাৎ “দুর্যোধন, দুর্যোধন” বলে চিৎকার করতে করতে তাঁবুর দিকে রওনা হলেন।

ভবানী বলল, “ঠিকই জবাব দিয়েছে।”

আমি বললাম, “ননীদা এখন আগের তুলনায় অনেক নরম হয়ে গেছে। এরকম জবাব বারো বছর আগে শুনলে সহ্য করত না।”

“তোমার নামটা কী ভাই!” ভবানী চেঁচিয়ে বলল।

“তন্ময় বোস।” ছেলেটি আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপরই নিখুঁত একটি লেট কাট করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর দিকে তাকালাম—ননীদা কোথায় দেখার জন্য। ফেনসিং-এর গেটে দাঁড়িয়ে দুর্যোধনের সঙ্গে কথা বলছেন, কিন্তু চোখ নেটের দিকে। দেখলাম মাথাটা বিরক্তিভরে দু’বার নেড়ে নিলেন। আমি জানি ননীদা এখন মনে মনে কী বলছেন। বারো বছর আগে আমায় বলেছিলেন, “ফ্যানসি শট,এসব হচ্ছে ফ্যানসি শট। সিজন শুরু হবার এক মাসের মধ্যে খবরদার লেট কাট করবে না।”

“ন্যাচারাল ক্রিকেটার। ছেলেটার হবে মনে হচ্ছে।” ভবানী ভারিক্কি চালে বলল, “অবশ্য যদি গেঁজে না যায়।”

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

কালো কুচকুচে। ঝকঝকে দাঁত। ছিপছিপে বেতের মতো দেহ। তন্ময়কে অনায়াসে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। খেলেও সেই রকম। কোনও কিছুর তোয়াক্কা নেই। চলনে বলনে ঔদ্ধত্য ফুটে ওঠে। একদিন সে বলল, “আরে ধ্যেৎ, ক্রিকেট খেলে কোনও লাভ নেই। ফুটবলে পয়সা আছে।” আর একদিন বলল, “শীতকালটায় রোদ পোয়াব বলেই ক্রিকেট খেলি। নয়তো কে এই খুটখাট খেলার জন্য সময় নষ্ট করে!” ননীদা এসব কথা শুনেছেন। একদিন আমায় বললেন, “ঘাড় ধরে ক্লাব থেকে বার করে দেব। নেহাত ছেলেটার পার্টস আছে তাই সহ্য করে যাচ্ছি।” আর একদিন তন্ময় সিগারেট টানতে টানতে তাঁবুতে ঢুকল। ননীদা আর একটি ছেলেকে দিয়ে বলাল, তাঁবুর মধ্যে সিগারেট খাওয়া চলবে না। তন্ময় আড়চোখে ননীদার দিকে তাকিয়ে তাঁবুর দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা শেষ করল।

॥ তিন ॥

প্রতি বছর মরশুম শুরুর আগে ক্লাবের মেম্বারদের নিয়ে একটা ম্যাচ হয়। নেহাতই এলেবেলে ধরনের খেলা। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট একদলের ক্যাপটেন অন্য দলের ননীদা। যাদের দাক্ষিণ্যে ক্লাব চলে তাদের খুশি করার জন্যই খেলাটা হয়। সেদিন লাঞ্চটাও হয় একটু বিশেষ রকমের। সদস্যদের বাড়ির বউ মেয়েরাও খেলা দেখতে আসে।

এবারের প্রেসিডেন্ট চাঁদমোহন শ্রীমানী নাকি এককালে ক্রিকেট খেলতেন বলে জানিয়েছেন। চিনি, মাছ আর ঘি-এর আড়তদার। রেশনের আর কাপড়ের দোকানও গুটি কয়েক আছে। ননীদা জানালেন, ‘ব্যাটা এখনও ব্যাটের সোজাদিক-উলটোদিক কোনটে জানে না।’

শ্রীমানী বছরে দেড় হাজার টাকা দেবেন এবং পাঁচটি টেস্ট ম্যাচের টিকিট পাবেন, এই কড়ারে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। গৃহিণী, চার ছেলে এবং দুই মেয়েকে নিয়ে দুটি মোটরে হাজির হলেন। সঙ্গে পাঁচ বাক্স সন্দেশ, পাঁচ হাঁড়ি দই ও এক ঝুড়ি কমলালেবু। অ্যাটর্নি মাখন দত্ত ত্রিশ কিলো আলু, দশ কিলো পাউরুটি, দশ কিলো তেল ও কুড়ি কিলো মাংসের দাম এই মরশুমে দেবেন তাই ভাইস-প্রেসিডেন্ট। তিনিও সপরিবারে হাজির। শ্রীমানী-গিন্নির পাশে বসলেন দত্তগিন্নি।

ননীদার টিমে ক্লাবের এবারের নবাগতরা। নিয়মিত খেলোয়াড়দের অধিকাংশই এ ম্যাচে খেলে না। প্রেসিডেন্টের টিমে কর্মকর্তারা এবং তাদের বাচ্চা ছেলেরা। তবে একজন উইকেটকিপার ও দু’জন বোলার রেগুলার টিম থেকে মজুত রাখা হয় ওদের জন্য। আধ ঘণ্টার মধ্যেই সাধারণত, তাদের ডাক পড়ে। দু’দলে পনেরোজন করে খেলে। কতকগুলো অঘোষিত নিয়ম এই ম্যাচটির জন্য আছে। সেগুলো দুই আম্পায়ার, ননীদা আর আমার মতো খুব পুরনো দু’-একজনই শুধু জানে। ননীদা চার বছর আগে রিটায়ার করে গেলেও এই ম্যাচটিতে অধিনায়কত্ব করেন। গত আঠারো বছর ধরে করছেন এবং আমার মতো অনেকেরই ধারণা, আমৃত্যু করবেন।

লাঞ্চ পর্যন্ত আমি স্কোরার। তারপর আম্পায়ার হব। আমার পিছনে দর্শকরা চেয়ারে ও বেঞ্চে বসে। কানে এল শ্রীমানীগিন্নি বলছেন, “সেই কবে খেলতেন, কোনও জিনিসই তো আর নেই। প্যান্ট পরাও অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছেন। তাই আর্জেন্ট অর্ডার দিয়ে প্যান্ট, জামা, বুট করালেন। খেলার যে কী শখ কী বলব। তিরিশ বছর আগে গোরাদের সঙ্গে খেলায় একবার নিয়ে গেছলেন। তখন সবে বিয়ে হয়েছে। একটা লালমুখো কী জোরে জোরে বল দিচ্ছিল, বাব্বাঃ, দেখে তো আমি ভয়ে কাঁপছি। একজনের মাথা ফাটল, আর একজনের আঙুল ভাঙল। উনি বললেন, দাঁড়াও ব্যাটাকে দেখাচ্ছি। তারপর ব্যাট করতে গিয়ে বলে বলে ছক্কা মারতে লাগলেন। শেষকালে সাহেবটা হাতজোড় করে বলল, মিস্টার শ্রীমানী অপরাধ হয়েছে এবার ক্ষান্ত হোন। তখন উনি বললেন, “মনে রেখো টিট ফর ট্যাট উই ক্যান ডু।”

“ওঁর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খুব হাঁকড়ে খেলতেন!” দত্তগিন্নির সম্ভ্রমসূচক কণ্ঠস্বর কানে এল।

“একটু অপেক্ষা করুন, নিজেই দেখতে পাবেন।” শ্রীমানীগিন্নির গলায় চাপা অহঙ্কার, চট করে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম ডিবে থেকে পান বার করে তিনি দত্তগিন্নিকে দিচ্ছেন।

খেলাটা ভাল ভাবেই শুরু হল। শ্রীমানী ইলেভেনের পক্ষে প্রথম ব্যাট করতে নামল মাখন দত্ত আর পল্টু চৌধুরী। তার আগে ক্যাপ্টেন শ্রীমানী দু’জনকে জানিয়ে দিলেন, “তাড়াহুড়ো করবেন না। দেখে দেখে খেলুন, বলের পালিশ উঠে গেলে একটুখানি হাত খুলবেন। তারপর আমি তো আছিই।”

ননীদা বরাবরই সি কে নাইডু ভক্ত!

মাঠে চলাফেরা, বোলারদের সঙ্গে পরামর্শ, ফিল্ড সাজানো, অ্যাপিল করা, সব কিছুই সি কে-র মতো। নতুন একটি ছেলেকে দিয়ে মাখন দত্তর বিরুদ্ধে বল শুরু করলেন। প্রবল উৎসাহের জন্যই ছেলেটির প্রথম বলটি ফুলটস হয়ে গেল। মাখন দত্ত ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে যাবার সময় ব্যাটটিকে হাতপাখার মতো সামনে একবার নেড়ে দিলেন। ব্যাট থেকে তিরবেগে বলটি স্লিপে দাঁড়ানো তন্ময়ের পাশ দিয়ে থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে চলে গেল। হই হই করে উঠল দর্শকরা। শ্রীমানী চেঁচিয়ে নির্দেশ পাঠালেন, “তাড়াহুড়ো নয়, তাড়াহুড়ো নয়।”

পরের দুটি বল চমৎকার আউট সুইঙ্গার। মাখন দত্তর অফ স্টাম্প ঘেঁষে বেরিয়ে গেল।ননীদা বোলারের কাছে গিয়ে কী যেন বললেন। ছেলেটি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কী বলতে যাচ্ছিল, ননীদা ততক্ষণে শর্ট লেগে নিজের জায়গার দিকে রওনা হয়ে গেছেন। সি কে-র সিদ্ধান্তের উপর আর কথা চলে না। পরের তিনটি বল লোপ্পাই ফুলটস এবং লেগ স্টাম্পের বাইরে। মাখন দত্ত তিনবার ঝাড়ু দিলেন, ব্যাটে বলে হল না। পরের ওভারে স্বয়ং ননীদা বোলার। ভাল লেগব্রেক করাতেন এক সময়। পল্টু চৌধুরীকে দুটি বলই অফ স্টাম্পের বাইরে লেগব্রেক করলেন। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ ভুলে পল্টু চৌধুরী ব্যাটটাকে ছিপের মতো বাড়িয়ে রইলেন। বল তিনবার ব্যাটে লেগে পয়েন্টের দিকে গেল।

“ইয়েসসস” বলেই চৌধুরী দৌড়ল। তন্ময় ছুটে গিয়ে বলটা কুড়িয়ে উইকেটকিপারকে দিতেই সে যখন উইকেট ভাঙল মাখন দত্তের তখন ক্রিজে পৌঁছতে চার হাত বাকি। আম্পায়ার হাবলোদা দ্বিধাহীন কণ্ঠে বললেন, “নট আউট।”

দেখলাম তন্ময় বিরক্ত হয়ে কাঁধ বাঁকাল। শ্লিপের অন্যরা যখন ক্যাচের প্রত্যাশায় হাঁটুভেঙে ঝুঁকে পড়ছে, তন্ময় তখন কোমরে হাত দিয়ে সিধে দাঁড়িয়ে। ননীদা তাই দেখে গম্ভীর হলেন। কিন্তু ওর অবস্থাটা আমি জানি। ক্লাব চালাতে হলে কতভাবে লোককে খুশি করতে হয় সেটা ইতিমধ্যে আমারও জানা হয়ে গেছে। এই ম্যাচে শ্রীমানীকে হাফ-সেঞ্চুরি করাতে আর ওর টিমকে জেতাতে না পারলে সামনের বছর ওকে প্রেসিডেন্ট রাখা দায় হয়ে পড়বে। এসব কথা (ননীদা বলেন, স্ট্র্যাটেজি!) নতুন ছেলেদের কাছে তো আর ফাঁস করা যায় না।

এক ঘণ্টা খেলার পর শ্রীমানী ইলেভেনের স্কোর পাঁচ উইকেটে ৮১। মাখন দত্ত ৩১ নট আউট। যে পাঁচজন আউট হয়েছে তারমধ্যে একমাত্র বিকাশ চাটুজ্জেই বছরে এক ডজন বল ও একটি ব্যাটের দাম দেন। তিনি ঠিক ২৫ রানের মাথায় আউট হয়েছেন। হাবলোদা আর পটাবাবু এ পর্যন্ত নির্ভুল আম্পায়ারিং করে গেছেন। তারা দুজনে, আঠারোটা এল বি ডবল্যু, সাতটা রান আউট ও ন’টা স্টাম্পিং আবেদন নাকচ করেছেন।

সাড়ে বারোটায় লাঞ্চ। তারপর ননীদার ইলেভেন ব্যাট করবে। চাঁদমোহন শ্রীমানীকে যদি হাফ-সেঞ্চুরি করতে হয় তা হলে অন্তত সাড়ে এগারোটায় তাকে ব্যাটিং-এ নামানো দরকার। একটা কাগজে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি লিখে মাঠে ননীদার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। ননীদা পাঠ করেই হাত তুলে আমাকে বোঝালেন, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। পরের ওভারেই তিনি তন্ময়কে ডাকলেন বল করার জন্য।

ব্যাটিং অর্ডারে সাতজনের পর শ্রীমানীর নাম। (নিজেকে শেষের দিকে রেখেছে এই জন্য, “যদি ঝরঝর করে উইকেট পড়ে তা হলে আটকাবে কে!”—শ্রীমানীর বিজ্ঞতায় স্তম্ভিত আমার মুখ দেখে ননীদা পর্যন্ত খুশি হয়েছিলেন!) বোলিং চেঞ্জ দেখে বুঝলাম ননীদা এই ওভারেই একজনকে আউট করিয়ে শ্রীমানীকে নামাচ্ছেন। স্ট্র্যাটেজিতে ননীদার কোনও খুঁত নেই। শ্রীমানীকে দেখলাম প্যাড পরে ব্যস্ত হয়ে এলেন তাঁর স্ত্রীর কাছে।

“ওগো সন্দেশ আর দইগুলো এবার গাড়ি থেকে আনিয়ে রাখো।”

“আনাচ্ছি। তোমার ব্যাট করাটা একটু দেখে নি।”

“ও আর দেখার কী আছে।”

“আহা, আমিই শুধু দেখব নাকি, মিসেস দত্তও দেখবেন বলে অপেক্ষা করছেন।”

“মিস্টার দত্ত যা ব্রিলিয়ান্টলি খেলছেন, এরপর আমার ব্যাট কি আপনার ভাল লাগবে মিসেস দত্ত?”

“উনি তো শুধুই খুট খুট করছেন। আপনি সেই সাহেব বোলারটাকে যেমন ছক্কা মেরেছিলেন, সেই রকম আজ নিশ্চয়ই দেখব।”

“ওহ্, সে গল্প বুঝি এর মধ্যেই শোনা হয়ে গেছে।”

দত্তগিন্নি কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তখনই মাঠ থেকে ননীদার বিকট চিৎকার উঠল “আউজাট?” পটাবাবু পরিচ্ছন্ন কট অ্যান্ড বোল্ড হওয়া মাখন দত্তকে বিদায় সঙ্কেত জানাতে এবার আর দ্বিধা করলেন না। ৩১ রানেই, হাসতে হাসতে তিনি ফিরলেন।

“ওয়েল প্লেড।” চাঁদমোহন শ্রীমানী মাঠে নামতে নামতে মাখন দত্তকে তারিফ জানালেন। তন্ময় কোমরে হাত দিয়ে একদৃষ্টে শ্রীমানীর দিকে তাকিয়ে। ননীদা তার স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী লেগ সাইড থেকে ফিল্ডার সরিয়ে ফাঁকা করে দিলেন যাতে রান ওঠার গতি ব্যাহত না হয় বা শ্রীমানীর ক্যাচ কেউ না ধরে ফেলে। তারপর তন্ময়কে ডেকে কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বললেন, তন্ময় বাধ্যের মতো মাথা নাড়ল।

চাঁদমোহন শ্রীমানী উইকেটে পৌঁছোলেন অতি মন্থর গতিতে। পৌঁছেই পিচ পরীক্ষায় ব্যস্ত হলেন। কয়েকটা কাঁকর খুঁটে ফেললেন। স্থানে স্থানে ব্যাট দিয়ে ঠুকলেন। তারপর গ্লাভস পরতে শুরু করলেন। পরা হয়ে গেলে হাবলোদার কাছে গার্ড চাইলেন, ওয়ান লেগ। তারপর বুটের ডগা দিয়ে ক্রিজে দাগ কাটলেন। এরপর শুরু করলেন ফিল্ড প্লেসিং নিরীক্ষণ। তাও হয়ে যাবার পর স্টান্স নিলেন। তন্ময় একদৃষ্টে ওকে এতক্ষণ দেখে যাচ্ছিল। এবার বল করার জন্য ছুটতে শুরু করা মাত্র শ্রীমানী উইকেট থেকে সরে গেলেন।

কী ব্যাপার?

সাইট স্ক্রিনের সামনে দুর্যোধনের কুকুরটা ঘাড় চুলকোতে ব্যস্ত।

হই হই করে হাবলোদা ছুটে গেলেন। কুকুরটা চটপট দৌড় দিল। শ্রীমানী আবার চারদিকের— ঠিকমতো বললে তিনদিকের—ফিল্ড প্লেসিং দেখে নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়ালেন। মুখে মৃদু হাসি।

অদ্ভুতভাবে বলটা ঢুকল অফ স্টাম্পের বাইরে থেকে। মাটিতে পড়ে অতখানি ব্রেক করে এলে যে কোনও টেস্ট ব্যাটসম্যানও মুশকিলে পড়ে যাবে। বলটা শ্রীমানীর ব্যাট আর প্যাডের মাঝ দিয়ে এসে লেগ স্টাম্পটাকে শুইয়ে দিল।

সারা মাঠ বোবা হয়ে গেল। মাঠের বাইরে দর্শকদের গুঞ্জন থেমে গেল। শ্রীমানী ফ্যালফ্যাল করে উপড়ানো স্টাম্পটার দিকে তাকিয়ে। ননীদা কটমট করে তাকিয়ে তন্ময়ের দিকে। তন্ময় আকাশে তাকিয়ে শিস দিচ্ছে। চাঁদমোহন শ্রীমানী অবশেষে ফিরতে শুরু করলেন।

“নো বল!”

চমকে সবাই ফিরে দেখল, হাবললাদা গম্ভীর মুখে ডান হাতটি ট্রাফিক পুলিশের মতো বাড়িয়ে। ননীদা ছুটে গেলেন শ্রীমানীকে ফিরিয়ে আনতে। ফিল্ডাররা ফ্যালফ্যাল করে হাবলোদার দিকে তাকিয়ে। তন্ময় ঘুরে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চোখে শ্রীমানীর প্রত্যাবর্তন দেখছে।

এরপরের বলটি সোজা কপাল টিপ করা। শ্রীমানী কোনওক্রমে হাতটা তোলার সময় পান তাই বলটা কনুইয়ে লেগে খটাং শব্দ করল। শব্দের ধরনে সবাই বুঝে গেল হাড় ভেঙেছে। ওকে যখন মাঠের বাইরে আনা হল, তন্ময় তখন হাসছে। তাড়াতাড়ি শ্রীমানীকে তার গাড়িতেই হাসপাতালে পাঠানো হল। সঙ্গে গেলেন ওর বাড়ির সবাই এবং ননীদা। যাবার আগে ননীদা আমাকে শুধু বললেন, “আমার দোষেই এটা হল৷ তন্ময় এমন করবে জানলে বল করতে দিতুম না।”

আর লাঞ্চের সময় তন্ময় বেশ জোরেই তার পাশে বসা ছেলেটিকে বলল, “য়্যাঁ, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দইসন্দেশও গাড়িতে করে চলে গেল! আই অ্যাম সরি, রিয়েলি সরি। ইসস, আগে জানলে লাঞ্চটা নষ্ট করতুম না।”

তন্ময়ের এই কথায় আমি বিরক্ত বোধ করলাম। লাঞ্চের পর সবাই গল্প-গুজবে ব্যস্ত, তখন ওকে একধারে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম আজকের ম্যাচের উদ্দেশ্য। মন দিয়ে শুনল কিন্তু কোনও ভাবান্তর হতে দেখলাম না। বলল, “ক্লাবের যখন এতই দুরবস্থা তা হলে ক্লাব রাখা কেন। আর রাখতেই যদি হয়, তা হলে ফার্স্ট ডিভিশনে ওঠার জন্য চ্যাম্পিয়ানশিপ ফাইট করা উচিত।”

“প্লেয়ার কোথায়?” আমি বললাম, হতাশা এবং অনুযোগ মিশ্রিত স্বরে।

“এই টিম নিয়েই আমি ফাইট করব, দেবেন আমায় সব দায়িত্ব?”

আমি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলাম। উত্তেজনায় ও উৎসাহে তন্ময়ের চোখমুখ ঝকমক করছে। “সব ভার আমায় দিন, দেখবেন সামনের বছরই সি সি এইচ, মোহনবাগান, কালীঘাট, স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে লিগ খেলবে। তবে ননীদার মাতব্বরি একদমই কিন্তু চলবে না। লাঞ্চ-টাঞ্চ, মালি, মাঠ, খাতাপত্তর এই সব নিয়েই তিনি থাকুন, টিম আর খেলায় নাক না গলালেই হল।”

“তুমি এখনও যথেষ্ট ছেলেমানুষ তন্ময়। নতুন এসেছ, এখনও এ ক্লাবের কিছুই জানো না!” আমি আস্তে আস্তে বললাম, “ননীদাকে বাদ দিলে সি সি এইচ উঠে যাবে। আর ওকে বাদ দেওয়ার ক্ষমতা কারুরই নেই। তিরিশ বছর এই ক্লাব নিয়ে পড়ে আছেন। বউ পাগল, ছেলেপুলে নেই, মাইনের সব টাকাই ক্লাবে ঢালেন। মাঠে নেমে ম্যাচ জিতলেই ক্লাব চলে না। অজস্র খুঁটিনাটি কাজ আছে, যেগুলো করার লোক পাওয়া যায় না। আমি নিজেও ফাঁকি দিয়ে এড়িয়ে যাই।” লক্ষ করলাম কথাগুলো ওর মনে দাগ কাটছে না, তাই সুর বদল করে বললাম, “আমিও কি ননীদার সব ব্যাপার পছন্দ করি ভেবেছ? বিশেষ করে ওর কথাবার্তা? কিন্তু মানিয়ে চলি। হাজার হোক বয়স্ক লোক তো। তুমিও মানিয়ে নাও। আমার এই অনুরোধটা রাখো। তা ছাড়া এ বছর আমি ক্যাপ্টেন, তোমার কোনও অসুবিধা হবে না।’’

কী যেন ভেবে নিয়ে তন্ময় বলল, “আচ্ছা, দেখি।”

॥ চার ॥

আমার যা কিছু অধিনায়কত্বের শিক্ষা ননীদার কাছেই। ননীদার প্রধান থিয়োরি—টিম যখন দুর্বল তখন জেতার বা বাঁচার একমাত্র উপায় স্ট্র্যাটেজি। সেটা নির্ভর করবে স্থান, কাল, পাত্রের উপর। এজন্য তিনটি জিনিসে তিনি জোর দেন: (১) আইনের ফাঁক খুঁজে বার করে তার সুযোগ নেওয়া। (২) আম্পায়ারদের স্টাডি করে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া। (৩) বিপক্ষ প্লেয়ারদের নানাপ্রকার ধাঁধায় ফেলা। যেমন ডবল্যু জি গ্রেস করতেন।

ননীদার থিয়োরি আমাদের অনেক হারা ম্যাচ জিতিয়েছে। তরুণ মিলনের সঙ্গে খেলায় ওদের ৪৮ রানে নামিয়ে আমরা করলুম ৭ উইকেটে ৩২। হার অবধারিত। ননীদা তখন খেলতে নামলেন। আর একদিকে ব্যাট করছে চশমা-পরা অঞ্জন। ননীদা প্রথমেই অঞ্জনকে বলে দিলেন, “শুধু ডিফেন্স করে যাও। বলের লাইনে পা, মাথা নিচু, স্ট্রেট ব্যাট। বাকি যা করার আমি করছি।”

এরপর ননীদা নন-স্ট্রাইকার এন্ডে গিয়ে ওদের সাত রানে পাঁচ উইকেট পাওয়া ফাস্ট বোলারটির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিলেন। আমাদের দু’জন ব্যাটসম্যানের কপালে আলু তৈরি এবং একজনের দুটি দাঁত কমিয়ে দেওয়ার জন্য এই বোলারটিই দায়ী। ফাস্ট বোলারটি বল করার জন্য বোলিং মার্কে ফিরে যাচ্ছে, ননীদাও কথা বলতে বলতে তার সঙ্গে চললেন।

“অফ স্পিন বোলারকে এতটা দৌড়ে এসে বল করতে আগে কখনও দেখিনি।” ননীদা খুবই বিস্মিত স্বরে বললেন।।

“তার মানে? আমি কি স্লো বোলার?” থেমে গিয়ে ফাস্ট বোলারটি বলল।

“তাই তো মনে হচ্ছে।” নিরীহ মুখে ননীদা একগাল হাসলেন।

রাগে ফাস্ট বোলারের চোখ দুটি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। চেঁচিয়ে সে আম্পায়ারকে বলল, “আম্পায়ার, আপনি কি এ-লোকটার কাণ্ড দেখতে পাচ্ছেন না? একে থামাচ্ছেন না কেন?”

আম্পায়ার মাথা নেড়ে বললেন, “বোলারের সঙ্গে হাঁটতে পারবে না, এমন কথা আইনে নেই।”

“অ।” ফাস্ট বোলার তার আঠারো কদম দূরের বোলিং মার্কে ফিরে গেল, সঙ্গে ননীদাও। বোলার ছুটতে শুরু করল, তার পাশাপাশি ননীদাও ছুটছেন। মাঝপথে বোলার থেমে গেল।

“আম্পায়ার! দেখতে পাচ্ছেন না লোকটা কী করছে?”

“দেখেছি।” আম্পায়ার নিরেট মুখ করে বলল, “সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে। কী করব, আইনে বারণ করা নেই।”

ননীদা এরপর ছায়ার মতো ফাস্ট বোলারটিকে অনুসরণ করতে শুরু করলেন। তাতে মাথা খারাপ হবার উপক্রম হল বোলারটির। পর পর এমন তিনটি বল করল যাতে থার্ড শ্লিপের পরলোকগমন সম্ভাবনা ছিল। তৃতীয় বলটি করেই সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ননীদাকে এমন ভাষায় কয়েকটি কথা বলল, যেগুলো ছাপা যায় না। ননীদা চুপ করে রইলেন, তারপর আম্পায়ারকে বললেন,

“শুনলেন, কী বলল?”

“শুনেছি!” আম্পায়ার বলল।

“আপনি কি মনে করেন ক্রিকেট খেলার মধ্যে এরকম ভাষা ব্যবহার করা উচিত?”

“না।” আম্পায়ার বলল।

“তা হলে আমি এর প্রতিবাদে টিম নিয়ে চলে যাচ্ছি। আপনি নিশ্চয় স্বকর্ণে যা শুনেছেন রিপোর্টে লিখবেন?”

“নিশ্চয় লিখব।”

ননীদা ড্রেসিংরুমে ফিরে শুধু বললেন, “ট্যাকটিকস।” লিগ সাব কমিটি আমাদের পুরো পয়েন্টই দিয়েছিল।

আর একবার ইস্ট সুবার্বানের সঙ্গে খেলায় ননীদা টিম নিয়ে ফিল্ড করতে নেমেই আম্পায়ার দু’জনের মধ্যে যে বয়স্ক তার সঙ্গে আলাপ শুরু করে দিলেন।

“অনেকদিন পর দেখা, আছেন কেমন?”

“আর থাকা! চলে যাচ্ছে একরকম করে!” আম্পায়ার একটু খুশি হয়েই বলল।

“বাতের ব্যথাটা কেমন?”

‘‘ক’দিন বড্ড বেড়েছে!” আম্পায়ার বেশ বিস্মিত হয়েই বলল। বিস্ময়ের কারণ, লোকটা জানল কী করে?

“আমাদের পাড়ায় এক কোবরেজের অদ্ভুত একটা তেল আছে। আমার কাকার পনেরো বছরের বাত মাত্র সাত দিন ব্যবহার করেই সেরে গেছে।”

“সত্যি!” আম্পায়ার গদগদ হয়ে পড়ল, “ঠিকানাটা দেবেন?”

“নিশ্চয়। বরং আমিই দিয়ে আসব আপনার কাছে। আপনার ঠিকানাটা খেলার পর দেবেন।”

এইখান থেকেই ইস্ট সুবার্বানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। ননীদা যখন বল করতে এলেন, তখন ৪০ রান, একটিও উইকেট পড়েনি। ওর প্রথম বলটা অনেকখানি ব্রেক করল, অফ স্টাম্প থেকে প্রায় স্কোয়্যার লেগে। খেলতে গিয়ে ব্যাটসম্যানের প্যাডে লাগল। ননীদা আম্পায়ারের দিকে ঘুরে হাত তুলেই মৃদু হাসলেন “হয়নি, হয়নি। অ্যাপিল করার মতো হয়নি।”

দুটি বল পরে আবার ব্যাটসমানের প্যাডে লাগল। ননীদা “হা আ আ” বলেই অ্যাপিলটা আর সমাপ্ত করলেন না। স্বরটাকে মৃদু করে বললেন, “সরি, আম্পায়ার! অ্যাপিল করার মতো হয়নি। ইগনোর করে ঠিকই করেছেন।”

আম্পায়ার তখনও বাত থেকে মুক্তির সম্ভাবনায় ও আপন বিচারদক্ষতা প্রমাণের সাফল্যের আনন্দ কাটিয়ে ওঠেনি ননীদা ফার্স্ট শ্লিপ থেকে অ্যাপিল করলেন কট বিহাইন্ডের। সে চিৎকারে চৌরঙ্গির পথচারীরাও চমকে উঠতে পারে। আম্পায়ার কোনও দ্বিধা না করেই হাত তুলল। বিস্মিত ব্যাটসম্যান আম্পায়ারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে রওনা হল। আমি সেকেন্ড শ্লিপে। পরিষ্কার দেখেছি বল ব্যাটে লাগেনি। চাপা গলায় বললাম, “ননীদা, ব্যাপার কী?”

“সাইকোলজি!” ননীদা জবাব দিলেন।

“বাত আছে জানলেন কী করে?”

“পঞ্চাশ বয়সের ওপর শতকরা ষাটটা বাঙালিরই অম্বল নয়তো বাত আছে। তেল নয়তো বড়ি, দুটোর একটা লেগে যাবেই।”

ননীদার অ্যাপিলে সেদিন চারটে এল বি ডবল্যু আর তিনটে রান আউট পেয়ে আমরা ৬২ রানে ইস্ট সুবার্বানকে খতম করে দিয়েছিলাম। কয়েকদিন পর ননীদাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, তিসির তেলে রসুন, কাঁচালঙ্কা, গন্ধক মিশিয়ে এক শিশি পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ননীদার ট্যাকটিকসের আর একটি অস্ত্র ব্যাটসম্যান যখন বল খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে এবং বোলার বল দিতে ছুটতে শুরু করেছে তখন ফার্স্ট শ্লিপ থেকে উইকেটকিপারের সঙ্গে কথা বলে যাওয়া। ব্যাটসম্যান বল খেলুক বা ছেড়ে দিক বা ফস্কাক অমনি ননীদা “উহহহ”, “আহহহ” “ইসসস”, আর একটু যদি ঘুরত বলটা! “এবার নির্ঘাৎ!” ইত্যাদি বলে যাবেনই। অফ স্টাম্পের এক গজ বাইরে দিয়ে গেলেও এমন করবেন যেন উইকেট ভেদ করে বল গেল। নতুন ব্যাটসম্যান উইকেটে এসেই দেখত ননীদা খুব চিন্তিতভাবে গুডলেংথের কাছাকাছি একটা জায়গার দিকে তাকিয়ে। তারপর ব্যাটসম্যানকে শুনিয়ে আমাকেই বলতেন, “একই রকম আছে হে, মতি। দুর্যোধনকে কাল পই পই বললুম ভাল করে রোলার টানবি নয়তো কোনদিন যে মানুষ খুন হবে কে জানে! আগের ম্যাচে তপনবাবুর যা অবস্থা হয়েছে…ভাল কথা কাল হাসপাতালে গেছলে?”

“চোয়ালটা ঠিকমতো সেট হয়নি, মুখটা বোধ হয় একটু বেঁকেই থাকবে আর সামনের দাঁত দুটোর তো কিছুই করার নেই!” বলতে বলতে লক্ষ করলাম ব্যাটসম্যান উৎকর্ণ হয়ে শুনছে।

“তা হলে গোবিন্দকে বলি বরং একটু আস্তে বল করুক।” ননীদা রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।

“আগে দেখুন না বল লাফায় কি না!”

এরপর ব্যাটসম্যানের টিকে থাকা—না থাকা নির্ভর করে ফার্স্ট শ্লিপ থেকে ননীদার অবিরত রানিং কমেন্টারি উপেক্ষার ও মনঃসংযোগ ক্ষমতার উপর। ননীদা তার এই ট্যাকটিকসকে বলেন— প্রোপাগান্ডা! এতে একবারই ওকে ব্যর্থ হতে দেখেছিলাম। একটি ম্যাচে আমি আর ননীদা যথারীতি প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছি, আর ব্যাটসম্যান মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকিয়ে লাজুক ভাবে হাসছে। তাতে আমরা খানিকটা ঘাবড়ে যাই। ননীদা অবশেষে আর থাকতে না পেরে ওভার শেষে ব্যাটসম্যানটিকে বললেন, “পিচটা খুবই খারাপ, তাই না?”

ব্যাটসম্যান হাসল।

“আগের ম্যাচে আমাদের বেস্ট ডিফেনসিভ ব্যাট তপনবাবুর চোয়াল আর দাঁত ভেঙেছে। মালিটাকে এবার তাড়াতেই হবে। কিসসু কাজ করে না।”

ব্যাটসম্যান আবার হাসল।

“গোবিন্দকে অবশ্য বলে দিয়েছি ওভার পিচ হয় হোক, তবু ওই স্পটে যেন বল না ফেলে। ম্যাচ জেতার জন্য তো আর মানুষ খুন করতে পারব না।”

ব্যাটসম্যান এবারও হাসল। ননীদা চুপ করে গেলেন। পরের ওভার শেষ হতেই অপর ব্যাটসম্যানকে তিনি বললেন, “আপনার পার্টনারটি কেমন লোক মশাই একটা কথারও জবাব দেয় না?” সখেদ উত্তর পেলাম, “আমাদেরও এই একই মুশকিল হয়। হাবু শুনতেও পায় না, কথাও বলতে পারে না।”

রুপালি সঙেঘর সঙ্গে সি সি এইচের হাড্ডাহাড্ডির শুরু পচিশ বছর আগে শনিবারের একটা ফ্রেন্ডলি হাফ-ডে খেলা থেকে। ননীদা এমন এক স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করে ম্যাচটিকে ড্র করান যার ফলে এগারো বছর রুপোলি সঙ্ঘ আমাদের সঙ্গে আর খেলেনি। গল্পটা শুনেছি মোনা চৌধুরীর (অধুনা মৃত) কাছে। মোনাদা এ খেলায় ক্যাপ্টেন ছিলেন। উনি না বললে, এটাকে শিব্রাম চকরবরতির লেখা গল্প বলেই ধরে নিতাম।

সি সি এইচ প্রথম ব্যাট করে ১৪ রানে সবাই আউট হয়ে যায়। মোনাদা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ড্রেসিং-রুমে। সবারই মুখ থমথমে। এক ওভার কি দু’ ওভারেই রুপোলি সঙঘ রানটা তুলে নেবে। ওদের ড্রেসিংরুম থেকে নানান ঠাট্টা এদিকে পাঠানো হচ্ছে। ক’টা বলের মধ্যে খেলা শেষ হবে তাই নিয়ে বাজি ধরছে। রুপোলির ক্যাপ্টেন এসে বলল, “মোনা, আমরা সেকেন্ড ইনিংস খেলে জিততে চাই, রাজি?” মোনাদা জবাব দেবার আগেই ননীদা বলে উঠলেন, “নিশ্চয় আমরা খেলব। তবে ফার্স্ট ইনিংসটা আগে শেষ হোক তো!”

সবাই অবাক হয়ে তাকাল ননীদার দিকে। রুপোলির ক্যাপ্টেন মুচকি হেসে, “তাই নাকি?” বলে চলে গেল। ননীদা বললেন, “এ ম্যাচ রুপোলি জিততে পারবে না। তবে আমি যা বলব তাই করতে হবে।”

মোনাদা খুবই অপমানিত বোধ করছিলেন রুপোলির ক্যাপ্টেনের কথায়, তাই রাজি হয়ে গেলেন। তখন বিষ্টুকে একধারে ডেকে নিয়ে ননীদা তাকে কী সব বোঝাতে শুরু করলেন আর বিষ্টু শুধু ঘাড় নেড়ে যেতে থাকল। তিরিশ মাইল রোড রেসে বিষ্টু পরপর তিন বছর চ্যাম্পিয়ন। শুধু ফিল্ডিংয়ের জন্যই ওকে মাঝে মাঝে দলে নেওয়া হয়। ব্যাট চালায় গাঁইতির মতো, তাতে অনেক সময় একটা-দুটো ছক্কা উঠে আসে।

রুপোলি ব্যাট করতে নামল। ননীদা প্রথম ওভার নিজে বল করতে এলেন। প্রথম বলটা লেগস্টাম্পের এত বাইরে যে ওয়াইড সঙ্কেত দেখাল আম্পায়ার। দ্বিতীয় বলে ননীদার মাথার দশ হাত উপর দিয়ে ছয়। তৃতীয় বলে পয়েন্ট দিয়ে চার। পরের দুটি বলে, আশ্চর্য রকমের ফিল্ডিংয়ে কোনও রান হল না। শেষ বলে লেগবাই। বিষ্টু লং অন থেকে ডিপ ফাইন লেগে যেভাবে দৌড়ে এসে বল ধরে, তাতে নাকি রোম অলিম্পিকের ১০০ মিটারে সোনার মেডেল পাওয়া যেত। তা না পেলেও বিষ্ঠু নির্ঘাৎ পরাজয় অর্থাৎ বাউন্ডারি বাঁচিয়ে যখন উইকেটকিপারকে বল ছুড়ে দিল, রুপোলির দুই ব্যাটসম্যান তখন তিনটি রান শেষ করে হাঁফাচ্ছে।

ওভার শেষ। স্কোর এখন সমান সমান। দু’দলেরই ১৪। বিষণ্ণতায় সি সি এইচ-এর সকলের মুখ ম্লান। শুধু ননীদার মুখে কোনও বিকার নেই। সাধারণত অতুল মুখুজ্জেই এরপর বল করে। সে এগিয়ে আসছে কিন্তু তাকে হাত তুলে নিষেধ করে ননীদা বলটা দিলেন বিষ্ণুর হাতে। সবাই অবাক। বিষ্টু তো জীবনে বল করেনি! কিন্তু কথা দেওয়া হয়েছে, ননীদা যা বলবেন তাই করতে দিতে হবে। বিষ্ঠু গুনে গুনে ছাব্বিশ কদম গিয়ে মাটিতে বুটের ডগা দিয়ে বোলিং মার্ক কাটল। ব্যাটসম্যান খেলার জন্য তৈরি। বিষ্টু তারপর উইকেটের দিকে ছুটতে শুরু করল।

বোলিং ক্রিজে পৌঁছোবার আগে অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল। বিষ্টু আবার পিছু হটতে শুরু করেছে। তারপর গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করল। সারা মাঠ অবাক শুধু ননীদা ছাড়া।

বিষ্টু কি পাগল হয়ে গেল? ঘুরছে, পাক খাচ্ছে, ঘুরছে আবার পাক খাচ্ছে, লাফাচ্ছে, বোলিং মার্কে ফিরে যাচ্ছে, ডাইনে যাচ্ছে, বাঁয়ে যাচ্ছে কিন্তু বল হাতেই রয়েছে।

“এ কী ব্যাপার!” রুপোলির ব্যাটসম্যান কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল, “বোলার এভাবে ছুটোছুটি করছে কেন?”

ননীদা গম্ভীর হয়ে বললেন, “বল করতে আসছে।”

“এসে পৌঁছবে কখন?”

“পাঁচটার পর। যখন খেলা শেষ হয়ে যাবে।”

এরপরই আম্পায়ারকে ঘিরে তর্কাতর্কি শুরু হল। ননীদা যেন তৈরিই ছিলেন, ফস করে পকেট থেকে ক্রিকেট আইনের বই বার করে দেখিয়ে দিলেন, বোলার কতখানি দূরত্ব ছুটে এসে বল করবে, সে সম্পর্কে কিছু লেখা নেই। সারাদিন সে ছুটতে পারে বল ডেলিভারির আগে পর্যন্ত।

বিষ্টু যা করে যাচ্ছিল তাই করে যেতে লাগল। ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছাড়তে ভরসা পাচ্ছে না, যদি তখন বোল্ড করে দেয়। ফিল্ডাররা কেউ শুয়ে, কেউ বসে। ননীদা মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছেন আর হিসেব করে বিষ্টুকে চেঁচিয়ে বলছেন, “আর দেড় ঘণ্টা!”…আরও এক ঘণ্টা!” “মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট!”

কথা আছে পাঁচটায় খেলা শেষ হবে। পাঁচটা বাজতে পাঁচে নতুন এক সমস্যার উদ্ভব হল। বল ডেলিভারি দিতে বোলার ছুটছে তার মাঝেই খেলা শেষ করা যায় কি না? দুই আম্পায়ার কিছুক্ষণ আলোচনা করে ঠিক করলেন, তা হলে সেটা বে-আইনি হবে।

সুতরাং বিষ্ঠুর পাক দিয়ে দিয়ে দৌড়নো বন্ধ হল না। মাঠের ধারে লোক জমেছে। তাদের অনেকে বাড়ি চলে গেল। অনেক লোক খবর পেয়ে দেখতে এল। ব্যাটসম্যান সান্ত্রীর মতো উইকেট পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যা নামল। বিষ্টু ছুটেই চলেছে। চাঁদ উঠল আকাশে। ফিল্ডাররা শুয়েছিল মাটিতে। ননীদা তাদের তুলে ছ’জনকে উইকেটকিপারের পিছনে দাঁড় করালেন, বাই রান বাঁচাবার জন্য। এরপর বিষ্টু বল ডেলিভারি দিল।

রুপোলির ব্যাটসম্যান অন্ধকারে ব্যাট চালাল এবং ফসকাল। সেকেন্ড শ্লিপের পেটে লেগে বলটা জমে গেল। ননীদা চেঁচিয়ে উঠলেন, “ম্যাচ ড্র।”

রুপোলির ব্যাটসম্যান প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, বল ডেলিভারির মাঝে যদি খেলা শেষ করা না যায়, তা হলে ওভারের মাঝেও খেলা শেষ করা যাবে না। শুরু হল তর্কাতর্কি। বিষ্টুকে আরও পাঁচটা বল করে ওভার শেষ করতে হলে, জেতার জন্য রুপোলি একটা রান করে ফেলবেই—বাই, লেগবাই, ওয়াইড যেভাবেই হোক। কিন্তু ননীদাকে দমানো সহজ কথা নয়। ফস করে তিনি আলোর অভাবের অ্যাপিল করে বসলেন। চটপট মঞ্জুর হয়ে গেল।

আমার ধারণা মোনাদা কিছুটা রং ফলিয়ে আমাকে গল্পটা বলেছেন। আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তগুলো, ফ্রেন্ডলি ম্যাচে হলেও, সঠিক হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু ননীদাকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে জানে, তারা কেউ এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তুলবে না।

॥ পাঁচ ॥

ননীদাকে ভাল করে জানি বলেই অবাক হচ্ছিলাম তন্ময়কে উনি এখনও ক্লাবে ঢুকতে দিচ্ছেন কোন কারণে? চাঁদমোহন শ্রীমানী জানিয়েছেন, ব্যবসা খুব মন্দা যাচ্ছে। হাজার টাকার বেশি দিতে পারবেন না। আমরা বুঝলাম তন্ময়ের জন্যই পাঁচশো টাকা ক্লাবের জরিমানা হল। এতবড় ধাক্কা সামলানো খুবই শক্ত, বিশেষত ননীদার পক্ষে।

প্রথম লিগম্যাচে তন্ময় ১০৮ নট আউট রইল। এগারো বছর পর এই প্রথম ক্লাবের কেউ সেনচুরি করল প্রতি বছরই লিগ শুরুর আগে ননীদা সবাইকে জানিয়ে দেন, সেনচুরি করলেই একটা নতুন ব্যাট পাবে। তন্ময় খেলা শেষেই তার দাবি জানাল। ননীদা খুব খুশিতে ছিলেন। “নিশ্চয় পাবে। কথার খেলাপ আমার হয় না!” এই বলে ননীদা ওর পিঠ চাপড়ালেন।

“দেখবেন, কাঁটাল কাঠের ব্যাট গছাবেন না।” তন্ময় বলল।

“আরে, না না। ভাল ব্যাটই দেব।”

“কবে দেবেন, কালকেই?”

“কাল কি আর সম্ভব? ক’টা দিন সময় দাও, ঠিক পেয়ে যাবে।”

ননীদাকে একসময় বললাম, “শ খানেক টাকার কমে তো ব্যাট হবে না। পাবেন কোত্থেকে? ক্লাবের যা অবস্থা!”

“আরে, টাকা ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। দেখলে, ফাস্ট বোলারটাকে যে ছয়টা মারল সেকেন্ড ওভারে! এগিয়ে যেই দেখল পাবে না, সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে ব্যাকফুটে স্ট্রেট বোলারের ওপর দিয়ে। ছেলেটার হবে, বুঝলে মতি! এত বছর গড়ের মাঠের ঘাসে চরছি, বুঝতে ঠিকই পারি। তবে বড্ড ডেয়ারিং, অধৈর্য, রিস্কি শট নেয়। ওকে তুমি একটু কনট্রোল করো। আমার কথা তো শুনবে না।”

বললাম, “আমার কথাও শুনবে না। আজকাল ছেলেরা একটু অন্য রকম, বোঝেনই তো।”

পরের ম্যাচ খেলতে নামার আগে তন্ময় তাঁবুর মধ্যে চিৎকার করে সবাইকে শুনিয়েই বলল, “ব্যাটটা যে এখনও পেলুম না। দেবেন তো, নাকি ক্যালকাটা করপোরেশন হয়ে থাকবেন?”

“না, না অবশ্যই দেব।” ননীদা খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে বললেন।

এ খেলায় তন্ময় ১০১ করল। ননীদা আহ্লাদে যে কী করবেন, ভেবে পেলেন না। আমি শুধু বললাম, “আর একখানা ব্যাট দিতে হবে, মনে থাকে যেন!”

“রেখে দাও তোমার ব্যাট!” ননীদা ধমকে উঠলেন। “কলকাতার ক’টা ব্যাটসম্যান পারে লেগ স্টাম্পের বাইরে সরে এসে লেগের বল অমন করে স্কয়্যার কাট করতে? মতি তুমি ব্যাটের কথাই শুধু ভাবছ, ছেলেটা যে আর্টিস্ট সেটা বলছ না!”

চুপ করে রইলাম। লাঞ্চের সময়ই, যা আন্দাজ করেছিলাম তাই ঘটল। তন্ময় টেবিলে বসেই হেঁকে বলল, “আগের ব্যাটটা তো এখনও পেলুম না। আর কতদিন সময় দিতে হবে, ননীদা?”

“পাবে, পাবে! এক সঙ্গেই দুটো পাবে!”

“ঠিক আছে। তবে সামনের ম্যাচের আগে না পেলে আমি আর আসছি না।”

কথামতোই তন্ময় এল না পরের ম্যাচে। দুটো কেন, একটা ব্যাট দেওয়ার সামর্থ্যও সি সি এইচের নেই। তন্ময় ব্যাট না পাওয়ায় অন্য প্লেয়াররাও গুঞ্জন তুলল। আমরা চার উইকেটে ত্রিবেণী ইউনাইটেডের কাছে হারলাম। পরের খেলা রুপোলি সঙেঘর সঙ্গে। এখন রুপোলির ক্যাপ্টেন চিতু। দুটো ম্যাচে খেলে, তন্ময় একাই ম্যাচ দুটো জিতে দিয়েছে। মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা জেগেছে, সি সি এইচ চ্যাম্পিয়ন হবার চেষ্টা করলে এবার বোধ হয় হতে পারবে। তন্ময়ের অনুপস্থিতি আমাকে ব্যস্ত করে তুলল।

ঠিকানা জোগাড় করে তন্ময়ের বাড়ি হাজির হলাম। সরু গলি। আধা-বস্তি অঞ্চল। নম্বর অনুযায়ী কড়া নাড়তে এক প্রৌঢ়া দরজা খুললেন। তাঁর চেহারা ও বেশে দারিদ্রের তকমা আঁটা কিন্তু কথায় ও আচরণে প্রাক্তন আভিজাত্যের ছাপ। উনি তন্ময়ের মা।

“তমু তো দু’দিন হল বাড়ি নেই। বর্ধমানের কোথায় যেন ফুটবল খেলতে গেছে।”

গ্রামাঞ্চলে শীতকালেই ফুটবল টুর্নামেন্টগুলো হয়। কলকাতার ফার্স্ট ডিভিশান ফুটবলারদের তখন ভাড়া পাওয়া যায়। তা ছাড়া, ধান ওঠার পর অবসর ও অর্থ দুইই তখন হাতে আসে। এক একটা গ্রামের ফুটবল টিমে কলকাতারই এগারোজনকে দেখা যায়। এই রকমই কোনও টিমের হয়ে তন্ময় ভাড়া খেলতে গেছে। আমার ঠিকানা দিয়ে বললাম, তন্ময় ফিরলেই যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।

দু’দিন পরই তন্ময় আমার বাড়িতে এল।

“হল না, মতিদা! পর পর দুটো জায়গায় সেমিফাইনাল আর ফাইনাল খেললুম। দুটোতেই ডিফিট, মোট একশো কুড়ি টাকা পাওয়ার কথা— পেলুম পঞ্চান্ন।”

“ফুটবল খেললে ক্রিকেটের বারোটা বাজবে!” ক্ষুণ্ণস্বরে বললাম, “কখন চোট লাগবে কে বলতে পারে!”

তন্ময় হাসল। বলল, “বাঁ-কাঁধটা নাড়তে কষ্ট হচ্ছে, ব্যাকটা এমন ঝাঁপিয়ে পড়ল।” তারপরই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি জানি কেন দেখা করতে বলেছেন। দুটো সেঞ্চুরির জন্য দুটো ব্যাট আমার পাওনা হয়েছে। না পেলে আমি যাব না আর।”

“কিন্তু আমাদের ক্লাব গরিব, কুড়িয়ে বাড়িয়ে কোনওক্রমে টিকে আছে। তুমি এই দিকটা নিশ্চয় বিবেচনা করবে।”

“আমিও গরিব। কুড়িয়ে বাড়িয়েই চলে আমাদের সাতজনের সংসার। বাবার যা রোজগার তাতে টেনেটুনে পনেরো দিনের বেশি চলে না। আমি বড়ছেলে, প্রি-ইউ পাশ, মাঝে মাঝে ফুটবল খেলার কয়েকটা টাকা বাড়িতে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই সাহায্য করতে পারি না। ব্যাট দুটো পেলে বিক্রি করে কিছু টাকা মাকে দিতে পারব। ক্লাব যদি ব্যাটের বদলে তার দামটা দেয় তা হলে আমি যাব। আমার এখন একটা চাকরি দরকার।”

“চাকরি বা টাকা, কোনওটা দেওয়াই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

“তা হলে আমার পক্ষেও খেলা সম্ভব নয়।”

কথাটা ননীদাকে জানালাম। শুনে মুখখানা কেমন যেন হয়ে গেল। বিমর্ষকণ্ঠে বললেন, “দেখি, টাকাটা জোগাড় করতে পারি কি না। ও থাকলে এবার আমরা ঠিকই চ্যাম্পিয়ন হব।”

রুপোলি সঙ্ঘের সঙ্গে খেলার দিন তন্ময়কে কিটব্যাগ হাতে হাজির হতে দেখে অবাক হলাম। ননীদা কোন স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করে ওকে হাজির করালেন, সেটা জানার জন্য ননীদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “টাকা পেলেন কোথায়?”

“কীসের টাকা?”

“ব্যাটের দাম না পেয়েই তন্ময় এল?”

“ওহ!” ননীদা হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে কী যেন মনে করতে চেষ্টা করলেন, তারপরই যেন মনে পড়ল।

“পিচটা দেখেছ কি? দুর্যোধনকে বলেছিলুম আজ যেন একদম জল না দেয়। ওদের একটা ভাল স্পিনার আছে…” বলতে বলতে ননীদা মাঠের দিকে প্রায় দৌড়লেন।

তন্ময়কে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, আজ সকালে ননীদা একশো টাকা ওকে দিয়ে এসেছেন। আরও তিরিশ টাকা দেবেন ওমাসে। ননীদা এবং ক্লাব দুয়েরই অবস্থা জানি, তাই বিস্মিত হয়ে যখন ভাবছি টাকাটা এল কোত্থেকে তখন একগাল হেসে চিতু প্যাভেলিয়ানে ঢুকল। দু’-চারটে কথা হবার পরই চিতু বলল, ‘হ্যাঁরে, তোদের ক্লাবে একটা ছেলে নাকি দারুণ ব্যাট করছে? আজ খেলবে নাকি?’

আমি ঘাড় নাড়লাম। ও বলল, “দেখতে হবে তো কেমন খেলে!”

তন্ময় ৭৫ করে রান আউট হল। আমিই ছিলাম নন-স্ট্রাইকার এবং কাজটা ইচ্ছে করেই করলাম। যেভাবে ও খেলছিল তাতে আর একখানা ব্যাট বা তার দাম ওকে দিতেই হত। সুতরাং ননীদা এবং ক্লাবকে বিপদ থেকে বাঁচাবার জন্যই কাজটা করলাম। বলাবাহুল্য খেলাটি ড্র হচ্ছে বুঝেই এ কাজ করেছি। ননীদা কিন্তু ভীষণ খেপে গেলেন। অবশ্য আমার উদ্দেশ্যটা বুঝিয়ে বলতেই ঠান্ডা হলেন। চাপা স্বরে বললেন, “গুড স্ট্র্যাটেজি!”

কিন্তু তন্ময়কে কে যেন ফাঁস করে দিল ব্যাপারটা। প্রথমে আমাকে তারপর ননীদাকে অকথ্য ভাষায় চিৎকার করে তন্ময় কয়েকটা কথা বলল, রুপোলির খেলোয়াড়রা তখন চা খাচ্ছে। আমরা অপমানে মুখ কালো করে বসে রইলাম। চিতু আমাকে বলল, “কীরে, তোদের ননীদাকে যে ঘোল করে ছেড়ে দিল। ছেলেটাকে তা হলে, সামনের বছর আমাদের ক্লাবে নিয়ে নোব।”

আমি তখন অপমানে জ্বলছি। কোনও জবাব দিলাম না।

ছয়

পর পর কয়েকটা ম্যাচ ড্র করে আমরা হঠাৎ লিগ টেবলের মাঝামাঝি কয়েকটা ক্লাবের সঙ্গে সমান হয়ে গেলাম। উপরের তিনটি ক্লাবও সমান পয়েন্ট করে এক সঙ্গে প্রথম স্থানে রয়েছে। তার মধ্যে রুপোলি সঙঘও আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের মাত্র দুটি পয়েন্টের তফাত।

ননীদার ইচ্ছা নয় চ্যাম্পিয়ানশিপ লড়াইয়ে। ফার্স্ট ডিভিশনে উঠলে তো ক্লাবের খরচ বেড়ে যাবে। এখনই আমরা পাউরুটি আর আলুর দম দিয়ে লাঞ্চ শুরু করেছি। প্লেয়াররা রীতিমতো অসন্তুষ্ট। আমি কিন্তু চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইট করারই পক্ষে। ফার্স্ট ডিভিশনে যে করেই হোক একবার উঠতেই হবে। পরের বছরই নয় নেমে যাব, তবু তো বলতে পারব আমার অধিনায়কত্বে সি সি এইচ একবার ফার্স্ট ডিভিশনে উঠেছিল। প্লেয়ারদের ক’দিন ধরেই তাতাচ্ছি ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার ইজ্জতের লোভ দেখিয়ে।

ক’দিন ধরে ননীদা মাঠে আসছেন না। একটা ম্যাচ খেলা হয়ে গেল ননীদার উপস্থিতি ছাড়াই। আমরা জিতলাম শুধু ফিল্ডিং-এর জোরে। বেলেঘাটা স্পোর্টিং-এর কাছে আচমকা রুপোলি সঙঘ এক উইকেটে হেরে আমাদের সমান হয়ে গেল। হঠাৎ আমার তন্ময়কে মনে পড়ল। এই সময় ও যদি থাকত, তা হলে বাকি ম্যাচ ক’টা বোধহয় জিততে পারব, এই রকম একটা ধারণা আমার মনে উঁকি দিতে লাগল। ভাবলাম ননীদাকে বলি, যদি দরকার হয় হাতে-পায়ে ধরেও তন্ময়কে বাকি ক’টা ম্যাচ খেলবার জন্য ডেকে আনি।

বলমাত্র ননীদা তেলে বেগুন হয়ে উঠলেন।

“তোমার লজ্জা করে না, মতি? যেভাবে, যে ভাষায় বাইরের টিমের সামনে আমাদের অপমান করেছে, তারপরও তুমি ওকে আনতে চাও? কী আছে ওর খেলায়, য়্যাঁ? কী আছে? নেমেই দুমদাম ব্যাট চালায়, বরাতজোরে ব্যাটে বলে হয়ে গেছে তাই রান পেয়েছে। একটু বুদ্ধিমান বোলারের পাল্লায় পড়লে তিন বলে ওকে তুলে নিয়ে যাবে। ক্রিকেট অত সোজা ব্যাপার নয়, এটা ফুটবল নয় যে গোল খেলেও গোল শোধ দেওয়ার সুযোগ পাবে। প্রত্যেকটা বলের ওপর ব্যাটসম্যানের বাঁচামরা নির্ভর করে, একটা ভুল করেছ কী তোমার মৃত্যু ঘটে যাবে। কী ভীষণ ডিসিপ্লিনড হতে হয়, কী দারুণ কনসেনট্রেশন দরকার হয় বড় ব্যাটসম্যান হতে গেলে। তোমার ওই তন্ময়ের মধ্যে তা কি আছে?”

আমি চুপ করে ননীদার উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই লোকটিই মাসখানেক আগে যার ব্যাটিং দেখে উচ্ছ্বসিত হতেন আর আজ তাকে ব্যাটসম্যান বলতে রাজি নন! ননীদা একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “তোমার বউদির একটা বালা বিক্রি করে টাকাটা দিয়েছিলাম। ওর তো মাথা খারাপ, বালা দিয়ে আর কী করবে? ভেবেছিলাম টাকা পেয়ে তন্ময় ক্লাবে থাকবে। খেলাটাই বড় কথা, টাকাটা সব কিছু নয়।”

বাড়িতে ফিরে দেখি তন্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথমেই বলল, “মতিদা, আমি খেলব।”

অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, “হঠাৎ যে!”

ও ইতস্তত করল কিছু বলার জন্য। মাথা নামিয়ে রইল। আমি আবার বললাম, “খেলবে, সে তো ভাল কথা, কিন্তু আর আসবে না বলে আবার নিজে থেকেই এসে খেলতে চাইছ, ব্যাপার কী?” .

তন্ময় বলল, “আমার একটা চাকরি পাবার সম্ভাবনা আছে ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাঙ্কে। ওরা ক্রিকেট টিম করে লিগে সামনের বছর খেলবে। প্রায় তিনশো টাকা মাইনে। ক্রিকেট সেক্রেটারি আর ডেপুটি ম্যানেজার আমার খেলা দেখতে চায়।”

“তা হলে সামনের রোববার খেলো। একটা ক্রুশিয়াল ম্যাচ রয়েছে কসবা ভ্রাতৃসঙেঘর সঙ্গে। যদি জিততে পারি তা হলে ফ্রেন্ডস স্পোর্টিং আর আমরা সমান পয়েন্ট হয়ে লিগ টেবলের টপে চলে যাব। রুপোলি তা হলে দু’পয়েন্ট পিছিয়ে যাবে আমাদের থেকে।” বলতে বলতে আমার হাসি পেল। রুপোলি সঙঘ আমাদের পিছনে থাকবে এটাই বড় কথা লিগ চ্যাম্পিয়ান হই বা না হই— এই মনোভাব দেখছি আমার মধ্যেও বদ্ধমূল হয়ে গেছে।

তন্ময় বলল, “ননীদা কোনও আপত্তি করবেন না তো?”

“করে যদি তো কী হবে?” আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম, “আমি ক্যাপ্টেন, আমি যাকে খেলাব সেই খেলবে। কেউ আপত্তি করলেও শুনব না।”

ননীদা কিন্তু আপত্তি করলেন না তন্ময়কে দেখে। রবিবার আমাদের মাঠেই ভ্রাতৃসঙ্ঘের সঙ্গে খেলা। সাতজন মাত্র আমাদের প্লেয়ার হাজির হয়েছে। শুকনো মুখে আমি আর ননীদা তাঁবুর বাইরে যাচ্ছি আর ফিরে আসছি। খেলার কুড়ি মিনিট মাত্র তখন বাকি। এমন সময় তন্ময় পৌঁছল। ননীদা কপাল এবং ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন।

বললাম, “তন্ময় আজ খেলবে।”

“আমি তো জানতাম না। টিমে তো ওর নাম দেখছি না।”

“আপনাকে বলতে ভুলে গেছি আজ তন্ময় খেলছে। টিমের কাউকে বসিয়ে দিয়ে ওকে খেলালেই হবে।” আসলে আমি ইচ্ছে করেই আগে বলিনি। ননীদা যদি ব্যাগড়া দেন এই ভয়ে।

‘টিমে যে আছে তাকে বিনাদোষে বসানো উচিত নয়।” এই বলে ননীদা আবার তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তন্ময়কে না খেলিয়ে উপায় ছিল না। চারজন খেলোয়াড় আর এলই না। লিগের শেষ দিকে এই রকমই অবস্থা হয় আমাদের ক্লাবে।

তন্ময়কে নিয়ে আটজন। অবশেষে ননীদাকেও নামতে হল। একটা বাড়তি ট্রাউজার্স আমার ব্যাগে থাকেই। সেটা পরলেন। ঝুলে বড়, কোমরে ছোট, ঘের অর্ধেক। কেডস জোগাড় হল। সাদা পাঞ্জাবিটা ট্রাউজার্সে গুঁজে নিলেন। আমরা টসে জিতে ন’জনে ফিল্ড করতে নামলাম।

ননীদা স্লিপে প্রথম দু’ওভারে তিনটি ক্যাচ ফেললেন। তা সত্ত্বেও ভ্রাতৃসঙ্ঘ সুবিধা করতে পারল না, আমাদের নতুন মিডিয়াম পেসার ছেলেটির বলে। তিন উইকেটে ৭৪ থেকে সবাই আউট হল ৯৬-এ।

ননীদা বললেন, “আমাকে উপরদিকে ব্যাট করতে পাঠিয়ো না, মাঝামাঝি রেখো।”

তন্ময় একটি লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। সে আমার দিকে হাত তুলে ছুটে এল। “মতিদা, ওরা এসেছে।”

“তা হলে ওয়ান ডাউন যাও।”

“না না, আর একটু তলায় দিন।”

তন্ময়কে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে। নিজের উপর যেন আস্থা রাখতে পারছে না। বললাম, “খেলা যদি দেখাতে চাও তা হলে তলার দিকে ব্যাট করে লাভ কী হবে। যদি সবাই আউট হয়ে যায়, তুমি শুধু নট আউটই থাকবে। কিন্তু ওরা এসেছে তোমার স্কোর দেখতে।”

আমাদের দুই উইকেটে ২২, তখন তন্ময় নামল। নেমেই প্রথম বলে একস্ট্রা কভারে চার। হাঁফ ছাড়লাম আমি অপর উইকেটে দাঁড়িয়ে। এরকম কতকগুলো মার মারতে পারলে কনফিডেন্স পাবে। ৩২ রানের মাথায় আমি স্টাম্পড হলাম ভ্রাতৃসঙেঘর অফস্পিনারের বল হাঁকড়াতে গিয়ে। এরপরই তন্ময়ের খেলা কেমন যেন গুটিয়ে গেল। ১১ রান করে ও আর ব্যাট তুলতেই চায় না। আধ ঘণ্টা কোনও রান করল না।

ননীদা হঠাৎ আমায় বললেন, “ব্যাটিং অর্ডারটা একটু বদলাও, এরপর আমি ব্যাট করতে যাব।” শুনে ভাবলাম, ব্যাপার কী! তন্ময়কে আউট করিয়ে দেবার মতলব নেই তো! বললাম, “ননীদা আমাদের তো দু’জন কম। আপনি যদি ফাইভ কি সিক্স ডাউন যান তা হলে ভাল হয়। শেষ দিকে আটকাবার কেউ নেই।”

কী ভেবে ননীদা বললেন, “আচ্ছা।”

পরপর আমাদের দুটো উইকেট পড়ল ৪৬ ও ৪৯ রানে। ননীদা খুব মন দিয়ে খেলা দেখছেন। একবার আমাকে বললেন, “অফ স্পিনারটা ভাল ফ্লাইট করাচ্ছে। তন্ময়টা বোকার মতো খেলছে, এখুনি শর্ট লেগে ক্যাচ দেবে।”

হঠাৎ চিতুকে দেখি আমাদের স্কোয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে স্কোর বুকে উঁকি দিচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, “পাঁচ উইকেটে উনপঞ্চাশ, পারবি না তোরা। হাতে আছে তিন উইকেট সাতচল্লিশ তুললে তবেই জিত। পারবি না, হেরে যাবি।” বলে চিতু হাসতে লাগল।

“তোর খেলা নেই আজ?”

“হচ্ছে, গ্রিয়ার মাঠে। আমরা ব্যাট করছি। আমি আউট। ভাবলাম, দেখে আসি এ মাঠে কী হচ্ছে! আমরা প্রায় জিতে গেছি। তোদের তো শোচনীয় ব্যাপার।”

মাঠে একটা হায় হায় শব্দ উঠল। তন্ময়ের সহজ ক্যাচ শর্ট লেগ ফেলে দিয়েছে। তন্ময়ের মুখ পাংশু। পঞ্চাশ মিনিট খেলে করেছে ১৮ রান, যা কখনও হয় না।

“ব্যাপার কী? তন্ময় যে আজ এমন করে খেলছে?” ননীদা প্যাড পরতে পরতে আমায় বললেন।

“একটা ব্যাঙ্কে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ওর আছে। ব্যাঙ্কের এক কর্তা ওর খেলা দেখতে এসেছে। তাই খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে।”

“সেলফিশ! নিজের জন্য খেলছে, টিমের জন্য খেলছে না!” গম্ভীর হয়ে ননীদা বললেন আর তখনই ৫৭ রানের মাথায় আউট হল যষ্ঠ ব্যাটসম্যান। অফস্পিনারের পঞ্চম শিকার।

“তোদের হয়ে গেল!” চিতু চেঁচিয়ে বলল, ননীদা মাথা নিচু করে গ্লাভস পরছিলেন। একবার চিতুর দিতে তাকালেন।

উইকেটে পৌঁছে তন্ময়কে ননীদা কী যেন বললেন। অফস্পিনারটি বল করছে। ননীদা প্রত্যেকটা বলে পা বাড়িয়ে ব্যাটটা শেষ মুহূর্তে তুলে নিয়ে প্যাডে লাগাতে লাগলেন। ওদিকে হঠাৎ তন্ময় পর পর দুটো স্ট্রেট ড্রাইভ থেকে আট রান নিল।

ননীদার দিকে রয়েছে অফস্পিনার বোলারটি। ওকে একটার পর একটা মেডেন দিয়ে যেতে লাগলেন ননীদা। কিন্তু তন্ময়কে এদিকের উইকেটে খেলতে দিচ্ছেন না। দু’-একবার রান নেবার জন্য তন্ময় ছুটে এসেছে, ননীদা চিৎকার করে বারণ করেছেন।

নিজের ৪৮ রানে পৌঁছে তন্ময় গ্লান্স করেই দৌড়ল দুটি রান নিয়ে হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করবে বলে। দৌড়বার আগে লক্ষই করেনি শর্ট স্কোয়্যার লেগ বল থেকে কতটা দূরে। তন্ময় যখন পিচের মাঝামাঝি ননীদা ওকে ফেরত যাবার জন্য চিৎকার করছেন। তন্ময় ফিরে তাকিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। আর কিছু করার নেই তার। স্কোয়্যার লেগের ছোড়া বল উইকেটকিপার ধরছে। তন্ময় চোখ বন্ধ করে ফেলল।

“হাউজ্যাট?” চিৎকারে অন্য মাঠের লোকও ফিরে তাকাল। তন্ময় আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখল ননীদা হাসছেন। তারপর মাথাটা কাত করে রওনা হলেন। তন্ময় চোখ বুজিয়ে থাকায় দেখতে পায়নি, ননীদা কখন যেন ছুটে তাকে অতিক্রম করে নিজে রান আউট হলেন।

ননীদা প্যাড খুলছেন। বললাম, “কী ব্যাপার?”

বললেন, “ক্রিকেটে অসাবধান হলেই যেমন মৃত্যু আছে তেমনি আত্মহত্যাও আছে। সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি করে এখন আর আমার হবেটা কী? তার থেকে যার ভবিষ্যৎ আছে, সে খেলুক।”

পরের ওভারে তন্ময় দুটি ওভার বাউন্ডারি মারল। আমরা জিতে গেলাম। ওকে কাঁধে তুলে আনার জন্য আমরা মাঠে ছুটে গেলাম।

বহুক্ষণ পর, তাঁবু তখন প্রায় ফাঁকা। দুর্যোধন এসে আমায় বলল, “বাবু দেখিবারে আসো।”

ওর সঙ্গে তাঁবুর পিছনে গিয়ে দেখি ফেন্সের ধারে তন্ময় ব্যাট নিয়ে একটা কাল্পনিক বলে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলে স্ট্যাচুর মতো হয়ে আছে। আর ননীদা পিছনে দাঁড়িয়ে।

“দ্যাখো, পা-টা কোথায়? বলের লাইনের কত বাইরে? কাল থেকে দু’শোবার রোজ স্যাডো প্র্যাকটিস করবে। দু’শোবার!”

১৩৭৮

অলংকরণ: সুধীর মৈত্র

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন