সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার

পৌলোমী সেনগুপ্ত

ওপরে নীল আকাশ, সেখানে চতুর্দশীর চাঁদ। দু’-তিনটে সাদা মেঘের নৌকোর শরীরে চাঁদটা সাঁটা, তাই তার আলো বেশ হালকা। অবশ্য তাতেই পাহাড়টাতে চিনতে কোনওরকম অসুবিধে হচ্ছে না। বেশ খাড়াই পাহাড়, যার খাঁজে খাঁজে অন্ধকার। পাহাড়টা এমন ন্যাড়া যে, সবুজ রংটা ওর শরীর থেকে উধাও। পেট বরাবর একটা বিশাল পাথর বেরিয়ে এসেছে চাতালের আদলে, ঠিক ঝুল-বারান্দা। সেখানেই চাঁদ যেন টর্চের আলো ফেলে রেখেছে। পাহাড়ের নীচে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না, কারণ সেটা চোখের আড়ালে।

ক্রমশ পাহাড়টা আরও বড় হয়ে গেল। এখন চোখের সামনে জুড়ে আছে ওই চাতালটা। পাহাড়ের অন্য অংশ আর দেখা যাচ্ছে না। চাতালটার বুকে ছড়ানো রয়েছে বড় বড় পাথর। তার একদিকে জ্যোৎস্নায় চকচকে, অন্যদিকে অন্ধকার। কোনও শব্দ নেই, কোনও প্রাণের অস্তিত্ব নেই। রাত বলেই হয়তো পাখিরাও দেখা দিচ্ছে না। হঠাৎ একটি পাথরের আড়ালের অন্ধকার নড়ে উঠল। তারপর সেখান থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে এল একটি লম্বা মানুষ। চাঁদের আলো তার চকচকে কালো পোশাকে জমে গেল। পা থেকে কাঁধ পর্যন্ত শরীর আঁকড়ে থাকা কালো পোশাক, শুধু কাঁধের পেছন থেকে আর একটা কালো কাপড় পেখমের মতো ছড়ানো। লোকটার মাথায় একটা কালো রবারের মতো কিছু যা তার চুল এবং ঘাড়কে চেপে রেখেছে। কিন্তু তার কপালের শুরু থেকে চিবুক পর্যন্ত উন্মুক্ত। ফলে বোঝা যাচ্ছে ওর মুখ বেশ মিষ্টি, বিশেষ করে হাসিটা। গায়ের রং যে অত্যন্ত গৌর, তা ওই মুখেই মালুম হয়। চোখ টানা টানা, হাসির সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে গেছে। কিন্তু লোকটা যখন কয়েক পা হেঁটে উন্মুক্ত চাতালে এল, তখন বোঝা গেল এতক্ষণ ও সন্ত্রস্ত ছিল। এখনও হাবভাবে তার রেশ রয়েছে। যেন তার শত্রুর উপস্থিতি আশঙ্কা করছিল সে। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে চাঁদের দিকে তাকাতেই লোকটার সুন্দর মুখ আরও সুন্দর হয়ে উঠল।

হঠাৎ দুটো হাত দু’দিকে ছড়িয়ে লোকটা চিৎকার করে উঠল, “কোথায় সে? আমি তাকে চাই। এই দুটো হাত দিয়ে তাকে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলব। কোথায় সে?”

শব্দগুলো পাহাড়ের শরীরে আছড়ে পড়তেই কয়েকগুণ হয়ে ফিরে এল। লোকটা তার প্রসারিত একটি হাত চাঁদের দিকে নিয়ে গেল। “তুমি! কেন যে চিরটাকাল কৃষ্ণপক্ষ হয় না!”

তখনও চাঁদের কোনও পরিবর্তন ছিল না। শুধু মেঘের নৌকোগুলো যেন গায়ে গায়ে সরে এল। জ্যোৎস্নায় মাখামাখি চাতালটায় লোকটা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে কয়েকবার পায়চারি করে নিয়ে আচম্বিতে এক হাঁটু ভেঙে নিচু হল। তার দুটি মুষ্টিবদ্ধ হাত সামনে নিয়ে চিৎকার করে উঠতেই একটা বিশাল কালো পাখি উড়ে এল শূন্য থেকে। ডানায় শব্দ হতেই লোকটা হিংস্র চোখে তাকাল। আর ওই মুহূর্তে দেখা গেল, ওর সুন্দর মুখ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গৌরবর্ণ চামড়া, টানা হাসি হাসি চোখের বদলে কয়েকটা শুকনো হাড়ে গড়া মুখ দেখা গেল, যার দুই চোখের বদলে অন্ধকার। লোকটার মুষ্টিবদ্ধ হাতের ওপর পাখি নরম পায়ে বসতেই ওর জাত জানা গেল। ওই কুৎসিত চেহারা একমাত্র শকুনেরাই অর্জন করেছে।

“কোথায় সে? দেখেছিস?”

ন্যাড়া মাথার পাখিটা শরীর দোলাল। না, সে দেখেনি।

সঙ্গে সঙ্গে তাকে আছড়ে ফেলল লোকটা শূন্যে। “অপদার্থ! যা, যেমন করেই হোক তার হদিশ নিয়ে আয়। তাকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। দূর হ, দূর হ আমার সামনে থেকে।” ক্রীতদাসের মতো পাখিটা ডানায় সাঁতার কেটে অন্ধকার থেকে অন্ধকারে চলে গেল সন্ধানে।

লোকটা সেই যাওয়া দেখল। তার চোখের বদলে নরকের অন্ধকার। মুখের গহ্বরে জিহ্বার বদলে চিতার অগ্নিশিখা। অথচ যেই সে দুটো হাত তার দুই গালে আদরের ভঙ্গিতে বোলাল, অমনি সেই সুন্দর কন্দর্পকান্তি মুখ ফিরে এল। আবার সুন্দর করে হাসল লোকটা। তারপর পায়ে পায়ে চলে এল চাতালের ধারে।

এইবার দেখা গেল নীচের খাদ কত গভীর। তাল তাল অন্ধকার সেখানে স্তুপ করে রাখা। লোকটা সেদিকে তাকিয়ে আবার হাসল। তারপর চকিতে চাঁদের দিকে ঘুরে চিৎকার করে উঠল, “তোমরা শুধু সামনেটাই ধুয়ে দিতে পারো, কিন্তু পেছনটা? পেছনটা আমার অধিকারে। সেখানে তোমাদের কোনও কায়দা চলবে না। অতএব এই পৃথিবীর অর্ধেক আমার। কিন্তু আমি এবার পুরোটা চাই। সে কোথায়?” তারপর নিচু গলায়, যেন নিজেকেই শোনাল, “আমি যেমন তাকে খুঁজছি, সে-ও তো আমাকে। অতএব দেখা হবেই।” তারপর দুটো হাত শূন্যে বাড়িয়ে লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়ল চাতাল থেকে, ঠিক শকুনের মতো নীচে নেমে যেতে লাগল সে।

পাহাড়ের নীচেও কোনও গাছপালা নেই। ছোট বড় প্রচুর পাথর ডিঙিয়ে হঠাৎই বালির রাজত্ব শুরু। দিগন্তে ছড়ানো শুধু বালি আর বালি, দু’-একটা কাঁটাঝোপ আর মাঝে মাঝে এমন ন্যাড়া পাহাড়। দূর বহুদূর থেকে বয়ে আসা বাতাস সেই বালি তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি ছুটে এসে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খায়, এবং ফিরে যায়। বালিতে শরীরের অর্ধেক গোঁজা, একটা বিশাল পাথরের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। তার চোখ এবং কান সতর্ক। কিন্তু এর শরীরে হালকা নীল-রঙা পোশাক। পা-আঁটা প্যান্ট, কোমরে চামড়ার বন্ধনী, লম্বা-হাতা হালকা নীলশার্টের প্রান্ত সেই বন্ধনীর নীচে। মাথায় কোনও আড়াল নেই। মানুষটির গায়ের রং শ্যামলা, চোখ-মুখ সাধারণ মানুষের মতো। শুধু তার শরীর ছিপছিপে এবং চোয়ালের গঠনে বোঝা যায়, ওর চরিত্রে দৃঢ়তা আছে। কাঁধের পেছন থেকে ঝালরের মতো একটা কাপড় তারও।

লোকটি সতর্ক চোখে বাতাসের যাওয়া-আসা দেখল। জ্যোৎস্নায় সন্দেহজনক কিছু নেই। ঠিক এইসময় সে বাতাসে সামান্য শব্দ পেতেই পাথরের আড়ালে সরে এল। জ্যোৎস্নায় ছায়া ফেলে শকুনটা একটা পাক দিল। তার নাক ঘ্রাণ পাচ্ছে, অথচ চোখে কিছু ঠেকছে না। ক্রমশ পাকগুলো ছোট হয়ে এল। লক্ষ্যবস্তুর সন্ধানে তার কুৎসিত মাথাটা চারপাশে নড়ছে।

শেষপর্যন্ত নিঃশব্দে শকুনটা এসে সেই পাথরের ওপর বসল, যার পেছনে নীলবসন মানুষটি লুকিয়ে রয়েছে। শকুনের ভঙ্গিতে বেশ ঘাপটিমারা ভাব, যেন দর্শন পাওয়ামাত্র সে উড়ে যাবে খবর দিতে। লোকটি নিশ্বাস বন্ধ করে পাখিটাকে দেখছিল। একটা সাধারণ পাখি এরকম সন্দেহজনক আচরণ করবে কেন? সে তার কোমরবন্ধনী খুলে আচমকা আঘাত করতেই শকুন তীব্র চিৎকার করে উড়ে যেতে চাইল, কিন্তু পরিবর্তে পাথরের ওপর থেকে বালিতে গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সে প্রাণহীন হয়নি, কারণ তার চোখ হিংস্র এবং সে দুই পায়ের আঁচড়ে বালির ঝড় তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার ডানা অসাড় হয়ে যাওয়ায় সে স্থির হয়ে চেয়ে রইল একসময়। লোকটি ঝুঁকে দেখল শকুনের শরীর থেকে যে ধারা বের হচ্ছে, তার রং কালো।

নীলবসনের চোয়াল আরও শক্ত হল। কিন্তু সে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি মরতে চাও?”

সঙ্গে সঙ্গে শকুনের মাথাটা যেন কুঁকড়ে উঠল, দৃষ্টিতে বোঝা গেল প্রাণ বড় আদরের।

নীলবসন হাসল, “রক্ত যার কালো, তার বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। কিন্তু তবু তোমাকে আমি সুযোগ দিচ্ছি। সে কোথায়?”

শকুনের বাকশক্তি নেই। সে অসহায়ভাবে ডানা ঝাপটাতে লাগল। যার অর্থ, সে শক্তিহীন। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই। নীলবসন দেখল ওই দুরবস্থাতেও শকুনের চোখে হিংস্র হাসি। সে তার চামড়ায় মোড়া পা তুলল শকুনটাকে হত্যা করার জন্যে, কিন্তু তারপরেই মত পরিবর্তন করল। একটি আহত প্রাণীকে হত্যা করার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই।

তখন চাঁদ ঠিক মাথার ওপরে। মেঘের নৌকোগুলো উধাও। চারধারে তকতকে জ্যোৎস্না। নীলবসন সামান্য লাফানোর ভঙ্গি করতেই তার দেহ ওপরে উঠে যেতে লাগল। অনেক ওপরে উঠে সে চাতালটাকে দেখতে পেল। শূন্য চাতালে কয়েকটা ছোট বড় পাথর ছড়ানো। সেখানে চাঁদ-সাদা রং। নীলবসন সেই চাতালে নেমে এল। সতর্ক চোখে সে চারপাশ দেখে নিয়ে চাঁদের মুখোমুখি হল। “আমি বাতাসে তার ঘ্রাণ পাচ্ছি। তার প্রতিনিধিকে খানিক আগে দেখে এসেছি। এই নিস্তব্ধ চরাচরে তোমার দৃষ্টির আড়ালে কেউ যেতে পারে না। সুতরাং তুমিই বলতে পারো সে কোথায়!”

তখনও চাঁদের কোনও পরিবর্তন হল না। নীলবসন আক্ষেপে তার ডান হাত তুলতেই চাতালে ছায়া পড়ল। চকিতে ঘুরে দাঁড়াল সে। এই বিশাল চাতালে তার নিজের দীর্ঘ ছায়া লুটিয়ে আছে। দু’পা সরতেই ছায়াটাও সরে এল। তার মানে চাঁদ সর্বত্রগামী নয়। সে পাথরগুলোর দিকে তাকাল। ওদের পেছনে জ্যোৎস্না যাচ্ছে না। অতএব ওই আড়ালে কেউ লুকিয়ে থাকলে চাঁদের চোখে পড়বে না। পৃথিবীর অর্ধেকটা আলোকিত, অর্ধেক অন্ধকার। নীলবসন নিজের কোমরে হাত দিয়েই চমকে উঠল। তার কোমরবন্ধনী? তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল, পাখিটাকে আহত করে ওটাকে সে পাথরের ওপরেই ফেলে এসেছে।

আর দেরি করল না নীলবসন। চাতালের প্রান্তে গিয়ে সে দুটো হাত সামনে প্রসারিত করে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তেই তার শরীর পাখির মতো নীচে নেমে যেতে লাগল। ধুধু বালির ওপর দাঁড়িয়ে সে মুখ তুলতেই কৃষ্ণবসনকে দেখতে পেল। বালির প্রান্তে পাহাড়ের তলায় কৃষ্ণবসন, তার অন্ধকারের চোখ জ্বলছে। মুখে কয়েকটা হাড়ের বাঁধন। কৃষ্ণবসনের ডান হাতে আহত শকুন আর বাঁ হাতে ফেলে-আসা কোমরবন্ধনী। চোখাচোখি হতেই প্রচণ্ড গর্জন করে কৃষ্ণবসন শকুনটাকে ছুড়ে দিল নীলবসনের দিকে।

আচমকা চোখের সামনে সমুদ্রের ঢেউ উঠে এল। ঢেউয়ের ওপর একটি শীতল পানীয় বোতলে ভাসছে। পৃথিবীর সবরকম কানফাটানো সংগীত বেজে যাচ্ছে দৃশ্যটির সঙ্গে। এতক্ষণ দু’হাতে আঁকড়ে থাকা রবারের বড় বলটা আচম্বিতে ছুড়ে দিল কালোশার্ট নীলশার্টের দিকে। টিভির পর্দায় দৃশ্যান্তর হওয়ামাত্র নীলশার্ট সতর্ক ছিল, কিন্তু বলের গতি এত দ্রুত যে, সে মাথা সরাতে পারল না। কপালের ওপরে সেটা স্পর্শ করেই ওপরে উঠে গেল। সুন্দর সাজানো ঘরের মাঝখানের ছাদ থেকে পুরনো দিনের ঝাড়লণ্ঠনের আদলে বিজলি বাতি ঝুলছিল। বলটা সেই কাচের ভিড়ে আঘাত করতেই ঝনঝন শব্দ বাজল। কোনওরকম ভাঙচুর না করে বলটা ফিরে আসতেই কালোশার্ট সেটাকে লুফে নিয়ে একটু লাফিয়ে দুটো পা ফাঁক করে চিৎকার করল, “আমি হি-ম্যান। আমি তোমাকে হত্যা করব।”

নীলশার্ট কপালে হাত ঝুলিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল, “কী করে! তোমার গায়ে কালোশার্ট। ওটা ব্যাড ম্যানেরা পরে থাকে।”

কালোশার্ট চকিতে নিজের জামা দেখে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে, এসো, জামা দুটো পালটাপালটি করে নিই।”

“অসম্ভব।” নীলশার্ট এক পা এগিয়ে এল, “আমি হি-ম্যান, আমি তোমাকে হত্যা করব।” তারপর চকিতে টিভি’র দিকে ফিরে সেইরকম গলায় চিৎকার করল, “তোমার দৃষ্টির আড়ালে কেউ যেতে পারে না। অতএব তুমিই বলতে পারো সে কোথায়!”

সঙ্গে সঙ্গে কালোশার্ট চিৎকার করে উঠল, “কোথায় সে? আমি তাকে চাই। এই দুটো হাত দিয়ে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলব। কোথায় সে?”

সামনের পর্দায় তখন একটা অক্টোপাশ তার সবকটা শুঁড় দিয়ে পানীয়ের বোতলটা আঁকড়ে টেনে এনেছে মুখের কাছে। তারপর সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে সেই রঙিন পানীয় ঢেলে দিল গলায়। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র বাজনার সঙ্গে একটি অদৃশ্য কণ্ঠ বলে উঠল, “জল, সর্বত্র জল, শুধু আমাদেরটাই পানীয়।”

দুই দর্শকের মুখ বিকৃত হল। ওরা জানে এখন মিনিট কয়েক এইসব বিজ্ঞাপন চলবে। নীলশার্ট প্রচণ্ড গতিতে ছুটে এল কালোশার্টের দিকে। তারপর ঢিসুম করে একটি ঘুসি চালাতেই কালোশার্ট উলটে পড়ল সোফায়। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নীলশার্ট বলল, “কোথায় সে? আমি তাকে হত্যা করব।”

কালোশার্টের খুব কষ্ট হচ্ছিল। তার চোখে জল বেরিয়ে এলেও সে বলল, “তুমি একটা গাধা! একটা প্যাঁচা! একটা ব্যাং!”

নীলশার্ট ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“তোমার গায়ে নীলশার্ট। তুমি আগে মার খাবে। দমাদম মার। খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত বেল্টটা ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে মারতে পারবে। আজ আমি খতম হব। কিন্তু প্রথমে আমি মারব। সেটাই রুল।” বলতে বলতে উঠে দাড়াল কালোশার্ট।

নীলশার্টের মনে পড়েছে। অতএব সে মার খেতে লাগল। নীলশার্ট পালাতে লাগল। ঘরের এ-কোণ থেকে ওই কোণে। বাইরের দরজায় তালা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। নীলশার্ট পাশের ঘরে ঢুকল আত্মরক্ষার জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে খাটের ওপর লাফিয়ে উঠল কালোশার্ট। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নীলের ওপর। দুটো শরীর ধড়াম করে আছড়ে পড়ল মেঝেতে।

নীলশার্ট ককিয়ে উঠল। তার কোমরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা সত্ত্বেও সে মুখে কিছু বলল না। এই অবস্থায় নীলবসন কখনও কাঁদেনি। তাকে অন্তত পাঁচ মিনিট নির্মমভাবে মারবে ওই কৃষ্ণবসন। তারপর তার পালা। যে মার সে খেয়েছে, তার ডাবল মারতে পারবে। কিন্তু প্রথম পাঁচটা মিনিট যে সহ্য করা মুশকিল। কালোশার্ট তখন টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকে সে ঝাঁপ দেবে নীলশার্টের ওপর, যেমন করে কৃষ্ণবসন পাহাড়ের ওপর থেকে সাঁ করে নেমে আসে। নীলশার্ট উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু ঠিক তখনই তার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কালোশার্ট চিৎকার করে উঠল, “এই পৃথিবীর পুরো দখল চাই আমি। আকাশ থেকে চন্দ্রসূর্য মুছে যাক।” তারপর ঢিসুম করে আর একটা ঘুসি।

সেই বালক-হাতের ঘুসিতে তেমন জোর ছিল না। কিন্তু নীলশার্টের মনে হল আজ কালোশার্ট তাকে খুব বেশি মারছে। সে কোনওরকমে উঠে জানলার কাছে ছুটে গেল। তারপর পাল্লা খুলে উঠে বসে চেঁচাল, “পাঁচ মিনিট হয়ে গিয়েছে।”

কালোশার্টের হাতে তখন একটা চামড়ার বেল্ট। সে মাথা নাড়ল, “না, তিন মিনিট, এখনও দু’ মিনিট বাকি।” এই বলে সে চামড়ার বেল্টটা শূন্যে নাড়াতে লাগল, যেমন করে ক্রুদ্ধ সাপ লেজ নাড়ে।

নীলশার্ট আর পারল না। সে ভয়ে লাফিয়ে পড়ল বাইরের বাগানে। তারপর আত্মরক্ষা করতে ছুটে গেল বাগানের কোণে। সেখানে জঞ্জাল ফেলার খালি ড্রাম পড়ে আছে। আজ বাড়ি থেকে বের হবার আগে মা বাবা ওটা খালি করিয়ে গেছেন। নীলশার্ট টুক করে সেই ড্রামের মধ্যে ঢুকে বসে রইল উবু হয়ে। এইসময় কালোশার্ট বেরিয়ে এল জানলায়। তারপর চিৎকার করল, “কোথায় সে?” তার হাতের বেল্ট বাতাসে আস্ফালিত হচ্ছিল। সে আরও দু’বার চিৎকার করল। কিন্তু তার গলার স্বর ক্রমশ নরম হয়ে আসছিল। নীলশার্টকে সে কোথাও দেখতে পাচ্ছিল না। তার হিসেবমতন পাঁচ মিনিট হয়ে গিয়েছে। এবার তার মার খাওয়ার পালা। কী নির্মম সেই মার। প্রতিদিন বাবা-মা কাছাকাছি থাকায় সেই নির্মম প্রহারের সময় তাঁরা ছুটে এসে রক্ষা করেন। নীলশার্টকে শাস্তির ভয় দেখান। তাই নীলশার্ট এখন জামা বদল করতে চায়। প্রথম মারটা সে মারতে চায়। কিন্তু কালোশার্ট কিছুতেই রাজি হয়নি এতকাল। আজ বাড়িতে বাবা নেই, আজ তাকে কে বাঁচাবে। টিভিতে নীলবসন যখন পালটা মার মারে, কালোশার্ট সে-দৃশ্য কল্পনা করে শিউরে উঠল।

চট করে জানলা বন্ধ করে সে আশ্বস্ত হল। এখন সে ঘরের ভেতরে, বাইরে নীলশার্ট। দরজায় তালা। এখন তার মার খাওয়ার সময়, কিন্তু নীলশার্ট তো ভেতরে ঢুকতেই পারবে না। সে খুশি হল। তারপরেই খেয়াল হল এই বাড়িটায় এখন সে একা। সে চিৎকার করল, “এই পৃথিবীটা এখন আমার। অর্ধেকটা নয়। পুরোটা।”

এইসময় ঢিসুম শব্দটা কানে ছিটকে আসতেই কালোশার্ট টিভির ঘরে ছুটে এল। সেখানে চাঁদের আলোর নীচে কৃষ্ণবসনকে দু’হাতে তুলে নীলবসন আছাড় মারল। “পৃথিবীটা তোর? খুব লোভ? তোর ওই কালো মনটাকে আমি খতম করবই।” তারপর দড়াম করে ছুড়ে দিল মহাশূন্যে। কৃষ্ণবসনের শরীর ভাসতে ভাসতে পৃথিবীর বাইরে চলে যেতে নীলবসন দর্শকের দিকে তাকিয়ে হাসল, “পৃথিবীর কালো দূর হোক।”

সেই হাসির দিকে তাকিয়ে কালোশার্ট শিউরে উঠল। চটপট নিজের জামা খুলে ফেলতে বেশ আরাম মনে হল। তারপরেই খেয়াল হল, নীলশার্ট তো বদলা নিতে এল না। ঘরে ঢুকতে না পারলেও তার চিৎকার শোনা যেত! কী হল তার?

কালোশার্টটাকে সোফার নীচে চালান করে খালি গায়ে সে জানলা খুলে বাগানে বেরিয়ে এল। পাখির ডাক ছাড়া কোনও শব্দ নেই। সমস্ত বাগান খুঁজে সে ড্রামটার কাছে এল। তারপর সন্তর্পণে ভেতরে উঁকি মেরে ডাকল, “বাপি!”

কোনওরকমে মুখটা ওপরে উঠল, “আমাকে আর মারিস না। আমি শার্ট খুলে ফেলেছি।”

ঊর্ধ্বাঙ্গ বিবস্ত্র, বালক কাঁপতে কাঁপতে উঠে দেখল কালোশার্ট নেই। তার যমজভ্রাতা জিজ্ঞেস করল, “তুই আমাকে মারবি না? পাঁচ মিনিট হয়ে গিয়েছে।”

“কী করে মারব? তোর গায়ে তো কালোশার্ট নেই।”

জানলা গলে ওরা আবার ফিরে এল ঘরে। একজন খুব কাহিল, অন্যজন নার্ভাস। টিভির সামনে বসতেই দেখল ঝড় উঠেছে। শোঁ শোঁ করে বালির ঝড় উঠছে। আকাশ অন্ধকার। চাঁদের দেখা নেই। সেই শীর্ণ আলোয় দেখা গেল একটা শকুন আবার আকাশে ডানা মেলল।

আর তখনই একজনের চোখে পড়ল সোফার নীচে ঢুকিয়ে রাখা কালোশার্টের একটা প্রান্ত বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সন্তর্পণে সঙ্গীকে লুকিয়ে সে গোড়ালি দিয়ে কালোশার্টটাকে আরও ভেতরে ঠেলে দিল। যাতে না দেখা যায়। তারপর ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর কষ্ট হচ্ছে?”

১৩৯১

অলংকরণ: প্রণবেশ মাইতি

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন