পৌলোমী সেনগুপ্ত
ক্লাস টেনের ছেলেরাও সাধু কালাচাঁদকে সমীহ করে চলে। তার কারণ অনেক। সে-কথায় পরে আসছি। ক্লাস সেভেনে ঢুকলে দেখা যাবে ডান দিকের ফিফ্থ বেঞ্চে সাধু কালাচাঁদ দেওয়ালের দিকে কোণে বসে আছে। সে কর্মকার না প্রামাণিক, ঘোষ না দত্ত—তা কারও মনে নেই। সবাই সাধু কালাচাঁদ বলেই ডাকে। একবার ওর মা বলেছিলেন, কালাচাঁদ আমার সাধু প্রকৃতির ছেলে। সেই থেকে ওর নামের আগে সাধু।
বড় ঘেরের হাফপ্যান্ট হাঁটুর মালাইচাকি পার হয়ে ঝুলছে। শার্টের গলার বোতাম আটকানো। পায়ে রবারের শু ফিতেবন্দি। দুই কনুইতে দুটি পুরনো পাঁচড়া। কালাচাঁদ তাদের দেশের ভাষায় বলে ‘পায়না’। চোখে একটু ঝিমুনির ভাব।
সারা ক্লাসের অনুরোধে থার্ড পিরিয়ডে সে সাত-আট বার বাঘ ডেকেছে। নতুন ভূগোল-স্যার ওঁত পেতে থেকেও ধরতে পারেননি। শেষ দিকে জি এন মণ্ডল—গোপীনাথ মণ্ডল—শূন্যে বেত ঘুরিয়ে বলে গেছেন, “আমার যা কথা সেই কাজ। ওই বাইশ পাতাই উইকলি পরীক্ষার পড়া। আফরিকার জলবায়ু, নদ-নদী, ভূপরিচয়, বন্যপ্রাণী—যে-কোনও জায়গা থেকে কোশ্চেন আসবে। তারপর দেখছি বাঘ কোথায় যায়।”
নিষ্পাপ মুখ করে সাধু কালাচাঁদ আগাগোড়া বাঘ ডেকেছে। বলে না-দিলে তার ভাবভঙ্গি দেখে কেউ ধরতেই পারবে না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে—সব সময় অন্য কোনও চিন্তায় সে ডুবে আছে। কিন্তু ওই মুখেই সে বাঘ ডাকে, কোকিল ডাকে, কাচ বা ব্লেড চিবিয়ে খায়। আবার দরকারমতো যে-কোনও স্যারের সই জাল করে যে-কোনও ক্লাসের ছেলেকে হাফ ছুটি দিয়ে দেয়।
সে নিজেই বলেছে, আর এক বছরের ভেতর হেডস্যারের সই জাল করে লেট ফি কিংবা ফাইনও মকুব করে দিতে পারবে। এখন ছুটির পর বাড়ি ফিরে সে রোজ তিরিশ বার করে জড়িয়ে জড়িয়ে লেখে—নিবারণচরণ পাকড়াশি। ইংরেজিতে এন সি পাকড়াশি।
সারা স্কুলে এভাবে অসময়ের ছুটিছাটার মালিক হয়ে সে এখন নাইন-টেনের স্টুডেন্টদের কাছেও খাতির পায়। দু’পয়সা আসেও তাতে। ফি না বলে কালাচাঁদ বলে ভিজিট। টেনের জন্যে হাফছুটি পিছু এক আধুলি। নাইনের বেলায় তিরিশ পয়সা। হিংসুটেরা বলে, সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার।
কাছাকাছির ভেতর মডেল স্কুল, বি কে স্কুল থেকেও কল পায় কালাচাঁদ। ভিজিট নিয়ে দর-কষাকষি চলে। রফা হলে স্কুলের খাতায় একখানা আসল সই দেখে কালাচাঁদ হুবহু সই করে দেয়। ফাইন মকুব কিংবা ছুটি-ছাটার দরখাস্তে। কোন স্কুলের কেরানিই বা এ-সব সই যাচাই করার সময় পায়?
ভিজিটের পয়সায় সাধু কালাচাঁদের বাজারহাট ভালই হয়। এসব ব্যাপারকে সে বলে—কেস। অসুবিধায় পড়ে যারা আসে তাদের বলে— পেশেন্ট। সময়টা ভালই যাচ্ছিল। ফি-দিন টিফিনে কালাচাঁদ ঘুগনি খায়। স্কুলফেরত আইসক্রিম। কোনদিন বা বাজারে জেমস কেবিনের পর্দাঢাকা কাঠের কুঠুরিতে বসে হাফ প্লেট ফাউলকারি সাঁটায়। স্কুলের শেষে হাফপ্যান্টের দু’ পকেট ঝমঝম করে বাজিয়ে বাড়ি ফেরে।
নদীর ঘাট, ডাকবাংলোর মোড়, কাছারি পাড়া— সব জায়গায় মনোহারী দোকানদাররা রাস্তা দিয়ে সাধু কালাচাঁদকে যেতে দেখলে ‘কালাচাঁদবাবু’ বলে ডাকে। ‘আসুন আসুন’ বলে ধরে এনে বসায়। সাধু তাদের এটা-ওটার খদ্দের।
কালাচাঁদ নিজেও পঞ্জিকা দেখে মানি অর্ডার করে। কখনও অমৃতসর থেকে ঘড়ি আসে। লুধিয়ানা থেকে মাছ ধরার ছিপ। জম্মু থেকে ছুরি ভরে রাখার জন্যে ভেড়ার শিঙের খাপ।
এরকম পসারের পর কালাচাঁদ তো আর হেঁটে স্কুলে আসতে পারে না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেল রিকশায় ওঠে। আবার স্কুলের একটু আগে বাদামতলায় এসে নেমে পড়ে। শহরের সবচেয়ে নতুন সাইকেল-রিকশাখানা তার খুব পছন্দ। বেশ সাজানো গোছানো। সেখানাই সে মাসকাবারি করে ফেলল। নিচু ক্লাসের ছেলেরা বলে, কালাচাঁদদার প্রাইভেট কার। ক্লাসফ্রেন্ডরা বেটাইমে সেই রিকশায় কালাচাঁদকে যেতে দেখলে বলে, সাধু কলে বেরোল! নিশ্চয়ই কঠিন কেস।
তা দু’-একটা এখন তখন রুগিকে হাতে নিতে হয় তার। বিশেষ করে শীতকালে। জানুয়ারি মাসে। একখানা আসল ট্রান্সফার সার্টিফিকেট সামনে রেখে সে যে-কোনও স্কুলের হেডস্যারের সইসুদ্ধ নিজ দায়িত্বে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দেয়। ভিজিট পুরো পাঁচ টাকা।
গত জানুয়ারিতে মডেলের ক্লাস এইটের বিষ্টু আটশোর ভেতর মোট বারো পেয়ে সাধু কালাচাঁদকে কল দিল। দু’দিন পরামর্শের পর পুরো ভিজিট নিয়ে কালাচাঁদ ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিল। পাঁচ মাইল দূরে পল্লীমঙ্গল স্কুলে গিয়ে বিষ্টু নাইনে অ্যাডমিশন পেল। প্রোগ্রেস রিপোর্টে ভাল ভাল নম্বর। সাধু কালাচাঁদের হাতের কাজ।
কালাচাঁদ’স ওন সলিউশন। কেরোসিন সহযোগে আমরুলি পাতা। খেতে টকটক। যে কোনও শ্যাওলাধরা পুরনো দেওয়ালে ইটের ফাঁকে গজায়। ভাল করে হাতের চেটোয় ডলে নিয়ে তাতে দু’ফোঁটা কেরোসিন ঢেলে নিল কালাচাঁদ। তারপর সেই মিক্সচার দিয়ে পাকা হাতে প্রোগ্রেস রিপোর্টের নম্বরগুলো তুলে ফেলে নতুন নতুন নম্বর বসিয়ে দিল।
একগাদা খুচরো পেশেন্টের চেয়ে এখন দু’-চারটে কঠিন কেস অনেক লাভের। সেরকম রুগি এলে কালাচাঁদ উদাস মুখে বলে, হসপিটালে যাও। কিংবা বলে, চেম্বারে যাও। কড়কড়ে পাঁচ টাকার নোট দেখলে হিংসুটেদের চোখ টাটায়। তাই বুদ্ধি করে কালাচাঁদ তাদের নিজের বাড়ির বারান্দায় যেতে বলে। অনেকটা চেম্বারের মতোই। চাটাই বেড়া দিয়ে ঘেরা বারান্দায় সাধুর পড়াশুনোর ঘর।
চেম্বারের প্র্যাকটিস বেড়ে যাওয়ায় কালাচাঁদ একদিন ঘোষণা করল, “আর ভাই প্রাইভেট প্র্যাকটিস পোষাচ্ছে না। মাথার কাজ। চাপ পড়ে ভীষণ। যার যা কেস তা নিয়ে হসপিটালে গেলে পারো।”
ক্লাসে বসে যে-সব জালিয়াতি করতে হয় তার নাম দিয়েছে প্রাইভেট প্র্যাকটিস। আসলে সবার সামনে নিতে হয় বলে ভিজিট সামান্য। তাই কালাচাঁদ ইন্টারেস্ট পায় না। ষণ্ডামার্কা বিশ্বনাথ আবার ভিজিটের ভাগ চায়।
এ-সব পেশেন্ট অত ভিজিট দেবে কোত্থেকে। তাই চেম্বার বা হসপিটাল তাদের দু’চোখের বিষ।
তবু চেম্বারেই ভিড় বাড়তে লাগল। আশপাশ ধরে ছোট বড় আটটা স্কুল। রুগির অভাব হওয়ার কথা নয়। খুব সিরিয়াস কেসে সাধু তার নিজের প্রাইভেট কারে পেশেন্ট দেখতে যায়। এমনিতে সকাল বিকেল পেশেন্ট লেগেই আছে। নদীর ওপারের বেলফুলিয়া হাইস্কুল থেকেও পেশেন্ট আসছে। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পেশেন্টরা আর তার দেখা পায় না। পেলেও মন পায় না। সাধু দায়সারা গোছের দেখে। একটা হাফছুটির কেস তো গুবলেটই হয়ে গেল। ধরা পড়ে পেশেন্ট মার খেয়েও ডাক্তারের নাম কবুল করেনি। সাধুর লাক।
চেম্বারের রুগিরা ভিজিট ছাড়াও ভেট দেয়। ডট পেন, ডাইরি, চকোলেট বার। প্রাইভেট প্র্যাকটিসে সে-সব কিছুই নেই। তবু এই প্র্যাকটিস থেকেই তো তার নাম ছড়ায়। এর থেকেই তো তার আজকের এই পসার। নামডাক। সাধারণ রুগিদের তাই অভিযোগ।
নিয়তির পরিহাস। সাধু আজ দু’বছর ক্লাস সেভেনেই আছে। তার হাত দিয়ে কত রুগি তরে গেল। নিজে তরেনি। কারণ সাধারণ। সই জিনিসটা দু’ইঞ্চি লম্বা। সেটা সামলানো যায়। কিন্তু লিখিত পরীক্ষার আনসার তো অনেকখানি। সে-সব সাধু সামলায় কী করে। পড়াশুনো জিনিসটা একেই বিচ্ছিরি। তারপর এই পসার হওয়ায় কালাচাঁদ ওদিকে বিশেষ মন দিতে পারেনি। সাধুর সে-জন্যে কোনও আফসোস নেই।
কালাচাঁদ প্রিয় পেশেন্টদের নিয়ে জেমস কেবিনে মাটন কবিরাজি খাচ্ছিল। পেশেন্টরাই খাওয়াচ্ছিল। সাধু খেতে খেতে হাঁফিয়ে উঠল। ভারিক্কি আরামি চালে বলল, “আমার আর পড়াশুনোটা হল না রে।”
মডেল স্কুলের সিক্সের সতীনাথ তার এখন খুব ন্যাওটা। সব সময় সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। অনেকে খাতির করে সতীনাথকে বলে কম্পাউন্ডারবাবু। কারণ সতীনাথ নিজেই শুধু কালাচাঁদকে একা পেলে ডাক্তারবাবু বলে ডাকে। সে-কথা চাউর হয়ে যায়। সাধুরও আসকারা ছিল তাতে। সতীনাথ হাসিহাসি মুখে বলল, “ডাক্তার তোমার চেম্বারের ঝক্কি আগে সামলাও। তারপর ওই এলেবেলে পড়াশুনো আপনাআপনিই হয়ে যাবে।”
লেখাপড়া করে যেই!
গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই!!
সাধুর এই শ্লোকে শোক মেশানো ছিল। তার ক্লাসফেন্ডরা এখন উঁচুতে উঠে অন্য ঘরে বসে। সতীনাথ সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “যেজন্যে লেখাপড়া তার আর বাকি কী! তুমি তো গাড়ি ঘোড়া চড়েই থাকো।”
‘তা যা বলেছিস!”
সেদিন সন্ধেবেলা কালাচাঁদের বাবা অঘোরবাবু আগে কাটা কার্তিকরাঙি ধান বোঝাই দিয়ে নৌকো করে আবাদ থেকে ফিরলেন। ভুলো মানুষ। মনটা খুশি খুশি ছিল। খেতে বসে ছেলেকে বললেন, “কোন ক্লাসে পড়িস?”
“সেভেনে।”
কেমন খটকা লাগল। “গতবারও ধান নিয়ে ফিরে শুনেছিলাম, সেভেন। এবারও সেভেন? কী ব্যাপার?”
সাধুর মা পরিবেশন করছিলেন। বললেন, “আজকালকার মাস্টারমশাই সব আগের মতো তেমন কি আছেন। সব পাশ টেনে চলেন। কালাচাঁদকে দেখবার তো কেউ নেই। তাই আর উঠতে পারেনি।”
“তোমায় সেই কথা বুঝিয়েছে বুঝি।”
অঘোরবাবু গম্ভীর হয়ে খাওয়া শেষ করলেন৷ তারপর হাত মুখ ধুয়ে কালাচাঁদকে প্রশ্ন করে করে সব জেনে তো তাঁর চক্ষুস্থির। এক বছর নয়, অনেকদিন হল কালাচাঁদ ক্লাস সেভেনে।
সাধুর চেম্বারে ঢুকে তিন শিশি সলিউশন পেলেন। গন্ধ শুঁকে কিছু বুঝতে না পেরে অন্ধকার মাঠে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তারপর একখানা খাতা খুলে দেখেন—অসংখ্য সই।
আধঘণ্টা মেরেও কালাচাঁদের মুখ থেকে কিছু বের করতে পারলেন না। কালাচাঁদ মার খায় আর সলিউশনের জন্যে মনে মনে হায় হায় করে ওঠে। গাদা গাদা গার্জেন আর ক্লাস টিচারের নমুনা সই-সুদ্ধ খাতাখানাও অঘোরবাবু ছিঁড়ে কুটি কুটি করলেন। কালাচাঁদ চোখ মোছে আর ভাবে— গেল! গেল!! এতবড় পসারটা মাঠে মারা গেল। বাবা যদি কিছু বোঝে।
“উইকলি পরীক্ষা কবে?”
“শুক্রবার।”
“কী পরীক্ষা?”
“ভূগোল।”
“বই নিয়ে আয়। কতদূর পড়া দেখি। মাঝে তো দুটো দিন মোটে—”
দেখাল কালাচাঁদ। বইখানা কালাচাঁদের হাতে দিয়ে বললেন, “আজ সারারাত ধরে এই বাইশ পাতা মুখস্থ করবে। ঘুমোবে না। কাল সকালে পড়া ধরব।”
কালাচাঁদ পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে সারা পাড়া ঘুমিয়ে পড়ল। বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে সবজির গোরুর গাড়ি যায় ক্যাঁচ কোচ। দু’চাকার মাঝে নীচের হেরিকেনটা হটাং ঘটাং দুলছে।
টেবিল থেকে উঠে কালাচাঁদ অন্ধকার মাঠে নামল। হাতড়াতে হাতড়াতে দুটো ফাঁকা শিশি পেল। তিন নম্বরটা যে কোথায় পড়ে আছে অন্ধকারে। নমুনা সইয়ের খাতার পেছনের আধখানা পেল মাঠের শেষে একদম রাস্তার গায়ে।
সবকিছু তুলে এনে টেবিলে রাখল সাধু। দু’ শিশির কোনওটাতেই সলিউশনের ছিটেফোঁটাও নেই। ছেঁড়া খাতার শেষ বারো পাতায় পল্লীমঙ্গল, মডেল আর বি কে স্কুলের ক্লাস টিচারদের, কিছু গার্জেনের সই আস্ত পাওয়া গেল। অথচ এই খাতা আগে গার্জেনদের সইয়ে গিজ গিজ করত।
খাতার অবস্থা দেখে কালাচাঁদের চোখে জল এসে গেল। বাবা অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশুতি রাত। খাতার পাশেই ভূগোল বই। আফরিকার নদ-নদী চ্যাপ্টারে লাল কালির দাগ। সেখানে কালাচাঁদের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে মিশে গেল। কালাচাঁদ জানে পরের চ্যাপ্টারে আফরিকার পর্বতমালা। কিলিমানজারো না কীসব পর্বতের নাম। তার পায়ের কাছে মরুভূমি।
ডান হাতে মাথা রেখে খাতার ওপরেই সাধু ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভেঙে দেখে তাজ্জব ব্যাপার। বিশ্বাসই হতে চায় না। এ সে কোথায় এসেছে।
উঁচু মালভূমি-মতো জায়গায় পাহাড়ি পথের ওপর লোকালয়। গোলপাতার ঘর। কাঠের দেওয়াল কয়েকখানা বর্শা হেলান দিয়ে দাঁড় করানো। একটা বড় জয়ঢাক পেটাচ্ছে একজন আফরিকান। তার কোমর থেকে কলাপাতার ঝালর ঝুলছে। নীচের উপত্যকা দেখা যায়। সেখানে শীতকালের শান্ত একটা নদী নীল জল নিয়ে পড়ে আছে। তার তীর ধরে তিনটে সিংহী তাদের ছোট বাচ্চাদের নিয়ে খেলছে। নীচে দূরে খানিকটা জায়গায় এক পোঁচ সবুজ ঝকঝক করে উঠল সকালবেলার রোদে। কালাচাঁদ দেখেই বুঝল—ওটা মরূদ্যান। নদীর পারে জার্সি গায়ে একটা জেব্রা এসে হাজির হতেই সিংহের বাচ্চাগুলো তার পায়ের ফাঁকে গলে যেতে লাগল। তিন সিংহী ঠায় বসে তা দেখতে লাগল।
কালাচাঁদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। ফিরে তাকাতেই চিনতে পারল। আরে। এ তো সেই কিলিমানজারো পর্বত। তার সরল ভূজ্ঞানে ন’য়ের পৃষ্ঠায় হুবহু এই ছবি আছে।
কিন্তু সে তো কালাচাঁদ। সে এখানে আসে কী করে? এবারে নিজের দিকে চোখ পড়ল। সে উঁচু ঢিবিতে বসে আছে। তার ডান হাতের কাছে একখানা বর্শা মাটিতে গাঁথা। কোমরে কলাপাতার ঝালর। দু’হাতের দুই কনুইয়ের পায়নাদুটো সেরে গেছে। মাথায় কিলিমানজারো পাহাড়ের কোনও গাছের পাতার মুকুট হবে। গলায় পাথুরে মালা। বেশ ওজন আছে।
দূরে নদীর গায়ে একখানা লম্বা ছিপ এসে ভিড়ল। আসলে আফরিকান মাঝি ছিপখানা তীরে ভিড়িয়ে দিয়ে জলে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজন যাত্রী লাফিয়ে ডাঙায় উঠল। এদিকেই আসছে।
কাছে আসতেই কালাচাঁদ চিনতে পারল।
প্ৰথমজন অঘোর প্রামাণিক। পায়ে রবারের জুতো বালিতে ভরে গেছে। হাফশার্ট। মাথায় একটি আঁব।
দ্বিতীয়জন নিবারণচরণ পাকড়াশি। পায়ে খোলা কাবলি জুতো। বুক-পকেটে খাতা দেখার লাল ডটপেন। হাতে ছাতা।
তৃতীয়জন খালি পায়ে এসেছে। বিশ্বনাথ।
তিনজনই পরিশ্রান্ত। একটা পাথরে বসে হাঁফাচ্ছিল সবাই। অঘোর প্রামাণিক রবারের জুতো উলটে বালি বের করছিলেন! এমন সময় জয়ঢাক থামল।
তিনজনই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠলেন।
“আপনারা কোত্থেকে আসছেন?”
“আপনি বাংলা জানেন?”
“সব জানতে হয়।” বলতে বলতে সাধু দেখল, কেউ তাকে চিনতে পারেনি।
তিনজনই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে জয়ধ্বনি দিল। জয় সাধু কিলিমানজারোর জয়! জয় বাবা কিলিমানজারো!! জয়!!
কালাচাঁদের খটকা লাগল। সে আবার পেছন ফিরে কিলিমানজারো পাহাড়টাকে দেখে নিল। মনে মনে ভাবল, তা মন্দ না। কালাচাঁদ থেকে এক লাফে কিলিমানজারো। কালাচাঁদের আফরিকান বাংলা হয়তো কিলিমানজারো। যে ভাবেই সে এখানে আসুক, হয়তো ভাল পসার জমে যেতে পারে। একবার পসার হয়ে গেলে সে সবার সামনে আত্মপ্রকাশ করবে। তখন সবাইকে দেখিয়ে দেবে—সে আসলে কী। তার আগে নয়।
অঘোর প্রামাণিক বললেন, “আমরা এশিয়ার খুলনা থেকে আসছি।”
“সে তো দেখেই বুঝেছি। কোন পথে এলেন? ভৈরব দিয়ে?”
ওঁরা আশ্চর্য হলেন, “আপনি সব জানেন?”
“জানতে হয়।”
বিশ্বনাথ বলল, “ভৈরব দিয়ে রূপসা নদীতে পড়লাম। তারপর মিপসা। বঙ্গোপসাগর। ভারত মহাসাগর। ভূমধ্য সাগর। আমাজনের মোহানায় নৌকাডুবির জোগাড়। কঙ্গো নদী অনেক ঠান্ডা। শুধু কুমিরের উপদ্রব। নীল নদে ঢুকে জোয়ার পেয়েই পাল খাটিয়ে নিলাম। তিন জোয়ারের পথ পেরিয়ে আপনার ডেরায় এসে হাজির হলাম।”
“পথে ঢেউ পেয়েছিলেন?”
নিবারণচরণ পাকড়াশি বললেন, “প্রবল। ভারত মহাসাগরে অঘোরবাবু বমি করে একাকার করলেন। আমার পকেটে সব সময় মুখশুদ্ধি থাকে। তাই দু’বার খাওয়ালাম। তারপর আর বমি করেননি।”
“আপনি তো জুবিলি স্কুলের হেডমাস্টার?”
এ-কথায় এন সি পাকড়াশির চোখ কপালে উঠল। “জয় বাবা কিলিমানজারো! আপনার দেখছি কিছুই অজানা নয়।”
“ডটপেনটা দিন। কাগজ আছে?”
এন সি পাকড়াশি ডটপেনের সঙ্গে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে নোটবই বের করে দিলেন।
“এই তো আপনার সিগনেচার?”
“আশ্চর্য! আপনি আসলে কে বাবা? আপনি জাতিস্মর না যোগী? জয়! সাধু কিলিমানজারোর জয়!!”
“সেই জি এন মণ্ডল ভূগোল পড়াচ্ছেন?”
“হ্যাঁ বাবা।”
“ওঁকে ড্রিলের ক্লাসে দিন।”
“কিন্তু উনি যে জিয়োগ্রাফি ট্রেনড টিচার—”
“ড্রিলে দিয়ে দেখুন না। ভাল পড়াবেন। এশিয়া থেকে মার্চ করে আফরিকায় চলে আসতে পারবেন। বেশ মজবুত স্বাস্থ্য। কী? প্রস্তাবটা খারাপ?”
“না না। আপনি যখন বলছেন। এর পর আর কী কথা—”
বিশ্বনাথ যেন খুশিই হল। এ হল গিয়ে বাবা কিলিমানজারোর নির্দেশ।
এন সি পাকড়াশি অধীর হয়ে বললেন, “একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি।”
“ভিজিট এনেছেন?”
একখানা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিতে কালাচাঁদ আপত্তি করল। “অত তো নয়।”
“নিন না। এ তো স্কুল ফান্ডের টাকা। পেশেন্ট হল গিয়ে স্বয়ং জুবিলি স্কুল। গত বছর আশপাশের স্কুল থেকে কয়েকটি ভাল ছেলে ভাল ভাল নম্বরসুদ্ধ ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে আমার স্কুলে এসে ভর্তি হয়। এবার টেস্টে তারা সবাই ঢেড়িয়েছে। এদের যদি সেন্ট আপ করি— তা হলে স্কুল ফাইনালে ফেল করে ওরা স্কুলের অ্যাফিলিয়েশনের দরকারি পাশের সংখ্যা নষ্ট করে দিতে পারে। ওদের ফাইনাল দিতে না পাঠালে ছাত্রসংখ্যা আবার কম হয়ে যায়। উভয় সঙ্কটে পড়েছি। কী করব বাবা?”
বুনো মহিষের শিঙের ভেতর নোটখানা গুঁজে রেখে কালাচাঁদ বলল, “সেন্ট আপ করুন। ঢালাওভাবে টুকতে দিন।”
“তা কী করে দেব? ওদের তো অন্য স্কুলে সিট পড়বে।”
“সে-স্কুলের হেডস্যারের সঙ্গে ব্যবস্থা করুন। তাঁর ছেলেদেরও টুকতে দিন। আপনার স্কুলেই তো সিট পড়বে।”
“তা তো পড়বে। কিন্তু ওই হেডমাস্টারমশাই গোঁয়ার আছেন। টোকাটুকিতে বিশ্বাস নেই একদম। এ-কথা বলতে গেলে মারতে আসবেন।”
“খুচরো দশ টাকার নোট আছে?”
এন সি পাকড়াশি একখানা এগিয়ে দিলেন।
সে-নোটখানাও মহিষের শিঙের ভেতর গুঁজে রেখে কালাচাঁদ একটা শিশি এগিয়ে দিল। “সাধু কিলিমানজারো’স ওন সলিউশন। জোর করে ধরে খাইয়ে দেবেন দু’দাগ। সব কথা শুনবেন। গোঁয়ার্তুমি আর থাকবে না।”
“খাওয়াতে গেলে যদি কামড়ে দেয়?”
“জুবিলি স্কুলের জন্যে এতটা পথ এলেন। ফিরে গিয়ে আর এটুকু করতে পারবেন না?”
এন সি পাকড়াশি লজ্জায় সলিউশনের শিশিটা ঝুল পকেটে ভরে ফেললেন।
অঘোর প্রামাণিক বললেন, “আমার একমাত্র ছেলে কালাচাঁদকে পাচ্ছি না। তার মা কান্নাকাটি করে অন্নজল ত্যাগ করেছেন।”
“তাকে আর পাবেন না। সাধু হয়ে গেছে।”
“আমার পরিবারেরও তাই সন্দেহ। একবার চোখের দেখা দেখা যায় না? নইলে ওর গর্ভধারিণী আত্মঘাতী হবেন।”
“বাড়ি গিয়ে সকালবেলা পুবমুখী হয়ে বসবেন আর এক লক্ষ আট হাজার বার জপ করুন।”
“কী জপ করব বাবা?”
“আর ঠ্যাঙাব না। আর ঠ্যাঙাব না।”
“আপনি কী করে জানলেন বাবা?” অঘোর একদম আশ্চর্য। “সত্যি, মারটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। কার মাথা ঠিক থাকে বলুন। একই ক্লাসে পাকাপাকি রয়ে গেছে—বাড়ি ফিরেই জপে বসব। যদি ফিরে আসে কালাচাঁদ।”
“প্রাণমন দিয়ে জপলে কী না হয়!”
“আপনি ত্রিকালদর্শী বাবা কিলিমানজারো।”
“সবই দেখতে হয় আমাদের। তোমার ব্যাপার কী খোকা?”
বিশ্বনাথ হাঁটি হাঁটি পা করে সামনে এগিয়ে এল। “আমি লেখাপড়া বিলকুল ভুলে যাচ্ছি বাবা। রোজ একটু একটু করে—”
“কীরকম?”
“কাল পর্যন্তও মনে ছিল—ছোট হাতের টি লেখে কী করে। আজ আর তাও মনে নেই। আজ এই সকালবেলার ভেতরেই বড় হাতের ইউ লেখা আধখানা ভুলে গেছি। আর মোটে পাঁচটি হরফ ভুলে যেতে বাকি আছে। তারপর সব সাফ।”
“মনে মনে সেন্টেন্স করতে পারো?”
“তা এখনও পারি। কিন্তু লিখব কী করে? হরফগুলোই মন থেকে মুছে যাচ্ছে রোজ।” বিশ্বনাথ কেঁদেই উঠল। “এখন সারাদিন বই খুলে বসে থাকি। কিন্তু পড়তে পারি না। অর্ধেকের ওপর হরফ যে মনে নেই।”
“এ তো কঠিন অসুখ। এর পর বাক্য গঠনও ভুলে যাবে। শেষে নিজের নামও হারিয়ে যাবে। নিজেকেই চিনতে পারবে না একদিন। শনাক্ত করতে লোক লাগবে।”
বিশ্বনাথ কালাচাঁদের ঢিবির সামনে বসে পড়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। দু’হাত ওপরে তুলে বলল, “একটা পথ দেখান সাধু কিলিমানজারো। না হলে আমি এখান থেকে উঠব না।”
“আপনারা দু’জন ওই জয়ঢাকটার ওপাশে গিয়ে বসুন। কঠিন কেস। ভাল করে দেখতে হবে।”
নিবারণ আর অঘোর সেদিকে তাকিয়ে বললেন, “উনি যদি কিছু বলেন—”
উনি মানে সেই আফরিকান ঢাকি। বর্শা হাতে সেই জয়ঢাকটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ এদিকে। তার দৃষ্টির খানিকটা কিলিমানজারো পাহাড়ের ডগায়। ডোরা কাটা জেব্রাটার সঙ্গে খেলতে খেলতে সিংহীদের দুই বাচ্চা পাহাড়ি পথ ধরে এদিকেই অনেকটা এসে পড়েছে। দূরে নদীতে আরেকখানা ছিপ এসে ভিড়ল। আফরিকান পেশেন্টরা দল বেঁধে আসতে শুরু করেছে সবে। বর্ষাকালে জলের ঢল পাহাড় ধসিয়ে নামে অনেক সময়। তাই কিলিমানজারোর গায়ের অনেক জায়গায় পাথুরে খোসা উঠে গিয়ে লালচে বুক বেরিয়ে পড়েছে। সেখানটায় রোদ পড়ে দগদগ করছে।
ওরা দু’জন সরে যেতে কালাচাঁদ বিশ্বনাথের দিকে তাকাল। “কখনও কোনও ভিজিটে ভাগ বসিয়েছিলে?”
“কোথায়? মনে পড়ে না তো।”
“ভাল করে স্মরণ করো।”
“হ্যাঁ বাবা। কালাচাঁদের ভিজিটে। ও নিজেও দিত আমাকে—”
“কোন কালাচাঁদ? অঘোরবাবুর হারানো ছেলে?”
“হ্যাঁ বাবা। মারের চোটে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা—”
“ফিরলে ভাল ব্যবহার করবে?”
“করতেই হবে। নইলে নিজেও তো একদিন হারিয়ে যাব। চিনতে পারব না। চিনিয়ে দিতে লোক লাগবে বললেন—”
“দায়ে পড়ে নয়—নিজের থেকেই ভাল ব্যবহার করবে তো?”
“আমার সে-অভ্যেস নেই বাবা। ক্লাস থ্রি থেকেই সবাই আমায় ভয় করে। আমি কেড়ে খেয়ে বড় হচ্ছি—”
“অভ্যেসটা না ছাড়লে তো নিজের নাম ভুলে যাবে এক হপ্তার ভেতর।”
“আমায় বাঁচান সাধু কিলিমানজারো—এই আপনার ভিজিট—”
বিশ্বনাথ তার হাত ধরতেই ঘুম ভেঙে গেল কালাচাঁদের। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল, রোদ উঠে গেছে অনেকক্ষণ। কোথায় কিলিমানজারো পাহাড়। ঘুমের ভেতর মুখ থেকে লালা পড়ে সরল ভূজ্ঞানের একখানা পাতা পুরো ভিজে গেছে।
বাবা অঘোর প্রামাণিক লোকজন জোগাড় করে উঠোনে ধান ঝাড়ানো শুরু করছেন।
১৩৮৩
অলংকরণ: মদন সরকার
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন