পৌলোমী সেনগুপ্ত
গোটের রুজুরুজু বিশাল আমলকী গাছ। তার পাশেই পোড়ো ইটের পাঁজা। বেশি পুড়ে ঝামা হয়ে গেছে। পাঁজার গর্তে গর্তে বেজির বাড়বাড়ন্ত সংসার। পায়ের শব্দে যেতে যেতে মুখ তুলে থমকে তাকায়; এক মুহূর্ত তারপর যেদিকে যাবার একটু দৌড়ে যায়।
দেয়ালের গায়ে কতকালের শ্যাওলা, ফার্ন। সরু পথ থেকে ডেঙো মেরে ভেতরের গাছগাছালি নজরে পড়ে। জুঁই ফুলের গাছ, পাহাড়ি চাঁপা, কাগজ ফুলের লতা—কত কী? নাম না জানা হরেক গাছ আর একলাইন ঘাস ফুল। ভেতরে ঢুকতেই কাছারিবাড়ি, দুর্গাদালান। দালানে হাঁড়িকাঠ পোঁতা। সিঁদুরে ছয়লাপ। নিত্য পুজো টিমটিমে। ষষ্ঠীর দিন থেকে চারদিন জমজমাট। বলি হয়। জমিদারবাড়ির ফর্সা, পাঞ্জাবি গায়ে ছেলেপুলেরা, বড়রা কলকাতা থেকে আসে। কেউ কাঁসর বাজায়, কেউ পেটা ঘড়ি। কেউ দোলায় চামর, কেউ ধুনুচির ওপর পাখা দেয়। আশ্চর্য সুগন্ধে ভরে যায় দুর্গামণ্ডপ। অষ্টধাতুর স্থায়ী মাতৃমূর্তি তখন ভীষণ উজ্জ্বল, আয়ত চোখ দুটি থেকে স্নেহ ঝরে পড়ে। প্রতিধ্বনি ছোট থেকে বড় হয়। গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্গাদালান ভরে যায় গ্রামের ছেলেমেয়ের খুশিতে। বলি হয় আখ, চালকুমড়ো আর নিখুঁত কালো পাঠা। ভোগ যায় বাড়ি বাড়ি। পাঁঠার নিরামিষ ঝোল অর্থাৎ তাতে পেঁয়াজ পড়বে না, রসুন পড়বে না। রান্না হবে সরল তরল।
এই পুরনো জমিদারবাড়ি আরও একবার ঘুম থেকে জাগে, তখন বাসন্তী পুজো। কিন্তু সে জাগায় বিস্ময় ছোট। সে জাগার কথা আজ আর সুদর্শনের তেমন করে মনে নেই। সুদর্শনের কথা উঠলে তার মনে পড়ল—সুদর্শন পোকার কথা। প্রায় মাদি ডেয়ো পিঁপড়ের মতন চেহারা। একটু মোটা, একটু বা সাদা ফোঁটায় ভর্তি পিঠ। প্রকৃতি অলস। ওড়ে না, হাঁটে। গাঁয়ের মেয়েরা জানে—ওই পোকা দেখা মানেই—হয় স্বামী শহর বিদেশ থেকে ফিরবে, নয়তো আসবে মনি অর্ডারের টাকা। ফলে, এর নাম টাকা-পোকাও। মাঝখানে টাকা-পোকা রেখে আঙুল দিয়ে মাটির ওপর তিন-তিনটি গণ্ডি কাটা আর প্রণাম করা। অন্তরে যে-কথা আসছে, তাও মনে মনে শুনিয়ে দেওয়া চাই।
তারপর চলে পিওনের জন্যে প্রতীক্ষা। গাঁয়ে পিওন ঢুকলেই, বাচ্চাদের দৌড় করানো।
দেখ তো আমাদের কিছু এয়েছে কি না?
সুদর্শনরা খুব গরিব। শরিকানি বাড়ির এককোণে পড়ে থাকে। ওর বাবা শহরের এক মিষ্টি দোকানের কারিগর। মাসে দু’ মাসে শহর থেকে এলে, তাঁর সঙ্গে কিছু টাকা আসে, আসে বহু রকমারি মিষ্টি। কোনওটা একটু বেশি পুরনো, ভাঙাচোরা, কিছু খুবই টাটকা। যেটা যখন যেভাবে সরাতে পেরেছেন তিনি, সেইভাবে জমিয়েছেন। টিনের কৌটোয় থাকত বলে, তাদের অনেকগুলোয় বেশ টিনের গন্ধবাস। সুদর্শন একা আর কত খাবে? পাড়ায় বিলোত। পাড়াগাঁয়ে ওসব ধসা-পচা টিনের বাস কেউ গায়ে মাখত না। গাল ভরে খেত। অমিরতি, সিমলের কড়া পাক, বোঁদে, আরও কত কী। বোঁদের নানারঙে সুদর্শন ভারী আহ্লাদ পায়। টুকে টুকে খায়। একটা দুটো করে দানা গালে পোরে আর চোখ বুজে দাঁতে কাটে। রস অবশ্য মরে চিনি! তাতে কী?
আর বাবা আনে টিনের ফুলতলা সুটকেস। কাঁসা, পেতল, ভরনের থালাবাটি। বেদানা, আপেল, মনাক্কা, আলুবখরা। বাবা খুব ভাল। বাবা সুদর্শনকে ভারী ভালবাসে। এক ছেলে—দ্বিতীয় পক্ষে। প্রথম পক্ষে কেউ নেই। প্রথম পক্ষও অনেককাল গত। তারপরই সুদর্শনের মা এবং বছর দশেক পরে সুদর্শন। সংসারধর্ম, পাপপুণ্য, ভাল-মন্দ—সবই তাকে কেন্দ্র করে। হবেই তো? এ আর বেশি কথা কী? মার সঙ্গে সুদর্শন একাই থাকে গাঁয়ের বাড়িতে। কমলালেবুর খোসা শুকুতে থাকে জানলায়, পানের সঙ্গে তাই তিনি টুকরো করে খান। বাবার অনেকগুলো পিকদানি আছে। ছোট বড় মাঝারি। ওঁর হাঁপানির টানের সময়, তাতে গয়ের ফেলেন। মা পিচ ফেলেন যেখানে সেখানে। জালের জালনা মাঝে-মধ্যে বুজে এসেছে। ক্রস-ওয়ার্ডের ছকের মতন। সুদর্শন ক্রসওয়ার্ড চেষ্টা করে, পারে না। ওর মাস্টারমশাই অনেক লাইন মেলান। তাঁর থেকে এটা পেয়েছে সে। উনি বলেছেন, এতে ইংরেজি স্টক অব ওয়ার্ড বাড়বে। সুদর্শন ক্রমে-ধীরে বড় হচ্ছে। ইস্কুলে ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি হয়েছে গত বছর। একটু বেশি বয়সেই ইস্কুলে গেল সে। এতদিন অল্পস্বল্প পড়ত বাড়িতে। আর না দিলে নয়—কেমন বেটো হয়ে যাচ্ছিল। এই মাঠঘাট বনবাদাড়ে রাত্রিদিন ঘুরছে। এই গুলি খেলছে, এই দাড়িয়াবান্ধা, এই কপাটি, তো ওই ক্যাম্বিসের বলে লাথ। এভাবে কোনও গরিব ঘরের ছেলের চলে না। চলা উচিতও না। সেজন্যেই ইস্কুল। সেজন্যে ধরা-বাঁধা ছকে ওকে ফেলার চেষ্টা!
ভারী পেটরোগা সুদর্শন, সেই এক টুকরো বয়েস থেকেই। তাই থানকুনির ঝোল আর কাঁচকলা থোড় আর গাঁদালের লম্বা জল। কী বিচ্ছিরি গন্ধ এই গাঁদালের—রাঁধার সময় বাড়ি টেকা যায় না। খাবার সময় অবিশ্যি কোনও গন্ধবাস নেই। ওই যা রক্ষে। নয়তো মরে যেত সুদর্শন। ইতিমধ্যেই কালমেঘ, আনারসের কোঁক ছেঁচা খেতে খেতে পেটে চড়া পড়ে গেছে। বাতাসার ওপর পেঁপের রস। গেঁড়ির ঝোল আর রক্তে সিঙ্গি। এসব খেতে খেতে জিব এলে গেছে তার। আর কুমারেশ। যত শিশি খেয়েছে, তা যদি এককাট্টা করা যেত, তাতে কুমারেশের একটা ছোটখাটো টিলা-টিবি হয়ে যেত।
ঠিক দুক্কুরবেলা তালগুঁড়ির ঘাটে বসে পুঁটলে ছিপ দিয়ে মাছ ধরার দিন কাবার। একতাল গোবর ছুড়ে চার। কেঁচো আর পিঁপড়ের ডিমের টোপ। কখনও কখনও কুচো চিংড়ির কাটা টোপ। দারুণ মাছ খেত। পুঁটি, ট্যাংরা, কই-এর কথাই নেই। মাঝে মধ্যে উঠত ন্যাদোস, বেলে, ল্যাটা। রুই মিরগেলের বাচ্চাও নেহাত কম উঠত না। মীন রাশ কিনা! তাই, মাছের সঙ্গে অদ্ভুত যোগাযোগ ছিল সুদর্শনের। আর-একটা কাজ করত সে। কলসি মালসা ফুটো করে গলার কাছে বাস্না বেঁধে-জড়িয়ে, শামুক ছেঁচে তার ভেতরে দিয়ে, জলে বুড়িয়ে দেওয়া। সন্ধে নাগাদ এই কম্ম করে, ভোর হতে-না-হতেই জল থেকে তুলে ফেলা। ভেতরটা খরখরিয়ে ওঠে। গা ছমছম করে তার। কিন্তু, ও জিনিস তো মা তোকে দেবে না। আর দিলেও হালকা ঝোল। ভাল লাগে? ওঁরা খাবেন ঝাল। রগরগে কষা। আর আমার বেলায় ওই কুচ্ছিত জলের ঢেউ! ঘেন্না করে। আর ধরবে না, কচু। বয়ে গেছে। পরের পেটপুজোর জন্যে সে খামোকা খেটে মরবে কেন? এক হিসেবে মা-ও তো পর। পেট তো আলাদা, না কি? তোমরাই বলো।
কচু পাতার কোষে ফটিক জল। রোদ্দুর পড়লে সলোমনের মণি। বিষ্টি হয়ে গেলে একধরনের ভাপ বেরোয় মাটি থেকে। বাঁশবনে ডাহুক আর হাঁড়িচাঁচা। সোঁদা গন্ধ নাকে এসে ঝামরে পড়ে। রঙিন চকরাবকরা শামুক একেবারে কলাগাছের ডেকলোয়। শুঁড় বের করছে। পাতার ওপর ওর হাঁটার দাগ—আটার মতন সুতোর ছাপ। জলে ধুয়ে যাচ্ছে। জলের টুপটাপ শব্দে ছাঁচতলা ভরে যাচ্ছে। কাগজের নৌকো তৈরি করে জলে ভাসাচ্ছে সুদর্শন। ছাঁচে জল পড়ে গর্ত-গর্ত। জলের রং হুঁকোর জলের মতন। পল পচে পড়ছে তো? উঠোনের কোণে একরাশ স্বর্গফুল ফুটেছে। মানে, ব্যাঙের ছাতা, অর্থাৎ ছত্রাক। ডুমো ডুমো নরম সাদা আর ছাই-রঙা বল্টু গাঁথা রয়েছে যেন। গাঁয়ের দিকে এর নাম কোঁড়ক। খেতে একেবারে মাংসের মতন৷ ভাজা খেতে পারো, তরকারি করে খেতেও পারো। কিছু চিংড়িমাছে দিলে, কিছু মাংসের স্যুপে। চমৎকার লাগে। তবে, মা বোধহয় দেবে না। পেটের দোষ বড্ড বেড়েছে, এসব খেলে ব্যাপারটা সাংঘাতিক হয়ে পড়বে—ডাক্তার নাকি এই বলেছে। ছাইয়ের ডাক্তার। খেতে না করেছে, না কচু। ওষুধ তো খাচ্ছিই, তা হলে আর অত্যাচার করতে অসুবিধে কী?
কোনও কোনও জায়গায় হঠাৎ সুদর্শনের গা কেমন ছমছম করতে থাকে। একবার না, প্রতিবারই। ফি-বারই মনে হয়, এখানে যেন কিছু একটা আছে। কী আছে? সঠিক জানা যায় না। তবে আছে। তারই ফলে—ওই কিছু থাকার কথা। আসলে জায়গাটা নির্জন, ভাঙাচোরা, অন্ধকার। গুয়ের শ্বাসরোধী ভ্যাপসা গন্ধ থমকে আছে। শব্দ আছে—কীসের শব্দ বোঝা যাচ্ছে না। ওইরকম জায়গায় পৌঁছুলে সুদর্শন প্রায় চোখ বন্ধ করে একছুটে অঞ্চলটা পার হয়ে যায়। গ্রামের মধ্যে এমন বেশ কয়েকটি ভয়ংকর ভয় দেখানোর জায়গা আছে, যা সুদর্শন একা সামাল দিতে পারে না। তা ছাড়া, সে ভয়হীন, ডানপিটে। রাতভিত নেই, শ্মশান-মশান নেই—কুছ পরোয়া নেই।
ঠিক ওইরকম—আমলকীতলা দিয়ে এগিয়ে গেলে, বাঁ হাতি ইটের পাঁজা রেখে বরাবর জলে গেলে জমিদারবাবুদের যে শানপুকুর—তার জল গোটা গ্রাম খায়। তার মাছ সুদর্শন একবার দেখেছিল—সে মাছ, না মাছের ছায়া! মুণ্ডুটা এত্ত বড়, গায়ে একফোঁটা গত্তি নেই, কাঁকালসার। অমন ভয়ংকর চেহারার মাছ সুদর্শন কখনও দেখেনি। ওর নাম ভূতে-পাওয়া মাছ, শাঁকচুন্নি পেতনির নজর আছে ওই পুকুরের মাছে। ও মাছ মানুষকে ভয় দেখায়।
সুদর্শন ওর মাকে বলেছিল, মা, শানপুকুরের জল আর এনো না।
কেন রে? সব্বাই খায়! অমন জল!
বলছি এনো না, ব্যস। ও পুকুরে পেতনির দিষ্টি আছে।
কী যে সব ছাইপাঁশ বলিস? তোর মাথার ঠিক নেই নাকি?
তা হলে এনো, কিন্তু আমি ও জল ছোঁব না। তারপর সুদর্শন ওর মাকে ব্যাপারটা খুলে বলে।
হতে পারে রে। ও বাড়িতে তো কম লোক মরেনি। অশান্তি নিয়ে যে অনেকেই মরেছে। তারা মানুষের কাছাকাছি থাকতে চায়। পারলে একটু ভয় দেখায়, একটু অনিষ্ট করে। তুই আর ওদিকে যাস না। কী দরকার!
তুলোবুড়ির বাড়ি সুদর্শনদের বাড়ির কাছে। প্রথমে বাগেদের বাড়ি। তারপর ধম্মঠাকুর। তারপর বিশ্বাসবাড়ি—ভিটে সমস্তই ব্ৰহ্মডাঙা হয়ে আছে। অতঃপর তুলোবুড়ির বাড়ি। বুড়ি পৈতে তৈরি করে আর বেচে। তিনকুলে কেউ নেই। বয়েস? বয়েসের গাছপাথর নেই। সরু তারকাঁটার গায়ে মাটির কেমনধারা নাড়ু বানায়। সেই নাড়ু তারে গেঁথে তকলি। সেই তকলিতে সাদা কাপাস তুলে বাঁ হাতের দু’ আঙুলে আলতোভাবে ধরে ডান হাতের দু’ আঙুলে তকলি বনবন ঘোরায়। ভেজা তুলো থেকে সরু সুতো তকলিতে জড়াতে থাকে। সেখান থেকে পৈতে। এক পয়সায় একটা, খুব সরু দুটো তিন পয়সা।
বাবার জন্যে মা কিনে কিনে রাখে। বামুনপাড়ার সবাই কেনে। সবাই ভালবাসে তুলোবুড়িকে। মাটির বাড়ি। মাটির দাবা। ঝকঝকে তকতকে করে রাখে বুড়ি। সামনে উঠোনে কাপাসের জঙ্গল। তাতে থোকা থোকা বাসন্তী কাপাস ফুল। কান ফেটে বকের মতো বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে। এই-ই বুড়ির মজুত ভাণ্ডার। সেখান থেকেই তার রুজি-রোজগার। সবকিছু।
কাগাপাড়ায় গাজিদের বাড়ি। বড়লোক গাজিদের শুধু সেজ গাজিই দেশে থাকে। তাঁর নাতি আক্কাজ। আক্কাজ পড়ে সুদর্শনের সঙ্গে স্কুলে। প্রথম দিনে আক্কাজ আর সে পাশাপাশি বসেছিল—গোটা স্কুল জীবনই তারা পাশাপাশি বসে এসেছে। একজন প্রথম, তো অন্য দ্বিতীয়। এতেও বন্ধুত্ব অটুট। একদিন না দেখা হলে চলত না। টিম তৈরি হল। সেভেন বুলেটস। তার নন-প্লেয়িং ক্যাপটেন বেশিরভাগ সময় সুদর্শন। আসল ক্যাপটেন আক্কাজ। সেনটার ফরওয়ার্ড খেলে। তাকে রোখা খুব কঠিন। এ ছাড়া আছে শক্ত সিংহ ব্যাক। তিনজন ফরওয়ার্ড। দুই হাফ। একজন গোলি, ব্যাক একজন। মোট সাতজনের এই সেভেন বুলেটস, বাস্তবিকই, অজেয় টিম হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। দখনো এলাকার কোথায় না খেলতে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা টুর্নামেন্টে এন্ট্রি করা হচ্ছে। কোথায় রক্তাখাঁর মাঠ, কোথায় সুয্যিপুরের বড়দোলের মাঠ, কোথায় জয়নগর, মথ্রোপুর, সরষে, রায়দিঘি। সর্বত্র। তা ছাড়াও স্কুলের খেলা তো আছেই। স্কুলে আক্কাজ একজন অবশ্য-প্লেয়ার। অসুবিধের মধ্যে ওর হাইট। অনেকসময় বলে ঠিকমতন মাথা পায় না। তাতেও ওকে রোখা দায়। যেন-তেন-প্রকারেণ গোল ও করবেই। ভিজে মাঠে ও আরও মারাত্মক।
সেই আক্কাজ, বলা নেই কওয়া নেই—বিদ্রোহ করে বসল।
না, তোমার দলে আমার আর খেলা হবে না।
কেন? আকাশ থেকে পড়ল সুদর্শন।
অসুবিধে আছে।
কী অসুবিধে আক্কাজ?
আমাদের একটা আলাদা দল হচ্ছে—সেভেন মুসলিমস। তাতে আমিই ক্যাপটেন।
এখানে তো তুমিই ক্যাপটেন আক্কাজ।
তবুও।
সুদর্শনের সেদিনের মানসিক অবস্থা কহতব্য নয়। বাড়ি ফিরে চুপচাপ দাবায় বসল বইপত্তর নিয়ে।
কী রে? শরীর খারাপ নাকি?
না।
তা হলে?
কী তা হলে! প্রতিদিনই খেলতে হবে?
আজ না তোদের কোথায় ম্যাচ ছিল, বলেছিলি?
হ্যাঁ, ক্যানসেল হয়ে গেছে।
মা তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সুদর্শন আর নিজেকে সামলাতে পারে না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। মায়ের কাপড়ের একটা অদ্ভুত মা-মা গন্ধ ওকে শান্তি দেয়।
আমি আর খেলাধুলো করব না মা। ওটা বড়লোকদের শখ।
করবি না, করবি না। এখন চুপ কর।
ভোরবেলা হাঁটতে হত পাক্কা দেড় ক্রোশ। কাগাপাড়া ছাড়িয়ে দুর্গাপুর, দুর্গাপুর ছাড়িয়েও আরও খানিকটা গেলে ঈশেন পণ্ডিতের বাসা। মাথার চুল কোঁকড়ানো, কাকের বাসার মতন আলুথালু। এক ঢাল উঁচু চুল। চোখা নাক, রোগা পাতলা শরীরে কণ্ঠস্বর ভারী তীক্ষ। নস্যি নেন মুহুর্মুহু। কাপড়ের ওপর নিমে পরনে। স্কুলের সেকেন্ড পণ্ডিত। প্রসপেকটাসে ওঁর নামের পাশে লেখা: রেড আপটু আই এ। আরেক মাস্টারমশাই-এর নামের পাশে লেখা থাকত: প্লাক্ড ফর ম্যাট্রিক। হেড-মাস্টারমশাই-এর এম এ বি টি-র পর লেখা থাকত: ডিপ ইন স্পোকেন ইংলিশ। পরে জানা গিয়েছিল—ডিপ মানে ডিপ্লোমা।
সেই ঈশেন পণ্ডিতের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেত সুদর্শন। সে যেত, আক্কাজ যেত; যেত শক্ত সিংহ। পণ্ডিতমশাই ওদের কাছ থেকে কী নিত জানা যায় না, তবে সুদর্শনের কাছ থেকে নিত মাসে দশ টাকা। তাই যথেষ্ট বেশি। সুদর্শন থাকতও বেশিক্ষণ। পণ্ডিতমশাই ওকে একটু অন্য চোখে দেখতেন। বলতেন, তোকে জেলায় দাঁড়াতে হবে। পারবি তো?
দেখি স্যার।
দেখি আবার কী? কনফিডেন্স না থাকলে আমার কাছে আসিস না, দূর হয়ে যা।
ওঁর ছেলে বারিদও থাকত সময়-সময়ে। স্কুলে বারিদ এক ক্লাস উঁচুতে পড়ত বলে একটু ডাঁট। ওর বোন রমার কোনও ডাঁট ছিল না। রমা নিচুতে পড়ত এক ক্লাস, তাই হয়তো ডাঁট-ফাঁট দেখানোর কথা তার না। বরং, সবাই চলে গেলে পণ্ডিতমশায়ের কাছে যখন সুদর্শন একা, তখন রমা একবাটি মুড়ি নিয়ে এসে বলত, মা পাঠাল।
পণ্ডিত বলতেন না কিছু। খাতার ভুল দেখতে ঝুঁকে পড়তেন। সেই ফাঁকে রমা এক টুকরো পেঁয়াজ তুলত কোঁচড়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে, তারপর চট করে ফেলে দিয়ে বলত, এ্যাঁ এ্যাঁ… মনে করো এ বি সি একটি ত্রিভুজ—এ্যাঁ এ্যাঁ।
রমা ন-হাতি লাল ডুরে পরত। নাকে নাকছাবি। ছোট্ট এক টুকরো মুখ। মাগুর মাছের মাথার মতন তেলতেলা। একটু ঝগড়ুটে ছিল মেয়েটা। ঘাড়ের ওপর জ্বলন্ত কালো তিল ছিল দু-দুটো। একদিন সুদর্শন দেখে।
তোমার ঘাড়ে তিল। তুমি ঝগড়া করো নাকি?
তাই বাটি বাটি মুড়ি দিই? কাল দেব’খন। খেয়ো।
প্রমাদ গনে সুদর্শন। সত্যিই ভীষণ খিদে পায় ওর প্রতিদিন। অতখানি হাঁটা। তা ছাড়া ভোরে তো সেই ফাঁপা মুড়ি খেয়ে আসা। সেই কখন! কাগাপাড়া পর্যন্ত পৌঁছুতেই পেটের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করে। একটা ফাঁকা বাতাস বুকের দিকে ঠেলে ওঠে। গিয়েই এক ঘটি জল চায় সুদর্শন।
কাল একটু তেল ছড়িয়ে দিয়ো রমা।
নিশ্চয়ই। কোথায় ছড়াব?
কেন, মুড়িতে?
মুড়ি তোমায় আর দিচ্চেটা কে?
কেন, মাসিমা?
আচ্ছা, খেয়ো।
সেদিন রমা আর পড়তে এল না। এল না আক্কাজ। শক্ত এল।
কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল সুদর্শনের। কারণটা ঠিক বুঝতে পারল না। ফাঁকা। অথচ কেনই বা ফাঁকা হবে?
শেষ পর্যন্ত মুড়িও এল না। এল না রমা। তেল ছিটিয়ে দেবার কথা মনে পড়ে গেল ওর। একটা দিন তেল দিতে পারত। আর দিতে হত না। মুখ ফুটে বলল, তবু রমা—!
ঈশেন পণ্ডিত বললেন, সুদর্শন, তুমি আসছে হপ্তাটা এসোনা। শক্তকে বলতে ভুলে গেলাম। তুমি বলে দিয়ো। আক্কাজকে বলেছি। রমার বিয়ে। খুব ভাল পাত্তর পেয়ে গেলুম হঠাৎ। গৌরীদানের মতন দেখালেও, এই বয়েসেই বিয়ে হওয়া উচিত মেয়েদের। তা ছাড়া, জানিস তো ওর মাথায় কিছু নেই। মেলা পড়াশুনো করে করবেটা কী? গ্যাটম্যাট করে চাকরিতে তো আর যাচ্ছে না? কী বলিস?
সুদর্শন আবার একবার ভাবল, বড্ড গরিব ওরা। একবাটি করে মুড়ি পাচ্ছিল—তাও কপালে সইল না।
দরজা দিয়ে বেরুতে যাবে, এমন সময় বাগানের দেয়ালের কাছে ফিসফিসানি, এই শোন, এই শেষ— একমুঠো মুড়ি নিয়ে যা, পালা। আমার বিয়ে, জানিস তো?
জানি।
কর তোরা বোকার মতন পড়াশুনো। আমি ফ্রি।
তারপরই হি হি করে হাসতে হাসতে রমা গাছপালার মধ্যে হাওয়া। ওদিন আসিস কিন্তু, নইলে রাগ করব। আসিস আসিস আসিস—
১৩৮১
অলংকরণ: পূর্ণেন্দু পত্রী
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন