পৌলোমী সেনগুপ্ত
বারান্দায় বসে গল্প করছিল সবাই, এমন সময় দীপু ছুটতে ছুটতে সেখানে এল। তার হাতে একটা শুকনো গাছের ডাল। দীপুর মুখ চোখ উৎসাহে জ্বলজ্বল করছে। যেন সে হঠাৎ আবিষ্কার করেছে একটা নতুন কিছু।
শুকনো ডালটা উঁচু করে তুলে সে চেঁচিয়ে বলল, মা, দ্যাখো, কী সুন্দর একটা জিনিস পেয়েছি।
বড়রা গল্প থামিয়ে তাকাল দীপুর দিকে। তার হাতে শুধুই একটা শুকনো গাছের ডাল। সুন্দর কিছু না।
মা বললেন, দীপু, তুই আবার একলা একলা বাগানে গিয়েছিলি?
বাবা বললেন, সেই জন্যই অনেকক্ষণ দীপুকে দেখতে পাইনি!
বাড়ির পেছনেই বেশ বড় বাগান! বাগান মানে অবশ্য শুধু ফুলগাছের বাগান নয়। বড় বড় আমগাছ আর নারকোলগাছে ঘেরা অনেকখানি জায়গা। আরও অনেক রকম গাছ আছে। কেউ যত্ন করে না। আগাছা জন্মে গেছে মাটিতে। বাগানের মধ্যে একটা পুকুরও আছে, সেটাও কচুরি পানায় ভর্তি।
দীপুর বড়মামাদের এই গ্রামের বাড়িতে এখন আর বিশেষ কেউ থাকে না। এবার দীপুরা সবাই বেড়াতে এসেছে।
বড়মামা বললেন, ও বাগানে খেলুক না। ভয় তো কিছু নেই।
মা বললেন, যদি সাপ টাপ থাকে!
বড়মামা বললেন, তোর কী বুদ্ধি! শীতকালে বুঝি সাপ বেরোয়?
মা তবু নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। বললেন, তা হোক। এই দুপুরবেলা বাগানে একলা একলা থাকা ভাল নয়। একটা পুকুর আছে, যদি পড়ে টড়ে যায়।
দীপু তাড়াতাড়ি বলল, না, আমি পুকুরের কাছে যাইনি।
বাবার বন্ধু অমলকাকু এক পাশে বসে চুরুট টানছিলেন। তিনি বললেন, দীপু, তুমি কী সুন্দর জিনিস এনেছ?
দীপু গাছের ডালটা এগিয়ে দিয়ে বলল, দেখুন অমলকাকু, এটা খুব সুন্দর না? আমি আগে আর এরকম একটাও পাইনি!
বাবা বললেন, এটার মধ্যে আবার সুন্দর কী আছে?
একটা এক হাত প্রায় লম্বা আমগাছের ডাল। ওপরের দিকে কয়েকটা শুকনো পাতা তখনও আছে, মাঝখান দিয়ে আবার দু’দিকে দুটো শুকনো ডাল বেরিয়েছে।
দীপু বলল, দেখুন, দেখুন, এটা ঠিক মানুষের মতন দেখতে না?
অমলকাকু বললেন, তাই নাকি?
দীপু জোর দিয়ে বলল, দেখতে পাচ্ছেন না? অবিকল ছোটমামার মতন!
সবাই হো-হো করে হেসে উঠল এক সঙ্গে। শুধু দীপুর ছোটমামা হাসতে পারলেন না! ছোটমামার চেহারাটা রোগা আর লম্বা, মাঝে মাঝে ওপরের দিকে হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙেন। তাঁর চেহারা সম্পর্কে কেউ ঠাট্টা করলে তিনি রেগে যান।
অমলকাকু হাসতে হাসতে বললেন, ঠিকই বলেছে কিন্তু! এ ছেলে দেখছি বড় হলে নির্ঘাৎ আর্টিস্ট হবে!
মা বললেন, আর্টিস্ট হবে না ছাই! এই এক অদ্ভুত খেলা আছে ছেলেটার!
অমলকাকু ছোটমামাকে আরও রাগাবার জন্য বললেন, কিন্তু যাই বলো তোমরা, আমি কিন্তু খুব মিল দেখতে পাচ্ছি।
ছোটমামা মনের ভুলে ঠিক সেই সময়েই আড়মোড়া ভাঙার জন্য হাত দুটো উঁচু করলেন। সবাই হেসে উঠল আবার!
দীপু বলল, মা, আমি কিন্তু এটা নিয়ে যাব বাড়িতে!
আর কিছু না বলে দীপু লাফাতে লাফাতে চলে গেল তার ঘরের দিকে।
মা বললেন, ছেলেটা যত রাজ্যের জঞ্জাল এনে জমাচ্ছে ঘরে। এই সব নাকি আবার নিয়ে যেতে হবে!
বাবা বললেন, কালকে একটা কাঠের টুকরো কুড়িয়ে এনে বলেছিল সেটাকে নাকি দেখতে একেবারে জগন্নাথের মতন।
অমলকাকু বললেন, ভুল তো বলেনি তা হলে। দারু ভূতে মুরারি।
মা বললেন, কেন, সেই যে আর একটা কঞ্চি এনে একবার বলেছিল সেটা ওর ঠাকুমা!
এই সব গল্প করতে করতে বড়রা আবার বড়দের গল্পে ফিরে গেলেন।
আর কোনও ছোট ছেলে মেয়ে নেই বলে এখানে দীপুকে খেলা করতে হয় একলা একলা। মা বারণ করলেও সে টুক টুক করে লুকিয়ে চলে যায় বাগানে। সে যে পুকুরটার কাছে নেমে একবার জলে পা দিয়ে এসেছে, মা সে কথাও জানেন না।
বাগানটা খুব ঠান্ডা। এত সব বড় বড় গাছ, তাদের ডালে পাতায় হাওয়ায় লেগে লেগে কত রকম সব মিষ্টি মিষ্টি শব্দ হয়। দীপুর মনে হয়, গাছগুলো সব যেন বেশ মানুষ, সবাই তাকে দেখছে। পাতা দুলিয়ে দুলিয়ে কী যেন কথা বলতে চাইছে তার সঙ্গে। অনেক রকম পাখিও আছে এখানে। পাখিদের সঙ্গে গাছেদের খুব ভাব, কক্ষনও ওরা ঝগড়া করে না। পাখিগুলো সব সময় ব্যস্ত। হয় ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছে কিংবা বসে বসে ডাকছে। একটা পাখি অনেকক্ষণ ধরে কুং কুং কুং করে ডাকে, সেটাকে কিছুতেই দেখতে পাওয়া যায় না।
সবচেয়ে বড় আমগাছটার নীচে দুটো ছোট্ট গাছ। দীপুরই সমান লম্বা। দীপু ওদের নাম দিয়েছে অরিজিৎ আর সুমন্ত্র। ওই নামে দীপুর ইস্কুলের দু’জন বন্ধু আছে। গাছ দুটোকে দীপু ওই নাম দিয়ে দীপু ওদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে খেলা করে।
দীপু বলে, জানিস ভাই, আমি টিনটিনের বইগুলো আনতে ভুলে গেছি। তোরা কি টিনটিনের নতুন বই পেয়েছিস? আমাকে দিবি তো?
গাছগুলো হাওয়ায় দোলে। ঠিক যেন মাথা নাড়াচ্ছে।
দীপু আবার বলে, কাল রাত্তিরে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল, আর শুনলুম কীসের যেন একটা শব্দ হচ্ছে বাইরে। আমি মাকে ডাকিনি, বাবাকেও ডাকিনি। ভাবলুম কী, নিজেই একলা একলা বাইরে গিয়ে দেখব। একটুও ভয় পাইনি, সত্যি! যেই খাট থেকে নেমেছি, অমনি শব্দটা থেমে গেল। জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, একটা বেড়াল! আমাকে দেখেই পালাল। ওটা কিন্তু আসলে বেড়াল নয়। নিশ্চয়ই মিশমিদের সর্দার এসেছিল, সেই যে যে ইচ্ছে করলেই অন্যরকম চেহারা নিতে পারে— আমাকে দেখেই বেড়াল হয়ে গেল, বুঝলি?
এই রকম গল্প করতে করতেই দীপুর সময় কেটে যায়। মাঝে মাঝে দু’-একটা প্রজাপতি এসে বসে সেই ছোট গাছ দুটোতে। তখন দীপু কথা থামিয়ে সেই দিকে চেয়ে থাকে। একটা প্রজাপতির নাম সে দিয়েছে বুবাই। ওটা তার মাসতুতো বোনের নাম।
একবার দীপু দেখল অরিজিৎ নামের গাছটার গা বেয়ে বেয়ে একটা শুঁয়োপোকা উঠছে। দীপু খুব রেগে গেল সেটা দেখে। সে ধমক দিয়ে বলল, এই, তুমি আমার বন্ধুর গায়ে উঠছ কেন? শিগগির নামো!
শুঁয়োপোকাটা এমন পাজি যে কোনও কথাই শোনে না।
দীপু তখন একটা কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে সেটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। শুঁয়োপোকাটার নাম দেয় সে কুম্ভকর্ণ, তারপর অনেকক্ষণ ধরে সেটার সঙ্গে লড়াই করে। সেটাকে হারিয়ে দিয়ে দীপু আবার বাড়িতে ফিরে আসে মাকে খবরটা জানাবার জন্য।
দীপুর মামাবাড়ির গ্রামের খুব কাছেই বক্রেশ্বর। সেখানে গরম জলের ফোয়ারা আছে। পরের দিন সবাই সেখানে বেড়াতে যাবে। দীপু যেতে চায় না। তার বেশি ভাল লাগে ওই বাগানে খেলা করতে। কিন্তু দীপুকে একা রেখে যেতে মা রাজি হলেন না। দীপুকে যেতেই হল। গিয়ে অবশ্য একটা লাভ হল। সেখানে দীপু একটা পাথরের টুকরো পেয়ে গেল, সেটাকে দেখতে একদম সুতপামাসির মতন। ঠিক সেই রকম হাসি হাসি মুখ। পাথরটা সঙ্গে করে নিয়ে এল দীপু।
সাত দিন কেটে যাবার পর, এবার কলকাতায় ফিরতে হবে। বাবার আপিসের আর ছুটি নেই। ফেরা হবে বড়মামার গাড়িতে। মালপত্তরে একেবারে বোঝাই হয়ে গেছে গাড়ি। সবাই এক বস্তা করে নারকোল নিয়েছে। তার ওপরে আবার ঝুড়ি ঝুড়ি পাটালি গুড়। এর ওপর আছে আবার দীপুর নিজের জিনিস। সাতটা গাছের ডাল, তিনটে কঞ্চি আর চারখানা পাথরের টুকরো। বড়দের সব জিনিসপত্তর ঠিক ঠিক তোলা হল, শুধু দীপুর জিনিসগুলো নেবার বেলাতেই গাড়িতে জায়গা কম পড়ে যায়।
বাবা বললেন, এই সব আজেবাজে জিনিসগুলো নিয়ে কী করবি! ওগুলো ফেলে দে!
দীপু কিছুতেই রাজি নয়। এগুলো তার খেলার জিনিস, সে কিছুতেই ফেলে যাবে না।
দীপু প্রায় কেঁদে ফেলছে দেখে মা বললেন, যাক গে, নিতে চাইছে যখন নিয়ে যাক!
গাছের ডালগুলো রাখা হল গাড়ির মাথায় ক্যারিয়ারে, বিছানাপত্তরের পাশে। পাথরগুলো দীপু নিজের পায়ের কাছে রাখল।
দীপুর ছোটমামা শুধু থেকে গেলেন, তিনি আর ক’দিন পরে একা ফিরবেন। আর সবাই উঠে পড়ল গাড়িতে। অমলকাকু বসেছেন দীপুর ঠিক পাশেই। পাথরগুলোতে পা লাগায় অমলকাকু জিজ্ঞেস করলেন, এই পাথরগুলো নিয়ে গিয়ে কী হবে দীপু? এরকম পাথর তো সব জায়গাতেই পাওয়া যায়!
দীপু বলল, না, মোটেই না। এই দেখুন না, এই পাথরটাকে দেখতে ঠিক ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মতন।
অমলকাকু জিজ্ঞেস করলেন, ক্যাপটেন হ্যাডক কে?
দীপু বলল, সে আছে একজন আমার গল্পের বইতে।
অমলকাকু আর একটা পাথর তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর এইটা?
এটা তো সুতপামাসি!
তাই নাকি? তা হলে ওটা?
দীপু মুচকি হেসে বলল, অমলকাকু আপনার মতন দেখতেও একটা পাথর পেয়েছি!
অমলকাকু আগ্রহের সঙ্গে বললেন, তাই নাকি? কই দেখি দেখি!
দীপু একটা বিশ্রী দেখতে পাথর তুলে দিল। অমলকাকু. হাসতে হাসতে বললেন, আরে, তাই তো, এটা তো ঠিক আমার মতন অবিকল দেখতে।
সবাই দারুণ হাসতে লাগল। বড়মামা গাড়ি চালাতে চালাতে এমন হাসতে লাগলেন যে আর একটু হলে গাড়িটা রাস্তার পাশে গড়িয়ে যেত। কেউই কিন্তু পাথরটার সঙ্গে অমলকাকুর মুখের কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছে না!
বাবা বললেন, ছেলেটা একেবারে পাগল। কী যে ওর খেলা!
অমলকাকু বললেন, না, না, পাগল কেন হবে? আর্টিস্টস এরকম অনেক কিছু দেখতে পায়, আমরা সাধারণ লোকরা তা পাই না!
বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর অমলকাকুর চা খেতে ইচ্ছে হল। গাড়ি থামানো হল সেইজন্য। চায়ের দোকানের কাছে সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। অন্যদের হাতে চায়ের কাপ, দীপু নিয়েছে বোতলের শরবত।
সেখানে একজন মেয়ে কতকগুলো বড় বড় রং করা বেতের ঝুড়ি বিক্রি করছিল। অমনি মায়ের একটা পছন্দ হয়ে গেল। যে-কোনও জায়গা থেকে জিনিস কেনা মায়ের স্বভাব।
কিন্তু অতবড় ঝুড়িটা নেওয়া হবে কোথায়? গাড়ির মাথাতেই বেঁধে নিতে হবে। বাবা আর অমলকাকু সেটা বাঁধাবাঁধি করছেন, হঠাৎ দীপু চিৎকার করে ছুটে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল একী, কী করলে? ছোটমামার হাতটা যে ভেঙে গেল!
সবাই অবাক হয়ে থমকে গেল। চায়ের দোকানের লোকগুলো পর্যন্ত অবাক হয়ে তাকিয়েছে।
তারপরই বোঝা গেল ব্যাপারটা। ঝুড়িটা রাখতে গিয়ে ঠেলাঠেলিতে দীপুর একটা গাছের ডাল খানিকটা ভেঙে গেছে!
বাবা আর অমলকাকু ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসছিলেন, কিন্তু দীপু কাঁদতে লাগল। কেন তার খেলনা ভেঙে দেওয়া হল! অমলকাকু বললেন ঠিক আছে, রাস্তায় যেতে যেতে আর একটা ডাল কুড়িয়ে নিলেই তো হবে। কিন্তু দীপু সেকথা শোনে না। সে তো যে-কোনও গাছের ডাল নেয় না। এই ডালটা ঠিক ছোটমামার মতন ছিল, এটার কেন হাত ভাঙল, ঠিক এই রকম একটা তার আবার চাই।
বাবা শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে এক ধমক দিয়ে বললেন, তুমি বড্ড বিরক্ত করছ। ওই রকম করলে সব ক’টা ফেলে দেব। যাও, চুপ করে গাড়িতে বসে থাকো!
দীপু গাড়িতে গিয়ে মুখ নিচু করে বসে রইল। সারাটা রাস্তা আর কারুর সঙ্গে কথা বলল না।
কলকাতায় ফিরে আবার সব ঠিক হয়ে গেল। দীপু তার খেলনাগুলো সাজিয়ে রেখেছে নিজের ঘরে। তার স্কুল খুলতে এখনও কয়েকদিন দেরি আছে। খেলনার গাছের ডাল, পাথর, রাংতা কাগজ কিংবা পাখির পালক—এই সব কিছুই যেন তার চোখে জ্যান্ত। সে প্রত্যেককে একটা কিছু নাম দিয়ে এদের সঙ্গে কথা বলে। এদের মধ্যে আছে নানান চেনাশুনো আত্মীয় স্বজন, স্কুলের বন্ধু, জগন্নাথ, নেপোলিয়ান, ক্যাপ্টেন হ্যাডক, অরণ্যদেব, ভীম, অর্জুন, এই সব। দীপু অনেক সময় আপন মনে এদের সঙ্গে এত জোরে জোরে কথা বলে যে পাশের ঘর থেকে মা পর্যন্ত চমকে ওঠেন।
দুপুরবেলা মা শুনতে পেলেন, দীপু বলছে, বাবা, তুমি সিগারেট খাবে? দেশলাই এনে দেব?
দীপু যেন সত্যিই তার বাবার সঙ্গে কথা বলছে। মা চমকে উঠে এ ঘরে এসে বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস? তোর বাবা কোথায়? অফিস থেকে ফিরেছে নাকি?
দীপু আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই তো বাবা!
মা দেখলেন, একটা পুরনো ব্যাডমিন্টনের র্যাকেটের জালের ফাঁকে কাগজ পাকিয়ে সিগারেটের মতন আটকে রেখেছে দীপু। সেইটাকেই বাবা বলছে।
মা আজ আর রাগ করলেন না। হাসলেন। তারপর বললেন, তোকে নিয়ে আর পারি না! আচ্ছা, তোর আর কোন কোন খেলনা কার মতন দেখতে, শুনি তো!
দীপু পর পর সব ক’টা শুনিয়ে গেল। এমনকী সেই ভাঙা ডালটাও সে এখনও ফেলেনি। মা সবচেয়ে বেশি হাসলেন একটা কালো পাথরের নাম সুতপামাসি শুনে। সুতপামাসির গায়ের রং দারুণ ফরসা।
তারপর মা জিজ্ঞেস করলেন, আমার মতন দেখতে কোনটা রে? আমি কোনটা?
দীপু মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার মতন দেখতে একটাও পাই না মা। কত খুঁজেছি, তবুও পাই না।
সেদিন বিকেলবেলা বাবা অফিস থেকে ফিরে গম্ভীরভাবে মাকে বললেন, তোমার দাদা ফোন করেছিলেন, একটা খারাপ খবর আছে।
মা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর? কী হয়েছে?
বাবা বললেন, অনন্তপুর থেকে খবর এসেছে, কেষ্টর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
অনন্তপুর গ্রামেই দীপুরা বেড়াতে গিয়েছিল। আর কেষ্ট হচ্ছে ছোটমামার ডাকনাম। তিনি ওই গ্রামেই থেকে গিয়েছিলেন।
মা চোখ মুখে ভয় ফুটিয়ে বললেন, কী হয়েছে কেষ্টর?
বাবা বললেন, কেষ্ট গাছ থেকে পড়ে গেছে। ওই রোগা চেহারা নিয়ে কেষ্ট জোর করে একটা নারকোলগাছে উঠেছিল। নারকোলগাছে কি আর যে সে উঠতে পারে। অনেক উঁচু থেকে পড়ে গেছে শুনলাম।
কোথায় লেগেছে?
খুব জোর বেঁচে গেছে। মাথায় কিছু হয়নি। কিন্তু একটা হাতে খুব জোর চোট লেগেছে। কালকেই নিয়ে আসা হচ্ছে কলকাতায়।
তারপর এই নিয়ে অনেক কথা হল। মা সারা সন্ধে চিন্তা করতে লাগলেন তার ভাই সম্পর্কে। শুধু চিন্তা নয়, তার মনের মধ্যে একটা খটকা লেগে রইল। কী রকম যেন একটা অস্বস্তি।
মা এসে একবার দীপুর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালেন। দীপু তখনও একমনে কথা বলে যাচ্ছে তার খেলনাদের সঙ্গে। সে তখন কর্ণ সেজে যুদ্ধ করছে অর্জুনের সঙ্গে। মা দূর থেকে দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ দেখলেন। কিছু একটা বলি বলি করেও বললেন না। একবার তাকালেন সেই ভাঙা ডালটার দিকে। তাঁর ভুরু কুঁচকে রইল অনেকক্ষণ।
এর তিন দিন বাদে, দীপু স্নান করছে দুপুরবেলা, মা রান্নাঘরে, বাড়ির ঝি সব ঘর দোর মুছছে, এমন সময় দীপুর পড়ার ঘর থেকে দড়াম করে একটা শব্দ হল।
বাথরুম থেকেই সেই শব্দ শুনতে পেয়ে দীপু চেঁচিয়ে উঠল, কী হল? কী ভাঙল?
কোনও উত্তর না পেয়ে দীপু ভিজে গায়েই ছুটে এল নিজের ঘরে। এসে দেখল, বাড়ির ঝি দু’ টুকরো ভাঙা পাথর হাতে নিয়ে বোকার মতন দাঁড়িয়ে আছে।
দীপু চিৎকার করে বলল, রাধামাসি, তুমি আমার খেলনা ভেঙে ফেললে?
রাধামাসি বলল, কী জানি বাবা! মা বললেন ঘরটা মুছে দিতে। এই পাথরটা মেঝে থেকে টেবিলের ওপর তুলে রাখতে যাচ্ছিলাম, আপনি আপনি কী রকম পড়ে ভেঙে গেল।
দীপু কান্না মেশানো অভিযোগের সঙ্গে বলল, আপনি আপনি আবার কিছু পড়ে যায় নাকি!
মা রান্নাঘর থেকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে?
দীপু বলল, দ্যাখো না মা! ঠাকুমাকে দু’ টুকরো করে দিয়েছে।
মা একটু কেঁপে উঠলেন। তারপর বললেন, এসব আবার কী অলুক্ষণে কথা! চুপ কর।
দীপু তবু বলল, তোমরা কেন আমার সব খেলনা ভেঙে দেবে!
মা হঠাৎ রাধামাসিকে খুব বকতে লাগলেন। একটু দেখে শুনে কাজ করতে পারো না? সব সময়ই তো এটা ভাঙছ, সেটা ভাঙছ।
রাধামাসি গজগজ করে উঠে বলল, একটা সামান্য পাথর, তা-ও আপনা আপনি পড়ে গেল টেবিল থেকে—তাতেও আমার দোষ বলো!
সেইদিনই সন্ধেবেলা এলাহাবাদ থেকে টেলিগ্রাম এল। দীপুর ঠাকুমা হঠাৎ মারা গেছেন।
এলাহাবাদে দীপুর জ্যাঠামশাইরা থাকেন। ঠাকুমাও কয়েকমাস আগে সেখানে গিয়েছিলেন।
টেলিগ্রামটা পেয়ে বাবা ধপ করে বসে পড়লেন। কান্না কান্না গলায় বললেন, সামনের সপ্তাহেই মাকে নিয়ে আসব ভেবেছিলাম। মায়ের সঙ্গে আর দেখা হল না!
এই সময় মা এত জোরে কেঁদে উঠলেন যে বাবা পর্যন্ত চমকে উঠলেন। তারপর বাবা উঠে এসে মায়ের পিঠে হাত রেখে বললেন, তুমি অত ভেঙে পোড়ো না। আমার বাক্স গুছিয়ে দাও। আমি আজই রাত্রের ট্রেনে এলাহাবাদ রওনা হব।
মা বাবার হাত চেপে ধরে বললেন, আমার ভয় করছে! আমার ভীষণ ভয় করছে।
বাবা বললেন, ভয় কী! কয়েকটা দিন তুমি একা থাকতে পারবে না?
মা বললেন, সে জন্য না! তোমার মনে আছে, দীপুর খেলনা সেই গাছের ডালটা যখন ভেঙেছিল, তখন দীপু কী বলেছিল?
কী বলেছিল?
তোমার মনে নেই? দীপু বলেছিল, ছোটমামার হাত ভেঙে গেল যে! তারপর সত্যি সত্যি কেষ্টর হাত ভাঙল। তারপর আজই দুপুরে, ও যে খেলনাটাকে ঠাকুমা বলে সেটাকে ঝি ভেঙে দিয়েছে!
বাবা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দু-এক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, যাঃ, এসব কী। বলছ! এ আবার হয় নাকি!
মা ব্যাকুলভাবে বললেন, সত্যি যে মিলে যাচ্ছে। বাবা বললেন, মিললেই বা কী হয়েছে। একে বলে কাকতালীয়। এই থেকেই মানুষের কুসংস্কার জন্মায়।
বাবা চলে গেলেন এলাহাবাদ। এই কদিন মা দীপুকে সব সময় চোখে চোখে রাখলেন। তাকে আর বেশি খেলতে দেন না। সব সময় নিজের কাছে এনে জোর করে পড়তে বসান।
বাবা এলাহাবাদ থেকে ফিরে এলেন ক’দিন বাদেই। মাথা ন্যাড়া করেছেন। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন আরও কয়েকদিন। দুপুরবেলা বাড়িতেই থাকেন। দীপুর ইস্কুল খুলে গেছে।
বাবা ঠাকুমার একটা ছবি বাঁধিয়ে এনেছেন সেদিন সকালে। ছবিটা তাঁর শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে টাঙাবেন। পেরেক ঠোকার জন্য একটা শক্ত কিছু দরকার। বাড়িতে হাতুড়ি টাতুড়ি নেই। বাবা এ ঘর সে ঘর খুঁজতে খুঁজতে দীপুর পড়ার ঘর থেকে একটা বড় পাথর পেয়ে গেলেন। এটাতেই কাজ চলবে।
বাবা পেরেকটা ঠুকছেন, এমন সময় মা দৌড়ে এসে বললেন, একী, তুমি একী করছ! ওটা রেখে দাও!
বাবা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, কেন, কী হয়েছে?
তুমি দীপুর খেলনা নিয়েছ!
তাতে কী হয়েছে? পাথর দিয়ে পেরেক ঠুকতে পারব না।
ও খুব ভালবাসে খেলনাগুলো। এটাকে যে ও অমলকাকু বলে!
পেরেকটা তখন ঠোকা হয়ে গেছে। বাবা বললেন, ঠিক আছে, আমি রেখে দিচ্ছি। আবার ঠিক জায়গায় রেখে দিলেই তো হল। পাথর তো আর ক্ষয়ে যায়নি!
মা বাবার হাত থেকে পাথরটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, এই দ্যাখো, মাঝখানটা কী রকম খুবলে গেছে!
বাবা বললেন, মাঝখানটায় একটা চলটা উঠে গেছে শুধু। ও দীপু কিছু বুঝতে পারবে না। যাও, পাথরটা রেখে এসো।
মা তবু সেটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, অনেকদিন অমলের কোনও খবর নেই। এ বাড়িতেও আসেনি।
বাবা বললেন, হুঁ, বেশ কিছুদিন অমলের পাত্তা নেই বটে। আমিও এলাহাবাদে ছিলাম। এসেও খোঁজ নেওয়া হয়নি!
মা বললেন, তুমি এক্ষুনি ফোন করো!
মায়ের গলার আওয়াজটা এমনই অন্যরকম যে বাবা অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। ফোন তুললেন।
হ্যালো, অমল?
কে, প্রশান্ত? কী খবর?
তোর খবর কী? অনেকদিন পাত্তা নেই।
ক’ দিন খুব সর্দি কাশি আর জ্বরে ভুগছিলাম।
এখন ভাল আছিস?
অমলকাকু সব কথাতেই হাসেন। এবারেও হাসতে হাসতে বললেন, আজ এক্সরে রিপোর্ট পেলাম। বুকটা একটু জখম হয়েছে ভাই। ডাক্তার বলছে, আমার প্লুরিসি হয়েছে।
মা আর বাবা দু’ জনেই এক সঙ্গে চেঁচিয়ে বললেন, অ্যাঁ!
টেলিফোন রেখে দিয়েই বাবা একেবারে রেগে আগুন হয়ে উঠলেন। অমলকাকু তাঁর খুবই প্রিয় বন্ধু। মা তখনও সেই বুকের কাছে চলটা-ওঠা পাথরটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন।
বাবা বললেন, তোমার ছেলের এই সাঙ্ঘাতিক খেলা বন্ধ করতেই হবে!
মা বললেন, দীপুর দোষ কী! আমরাই তো ওর খেলনাগুলো ভেঙে দি কিংবা নষ্ট করি।
বাবা বললেন, তা বলে জ্যান্ত মানুষের নাম নিয়ে এ কী অদ্ভুত খেলা। একটার পর একটা বিপদ ঘটে যাচ্ছে!
বাবা রেগে গেলে আর কারুর কথা শোনেন না। দীপুর ঘরে ঢুকে তিনি সব পাথরের টুকরোগুলো ছুড়ে ফেলতে লাগলেন পেছনের মাঠে। গাছের ডাল, কঞ্চি, ভাঙা ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট এগুলোও ফেলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ মত বদলে বললেন, এগুলো সব আমি আগুনে পুড়িয়ে দেব!
দীপু তখন ইস্কুলে। তার সব খেলনা শেষ হয়ে যেতে লাগল। বাবা তার সব গাছের ডাল আর কঞ্চিগুলো গুঁজে দিতে লাগলেন রান্নাঘরে জ্বলন্ত কয়লার উনুনে।
ভাঙা ব্যাডমিন্টনের র্যাকেটটাও যখন উনুনে দিতে যাচ্ছেন, তখন মা তাঁর হাত চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বললেন, ওটা দিয়ো না, ওটা থাক, ওটা দিয়ো না!
বাবা সেকথা শুনলেন না। জোর করে, র্যাকেটটা ভরে দিলেন উনুনে।
তখুনি উনুন থেকে একটা আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠল। আগুনের জিভ ছুঁয়ে দিল বাবার পাঞ্জাবির হাতা। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। মা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই কোনওক্রমে তিনি উনুন থেকে টেনে তুললেন র্যাকেটটা।
আগুন বেশি ছড়ায়নি। বাবার হাতটা একটু শুধু ঝলসে গিয়েছিল, বেশি কিছু হয়নি, মলম লাগাতেই সেরে গেছে।
বাবা দীপুর জন্য অনেকগুলো পুতুল ও মূর্তি কিনে দিয়েছেন। যেমন, বিবেকানন্দ, নেপোলিয়ান, বুদ্ধ, কৃষ্ণ, যিশুখ্রিস্ট, সৈন্য, নাবিক, শিকারি, রবীন্দ্রনাথ, শিবাজি এইসব—অর্থাৎ যাঁরা কেউ এখন বেঁচে নেই।
১৩৮১
অলংকরণ: সুধীর মৈত্র
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন