রাত যখন বারোটা – অশোক বসু

পৌলোমী সেনগুপ্ত

রাত যখন বারোটা – অশোক বসু

বাইরে চাকরি করি। পুজোর ছুটির সঙ্গে বাড়তি ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিলাম। আমার সহপাঠী বন্ধু শৈলেন সম্প্রতি একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি কিনেছে। একদিন সে যখন বলল, “চল দেবেশ, গোরুমারা ফরেস্টে দারুণ একটা প্লেজার-ট্রিপ দিয়ে আসি,” আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। শৈলেনের সঙ্গে বনবিভাগের চিঠি তো ছিলই, তা ছাড়া গোরুমারার নতুন রেঞ্জার নাকি শৈলেনের খুব জানাশোনা লোক। আমরা দু’ বন্ধু হই-হই করে বেরিয়ে পড়লাম।

ঠিক ছিল, দিনের আলো থাকতে-থাকতেই আমরা গোরুমারায় পৌঁছে যাব। কিন্তু ঠিক সময়ে কেন, সে-দিনই পৌঁছতে পারলাম না। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়েই আকাশে অল্প-অল্প মেঘ ছিল। তিস্তা-ব্রিজ পার হতেই সেই মেঘ ঘন কালো হয়ে সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে গেল। আরও কিছুদূর যেতেই ঝোড়ো হাওয়া উঠল, হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি। লাটাগুড়ি ফরেস্টে ঢোকবার মুখেই দেখা গেল একটা প্রকাণ্ড পাকুড়গাছ রাস্তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। যাওয়া-আসার রাস্তা বন্ধ। শৈলেন গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল।

বললাম, “এখন উপায় কী?”

শৈলেন হতাশ মুখে মাথা নাড়ল, “আপাতত নো উপায়। লোকজন এসে গাছ কেটে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে সেই সকাল। পাশ কাটিয়ে যাব, তারও উপায় নেই। দেখছিস না, রাস্তার দু’পাশেই ডিপ ড্রেন।”

“তার মানে ব্যাক টু দি প্যাভিলিয়ন, শৈলেন?”

শৈলেন ভুরু কুঁচকে গাড়ির জানলার বাইরে আকাশ দেখল। মেঘ থাকলেও বৃষ্টি হচ্ছে না। মেঘলা-অন্ধকারে মনে হচ্ছে সন্ধে, কিন্তু হাত-ঘড়ির কাঁটায় এখন বিকেল পাঁচটার একটুও বেশি নয়। এখানে জঙ্গলের ধারে লোকবসতি নেই। চারধারে নির্জনতা থমথম করছে।

গাড়ি ফের স্টার্ট দিয়ে ঘুরিয়ে নিল শৈলেন। বলল, “অকারণ তেল অপচয় করে বাড়ি ফিরব না। চল, আজ রাতটা লাটাগুড়িতে বিষ্ণুদার বাড়িতে কাটিয়ে কাল সকালে গোরুমারা যাব।”

ফিরতে পথে আরেক বিপত্তি। কিছু দূরে গিয়েই ইঞ্জিন বিকল হয়ে গাড়ি থেমে গেল। বনেট খুলে শৈলেন টর্চের আলোয় অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি চালু করতে পারল না। ইতিমধ্যে মেঘ কেটে গিয়ে আকাশ একটু-একটু পরিষ্কার হচ্ছে। আধখানা চাঁদ ভাসছে আকাশে। চাঁদের আলোয় দেখা গেল, জনহীন দু’পাশে শুধু ফাঁকা মাঠ। গভীর জঙ্গল পেরোতে হয় বলে রাত্রিবেলায় হয়তো এ-রাস্তায় গাড়ি চলাচল করে না। আমাদের গাড়ি খারাপ হওয়ার পর এ-পর্যন্ত একটাও গাড়ি আসেনি এ-রাস্তায় এলে হয়তো ড্রাইভারের সাহায্য নিতে পারত শৈলেন। সত্যি বলতে কী, এ-ব্যাপারে সাহায্য করার মতো আমার কিছুই জানা ছিল না।

বনেট নামিয়ে দিয়ে শৈলেন বলল, “আমার মেকানিজম শেষ। সারারাত এই রাস্তায় গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে হবে।”

চাঁদের আলোয় ফাঁকা মাঠের ওপারে জঙ্গলের গা-ঘেঁষে একটা দোতলা বাড়ি আমার চোখে পড়েছিল। বললাম, “ওটা কার বাড়ি রে শৈলেন? ওই যে দেখা যাচ্ছে, ধবধবে সাদা, দোতলা…”

শৈলেন বাড়িটা দেখল। তারপর বলল, “দি আইডিয়া! গাড়িটা আজ রাতের মতো এইখানেই থাকুক। চল, আমরা জমিদারবাহাদুরের আতিথ্য গ্রহণ করি আজকের রাতের জন্যে। এক্সকারশন না হোক, অ্যাডভেঞ্চার তো হবে।”

শৈলেন জানলার কাচ তুলে দিয়ে গাড়ি লক করে দিল। সুটকেসটা হাতে নিল। পাকা রাস্তার বাঁ ধারে নেমে একটা কাঁচা রাস্তা পেয়ে গেলাম। একটু পরে যখন বাড়িটার কাছে পৌঁছে গেলাম, তখনও জানি না এ-বাড়িতে আসাটা শৈলেন অ্যাডভেঞ্চার বলছে কেন। বাড়িটা দেখে কিন্তু শৈলেনের কথাটা আবার মনে পড়ল আমার। জঙ্গল-পরিকীর্ণ জনহীন মাঠের ধাৱে ভাঙা চাঁদের মায়াবী আলোয় নিঃসঙ্গ বাড়িটা দেখেই কেন যেন আমার বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল। বাড়িটা নিঃসন্দেহে বহু কালের পুরনো। এখানে কোনও মানুষের থাকার কথাও নয়। তবু আমার মনে হচ্ছিল, কী যেন আছে, কী যেন হয় এখানে।

বারান্দায় উঠে শৈলেন টর্চ জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক দেখল। চারদিকেই বহুদিনের গজিয়ে-ওঠা আগাছার ঝোপজঙ্গল, বাড়ির পলেস্তারা-খসা। নোনা-দেয়ালের শ্যাওলা-ধরা ইঁট বেরিয়ে এসেছে। নির্জন, নিস্তব্ধ। টর্চ নিভিয়ে দিয়ে শৈলেন বলল, “এ বাড়িটার দারুণ বদনাম আছে। অনেককাল আগে জমিদার বীরেশ্বর দেব বানিয়েছিলেন। তখন অবশ্য এখানে বড়সড় একটা গ্রাম ছিল। ফরেস্টও অনেক দূরে ছিল। এখন কিছুই নেই, আছে শুধু এই পোড়োবাড়িটা, আর বাড়িটাকে নিয়ে আজগুবি গল্পগাছা।”

আমি সরে এসে শৈলেনের গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। দোতলার সিঁড়িতে অস্পষ্ট আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কেউ যেন নেমে আসছে ওপর থেকে। একটু পরেই তাঁকে দেখা গেল। জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে এক লম্বা, রোগা, অতিবৃদ্ধ মানুষ। বয়েসের ভারে ঈষৎ কুঁজো। সারা মুখে শুভ্র দাড়িগোঁফ। পরনে ধুতি আর সাদা ফতুয়া। বৃদ্ধ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখ কোটরগত এবং দৃষ্টি নিশ্চল। আমাদের দেখেও তাঁর লোলচর্মমণ্ডিত মুখে কৌতূহল কিংবা জিজ্ঞাসার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। যেন বরফের এক ভাবলেশহীন হিমশীতল মূর্তি অপেক্ষা করে আছে আমাদের কথা শোনার জন্য। আমার শরীর শিরশির করে উঠল। সত্যি বলতে কী, আমি একটু ভিতুগোছেরই লোক।

বৃদ্ধকে দেখে প্রথমটা একটু চুপ করে থাকলেও একটু পরে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, “আমরা একটু অসুবিধায় পড়ে এখানে এসেছি। মানে, আমাদের গাড়িটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে তো, তাই ভাবলাম বৃষ্টি-বাদলের রাতটুকু—”

“বলুন”, বৃদ্ধ যেন কথা বললেন না, তাঁর নিস্পন্দ দুটি ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অন্য কারও অপার্থিব কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

শৈলেন আড়চোখে আমাকে একবার দেখে নিয়ে বলল, “রাতটুকু কোনও রকমে কাটিয়ে, মানে এ-বাড়িতে কেউ থাকে না তো—”

“থাকে,” বৃদ্ধ সেই একইভাবে গমগমে গলায় বললেন, “জমিদার বীরেশ্বর দেব এ-বাড়িতে থাকেন।”

শৈলেন দারুণ অবাক গলায় বলল, “সে কী! জমিদার বীরেশ্বর দেব তো—”

বৃদ্ধ বললেন, “তিনি প্রতিদিন রাতে এ-বাড়িতে আসেন। ওপরের কোনও ঘরে আপনারা থাকতে পারবেন না। কিন্তু অতিথি ফিরে যাওয়া জমিদারবাড়ির নিয়ম নয়। আপনারা নীচের তলার অতিথিশালায় থাকবেন। ডান দিকের শেষ ঘরটা।”

শৈলেন আমার দিকে তাকাল। আমি দেখলাম শৈলেনের সাহসী চোখেও প্রশ্ন। আমার কাছে জানতে চাইছে, কী করা যায়! ভয়ে তখন আমার জমে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু এখন চলে যাওয়ারও কোনও উপায় নেই। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চাঁদ ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে। তুমুল হাওয়া বইছে। আমি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকলাম শৈলেনের দিকে।

টর্চ জ্বালিয়ে শৈলেন বোধহয় অতিথিশালাটা দেখতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ বলে উঠলেন, “একটা কথা। রাত বারোটার পর কোনওমতেই টর্চ জ্বালবেন না। তখন কর্তাবাবু আসেন। উনি আলো পছন্দ করেন না।”

বৃদ্ধের হাতের মোমের আলো হাওয়ার ঝাপটায় নিভে নিভে আসছিল। তাঁর পাণ্ডুর, নীরক্ত মুখে মোমের শিখার আলোছায়া কাঁপছিল। আবার ওপরে উঠবেন বলে পেছন ফিরে সিঁড়িতে পা বাড়াতেই শৈলেন আচমকা প্রশ্ন করল, “আপনি, আপনি কে?”

বৃদ্ধ থেমে গেলেন। সিঁড়ির দিকে মুখ করে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “আমি নিশানাথ। আশি বছর ধরে আমি এ-বাড়ি দেখাশোনা করছি।”

“আ-শি ব-ছ-র!” শৈলেনের সবিস্ময় প্রশ্ন।

“হ্যাঁ, আশি বছর। আপনারা বিশ্রাম করুন এখন।”

বৃদ্ধ আর দাঁড়ালেন না। সিঁড়ি দিয়ে আস্তে-আস্তে ওপরে উঠে গেলেন। একরাশ হিমেল কুয়াশা যেন তাঁকে আমাদের চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে দিল শূন্যে।

সেই দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে শৈলেন বলল, “যত সব বোগাস। চল, অতিথিশালাটা দেখে নিই আগে।”

টর্চের আলো ফেলে দেখা গেল অতিথিশালাটা থাকার পক্ষে খুব একটা অনুপযুক্ত নয়। ঘরে একটা তক্তাপোশ পাতা আছে, তাতে কোনও বিছানাপত্র নেই। অবশ্যি সুটকেসে চাদর আছে। তক্তাপোশ পেতে নেওয়া যাবে।

আমি বললাম, “চল শৈলেন, এখানে থাকার দরকার নেই। ভুতুড়ে ব্যাপার-ট্যাপার মনে হচ্ছে।”

শৈলেন তক্তাপোশের ওপর বসে পড়ে বলল, “ধুস! যত সব বাজে ব্যাপার। বুড়োটা একটা বদ্ধপাগল। বলে কি না আশি বছর এ-বাড়ি দেখাশোনা করছে। তা হলে ওর বয়েস এখন কত? একশো? আর জমিদার বীরেশ্বর দেব? সে তো কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে।”

“মরে ভূত হয়ে গেছে,” আমি কাঁপা-কাঁপা গলায় বললাম, “রাত বারোটার সময় তা হলে কে আসে?”

শৈলেন কোনও উত্তর দিল না। ঠিক সেই সময় কানে এল অনেক দূরে কোথাও একটা কুকুর কান্নার গলায় একটানা ডেকেই চলেছে। শোঁ-শোঁ করে শব্দ হচ্ছে হাওয়ার। এক অজানা ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

শৈলেন জানলার বাইরে তাকিয়ে বলল, “তা ছাড়া, ইচ্ছে থাকলেও এখন যাওয়া যাবে না। রাতটুকু এখানেই থাকতে হবে।”

অন্ধকার ঘরের মধ্যে তক্তপোশের ওপর দু’জনে পাশাপাশি বসে থাকলাম। একটু আগেই ঘড়ি দেখেছি টর্চ জ্বালিয়ে। রাত দশটা। বাইরে দুর্যোগের রাত। মেঘ ডাকছে, জানলা দিয়ে বিদ্যুতের আলো ঝাঁপিয়ে আসছে ঘরের ভেতর। আশেপাশে মানুষজন, ঘরবাড়ি নেই বোধহয়। আসবার সময় সে-রকম কিছু চোখেও পড়েনি৷ বৃদ্ধ নিশানাথেরও কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। শুধু নিশানাথ নন, জীবনের কোনও চিহ্নই নেই যেন কোথাও। শৈলেন যেন নিজের সঙ্গেই বোঝাপড়া করে নিতে নিতে বলল, “পাগল ছাড়া কী! লোকটা দেখাশোনা করছে এমন একটা ভাঙা বাড়ি, যে বাড়িতে লোক নেই, জন নেই, ত্রিসীমানার মধ্যেও কেউ থাকে না। পাগল ছাড়া এমন উদ্ভট চিন্তা কারও থাকতে পারে?”

কিন্তু নিশানাথ যে পাগল নয়, কিছুক্ষণ পরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। ঘড়িতে সময় দেখলাম। রাত বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে, হাওয়া দিচ্ছে না। চারদিকে ছমছম করছে নিস্তব্ধ নিশুতি রাত। হঠাৎ শুনলাম ওপর তলার কোনও ঘরে গভীর গম্ভীর শব্দে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বাজছে। এখানে এই জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত বাড়িতে ঘড়ি! তখনই মনে হল, ওপর তলায় কেউ যেন কথা বলছে। কে যেন চেয়ার কিংবা টেবিল টেনে নিয়ে গেল। একটু পরেই শুনলাম হা হা করে হেসে উঠল কেউ।

এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস আমার গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। আমি শৈলেনের হাত চেপে ধরে ভয়-পাওয়া গলায় বললাম, “জমিদার বীরেশ্বর দেব এসেছেন।”

শৈলেন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “অ্যাবসার্ড, অ্যাবসার্ড! এ সমস্ত জিনিস আমি বিশ্বাস করি না।”

আমি বললাম, “শৈলেন, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ…।”

শৈলেন চিরকালই ডাকাবুকো বেপরোয়া ধরনের ছেলে। সুটকেস খুলে তার রিভলভারটা হাতে নিয়ে বলল, “আমি নিজের চোখে দেখব, উইথ মাই ওপেন আইজ, তারপরে বিশ্বাস করব।” বলতে বলতে সে এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে লোডেড রিভলভার নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আমিও তার পেছন-পেছন দৌড়লাম। বন্ধুকে তো আর বিপদের মুখে একলা পাঠাতে পারি না।।

অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে আতর আর অম্বুরি তামাকের সুগন্ধ নাকে আসছিল। জমিদারের প্রেতাত্মা কি মৌতাতে বসেছে? আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। তবু আমি সিঁড়ি ভাঙছিলাম। আমার আগে-আগে শৈলেন।

আমি শৈলেনকে ডাকছি। শৈলেন শুনছে না। ওপরে বারান্দায় উঠেই সে সামনের ঘরে ঢুকে গেল। ঘরের দরজা খোলা। আমিও গেলাম পেছন-পেছন।

ঘরে ঢুকেই ভয়ে আতঙ্কে আমার রক্ত জল হয়ে গেল।

শৈলেন কিন্তু বরাবরই দুঃসাহসী আর সংস্কারমুক্ত মানুষ। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকেছে ঘরে। সেই আবছা আলো-অন্ধকারে, দেখলাম, শ্বেতবস্ত্ৰ-পরিহিত এক নিশ্চল মূর্তি। জমিদার বীরেশ্বর দেব? জানলা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া এসে আমাকে যেন উড়িয়ে নিতে চাইল।

এক মুহূর্ত মাত্র। তারপরেই শৈলেনের হাতের টর্চের তীব্র আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল মূর্তির মুখে। শৈলেনের অন্য হাতের রিভলভারের মুখও তার দিকে তাক করা। মূর্তিটা যেন ভীষণ চমকে উঠে আলোর দিকে তাকাল। কিন্তু এ কী! ভীষণ আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, জমিদার বীরেশ্বর দেব নন, বনেদি কায়দায় চেয়ারে বসে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন শ্বেত-শ্মশ্রুমণ্ডিত সেই বৃদ্ধ। নিশানাথ। হাতে গড়গড়ার নল। তাঁর মুখে একসঙ্গে ফুটে উঠেছে ভয়, বিরক্তি, ক্রোধ আর বিস্ময়। মূহূর্তকাল তাকিয়ে থেকেই তিনি হতচেতন হয়ে ঢলে পড়লেন চেয়ারে।

নিশানাথের জ্ঞান ফিরেছিল অনেক পরে। আমরা হাজার চেষ্টা করেও তাঁর মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারিনি। হতবুদ্ধির মতো বড়-বড় চোখে ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে ছিলেন আমাদের দিকে।

পরের দিন গোরুমারার ফরেস্ট বাংলোয় বসে চা খেতে-খেতে শৈলেন বলেছিল, “নিশানাথ ভূত ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভূতগ্রস্ত মানুষ। লৌকিক আর অলৌকিক জগতের সীমারেখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করতেন। দিনের বেলায় তিনি নিশানাথ, রাত বারোটা বাজলেই তিনি নিজেকে জমিদার বীরেশ্বর দেব মনে করতেন। এক বিচিত্র ধারণা নিয়ে নিশানাথ দিনের পর দিন নির্জন জঙ্গুলে জায়গায় ওই আদ্যিকালের পোড়ো-বাড়িতে নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। দিনের ঘটনা যেমন রাতে তিনি ভুলে যেতেন, রাতের ঘটনাও দিনের আলোতে তাঁর একটুও মনে থাকত না। নিশানাথ সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন, রাতে কর্তাবাবু বীরেশ্বর দেব আসেন। কিন্তু ওই বাড়ির ঘড়িতে রাত বারোটার ঘণ্টা বাজলেই তিনি নিজেই যে বীরেশ্বর দেবের চরিত্রের অভিনেতা হয়ে যেতেন, তা তিনি নিজেই জানতেন না। টর্চের জোরদার আলো তাঁকে অবচেতন মনের রহস্যলোক থেকে টেনে এনেছিল চরম বাস্তবে, যেটা তাঁর দুর্বল মন সহ্য করতে পারেনি। ডাক্তার জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইডের গল্প তো জানিস। অনেকটা সেইরকম, মালটিপ্‌ল পারসোনালিটির লোক ছিলেন নিশানাথ।”

কিন্তু বিজ্ঞান কী বলে, আমার শুনতে ইচ্ছে করছিল না। আমি তখন জানলা দিয়ে গভীর গহন জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিশানাথ এখন পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক বাড়িতে আছেন। আমি আর শৈলেনই ব্যবস্থা করে এসেছি। এখন সকাল। সকাল শেষ হয়ে দুপুর হবে, দুপুরের পর বিকেল। তারপরে সন্ধে। তারপরে রাত্রি। তারপরে এক সময় চারপাশে নিঝুম, নিস্তব্ধ হলে রাত বারোটা বাজবে জমিদারবাড়ির দেওয়াল-ঘড়িতে। তখন?

তখন কী করবেন নিশানাথ?

১৩৯২

অলংকরণ: প্রবীর সেন

সকল অধ্যায়

১. প্রোফেসর হিজিবিজ্‌বিজ্ – সত্যজিৎ রায়
২. বাহাদুর – আশাপূর্ণা দেবী
৩. কুমির – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৪. ননীদা – মতি নন্দী
৫. হর্ষবর্ধনের ভাগনে ভাগ্য – শিবরাম চক্রবর্তী
৬. কর্ভাস – সত্যজিৎ রায়
৭. বেণী লস্করের মুণ্ডু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৮. টুম্পুর গল্প – সুকুমার দে সরকার
৯. বারীন ভৌমিকের ব্যারাম – সত্যজিৎ রায়
১০. বীর হওয়ার বিড়ম্বনা – শিবরাম চক্রবর্তী
১১. নন্দগুপি – লীলা মজুমদার
১২. পালোয়ান ভূত – মনোজ বসু
১৩. হিসাব – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
১৪. গান – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৫. জ্যান্ত খেলনা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. মুড়ি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
১৭. কর্নেল মিত্র – বিমল মিত্র
১৮. গুল-ই ঘনাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
১৯. ভয়ঙ্কর মুখোশ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২০. দিনে ডাকাতি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২১. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২২. মেজকর্তার খেরোখাতা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
২৩. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৪. সাধু কালাচাঁদের ফলাও কারবার – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
২৫. একটি ভুতুড়ে ঘড়ি – বিমল কর
২৬. বুনো হাতির বন্ধুত্ব – সমরেশ বসু
২৭. গোয়ায় গোগোলের প্রথম কীর্তি – সমরেশ বসু
২৮. ইঁদারায় গণ্ডগোল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৯. চোর সাধু – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩০. টোরি জঙ্গলের ভক্ত-বাঘ – সুবোধ ঘোষ
৩১. জোনাকি-ভূতের বাড়ি – সমরেশ বসু
৩২. বনবিড়াল – বিমল কর
৩৩. ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
৩৪. সুপারমেন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. রাত যখন বারোটা – অশোক বসু
৩৬. প্রেতাত্মার উপত্যকা – ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
৩৭. আলুর চপ – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৮. হাবুলমামার ভূতের ব্যবসা এবং… – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৩৯. অশোকের কাণ্ড – হর্ষ দত্ত
৪০. হারাধন – দুলেন্দ্র ভৌমিক
৪১. হয়তো এইরকমই – আশাপূর্ণা দেবী
৪২. মহারাজা তারিণীখুড়ো – সত্যজিৎ রায়
৪৩. খুড়ো-ভাইপো – বাণী বসু
৪৪. সহযাত্রী – সত্যজিৎ রায়
৪৫. দারিৎসু – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৪৬. চার বুড়োর আড্ডা – আশাপূর্ণা দেবী
৪৭. রামপলের অন্তর্ধান রহস্য – রূপক সাহা
৪৮. দেয়ালা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪৯. শুভ জন্মদিন – জয় গোস্বামী
৫০. ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি – সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন