পৌলোমী সেনগুপ্ত
আমার দাদা, অহিদা, ব্যারাকপুরে নতুন বাড়ি করেছেন। চারপাশে বাগান। একতলা হলদে বাড়ি। ছাদে অ্যালুমিনিয়াম রঙের জলের ট্যাঙ্ক। টেলিভিশনের অ্যান্টেনা। একপাশে খানিকটা অংশ চারদিক তারের জাল দিয়ে ঘেরা। তার ভেতরে নানারকম গাছ। এক-একটা টবে ছোট ছোট চৌকো টিকিট, কাঠি দিয়ে নোটিসের মতো মাটিতে পোঁতা। অদ্ভুত অদ্ভুত সব নাম—অ্যাকুইলেগিয়া, অ্যাসপিডিস্ট্রা, ক্যালানা ভালগারিস, গোদেতিয়া, গ্লোকসিনিয়া। ওই জালিঘরে ঢোকার গেটে একটা টিনের ফলকে লেখা—যারা ফুল ভালবাসে, তারা ঈশ্বরকে ভালবাসে। আর একটা ফলকে লেখা, ফুল মানে ফল নয়। আর একটা ফলকে লেখা— ফুলের আকাঙ্ক্ষা করো, ফলের নয়।
নিজে আর্টিস্ট, যা খুশি তাই লিখতে পারেন। আঁকতে পারেন। যেমন বাড়িতে ঢোকার গেটের বাইরে লিখে রেখেছেন— কুকুর নেই। কুকুর শব্দটা পড়েই লোকে ভাবেন, লেখা আছে—কুকুর হইতে সাবধান। ঢোকার আগে গেটের আংটা বাজিয়ে চিৎকার করে বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকেন, “কুকুর বাঁধা আছে তো?” বসার ঘরে জানালা খুলে অহিদা তখন ভারী গম্ভীর গলায় বলেন, “আর একবার পড়ে দ্যাখো।”
প্রভাতবাবু একদিন সকালে ওইভাবে বেকায়দায় পড়ে, পরে ঢুকতে ঢুকতে, একটু রাগ রাগ গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এটা তোমার কী কায়দা অহি৷ কুকুর নেই, সেটা লিখে জানাবার কী আছে হে!” মোটা চশমার কাচ মুছতে মুছতে অহিদা বলেছিলেন, “একটাই কারণ কাকা, পড়লে পুরোটাই পড়বেন, বুঝলে পুরোটাই বুঝবেন। শুধু মলাট দেখেই বিচার করবেন না। ক মানেই কৃষ্ণ নয়, কাকও হতে পারে, কঙ্কালও হতে পারে, কালীও হতে পারে!”
বাথরুমের বাইরে লিখে রেখেছেন—বাথরুম। শোবার ঘরে—বেডরুম। রান্নাঘরে—কিচেন। এ-সব কেন লিখেছেন অহিদা, বোঝাই তো যাচ্ছে বাথরুম, বেডরুম, কিচেন। অহিদা বললেন, “ক’টা লোক বোঝে হে, স্নানঘর, শোবারঘর, রান্নাঘর, খাবারঘরের মর্ম। ঘরে ঘরে গিয়ে দ্যাখো, বাথরুমে পা দিতে পারবে না। শোবার ঘরটা খেলাঘর, বসার ঘর। খাটে পাতা বিছানা লণ্ডভণ্ড। ধুলো-বালি কিচকিচ করছে। বসার ঘরটাকে মনে হবে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। রান্নাঘরটাকে করে রাখবে গোয়ালঘর। চলতে ফিরতে মনে করিয়ে দাও। সবসময় চোখের সামনে নোটিস লটকে দাও।”
আমার এই দাদা, অহিদা, যেমন ছবি আঁকতে ভালবাসেন, তেমনি খেতে ভালবাসেন। খেতে ভালবাসেন বলে রাঁধতেও ভালবাসেন। রাঁধতে ভালবাসেন বলে বাজার করতে ভালবাসেন। সুখে থাকলে, আনন্দে থাকলে মানুষের চেহারা ভাল হয়। প্রথমে মুখটা গোল হতে থাকে। বেলুন আস্তে আস্তে ফোলালে যেমন হয়। ভাঙা গাল, চোয়ালের হাড়, সব ভরাট হতে থাকে। গলার কণ্ঠা ক্রমশ চাপা পড়তে থাকে। ঘাড়টা ক্রমশ বেড়ে-ওঠা কলাগাছের মতো গোল থেকে আরও গোল হতে থাকে। অহিদার চেহারা বরাবরই ভাল। তারপর ভালতর থেকে ভালতম হয়ে এখন ভাল, ভালতর, ভাল ভালতর, ভালতম হয়ে ক্রমশই বেড়ে চলেছে। কী মজা, রোগা হলে লোকে বলবেন, আহা তোমার শরীরটা কী হয়ে গেছে! আবার মোটা হলেও বলবেন, কী হচ্ছে তোমার শরীরটা! প্রতিবেশী প্রভাতবাবু দেখা হলেই বলবেন, “কী হচ্ছে অহি! এরপর তো একটা আয়নায় তোমার কুলোবে না হে, জোড়া লাগিয়ে মুখ দেখতে হবে।”
অহিদার নজর লাগবে না। লাগলেও কিছু হবে না। কী আর কমবে! সাগর থেকে ঘটিখানেক জল তুলে নিলে সাগরের কী হবে! সে হবে আমাদের কেউ যদি বলেন, তোর চেহারাটা বেশ চকচক করছে, তা হলেই আমার মা আড়ালে ডেকে কড়ে আঙুলটা একটু কামড়ে দেবেন। গায়ে একটু নুন ছিটিয়ে দেবেন।
এখন নিজের চেহারাটা যখন এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, নিজেকেই বয়ে বেড়াতে হয়, তখন বাজার বওয়া, কি কাঁধের পাশের সামান্য একটা ঝোলা ব্যাগ বওয়াও কষ্টকর ব্যাপার। নিজেরটা নিয়েই অস্থির, তার ওপর আবার আলু, পটল, ঢ্যাঁড়স, ড্রয়িং বোর্ড, তুলি, রং, জামা, কাপড়, চটি, চুল, দাড়ি! সেই জন্যেই নেপাল থেকে আনিয়েছেন বাহাদুরকে। বাহাদুর সব পারে।
ছাদের বাগান আর নীচের বাগানে চারাগাছে জল দিতে পারে। এমনভাবে পারে, একটা চারাও উলটে পড়বে না। একটা মাঝখান থেকে চেরা বাঁশ এমন কায়দায়, ফ্যাটফ্যাট করে বাজাতে পারে যে সেই শব্দ শুনলে মানুষের ঘুম এসে যাবে, আর যে-সব পাখি বীজ, চারা নষ্ট করে, তারা ফররর, ফররর করে উড়ে পালাবে। বাহাদুর মোটর গাড়ির টায়ার কাঁধে তুলতে পারে। দু’ কাঁধে, হাতের ফাঁক দিয়ে দুটো টায়ার ঝুলিয়ে, শিস দিতে দিতে দু’ মাইল দূরের বাজার থেকে ঘুরে আসতে পারে। একটা বড় খাট একাই তুলতে পারে। পারে না কেবল অহিদাকে তুলতে।
কী করে বলছি পারে না? দেখেছি বলেই বলতে পারছি। অহিদা ব্যারাকপুর স্টেশনে একদিন পা মচকে পড়ে গেলেন। অহিদার দোষ নেই। একটা কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্ঘটনা। মহৎ কাজ! অসুবিধে হল, গাড়ির হর্ন থাকে, অহিদার তো হর্ন নেই। গাড়ির একেবারে চাকার তলায় কিছু পড়লে ড্রাইভার দেখতে পায় না, অহিদার একেবারে ভুঁড়ির তলায় প্ল্যাটফর্মে কুকুরটি শুয়ে ছিল। কী করে দেখবেন! বাহাদুর চেঁচাচ্ছে, “কুত্তা বাবু; বাবু কুত্তা।” কুকুর ঘুমুলেও তার অনুভূতিটা তো আর ঘুমিয়ে পড়ে না। সে ভেবেছে মালবোঝাই লরি আসছে। অহিদার শেষ পদক্ষেপটা কুকুরটার পেটের ওপরেই হত, যদি না কুকুরটা বিদ্যুৎগতিতে অহিদার পায়ের ফাঁক দিয়ে পালাবার চেষ্টা করত। পালাবে কোথায়! সামনে কোঁচা, পেছনে ঝুলন্ত কাছা। কুকুরটা আকারেও তেমন বড় নয়। অহিদার কাছায় কোঁচায় জড়ামড়ি হয়ে, জালে-পড়া শেয়ালের মতো ঝটপট করছে, সঙ্গে কেঁউ কেঁউ আর্তনাদ। বাহাদুর বলছে, “উতার দিজিয়ে, উতার দিজিয়ে।” পেছন থেকে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলছেন, “ঝেড়ে ফ্যালো খোকা, ঝেড়ে ফ্যালো খোকা!”
অহিদা নীচের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, পায়ের ফাঁকে ব্যাপারটা কী হচ্ছে! দেখতে তো পাচ্ছেন না। ভুঁড়ির জন্যে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। পুরো ঘটনাটাই খুব দ্রুত ঘটছে। কুকুরটা মুক্তির চেষ্টায় শেষ ঝটকাটা বোধহয় একটু জোরেই দিতে পেরেছিল। কাছাটা খুলে গেল। অহিদার কাছা এবার কুকুরটার পেছনের পায়ে জড়িয়ে কুকুরের কাছা হয়ে গেছে। কুকুর ভাবছে, অহিদা তার কাছা টেনে ধরেছেন। যেদিকে কুকুরের মুখ, অহিদার মুখ তার উলটো দিকে। কুকুরটা প্রাণপণে দৌড়োচ্ছে তিন পায়ে। একটা পা কাছায় আটকে উঁচু হয়ে আছে। অহিদা কখনও রাগেন না বা উত্তেজিতও হন না। ধীর গলায় শুধু বলছেন, “এই, কী হচ্ছে, কী হচ্ছে!” কুকুরটা শেষ পর্যন্ত হয়তো পালাতে পারত কাছা ছাড়িয়ে, পারল না। কোথা থেকে একটা মুশমুশে কালো কুকুর টিনের বেড়া গলে সামনে এসে দাঁড়াল। মনে হয় জাতভাইয়ের দুর্গতিতে কোনও সাহায্য করা যায় কি না দেখতে এসেছিল। অহিদার কাছায় জড়ানো কুকুরটা কিন্তু অন্যরকম ভেবে বসল। ভয়ে আবার উলটো দিকে দে দৌড়। নিমেষে অহিদার কাছাতে, কোঁচাতে, কুকুরের ন্যাজেতে কী হয়ে গেল। হিমগিরির পতন। অহিদা পড়ে গেলেন। আমাদের পড়া একরকম, অহিদার পড়া একরকম। আমাদের ওপর দিকটা তো তেমন ভারী নয়। অহিদার পড়া মানে, নিজের পায়েই নিজে পড়া। ওপরের অতটা গুরুভার সহসা নেমে এল নিজের পায়ে! সেইদিন দেখলুম, বাহাদুর সব তুলতে পারে, পারে না কেবল নিজের বাবুকে। অহিদা অবশ্য পরে গর্ব করে বলেছিলেন, “যে বাবুকে চাকর তুলে ফেলে সে-বাবু বাবুই নয়।” তখন অবশ্য বাহাদুরকে খুব গালাগালি দিয়েছিলেন। “এর আগের বাহাদুর হাতি তুলে ফেলত, তুই ব্যাটা কোথাকার বাহাদুর!” অহিদার বাড়িতে যেই কাজ করতে আসে, তার নামই বাহাদুর।
সেই বাহাদুর রাগ করে কলকাতায় চলে গেছে। প্রথম দিন বাহাদুরশূন্য অবস্থায় অহিদার খুব অসুবিধে হয়েছিল। অহিদার চেয়ে অসুবিধে হয়েছিল বউদির। দুটো প্রেশার কুকার, দুটো ডবল গ্যাস-উনুন, একটা কেরোসিন স্টোভকে কাজে নামিয়েও তিনি অহিদাকে সামলাতে পারেন না। খেতে ভালবাসেন। অনবরতই খেতে চান। খাই খাই। একটু এদিক ওদিক হলেই রাগ। অতবড় একটা মানুষ রেগে গেলে কীরকম শব্দ হয়! বউদি আবার শব্দ সহ্য করতে পারেন না। অহিদা রেগে গেলেই হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা নয়, একেবারে ফরাসি ভাষায় চলে যান। স্তুপিদ, স্তুপিদ! ভুজ্যাত অ্যা মেসাঁ, মেসাঁ। নল দিয়ে জল বেরোলে বেশ জমপেশ করে একটা কিছু গুঁজে দিলে জল বন্ধ হয়। গর্ত দিয়ে শেয়াল বেরোলে মাটি চাপা দিতে হয়। ফুটো দিয়ে ইঁদুর বেরোলে ইট পুরে দিতে হয়। অহিদার মুখ দিয়ে ফরাসি বেরোলেই বেশ নরম, গরম, তুলতুলে, মুচমুচে, ভরাট কিছু খাবার গুঁজে দিতে হয়। তা না হলেই ভুজ্যাত ভুজ্যাত!
সারাদিন এইভাবে সংসার চালাতে গিয়ে রাতের দিকে বউদির শরীরে আর শক্তি থাকে না। রাতের খাওয়া শেষ করেই বউদি ধপাস করে যেই বিছানায় পড়েন, অমনি ঘুম। বউদি ঘুমোলেই অহিদার যত খুটখাট শুরু হয়ে যায়। চাপা আলো জ্বেলে, ইজিচেয়ারে বসে বিদেশি বই পড়ছেন। সাবেক আমলের পিয়ানোর ধুলো ঝেড়ে, বেঠোভেনকে স্মরণ করে, টুংটাং করছেন। যেমন কায়দার বসা, তেমনি কায়দার বাজানো! মনে মনে ভাবছেন, সোনাটা বাজাচ্ছি! ভেতর থেকে তিড়িং করে যেই একটা ইঁদুর লাফিয়ে উঠল, তাড়াতাড়ি ঢাকনাটা বন্ধ করে, বাজানোর টুল থেকে উঠে পড়লেন। দরকার নেই বাবা, মাউস!
কোনও কোনও দিন চোরের মতো এদিক-ওদিক তাকিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে, আলো জ্বেলে কী করেন? নোট জাল নয় তো? আধঘণ্টার মধ্যেই প্রেশার কুকার ফিইস করে ওঠে। চোখ বুজে, নিজের দু’ কানে আঙুল দিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভাবেন নিজের কান চাপা দিলেই স্ত্রীর কানে এই বিচ্ছিরি শব্দটা ঢুকবে না, ঘুম ভাঙবে না, ইচ্ছেমতো রান্না করে খাবার অপরাধটা ধরা পড়বে না। শব্দটা বন্ধ হলে, কুকারটা ওভেন থেকে নামিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের দরজা খুলে চুপি চুপি বেরিয়ে এসে পা টিপে টিপে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যান। ভারী পর্দাটা অল্প একটু ফাঁক করে প্রায় অন্ধকার ঘরে দেখে নেন, স্ত্রী জেগে উঠেছে কি না।
নাঃ, গভীর ঘুম। ঘুমোও, ঘুমোও! মোটা হয়ে যাচ্ছি বলে ডাক্তার কম খেতে বলেছে! তাই না! মোটা হচ্ছি আমি হচ্ছি, কার তাতে কী!
পর্দাটা ফেলে দিয়ে বাইরের দালানে দাঁড়িয়ে অহিদা, দু’ হাতের বুড়ো আঙুল দুটো পুরুষ্টু কলার মতো শূন্যে তুলে, গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে একপাক নেচে নেন। কলা দেখান ডাক্তারকে। আর আমার সাবধানী ঘুমন্ত বউদিকে।
সেদিন শনিবার। সন্ধের দিকে বৃষ্টি হয়ে বেশ একটু শীত- শীত ভাব! খেতে বসে অহিদা আর একটা ফিশ-ফ্রাই চেয়েছিলেন। বউদি ধমকে বলেছিলেন, “আর আধখানাও না। নেহাত শনিবার বলে একটা দিয়েছি তোমাকে!” ভালমানুষের মতো মুখ করে অহিদা খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়লেন। বুঝতেও দিলেন না, কী করবেন পরে, কী প্ল্যান আছে মাথায়।
তেমন গরম নেই বলে বউদির ক্লান্তিটাও কম! অন্যদিন শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। আজ মুখের কাছে একটা বই ধরে রেখেছেন। অহিদা উশখুশ করছেন, একবার চেয়ারে বসছেন, একবার ইজিচেয়ারে আধশোয়া হচ্ছেন। কখনও বাগানে বেরিয়ে, হাততালি দিয়ে পেয়ারাগাছ থেকে বাদুড় ওড়াচ্ছেন। বউদি একবার বললেন, “কী ছোট ছেলের মতো ছটফট করে বেড়াচ্ছ, শুয়ে পড়ো না।”
গম্ভীর গলায় অহিদা বললেন, “তোমার মতো আমার তাড়াতাড়ি ঘুম পায় না। রাত বাড়লে তবেই আমার মাথায় ভাল ভাল প্ল্যান আসে, ছবির আইডিয়া আসে।”
“তবে তাই আসুক। আমার বাবা শুলুম আর ঘুমোলুম।”
“ভাল!”
মুখের সামনে বিলিতি ম্যাগাজিন খুলে, অহিদা কালো ঝকঝকে একটা রকিং চেয়ারে বসে ধীরে ধীরে দোল খাচ্ছেন। আর মনে মনে ভাবছেন, ঘুমোও না বাপু, ঘুমোও। না-ঘুমোলে কিছু করতে পারছি না। রাত এগারোটা নাগাদ বউদি ঘুমিয়ে পড়লেন। অহিদা ভাল করে দেখে নিলেন। সারাদিনের সেই বিরক্ত মুখ নয়। ভাঁজটাজ মিলিয়ে মোলায়েম হয়ে গেছে। ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস পড়ছে। ডান দিকে বাঁ দিকে ঘাড় নেড়ে-নেড়ে অহিদা খুশি খুশি মুখে বললেন, “ঘুমিয়েছে ঘুমিয়েছে!”
ট্যাং ট্যাং করে বারোটা বাজল। রান্নাঘরে অহিদার প্রেশার কুকারও ফিইস করে উঠল। শব্দটা থামতেই দরজা খুলে পা টিপে টিপে অহিদা বেরিয়ে এলেন। খেতে বসার আগে দেখতে হবে তো ঘুমটা বেশ গভীর হল কি না! অহিদা গুটিগুটি এগোচ্ছেন, পেছন পেছন গুটিগুটি ঘি আর গরম মশলার গন্ধ।
ওদিকে ছাদের সিঁড়ির দিক থেকে আর একটা লোকও গুটিগুটি এগিয়ে আসছে। অহিদা প্রথমটা লক্ষ করেননি। চোখে চশমা নেই। ঝাপসা ঝাপসা অহিদাকে এগিয়ে আসতে দেখে দ্বিতীয় লোকটা থেমে পড়েছে। অহিদা নিজের কায়দায় দম বন্ধ করে এগিয়ে চলেছেন। কোনওদিকে নজর নেই, নজর ঘরের দিকে, পর্দার দিকে।
অহিদার বিশাল পালোয়ানের মতো চেহারা। তার ওপর ওইভাবে গুটিগুটি চিতাবাঘের মতো হেঁটে আসছেন, যেন এখুনি লাফিয়ে পড়বেন ঘাড়ের ওপর। লোকটা থেমে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিল পালাবে। তবে চোর হলেও সে শুনেছে, সব লোকেরই চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। সে যেই পালাতে যাবে, অমনি চিৎকার উঠবে, ‘চোর চোর’। অবশ্য দু’-একটা বাড়িতে সে এমনও দেখেছে, শুয়ে শুয়ে ড্যাবড্যাবে চোখ বের করে দেখছে, চোর সব নিয়ে পালাচ্ছে, খুব চেষ্টা করছে ‘চোর চোর’ করে চেঁচাতে কিন্তু ভয়ে গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না, একেবারে সরু পিঁপড়ের মতো গলায় ‘চো, চো’ করছে।
কিন্তু এ লোকটাকে তেমন সুবিধের মনে হচ্ছে না। ভয়টয় পেয়েছে বলেও মনে হয় না। পালাতে গেলেই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করবে! এদিকেও মরেছি ওদিকেও মরেছি। তার চেয়ে পায়ে পড়ে দেখি। মোটাসোটা সাহসী বাবুদের দয়ামায়া সময় সময় থাকে। গলাটাকে কান্না-ভাঙা করে, ‘বাভুউউ আহার কোওরবোনা’ বলে লোকটা ঝপাং করে অহিদার দু’ পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল।
এইরকম একটা ঘটনার জন্যে অহিদা একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। সারা বাড়িতে দুটি মাত্র লোক। নিজে আর নিজের স্ত্রী। হঠাৎ কোথা থেকে আর একটা লোক এসে হাজির হল! অহিদা থতমত খেয়ে গেলেন। মহা উৎপাত দেখছি। ভেউ-এ-উ করে চিল্লিয়ে ঘুমটা ভাঙাবে, খাওয়াটা পণ্ড হবে। শুধু পণ্ড হবে না, চিরকালের মতো চুরি করে রান্না করে যা খুশি তাই খাওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে। রান্নাঘরে চাবি পড়ে যাবে। অহিদা মাটিতে ‘অহল্যা উদ্ধারের’ মতো পড়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে একটা আঙুল রাখলেন। হিসহিসে গলায় বললেন, “স্যুপ! আর একটা কথা বললেই গলায় ঠ্যাং তুলে দোব!”
পায়ের কাছেই লোকটা পড়ে আছে। মনে মনে ভাবলে, হ্যাঁ, একটা পায়ের মতো পা! ওই পা গলায় ওঠা, আর গলার ওপর দিয়ে একটা লরির চাকা চলে যাওয়া একই কথা! তবু মিনমিনে গলায় বললে, “আমি চেঁচাব কেন বাবু! আমার কি চেঁচানো শোভা পায়!”
অহিদা জামার কলারের পেছন দিকটা ধরে, বেড়ালছানাকে যেভাবে তোলে, সেইভাবে মেঝে থেকে লোকটাকে তুলে, সোজা রান্নাঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। রোগাপটকা লোক, তেমন ভারী নয়। ঝুলতে ঝুলতেই লোকটা বলছে, “চেঁচাবেন তো আপনি। চোরের মার বড় গলা হলেও চোরেদের গলা খাটোই হয়। তা বাবু, আর যাই করেন, নর্দমায় ফেলবেন না!”
অহিদা লোকটাকে রান্নাঘরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, ভেতর থেকে ছিটকিনিটা তুলে দিলেন, “নে, এবার প্রাণ খুলে বকবক কর। আমি ততক্ষণ খেয়ে নিই! এরপর আর কখন খাব! রাত তো প্রায় ভোর হয়ে এল! এই তিন দিনেই তুই এত রোগা হয়ে গেলি কী করে! নে, এখন রাগ করে চলে যাবার ঠ্যালা বোঝ। সাত দিন তেড়ে খাওয়া-দাওয়া করলে তবেই আবার ‘বাহাদুর’ হবি। হি হি, এখন একেবারে চামচিকি!”
প্রেশার কুকারের ঢাকনাটা খুলেছেন অহিদা! গন্ধে জিভে জল এসে যায়! লোকটা বুঝতেই পারছে না এই মোটামতো লোকটা কী সব বলছে! ভীষণ লোভও হচ্ছে! চোর হয়ে সারাজীবন শুধু প্রহারই খেতে হল, ভাল, খাবার আর জুটল কোথায়? মাঝেমধ্যে অবশ্য বড় বড় লোকের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে হেঁসেলটা আগে হাঁটকে-পাঁটকে দেখে। ধ্যুর! বড় লোকেরা ভীষণ হিসেবি। যা বাঁচল সব ঠান্ডা বাক্সে পুরে দিল। দরজা খুললেই আলো জ্বলে উঠল, হিম-ঠান্ডা, ধোঁয়া বেরোচ্ছে! কী আছে ভেতরে? বোতল-বোতল জল, তরকারিতে দেবার বাটা মশলা, এক বোতল হলদে সিরাপ, দু’-একটা ফল, ছোট্ট এক বাক্স মিষ্টি, ছোট ছোট বরফের টুকরো, সাদা ফ্যাকফ্যাকে মুরগির ঠ্যাং একটা, এক চাকা মাছ, ঘাঁটাঘাঁটা তরকারি তলানি, গন্ধেই বমি আসে। গরিবদের হেঁসেলে তবু কিছু ভাল খাবার থাকে! মুশকিল, চুরি করতে হলে বড়লোকের বাড়িই ঢুকতে হবে! এ লোকটা তা হলে কী! গরিব না বড়লোক! মনে হচ্ছে খেয়েই ফতুর। ইশ, কার মুখ দেখে যে উঠেছিলুম আজ!
অহিদা ইতিমধ্যে কাচের প্লেটে করে ডিমের খিচুড়ি রেখেছেন লোকটার সামনে। “নে, বাদলা-বাদলা আছে, ঝপাঝপ মেরে দে। মনে আছে তো আমাদের সব আগের কায়দা! সব ধুয়েমুছে তকতকে করে রেখে দিতে হবে। সকালে তোর মাইজি যদি টের পায়, ব্যস, তা হলেই হয়ে গেল, চিরকালের মতো খাওয়ার বারোটা! কী, কীরকম হয়েছে? ফাস্ক্লাস! কী, বল! আর-একটু ঝাল হলে ভাল হত!”
বাইরে খুট করে একটু শব্দ হতেই, অহিদা ঝট করে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে, চাপা গলায় হিসহিস করে উঠলেন। সব চুপচাপ। নাঃ, কিছু না। আলোটা জ্বেলে দিলেন। “ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম রে, ভেবেছিলুম তোর মাইজি বুঝি বাথরুমে যাচ্ছে। নাঃ, ইঁদুর-টিঁদুর হবে। ও ঘুম তো সহজে ভাঙার নয়।”
লোকটা ভয়ে ভয়ে খাচ্ছে, কৌতূহল আর চাপতে পারছে না, শেষে জিজ্ঞেস করল, “বাবু, আপনিও কি চোর?”
আঙুল চুষতে চুষতে অহিদা লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন একনজরে, তারপর ডান হাতের মোটা আঙুলটা চোরটার দিকে ইঙ্গিত করে দমকা হাসি চেপে বললেন, “ধরেছিস ঠিক! ধরেছিস ঠিক। হার্টের সঙ্গে চুরি।” বলেই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। দু’ কদম এগিয়ে গেলেন লোকটার দিকে ঝুঁকে পড়ে মুখটা দেখলেন। “এ কী রে! তুই তো দেখছি নয়া লোক! তুই তো বাহাদুর নোস!” তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “ঠিক করে বল তুই কে! গুপ্তচর? স্পাই? কে তোকে এ-বাড়িতে চাকরি দিয়েছে এবং কবে থেকে? আমার বউ?”
“আজ্ঞে না! কেউ চাকরি দেয়নি! আমি গুপ্তচর নই, চোর! চুরি করতে এসেহেহেছিলুম বাবুহু।” লোকটা ধড়াস করে অহিদার পায়ে পড়ল, “আমি অপরাধী বাবু! আমাকে ক্ষমাহ করুন।” ভেউ ভেউ করে লোকটা কেঁদে ফেলল।
লোকটার কান্না শুনে অহিদা ভীষণ বিরক্ত হলেন। “পা ছাড়, পা ছাড়। পায়ে ধরে সাধু হবে ভেবেছ! জানিস, আমি যদি এখুনি ‘চোর চোর’ করে চেঁচাই, তোর কী অবস্থা হবে!”
“পিটিয়ে শেষ করে দেবে বাবু! তবে জেনে রাখুন, তা হলে আপনিও ধরা পড়ে যাবেন!”
অহিদা খুব চিন্তিত হলেন, “তা যা বলেছিস! তা হলে তোর যা নেবার নিয়ে চলে যা। আমি ততক্ষণ এ-সব ধুয়ে-মুছে রাখি। দে, তোর ডিশটা দে! যাক, চুরি তো তুই করবিই, তার আগে বলে যা, রান্নাটা কেমন হয়েছে।”
“ডিশটিশ আপনাকে ধুতে হবে না। আমি সব ধুয়ে দিচ্ছি।”
“দিচ্ছি কেন বলছিস, বল নিচ্ছি! তবে জেনে রাখ, তুই চুরির ‘চ’ও শিখিসনি। এইসময় কেউ কারওর বাড়িতে চুরি করতে যায় গবেট? বিলেতে লোকে এইসময় বেড়াতে বেরোয়। বুঝলি কিছু? চুরি করতে গেলে অত হাঁকপাক চলে না। ধৈর্য চাই। দে, ডিশটা দে, ধুয়ে দি!”
“না, আমি ধুচ্ছি!” লোকটা সিল্কের কাছে ধোয়াধুয়ি শুরু করেছে। অহিদা কৌটো-টৌটো ঠিকঠাক জায়গায় তুলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর নাম কী রে! ও! নাম তো আবার বলবি না। ঠিক নাম তো তুই নিজেই জানিস না। কাগজে দেখেছি তো, কোর্টে যখন কেস ওঠে তখন তো শুধুই, ওরফে মণ্টু ওরফে পল্টু ওরফে জন ওরফে নিয়াজ আলি ওরফে বকু সর্দার ওরফে পরেশ ওরফে ছকুলাল…”
“না বাবু না। আমার আসল নাম শুনলে হাসবেন, তাই বলব না।”
“বল না।”
“আমার নাম সাধু।”
“ভালই তো রে! খারাপ নাম কী! চোরে আর সাধুতে তফাত কী! কেউ সাধু চোর, কেউ চোর সাধু।”
ঠ্যাং ঠ্যাং করে দুটো বাজল দূরের ঘড়িতে। অহিদা বললেন, “একটু হাত চালা বাবা! এবার আমার নিজেরই ভয় ভয় করছে। আমার বউ যদি উঠে পড়ে, তখন কিন্তু রক্ষে থাকবে না। ‘চোর চোর’ করে চেঁচাবে, লোকে তোকে ধরেই পেটাবে।”
সাধু নামক চোরটি তোয়ালে দিয়ে ডিশ মুছতে মুছতে বললে, “আপনার বাবু কোনও বুদ্ধি নেই। বউদি আমাকে চোর বলে বুঝতেই পারবেন না। চোরের সঙ্গে মালিকের এইরকম সম্পর্ক হয় নাকি? মনে করবেন চাকর।”
“চাকর? রাত দশটা সাড়ে দশটা অবধি চাকর ছিল না, হঠাৎ রাত বারোটার সময় চাকর এসে গেল। এ কি কারখানা নাকি, সকালের শিফটে একরকম লোক, রাতের শিফটে আর একরকম! অত বোকা ভেবেছিস নাকি আমার বউকে?”
“বোকা আপনি। রাগ করবেন না।”
“প্রমাণ কর, তা না হলে রেগে যাব কিন্তু।”
“আপনি বলবেন, সকালে তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলুম; অমুকবাবু কি তমুকবাবু, যা হয় একটা চেনা নাম বলে দেবেন, একজন লোক দেবে বলেছিল, আসার কথা ছিল অনেক আগেই, ট্রেন লেট করায় তুমি শুয়ে পড়ার পর এল।”
“বিশ্বাস করবে?”
“আলবত করবে, যদি মিথ্যে কথা বলার অভ্যাস থাকে আর সেইভাবে বলতে পারেন, নিশ্চয়ই করবে।”
“তারপর কাল সকালে তুই যখন চলে যাবি সব মালপত্তর নিয়ে, তখন আমার অবস্থাটা কী হবে, ভেবে দেখেছিস?”
“তা বটে! তা হলে এক কাজ করুন বাবু, ‘চোর চোর’ করে চেঁচান। এখন তো সব ধোয়া-মোছা হয়ে গেছে, আপনার তো কোনও ভয় নেই বাবু, লোকে এসে আমাকেই পেটাবে। অনেকদিন জেলেও যাইনি। এদিকে ব্যাঙ্কে সব লকার হয়ে গেছে, সোনাদানা তেমন পাওয়াও যায় না, বাজার বড় মন্দা। যাই, কিছুদিন থেকে আসি।”
হঠাৎ রান্নাঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। অহিদা দরজার দিকে পেছন ফিরে ছিলেন। দেখতে পাননি, চোর সাধু দেখেছিল। সে একগাল হেসে ছুট্টে গিয়ে, অহিদার স্ত্রীর পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, “ট্রেন লেট ছিল মা, আসতে দেরি হয়ে গেল।”
বউদি ঘুম-চোখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ব্যাপার-স্যাপার দেখে অবাক। আরব্যরজনী নাকি! ফটফট করে আলো জ্বলছে সবকিছু ঝকঝকে তকতকে করে সাজানো। লোকটাই বা কে! দাদাই বা কী করছেন। সময়টাই বা কত! চোর সাধু বললে, “আপনি আমাকে সাধু বলেই ডাকবেন মা! বাবু আমাকে রান্নাঘর, কাজকর্ম সব দেখিয়ে দিয়েছেন! কাল থেকে আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। দেরিতে ঘুম থেকে উঠলেও চলবে। আমার হাতের রান্না যে একবার খেয়েছে, সে আর ভুলবে না।”
রান্না নিয়ে বড়াই করলে অহিদার সহ্য হয় না। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ, “দেখ সাধু বাড়ছিস বাড়, তা বলে সীমা ছাড়িয়ে যাসনি। রান্নায় তুই আমাকে হারাতে পারবি! কেন মিথ্যে বলছিস! হয়ে যাক “চ্যালেঞ্জ।”
“চ্যালেঞ্জ!”
বউদি থামিয়ে দিলেন, “আহা হা, চুপ করো। এ লোকটা কে!”
“আজ্ঞে আমি সাধু। নতুন কাজের লোক। বাবু বলেননি। আজ আমার জয়েন করার কথা।”
অহিদা গম্ভীর গলায় বললেন, “ও হ্যাঁ, তোমাকে বলা হয়নি, এ সাধু। থাকবে। কাজ করবে। কাজের লোক। তা দেখিয়ে টেখিয়ে দিলুম। ভোর থেকেই লেগে যেতে পারবে!”
বউদি হাই তুলে বললেন, “বাব্বা বাঁচা গেছে, ভগবান মেলে তো লোক মেলে না। ক’টা বাজল? তোমরা শোবে না? সারারাত প্যাঁচার মতো জেগে থাকবে নাকি?”
বউদি চলে গেলেন। অহিদা চাপা গলায় বললেন, “তুই শুধু চোর না, মিথ্যেবাদী। জানিস, চোরের চেয়ে মিথ্যেবাদী আরও খারাপ! কাল সকালে আমার কী অবস্থা হবে?”
“কী আবার হবে। সকলেই জানে, চাকররাই শেষে সব ফাঁক করে পালায়।”
“তা বলে যেদিন এল সেইদিনই পালাল?”
“বলুন, যে-রাতে এল সেই রাতেই পালাল। রাতেরাতেই কাজ শেষ!”
“যাঃ কী যে করলি না। একেই বলে যে, আমি কোনও কম্মের নই। এরপর কী বলবে তুই ভাবতে পারিস? তুই লুকিয়ে থাকতে পারতিস। তুই যখন অভিনয়ই করলি, অন্যভাবে করতে পারতিস। ওই ছুরিটা তুলে নিয়ে আমার পেটের কাছে ধরে বলতে পারতিস, ‘একটুও নড়েছ কি মরেছ, আমি চোর।’ তা হলে আমার বউ বুঝতে পারত, আমি তোকে বীরের মতো ধরতে এসে বিপদে পড়েছি।”
“বাঃ, আপনাকে চুরির দায় থেকে বাঁচালুম, দোষ হল আমার।”
“তুই তো, আমি যেভাবে বললুম সেভাবেও বাঁচাতে পারতিস।”
“তা হলে তো আমি নিজেই চোর হয়ে যেতুম।”
“তুই তো চোরই, নামটাই যা সাধু। শোন, তুই চুরি কর ক্ষতি নেই, তবে সাত-আট দিন পরে কর। দিন সাতেক থেকে যা, তোর কোনও কষ্ট হবে না।”
সাধু কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললে, “তবে তাই হোক। আমার ঘুম পাচ্ছে। কোনটা শোবার ঘর?”
অহিদা বাহাদুরের ঘরটা সাধুকে খুলে দিলেন। নিজেই আলো জ্বাললেন। “ওই দেখ চৌকি, বিছানাটা খুলে নে। ওই দেখ নাইলনের মশারি, পেড়ে নে। জানালাগুলো খুলে নে, বেশ হাওয়া আসবে।” সাধু সব দেখে-টেখে বললে, “জীবনে এরকম ঘরে ঘুমিয়েছি? এ তো লাটসাহেবের ঘর। যান, শুয়ে পড়ুন।”
অহিদা চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “পালাবি না তো? দেখিস বাবা, অনুরোধ রাখিস। সাতটা দিন শুধু অপেক্ষা কর। তোর চুরির জন্যে এর মধ্যে আমি ভাল ভাল জিনিস এনে রাখব।”
“লোভ দেখাবেননি বাবু। দুগগা, দুগগা। শুয়ে পড়ুন।”
সাধু শুয়ে পড়ল। অহিদা নিজের ঘরে ঢুকতেই অহিদার স্ত্রী ঘুম-জড়ানো গলায় বললেন, “তুলে নিলুম।”
“সে আবার কী?”
“অপদার্থ বলেছিলুম, তুলে নিলুম। একটা কাজের মতো কাজ করেছ। লোকটা যেমন ভদ্র, তেমনি চটপটে। কাল সকালে চায়ের জন্যে খোঁচাখুঁচি করে ঘুম ভাঙাবে না।”
অহিদা শুয়ে পড়লেন। কানটা সজাগ। ভয়! খুটখাট শব্দ হলেই লাফিয়ে গিয়ে ধরব। এবার তুমি চোর! হাই উঠল। ঘুমোলে চলবে না। পাশের ঘরেই চোর। আবার হাই। মনে মনে বললেন, “পালাসনি সাধু!”
রাত অনেক। নিস্তব্ধ বাড়ি। অহিদার নাক ডাকছে।
১৩৮৫
অলংকরণ: অলোক ধর
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন