পৌলোমী সেনগুপ্ত
হাসির শব্দটা প্রথম এল ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে।
প্রীতম দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্যরাও দাঁড়িয়ে আছে ওর মত। মাথা নিচু করে, চোখ নামিয়ে। আজ তিরিশে জানুয়ারি। মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুদিন। শহিদ দিবস। এই দিনে গান্ধীজি আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়ে শহিদ হয়েছিলেন।
এই দিনটাতে এ-এক ভারী যন্ত্রণা। নীরবতা পালনের জন্যে উঠে দাঁড়াবার পর থেকেই হাসি পেতে শুরু করে। অথচ মাত্র দু’ মিনিটের ব্যাপার! হাসি তো পায়ই, সেই সঙ্গে মনে হয়, দু’ মিনিট যেন কত সময়, কিছুতেই ফুরোচ্ছে না!
ফার্স্ট পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগেই গান্ধীজি ও ভারতের অন্যান্য শহিদ-সন্তানদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার কাজটা সেরে নেওয়া হয়। আজকে প্রীতমদের ক্লাসের প্রথম পিরিয়ড নেবেন উদয়ন-সার। উনি রিস্টওয়াচে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। দু’ মিনিট হয়ে গেলেই সবাইকে বসে পড়তে বলবেন। উদয়বাবু লাইফ সায়েন্স-এর মাস্টারমশাই। বয়স কম। বেশ হাসিখুশি। ক্লাসে মজার-মজার কথা বলেন। তবে রেগে গেলে রক্ষে নেই। যাকে বলে উত্তম-মধ্যম ধোলাই, তেমনভাবে মারতে শুরু করেন। নন স্টপ। যতক্ষণ না রাগ পড়ে। একেবারে স্মরণীয় মার। অবশ্য উদয়ন-সার কাউকে মেরেছেন—এমন ঘটনা বছরে একটা কি দুটো ঘটে।
প্রীতম চোখ তুলে দেখার চেষ্টা করল, কে হাসছে! উদয়ন স্যারের কানে কি হাসির আওয়াজ যায়নি? নিশ্চয়ই গেছে। কিন্তু উনি নির্বিকার। ঘড়ি থেকে চোখ সরাচ্ছেন না। প্রীতম দেখল এরই মধ্যে হাসির শব্দ সারা ক্লাসরুমে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই ফিক ফিক করে হাসছে। ক্লাস টেনের ছেলেরা শহিদ স্মরণে নীরবতা পালনের জন্যে দাঁড়িয়ে হেসেছে—একথা যে-কেউ শুনলেই রাগ করবেন। হয়তো তিনি বলবেন, তোমরা ছাত্র নামের অযোগ্য। নীচের ক্লাসে পড়ার সময় খুব হাসি পেত। কেন পেত—প্রীতম বলতে পারবে না। তখন বয়স কম ছিল, মাথার মধ্যে সব সময় দুষ্টুমি ঘুরপাক খেত। কিন্তু এখন! ক্লাস টেনের ছেলে মানে স্কুলের সবচাইতে বড়রা। অন্য ছাত্রদের দাদা। আগামী বছর যারা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে স্কুল থেকে বিদায় নেবে। চিরদিনের মতো। তাদের পক্ষে এইভাবে হাসাটা খুব অন্যায়। প্রীতম জানে। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। কেউ-না-কেউ হাসবেই। আর তারপর সেই হাসি সংক্রামক অসুখের মতো সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
প্রীতম বহু কষ্টে হাসি চাপতে গিয়েও পারল না। ফিক করে হেসে ফেলল।
দু’ মিনিট হয়ে গেছে। উদয়ন-সার বাঁ হাতটা নামিয়ে মুখ তুলতেই সারা ক্লাসের হৃৎপিণ্ড ধক্ করে উঠল। সারের মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
“কে হাসছিলে? বলো, কে হাসছিলে?”
উদয়ন-সার রাগে কাঁপতে-কাঁপতে ফার্স্ট বেঞ্চের সামনে এগিয়ে এলেন।
প্রায় সবাই হেসেছে। একজন নয়। কে হেসেছে বলতে গেলে সবার নাম উঠে আসবে।
“কী হল? বলছ না কেন? বলো!”
উদয়ন-সার বেঞ্চের উপরে জোরে ঘুসি মেরে চিৎকার করে উঠলেন। ফার্স্ট বেঞ্চে বসে আছে চারজন—অশোক, তপোধীর, সন্ময় আর শুভাশিস। থার্ড বেঞ্চের ডান দিকের কোণ থেকে প্রীতম দেখল ওরা মাথা নিচু করে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
“তুমি হাসছিলে! তুমি! বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো। বদমাশ ছেলে, মেরে তোমার পিঠের ছাল-চামড়া তুলে নেব।” উদয়ন-সার হঠাৎ অশোকের কান ধরে টেনে আনলেন বেঞ্চের বাইরে।
ফার্স্ট বেঞ্চের প্রথমেই বসে আছে প্রীতমের বন্ধু অশোক। অন্য স্কুলের মতো প্রীতমদের স্কুলে গুড বয়রাই কেবল ফার্স্ট বেঞ্চে বসে না। অন্যরাও বসে। এই যেমন অশোক। ও পড়াশোনায় দারুণ—এমন নয়। তবে খারাপ রেজাল্ট করে না। আর অশোকের খ্যাতি, ও ভাল আবৃত্তি করতে পারে। বড়-বড় কবিতা ওর কণ্ঠস্থ। অশোক হেসেছে কিনা প্রীতমের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। হাসতেও পারে। তবে ওদের মধ্যে সন্ময় যে হেসেছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। লেখাপড়ায় ভাল বলে সন্ময়ের যেমন ডাঁট, তেমনই সব সময় দেখাতে চায় দুষ্টুমিতেও ও সবার থেকে এগিয়ে। টিফিন পিরিয়ডে মাঝে-মাঝেই এর-তার পেছনে লেগে মারামারি বাধায়। ও হাসেনি—এ হতে পারে না। অশোককে যেভাবে উদয়ন-সার টেনে আনলেন, তাতে প্রীতমের সারাটা শরীর অজানা আশঙ্কায় কেঁপে গেল।
“আমি হাসিনি সার, অশোক খুব করুণ সুরে বলল।
“তা হলে কে হেসেছে? নাম বলো! আমি স্পষ্ট হাসির শব্দ পেয়েছি। তোমাদের বেঞ্চ থেকেই ফিক ফিক আওয়াজটা এসেছে। বলো?” অশোকের কানে জোর মোচড় লাগিয়ে উদয়ন-সার জিজ্ঞেস করলেন।
“জানি না। আমি তো চোখ বুজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি দেখিনি সারা বিশ্বাস করুন।”
“চোখ বুজে দাঁড়িয়েছিলে! মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাওনি। তুমিই হেসেছ…।”
“না, সার। সত্যি বলছি!”
“ফের মিথ্যে কথা!”উদয়ন-সার অশোকের কান ছেড়ে দিয়ে আচমকা টেনে এক চড় মারলেন। প্রচণ্ড জোরে। টাল সামলাতে না পেরে অশোক বোঁ করে ঘুরে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
ক্লাসের চল্লিশজন ছেলের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। প্রীতমের ভীষণ খারাপ লাগছে। সকলের দোষ একা অশোকের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে। কোনও মানে হয়! প্রীতমের হঠাৎ মনে পড়ল, উদয়ন-সার এমনিতে ভাল। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ানক।
“সার, আপনি আমাকে শুধুমুধু মারলেন।” গালে হাত বুলাতে বুলোতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অশোক বলল।
“কী বললে? কী বললে? আমি তোমাকে শুধুমুধু মারছি! তোমার এতবড় সাহস। এতদূর আস্পর্ধা! দাঁড়াও দেখাচ্ছি। তোমাকেই আজ শহিদ করে ছাড়ব।” কথা বলতে বলতেই উদয়ন-সার ঝাঁপিয়ে পড়লেন অশোকের ওপরে।
পাশের টেন-সি-তে ক্লাস নিচ্ছিলেন প্রিয়তোষবাবু। উনি এসে উঁকি না মারলে হয়তো উদয়ন-সার অশোককে আরও মারতেন। কিছুতেই থামতেন না। অশোকের আর্তনাদ আর সারের গর্জন শুনে প্রিয়তোষবাবু দৌড়ে এসেছিলেন।
‘যাও, স্টুপিড কোথাকার! তুমি আমাকে চেনো না।” বেঞ্চের কোনায় অশোককে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে উদয়ন-সার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
প্রীতমের দু’ চোখ জলে ভরে এল। অশোক সত্যিই হাসেনি। ও যেভাবে দৃঢ় গলায় বলছিল, তাতে প্রীতম নিশ্চিত অশোক নির্দোষ। এত মার খেয়েও ও কারও নাম বলল না। আমি হলে মারের চোটে বলে দিতাম হয়তো— প্রীতম ভাবল। মাঝখান থেকে পার পেয়ে গেল সন্ময়টা। সন্ময়ের উচিত ছিল দোষ স্বীকার করা। সারকে বলা, সার, আমি হেসেছি। অবশ্য শুধু সন্ময় কেন, ক্লাসের সবাই অশোকের হয়ে প্রতিবাদ করতে পারত। বলতে পারত, আমরা প্রায় সকলেই হেসেছি সার, অশোক একা নয়। আমাদেরও মারুন। প্রীতমের ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল। হাসির অসুখটা ওকেও তো আক্রমণ করেছিল। শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল প্রীতমেরও। কী যে হয়ে গেল আজ!
উদয়ন-সার বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকলেন। একই সঙ্গে নীরব হয়ে থাকল পুরো ক্লাসটা। ভীষণ নিস্তব্ধ। অশোক হাইবেঞ্চে মুখ গুঁজে সেই যে বসেছিল এখনও সোজা হয়নি। প্রীতম দেখল অশোকের দেহটা আঘাতের যন্ত্রণায় মাঝে-মাঝে কাঁপছে। অশোক নিঃশব্দে কাঁদছে কি? খুব ইচ্ছে করছে অশোকের পাশে গিয়ে বসতে।
কিছুক্ষণ পড়ানোর পরই ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা বেজে গেল। উদয়ন-সার গম্ভীর মুখে উঠে চলে গেলেন। অন্যদিন হলে দেখা যেত বেল বাজার পরেও উনি পড়াচ্ছেন। কিংবা কোনও মজার গল্পের শেষটুকু বলছেন। আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে সারা ক্লাস জুড়ে। আর আজ! যেন কেউ মারা গেছে!
সারা মুখে আর দেহে মারের দাগ নিয়ে চুপ করে বসে ছিল অশোক। কারও সঙ্গে কথা বলেনি। ওর কপালের ডান দিকে বেশ খানিকটা জায়গা নীল হয়ে ফুলে উঠেছিল। এখন অনেকটা কমে গেছে। প্রীতম রুমাল ভিজিয়ে এনে বন্ধুর হাতে দিয়ে বলেছে, ওখানটায় একটু চেপে ধর। কালশিটে পড়ে গেছে। অশোক কেবল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জলে-ভেজা রুমালটা ফোলা জায়গায় কিছুক্ষণ ধরে রেখেছে।
স্কুল ছুটি হয়েছে একটু আগে। ক্লাস টেনের অন্যান্য সেকশনের সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছে উদয়ন-সারের হাতে অশোক মার খেয়েছে। অভিমান আর লজ্জায় অশোক একেবারে কুঁকড়ে আছে। স্কুলের পাঁচিলঘেরা চৌহদ্দি ছেড়ে রাস্তায় নেমেই প্রীতম বলল, “তুই আমাকে ক্ষমা কর।”
অশোক অবাক। প্রীতমের হাত ধরে ও বলল, “কেন? এমন কথা বলছিস কেন? তুই কী করেছিস যে…”
“আমিও হেসেছিলাম। তুই ফালতু মার খেলি। সার আমাকে কেন মারলেন না!” প্রীতমের গলা বুজে এল।
“দূর! তুই মিছিমিছি মনখারাপ করছিস।…তবে কী জানিস, আমি সত্যিই হাসিনি। পাছে হাসি পায়, তাই তখন আমি দিদির কথা ভাবছিলাম।”
প্রীতম চমকে গেল। গত বছর অশোকের দিদি একটা অদ্ভুত রোগে হঠাৎ মারা গেছে। দিদি ওকে খুব ভালবাসত। ওদের বাড়িতে গিয়েও প্রীতম দেখেছে, অশোকের সব-কিছু ছিল যেন ওর দিদিকে ঘিরে। দিদির কাছেই ও আবৃত্তি করার কলাকৌশল শিখেছে। কোনওদিন যাকে ভুলতে পারবে না, সেই দিদিকেই অশোক আজ ভাবছিল নিজেকে শক্ত রাখার জন্যে। প্রীতম থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই আমাদের নাম বলে দিলি না! আমরাই তো আসলে দোষী! …দেখবি তোর দিদি আমাদের স্বর্গ থেকে অভিশাপ দেবে।”
ম্লান হেসে অশোক বলল, “আমার দিদি মোটেই তেমন মেয়ে নয়। …তুই কী বলছিস! তোদের নাম বলে দেব! তোরা সকলে মার খেতিস, তার জায়গায় আমি একা খেলাম। এই তো। কালকেই দেখবি ভুলে যাব। এ-সব নিয়ে আর ভাবিস না।”
“তুই কিন্তু দারুণ কষ্ট পেয়েছি। আমি বুঝতে পারছি।”
“তা একটু পেয়েছি। তবে আমি ভাবছি অন্য কথা।”
“কী ভাবছিস?” প্রীতম বিস্মিত হল।
“এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে উদয়ন-সার আমাকে নেবেন না। তুই দেখে নিস। গতবার দিদির মৃত্যুর জন্যে যোগ দিতে পারিনি। আর এবারে পারব না একটা মিথ্যে অপবাদে। মিথ্যে দোযে।…খুব বাজে লাগছে।”
প্রীতম মাথা নিচু করল। ওদের জন্য অশোক এতবড় শাস্তি পাবে। ওদের স্কুলের অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান বর্ষবরণ উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে হয়। বিবেকানন্দ-জয়ন্তী, রবীন্দ্র-জন্মোৎসব নেতাজি-স্মরণ—এসব তো আছেই। তার পাশে এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। সব দিক থেকে দারুণ। স্কুলের বহু ছেলে অংশ নিতে পারে। অভিনয়, গান, নাচ আর পাঠে। উদয়ন-সারের এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে খুব উৎসাহ। গত দু’ বছর উনিই স্ক্রিপ্ট লিখছেন। হেডমাস্টারমশাই ওঁর আর নাচ-গানের স্যার সিতিকণ্ঠবাবুর উপর সব ভার ছেড়ে দিয়েছেন। আগামী মাস থেকেই রিহার্সাল শুরু হবে। অসম্ভব ভাল আবৃত্তি করে বলে এই অনুষ্ঠানে অশোক অপরিহার্য। কিন্তু আজ যা ঘটল, তাতে করে ওর সঙ্গে উদয়ন-সারের সম্পর্ক বেশ খারাপ হয়ে গেল। দিলখোলা মানুষ একবার খেপে গেলে কিছুতেই রাগ পড়ে না। সারের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হবে। অশোককে আর উনি কিছুতেই ভাল চোখে দেখতে পারবেন না। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের নামের তালিকা থেকে হয়তো অশোকের নাম কেটে দেবেন। বলা যায় না, হেডস্যারকে ওর নামে নালিশ জানাতেও পারেন। অনেক কিছুই হতে পারে। এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে না পারলে অশোকের অবস্থাটা কী হবে—প্রীতম কল্পনাও করতে পারছে না।
সান্ত্বনার সুরে প্রীতম বলল, “না, না। এ-সব ভাববি না। তোকে ছাড়া পুরো আবৃত্তির ব্যাপারটাই পঙ্গু হয়ে যাবে। তোকে নিতেই হবে।”
“নিতেই হবে বলিস না। সেটা স্যারের ইচ্ছে। স্কুলের অনেকেই আবৃত্তি করতে পারে। বেশ ভাল পারে।” অশোক হেসে বলল।
“তবে তোর মতো নয়।”
“দেখ, একজনকে ভালভাবে তৈরি করে নিতে কতক্ষণ লাগবে? অতএব, আমাকে ছাড়াও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আবৃত্তি হবে। কেন, গতবার চন্দন ভৌমিক ভাল করেনি। ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটা কী সুন্দর গলায় তুলেছিল। ওটা যে আসলে একটা গান— মনেই হয়নি।”
আশা ছাড়ল না প্রীতম। মাথা ঝাঁকিয়ে রাগতস্বরে বলল, “তুই থাকবিই। দেখে নিস। ইয়ার্কি নাকি! বাদ দিয়ে দেব বললেই বাদ দেওয়া যায়। মামদোবাজি!”
“কে মামদোবাজি করছেন শুনি!” অশোক হোহো করে হেসে বলল।
রাগের চোটে বলে ফেলেছে। সংবিৎ ফিরে পেয়ে প্রীতম লজ্জা পেল। মুখ ফিরিয়ে বন্ধুকে বলল, “তোর হয়ে আমি উদয়ন-সারের কাছে ক্ষমা চাইব। তোকে দোষী ভাবুন ক্ষতি নেই। কিন্তু বর্ষবরণ থেকে যেন কিছুতেই বাদ না দেন।”
অশোকের কথাই ঠিক।
লিস্ট থেকে অশোকের নাম বাদ গেছে। নোটিস বোর্ডের সামনে দাড়িয়ে অশোক বলল, “দেখলি তো, কী বলেছিলাম!”
প্রীতম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘উদয়ন-সাব খুব অন্যায় করলেন। এখন কী হবে?”
“কী আর হবে! দর্শকের আসন থেকে অনুষ্ঠানটা দেখব। তুই তো কোনও-কিছুতেই যোগ দিস না। এবার তোর পাশে বসে থাকব।” অশোক হেসে বলল।
“না, এ হতে পারে না। আমি উদয়ন-সারের কাছে আজই যাব। ছুটির পরে তুই বাড়ি চলে যাবি। আমার জন্য দাঁড়াবি না। সারের সঙ্গে কথা বলব, তারপর বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবব।”
“মাথা খারাপ। আমার হয়ে বলতে গিয়ে তুই শেষকালে কেন ঝাড় খাবি?”
“ঝাড় খাই খাব। তোকে সেটা দেখতে হবে না। আমার উপর ছেড়ে দে।” নোটিস বোর্ডের সামনে থেকে অশোকের হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে প্রীতম বলল।
“দেখ কী করতে পারিস! তবে ব্যাপারটা নিয়ে যেন বেশি জলঘোলা না হয়।” অশোক বন্ধুকে শান্ত গলায় বলল।
উদয়ন-সার প্রীতমকে সোজা হাঁকিয়ে দিলেন। পরিষ্কার বলে দিলেন, “শহিদ দিবসে যে-ছাত্র চোখের জল ফেলার বদলে হাসতে পারে, তার কোনও গুণেরই কোনও দাম নেই। বরং সে হাসতে হাসতে লোকের বুকে ছুরি মারতেও পারে। ওর আরও শাস্তি পাওয়া দরকার।”
নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে প্রীতম ব্যর্থ। সারের রাগ কিছুতেই কমছে না। অশোকের হয়ে একটু বেশিই বলেছে প্রীতম। তবু উনি অনড়। শেষে বেশ বিরক্ত হয়ে বলেছেন, “ওকে বাদ দেওয়াতে তোমার এত কষ্ট লাগছে কেন? ও-সব বন্ধুপ্রীতি বাড়িতে গিয়ে দেখাবে। স্কুলে নয়। আমি এমনিতে খুব ভাল। তোমাদের আপন ভাইয়ের মতো দেখি। কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে শয়তানি করলে, আমাকে অপমান করলে, তাকে ছেড়ে দেব কি? তুমিই বলো! ভাল আবৃত্তি করতে পারে বলে, অশোক কি আমার মাথা কিনে নিয়েছে! যাও, ওর হয়ে আমাকে আর বলতে এসো না।”
বন্ধুর কাছ থেকে সব শুনে, অশোক মনের দুঃখটাকে আরও লুকিয়ে ফেলল। মারের চেয়ে এটা আরও অনেক বড় শাস্তি অশোকের কাছে। প্রীতম অনুভব করতে পারছে। কিন্তু এই শাস্তির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার কোনও উপায়ও নেই। একমাত্র হেডসার ভরসা। ওঁকে গিয়ে বললে যদি কিছু হয়। এখানেও সমস্যা! কে বলবে? আর কী-ই বা বলবে। যাই বলা হোক না কেন, নীরবতা-পালনের সময়ে হাসির ব্যাপারটা বলতেই হবে। তখনই দেখা দেবে চরম বিপত্তি। হেডসার পুরনো আমলের মানুষ। তিনি এইরকম বেয়াদপি কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না। অশোক দোষ করেছে কি করেনি—এই প্রশ্নের চেয়ে তখন বড় হয়ে উঠবে হাসির ব্যাপারটা। উনি হয়তো ক্লাস টেন-বি-কে ভর্ৎসনা করবেন। নীচের ক্লাসের ছেলেদের সামনে যা-তা বলে অপমান করে দেবেন। কিংবা গার্জেনদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে গুণধর ছাত্রদের অপকীর্তির কথা জানাবেন। তার মানে, লজ্জার আর শেষ থাকবে না।
প্রতিদিন শেষ পিরিয়ডের সময় থেকে স্কুলের হল ঘরে রিহার্সাল হচ্ছে। অন্যবারের মতো এবারও কোরাস গানের সুর, আবৃত্তির উদাত্ত কণ্ঠস্বর, নূপুরের শব্দ দোতলায় ভেসে আসছে। প্রীতমদের ক্লাস থেকে দু’জন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। গৌতম আর কৌশিক। দু’জনই গানের দলে থাকবে। ওরা এখন আর লাস্ট পিরিয়ডটা করে না। এই সময়ে যে-সার থাকেন, তাঁকে বলে হাসতে হাসতে ওরা মহড়ায় চলে যায়। ওদেরকে দেখে প্রীতমের দারুণ হিংসে হয়। যার যাওয়া উচিত ছিল সবার আগে সেই ফাঁকিতে পড়ে গেল। অশোক কিন্তু এমনভাবে ঘুরছে, যেন কিছুই হয়নি। রাগ নেই, মন খারাপ করা নেই, দুঃখ-দুঃখভাব নেই। স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখের কোণে মৃদু হাসি। প্রীতম এবার রেগে গিয়ে বলল, “তুই হাসছিস! এদিকে হলঘরের পাশ দিয়ে তো আর হাঁটা যাচ্ছে না! যে-সব ছেলে আবৃত্তি করছে, শুনেছিস! হাসি পাবে…হাসি!”
“তাই তো হাসছি।” অশোক বলল।
“তোর সব-কিছুতেই ঠাট্টা।”
‘বা রে, হাসতেও দিবি না। মিথ্যে হাসির জন্যে শাস্তি পেলাম বলে কি সত্যিকারের হাসি হাসব না?”
“না!” প্রীতম গলা চড়িয়ে বলল, “এবারের বর্ষবরণ ঝুলে যাবে। একদম মাটি হয়ে যাবে। তুই দেখে নিস! পুরো অনুষ্ঠানটা মাটি হয়ে যাবে। উদয়ন-সার খুব বাড়াবাড়ি করলেন। অনুষ্ঠানের দিন যদি দেখি একটুও খারাপ হচ্ছে, তা হলে ঢিল মারব, হইচই বাধিয়ে দেব।”
অশোক ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, “ও-সব করিস না। টেস্টে আটকে দিলে, বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। দেখবি উদয়ন-সার নিজের ভুল বুঝতে পারবেন।”
“কবে! কবে বুঝতে পারবেন?” প্রীতম ক্রুদ্ধ গলায় বলল।
“একদিন না একদিন। সার তো আমাদের সকলের প্রিয়। দেখেছিস, ক্লাসে এসে তোদর সঙ্গে আগের মতোই ব্যবহার করছেন। কেবল আমার দিকে মাঝে-মাঝে তাকাচ্ছেন গম্ভীর চোখে। আর হুটহাট পড়া ধরছেন। খারাপ ব্যবহার তো আর করছেন না! তুই কী বলিস?”
অশোকের কথার আর কোনও জবাব দিল না প্রীতম। দু’কান আঙুল দিয়ে বন্ধ করে একটু চেঁচিয়ে ও বলল, “একটু পরেই তো শুরু হবে ঋতুচক্রের পথ ধরে নববর্ষের সোনার রথ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসবে। প্রথম বৈশাখের নবপ্রভাতে এসে থামবে বঙ্গজননীর দ্বারের সম্মুখে। আজ আমরা সেই সমাগত নতুন অতিথিকে স্বাগত জানাই: ‘ওহে সুন্দর মরি মরি, তোমায় কী দিয়ে বরণ করি…’। ওঃ অসহ্য! কানে তুলো দে।”
“তোর দেখছি শুনে শুনেই সব মুখস্থ হয়ে গেছে।” অশোক হাসল।
কী একটা বলতে গিয়েও প্রীতম থেমে গেল। ইতিহাসের সার ডি. কে. এম. ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন। আর কথা নয়।
শেষ পর্যন্ত উদয়ন-সারকে ডুবিয়েছে চন্দন ভৌমিক। অনুষ্ঠানের দু’দিন আর বাকি। কোন বিয়ে বাড়িতে ঠেসে আইসক্রিম খেয়ে চন্দনের গলা বসে গেছে। উদাত্ত-অনুদাত্ত কোনও স্বরই কণ্ঠে খেলছে না। এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। উদয়ন-সার দারুণ বিপাকে পড়েছেন—গানের দলের কৌশিক খবরটা দিল। প্রীতম উল্লসিত। সার ডুবেছেন—এবার নিশ্চিত অশোকের ভেসে ওঠার পালা। পুরো ঘটনাটা জানিয়ে প্রীতম বন্ধুকে বলল, “অশোক বি রেডি। যে-কোনও মুহূর্তে তোর ডাক পড়তে পাবে।”
“কী কবে করব বল তো! একদিনও রিহার্সাল দিইনি। সে খেয়াল আছে। আর তা ছাড়া…”
“তা ছাড়া কী?” প্রীতম ব্যর্থ হয়ে জানতে চাইল।
“নিরুপায় হয়ে সার আমাকে হয়তো ডাকবেন। কিন্তু আজ তো আমি যাব না। না-যাওয়ার রাইট আমার কাছে। আছে কি না! উদয়ন-সার সত্যি-মিথ্যে যাচাই না করে শাস্তি দিতে পারেন, আর আমি যেতে অস্বীকার করতে পারি না!”
“হ্যাঁ পারিস। সে রাইট তোর কাছে। তবে এই যে প্যাঁচে পড়ে তোক ডাকতে হবে, এটাও তো কম কথা নয়। আর কাউকে নয়, কেবল তোকেই ডাকতে হবে। ভাবতে পারছিস—ব্যাপারটা কত সম্মানের।”
অনুষ্ঠানের আর একদিন বাকি। প্রীতম ভেতরে ভেতরে দারুণ উত্তেজিত। কী হয়, কী হয়। উদয়ন-সার ভেঙে পড়েছেন, কিন্তু এখনও মচকাননি। ক্লাসে বসে বসে প্রীতম এ-সব ভাবছিল। অখিলবাবু ইংরেজি গ্রামারের ক্লাস নিচ্ছেন। অনেকেই মনোযোগ দিয়ে শুনছে না। ফিসফিস করে কথা বলছে। অখিলবাবু খুব ভালমানুষ। নিজের মতো আপন মনে পড়িয়ে যাচ্ছেন।
হঠাৎ উদয়ন-সার ঝড়ের বেগে ক্লাসে ঢুকে অখিলবাবুকে বললেন, “অখিলদা, আপনার অনুমতি নিয়ে এই অশোককে একটু নিয়ে যাচ্ছি। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ওকে খুব দরকার।”
অখিলবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, “সে কী, অশোককে তুমি এখনও নাওনি! ও তো খুব ভাল রিসাইটেইশন করে। যাও, যাও, এক্ষুনি নিয়ে যাও।”
প্রীতমের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। অশোক ক্লাস ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বুড়ো আঙুল দেখাল। অশোকের ঠোঁটে হাসির আভাস। প্রীতমের চোখে টলটল করছে অশ্রু। ক্লাসের সবাই দেখল। কিন্তু কেউ এর অন্তরালের অর্থটা ধরতে পারল না।
সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। হলঘর ভর্তি। সমস্ত ছাত্র, মাস্টারমশাই আর স্কুলের অন্যান্য কর্মীরা সবাই উপস্থিত। ছাত্ররা মেঝের উপরে শতরঞ্চিতে বসে আছে। মাস্টারমশাই ও অন্যান্যরা বসেছেন পিছনের দিকে চেয়ারে।
কাল রাত্রে প্রীতমের বাড়িতে এসেছিল অশোক। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষটা মোটামুটি বলে গেছে। উদয়ন-সার এবারের বর্ষবরণের স্ক্রিপ্টে নতুন কিছু চমক দেখাতে পারেননি। সেই ঋতুবন্দনা দিয়ে শুরু। প্রথমে বর্ষা। তারপর শরৎ-হেমন্ত আর শীত। বসন্তের শেষে ঋতুর দেবতা প্রবেশ করবেন গ্রীষ্মের ‘শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে’। নতুন বছর শুরু হচ্ছে এই গান দিয়ে; “এসো এসো এসো প্রাণের উৎসবে, দক্ষিণ বায়ুর বেণুরবে।।” প্রতিটি ঋতুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নাচ-গান-আবৃত্তি আর পাঠ। এর মধ্যে যেটুকু আবৃত্তির অংশ তার পুরো ভারটা পড়েছে অশোকের কাঁধে। অশোক বলছিল, “আর-একটু সময় পেলে খুব ভাল হত। কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে কী হবে জানি না।” অশোকের প্রথম কবিতা ‘নীলনবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে’, আর শেষ আবৃত্তি ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ’ ইত্যাদি বিখ্যাত দুটো পঙ্ক্তি। প্রীতম একটু অবাক হয়ে জানতে চেয়েছে, “শেষেরটা তো দেশবন্ধুর মৃত্যুর পরে কবিগুরু শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে লিখেছিলেন। বর্ষবরণের সঙ্গে এর সম্পর্ক কোথায়?” সামান্য হেসে অশোক বলেছে, “উদয়ন-সারের মতে, বসন্তের আত্মদানের আগুন থেকেই তো গ্রীষ্মের জন্ম। বৈশাখী দিনের সূচনা। তাই বসন্তের উদ্দেশে এই দুটো লাইন দারুণ ফিট করবে। বোঝ! আমার আবৃত্তির পরেই ক্লাস সিক্সের ছেলেরা নাচবে এই গান গেয়ে, ‘বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে।/ দেখিস নে কি শুকনো-পাতা ঝরা-ফুলের খেলা রে’।”
অনুষ্ঠানে মাঝে-মধ্যে একটু-আধটু ভুল হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে নাচে। ছেলেরা নাচলে যা হয়! আর মাইকের গণ্ডগোল তো আছেই! ছোটরা ভুলের মজায় সামান্য গুঞ্জন করে আর হেসে চুপ করে যাচ্ছে। বর্ষার পালা শেষ হল। এবার শরৎ। অশোকের অসুবিধে হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। কণ্ঠের জাদুতে সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
হেমন্ত গেল। এবার শীত। সারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে এখানটায় অশোকের কবিতা তেমন জমল না। ওকে একটু বিরক্ত মনে হল। তবে কোরাসের দল দারুণ গাইল “শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে।”
বসন্তের বন্দনায় উদয়ন-সার অভিধান থেকে যত ভাল ভাল শব্দ আছে বেছে নিয়ে এসেছেন। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন, কবিতার লাইন আর ভাষা দিয়ে গড়ে তুলেছেন ঋতুরাজের প্রতিমা। সবাই টানটান হয়ে বসে আছে। গলা কাঁপিয়ে বেদনার সুরে সার ভাষ্যপাঠ থামালেন, এখন অশোকের আবৃত্তি। এবং এটাই ওর শেষ বলা।
অশোক চোখ ঘুবিয়ে দর্শকদের মধ্যে কাকে যেন খুঁজল। তারপর নিজের স্ক্রিপ্টটা পাশে রেখে অসম্ভব টেনে টেনে বলল, “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন জিনিস/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে ফিনিশ।”
নিজের কানকে প্রীতম বিশ্বাস করতে পারছে না। অশোক এ কী বলল। মাথার ওপর যেন বাজ পড়েছে—এমনভাবে উদয়ন-সারের মুখ ঝুলে গেল। অসহায়ভাবে উনি সিতিকণ্ঠবাবুর দিকে তাকালেন। নীচের ক্লাসের ছেলেরা কিছু বুঝতে পারার আগেই বড়রা হোহো করে হেসে উঠল। এতক্ষণ ধরে যে-মুগ্ধতা সবাইকে প্রায় স্তব্ধ করে রেখেছিল, তা ছিন্ন হয়ে গেল এক লহমায়।
হেডসার তড়াক করে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলেন, “স্টপ ইট, স্টপ ইট। অনুষ্ঠানের নামে এই বজ্জাতি সহ্য করব না।”
সারা হলঘর জুড়ে হইচই কাণ্ড। বাংলার মাস্টারমশাই মহীতোষবাবু তাড়াতাড়ি উঠে হেডসারকে কীসব বলে শান্ত করলেন। প্রীতমের কানে এল, হেডসার উত্তেজিত স্বরে কাকে যেন বলছেন, “উদয়ন এ-সব কী শিখিয়েছে ছেলেদের? ছিঃ! ছিঃ! স্কুলের মুখে চুনকালি পড়ে গেল।”
“সকলে চুপ করো, চুপ করো” বলতে বলতে অন্যান্য মাস্টারমশাইরা নেমে পড়েছেন। কিছুক্ষণ পরে আবার বর্ষবরণ শুরু হল।
প্রীতম দেখল, অশোক মাথা নামিয়ে স্টেজের ওপর গোবেচারার মতো বসে আছে। যেন কিছুই হয়নি। অনুষ্ঠানের আর খানিকটাই বাকি আছে। প্রীতম দমবন্ধ করে বসে রইল।
সর্বশেষ গানটি গাইলেন সিতিকণ্ঠবাবু স্বয়ং, ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও।’
এখনও গান চলছে। অশোক লাফ দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে এল। বন্ধু কোথায় বসেছে, স্টেজ থেকেই ও দেখে রেখেছিল। নীচে নেমেই অশোক ডাকল, “অ্যাই প্রীতম, চলে আয়। আমি পালাচ্ছি।”
কেউ কিছু বোঝার আগেই দু’জনে ঝড়ের বেগে হল থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। স্কুলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে একেবারে বড় রাস্তায়।
রাস্তার এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে মাইকে সিতিকণ্ঠবাবুর গান, ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক/ যাক ভেসে যাক/ যাক ভেসে যাক/ আমরা শুনেছি ওই মাভৈঃ মাভৈঃ/ কোন্ নূতনেরই ডাক।’
১৩৯৬
অলংকরণ প্রবীব সেন
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন